হাদিদের রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে। কিন্তু অত্যাধিক রক্ত ঝরায় দুর্বল হয়ে পড়েছেন জ্ঞান হারাচ্ছিলেন বার বার। মাথা ঝাঁকিয়ে তিনি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছিলেন।
ছোট এক খেজুর বাগানের কাছে এসে থামল তরুণী। আলগোছে নামাল তাকে। পানি পান করাল। জিনের সাথে বাঁধা থলে থেকে খাবার এনে দিল। আচ্ছন্নভাবটা কেটে গেল হাদিদের। স্বগতোক্তি করে বললেন, ‘আগে ছিলাম যুবতীর রক্ষী, এখন ওর বন্দী।’
সিনথিয়া তাকে শুইয়ে দিল। বিশ্রামের পর অনেকটাই সুস্থ বোধ করলেন হাদিদ।
‘আমরা সুবাকের কাছে চলে এসেছি। আর মাত্র একদিনের পথ।’ হাদিদ বললেন, ‘একটা ঘোড়া নিয়ে তুমি চলে যাও। আমি এখান থেকেই ফিরে যাব।’
‘তুমি একা যেতে পারবে না। মরে যাবে। এখান থেকে ফিরে যেতে চাইলে আমাকে সাথে নাও। তুমি আমায় একা ছাড়নি, আমিও তোমাকে নিঃসঙ্গ যেতে দেব না।’
‘আমি পুরুষ। একজন নারী আমার হেফাজত করছে এ কথা মানতে পারছি না। এরচে মরে যাওয়াই ভাল।’
‘যারা ঘরের চার দেয়ালে আবদ্ধ থাকে আমি তেমন মেয়ে নই। ওরা পুরুষের সহযোগিতা ছাড়া একপাও চলতে পারে না। মনে কর আমি এক পুরুষ সৈন্য। পার্থক্য, আমার অস্ত্র আমার রূপ, যৌবন, চোখের কটাক্ষ, মুখের হাসি আর কণ্ঠের মধু। তোমার মত আমিও কষ্ট সইতে পারি। ইচ্ছে করলে পায়ে হেঁটেও সুবাক যেতে পারব।’
‘আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। সিনথিয়া, তোমার এ আবেগকে আমি সম্মান করি। আমার প্রতি তোমার এ সহৃদয়তার কারণ কৃতজ্ঞতাবোধ। দস্যুরা আমাদের দু’জনকে অনেক কাছে নিয়ে এসেছে। অথচ আমরা উভয়েই জানি আমাদের দু’জনের পথ ভিন্ন। তুমি আমার জাতির মূল উপড়ে ফেলার চেষ্টা করছ, আর আমি ক’দিন পর তোমার দেশ আক্রমণ করার স্বপ্ন দেখছি।’
‘আপাততঃ আমার বন্ধুত্ব গ্রহণ কর। তুমি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে গিয়ে শত্রুতার কথা ভেবো।’
হাদিদের ঘাড়ের নীচে হাত দিয়ে যুবতী তাকে শোয়া থেকে তুলল। হাদিদ এখন হাঁটতে পারছেন।
ঘোড়া পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন তিনি। সিনথিয়া তাকে ঘোড়ায় চড়তে সাহায্য করল। উঠে বসলেন হাদিদ। সিনথিয়া তার পেছনে উঠতে চাইল। হাদিদ বাধা দিলেন।
‘তুমি অন্য ঘোড়ায় উঠ। আমি এখন একা চলতে পারব।’
‘না’ যুবতীর কণ্ঠে সিদ্ধান্তের সুর, ‘আমি এ ঘোড়ায়ই উঠব। তুমি লেগে থাকবে আমার বুকের সাথে।’
যুবতী হাদিদের পেছনে উঠে বসল। এক হাতে তাকে জড়িয়ে ধরল যুবতী। বাধা দিল হাদিদ।
‘আমাকে আমার শক্তিতে বসতে দাও।’
সিনথিয়া তার এ কথায় মোটেই আমল দিল না। জোর করে তাকে ধরে রাখল। হাদিদের মাথা রাখল নিজের কাঁধে। বলল, ‘জানি, বাজে মেয়ে মনে করে তুমি আমার কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছ।’
‘না, তা নয়। তুমি এক যুবতী। বাজে হও, আর ভাল হও সব অবস্থায় তোমার থেকে দুরে থাকা আমার কর্তব্য। আমি আমার পৌরুষের হেফাজত করতে চাই। ভেবে দেখো, তোমাকে কাছে পেতে চাইলে যে দু’রাত তুমি আমার বন্দিনী ছিলে সে সময় যা ইচ্ছে তাই করতে পারতাম। কিন্তু আমি শয়তানকে কাছে আসতে দেইনি। এখন মনে হচ্ছে আমি আমানতের খেয়ানত করছি। আমার ভেতর পাপের বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছে। তাই তোমার কাছ থেকে সরে থাকতে চাচ্ছি।’
‘তুমি তো আর পাথর নও। প্রতিটি পুরুষই আমার দিকে তাকায় কামনার দৃষ্টি নিয়ে। সামান্য বিনিময়ের পরিবর্তে তোমার জাতির লোকদের ঈমান কিনে নেয়ার অভিজ্ঞতা আমার নতুন নয়। কিন্তু তোমার কাছে তো আমি কোন বিনিময় দাবী করছি না।’
‘কিসের বিনিময়ে ঈমান ক্রয় কর তুমি?’
