» » সুবাক দুর্গে আক্রমণ

বর্ণাকার

হাদিদকে ক্যাম্প থেকে বের করাটাই ছিল বড় সমস্যা। ক্যাম্পে পাহারার কড়াকড়ি নেই ঠিক, কিন্তু সিনথিয়াকে সেখানে দেখলে বিপর্যয়ের সম্ভাবনা ষোল আনা।

ওখানে যারা থাকে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ওদের বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়। ক্যাম্পে আনা হয় সূর্যাস্তের পর।

একজন প্রহরী প্রতিদিন পাশের ডাক্তারখানায় নিয়ে যেত আহত বা অসুস্থ বন্দীদের।

পরদিন নেমসিকে নিয়ে ক্যাম্পের কাছে গেল সিনথিয়া। পঁচিশ ত্রিশজন রোগীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ডাক্তারের কাছে। প্রহরীর হাতে লাঠি। দ্রুত চলার জন্য সে রোগীদের পিটাচ্ছিল।

মেয়ে দু’জন চলে এল রোগীদের কাছে। ভাব দেখাচ্ছে যেন এ দৃশ্য উপভোগ করছে ওরা। সবাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে  দেখছে।

হঠাৎ করেই চমকে উঠল সিনথিয়া। ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে হাদিদ। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তার। চেহারায় আগের সেই জৌলুস নেই। ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটছে। কাপড়ে চটচটে রক্তের দাগ।

কান্না পেল সিনথিয়ার। অশ্রু এসে জমা হতে লাগল দু’চোখ ভরে।

ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল হাদিদ। সামনে চলে গেল রোগীর দল। নেমসি প্রহরীর সাথে কথা জুড়ে দিল। কথার মাঝে প্রকাশ পাচ্ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা।

ওদের বাকচাতুর্যে পটে গেল প্রহরী। দুই যুবতীর কাণ্ডকারখানা দেখছিল প্রহরী, সিনথায়া হঠাৎ করেই বলল, ‘এই, ওদের সাথে আমাদের একটু মজা করতে দেবে?’

নেমসি বলল, ‘ও মাই গড, কি বিচ্ছিরি! তুই যা, আমি ওদের কাছে যাব না।’

সিনথিয়া এগিয়ে গেল রোগীদের পাশে। প্রহরী কোন আপত্তি করল না। নেসমি প্রহরীর সাথে গল্পে মেতে উঠল।

ডিসপেনসারিতে রোগীর প্রচণ্ড ভীড়। বন্দীদেরকে বাইরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। নেমসি তখনো প্রহরীর সাথে গল্প চালিয়ে যাচ্ছে। বন্দীদের নিয়ে তামাশা করছে সিনথিয়া।

দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে হাদিদ। ফ্যকাশে চেহারা। সিনথিয়া তাকে চোখের ইশারায় কাছে ডাকল। নিয়ে গেল আড়ালে। বলল, ‘কর্তৃপক্ষ তোমার সাথে দেখা করতে আমাকে নিষেধ করেছেন। বসো, আমরা যে কথা বলছি কেউ যেন বুঝতে না পারে।’

‘তোমার কর্তৃপক্ষ আর তোমার ওপর গজব পড়ুক।’ ক্ষোভের সাথে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল হাদিদ। ‘কোন প্রতিদানের আশায় তোমাকে দস্যুদের কবল থেকে রক্ষা করিনি। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি। কর্তব্যপরায়ণ সব লোকদের সাথেই কি তোমরা এমন ব্যবহার কর?’

‘চুপ কর হাদিদ।’ সিনথিয়ার কান্না ভেজা কণ্ঠ, ‘এসব কথা পরে হবে। রাতে তুমি কোথায় থাক? আজই তোমাকে এ নরক থেকে বের করতে হবে।’

হাদিদ ওর সাথে কথা বলতে চাচ্ছিল না। সিনথিয়ার চোখে বেদনার সুনীল টলমলে জল দেখে বুঝল, ও আসলেই প্রতারণা করছে না।

হাদিদ শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করল ওকে। রাতে কোথায় থাকে বলল, বলল, ‘এখান থেকে পালানো কোন কঠিন কাজ নয়। কিন্তু যাব কোথায়?’

