ঘোড়া লাফিয়ে উঠল শূন্যে। অন্য মুখোশধারীর তলোয়ারের আঘাতে অপর আততায়ীর একটি হাত কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল দেহ থেকে। প্রতিরোধ শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল ওদের। রক্ষীরা এলে বন্দী আততায়ীদের তুলে দিল ওদের হাতে।
মুখোশধারীরা এবার তাদের মুখোশ খুলে ফেললো। বললো, “আমরা দু’জন সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দো।”
তাদের একজন ছিল খলিল, অন্যজন তার সাথী। আর যারা পালাতে গিয়ে ধরা পড়লো তারাও ছিল মুসলমান। জুরাদিককে হত্যা করার জন্য তারাই তীর ছুড়েছিল।
এর মধ্যে যার হাত কাটা গিয়েছিল তাঁকে নিৰ্দয়ের মত দূরে ছুঁড়ে ফেলে দ্বিতীয়জনকে হাজির করা হলো জুরদিকের সামনে। তাকে বলা হলো, “যদি জীবিত ফিরে যেতে চাও, তবে জলদি বলো, কে তোমাদের পাঠিয়েছে? নইলে যে হাত দিয়ে তীর ছুড়েছে সে হাত কেটে ফেলা হবে।”
সে বললো, “আমাদের দু’জনকে রিমাণ্ডের এক সামরিক উপদেষ্টা পাঠিয়েছে। দু’জন মুসলমান আমীরের উপস্থিতিতে আমাদের বলা হয়েছে, অমুক দিন এতটার সময় জুরাদিক হলব থেকে যাত্রা করবে। সে অমুক সময় পাহাড়ী প্রান্তরে গিয়ে পৌঁছবে।
আমাদের দু’জনকে আশাতীত পুরস্কার দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সেখানে নির্জন প্ৰান্তরে তোমরা লুকিয়ে থাকবে এবং জুরাদিককে তীরবিদ্ধ করে পালিয়ে আসবে।”
সে আরো বললো, ‘নির্দিষ্ট সময়েই আমরা এখানে এসে পৌঁছি এবং রাস্তা থেকে একটু দূরে উঁচু এক টিলার আড়ালে লুকিয়ে পড়ি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর আপনাকে আসতে দেখলাম। আমরা সময় মতই তীর ছুড়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ ঘোড়া লাফিয়ে উঠায় আমাদের তীর লক্ষ্যভ্ৰষ্ট হয়। দুৰ্ভাগ্য আমাদের, দুটো তীরই ঘোড়ার মাথায় গিয়ে বিধে। লাফালাফির কারণে এবারও আমরা ব্যর্থ হই। এরপর আমরা বাধ্য হয়ে আত্মরক্ষার চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি।”
সে বললো, “এখানে লুকানোর অনেক জায়গা ছিল। আমরা এক জায়গায় ঘোড়া লুকিয়ে রেখে তাদের মুখ বেঁধে দিয়েছিলাম, যাতে ওরা শব্দ করতে না পারে।”
এরপর তীরন্দাজরা কোথায় লুকিয়ে ছিল সে জায়গা রক্ষীদের দেখাল। রক্ষীরা যখন চারদিক ছড়িয়ে পড়ে ওদের খুঁজছিল তখন ওরা সেখান থেকে লুকিয়ে সবই দেখতে পাচ্ছিল।
যখন কেউ একজন চিৎকার করে বললো, ‘এদিকে এসো, ধরে ফেলেছি’। তখন তীরন্দাজরা দেখলো, রক্ষীরা তিনজন মুখোশধারীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তারা এতে খুবই খুশী হলো, যাক, আপাততঃ জান তো বাঁচলো! কিন্তু তবু তারা সেখান থেকে পালানোর সাহস করলো না। কারণ, ধরা পড়ার কোন রিস্ক নিতে চাচ্ছিল না ওরা।
অনেক পরে যখন জুরদিক তার রক্ষীদের নিয়ে রওনা হলো তখন ওরা ভাবল, বিপদ কেটে গেছে, এবার যাওয়া যাক।
ওরা ওদের ঘোড়ার কাছে গেল। ঘোড়ার মুখ খুলে অশ্বপৃষ্ঠে চেপে ছুটলো হলবের দিকে। তারা বুঝতে পারেনি, জুরাদিক তাদের পলায়ন টের পাবে এবং টের পেলেও সাথে সাথে পিছু ধাওয়া করবে।
ওদের ধারনা ছিল, খুনী সন্দেহে যাদের জুরদিক বন্দী করেছে তারা অস্বীকার করলেও জুরদিক তাদের বিশ্বাস করবে না। এবং আসল ঘাতকরা ধরা পড়েনি এটা টের পাবে না। কিন্তু দুৰ্ভাগ্য তাদের, তাদের সব ধারনা ও হিসাব ভুল প্রমাণিত করে নিয়তি তাদের ধরিয়ে দিল।
জুরদিক তীরন্দাজকে সঙ্গে নিয়েই হেম্মাতের দিকে রওয়ানা হলেন আবার। অপর তীরন্দাজ ততক্ষণে কাটা বাহুর রক্তক্ষরণে ছটফট করে মারা গেছে।
রাস্তায় জুরদিক খলিল ও হুমায়রার পুরো কাহিনী শুনলো। কেমন করে ওরা উইণ্ডসারকে খুন করেছে খুলে বললো খলিল।
জুরদিক অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো, এই ব্যাপক অনুসন্ধানের ভেতর দিয়ে কিভাবে ওরা হলব থেকে নিরাপদে বেরিয়ে এলো! এক সময় বলেই ফেললো, কিন্তু হলব থেকে তোমরা বেরোলে কি করে? ওখানে তোমাদের গরু-খোঁজা করে খোঁজা হচ্ছে টের পাওনি?”