‘আমার কাঁধে মাথা রাখার, একটু পাশে বসার সুযোগ দিয়ে।’
‘ওদের কাছে ঈমানই ছিল না।’
‘যা-ই ছিল আমি নিয়ে নিয়েছি। ওদের বক্ষে ঢুকিয়ে দিয়েছি গাদ্দারী। আপন জাতির বিরুদ্ধে ওদের হৃদয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছি ঘৃণা।’
‘ওরা কারা?’
‘এখন বলব না। তোমাদের কর্তব্য তোমার কাছে যেমন প্রিয় আমার কর্তব্যও আমার কাছে।’
হাদিদ চুপ করে রইলেন। ক্রমশঃ আবার তিনি দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। ক্লান্তি অনুভব করলেন তিনি। তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল, তিনি চোখ বন্ধ করে নিলেন।
সিনথিয়া তাকে শক্ত করে ধরে আছে। যুবতীর দেহের উষ্ণ পরশ অনুভব করলেন তিনি। ওর রেশম কোমল চুল বাতাসে উড়ছিল। ছুঁয়ে যাচ্ছিল হাদিদের গাল, মুখ।
ঝিমুতে লাগলেন হাদিদ। অনেকক্ষণ পর চোখ খুললেন। দেখলেন, সূর্য মাথার ওপর উঠে এসেছে।
তিনি তৃষ্ণা অনুভব করলেন। বললেন, ‘সিনথিয়া, একটু পানি।’
সিনথিয়া পানি এগিয়ে দিল। পানিটুকু পান করে তিনি আবার তাকালেন সূর্যের দিকে। বললেন, ‘সিনথিয়া ঘোড়া জোরে ছুটাও। আরেকটু দ্রুত গেলে আশা করি সূর্যান্তের পরপরই আমরা সুবাকে পৌঁছতে পারব।
ঘোড়া ছোটাল যুবতী। দ্রুত পেছনে সরে যেতে লাগল মরুভূমির বিশাল বিস্তার।
* * *
সূর্য ডুবে গেছে। দরবার কক্ষে খ্রিষ্টান সম্রাট এবং সেনাপতিগণ বসে আছেন। ডিউক মুখ খুলল, ‘মেয়ে দু’টোর কি হয়েছে জানি না। আমি ওদের রক্ষা করার চেষ্টা করিনি। আপনাদের কাছে মূল্যবান তথ্য পৌঁছানো জরুরী মনে করে সুযোগ পাওয়ামাত্র একটা ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে এসেছি। ডাকাতদের আক্রমণের পর মেয়েদের দিকে একবারও তাকাইনি। তাকানোর কোন সময় ও পরিবেশ ছিল না। আমি যে আপনাদের কাছে পৌঁছতে পারব তারও কোন আশা ছিল না। যিশুর অসীম দয়ায় ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছি। নইলে এমন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না।
কেউ আমাকে অনুসরণ করেনি। আমার মনে হয় ওরা দস্যু নয়, সুলতানের পাঠানো লোক। ভেবে পাই না তিনি কেন আমাদের মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে মেয়েদেরকে নষ্ট করার এ পথ বেছে নিলেন। এখন বুঝতে পারছি, এর পুরোটাই ছিল সাজানো নাটক। মেয়েদের জন্যই এ নাটক সাজানো হয়েছিল। এদেরকে হত্যা না করে এখনও হয়ত ওদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে পশুগুলো।’
‘ডিউক, ওদের মুক্ত করার কোন ব্যবস্থা এখন আমরা নিতে পারছি না। এ ত্যাগ আমাদের স্বীকার করতেই হবে। আমাদের কাছে তো মেয়ের অভাব নেই। যুবতীদের ব্যবহার করে আমরা যে সাফল্য লাভ করেছি সে কথা বিবেচনা করে আমরা আরও অনেক মেয়েকে ট্রনিং দিয়ে তৈরী করেছি। ওদের কথা বাদ দিয়ে এবার তোমার মূল্যবান গোপন সংবাদের কথা বল।’ বললেন এক সেনাপতি।
ডিউক সব কথা খুলে বলল। সুলতানের আক্রমণের তারিখ উল্লেখ করে বলল, ‘সালাহুদ্দীন ক্রাক আক্রমণ করবে শুনে একজন কমাণ্ডার বলেছিল, ‘আগে সুবাক দখল করা উচিৎ।’
কিন্তু সালাহুদ্দীন এখানে শক্তি ক্ষয় করতে চাইছেন না। ক্রাককে দুর্বল মনে করে আগে ক্রাক দখল করবেন। ক্রাক হবে তার কেন্দ্র। ওখান থেকেই চারদিকে আক্রমণ পরিচালনা করবেন। আমাদের অজ্ঞানে তিনি আক্রমণ করতে চাইছেন। কারণ, তার সৈন্য সংখ্যা কম। অস্ত্রশস্ত্র ওদের চেয়ে আমাদের বেশী।
