সূর্য ডোবার পূর্বেই পার্বত্য এলাকা পেরিয়ে যেতে চাইছে ও। চোখ-কান সতর্ক। কোন টিলা থেকে যে কোন সময় ছুটে আসতে পারে শত্রুর নিক্ষিপ্ত তীর।
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এগিয়ে যাচ্ছে আরমান সামনের পথ পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ঘুরে গেছে। এলাকাটা ভয়াবহ দুর্গম।
আচম্বিত ভেসে এল ছুটন্ত পায়ের শব্দ। কেউ পাশের টিলার আড়ালে লুকিয়েছে কিনা না দেখরা জন্য দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে ও টিলার ওপাশে পৌঁছল। সামনে বেরোবার পথ নেই। স্থানটি এক বিশাল গর্তের মত।
আরমানের বিশ কদম দূরে লম্বা জুব্বা পরে এক ব্যক্তি উপরে উঠার চেষ্টা করছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না। লোকটির মাথাও ঢাকা। ওখানে আর কেউ নেই।
আরমান ওকে ডাকল। কিন্তু লোকটি পাহাড়ে উঠার চেষ্টা থামাল না। এগিয়ে গেল আরমান।
লোকটি দ্রুত উপরে উঠার চেষ্টা করল। কিন্তু তার ক্লান্ত হাত ফসকে এসে পড়ল আরমানের ঘোড়ার কাছে।
মুখের কাপড় সরে গেল লোকটার। আরমানের হতবাক দৃষ্টি অপলক তাকিয়ে রইল সে চেহারার দিকে।
এ-তো এক সুন্দরী যুবতী। এমন অপরূপা নারী ও জীবনে দেখেনি।
আরমান ঘোড়া থেকে নামল।
মেয়েটি উঠে বসল। ভীত হরিণীর মত কাঁপছে সে।
‘কে তুমি?’ আরমান প্রশ্ন করল।
জবাবে পানি চাইল ও। আরমান ঘোড়ার সাথে বাধা মশক থেকে পানি এনে দিল। মেয়েটি ঢক ঢক করে পানি পান করল।
ক্লান্তি বা ভয়ে বন্ধ হয়ে আসছিল মেয়েটির চোখের পাতা।
চোখ বন্ধ করে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ল মেয়েটি।
আরমান এগিয়ে ওর চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিল। জ্ঞান ফিরল ওর। আরমান থলে থেকে কিছু খাবার এনে তুলে দিল মেয়েটির হাতে। খাওয়া শেষে কিছুটি স্বাভাবিক হল মেয়েটা।
আরমান বলল, ‘আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কি তোমার পরিচয়। তুমি কোত্থেকে এসেছ?’
‘সুবাক থেকে আমার পরিবারের সাথে এসেছি।’ মেয়েটির দুর্বল কণ্ঠ। ‘মুসলিম সৈন্যদের আক্রমণে পরিবারের সবাই মারা গেছে। বেঁচে আছি আমি একা।’
আরমান বরল, ‘তুমি ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করছ কেন? তুমি যা বললে এর সবচাই মিথ্যে। আমাকে তোমার আসল পরিচয় দিচ্ছ না কেন?’
‘মিথ্যে হলে হল।’ একই সাথে আতঙ্ক ও ঝাঁঝ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল মেয়েটি। তারপর সুর সামান্য নরম করে বলল, ‘আমি তোমার করুণা ভিক্ষা করছি। অনুগ্রহ করে আমাকে ক্রাক পর্যন্ত পৌঁছে দাও।’
‘সুবাক পর্যন্ত। আমি তোমায় সুবাক পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারি, ক্রাক নয়। দেখতেই পাচ্ছ আমি মুসলমান। তোমাকে ক্রাক পৌঁছাতে গিয়ে পথে খ্রিষ্টান সৈন্যদের হাতে মরার কোন ইচ্ছে নেই আমার।’
‘তাহলে আমাকে একটা ঘোড়া দাও।’
‘তোমায় ঘোড়াও দিতে পারছি না, এখানেও একা ছেড়ে যেতে পারছি না। তোমায় সুবাক পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া আমার দায়িত্ব।’
‘ওখানে নিয়ে আমায় কী করবে?’