এর পর পালানোর একটা পরিকল্পনা তৈরী করল ওরা, যা এ দু’জন ছাড়া আর কেউ টেরও পেল না।

* * *

বেগার ক্যাম্পে মরার মত ঘুমিয়ে আছে বন্দীরা। প্রহরীও ঘুমিয়ে আছে।

এখান থেকে কেউ কখনও পালায়নি। পালিয়ে যাবেই বা কোথায়? বন্দীদের কোন রেজিষ্টার নেই বলে দু’একজন পালালেও কেউ জানতে পারে না।

রাতের প্রথম প্রহর শেষ হয়েছে। পুরনো ছেঁড়া এক তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক। হামাগুড়ি দিয়ে তাঁবুর আড়ালে চলে গেল। এখন প্রহরী সজাগ থাকলেও তাকে আর দেখতে পাবে না।

ক্যান্পের গেট পেরিয়ে এগিয়ে চলল লোকটি।

ঘুটঘুটে অন্ধকার। সামনে খেজুর বাগানের নীচে আঁধার আরো ঘন। কিছুই দেখা যায় না। ও খেজুর বাগানের দিকে পা চালাল।

ওখানে আপাদমস্তক মোটা কাপড় শরীরে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামূর্তি।

তাঁবু থেকে বের হওয়া লোকটা বাগানে ঢুকতেই সন্তর্পণে এগিয়ে এল ছায়ামূর্তি। কাছে এসে বলল, ‘দ্রুত হাঁটতে পারবে হাদিদ?’

‘চেষ্টা করব।’

সিনথিয়া হাদিদের হাত চেপে ধরে বলল, ‘তাহলে চল। সাবধানে হাঁটতে হবে, নাইটগার্ডের চোখে পড়লে বিপদ হবে।’

ক্যাম্প পেছনে ফেলে অনেক দুরে চলে এল ওরা, সামনে বিশাল অনাবাদী ভূমি।

হাদিদ দ্রুত হাঁটতে পারছে না। সিনথিয়া ওকে সাহায্য কারছে হাঁটতে।

চলতে চলতে গোয়েন্দা প্রধান এবং অফিসাররা কি কি বলেছে একে একে সব বলল সিনথিয়া। হাদিদের সকল সন্দেহ দূর হয়ে গেল।

সামনে শহর। শহরে প্রবেশ করেই একটা গলিতে ঢুকল ওরা। কিছুদূর এগিয়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে ডাক্তারের বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়াল।

হাদিদকে অন্ধকারে দাঁড় করিয়ে রেখে এগিয়ে গেল সিনথিয়া। দরজার কড়া নাড়ল তিন চারবার।

বেতরে কারও পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিলেন ডাক্তার। দরজা খুলতেই সিনথিয়া দ্রুত হাদিদকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।

হাদিদের ক্ষতস্থান পরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন, ‘সুস্থ হতে কমপক্ষে দিন বিশেষ লাগবে।’

সমস্যায় পড়ল সিনথিয়া। হাদিদকে এতদিন কোথায় লুকিয়ে রাখবে? বেগার ক্যাম্পে নেয়া যাবে না। সিদ্ধান্ত নেয়ার শক্তি লোপ পেল ওর।

ততক্ষণে ডাক্তার হাদিদের ক্ষতস্থানে ব্যাণ্ডেজ করে দিয়েছেন। বললেন, ‘ওকে ভাল খাবার দিতে হবে।’

সিনথিয়া ডাক্তারকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, ‘ও তো গরীব, ও এত ভাল খাবার পাবে কই? আর ওর এমন কেউ নেই যে ওকে দেখাশোনা করবে। আমার বাড়িতেও ওকে নিতে পারছি না।

এক কাজ করুন, ওকে বরং এখানেই রাখুন। তাতে বারবার ওকে আনা নেয়ার ঝামেলাও কমবে, আর ঠিকমত দেখাশোনা করারও সুবিধা হবে। আমার কাছে বিনিময় এবং পারিশ্রমিক যা চাইবেন দেব।’

ডাক্তার অস্বাভাবিক পারিশ্রমিক দাবী করল। শুনে চোখ কপালে তুলল সিনথিয়া। বলল, ‘ও মাই গড, বলেন কি আপনি?’