তিনি সকলকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘খ্রিষ্টান ফৌজ পথে বাধা দিলে পরাজয় অনিবার্য। কোন অবস্থাতেই খোলা মাঠে যুদ্ধ করবে না। সম্মুখ লড়াইয়ের পথ এড়িয়ে আমরা ক্রাকে ঝটিকা হামলা করব। ওরা প্রস্তুত হওয়ার আগেই আমাদের বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে।’ ডিউক থামল।
এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে মেয়েদের প্রসঙ্গ চাপা পড়ে গেল। সালাহুদ্দীনকে প্রতিরোধের ব্যাপারে আলাপ শুরু হল। ওরা স্বীকার করল, সালাহুদ্দীন নিঃসন্দেহে দূরদর্শী এবং যুদ্ধবাজ। ক্রাক আক্রমণের পরিকল্পনা তার বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। পথে যুদ্ধ করে শক্তিক্ষয় করতে না চাওয়াও তার যুদ্ধ পলিসির উজ্জ্বল দিক।
‘পবিত্র যিশুর দয়ায় আমরা আগে ভাগেই তার পরিকল্পনা টের পেয়েছি। নয়তো ক্রাক দখলে রাখা আমাদের জন্য সমস্যা হত।’ বলল এক সেনাপতি।
সালাহুদ্দীনের আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য পরিকল্পনা তৈরী হতে লাগল। সিদ্ধান্ত হল, সুবাকে থাকবে কেন্দ্রীয় কমাণ্ড। রসদও থাকবে এখানে। ক্রাকে আরও সৈন্য পাঠিয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। ক্রাক থেকে অনেক দূরে পার্বত্য স্থানে সালাহুদ্দীনকে বাধা দেয়া হবে। অশ্বারোহী এবং উষ্ট্রারোহী সৈন্যের পরিমাণ থাকবে বেশী। পানির ঝর্ণাগুলো আগে ভাগেই দখল করে নিতে হবে। সালাহুদ্দীনের বাহিনীকে ঘেরাও করে শেষ করে ফেলতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হল। সবাই ভীষণ খুশি। এই প্রথম সুলতান সালাহুদ্দীনের গোপন পরিকল্পনা ওরা আগেভাগে জানতে পেরেছে। তার মত একজন দূরদর্শী যোদ্ধাও যে সময়ে ভুল করতে পারে তার প্রমাণ এবারের অসতর্কতা। সুলতানের এ অসতর্কতার সুযোগে মূল্যবান গোপন তথ্য পাওয়ার আনন্দে ওরা বিভোর সবাই।
ফ্রান্সের সৈন্য ছিল অনেক দূরে। সিদ্ধান্ত হল, ওদেরকে নুরুদ্দীন জঙ্গীর আসার পথে পাঠিয়ে দিতে হবে।
একজন অফিসার ভেতরে এসে গোয়েন্দা প্রধানের কানে কানে কি যেন বলল। তিনি সকলকে শুনিয়ে বললেস, ‘দু’জন মেয়ের একজন ডাকাতের হাত থেকে বেঁচে এসেছে। সাথে রয়েছে একজন মুসলমান রক্ষী সেনা।’
সর্বপ্রথম ডিউক কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। কামরা থেকে বেরিয়ে ও দেখতে পেল বারান্দায় হাদিদকে শুইয়ে পাশে বসে আছে মেয়েটা। দীর্ঘ ভ্রমণের ফলে হাদিদের ক্ষতস্থান থেকে আবার রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে সে।
খ্রিষ্টান কমাণ্ডারদের কেউ তার দিকে ভ্রুক্ষেপও করল না। তাদের বলা হয়েছিল ডাকাতের আক্রমণ ছিল এক নাটক।
একজন সেনা অফিসার এগিয়ে গেল। মেয়েটাকে বলল, ‘সিনথিয়া, ভেতরে এসো।’
সিনথিয়া বলল, ‘এর ক্ষতস্থানে ব্যাণ্ডেজ না বাঁধা পর্যন্ত আমি ভেতরে যাব না।’
গোয়েন্দা প্রধান হরমুন ছিলেন একজন জার্মান। কামরা থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন তিনি। সিনথিয়ার কথা শুনে তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘তুমি ও সাপের বাচ্চার ব্যাণ্ডেজ করাতে চাইছ? জীবন নিয়ে ফিরে এসেছ এ-তো তোমার সৌভাগ্য। এ জানোয়ার তোমাদেরকে ডাকাতদের হাতেই তুলে দিতে চাইছিল।
‘মিথ্যে কথা।’ যুবতীর কণ্ঠে দৃঢ়তা। ‘প্রথমে আমিও তাই মনে করেছিলাম। এ যুবক আমার সব সন্দেহ দূর করে দিয়েছে। একা দু’জন দস্যুকে হত্যা করে সে আমার জীবন বাঁচিয়েছে।’