‘কমাণ্ডারের হাতে তুলে দেব।’
‘আমি যুবতী বলে কি আমাকে সুবাক নিতে চাচ্ছ?’
‘ভয় নেই, তুমি যে আশঙ্কা করছ তেমন ব্যবহার কেউ তোমার সাথে করবে না।’
মেয়েটা ক্রাক যাবার জন্য জিদ করছিল। আরমান বলল, ‘পথে কারও হাতে পড়লে কী অবস্থা হবে বুঝতে পারছ?’
‘সুবাক গেলে অবস্থা তারচে ভাল হবে এর নিশ্চয়তা কী?’
‘নিশ্চয়তা হচ্ছে আমাদের সুলতানের নির্দেশ। আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সুবাক থেকে কোন খ্রিষ্টান পরিবার যেন পালিয়ে যেতে না পারে। কাউকে পালিয়ে যেতে দেখলে ফেরত পাঠাতে বলা হয়েছে। সুলতান সবার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন বলেছেন। তাছাড়া তুমি একা ক্রাক পর্যন্ত পৌঁছুতে পারবে না।’
তরুণী ভেবেছিল মুসলিম যুবকটি হয়ত তার সম্ভ্রম নষ্ট করবে। সে সিদ্ধান্ত নিল দেহের লোভ দেখিয়ে এর কাছ থেকে একটা ঘোড়া বাগাতে হবে। কথার মোড় ঘুরিয়ে দিল ও।
‘আমি ভীষণ ক্লান্ত। আপনি চাইলে আমরা রাতটা এখানে কাটিয়ে সকালে সুবাকের পথ ধরতে পারি। কিন্তু এখন আমার পক্ষে সফর করা কঠিন।’
আরমান নিজেও ক্লান্ত। ঘোড়াগুলোর ওপর অনেক ধকল গেছে। মেয়েটাকেও ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ওখানেই রাত কাটাবার সিদ্ধান্ত নিল আরমান।
এর আগে মেয়েটা তাকে ভাল ভাবে দেখেনি। ওর কাছে মুসলিম সৈন্য মানেই এক হিংস্র পশু। তার কাছে অনুকম্পা আশা করা যায় না। কিন্তু আরমান এখানেই রাত কাটাতে রাজি হওয়ায় ও বুঝল ওকে হয়ত বাগানো যাবে।
মেয়েটি এবার গভীর চোখে আরমানের দিকে তাকাল।
আরমানও তাকাল মেয়েটির দিকে। ভাবল চারদিকে যুদ্ধের দামামা বাজছে, এর মাঝে অনিন্দ্য এক সুন্দরীর একা থাকা কত বিপজ্জনক। এমনও হতে পারে এ মেয়েটার জন্য। কমাণ্ডাররা পরস্পর ঝগড়া করে নিহত হয়েছে। ও রয়ে গেছে একা। সেও তো একজন মানুষ।
ও তরুণীর চোখে চোখ রাখল। মেয়েটা তার দিকে চেয়ে আছে। দৃষ্টি সরিয়ে নিতে চাইল আরমান। কিন্তু ওর মায়াভরা চোখ দুটো যেন আরমানের দৃষ্টি আটকে ফেলেছে। দেহে খেলে গেল অপরিচিত শিহরণ। চোখ সরিয়ে নিল ও।
পরক্ষণেই আবার দৃষ্টি স্থির হল যুবতীর চোখে। হৃদয়ে উৎকণ্ঠিত তোলপাড়। মেয়েটার ঠোঁটে ফুটে উঠল একটুকরো মিষ্টি হাসি।
‘সম্ভবত তুমি এখনও কুমারী।’ অনুচ্চ কণ্ঠে বলল আরমান।
‘হ্যাঁ।’ মেয়েটি চটপট জবাব দিল। ‘পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। তুমি আমাকে ক্রাক পৌঁছে দিলে আমি তোমায় বিয়ে করব।’
আরমান সচকিত হয়ে বলল, ‘এরপর বলবে তোমার ধর্ম ত্যাগ কর, যা আামর দ্বারা সম্ভব নয়। কেন, সুবাক গিয়ে মুসলমান হয়ে আমায় বিয়ে করতে পার না?’