ডাক্তার বলল, ‘আমাকে দিয়ে একটা বিপজ্জনক কাজ করাচ্ছেন। আমি জানি একে বেগার ক্যাম্প থেকে আনা হয়েছে। ও একজন মিসরীয় সৈনিক। আপনার সাথে ওর সম্পর্ক কী, পারিশ্রমিক বেশী হলে এই গোপন তথ্য আমার ঘরের বাইরে যাবে না।’

‘আমি রাজি। তবে এ গোপনীয়তা প্রকাশ হয়ে পড়লে আপনিও বাঁচতে পারবেন না। ওর পরিচয় যখন পেয়ছেন তখন আশা করি আমার পরিচয়ও আপনার জানা আছে।’

ডাক্তার হাদিদকে অন্য এক কক্ষে নিয়ে গেল। বলল, ‘সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তুমি এখানেই থাকবে।’

দুধ এবং ফল এনে দিল ভেতর থেকে। দরজা বন্ধ করে ফিরে গেল সিনথিয়ার কাছে।

পরদিন সিনথিয়া এবং তার বান্ধবী হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পের কাছে গেল। দেখল ঘুরে ফিরে। কথা বলল প্রহরীর সাথে। কথায় কথায় জেনে নিল হাদিদ যে পালিয়েছে কেউ টের পায়নি।

দিন গিয়ে রাত এল। সিনথিয়ার মত পারিাশ্রমিক পেয়ে ডাক্তার মহাখুশি। মন দিয়ে হাদিদের চিকিৎসা করছে, প্রয়োজনীয় খাবার দিচ্ছে। নিজেই সেবা শুশ্রুষা করছে।

প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ডাক্তারখানায় আসত সিনথিয়া। হাদিদের সাথে কথা বলত। সময় কাটাত ডাক্তারের ঘরে।

এভাবে বিশদিন কেটে গেল। হাদিদ এখন সুস্থ।

সিনথিয়া ডাক্তারকে বলল, ‘কাল রাতে ওকে নিয়ে যাব।’

সিনথিয়ার প্রতি দুর্বল ছিল একজন জুনিয়র অফিসার। ওকে ব্যবহার করল সিনথিয়া। অফিসারকে ভালবাসার কথা বলল, মদ খাওয়াল তাকে।

অতিরিক্ত মদ খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল অফিসার। তার দেহ থেকে সামরিক উর্দি খুলে নিয়ে হাদিদকে পরাল সে পোশাক।

শহরের চারপাশে ছিল মাটির উঁটু দেয়াল। ফটক খোলা হত দিনে। রাতে থাকত বন্ধ।

সালাহুদ্দীনের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সৈন্যরা ছিল বেজায় তৎপর। ওরা ফটক দিয়ে যাওয়া আসা করছিল হরদম।

সূর্য এখনও ডুবেনি। দুর্গের মূল ফটকের দিকে যাচ্ছিল একজন অশ্বারোহী। পরনে খ্রিষ্টান সেনাবাহিনীর উর্দি। কোমরে ঝুলানো খ্রিষ্টান সৈন্যদের তারবারী। ঝুলছে মুসলমানদের মত বাঁকা করে নয়, সোজা।

খোলা ফটক। উটের বহর যুদ্ধের রসদ নিয়ে বাইরে যাচ্ছে।

অশ্বারোহী পৌঁছল ফটকে। এ সময় খ্রিষ্টানদের গোয়োন্দা প্রধান ভেতরে ঢুকছিলেন, তাকালেন অশ্বারোহীর দিকে। মৃদু হাসলেন তিনি। অফিসার জবাবে হাসল না, বরং তাকে অগ্রাহ্য করেই যেন ফটক পেরোল।

হরমুনের কি মনে হল, ঘোড়ার বলগা টেনে ধরলেন তিনি। কয়েক কদম এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ঘোড়া। তিনি ঘোড়ার মুখ ঘুরালেন।