যুবতী হরমুনকে সব ঘটনা খুলে বলল। ‘দেখুন! লোকটা বার বার আমাকে বলেছে, আমায় এখানেই মরতে দাও। পালিয়ে যাও তুমি।’
মুসলমানদের বিরুদ্ধে খ্রিষ্টানদের হৃদয়ে ছিল প্রচণ্ড ঘৃণা। হাদিদের চিকিৎসার কথা কেউ বলল না। বলল না ডিউকও। মেয়েটা ওর চিকিৎসা ছাড়া ভেতরে যাবে না।
এক অফিসার বলল, ‘মুসলমানটাকে নিয়ে ব্যাণ্ডেজ করে দাও।’
হাদিদকে নিয়ে গেলে যুবতী হাঁটা দিল অফিসারের সাথে। অফিসার তাকে নিয়ে কামরায় ঢুকলেন। সম্রাট ও কয়েকজন সেনাপতি তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ওরা কামরায় ঢুকলে একজন বলল, ‘বল তো মেয়ে কিভাবে বেঁচে এলে?’
মেয়েটা পথের সব ঘটনা বর্ণনা করল ওদের সামনে।
‘তুমি খুব ইণ্টারেষ্টিং গল্প শোনালে।’ বলল এক সেনাপতি। ‘এমন মজাদার কাহিনী শোনার পর একটু আনন্দ না করলে গুণাহ হবে।’
সম্রাট বললেন, ‘সত্যিই আজ বড় আনন্দের দিন। এসো, সবাই মিলে প্রাণ ভরে খাও এবং পান করো।’
ওদের সামনে খাবার এবং মদ পরিবেশন করা হল। মেয়েটা বলল, ‘আহত লোকটির খাওয়া হলে আমি খাব। আমি ওকে একটু দেখে আসি।’
উঠতে যাচ্ছিল সিনথিয়া, হরমুন কণ্ঠে ঝাঁঝ মিশিয়ে বললেন, ‘দাঁড়াও সিনথিয়া। তুমি এ নিয়ে দ্বিতীয়বার ফৌজি নির্দেশ অমাণ্য করলে। প্রথববার তোমাকে ভেতরে আসতে বলা হল, তুমি বললে, আহত ব্যক্তির চিকিৎসা না হলে আমি ভেতরে যাব না। এখন কারো অনুমতি ছাড়াই বাইরে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছ। এখানে সম্মানিত সেনাপতিগণ ছাড়াও উপস্থিত রয়েছেন মহামান্য সম্রাট। তুমি জান তোমার এ নির্দেশ অমান্য করার শাস্তি কি?’
‘দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।’
‘শত্রুর সামান্য একজন কমাণ্ডারের জন্য তুমি আমাদের নির্দেশ অমান্য করেছ। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে।’
‘লোকটি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রু শিবিরের একজন অভিজ্ঞ গোয়েন্দার জীবন বাঁচিয়েছে, খ্রিষ্টান সম্রাট এবং সেনা অফিসারগণ কি তাকে এর জন্য কোন প্রতিদান দেবেন না? আমি জানি যে ও শত্রুদের সেনা কমাণ্ডার। আমি তখনই তাকে দুশমন ভাবব, যখন সে নিজ সেনাবাহিনীতে ফিরে যাবে।’
‘দুশমন সব সময়ই দুশমন থাকে।’ একজন কমাণ্ডার চিৎকার দিয়ে বলল, ‘আমরা ফিলিস্তিনে ক’জন মুসলমানকে বাঁচতে দিয়েছি? ওদের বংশ কেন শেষ করেছি আমরা? কারণ ওরা আমাদের শত্রু, ওরা আমাদের ধর্মের শত্রু। পৃথিবীতে শুধু খ্রিষ্টানদের শাসন থাকবে। আমাদের কাছে একজন আহত মুসলমানের কোন মূল্য নেই। তুমি বস।’
বসে পড়ল যুবতী। তার দু’চোখ ফেটে বেরিয়ে এল অশ্রুর বন্যা।
সুবাকের কাজকর্ম চলছে স্বাভাবিক গতিতে। সেনাবাহিনীতে চলছে অন্য তৎপরতা। কেল্লা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে দলে দলে সৈন্য। সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে উট। ওদের পিঠে চাপানো হচ্ছে যুদ্ধাস্ত্র এবং খাদ্য সামগ্রী। অফিসারেরা সবাই ব্যস্ত, কারও হাতে একদণ্ড সময় নেই। উর্ধ্বতন ক’জন সামরিক অফিসার ইতিমধ্যেই ক্রাক রওয়ানা হয়ে গেছেন। সিনথিয়া নির্লিপ্ত। যেন এ তৎপরতার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।
গতকালের সেনা সম্মেলন শেষ হয়েছিল মাঝ রাতে। সিনথিয়া ছিল ক্লান্ত-শ্রান্ত। একজন অফিসার ওকে বলেছিল, ‘আহত ব্যক্তিকে ডাক্তারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। দুশ্চিন্তার কারণ নেই।’