‘আমাকে অবশ্যই ক্রাক যেতে হবে। আমার সাথে চল, তোমার পৃথিবী বদলে যাবে।’
মেয়েটা আরমানকে দেহের লোভ দেখাল। কিন্তু আরমানের ভাবনাগুলো ও বুঝতে পারছিল না।
ও চোখ তুলে তাকাল মেয়েটার দিকে। ওর চেহারা, রেশন কোমল চুল, ওর দুটো মায়াবী চোখের দিকে তাকিয়ে থাকত অনেক্ষণ। এরপর মাথা নুয়ে হারিয়ে যেত ভাবনার গভীরে।
যুবতীর কোন কথাই ওর কানে যাচ্ছিল না। জোৎস্নাহীন মেঘলা রাতের আঁধারে ছেয়ে গেল ওর চেহারা।
উঠে দাঁড়াল ও। ঘোড়ার পালানে বাধা থলে থেকে খাবার বের করে এনে মেয়েটাক দিল। নিজেও কিছু খেল।
ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসছিল ওদের দেহ। পাথরে মাথা রেখে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল দু’জনই।
শেষ রাতে হঠাৎ করেই যুবতীর চোখ খুলে গেল। দু’হাতে চোখ তুলে সামনে তাকাল। আরমান নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে। ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়ে আছে ক’কদম দূরে।
টিলার মাথায় শেষ রাতের চাঁদ। মরুর স্বচ্ছ জোৎস্নায় ঘোড়ার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল মেয়েটা। পিঠে জিন বাধা। ঘুমানোর পূর্বে আরমান ওগুলো খুলে রাখার প্রয়োজনও বোধ করেনি।
মেয়েটা আবার আরমানের দিকে তাকাল। সহসা জেগে উঠবে বলে মনে হয় না।
খাওয়া এবং বিশ্রামের ফলে নিজেকে ঝরঝরে মনে হচ্ছে। যুবতী জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল চকচকে খঞ্জর। শক্ত করে মুঠোয় চেপে ধরল বাঁট।
ঝলমলে চাঁদনী রাতে আরমানকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যুবতী দৃষ্টি ফেরাল খঞ্জরের দিকে।
আরমান ঘুমের ঘোরে কি যেন বলছে। মেয়েটা ভাবল হয়ত অবচেতন মনে জেগে থাকা আত্মীয়কে স্মরণ করছে ও।
মেয়েটার দৃষ্টি নিবন্ধ হল আরমানের বুকে। অনুমান করছে হৃদপিণ্ড কোথায় হতে পারে। প্রথম আঘাতের পর দ্বিতীয় আঘাত করা যাবে না। মরতে মরতেও সে তাকে মেরে ফেলতে পারবে।
