সামরিক বিশ্রামাগারে গোসল সেরে শুয়ে পড়ল আরমান। দেহ ক্লান্ত, অবসন্ন। তবু ঘুম আসছিল না। হৃদয়ে চলছিল তোলপাড় করা অন্তর্দ্বন্দ্ব। পিতার সাথে কি দেখা করবে?
নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়াল ও। কক্ষ থেকে বেরিয়ে ক্যাম্পের দিকে হাঁটা দিল। লোকের কাছে জিজ্ঞেস করে পিতার কাছে পৌঁছল আরমান।
কঙ্কালসার এক বৃদ্ধ শুয়ে আছেন বিছানায় হাড় ছাড়া দেহে কিছু নেই।
বৃদ্ধের সাথে হাত মেলাল আরমান। বড় কষ্টে নিজকে সংযত রাখল।
নিজের পরিচয় না দিয়ে তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলল আরমান। ষোল বছরের অমানুষিক নির্যাতনের কারণে ভাল খাবার এবং ওষুধ কোন ক্রিয়া করছে না।
দুর্বল কণ্ঠে কথা বলছিলেন বৃদ্ধ। কিন্তু আরমানের মন ছুটে গিয়েছিল ষোল বছর পূর্বের সেই হারানো অতীতে। পিতার চেহারা তো ভোলার মত নয়।
কয়েকবারই ভাবল পিতার কাছে নিজের পরিচয় প্রকাশ করবে। কিন্তু এতবড় আনন্দ তার এ দুর্বল শরীর সইতে পারবে না ভেবে নিজের পরিচয় গোপন রাখল।
তাছাড়া পিতৃস্নেহ যুদ্ধের ময়দানে যাবার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। আবার পিতার সাথে করমর্দন করে ও ফিরে এল।
বিশ্রামাগারে এসে ও কেন্দ্রের নির্দেশ পেল। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাকে এখানেই থাকতে বলা হয়েছে।
কেন্দ্রে কি কাজ থাকতে পারে ভেবে আশ্চর্য হল ও। নির্দেশ পাঠিয়েছেন গোয়েন্দা প্রধান।
আইওনার ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়ার জন্য লোক পাঠিয়ে দিলেন তিনি। ক্যাম্পে তার পিতার কাছেও খোঁজ নেওয়া হল। তিনি বললেন, ‘ষোল বছর পূর্বে তার সাত বছরের একটি মেয়ে অপহৃত হয়েছে। খ্রিষ্টানদের হাতে নিহত হয়েছে বড় ছেলে এবং স্ত্রী। ছোট ছেলে পালিয়ে গেছে। পরে শুনেছি সে সুবাক থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।’
নিশুতি রাত। আইওনার ঘুম আসছিল না। সে বুঝতে পেরেছে আলী তাকে বিশ্বাস করতে পারেননি। এখন তার কি হবে! কিভাবে বিশ্বাস করাবে তার বলা প্রতিটি কথাই সত্য।
একই সাথে হৃদয়ে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। আরমানের সাথে বাড়ি গিয়ে শৈশবের হারানো স্মৃতি মনের কোণে ভীড় জমিয়েছে।
অপহরণের দিনটি তার স্বপ্নের মত মনে পড়ছে। অপহরণের পর তাকে ভাল খাবার দেওয়া হয়েছে। আদর যত্নের কোন অভাব ছিল না। এরপর পাপের সমুদ্রে তাকে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ওর ভেতরের প্রতিশোধ স্পৃহা দৃঢ় হতে লাগল। শোয়ার পরও ও দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি।
পিতার সাথে দেখা করার ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু কক্ষ থেকে বাইরে যাবার অনুমতি নেই। মাথার ওপর দাঁড়িয়ে আছে দু’জন সেন্ট্রি।
ও বিছানা থেকে উঠল। দরজা খুলে উঁকি দিল বাইরে। প্রহরী দু’জনকে দূরে দেখা যাচ্ছে। কথা বলছে ওরা। মাথা নীচু করে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল আইওনা।
আরও দূরে সরে গেল প্রহরী। ও আলতো পায়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল। প্রাচীরের গা ঘেঁষে এগিয়ে চলল।
বড় গেট পর্যন্ত স্থানটি ঘাসে ছাওয়া। ও বসে নিঃশব্দে বিড়ালের মত হেঁটে ফটকে পৌঁছলে।
প্রহরী এদিকে আসেনি। বেরিয়ে গেল ও। হাঁটা দিল ক্যাম্পের দিকে। এখন আর কোন সান্ত্রীর ভয় নেই।
পিতার চেহারা ওর মনে নেই। এখানে এসে শুধু নাম শুনেছে। ও দ্রুত হাঁটতে লাগল।
কারও পদশব্দে পেছনে তাকাল। কেউ নেই। আবার হাঁটতে লাগল ও। আবার কারও পদশব্দ শুনে ও দাঁড়িয়ে পড়ল।
আচম্বিত ওর মুখ কাল কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল কেউ। শক্ত সমর্থ দুটি বাহু তুলে নিল ওকে।
হাত পা ছুঁড়ে নিজকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল আইওনা।
নিরব রাতের সুনসান সড়ক ধরে এগিয়ে চলল অপহরণকারীরা।
সামনে গিয়ে ওরা ওকে কম্বল দিয়ে ঢেকে গাঁঠুরীর মত কাঁধে তুলে নিল। আধ ঘণ্টা চলার পর ওকে কাঁধ থেকে নামিয়ে কম্বল সরিয়ে দেওয়া হল।
একটা কক্ষে চারজন লোক বসে আছে। পাশে দুটি মাটির প্রদীপ। ও হতবাক হয়ে চারজনের দিকে তাকাল।
‘তোমরা এখনও এখানে? মি. ডিউক আপনিও?’