ফেরার পথে দেখা হল গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান হরমুনের সঙ্গে। তিনি সিনথিয়াকে বললেন, ‘সিনথিয়া, তোমার আচরণ সত্যি খুব আবেগপ্রবণ। তোমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হলে এ ধরণের আবেগকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না।’
‘আমাকে মাফ করবেন। হয়ত আমি সত্যি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি। কিন্তু সে আমার জীবন বাঁচিয়েছে। এ কথা আমি ভুলব কেমন করে? তবে আমি আমার দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন আছি। ও নিয়ে আপনাদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। এখন আপনার অনুমতি পেলে আমি ওকে একটু দেখতে চাই।’
‘সিনথিয়া, তুমি জান কোনার্ড এবং লুজিনাম কাউকে ক্ষমা করেন না। রাতের ব্যাপারে না হলে ওরা তোমাকে তখনই জেলে পাঠিয়ে দিতেন। তোমার রক্ষীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তোমার জন্য নির্দেশ হল, তার সাথে দেখা করতে পারবে না।’
‘কেন?’ সিনথিয়ার হতবাক কণ্ঠ। ‘আমি কি তাকে কৃতজ্ঞতাও জানাতে পারব না!’
‘না, পাবরে না। কারণ সে শত্রু বাহিনীর। তোমার দায়িত্বের কথা তুমি জান। আমি তার সাথে দেখা করার অনুমতি তোমাকে দিতে পারি না। তোমার কাছে সংস্থার দাবীও তাই। আমি দেখতে পাচ্ছি তার ব্যাপারে তুমি মাত্রাতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছ। তোমাকে আমি এতটা আবেগপ্রবণ হওয়ারও অনুমতি দিতে পারি না।’
‘আমায় শুধু বলুন তার চিকিৎকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চিকিৎসার পর তাকে নিরাপদে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে।’
‘সিনথিয়া!’ হরমুনের কণ্ঠে ক্রোধ। ‘তোমার সে ইচ্ছে পূরণ করা হবে। তুমি এক বিপজ্জনক অভিযান থেকে এসেছ। এখন তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন। তোমাকে এক মাস ছুটি দেয়া হল। এখন গিয়ে আরাম কর।’
কনফারেন্স শেষে হরমুনের সঙ্গে এসব কথা হওয়ার পর রাতে নিজের কামরায় ফিরে গেল সিনথিয়া। গোয়েন্দা মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা ছিল সেনা হেডকোয়ার্টার থেকে অনেক দূরে। এদের অভিযান ছিল বিপজ্জনক, দায়িত্ব পালন কালে ধরা পড়লে মৃত্যু অবধারিত। তাই এদের জন্য সব রকম বিলাস উপকরণের ব্যবস্থা ছিল। বলতে গেলে ওরা থাকত রাজকুমারীর মত!
রুমে গিয়েই শুয়ে পড়ল সিনথিয়া। ক্লান্ত দেহটা বিছানায় ঠেকাতেই ঘুমিয়েও পড়ল। ঘুম ভাঙল পরদিন সকালে।
বিছানা ছাড়তে মন চাইছিল না তার। তবুও উঠে নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়ল। বেরোতেই দেখা হয়ে গেল লুজিনার সাথে। লুজিনা ওর পাশের কামরায় থাকে। ও কায়রোর অভিযানের কথা শুনতে চাইল।
‘লুজি, আমাকে এখনই একটু বাইরে যেতে হচ্ছে। ঘুরে আসি, তারপর সব বলল তোকে।’
একটু এগুতেই সিনথিয়া ওর এক বান্ধবীর সামনে পড়ল। সেও থাকে পাশের কক্ষেই। দূর থেকে ওকে দেখেই নেমসি চিৎকার করে ডাকল, ‘হ্যালো সিন!’
সিনথিয়া হেসে বলল, ‘হাই।’
নেমসি এগিয়ে এল ওর কাছে। বলল, ‘আরে সিনথিয়া! কখন ফিরলি? যাচ্ছিস কোথায়? তোকে কেমন উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। একি ক্লান্তি না অন্য কিছু! ছুটি পাসনি?’