খলিল বললো, “ওখানে আমাদের এক কমাণ্ডার থাকেন। আমি তার নাম-ঠিকানা বলতে চাচ্ছি না, তিনিই আমাদের বেরিয়ে আসার পথ বের করে দিলেন।”
‘কিভাবে?” জানতে চাইলেন জুরাদিক।
‘নবজাতক এক শিশুর মত একটি পুতুলকে কাপড়ে জড়িয়ে লাশ দাফনের জন্য চার পাঁচজন লোক কবরস্থানে রওনা হলো। কমাণ্ডার হুজুর হিসাবে কাফন পরা লাশ হাতে নিলেন। আমি ও আমার এ বন্ধু মুসল্লীর পোষাকে এবং হুমায়রা পুরুষের বেশে অন্য দু’জনের সাথে হুজুরের শিষ্য হিসাবে লাশের পিছনে কবরস্থানে চলে গেল। কবরস্থান শহরের বাইরে থাকায় ফটকে কেউ আমাদের বাঁধা দেয়নি।
কবরস্থানের পাশে আগে থেকেই তিনটি ঘোড়া রাখা ছিল। হুজুরের অন্য এক শিষ্য সে ঘোড়া নিয়ে দাঁড়িয়েছিল কবরস্থান থেকে একটু দূরে।
হলবের সেনাবাহিনীর চোখের সামনে দিয়েই কবরস্থানে গিয়েছিলাম আমরা। জানাজা পড়ানো হলো। লাশ দাফন করে আমরা তিনজন অশ্বগৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে দ্রুত সে এলাকা ত্যাগ করলাম।”
কাফেলা কেল্লায় পৌঁছতে বেশ রােত হয়ে গেল। খলিল, তার বন্ধু এবং হুমায়রাকে সসম্মানে মেহমান হিসেবে কেল্লায় অভ্যর্থনা জানালেন জুরাদিক। খলিলকে বললেন, “খেল্লাত, আমাকে দুশমন নয়, বন্ধু মনে করো। আমাকে বলো, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এখন কি করছেন? তিনি কি আস সালেহের ওপর শিঘ্রই অভিযান চালাবেন?”
আমি সুলতান আইয়ুবীর পরিকল্পনা সবটা জানি এমন নয় তবে যেটুকু জানি তাও এখন আপনাকে বলতে চাই না।” খলিল তাকে বললো, “এমনকি আমি হলব থেকে কি কি তথ্য নিয়ে যাচ্ছি তাও আপনাকে জানাতে প্ৰস্তুত নই।”
জুরদিক বললেন, ‘সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে আমার ব্যক্তিগত শক্রতা ছিল। সেই শক্রতার রেশ ধরেই আমি তার বিরুদ্ধে চলে গেলাম। তার কারণ যাই থাক, আমি যে ভুল করেছিলাম তা এখন বেশ বুঝতে পারছি। আমার এই উপলব্ধি এসেছে দুশমনের তৎপরতা দেখে। আমি খৃস্টানদের উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেছি। একদিকে তারা আমার সেনাবাহিনী ও আমার দুর্গ ব্যবহার করতে চায়, অন্যদিকে হত্যা করতে চায় আমাকে।
মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর কথাই ঠিক। তিনি সব সময় বলতেন, হেলাল ও ক্রুশের মধ্যে আপোষহীন এক যুদ্ধ চলছে। এটা কোন খৃস্টান রাজা ও মুসলমান সুলতানের লড়াই নয়। অমুসলিম কখনো মুসলমানের বন্ধু হতে পারে না। যখন অমুসলিম বন্ধুত্বের হাত বাড়ায় তখন তার হাতে লুকানো থাকে কোন বিষাক্ত ছোবল।”
“আইয়ুবীও সেই একই আদর্শের অনুসারী। তিনি সব সময় বলেন, যেদিন মুসলমান অমুসলিমের বন্ধুত্ব কবুল করবে, সেদিন থেকে ইসলামের অবক্ষয় ও ধ্বংসের যাত্রা শুরু হবে।” “এখন আমি বুঝতে পারছি, জঙ্গী ও আইয়ুবী দুরদর্শী বলেই দোস্ত ও দুশমন চিনতে ভুল করেনি ওরা।”
“তবে কি আপনি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতে চান?” খলিল বললো, “আমি একজন সাধারণ সিপাই। একজন কেল্লাধিপতিকে প্রশ্ন করার মত দুঃসাহস দেখানো আমার উচিত নয়। কিন্তু মুসলমান হওয়ার কারণে আমারও হক রয়েছে, কোন মুসলমানকে বিভ্রান্ত হতে দেখলে তাকে এ কথা বলা যে, আপনি ভুল পথে যাচ্ছেন।”
“হ্যাঁ।” জুরদিক বললেন, “তোমার এ অধিকার আছে। আমি তোমাকে একটি সংবাদ দিতে চাই। এ সংবাদ তুমি চুপি চুপি কেবল সুলতান আইয়ুবীকেই বলবে। আমি কোন লিখিত চিঠি দিতে পারবো না, কোন দূতও পাঠাতে চাই না। তুমি সুলতান আইয়ুবীকে বলবে, হেম্মাত দুৰ্গকে যেন তিনি আপন দুৰ্গ মনে করেন। তিনি ছাড়া একথা কোন বিশ্বস্ত সেনাপতিকেও বলবে না। আমি এ তথ্য কঠোরভাবে গোপন রাখতে চাই।
খৃস্টানরা বন্ধুত্বের নামে আমাদের এলাকায় প্রভূত্ব বিস্তার করতে চাচ্ছে। এরই মধ্যে এ প্রভুত্বের থাবা তারা অনেক দূর বিস্তার করে ফেলেছে। তিনি যেন শীতের পরপরেই আক্রমণ চালান। এদিক থেকে আক্রমণ শুরু হওয়ার আগেই তাকে অভিযান শুরু করতে বলবে। আর তিনি যদি আগেভাগেই অভিযান শুরু করতে পারেন। তবে যেন হেম্মাতের পথ হয়েই এগিয়ে যান। আমি ইনশাআল্লাহ পুরাতন বন্ধুত্বের দাবী পূরণ করবো।”