খঞ্জরের বাটে মেয়েটার হাত আরও শক্ত হল। ঘোড়াগুলোর দিকে চাইল একবার। পরিকল্পনাটা মনে মনে ঝালাই করে নিল।
ওর বুকে খঞ্জর মেরে ছুটে যাবে ঘোড়ার কাছে। ঘোড়ার পিঠে চেপে দ্রুত পালিয়ে যাবে।
ও সৈনিক নয়, হলে এত কিছু ভাবতে হত না। নির্দ্বিধায় আরমানের বুকে খঞ্জর ঢুকিতে দিত। তাকে হত্যা করার বড় যুক্তি হচ্ছে সে মুসলমান এবং তার শত্রু। কিন্তু ও যতবারই আরমানের দিকে তাকিয়ে খঞ্জরের বাট শক্ত করে ধরত, শুরু হত হৃদস্পন্দন। ও শুনতে পেত হৃদয়ের ধুকপুক শব্দ।
ঘুমের ঘোড়ে আবার বিড়বিড় করতে লাগল আরমান। আগের চে পরিষ্কার। স্বপ্নেই ও বাড়ি গেছে। ডেকেছে মাকে, বোনকে। এরপরের শব্দগুলোতে মনে হল ওদের কেউ হত্যা করেছে এবং তাকেও খুঁজছে।
কী এক অজানা অনুভূতি মেয়েটাক বাধা দিচ্ছিল। ভয়ও হতে পারে, অথবা কাউকে হত্যা না করার মানসিকতা।
আনচান করতে লাগল ও। না, তাকে হত্যা করব না, মনে মনে ভাবল, আস্তে আস্তে ঘোড়ার কাছে গিয়ে একটা ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে যাব। খঞ্জর হাতে নিয়ে ও ঘোড়ার দিকে পা বাড়াল।
কিন্তু পা নড়ছে না। বালিতে আটকে গেছে যেন।
দাঁড়িয়ে আরমানের দিকে চাইতেই কতগুলো প্রশ্ন এসে ওকে জড়িয়ে ধরল। এক সুন্দরী যুবতীকে বিজন মরুতে নিঃসঙ্গ পেয়েও কি তার মনে কোন অনুভূতি সৃষ্টি হয়নি। সে একবারও ভাবল না খ্রিষ্টান মেয়েটা ঘুমের ঘোরেই তাকে হত্যা করতে পারে!
লোকটা ঘোড়ার জিন খোলেনি, অস্ত্রগুলোও সাবধানে রাখেনি। কেন? সে কি আমায় বিশ্বাস করে। তার অনুভূতি কি এতই ভোতা, আমার মত রূপসী তরুণী তার আবেগ জাগাতে পারল না। ওর মনে হল লোকটা তাকে ঘোড়ার চাইতে বেশী মূল্যবান মনে করেনি।
ও ধীরে ধীরে পৌঁছল ঘোড়ার কাছে। ডেকে উঠল একটি ঘোড়া। চমকে আরমানের দিকে চাইল ও। ঘোড়ার হ্রেষা ধ্বনিতেও আরমানের ঘুম ভাঙ্গেনি।
ও এখন তিনটে ঘোড়ার আড়ালে। একটা ঘোড়ার পিঠি উঠতে যাবে আচম্বিত পেছন থেকে শব্দ ভেসে এল, ‘কে তুমি?’