সিনথিয়া দাঁড়িয়ে আছে শ’তিনেক গজ দূরে। হরমুনকে দেখে আড়ালে সরে গেল সে।

ফটকের দিকে ঘোড়া ছুটালেন গোয়েন্দা প্রধান। একটা সন্দেহ দূর করতে চাইছেন। বাইরে এসে দৃষ্টি ছুড়লেন। অশ্বারোহী অনেক দূর চলে গেছে। তাকিয়ে রইলেন তিনি, ঘোড়সওয়ার হারিয়ে গেল দৃষ্টির আড়ালে।

সিনথিয়ার সহযোগিতায় হাদিদ পালিয়ে গেছে এ কথা আর জানা হল না হরমুনের। কিন্তু সন্দেহটা মনের ভেতর খচখচ করতে লাগল।

ঘোড়া ঘুরিয়ে গোয়েন্দা প্রদান ছুটলেন মুসলিম ক্যাম্পের দিকে। হাদিদের হুলীয়া বর্ণনা করে কমাণ্ডারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এমন কেউ আছে তোমার এখানে?’

কমাণ্ডার খোঁজ নিল। দেখা গেল এমন কোন লোক নেই এখানে। হরমুনের সন্দেহ দৃঢ় হল। ফটকে যাকে দেখেছেন সে হাদিদ কিনা আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি সিনথিয়ার কক্ষে গেলেন।

দু’হাতে মাথা চেপে ধরে কাঁদছে মেয়েটা।

‘তুমিই কি ওকে পালাতে সাহায্য করেছ?’ গর্জে উঠল হরমুন।

সিনথিয়া ধীরে ধীরে মাথা তুলল।

‘মিথ্যে বলো না, আমি তদন্ত করে সব প্রমাণ করব।’

‘আপনার তদন্তের প্রয়োজন নেই। আমার মিথ্যে বলারও কিছু নেই। আমার জীবনটাই রাজকীয় মিথ্যা, আমি হচ্ছি চোখ ধাঁধাঁনো প্রতারণা। আমার আত্মার মুক্তির জন্য সত্য কথা বলে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে আমার কোন আপত্তি নেই।’

টলমলে পায়ে উঠে দাঁড়াল সিনথিয়া। কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল তার। পাশের টেবিলে শূন্য গ্লাসে কয়েক ফোটা পানি।

কাঁপা হাতে গ্লাস তুলে হরমুনের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছি। গ্লাসের অবশিষ্ট ক’ফোটা পানি এর সাক্ষী। আমি জাতির সাথে বেঈমানী করেছি বা বন্দী শত্রুকে পালাতে সাহায্য করেছি বলে এ শাস্তি নেইনি। বরং এ অপবিত্র দেহ দিয়ে এমন মানুষের সাথে প্রতারণা করেছি যারা প্রতারণা বা ধোকা বুঝে না।

আমাদের তো কোন সম্ভ্রম নেই। কিন্তু ওরা চারজন আমাদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য দশ বারোজন দস্যুর মোকাবিলা করেছে। দ্বিধাহীন চিত্তে বরণ করে নিয়েছে আপন মৃত্যু। অথচ আমাদেরকে ডাকাতের হাতে তুলে দিলে ওরা কোন ক্ষতিরই সম্মুখীন হত না।

এরপর এক ব্যক্তি নিজে আহত হয়ে আমাকে দস্যুদের কবল থেকে মুক্ত করেছে। সে জানত, আমি তার শত্রু, তবু আমার জন্য সে জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিল। অথচ আমার প্রতি তার কোন লোভ ছিল না।

তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝেছি সত্য মিথ্যার ফারাক। ঘৃণা এবং ভালবাসার পার্থক্য। আমি সত্য প্রকাশ করে মরতে পারছি, এ জন্য আমি আনন্দিত। এ মৃত্যু প্রশান্তির, এ মৃত্যু গৌরবের।’

ও পড়ে যাচ্ছিল, গ্লাস সহ ওকে ধরে পেলল হরমুন। ঝটকা মেরে হরমুনের হাত থেকে মুক্ত হয়ে সরে গেল ও।

অস্ফুট স্বরে বলল, ‘আমার দেহ স্পর্শ করো না। এ দেহ এখন তোমাদের কোন কাজে আসবে না। তোমাদের প্রয়োজন এক অপবিত্র দেহ। এ বিষে আমার দেহ পবিত্র হয়ে গেছে।