‘আমরা গিয়ে আবার ফিরে এসেছি।’ জবাব দিল ডিউক, ‘তোমাদেরকে মুক্ত করার জন্য। তোমাকে পেয়ে ভালই হল।’
গোয়েন্দা মেয়েদেরকে মুক্ত করার জন্য ক্রাক থেকে পাঠানো হয়েছে চল্লিশজন কমাণ্ডো সদস্য। মি. ডিউক এদের কমাণ্ডার। বৃটেনের অধিবাসী। নাশকতামূলক কাজে অভিজ্ঞ। এদের বলা হয়েছে সুবাকে যেসব গোয়েন্দা রয়ে গেছে তাদের সংগঠিত করে নাশকতামূলক কাজ করতে।
আস্তাবলে ঢুকে ঘোড়ার খাদ্যে বিষ মিশানো, ছাউনীর লঙ্গর খানার খাবারে বিষ মিশানো সহ বিভিন্ন প্রকার সন্ত্রাসী কাজ করবে।
এর আগেও এবার ডিউক আইওনাদের দলপতি ছিল। ডিউকের সাথে ছিল ওর ভাল সম্পর্ক। কিন্তু এখন তাকে দেখেই ওর মনে প্রচণ্ড ঘৃণা এবং প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠল। কিন্তু সংযত হল ও। এখন ঘৃণা প্রকাশের সময় নয়।
ডিউক ভাবতেও পারেনি আইওনার পৃথিবী বদলে গেছে। ওকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাচ্ছিলে?’
আইওনা বলল, ‘সুযোগ পেয়ে পালিয়ে এসেছি।’
আমরা চল্লিশজন কমাণ্ডো গোয়েন্দা নির্যাতীত মুসলমানের ছদ্মবেশে সুবাক এসেছি। বিচ্ছিন্ন গোয়েন্দাদের একত্রিত করেছি।
তোমরা যেখানে থাক দু’রাত থেকে সে বাড়িতে নজর রাখা হচ্ছে। প্রহরীদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য আজও দু’জন গিয়েছিল। অযাচিত ভাবেই তোমাকে পেয়ে গেছি। এবার বল তো, ওদেরকে বের করা যায় কিভাবে?’
‘ওদেরকে বের করে আনাটা কষ্টকর হলেও অসম্ভব নয়। ওখানে মাত্র দু’জন প্রহরী থাকে। বিভিন্ন কক্ষে থাকে মেয়েরা।’ আইওনা বলল।
রাতেই পরিকল্পনা তৈরী হল সিদ্ধান্ত নেওয়া হল ওদের বের করে আনা হবে। অভিযাবে কতজন যাবে, অন্যরা কোথায় থাকবে তাও বলা হল।
আইওনা বলল, ‘আমার ফিরে যাওয়া উচিৎ। আমাকে না পেলে অন্য মেয়েদের ওপর পাহারা আরও শক্ত হবে। তখন ওদের বের করা সম্ভব হবে না।’
ডিউকের পছন্দ হল ওর প্রস্তাব। এরপর নিজেই ওকে ফটকের কাছে রেখে এল। মেয়েটিকে আসতে দেখে প্রহরী জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় গিয়েছিলে?’