চকিতে পেছন ফিরে চাইল ও। দু’জন সৈনিক। এক ব্যক্তি শিষ কেটে বলল, ‘আমাদের সৌভাগ্য।’
হাসল দ্বিতীয় জন। ভাষায় বুঝা যাচ্ছে এরা খ্রিষ্টান সৈন্য। একজন মেয়েটার হাত ধরে নিজের দিকে আকর্ষণ করল। মেয়েটা বলল, ‘আমি খ্রিষ্টান।’
দু’জনই ওর কথায় শব্দ করে হেসে উঠল। বলল, ‘তবে তো তোমার পুরোটাই আমাদের।’
‘আগে আমার কথা শোন’, যুবতী বলল, ‘আমি সুবাক থেকে পালিয়ে এসেছি। নাম আইওনা। আমি গোয়েন্দা। ক্রাক যাচ্ছি। ওই দেখ একজন মুসলমান সৈন্য ঘুমিয়ে আছে। ও আমায় ধরে রেখেছে। ওকে ঘুমে রেখেই আমি পালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাকে সাহায্য কর। এ ঘোড়াগুলো সাথে নাও আর আমাকে ক্রাক পৌঁছে দাও।’
খ্রিষ্টানদের জন্য ও কত দামী সৈন্যদের বুঝিয়ে বলল আইওনা। একজন সৈন্য ওকে বাহু দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে বলল, ‘যেখানে বলবে পৌঁছে দেব।’
দ্বিতীয়জন একটা অশ্লীল মন্তব্য করল। দু’জনই ঠেলে ওকে টিলার অন্যদিকে নিয়ে যেতে লাগল।
খ্রিষ্টান বাহিনীর পদাতিক দুই সেপাই মুসলিম কমাণ্ডোদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করার জন্য ওরা এ পাহাড় কুচিতে ঢুকেছে। যুবতীর রূপ ওদের পশুতে পরিণত করে দিল। ও যখন দেখল খ্রিষ্টানের দোহাই দিয়েও বাঁচা যাচ্ছে না, জোরে জোরে চিৎকার শুরু করল। তার চিৎকার শুনে আরমান হয়ত জেগে উঠবে।
হঠাৎ একজন ভয়ার্ত কণ্ঠে সঙ্গীর নাম নিয়ে বলল, ‘সাবধান।’ সৈন্যটি সতর্ক হওয়ার পূর্বেই আরমানের বর্শা তার বুক এফোড় ওফোড় করে দিল।
দ্বিতীয় লোকটির হাতে উঠে এল তরবারী। মেয়েটা তার পাঁজরে খঞ্জর সেঁধিয়ে দিল। পরপর কয়েকটা আঘাত করে চিৎকার করে বলল, ‘তোমাদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। তোমরা খ্রিষ্টান নামের কলঙ্ক।’
খ্রিষ্টান সৈন্যদের দু’টো লাশ পড়ে আছে। আইওনা অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগল। আরমান তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘কেঁদ না। এখানে বেশীক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। ওদের দলের অন্যরা এসে পড়তে পারে। আমরা এখুনি সুবাকের পথ ধরব। ওরা কি তোমায় ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে?’
‘না, আমি জেগে ছিলাম। দাঁড়িয়ে ছিলাম ঘোড়ার কাছে।’
‘ঘোড়ার কাছে কেন?’
‘ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। তোমার সাথে যাবার ইচ্ছে ছিল না।’
‘এ খঞ্জর কোথায় পেয়েছ?’
‘আমার কাছেই ছিল। আগেই বের করে নিয়েছিলাম।’
‘আগেই বের করেছ! কেন? ও বুঝেছি, আমি যদি জেগে উঠি তাহলে মেরে ফেলবে?’
আইওনা আরমানের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইল। অনেকক্ষণ পর বলল, ‘আমি তোমায় হত্যা করে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। তুমি আমায় মেরে ফেলার আগেই বলছি, এ খঞ্জর তোমাকে হত্যা করার জন্যই বের করেছিলাম। কিন্তু পারিনি।
তোমায় কেন মারতে পরিনি জানি না। তোমার জীবন ছিল আমার হাতের মুঠোয়। আমি ভীতু নই। এর পরও তোমায় হত্যা করতে পারিনি। কেন, আমি বলতে পারব না। হয়ত তুমি বলতে পারবে।’
‘জীবন এবং মৃত্যু আল্লাহর হাতে। তিনিই তোমার হাত স্তব্ধ করে রেখেছিলেন, তিনিই তোমার সম্ভ্রম রক্ষা করছেন, আমি তো এক উপলক্ষ্য মাত্র। এখন একটা ঘোড়ায় চেপে বস। আমরা রওয়ানা করব।’
মেয়েটা আরমানের দিকে খঞ্জর বাড়িয়ে বলল, ‘রাখ। নয়ত আমি তোমায় মেরে ফেলতে পারি।’
‘তার প্রয়োজন নেই। বরং আমার তারবারীও তুমি নিয়ে নিতে পার। তুমি আমায় হত্যা করতে পারবে না।’
উপহাস নয়, দু’জনের কণ্ঠেই ছিল দৃঢ়তা। দু’জন দু’টো ঘোড়ায় চেপে তৃতীয় ঘোড়াটা সাথে নিয়ে চলতে লাগল।
সুর্যোদয়ের আগেই ওরা অনেক দূর এগিয়ে গেল। আশাপাশে কোন খ্রিষ্টান সৈন্য দেখা যায়নি। পথে একটা মুসলিম সেনাদলের দেখা পেয়েছিল ওরা। মুসলিম সেনাদলটির কাছে গিয়ে আরমান কী যেন বলে ফিরে এসে আবার চলতে লাগল।
এপ্রিলের উত্তপ্ত সূর্য উঠে এসেছে মাথার ওপর। মুখ মাথা ঢেকে ওরা চলা অব্যাহত রাখল। দূরের বালুকারাশি দেখে মনে হয় এক সাগর টলটলে স্বচ্ছ পানি। বাঁয়ে পাথুরে পর্বত।
দু’জন নিরবে চলছে। কেউ কারও সাথে কথা বলছে না। এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহ ওদের বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। একটা লাশও অক্ষত নেই। শৃগাল শকুন খুবলে নিয়েছে ওদের মাংস। কোন কোন লাশের শুধু হাড়গুলো পড়ে আছে।
আরমান মেয়েটাকে বলল, ‘এরা তোমার জাতির সৈনিক। বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানী, ইটালী সহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসে যে সব রাজরাজড়া মুসলিম বিশ্বকে নিশ্চিহ্ন করতে চাইছে এরা তাদেরই ইচ্ছের বলী।’
মেয়েটা নিশ্চুপ। বার বার তাকাচ্ছে আরমানের দিকে। মাথা ঝুঁকিয়ে কি যেন ভাবছে আবার।
আরমান পাহাড়ের দিকে গতি ফেরাল। সে জানত, ওখানে পানি এবং ছায়া দুটোই পাওয়া যাবে।
পশ্চিম আকাশে নেমে এসেছে সূর্য।
ওরা পার্বত্য এলাকায় পৌঁছল। খুঁজে বের করল ঘেষো জমিন। আশাপাশে কিছু বৃক্ষও রয়েছে। পাহাড় কেটে বয়ে চলছে স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা।
ঘোড়া থেকে নামল ওরা। নিজেরা পানি পান করল। ঘোড়াগুলোকে পানি খাইয়ে ছেড়ে দিল ঘেসো মাঠে।
‘কে তুমি?’ যুবতী প্রশ্ন করল। ‘তোমার নাম কি? কোথায় থাক?’
‘আমি মুসলমান। নাম আরমান। থাকি সিরিয়া।’
ঘুমের ঘোরে তুমি কার সাথে কথা বলছিলে?’
‘মনে নেই। হয়ত স্বপ্ন দেখছিলাম। সঙ্গীরা বলে, আমি নাকি ঘুমের মধ্যে কথা বলি।’
‘তোমার মা আছে, বোন আছে? সম্ভবতঃ ঘুমে তাদেরকে স্মরণ করছিলে।’
‘এক সময় ছিল।’ আরমানের কণ্ঠে বিষন্নতা। ‘এখনও ওদের স্বপ্নে দেখি।’
মেয়েটা আরও অনেক কিছু জানতে চাইল। কিন্তু জবাব না দিয়ে আরমানের বলল, ‘তুমি নিজের ব্যাপারে মিথ্যে বলেছ। আর তোমার পরিচয় জানতে চাইব না। তোমাকে গোয়েন্দা সংস্থার হাতে তুলে দিয়ে ফিরে আসব। নিজের ব্যাপারে সত্য বলতে চাইলে বলতে পার। তবে তুমি খ্রিষ্টানদের গুপ্তচর নও একথা বল না।’
‘তুমি ঠিকই ধরেছ। আমি গোয়েন্দা, নাম আইওনা।’
‘তুমি কি কাজ কর তোমার পিতা মাতা জানেন?’