ওকে আমি পালাতে সাহায্য করেছি। বিশ দিন লুকিয়ে রেখে চিকিৎসা করিয়েছি। অস্ত্র ও উর্দি চুরি করে ওকে দিয়েছি। আমার নিজের ঘোড়া দিয়েছি ওকে। ওর সাথে আমি যেতে পারছি না, ওকে ছাড়া থাকতেও পারছি না— এ জন্য বিষ খেয়েছি।’

বিছানায় পড়ে গেল ও। হরমুনের কানে বাজতে লাগল ওর অন্তিম শব্দগুলো।

সত্য বলার পর মৃত্যু কত প্রশান্তির হয় তাই তাকিয়ে দেখছিল হরমুন। চির শান্তির কোলে ঘুমিয়ে পড়ল সিনথিয়া, সেদিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল হরমুন।

সিনথিয়ার শেষকৃত্যের পর একজন অফিসার বলল, ‘ওর কোন আত্মীয় স্বজন থাকলে মৃত্যু সংবাদ পৌঁছে দেয়া উচিত।’

‘আমরাই ওর আত্মীয়।’ জবাবে বলল হরমুন। ‘ওর বয়স যখন এগার, এক কাফেলা থেকে ওকে অপহরণ করা হয়েছিল।’

সুলতানের সেনাবাহিনী মিসর ছেড়েছে তিনদিন আগে। পথে বাধা দেয়ার জন্য খ্রিষ্টানদের পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সুবাকের বেশীর ভাগ সৈন্য পাঠানো হয়েছে ক্রাকে। নুরুদ্দীন জঙ্গীকে ঠেকানোর জন্য কিছু গেছে সিরিয়ার দিকে। সুসজ্জিত খ্রিষ্টান বাহিনী সালাহুদ্দীনকে বাধা দেয়ার জন্য এখন পুরোপুরি প্রস্তুত।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী নিজের বাহিনীকে তিন ভাগে ভাগ করলেন। খানিকটা দূরুত্ব বজায় রেখে ওদের এগিয়ে চলতে নির্দেশ দিলেন। তিন দলে কমাণ্ডারদেরকে ডেকে পাঠালেন নিজের তাঁবুতে।

সবাই তাঁবুতে একত্রিত হল। সুলতান বললেন, ‘এবার গোপন তথ্য প্রকাশ করার সময় এসেছে। আমি বলেছিলাম ক্রাক আক্রমণ করব। কিন্তু তোমাদেরকে অন্য পথে নিয়ে এসেছি। এতে তোমরা নিশ্চয় আশ্চর্য হচ্ছ। আসলে আমি ক্রাকে আক্রমণ করব না। আমাদের লক্ষ্য হল সুবাক।

খ্রিষ্টান গোয়েন্দাদেরকে পাশের কামরায় রেখে যুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছিলাম, মৃত্যু দণ্ড না দিয়ে ওদের মুক্তি দিয়েছিলাম, ওদেরকে সুবাক পৌঁছে দেয়ার জন্য দেহরক্ষী দিয়েছিলাম—এর সব কিছুইতেই তোমরা আশ্চর্য হয়েছ।

এবার শোন এর হাকীকত। ওদের সাথে যে চারজন রক্ষী দিয়েছিলাম ওদের একজন কাল রাতে সুবাক থেকে ফিরে এসেছে। ডিউক গিয়ে আমাদের কাছ থেকে শোনা যুদ্ধের সব পরিকল্পনা ওদের কাছে ফাঁস করে দিয়েছে। আমি জানতাম এমনটি হবে।

আমি যেভাবে চেয়েছিলাম ঠিক সেভাবেই ওরা সৈন্যদের ছড়িয়ে দিয়েছে। এখন আমাদের ফৌজের বাঁয়ের অংশ থেকে চার মাইল দূরে রয়েছে খ্রিষ্টানদের বিশাল বাহিনী।

বাম অংশের কমাণ্ডারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি দু’মাইল সোজাসুজি এগিয়ে যাবে। এরপর বাঁয়ে  মোড় নেবে। চার মাইল এগিয়ে আবার বায়ে মোড় নেবে। দেখবে শত্রু সৈন্য বিশ্রাম নিচ্ছে। তীব্র গতিতে কমাণ্ডো হামলা করবে ওদের ওপর। পথের সবকিছু তছনছ করে আগের জায়গায় ফিরে আসবে।