পর দিন ভোরে জুরদিক খলিল, তার সাথী এবং হুমায়রাকে সসম্মানে বিদায় জানালেন কেল্লার ফটকে এসে।
খৃস্টান গোয়েন্দা বিভাগের কমাণ্ডার উইগুসারের খুন হওয়া নিঃসন্দেহে একটি আকস্মিক ও বড় রকমের ঘটনা। তিনি সুলতান আইয়ুবীর দুই গোয়েন্দাকে এমন অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তাকে হত্যা না করে তাদের কোন উপায় ছিল না।
ঘটনাটা আকস্মিক হলেও কাজটি ছিল বিরাট। তাকে হত্যার ফলে সুলতান আইয়ুবী বড় রকমের উপকার পেয়েছিলেন। এতে শক্রর গোয়েন্দা বিভাগ যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছিল। উল্টো দিকে সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা বিভাগ হয়েছিল আরো মজবুত এবং শক্তিশালী। তার গোয়েন্দা কমীরা শুধু গোয়েন্দাই ছিল না, সুদক্ষ যোদ্ধাও ছিল। সে জন্য ধরা পড়ার ভয় কম ছিল তাদের। মুখ বন্ধ রেখে কিভাবে তথ্য আদায় করতে হয়, সে প্রশিক্ষণ তিনি ভালমতই দিয়েছিলেন। যোদ্ধা হওয়ায় ধরা পড়লে ফাইট করে শত্রুর হাত থেকে সহজেই তারা বেরিয়ে যেতে পারতো। কাউকে হত্যা করার প্রয়োজন হলেও পিছপা হতো না।
তাদের শারীরিক গঠন হতো মজবুত। কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি, ক্ষুধা, পিপাসা ও ক্লান্তি সহ্য করার মত পর্যাপ্ত প্ৰশিক্ষণ দেয়া হতো তাদের।
এসব গুণগুলো খলিল এবং তার সাথীর মধ্যেও ছিল। তারা শুধু খৃস্টানদের বড় এক অফিসারকেই হত্যা করেনি, জুরদিকের মত বীর কেল্লাধিপতির সাথে সাহসের সঙ্গে কথা বলে তার ঘুমন্ত বিবেককে জাগিয়ে দিয়েছিল, তাকে সুলতান আইয়ুবীর সমর্থক বানিয়ে এসেছিল।
খলিল সুলতান আইয়ুবীকে হেম্মাত দুৰ্গাধিপতি জুরদিকের সংবাদ শুনালো। সুলতান এ খবর শুনে পরম প্রশান্তি অনুভব করলেন। মরুভূমিতে একটু ঠাণ্ডা বাতাস পেলে মানুষ যেমন শান্তি অনুভব করে, ঠিক তেমনি। তার সামনে তো দুশমন ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। ঘরেও শত্রু, বাইরেও শত্রু। জুরদিকের সংবাদ এ ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক ব্যতিক্রম।
কিন্তু মনে মনে শান্তি পেলেও এতে তিনি আনন্দে উচ্ছসিত হলেন না। সংবাদটা প্রতারণাও তো হতে পারে! সুতরাং তিনি তাঁর আক্রমণের প্ল্যান পরিবর্তন করলেন না। শুধু এটুকু মনে রাখলেন, হেম্মাত থেকে সাহায্যের আশা করা যায়।
হলব থেকে নিয়মিত সংবাদ পাচ্ছিলেন সুলতান। কিন্তু তাতে কোন নতুনত্ব ছিল না। কোন পরিবর্তন নেই দুশমন শিবিরে। আগের মতই সব রুটিন ওয়ার্ক। সেখানকার কমাণ্ডার ও উপদেষ্টারা নিশ্চিন্ত, শীতকালে আক্রমণের কোন সম্ভাবনা নেই।
এর মধ্যে একটি সংবাদ এল এমন, খৃস্টানরা প্রকাশ্যে সকলের সাথে বন্ধুত্বের ভান করলেও গোপনে মুসলিম আমীরদেরকে পরম্পরের বিরুদ্ধে উস্কানী দিচ্ছে। একজনের ওপর বিষিয়ে তুলছে অন্যজনের মন।
সুলতান আইয়ুবী আগেও জানতেন, আস সালেহের সমস্ত আমীররা একে অপরের শত্রু। তারা শুধু সুলতান আইয়ুবীকে মোকাবেলা করার জন্যই একত্রে সমবেত হয়েছে।
সুলতান আইয়ুবীর সাথে তাদের শত্রুতার কারণ, তিনি সকলকে আরাম ও বিলাসিত ত্যাগ করতে বলেন। নিজের আবেগ উচ্ছাস ও ইচ্ছার দাস হতে নিষেধ করেন। নফসের গোলামী বাদ দিয়ে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের গোলামী করতে বলেন। এসব কারণে তারা সুলতান আইয়ুবীর মিশন পছন্দ করে না। কারণ, এসব আমীরদের মনে ইসলামী সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ও একে স্থিতিশীল করার কোন আগ্রহ ছিল না। তারা বিলাসিতা, অলসতা ও আরাম-আয়েশের জন্য দুশমনকেও বন্ধু বানিয়ে নিয়েছিল।