‘আমাদের পিতা মাতা নেই। কোনদিন আমি ওদের চেহারাও দেখিনি। গোয়েন্দা সংস্থা আমার মা, গোয়েন্দা প্রধান হরমুন আমার পিতা।’
মেয়েটা প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘আমার সঙ্গী একটা মেয়ে একজন মুসলমান সৈন্যকে বাঁচানোর জন্য আত্মহত্যা করেছে। আমি তখন আশ্চর্য হয়েছিলাম। একজন খ্রিষ্টান যুবতী এক মুসলমানের জন্য এতবড় ত্যাগ স্বীকার করতে পারে? এখন বুঝতে পারছি, এমনটি হতে পারে।
সেই মুসলমান সৈন্যটিও তোমার মত ডাকাতদের সাথে যুদ্ধ করে মেয়েটির জীবন রক্ষা করেছিল। আহত হওয়ায় মেয়েটা তাকে সুবাক নিয়ে এসেছিল। তোমার মতই সে মেয়েটার রূপ যৌবনের প্রতি দৃষ্টিও দেয়নি। অথচ ও ছিল ভীষণ সুন্দরী। আমিও ওর মত তোমার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে পারি।’
‘আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। আমরা কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালন করে থাকি। আমার কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে আগেও তোমায় কোথাও দেখেছি। হয়ত এ আমার আবেগপ্রবণ মনের কল্পনা, হয়তবা সত্যি।’
‘দেখে থাকবে। তুমি মিসর গিয়েছ না, ওখানেই দেখেছ হয়ত।’
‘মিসর আমি গিয়েছি ঠিক, কিন্তু তোমাকে আমি মিশরে দেখিনি।
মুচকি হেসে আইওনা বলল, ‘আমার ব্যাপারে তোমার কী ধারণা। আমি কি সুন্দরী নই?’
‘তুমি সুন্দরী অস্বীকার করি না।’ আরমানের কণ্ঠে গাঢ়তা। ‘বুঝেছি কেন এ প্রশ্ন করেছ। ভেবে আশ্চর্য হচ্ছ, তোমার খ্রিষ্টান ভায়েরা তোমার সাথে যে ব্যবহার করতে চেয়েছে আমি কেন তা করিনি। এখনও হয়ত মনে করছ আমি তোমার সাথে প্রতারণা করছি। সুবাক নিয়ে তোমায় নষ্ট করব। তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোমায় বিয়ে করব অথবা বিক্রি করে দেব।
তোমার এ আশঙ্কা অমূলক। নারী সে নিজের ধর্মেরই হোক বা অন্য ধর্মের, আমি কাউকে খারাপ চোখে দেখতে অভ্যস্ত নই।
আমার বয়স যখন চৌদ্দ, আমার এক বোনকে অপহরণ করা হয়েছিল। ওর বয়স ছিল সাত বছর। ষোল বছর পেরিয়ে গেছে। ওকে অপহণ করেছে খ্রিষ্টানরা। জানি না বেঁচে আছে কি মরে গেছে। বেঁচে থাকলেও আছে কোন আমীরের হারেমে বা হয়ত তোমার মত গোয়েন্দাগিরী করেই ফিরছে।
এ জন্য প্রতিটি মেয়েকেই আমার বোন মনে হয়। তাকে খারাপ চোখে দেখিনি। সে আমার বোনও তো হতে পারে।
শুধু নিরাপত্তার জন্যই তোমায় সুবাক নিয়ে যাচ্ছি। আমি জানি মরুভূমিতে একা ছেড়ে দিলে তোমার কি অবস্থা হবে। কারও হাতে পড়লে তোমার খ্রিষ্টান ভায়েরা যা করতে চেয়েছিল তাই হত।
আমাকে রূপের ফাঁদে জড়ানোর চেষ্টা করো না। সে অনুভূতির দিক থেকে আমি মৃত। খ্রিষ্টানদের পেছনে ঘোড়া ছুটিয়ে ওদের রক্ত দিয়ে মরুর বালুকারাশি ভিজিয়েই শুধু আমি আনন্দ পাই।’
হতবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইল আইওনা। চোখে মদির আবেশ। তার সাথে তো এভাবে কেউ কথা বলেনি।
ওকে অশ্লীলতা আর বেহায়াপনার ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। ও নিজে এক চমৎকার প্রতারণা।
মদ্যপ হয়ে ওর রূপের মোহে ডুবে যায় মানুষ। ও নৈতিকতা আর সতীত্ব বঞ্চিত। ট্রেনিং শেষে অন্য মেয়েদের মত ও নিজেকে পুরুষের হৃদয়রানী ভেবেছে।
পিতা মাতার কথা ওর মনে নেই। বাড়ি কোথায় জানে না। আরমানের আবেগপ্রবণ কথাগুলো ওর ভেতর উসকে দিল নারীত্বের অনুভূতি। ভাবনার অতলে হারিয়ে গেল ও। ভুলে গেল আরমানের উপস্থিতি।
চিন্তার গহীন সাগরের অতল থেকে ও বলল, ‘এক ভয়ঙ্কর স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। আমাকে কোন এক বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। তখন বয়স কত ছিল মনে নেই।’
দু’হাতে মাথা চেপে ধরল ও। দু মুঠোয় চুল চেপে মাথা ঝাঁকুনি দিতে লাগল। হারানো অতীত স্মরণ করার চেষ্টা করছে।
শেষে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কিছু মনে আসছে না। মদ, বিলাসিতা আর অশ্লীলতার গহীনে হারিয়ে গেছে আমার অতীত। আমার পিতা মাতা কে, কেমন ছিলেন কখনও ভাবিনি। বাবা মায়ের প্রয়োজনই হয়নি।
কোন কালে আমার ভেতর মানবিক অনুভূতি ছিল না। পুরুষ যে পিতা এবং ভাইও হতে পারে জানি না।
পুরুষ আমাকে মনে করে ভোগের সামগ্রী। আমি ওদের ব্যবহার করি। আমার রূপ যৌবন দিয়ে যাকে বশ করতে না পারি তার জন্য রয়েছে মদ এবং হাশিশ।
তুমি আমার ভেতর এমন অনুভূতি সৃষ্টি করেছ, যা মা, বাবা এবং ভাই বোনের স্নেহের পিয়াসী।’
ওর অস্থিরতা বেড়ে গেল। কথা বলতে লাগল থেমে থেমে। শেষে একদম চুপ হয়ে গেল। কখনও তাকাচ্ছে আরমানের দিকে কখনও দু’হাতে ধরে মাথা ঝাঁকুনি দিচ্ছে।
ও ঘুরে ফিরছিল হারানো অতীত আর বর্তমানের মাঝে। আরমান বলল, ‘চল রওয়ানা হই।’
সহজ সরল বালিকার মত ও ঘোড়ায় চেপে বসল। পার্বত্য এলাকা ছেড়ে অনেক দূর এগিয়ে গেল ওরা। তখনও ও আরমানের দিকে তাকিয়ে আছে।
একবার শুধু হেসে বলল, ‘পুরুষের কথা এবং প্রতিশ্রুতি আমি কখনই বিশ্বাস করিনি। বুঝতে পারছি না কেন যেন মনে হচ্ছে তোমার সাথে যাওয়া উচিৎ।’
আরমান ওর দিকে চেয়ে মৃদু হাসল শুধু।