দ্বিতীয় দল সন্ধ্যার পর আট মাইল সোজা এগিয়ে বাঁয়ের মোড় নেবে। ওদের রসদ এবং খাদ্য সামগ্রী পাবে ওখানে। তোমরা তখন থাকবে শত্রুর পেছন দিকে। দিনে দুশমনের বাম অংশের পিছনে ধাওয়া করবে, কিন্তু সামনা সামনি যুদ্ধ করবে না।

ওরা মোকাবেলা করতে শুরু করলে পিছনে হটবে। আস্তে আস্তে অনেক দূরে পেছনে চলে আসবে। যেখানে এসে দেখবে দুটো পাহাড় এক জায়গায় মিলেছে, পাহাড়ের সেই সন্ধিস্থলে নিয়ে আসবে শত্রু সেনাদের। তারপর পাথরকুচির ফাঁক গলে সরে যাবে আরও পেছনে।

মূল আক্রমণ করবে রাতে। খ্রিষ্টান সেনাবাহিনী এগিয়ে এলে মাঝের অংশ পেছন থেকে ওদেরকে আক্রমণ করবে। আমি এক অংশ নিয়ে রাতেই রওয়ানা করব। কাল দুপুর নাগাদ সুবাক অবরোধ করব। বাকী দু’ভাগ মরুভূমির বিশাল এলাকায় ওদের ব্যস্ত রাখবে।

ওদের কাছে যেন রসদ পৌঁছতে না পারে। পানির সবগুলো ঝর্ণা দখল করে নেবে। আক্রমণ করবে একপাশ থেকে। যুদ্ধ করার জন্য কোথাও দাঁড়াবে না। সুইসাইড স্কোয়াড প্রতি রাতেই ওদের রসদ, পশু এবং খাদ্য বহরের উপর অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করবে।’

সুবাক অবরোধ করলেন সুলতান সালাহুদ্দীন, ওখানকার বেশীর ভাগ খ্রিষ্টান ফৌজকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল ক্রাকের পথে।

মরুভূমিতে মুসলিম সেনাবাহিনী ওদের এখান থেকে ওখানে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল।

রসদ নেই, পানি নেই। মুসলমানরা সামনাসামনি যুদ্ধ করছে না। সুবাক রক্ষার জন্য এগিয়ে যাবে, মুসলিম বাহিনী সে সুযোগও দিচ্ছে না। বলতে গেলে খ্রিষ্টান বাহিনীর এখন ত্রিশঙ্কু অবস্থা।

সুবাক কেল্লার অল্প সংখ্যক খ্রিষ্টান সৈন্য পাঁচিলে উঠে তীর নিক্ষেপ করছিল সর্বশক্তি দিয়ে। কিন্তু স্রোতের মত টুটে পড়ল মুসলিম ফৌজ।

একবার এদিক থেকে আবার ওদিক থেকে অব্যাহত হামলা চালাতে থাকল। দেড় মাস অবরোধের পর দেয়ার ভেঙ্গে শহরে প্রবেশ করলেন সুলতান সালাহুদ্দীন।

পাহাড় ও মরুভূমিতে ধাওয়া খাওয়া বিচ্ছিন্ন খ্রিষ্টান বাহিনী ধীরে ধীরে সমবেত হল ক্রাকের দূর্গে। কখন সুলতান ক্রাক আক্রমণ করবেন সে অপেক্ষায় বসে রইল ওরা।

রক্তের বাঁধন

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়। সুবাক দুর্গ সালাহুদ্দীনের পদানত হয়েছিল ডিসেম্বরে। শহর এখনও অশান্ত। কিছু কিছু খ্রিষ্টান পরিবার এখনও পালানোর চেষ্টা করছে।

এতদিন মুসলমানরা ওদের জন্য শান্তিতে থাকতে পারেনি। শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল অনেক পরিবার। সুবাকের মাটি লাল হয়ে উঠেছিল মুসলমানদের রক্তে। শাসকদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় লুণ্ঠিত হয়েছিল তাদের ঘরবাড়ি।