সুলতান আইয়ুবী এখন যুদ্ধের জন্য প্ৰস্তৃত। সেনাবাহিনীর সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে গেছে। এখন রাতের ট্রেনিংয়ে কেউ আর অসুস্থ হয় না।
১১৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরু। সুলতান আইয়ুবী তাঁর সেনা কমাণ্ডারদের সাথে শেষ বারের মত মিলিত হলেন। কেন্দ্রীয় কমাণ্ডের সমস্ত অফিসার এবং গ্রুপ কমাণ্ডাররাও এসে সমবেত হলো সেনা ছাউনিতে।
সুলতান আইয়ুবী তাদের বললেন, এই মুহুর্ত থেকে সৈন্যদের গতিবিধি সম্পর্কে কোন কথা, তা যত কম গুরুত্বপূর্ণ এবং অপ্রয়োজনীয়ই হোক না কেন, বাইরের লোকদের কাছে বলা যাবে না। যাদের সাথে বিবি-বাচ্চা আছে, তারা বাড়ীতেও এ বিষয়ে কোন আলোচনা করবেন না।
সৈন্যদের অভিযানের সময় হয়েছে, এ কথা কোথাও প্রকাশ করা যাবে না। সবাই জানবে, সৈন্যরা প্রতিদিনের মত কুচকাওয়াজ করতে যাচ্ছে।”
এ নির্দেশের পর তিনি সমবেত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, “আমাদের আরামপ্রিয় বন্ধু ও ঈমান বিক্রেতা ভাইয়েরা ইসলামের ইতিহাসকে এমন স্থানে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে তোমাদের প্রিয় বন্ধু ও আত্মীয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আজ ফরজ হয়ে গেছে। কেউ কোন দিন কি চিন্তা করেছো, আমাদের নেতা নুরুদ্দিন জঙ্গী মরহুমের সন্তানের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করবো? কিন্তু অবস্থা আজ এমন, মা তার বুকের ধন আপনি সন্তানকে বুক থেকে ছুড়ে ফেলেছে দূরে, আর চিৎকার করে অভিশাপের পর অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে। তোমরা কি মরহুম জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর আহাজারী শুনতে পাওনি, শুনতে পাওনি তার হাহাকার ধ্বনি, “আমার মুরতাদ বেটা কেন এখনও জীবিত? হে আমার প্রাণপ্ৰিয় ইসলামের মুজাহিদ ভাইয়েরা, কোথায় তোমরা? ইসলামকে বাঁচাও, আমার গাদার সন্তানের হাত থেকে ছিনিয়ে নাও ক্ষমতার দণ্ড।”
একটু দম নিলেন তিনি। তারপর আবার বলতে লাগলেন, “হে আমার বন্ধুরা! তোমরা যে সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করতে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে তোমাদের চাচাতো ভাই থাকবে, মামাতো-খালাতো ভাই থাকবে। আমার সেনাবাহিনীর মধ্যে এমন সৈনিকও আছে, যার আপন ভাই ঈমান বিক্রেতাদের দলে শামিল। যদি তোমরা রক্তের সম্পর্ক, আত্মীয়তার সম্পর্কে মনে জায়গা দাও, তবে ইসলামের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে তোমার।
যুদ্ধে যাওয়ার আগে ভাল করে চিন্তা করে নাও, কোন সম্পর্ককে তোমরা অগ্ৰাধিকার দেবে? যদি রক্তের সম্পর্কের চাইতে ইসলামের সম্পর্কই তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবে তোমাদের শপথ নিতে হবে, প্ৰতিজ্ঞা করতে হবে, সামনে কে আছে সেদিকে তাকিয়ে দেখবো না, আমাদের দৃষ্টি থাকবে শুধু পতাকার দিকে। অন্তরে এ সত্যই শুধু অটুট থাকবে, সামনে যাকে আমার কালেমা পড়া ভাই মনে হচ্ছে, সে আমার ভাই নয়। ইসলামের দুশমনরা তাকে অন্ত্র হিসাবে বাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের সামনে। দুশমনের কোন অস্ত্ৰকেই আমরা অটুট ও অক্ষত রাখবো না। সে কখনো আমার ভাই হতে পারে না, যে আমার ধর্মের বিরুদ্ধে শক্ৰদের সাথে মিলে অন্ত্র ধরেছে।”
কথা বলতে বলতে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কণ্ঠ আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল। তিনি মাথা নত করে গোপনে চোখের অশ্রু মুছে নিলেন। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। উপস্থিত সেনা কমাণ্ডার এবং অফিসারদের মধ্যেও সঞ্চারিত হলো আবেগের জোয়ার।