‘ধারে কাছেই। বেশী দূরে যাইনি।’
সেন্ট্রি কোন উচ্চবাচ্য করল না। তাদের দুর্বলতার কারণেই মেয়েটা বাইরে গিয়েছে। কমাণ্ডার শুনলে ওদের দু’জনেরই চাকরি যাবে।
পরদিন গোয়েন্দা প্রধান কী এক কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আইওনা সেন্ট্রিকে বলল, ‘আমাকে আলী বিন সুফিয়ানের কাছে নিয়ে চল।’ অস্বীকার করল প্রহরী। বলল, ‘প্রয়োজন হলে তিনিই ডেকে পাঠাবেন।’
‘দেখো, তার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। যদি ক্ষতি হয় তোমাকেই শাস্তি ভোগ করতে হবে।’
শাস্তির কথা শুনে ভয় পেল প্রহরী। গোয়েন্দা প্রধানের কাছে আইওনার সংবাদ পৌঁছে দিল।
সাথে সাথেই ওকে তিনি ভেতরে ডেকে নিলেন।
আইওনা তার কক্ষ থেকে আর বের হল না।
গভীর রাত। সবাই ঘুমিয়ে আছে। সুনসান নিঝুম প্রকৃতি। সতর্ক পায়ে নিঃশব্দ রাতের আঁধারে চিরে এগিয়ে চলেছে আটটি ছায়ামূর্তি। মূর্তিগুলো গোয়েন্দা প্রসাদের প্রধান ফটকে পৌঁছল।
আশ্চর্য কোন প্রহরী নেই। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল ওরা। আইওনার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দু’জন মেয়েদের কক্ষে ঢুকে পড়ল। অন্যরা বাইরে।
দু’জন সেন্ট্রিকে কাবু করা অসম্ভব হবে না। যারা ভেতরে ঢুকল আর বের হল না।
ডিউক অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছে। এতক্ষণে ওদের ফিরে আসার কথা। পূর্বের পরিকল্পনা অনুযায়ী এ বাড়িতে রয়েছে বিশজন। বাড়িটা এক খ্রিষ্টান ব্যবসায়ীর। বিশাল বাড়ি।
অন্যরা শহরের বিভিন্ন বাড়িতে। সবাই প্রস্তুত। মেয়েরা এলেই ওরা ক্রাকের পথ ধরবে।
দরজায় করাঘাতের শব্দ হল। পরিচিত শব্দ। তাড়াতাড়ি দরজার কবাট খুলল ডিউক। একটা পাল্লা খুলতেই কেউ তাকে টেনে বের করে নিল। সাথে সাথেই এক দল সৈন্য ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভেতরে বসেছিল বিশজন। কেউ পালানোর সুযোগ পেল না। বাড়ির মালিকসহ সবাইকে গ্রেফতার করা হল। একই সময়ে আক্রমণ করা হল আইওনার চিহ্নিত এগারটি বাড়িতে।
সকালে চল্লিশজন কমাণ্ডো সদস্য এবং চল্লিশজন গোয়েন্দাকে হাজির করা হল সুলতান সালাহুদ্দীনের সামনে।
বাড়িগুলোতে তল্লাশী নিয়ে পাওয়া গেল প্রচুর অস্ত্র, দাহ্য পদার্থ, বিষের পুটুলী, হাশিশ এবং নগদ টাকা পয়সা।
বন্দীদের মধ্যে সবচে মূল্যবান বন্দী ছিল ডিউক। সুলতানের নির্দেশে ওদের জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
গোয়েন্দাদের সমস্যা শেষ করার পর আইওনা সেসব মুসলমানদের নাম উল্লেখ করল যারা গোপনে খ্রিষ্টানদের সাথে গাটছাড়া বেঁধেছে। ও সুলতান এবং আলীকে বলল, ‘এবার তো আমায় বিশ্বাস করা উচিৎ?’
আরমানকে ডেকে পাঠালেন আলী বিন সুফিয়ান। আরমান এলে তাকে বলা হল, ‘আরমান, ও আইওনা, তোমার হারিয়ে যাওয়া বোন।’
ভাই বোনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হল তখন। দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে রইল অশ্রুসজল চোখে।
দু’ ভাই-বোনকে পিতার সামনে হাজির করা হল। আনন্দে অজ্ঞান হয়ে গেলেন বৃদ্ধ। জ্ঞান ফিরলে দু’সন্তানকে জড়িয়ে ধরলেন বুকের সাথে। বললনে, ‘ওর নাম আইওনা নয়, আশা।’
সুলতান বৃদ্ধের জন্য ভাতা নির্ধরণ করলেন। আলীকে বললেন, ‘সবকটি গোয়েন্দা মেয়ের ব্যাপারে খোঁজ খবর নাও। খোঁজ পেলে ওদেরকে আত্মীয় স্বজনের হাতে তুলে দিও। এদেরকেও হয়ত খ্রিষ্টানরা কোন মুসলমানদের বাড়ি থেকে অপহরণ করেছে।’
বড় ধরনের বিপদ থেকে বেঁচে গেলেন সুলতান। এবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সৈন্যদের এক করতে হবে।
সালাহুদ্দীন এবার তার হেডকোয়ার্টার স্থানান্তর করলেন মরুভূমিতে। অল্প কদিনের মধ্যেই সকল সৈন্য হেডকোয়ার্টারে জমায়েত হল।
সুলতান সেনাবাহিনীকে তিন ভাগ করলেন। এক ভাগ পাঠালেন সুবাকের প্রতিরক্ষার জন্য। এক ভাগ রাখলেন নিজের কাছে। তৃতীয় ভাগ ছেড়ে দিলেন বিশাল বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে পেট্রোল ডিউটির জন্য।
আলী সুলতানের কাজকর্ম দেখছিলেন আর ভাবছিলেন, খ্রিষ্টানরা কিছুতেই এ পরাজয় মেনে নেবে না। আবার তারা হামলা করবে। কিন্তু কোন পথে? তারা কি আমাদের সামনাসামনি লড়তে বাধ্য করবে, নাকি ভয়ঙ্কর কোন ফাঁদ পাতবে আগের মত?