মুসলমানরা সুবাক দখল করে নিয়েছে। অত্যাচারিত মুসলমানদের প্রতিশোধের ভয়ে পালাচ্ছে এখন খ্রিষ্টানরা।

সুলতান ঘোষণা করলেন, ‘কোন খ্রিষ্টান পরিবারকে পালাতে হবে না। নিশ্চিন্তে ওরা নিজেদের বাড়িতে থাকতে পারবে। ওদেরকে কেউ উত্যক্ত করবে না।’

তিনি পলায়নপর খ্রিষ্টানদের বাধা দেয়ার জন্য মুসলিম সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন। নির্দেশ পেয়ে সৈন্যরা তৎপর হয়ে উঠল।

ওরা কাউকে পালিয়ে যেতে দিচ্ছে না। যারা পালিয়ে গেছে তাদের খুঁজে আনছে মরুভূমি আর উপত্যকা থেকে। ওদের ছেড়ে যাওয়া বাড়ি ঘর ওদের বুঝিয়ে দিয়ে বলছে, ‘তোমাদের কোন ভয় নেই। মুসলমানরা তোমাদের ওপর কোন প্রতিশোধ নেবে না। তোমরা নিশ্চিন্ত, স্বাধীন।’

খ্রিষ্টানরা তবুও ভয় পাচ্ছিল। মুসলমানদেরকে ওরা শান্তিতে থাকতে দেয়নি। প্রায় দু’হাজার মুসলমান এখনও বেগার ক্যাম্পে মানবেতর কাল কাটাচ্ছে।

সুবাক দখল করে সুলতান সালাহুদ্দীন প্রথমেই গিয়েছিলেন বেগার ক্যাম্পে। দু’হাজার বন্দী যেন  মৃত লাশ। ওদের পশুর মত খাটানো হয়েছে। শহরের নোংরা আবর্জনা বহন করেছে ওরা। অনেকে এসেছে যৌবনে। এখন বৃদ্ধ। ভুলে গেছে ওরা স্বাধীন  মানুষ ছিল এককালে।

খ্রিষ্টানদের সাথে প্রথম যুদ্ধে যেসব মুসলমান বন্দী হয়েছে তাদেরকে যেমন এখানে রাখা হয়েছে তেমনি শহর থেকে জোর করে ধরে আনা বন্দীদেরও এখানেই রাখা হয়েছে।

তবে কাফেলা থেকে অপহরণ করে আনা বন্দীর সংখ্যাই এখানে বেশী। এদের কেউ ছিল ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, কেউ সুন্দরী যুবতী কন্যার পিতা। খ্রিষ্টানরা ওদের ধন সম্পদ কেড়ে নিয়েছে এবং যুবতী মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। ওদের একমাত্র অপরাধ ছিল ওরা মুসলমান।

খ্রিষ্টানদের ভয়ে শহরের মুসলমানরা সব সময় তটস্ত হয়ে থাকত। ওরা নামাজ পড়ত গোপনে, কোরান তেলাওয়াত করত অনুচ্চ স্বরে। মেয়েদেরকে ঘরের বাইরে যেতে দিত না। সুন্দরী মেয়ে ওদের চোখে পড়লে রক্ষে নেই। যে কোন বাহানায় তুলে নিয়ে যাবে।

সম্ভ্রান্ত মুসলমানকেও একজন সাধারণ খ্রিষ্টানকে ঝুঁকে কুর্ণিশ করতে হত। এসব অত্যাচারের কথা মনে ছিল বলেই এখন প্রতিশোধের আশঙ্কায় খ্রিষ্টানরা সপরিবারে পালিয়ে যাচ্ছিল।

বেগার ক্যাম্পের দু’হাজার জীবন্ত লাশের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন সুলতান। তার চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু অশ্রু। এক সময় আবেগ ভরা কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘ওদের মুক্ত করার বিনিময়ে আমি সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ছেড়ে দিতে পারি।’

তিনি সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিলেন, ‘এরা এখানেই থাকবে। তোমরা এদের থাকা খাওয়া এবং সুচিকিৎসার ব্যবস্থা কর। এরা আগে সুস্থ হোক, তারপর সিদ্ধান্ত নেব এদের কি করা যায়।’