হেসে ফেলল সিনথিয়া। ‘এক মাস ছুটি পেয়েছি। তবে…’ তার চেহারায় আবার চিন্তার ভাঁজ পড়ল।
‘তবে কি?’ উদ্বেগের স্বরে জানতে চাইল সে।
‘একটা বিশেষ কারণে আমি আসলেই চিন্তিত।’
‘কি ব্যাপার! কী ঘটেছে বল তো শুনি।’
সব কথা ওকে খুলে বলল সিনথিয়া। অফিসাররা যে শাসিয়েছে তাও বলল। সবশেষে বলল, ‘আমি হাদিদের সাথে দেখা করতে চাই। মনে হয় ওরা তার চিকিৎসা করেনি? না হয় শহর থেকে বের করে দিয়েছে। এমনও হতে পারে, মারার জন্য কোন কক্ষে বন্দী করে রেখেছে।’
‘তোকে না তার সাথে দেখা করতে নিষেধ করা হয়েছে? ধরা পড়লে কি শাস্তি দেবে তা জানিস?’
‘ওর জন্য আমি মরতেও প্রস্তুত। তোকে তো বলছি, আমার জন্যই ও নিজের জীবন বিপন্ন করেছে। আমার তো জীবনের কোন ভয় ছিল না। ডাকাতরা ক’দিন ব্যবহার করে কোন আমীরের কাছে হয়ত বিক্রি করে দিত। এ কথা হাদিদও জানত। আমার ইজ্জতের জন্যই নিজেকে বিপদে ফেলেছিল সে। দস্যুরা বলেছিল,
‘মেয়েটাকে আমাদের হাতে তুলে দিয়ে তুমি চলে যাও। আমরা তোমাকে কিছুই বলব না।’ আমি যে খারাপ মেয়ে তাও ওর জানা ছিল। কিন্তু তবু আমার ইজ্জত রক্ষা করাকে ওর আমানত মনে করেই ও নিজের জীবন বিপন্ন করে আমাকে রক্ষা করেছে।’
‘মনে হয় ওকে তুই ভালবেসে ফেলেছিস?’
‘হ্যাঁ, কথাটা তুই মিথ্যে বলিসনি। হরমুনের সামনে আমার এ আবেগ প্রকাশ করতে পারি না। কিন্তু আমার মনে সব কথাই তো তোকে বলতে পারি। তুই আমার বান্ধবী। নারী হৃদয়ের আবেগ তুই বুঝিস। আমাদের জীবনটা কি? চোখ ধাঁধাঁনো তরবারী, মিষ্টি বিষ। পুরুষদের ধোকা দেয়াই আমাদের পেশা। আমরা ট্রেনিং নিয়েছি প্রতারণার ফাঁদ পাতার।
কিন্তু একথা আগে কখনও ভাবিনি, আমরাও মানুষ। আমাদের যে হৃদয় আছে ভুলেই গিয়েছিলাম। ওর সংস্পর্শে এসে আমি যেন নতুন জীবন পেয়েছি। ওকে দেখে আমার আবেগের দরিয়ায় ঝড় উঠল। ওর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় গলে গেল আমার ও ছোট্ট হৃদয়। এ প্রথমবার মনে হল আমি কারও মেয়ে। আবার আমি কারো মা-ও হতে পারি।
এতদিন আমি নিজেকে রাজকুমারী মনে করতাম। ওর পরশ পেয়ে আমি মানুষের মধ্যে ফিরে এসেছি।
আমাদের গোয়েন্দাবৃত্তির ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। সম্রাটগণ আমাদের চোখের ইশারায় উঠাবসা করে। কিন্তু এতে খুশি হওয়ার কিছু দেখি না আমি। এরা তো আমাদেরকে পণ্যে পরিণত করেছে।
আমি অন্ধগলির মেয়ে না হলেও যেসব মেয়েরা প্রতিরাতে নতুন নতুন খদ্দের খোঁজে আমি তো তাদেরই মত একজন।
হাদিদ আমাকে এ পর্যায় থেকে অনেক উপরে তুলে দিয়েছে। আমি ছিলাম ওর বন্দিনী। ইচ্ছে করলে ও আমাকে সহজেই ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু ও আমাদের এড়িয়ে গেছে। আমার ইজ্জত রক্ষার জন্য ও যখন আহত হল আমি নিজকে ধরে রাখতে পারিনি। ওকে জায়গা করে দিয়েছি বুকের মধ্যে। আমি হয়ে গেছি এক সাধারণ মেয়ে। যার হৃদয় আছে, আবেগ ও উচ্ছাস আছে।
সালাহুদ্দীন আইউবী আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি কোন সম্মানিত লোককে বিয়ে করছ না কেন?’ তখন মনে হয়েছিল ও মুসলমান সম্রাট কত গবেট। এখন অনুভব করছি, আমাদের শত্রু কত মূল্যবান কথা বলেছেন।
আমি আর গোয়েন্দার কাজ করতে পারব না। শৈশব থেকে দেয়া আমার সব ট্রনিং হারিয়ে গেছে মরুভূমির ভয়ঙ্কর রাতের আঁধারে। ডাকাতদের ভয়, ওর শরীরের উষ্ণতা আর রক্তের গন্ধ আমার এতদিনের সব শিক্ষা মুছে দিয়েছে।’
‘এত কথা না বললেও তোর মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। তবু চরম বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা যায় না। ওকে চলে যেতে হবে। আর ও এখানে কোন কষ্টের মধ্যে থাকলেও তোর করার কিছুই নেই। তার সাথে দেখা না করার জন্য তোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ নির্দেশ অমান্য করার পরিণাম কত ভয়াবহ তা কি তোর অজানা?’