সুলতান আইয়ুবী মাথা উঠিয়ে দু’হাত আকাশের দিকে তুলে বলতে থাকলেন, “হে পরোয়ারদিগার! হে রাহমানুর রাহীম! হে আমাদের প্রভু রাব্ববুল আলামীন! তুমি সাক্ষী থেকো, কেবল তোমার নামের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার জন্য, তোমার রাসূলের সম্মানে আজ আমরা নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্ৰ ধারণ করেছি। হে আল্লাহ! আমাদের প্রতিটি কদমকে তুমি কেবল হকের পথেই অটল রেখো। তুমি আমাদের অন্তরগুলো দেখতে পাচ্ছে, তুমি জানো, দুনিয়ার কোন সম্পদ, নাম বা ক্ষমতার মোহে আমরা এ অস্ত্ৰ হাতে নেইনি। আমরা আমাদের সর্বোত্তম সামর্থ এবং যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়েছি। এখন তোমার পথ নির্দেশ ও সাহায্যই আমাদের একমাত্র ভরসা। হে আল্লাহ! আমাদের এ সিদ্ধান্ত যদি ভুল হয়ে থাকে, এখনি তোমার কুন্দরতি হাত দিয়ে থামিয়ে দাও আমাদের। আর যদি এ সিদ্ধান্ত সঠিক হয়ে থাকে, তবে আমাদের সেই হিম্মত, সাহস ও শক্তি দান করো, যে সাহস ও শক্তি দিয়েছিলে বদরের পূণ্যবান মুজাহিদদের।”
হাত তুলে রেখেই চুপ করে রইলেন তিনি, যেন আল্লাহর তরফ থেকে ইঙ্গিতের প্রত্যাশা করছেন।
এক সময় হাত নামালেন এবং উচ্চ স্বরে বলে উঠলেন, “আমরা আমাদের প্রথম কেবলা বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত করবো। বায়তুল মুকাদ্দাসের পবিত্ৰ মাটি ব্যাকুল চিত্তে ডাকছে আমাদের। আমাদের চলার পথে যদি আমার বাবাও বাঁধা দিতে আসে, তাকে খুন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবো না আমি। যদি আমার সন্তান বাধা হয়ে দাঁড়ায়, নির্বিচারে তাকে খুন করতে হাত কাঁপবে না আমার।’
আস্তে আস্তে কমে এল তার আবেগ ও উত্তেজনা। তিনি আবার সেই ঠাণ্ডা মাথার সালাহউদ্দিন আইয়ুবী হয়ে গেলেন। কথা বললেন সংক্ষিপ্ত ও প্রয়োজন মাফিক।
কমান্ডারদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘দুদিন সময় দেয়া হলো ব্যক্তিগত প্রয়োজন ও প্রস্তুতি সম্পন্ননের জন্য। তৃতীয় রাতে সেনাবাহিনী মুভ করবে।’
তিনি প্ল্যান অনুসারে সৈন্যদের গ্রুপ ভাগ করলেন। প্রত্যেক গ্রুপের জন্য নিয়োগ করলেন কমাণ্ডার। কমাণ্ডারদের জানিয়ে দিলেন অভিযানের সময় নির্দেশিকা। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন তাদের।
নিয়মিত সৈন্যদের থেকে আলাদা করলেন কমাণ্ডো বাহিনীকে। তাদের জানিয়ে দিলেন মূল সেনা বাহিনী কখন কোন পথ অতিক্রম করবে। এ সময় কমাণ্ডোদের কাজ কি হবে তাও বলে দিলেন তাদের।
এরপর বিশেষ গোয়েন্দা কর্মীদের নিয়ে বসলেন তিনি। বুঝিয়ে দিলেন তাদের কাজ। কখন কোথায় কিভাবে তারা রিপোর্ট করবে বললেন তাদের। কোন বাহিনী কোথাও কোন বিপদ বা সমস্যায় পড়লে কিভাবে সুলতানের সাথে যোগাযোগ করবে সকলকে জানিয়ে দিলেন।
প্ৰথমেই তিনি মিশরের রাস্তা বরাবর সদা সতর্ক ও গতিশীল কমাণ্ডো বাহিনীকে মার্চ করতে বললেন। এর আগে মুসাফির ও যাযাবরের ছদ্মবেশে গোয়েন্দা বিভাগের সৈন্যদের পাঠিয়ে দিলেন ঐ এলাকায়। রিমাণ্ডের আগমন পথে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বললেন তাদের।
বললেন, “মিশরের আশপাশের নিরাপত্তা এবং রিমাণ্ডের সৈন্য আগমনের পথ রুদ্ধ করা তোমাদের দায়িত্ব। রিমাণ্ডের সৈন্যরা এদিকে পা বাড়ালে তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালাবে রাতের অন্ধকারে হামলা চালিয়ে সন্ত্রস্ত করে রাখবে ওদের। প্রয়োজন মনে করলে জলদি সংবাদ পাঠাবে, যাতে খৃষ্টানদের অগ্রযাত্রা স্তব্ধ করে দেয়া যায়।’ খাদ্য ও রসদের ব্যাপারে সুলতানের কোন পেরেশানী ছিল না। কমপক্ষে এক বছর মিশর থেকে রসদপত্র আনার প্রয়োজন হবে না। অন্ত্রশস্ত্র এবং উট ঘোড়ার মজুদ যা গড়ে তুলেছেন, তাও মন্দ নয়।
তিনি বিভিন্ন বাহিনীকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে নিমগ্ন হয়ে পড়লেন অতল ভাবনায়। আবারো খতিয়ে দেখতে লাগলেন। পরিকল্পনা ঠিক আছে কি না।
❀ ❀ ❀
১১৭৪ খৃস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ। রাতের প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে প্রথম দলটি দামেশক ত্যাগ করলো। তীব্ৰ শীতের সাথে হাত মিলিয়েছে তুষার ঝড়। কনকনে হীমশীতল ঠাণ্ডা বাতাস শরীরে কামড় বসাচ্ছে। সৈনিক ও ঘোড়াগুলো এই তুষারপাতের মধ্যেও চলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এতদিনের কঠিন প্ৰশিক্ষণের মাহাত্ম এই প্রথম টের পেলো সৈন্যরা।
দলের কমান্ডারকে সুলতান বলে দিয়েছেন, ‘তোমাদের অগ্রযাত্রা নিরাপদ ও নিষ্কণ্টক করার জন্য কমাণ্ডো দল পাঠানো হয়েছে আগে। তারা সামরিক পোষাকে নয়, মুসাফিরের বেশে আছে। তাদের সাথে আছে দ্রুতগামী কাসেদ। সে তোমার সাথে যোগাযোগ রাখবে। সামনের পরিবেশ পরিস্থিতির সংবাদ জানাবে তোমাকে। বাহিনী নিয়ে তুমি সোজা হেম্মাত দুৰ্গে চলে যাবে। সেখানে দুর্গের অধিপতি তোমাদের অভ্যর্থনা জানাবেন।”
সুলতান আইয়ুবী কমাণ্ডারকে আরো বলে দিলেন, “হেম্মাত দুৰ্গ যুদ্ধ ছাড়াই আমাদের হস্তগত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তোমরা সতর্ক ও সাবধান থাকবে। কোন অবস্থাতেই প্রবঞ্চণায় পড়বে না। দুর্গ থেকে দূরে উপযুক্ত স্থানে থেমে যাবে। লক্ষ্য করবে, দুর্গাধিপতির মনের ভাব। যদি জুরাদিক আপোষে দুর্গ হস্তান্তর করতে রাজি হয়, তবে তাকে দুর্গের বাইরে আসতে বলবে।
সে দুর্গের বাইরে এলে দুৰ্গ আক্রমণের কোন দরকার নেই। কিন্তু তুমি নিজে তার সাথে আপোষ বা চুক্তি কোনটাই করবে না। তাকে বলবে, সুলতান আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। তিনিই আপনার সাথে সন্ধির শর্ত নির্ধারণ করবেন।
খবরদার! তার কথায় প্রভাবিত হয়ে তোমরা কেল্লায় প্রবেশ করবে না। আর যদি জুরদিক মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে মুজাহিদদের ঈমানের শক্তি কেমন তা তাকে বুঝিয়ে দেবে। কাসেদ মারফত সাথে সাথে এ খবর পাঠিয়ে দেবে আমার কাছে।”
সুলতান আইয়ুবী দেয়াল ভাঙ্গায় পারঙ্গম এক দল সৈন্যকে আলাদাভাবে আগেই পাঠিয়েছিলেন হেম্মাতের পথে। প্রথম দলটি যাত্রার তিন চার ঘন্টা পর আরও দুটো সৈন্য দলকে হেম্মাতের পথে যাত্রা করার হুকুম দিলেন। এক দলকে প্রথম দলের ডাইনে এবং দ্বিতীয় দলকে প্রথম দলের বায়ে অবস্থান নিয়ে এগিয়ে যেতে বললেন।
তাদের বলে দিলেন, “যদি প্রথম দলের সাথে হেম্মাত দুর্গের সৈন্যদের মোকাবেলা শুরু হয়, তবে তোমরা দু’দল দুদিক থেকে অগ্রসর হয়ে দুর্গ অবরোধ করে ফেলবে। তোমরা দুর্গের ওপর এমনভাবে তীর বর্ষণ করবে, যেন দেয়াল ভাঙ্গা বাহিনী দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে।”
এ দুই দল যাত্রা করার কিছুক্ষণ পর সুলতান আইয়ুবী স্বয়ং একদল সৈন্য নিয়ে যাত্রা করলেন হেম্মাতের পথে। এই নিয়ে পর পর চারটি দল হেম্মাতের উদ্দেশ্যে দামেশক ত্যাগ করলো।
অবশিষ্ট সমস্ত সৈন্য দামেশকেই রয়ে গেল। তিনি অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়েই যুদ্ধ জয়ের চিন্তা করছিলেন।
রসদপত্র সরবরাহের দায়িত্ব ছিল কমাণ্ডো বাহিনীর একাংশের ওপর। তারা রসদসহ ছোট ছোট দলকে হেম্মাতের পথে পাঠিয়ে দিল।
হেম্মাত থেকে হলবের পথ জুড়ে ছড়িয়ে ছিল ছদ্মবেশী কমাণ্ডো বাহিনী। কোন কাসেদ যেন হেম্মাতের খবর হলবে পৌঁছাতে না পারে এ জন্যই এ ব্যবস্থা। ওদের ওপর নির্দেশ ছিল, “কোন দিক থেকে সাহায্য আসা শুরু হলে কমাণ্ডো আক্রমণ চালিয়ে তাদের প্রতিরোধ করতে হবে।”
দিন গড়িয়ে রাত এল। রাতও ক্রমেই গভীর হতে থাকলো। মুজাহিদদের অগ্রযাত্রা থেমে নেই, এগিয়েই চলেছে তারা। রাতের দ্বিতীয় প্রহরে প্রথম দলটি হেম্মাত দুর্গ থেকে দু’তিন মাইল দূরে এসে অবস্থান নিল।
৯ ডিসেম্বরের সকাল। কেল্লার ওপর দাঁড়ানো প্রহরীরা তাকিয়েছিল। খোলা প্ৰান্তরের দিকে। অন্ধকারের প্রকোপ কমে এল, কুয়াশা হালকা হলো সামান্য। ওদের মনে হলো, দূরে মরুভূমিতে কালো কালো আবছা ছায়া দেখা যাচ্ছে। ভাল করে তাকালো ওরা। হ্যাঁ, মনে হচ্ছে অনেক মানুষ ও ঘোড়া। ওরা ভাবল, কোন কাফেলা হবে হয়ত।
সূর্য ওপরে উঠতে লাগলো, প্রহরীরা দেখলো, এটা কোন সাধারণ কাফেলা নয়, নিয়মিত সেনাবাহিনীর একটা দল। কেল্লার ডাইনে বায়ে সৈন্যদের যে ঘেরাও, তা তখনো ওদের চোখে পড়েনি।
সঙ্গে সঙ্গে হেম্মাত দুর্গে বেজে উঠলো জরুরী বিপদ সংকেত। এক কমাণ্ডার দৌড়ে ওপরে গেলো। তাকিয়ে দেখলো সৈন্যদের। ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটলো নিচে, দৌড়ে গিয়ে কেল্লার অধিপতি জুরাদিককে খবর দিল।
“ভয় পেয়ো না!” জুরদিক কমাণ্ডারকে বললেন, “এটা কোন আকরমণকারী সেনাদল নয়। আক্রমণকারী হলে রাতেই ওরা আঘাত হানতো। হতে পারে, খৃস্টানরা আমাকে হত্যা করতে না পেরে অন্য কোন ষড়যন্ত্রে আছে। হয়ত খলিফা আস সালেহের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে হেম্মাত কেল্লা আমার কাছে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে দিতে চায়। পেরেশান হওয়ার দরকার নেই, বাইরে গিয়ে ওরা কারা এবং কি চায় আগে খোঁজখবর নাও।”
কমাণ্ডার ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে বেরিয়ে গেলো কেল্লা থেকে। সুলতান আইয়ুবীর প্রথম বাহিনীর দিকে এগিয়ে গেল সে। দেখলো সুলতান আইয়ুবীর পতাকা উড়ছে ওখানে। ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসতে চাইলো সে।
আইয়ুবীর দলের কমাণ্ডার ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে গেল তার কাছে। কাছাকাছি হতেই দু’জন দু’জনকে চিনতে পারলো। দু’জনই নূরুদ্দিন জঙ্গীর সেনাবাহিনীতে একত্রে কাজ করেছে। “এই আমাদের ভাগ্যে ছিল!” আইয়ুবীর কমাণ্ডার বললো, ‘জঙ্গী যদি বেঁচে থাকতেন। তবে আমরা থাকতাম পরস্পর বন্ধু ও সঙ্গী। তিনি মারা গেছেন আর আমরা পরস্পর শক্র হয়ে গেলাম!”
“তোমরা কেন এসেছ?” কেল্লার কমাণ্ডার জিজ্ঞেস করলো।
“তোমরা এ দুর্গ আর নিজেদের দখলে রাখতে পারবে না।” আইয়ুবীর কমাণ্ডার বললো, “তোমার দুর্গাধিপতিকে গিয়ে বলো, কেল্লা আমাদের হাতে তুলে দিতে। কোন রক্তাক্ত যুদ্ধে জড়িয়ে লাভ নেই। ওতে কেবল হতাহতের সংখ্যাই বাড়বে। আপোষে সংঘর্ষ না এড়ালে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা কেল্লা অবরোধ করতে বাধ্য হবো।
কোথাও থেকে কোন সাহায্য পাবে না তোমরা, তোমাদের সাহায্যের সব পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অস্ত্ৰ সমৰ্পণ করে অযথা রক্তক্ষয় এড়ানোর জন্য আমি অনুরোধ করছি তোমাদের।”
কেল্লার কমাণ্ডার এর কোন জবাব না দিয়ে ফিরে গেলো জুরদিকের কাছে। জুরাদিককে বললো, “সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর ফৌজ আক্রমণ করেছে আমাদের। তারা অন্ত্র সমৰ্পণ করে রক্তক্ষয় এড়াতে বলছে।”
জুরদিক চিৎকার করে বললো, “তুমি ঠিক বলছো! সালাহউদ্দীন আইয়ুবী এসেছেন! তাহলে আর বসে আছো কেন? কেল্লার ওপর থেকে খলিফার পতাকা নামিয়ে নাও। ওখানে উড়িয়ে দাও সাদা পতাকা। না, কোন সংঘাত নয়, আইয়ুবীর সাথে লড়াই করে মরতে দেবো না আমার কোন সৈন্যকে! উড়াও, জলদি শান্তির পতাকা উড়িয়ে দাও কেল্লার ওপর।”
তিনি আবেগে দৌড়ে বাইরে চলে এলেন। অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে এগিয়ে গেলেন আইয়ুবীর বাহিনীর দিকে।
আইয়ুবীর সেনাদলের কাছে গিয়ে পৌঁছলেন তিনি। তিনি মনে করেছিলেন, সুলতান আইয়ুবী নিজেই আছেন সৈন্যদের সাথে। বললেন, “কোথায় মোহতারাম আইয়ুবী?”
“তিনি এখনো এসে পৌঁছেননি। জবাব দিল আইয়ুবীর বাহিনীর সালার।
“কিন্তু আমি তো তাঁর সঙ্গেই কথা বলতে চাই’।
“অবশ্যই তাঁর সাথে কথা বলবেন। আগে বলুন, আপনি কি লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, নাকি আত্মসমৰ্পন করবেন?”।
“আমি এর কোনটাই করবো না। আমি কি করবো তা কেবল সুলতানকেই বলবো।”
“ঠিক আছে। আপনি কি তাহলে সুলতান আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন?”
‘না, সুলতান কোথায় আছেন। ওখানে আমাকে নিয়ে চলো। আমি যত শিগগির সম্ভব সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে চাই।” সুলতান তখনো অনেক পেছনে। জুরদিক তখুনি আইয়ুবীর সেদিকে রওনা হয়ে গেলেন।
সুলতান আইয়ুবী জুরাদিককে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। জুরাদিক তার পূর্ব শত্রুতার কথা তুলে ক্ষমা চাইলেন সুলতানের কাছে। উভয়েই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। অতীতের কথা ভুলে নতুন করে বন্ধুত্বের বন্ধনে জড়িয়ে নিলেন পরষ্পর পরম্পরকে।
এরপর জুরদিক আইয়ুবীকে নিয়ে হেম্মত দুর্গে গেলেন। সমস্ত সৈন্যসহ দুর্ভেদ্য কেল্লা তুলে দিলেন সুলতান আইয়ুবীর হাতে। সুলতান আইয়ুবী তার কেন্দ্রীয় কমান্ডকে সঙ্গে নিয়ে কেল্লায় প্ৰবেশ করলেন। সৈন্যরা সাদা পতাকা নামিয়ে সেখানে সুলতানের পতাকা উড়িয়ে দিলো।
জুরদিক কেল্লার ছোট বড় সকল কমাণ্ডারকে ডেকে হাজির করলেন সুলতান আইয়ুবীর সামনে। সুলতান বললেন, “প্রিয় মুজাহিদ ভাইয়েরা! আমাদের জীবন, আমাদের মরণ, আমাদের সকল কাজ আল্লাহর জন্য, ইসলামের জন্য। ইসলামের পথে আছি বলেই তোমরা আমাকে বরণ করে নিয়েছো। আমিও ইসলামের স্বার্থেই তোমাদের কাছে ছুটে এসেছি। তোমরা দেখেছে, তোমাদের কারো কাছ থেকে অস্ত্ৰ কেড়ে নেয়া হয়নি। কাউকে অস্ত্ৰ জমা দিতেও বলা হয়নি। তার মানে হচ্ছে, কেউ তোমাদের পরাজিত করে এ কেল্লা দখল করেনি। তোমাদের সকল সৈনিককে বলে দিও, তারা যেন নিজেদেরকে পরাজিত মনে না করে। বরং ইসলামী জেহাদের প্রয়োজনে, দেশ, জাতি এবং মিল্লাতের স্বার্থে আমরা আজ পরস্পর মিলিত হয়েছি শুধু। আমরা সবাই মুসলিম ভাই ভাই। আমাদের লড়াই খৃস্টান ও তার তল্পীবাহকদের বিরুদ্ধে।”
সুলতান আইয়ুবী যে বিরাট পরিকল্পনা নিয়ে বের হয়েছিলেন তার প্রথম মঞ্জিল বিনা যুদ্ধেই জয় হয়ে গেল। তিনি দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে এর শুকরিয়া আদায় করলেন। এরপর জুরাদিককে নিয়ে বসলেন। পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করতে।
সমস্যা দেখা দিল, জুরদিকের সৈন্যরা শীতকালে যুদ্ধ করার কোন প্রশিক্ষণ পায়নি। ঠিক হলো, হেম্মাত দুৰ্গকে কেন্দ্র বানিয়ে এখান থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করা হবে। জুরদিকের সৈন্যরা কেল্লায় থাকবে এবং অফিসিয়াল দায়িত্ব পালন করবে।
কিন্তু সৈন্যরা এ সিদ্ধান্তে ঘোর আপত্তি জানালো। তারা দাবী করলো, তারাও সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের সাথে মিলে সরাসরি যুদ্ধে যাবে।
সামনে হেমসের দুর্গ। সুলতান আইয়ুবী এমনভাবে অভিযানের সময় নির্ধারণ করলেন, যাতে গভীর রাতে তার বাহিনী সেখানে গিয়ে পৌঁছে।
তিনি প্রথম সেনা দলকে পূর্বের মত আগে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু অন্যান্য পরিকল্পনায় কিছু কৌশলগত পরিবর্তন আনলেন। কারণ হেমসের দুর্গ বিনা যুদ্ধে জয় করতে পারবেন, তেমন কোন আশা ছিল না।
তিনি পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য একটি টিম পাঠালেন সবার আগে। এ টীম রাস্তাতেই সংবাদ পেল, কেল্লার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পার্শ্ববতী এলাকায় ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে টহল বাহিনী।
যেসব দিক থেকে হেমসে সাহায্য আসতে পারে সেসব এলাকায় সুলতান আইয়ুবী ছোট ছোট কয়েকটি দলকে পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, “বাইরে থেকে কোন সাহায্য যেন হেমস দুর্গে প্ৰবেশ করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে তোমাদের।”
অতিরিক্ত খাদ্যশস্য ও রসদ হেম্মাত দুর্গে রেখে তিনি বাকী রসদপত্র বহনের দায়িত্ব দিলেন একদল কমাণ্ডোকে। আরেকদল কমাণ্ডোকে পাঠিয়ে দিলেন রাস্তা নিরাপদ রাখতে। এদের সঙ্গী হলো হেম্মাতের এক দল সৈনিক।
সুলতান আইয়ুবী চাচ্ছিলেন, তিনি হলব পৌঁছার আগ পর্যন্ত যেন তার আক্রমণের সংবাদ ওখানে না পৌঁছে। সকলের অজ্ঞাতসারে অতর্কিতে তিনি সেখানে আঘাত হানতে চান।
এ জন্য তিনি নিজের কিছু লোককে হলবের রাস্তায় ছড়িয়ে রেখেছিলেন। তাদের বলে রেখেছিলেন, আমরা যাত্রা করার পর কোন পলাতক সৈন্য বা সাধারণ লোককেও তোমাদের অতিক্রম করে হেমসে যেতে দেবে না। ওদের থামিয়ে দেবে, বেশী বাড়াবাড়ি করলে তাকে ধরে আটক রাখবে।
রাত অনেক গভীর। কেল্লার অধিপতি ও অফিসাররা একটা প্রশস্ত কামরায় বসে শরাব পান করছিল। দু’জন নর্তকী নাচছিল ওদের সামনে। কামরায় তবলা, সরোদ ও অন্যান্য বাজনায় সুর তুলছিল বাদক দল। কামরা ভেসে যাচ্ছিল সুসজ্জিত আলোয়।