‘ধরা পড়লে এক সঙ্গে দু’জনই মরব, তবু তার সঙ্গে আমার দেখা করতেই হবে। আমাকে ভুল বুঝিস না বোন, তুই আমাকে একটু সাহায্য কর।’
মিনতি ঝরে পড়ল সিনথিয়ার কণ্ঠ থেকে।
‘বুঝেছি সিন তুই মরেছিস। কিন্তু তবু বলল, এমন কিছু করিস না, যাতে দু’জনকেই বিপদে পড়তে হয়। যা-ই করিস ভেবেচিন্তে করিস। আমার মনে হয় না এ অবস্থায় তার সাথে তোর দেখা করা ঠিক হবে।’
‘কিন্তু ওর কোন খোঁজ না নিয়ে চুপচাপ আমাকে বসে থাকতে বলিস?’
‘আচ্ছা, আমি খোঁজ নিচ্ছি।’
‘প্লিজ, খোঁজ নিয়ে দেখ ও কোথায় আছে। সুস্থ হয়ে ও ফিরে গেছে শুনলেও আমি স্বস্তি পাব।’
‘ঠিক আছে। তুই রুমে ফিরে যা, আমি ওর খোঁজ নিচ্ছি।’
উঠে দাঁড়াল দু’জন। পরস্পর বিদায় নিয়ে দু’দিকে হাঁটা দিল। হাসপাতালে না গিয়ে সিনথিয়া ফিরে এল তার রুমে।
* * *
কায়রোর সেনাবাহিনী প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ছাউনীর বাইরে সৈন্যদের ট্রনিং চলছিল। তৈরী করা হচ্ছিল কমাণ্ডো বাহিনী। শেখানো হচ্ছিল গেরিলা যুদ্ধের নিয়ম কানুন।
সুলতান নিজে সব দেখাশোনা করছেন। তিন চার দিন পর অফিসারদের দরবার বসেছে। যুদ্ধের মানচিত্র নিয়ে যুদ্ধ পলিসি ব্যাখ্যা করছেন সালাহুদ্দীন।
তিনি বললেন, ‘যুদ্ধের মূলনীতি হবে অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে শত্রুর উপর অতর্কিত আক্রমণ করা। অস্ত্রের চাইতে বুদ্ধি কাজে লাগাতে হবে বেশী। সামনাসামনি আক্রমণ করবে না। একশ জন সৈন্য দু’তিনটে যুদ্ধে যে সাফল্য লাভ করতে পারে দশ-বারো জনের একটা কমাণ্ডো বাহিনী ঠিকমত আঘাত করতে পারলে সফলতা লাভ রকতে পারে তারচে’ বেশী।’
দুর্গ অবরোধ এবং প্রাচীর ভাঙ্গার পদ্ধতি শিখান হল সৈনিকদের। দুর্বল উট, ঘোড়া এবং খচ্চরগুলো বাছাই করে সরিয়ে রাখা হল।
ফিলিস্তিন পুনর্দখল করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সালাহুদ্দীন। অন্যদিকে সালাহুদ্দীনকে পথে বাধা দেয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করছিল খ্রিষ্টান বাহিনী। প্রস্তুতি দেখে মনে হচ্ছিল দু’দলই পরস্পরকে চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন করে দেবে।
খ্রিষ্টান বাহিনী তাদের সৈন্য ছড়িয়ে দিয়েছিল সুবাক থেকে মিসর সীমানা পর্যন্ত। বাহ্যত মনে হচ্ছিল সুলতান সালাহুদ্দীনের বেঁচে আসার সকল পথ রুদ্ধ। আগে ভাগে সুলতানের পরিকল্পনা জানার কারণেই এভাবে প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হয়েছে।
সেনা প্রস্তুতির বাইরে সুবাকে চলছিল অন্য এক তৎপরতা। হাদিদের সংবাদের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুনছিল সিনথিয়া। নিজের কক্ষে ছটফট করছিল ও। নেমসি মেয়েটা দু’দিন থেকে হাদিদকে খুঁজছে। হাদিদ অফিসারদের হাসপাতালে নেই। সাধারণ সৈন্যদের হাসপাতালেও পাওয়া যায়নি তাকে।
গোয়েন্দা হওয়ায় সেনা অফিসাররা ওদের সম্মানের দৃষ্টিতে দেখত। মেয়েটা হাদিদের কথা অনেককে জিজ্ঞেস করেছে। কেউ কিছু বলতে পারেনি।
তৃতীয় দিন একজন অফিসার ওকে গেপনে বলল, ‘ব্যাণ্ডেজ করে তাকে মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট বেগার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’
নেমসি ছুটে এল সিনথিয়ার কাছে। সংবাদ শুনে সিনথিয়া থ’ মেরে বসে রইল। চোখ মুখে ফুটে উঠল আতঙ্ক।
মুসলমানদের বেগার ক্যাম্প এক ভয়ঙ্কর স্থান। যুদ্ধবন্দী ছাড়াও বিজিত এলাকার নিরপরাধ মুসলমানদেরকে এখানে জড় করা হয়েছিল। মুসলমানদের কাফেলা লুট করে ওদেরকেও এখানে এনে রাখা হত।
কারাগার নয় বলে ক্যাম্পে পাহারার কড়াকড়ি ছিল না। এখানে রাখা বন্দীদের কোন তালিকা করা হত না।
এদের সাথে আচরণ করা হত পশুর মত। কোথাও সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন হলে এদেরকে পশুর মতই তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হত। খাবার দেয়া হত বেঁচে থাকার মত। রাখা হত তাঁবুতে। সাধারণ রোগে চিকিৎসা করা হত। বেশী অসুস্থ হলে মেরে ফেলত বিষ খাইয়ে।
এখানে বন্দী হওয়ার জন্য কোন অপরাধ করার দরকার হত না। ও মুসলমান এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কি হতে পারে!
হাদিদকে এ ক্যাম্পেই পাঠানো হয়েছিল। হরমুন বুঝেছিলেন সিনথিয়া তার জন্য আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে। এজন্য হাদিদের সাথে সিনথিয়ার দেখা সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।
সিনথিয়া মনে প্রাণে এ নির্দেশে গ্রহণ করতে পারেনি। যখন ও শুনল হাদিদ বেগার ক্যাম্পে, বান্ধবীকে বলল, ‘আমি ওকে মুক্ত করব।’
ওকে সহযোগিতা করতে রাজি হল মেয়েটা।
সিনথিয়া শহরের এক প্রাইভেট ডাক্তারের সাথে দেখা করল। বলল, ‘একজন আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসা করতে হবে। শর্ত হচ্ছে এ কথা কাউকে বলা যাবে না।’
‘কেন?’
‘কারণ লোকটি একজন গরীব মুসলমান। ও আমার বংশের অনেক উপকার করেছে। কোথাও ঝগড়াঝাটি করে আহত হয়েছে চিকিৎসা করার মত সামর্থ নেই। ডাক্তারদের সবাই খ্রিষ্টান। বিনে পয়সায় কেউ ওর চিকিৎসা করতে চাইছে না।
ব্যাপারটা গোপন করার দ্বিতীয় কারণ হল, প্রশাসন যদি জানতে পারে মুসলমানরা ঝগড়াঝাটি করেছে তবে ওদের বেগার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেবে। ওদের বন্দী করার জন্যত একটা বাহানামাত্র প্রয়োজন।
সে আমার পরিবারের যে উপকার করেছে আমি তার প্রতিদান দিতে চাইছি। আমি তাকে নিয়ে আসব রাতে। বলুন আপনাকে কত দিতে হবে? গোপনীয়তা রক্ষার মূল্য আমি দেব।’
ডাক্তার সিনথিয়ার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখল। চোখে জ্বলজ্বলে কামনা।
সিনথিয়া এক ভদ্রঘরের মেয়ে হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছিল। ডাক্তার ওর দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। রূপসী তরুণীর কাছে বিনিময় চাওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলল ডাক্তার।
ডাক্তারের চোখের ভাষা বুঝে ফেলল সিনথিয়া। নিজের প্রশিক্ষণকে কাজে লাগাল। গলে গেল ডাক্তার।
সিনথিয়া তার হাতে চারটি স্বর্ণ মুদ্রা ধরিয়ে দিল। ডাক্তার সিনথিয়ার হাত ধরে বলল, ‘তোমার চাইতে দামী মূদ্রা আর কিছুই হতে পারে না।’
মৃদু হাসল সিনথিয়া। ‘আপনি যা চাইবেন দেব, আগে আমার কাজ করুন।’
ডাক্তার বুঝল ব্যাপার বিপজ্জনক। কিন্তু সিনথিয়াকে দেখে যে কোন ঝুঁকি নিতে রাজি হল সে। বলল, ‘আজ রাত বা কাল রাত যখনই ইচ্ছা নিয়ে এস। এ দু’দিন আমি কোন বাইরের কলে এটেণ্ড করব না। আমি ঘুমিয়ে থাকলে জাগিয়ে দিও।’
ডাক্তার এক হাতে স্বর্ণ মুদ্রা এবং অন্য হাতে সিনথিয়ার হাত ধরে ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল।