» » সুবাক দুর্গে আক্রমণ

বর্ণাকার

মুক্তিপ্রাপ্ত তিন বন্দীদের অন্তরে খুশির অন্ত নেই। শুধু মুক্তির জন্য নয়, মূল্যবান গোপন তথ্য নিয়ে যাচ্ছে ওরা সাথে করে।

কায়রো পেরিয়ে অনেক দূর চলে এসেছে ওরা। উট তিনটি পাশাপাশি চলছে। রক্ষীদের দু’জন সামনে, দু’জন পেছনে। গোয়োন্দারা আঞ্চলিক ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। রক্ষীরা সে আঞ্চলিক ভাষার কিছুই বুঝতে পারছিল না।

ডিউক মেয়েদর বলল, ‘পবিত্র যিশুর মাজেযা দেখলে! বুঝা যাচ্ছে তিনি আমাদের ভালবাসেন। বিজয় আমাদেরই হবে। সালাহুদ্দীন আর আলী বে-আক্কেলের মত বিপজ্জনক তথ্য আমাদের শুনিয়ে দিল। আমাদের সেনাবাহিনীকে সব কথা বললে ওরা সালাহুদ্দীনের সৈন্যদেরকে মরুভূমিতেই শেষ করে দেবে। সালাহুদ্দীন জিন্দেগীতে আর ক্রাক পৌঁছার সুযোগ পাবে না।’

‘আমর বিশ্বাস সেনাপতি ওদেরকে আক্রমণ করেই ক্ষান্ত হবে না। সহজেই ফৌজ শূন্য মিসরও দখল করে নিবেন, কি বলেন?’ বলল এক যুবতী।

অন্য যুবতী বলল, ‘আপনি একজন অভিজ্ঞ আলেম। আপনার বিবেচনাই হয়ত ঠিক। তবু আপনার দেখা মাজেযায় আমি বিপদের গন্ধ পাচ্ছি। রক্ষীরা হয়ত আমাদের হত্যা করে ফিরে যাবে। সালাহুদ্দীন আমাদের সাথে উপহাস করেছেন। জল্লাদের হাতে তুলে দেয়ার পরিবর্তে আমাদেরকে এদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। এরা আমাদেরকে নষ্ট করে শেষে মেরে ফেলবে।’

ডিউক এ কথার প্রতিবাদ করল না। আশঙ্কার মেঘ তার মনেও ভীড় করেছে। সে সায় দিয়ে বলল, ‘তাছাড়া আমরা নিরস্ত্র। তোমার ধারণাই হয়ত ঠিক। কোন শাসকই শত্রুর গুপ্তচরকে ক্ষমা করতে পারে না। মুসলমানরা যা কামুক, তোমাদের মত সুন্দরী মেয়েদের এভাবে ছেড়ে দেবে ভাবা যায় না।’

এতক্ষণে খুশি খুশি ভাব হঠাৎ করেই তাদের চেহারা থেকে সরে গেল।

‘রাতে আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে।’ বলল এক যুবতী।

দ্বিতীয় মেয়েটা বলল, ‘রাতে ঘুমালে ওদের অস্ত্র দিয়েই ওদের শেষ করতে হবে। শুধু একটু সাহসের প্রয়োজন।’

‘এ সাহস আমাদের করতেই হবে।’ ডিউক বলল, ‘এবং আজ রাতেই। সকাল পর্যন্ত আমরা অনেক দূর চলে যেতে পারব।’

রক্ষীরা গল্প গুজব করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিল। দু’জন সুন্দরী যুবতী ওদের হাতের মুঠোয় যে এ কথা কারও মনেই নেই।

সূর্য ডুবে যাচ্ছে, এগিয়ে চলছে কাফেলা। গভীর হচ্ছে মরুভূমির রাত। তিন গোয়েন্দা চলছে পাশাপাশি। রক্ষীদের হত্যার পরিকল্পনা করছে ওরা।

সামনে শ্যামল ভূমি দেখে রক্ষীরা থেমে গেল। তাঁবু টানিয়ে প্রথমে গোয়েন্দাদের খেতে দিল। এরপর নিজেদের খাওয়া সেরে শুয়ে পড়ল তিনজন রক্ষী সেনা। একজন রইল পাহারায়।

এক তাঁবুতে শুলো রক্ষীরা, পাশের তাঁবুতে ডিউক এবং মেয়েরা। ডিউক রক্ষীদের তাঁবুর দিকে ফিরে নিজেদের তাঁবুর পাশ ঘেঁষে শুয়ে রইল। দৃষ্টি তার রক্ষীদের তাঁবুর দিকে। ষষ্ঠইন্দ্রিয়ে টানটান সতর্কতা।

তাঁবুর চারপাশে ঘুরছে একজন সেন্ট্রি। দুই ঘণ্টা পর ঘুমন্ত এক রক্ষীকে জাগাল সে। তাকে পাহারায় রেখে নিজে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়র। আগের মতই সেন্ট্রি তাঁবুর চারপাশ ঘিরে চক্কর দিতে লাগল।

ডিউক মেয়েদের বলল, ‘আমরা সফল হতে পারছি না। বদমাইশটা শুধু ঘোরাঘুরি করছে। যা হবার হবে এখন ঘুমিয়ে পড়।’

তিনজনই একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। ভোরের হালকা আলো ফুটতেই রক্ষীরা ওদের ডেকে তুলল। আবার রওনা হল কাফেলা।

আগের নিয়মে এগিয়ে চলছে ওরা। তিন গোয়েন্দা পাশাপাশি। রক্ষীদের দু’জন সামনে, দু’জন পেছনে।

রক্ষীরা সন্দেহজনক কোন কথা বলেনি। এখন পর্যন্ত কারও সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করেনি। এমন কোন আচরণ করেনি যাতে ওদেরকে বদমাশ বলা যায়।

সূর্য উপরে উঠে এল। অভিযাত্রী দল প্রবেশ করল এক পার্বত্য এলাকায়। পাহাড়ের গা দেয়ালের মত খাড়া। গিরিপথে পাহাড়ের ঘন ছায়া। মেয়েগুলো ভয় পেয়ে গেল। ফ্যাকাশে হয়ে গেল ওদের চেহারা। হত্যা করার জন্য উপযুক্ত স্থান। কিন্তু রক্ষীরা ওদের দিকে ফিরেও চাইল না।

‘ওদেরকে বলুন আমাদের সাথে কথা বলতে।’ ডিউককে বলল একটি মেয়ে। ‘ওরা নিরব কেন। আমাদের ব্যাপারে ওরা এত উদাস কেন! মারতে হলে মেরে ফেলতে বলুন। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ভীষণ কষ্টকর।’

ডিউক নিরব রইল, কোন কথাই বলতে পারলাম সে। বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা আর যে কোন সময় মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শের আশঙ্কা ওকে যেন বোবা করে দিয়েছে। এখন সে মেয়েদের কোন সাহায্য করতে পারছে না। তিনজনই রক্ষীদের দয়ার ওপর বেঁচে আছে।

সূর্য মাথার উপর উঠে এসেছে। থামাল ওরা। এখানে পাহাড় ছাদের মত নুয়ে আছে। ফলে ছায়া রূপ নিয়েছে আঁধারের।

শঙ্কায় বুক শুকিয়ে এল গোয়েন্দাদের। চেহারা থেকে সরে গেল রক্ত।

‘ঈশ্বর, তুমি আমাদের জন্য মৃত্যুকে সহজ করে দাও।’ স্বগতোক্তির মত বলল ডিউক।

কিন্তু না, তেমন কিছুই ঘটল না। রক্ষীরা আগের মতই নির্বিকার। ওরা ওখানে সবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করল। গোয়েন্দারা ভাবল, মারার আগে শেষবারের মত খাইয়ে নিচ্ছে। মৃত্যুভয় ওদের ক্ষুধা দূর করে দিল, কিছুই খেতে পারল না ওরা।

একজন রক্ষী বলল, ‘কি ব্যাপার, তোমরা খাচ্ছ না কেন?’

ডিউক বলতে চাচ্ছিল, ‘আর খাওয়ার দরকার নেই, তোমরা তোমাদের কর্তব্য পালন কর, হত্যা করতে চাও তাড়াতাড়ি করে ফেল। শুধু শুধু আমাদের পেরেশানি বাড়াচ্ছ কেন?’ কিন্তু কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘তোমারা আমাদের সাথে কথা বলছ না কেন?’

‘কর্তব্যের মধ্যে নয় এমন কথা আমরা বলি না।’ কমাণ্ডার বলল। ‘কোন বিশেষ কথা থাকলে বলতে পার, জবাব দেব।’

‘আমাদের পরিচয় তোমরা জান?’

‘তোমরা গোয়েন্দা। মেয়েগুলো নষ্ট। আমাদের বিরুদ্ধে যাদের ব্যবহার করতে চাও, এদেরকে দিয়ে তাদের পাকড়াও কর। সুলতান কেন তোমাদের ক্ষমা করেছেন জানি না। তোমাদেরকে সুবাক পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা এখন সে নির্দেশ পালন করছি। কিন্তু একথা জিজ্ঞেস করছ কেন?’

‘তোমাদের সাথে কথা বলতে মন চাইছে। দীর্ঘ সফল। আমাদের ব্যাপারে তোমরা কেমন উদাসীন। তোমাদের এ ছাড়াছাড়া ভাব আমাদের খুব কষ্ট দিচ্ছে। আমাদের সাথে কথা বলতে বলতে চল।’

‘আমরা সবাই সহযাত্রী। কিন্তু আমাদের পথ ভিন্ন। দু’দিন পর আমরা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যাব।’

ডিউক কমাণ্ডারের কথা শুনল কি শুনল না, তার দৃষ্টি ছুটে গেল দুরে। সে ছিল মরু ভেদী, মরুর বিপদ সম্পর্কে অভিজ্ঞ।

তাকিয়ে রইল সে। আতঙ্কে বিস্ফারিত চোখ দুটো বেরিয়ে আসছে যেন। ডিউকের দৃষ্টি অনুসরণ করল কমাণ্ডার। চোখ বড় হয়ে গেল তারও। শ’খানেক গজ দূরে উঁচু জায়গায় দুটো উট। পিঠে দু’জন লোক নেকাবে ঢাকা মুখ। মাথায় কাপড় বাঁধা। উটের পা দেখা যাচ্ছে না। ঢালে দাঁড়িয়ে আছে, আরোহীরা নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে কাফেলার দিকে।

‘বলতে পার ওরা কারা?’ কমাণ্ডার ডিউককে প্রশ্ন করল।

‘মরু দস্যু। জানি না ওরা ক’ন।’

‘তা দেখা যাবে।’ কমাণ্ডার এক সঙ্গীকে ইশারা করে বলল, ‘আমার সাথে এসো।’

দু’টো ঘোড়ায় চেপে দস্যুদের দিকে এগিয়ে গেল দু’জন। তরবারী ছাড়াও ওদের হাতে বর্শা।

ওদের দু’জনকে এগুলো দেখে উষ্ট্রারোহীরা ঢালের দিকে নেমে গেল। গোয়েন্দাদের একা রেখে বাকী দু’জন রক্ষীও পাহাড়ে উঠে গেল অবস্থা বুঝতে।

ডিউক মেয়েদের বলল, ‘আমার ধারণা এবং তোমাদের আশঙ্কাই ঠিক। ওরা দস্যু নয়, সালাহুদ্দীনের পাঠানো লোক। দেখলে না নির্ভয়ে এরা ওদের কাছে চলে গেছে। সালাহুদ্দীন তোমাদেরকে চরম অপমান করবে। আমার তো মৃত্যু অবধারিত, তোমাদের ভাগ্যেও রয়েছে কঠিন শাস্তি।’

‘এর অর্থ আমরা মুক্ত নই?’ একটা মেয়ে বলল, ‘আমরা এখনও বন্দিনী?’

‘তাই তো মনে হয়।’ দ্বিতীয় মেয়েটার জবাব।

দস্যুদের কাছ থেকে ফিরে এল দু’জন রক্ষী সেনা। সবাই তাদের ঘিরে ধরল। কমাণ্ডার হাদিদ বলল, ‘ওরা মরু দস্যু। ওদের দু’জনের সাথে দেখা করেছি, পাহাড়ের আড়ালে আছে বাকীরা। ওদের সংখ্যা কত জানি না। যে দু’জনকে তোমরা দেখেছ তাদের কথা অনুযায়ী ওরা আমাদের পিছু নিয়েছে সকাল থেকে।

ওরা আমাকে বলল, ‘তোমরা সরকারী সৈন্য। মুসলমান। মেয়ে দুটো মুসলমান নয়। ওদের আমাদের হাতে তুলে দাও, আমরা তোমাদের আর বিরক্ত করব না। আমি বলেছি, এ মেয়েগুলো যে ধর্মেরই হোক, ওরা এখন আমাদের হেফাজতে। তাদের ইজ্জত, সম্মান এবং জীবন সবকিছু আমাদের কাছে আমানত। দেহে প্রাণ থাকতে ওদেরকে তোমাদের হাতে তুলে দেব না।

ওরা বলল, ‘দুটো মেয়ের জন্য নিজের জীবন নষ্ট করো না।’

আমি বলেছি, ‘আগে আমাদের মারবে তারপর মেয়েদের নেবে। তোমরা কি অস্ত্র চালাতে পার? ডিউককে প্রশ্ন করল কমাণ্ডার।

‘আমরা প্রতিটি মেয়েকেই অস্ত্র চালনা শিক্ষা দেই। তোমাদের কাছে তরবারী, বর্শা এবং তীর ধনু আছে। এর যে কোন একটা আমাদের দাও।’

‘এখন নয়।’ কমাণ্ডার বলল, ‘ওদের সাথে সংঘর্ষ বাধলে দেব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ এলাকা ছেড়ে আমাদের চলে যাওয়া উচিৎ। উটের সাথে ঘোড়া দিয়ে এখানে আক্রমণ প্রতিহত করা যাবে না।’

রওনা হল ওরা। রক্ষীরা হাতে নিল তীর ধনু। হাদিদ সবার আগে। একজন রক্ষী তাকে বলল, ‘গোয়েন্দাদের হাতে অস্ত্র দেয়া ঠিক হবে না। শত হলেও ওরা আমাদের শত্রু। ডাকাতদের সাথে মিশে আমাদেরকেই হত্যা করার চেষ্টা করতে পারে।’

ডিউক মেয়েদের বলল, ‘এদের উদ্দেশ্য খারাপ। নইলে আমাদের অস্ত্র দিতে অস্বীকার করত না। আসলে দস্যুরা ওদেরই লোক। তোমাদেরকে ডাকাতদের হাতে তুলে দেবে। আমাকেও মেরে ফেলবে।’

ডাকাত এবং রক্ষীদের ভয়ে ওরা ছিল পেরেশান। হাদিদ রক্ষীদের বলল, ‘মুখোশ পরা কাউকে দেখলে তীর মারবে। আমার অনুমতি নিতে হবে না। ওদের সাথে অবশ্যই আমাদের সংঘর্ষ হবে। কখন এবং কোথায় তাই দেখতে হচ্ছে।’

দ্রুত চলছিল ওরা। মাঝে মাঝে উট ঘোড়াকে বিশ্রাম এবং দানাপানি দেয়ার জন্য থামতে হচ্ছে। বিপদসঙ্কুল পথ আর ফুরোয় না। দীর্ঘ পার্বত্য এলাকার উঁচু-নীচু ও আঁকাবাঁকা পথ ধরে যথাসম্ভব দ্রুত ছুটছে ওরা। হাদিদের ভয় হচ্ছিল ওরা ওপর থেকে তীর ছোঁড়া শুরু করে দিতে পারে। তাই গোয়োন্দাদের তাড়া দিয়ে বলল, ‘উটগুলো ঘোড়ার গতিতে চালাও। পাহাড়ের ওপর নজর রেখে এগিয়ে চল।’

পাহাড়ী এলাকা পেরিয়ে গেল কাফেলা। কোন দস্যু নজরে আসেনি। পশ্চিমে নেমে যাচ্ছে সূর্য। অনেক দূরে দেখা গেল দু’টো উট ওদের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চলছে ওরাও।

পথে পানি পাওয়া গেল। উট ঘোড়াকে খাওয়ালো। নিজেরাও তৃষ্ণা নিবারণ করল। সামান্য বিরতি দিয়ে এগিয়ে চলল আবার।

সূর্য ডুবে গেল। আঁধারে ছেয়ে গেল মরু প্রকৃতি।

কমাণ্ডার থেমে গেল। বলল, ‘যুদ্ধের জন্য এ জায়গাটা উপযুক্ত। আশপাশ কোন বাধা নেই।’

ঘোড়ার পিঠে বাঁধা রইল জিন। খাওয়া শেষে মেয়েদেরকে ডেকে নিয়ে কমাণ্ডার বলল, ‘সতর্ক থেকো।’

ধনুতে তীর জুড়ে প্রস্তুত রইল রক্ষীরা। ঘুমাল না কেউ। তার দৃঢ় বিশ্বাস, দস্যুরা রাতে আক্রমণ করবেই।

* * *

নিঝুম রাত। আচম্বিত দেখা গেল চারপাশে কালো ছায়া মূর্তি। উটের ভারী পদশব্দে মাটি কাঁপছে। সংখ্যায় দশের অধিক। প্রতি উটে একজন আরোহী। কাফেলাকে আতঙ্কিত করতে চাইছে ওরা।

তিন চার বার চারপাশ চক্কর দিয়ে এক আরোহী ধমকের সুরে বলল, ‘মেয়েদেরকে আমাদের হাতে তুলে দাও। তোমাদের আমরা কিছুই করব না।’

শুয়ে শুয়েই তীর ছুঁড়ল হাদিদ। চিৎকার দিয়ে পড়ে গেল একজন। হাদিদ মেয়েদের বলল, ‘পালিও না। মাটির সাথে মিশে যাও। আমাদের কাছাকাছি থেকো। আমরা জায়গা বদল করলে তোমরাও অনুসরণ করো।’

উষ্ট্রারোহীদের মধ্য থেকে কেউ একজন চিৎকার করে বলল, ‘আক্রমণ কর, কাউকে জীবিত রেখো না। মেয়েদের তুলে নাও।’

জোসনা না হলেও রাতের মরুভূমি বেশ ফর্সা থাকে। অনেক দুরের জিনিষও দেখা যায়।

উষ্ট্রারোহীরা লাফ দিয়ে নীচে নামল। শুরু হল দু’দলের সংঘর্ষ। রাতের নিস্তব্ধতা ছিন্ন করে দিল তরবারীর ঝনঝনাৎ শব্দ। মেয়েদের পিছনে সরিয়ে দিয়ে মুখোমুখি লড়ছিল রক্ষীরা।

মেয়েদের পিছন থেকে বার বার বলতে লাগল, ‘আমাদেরও কিছু একটা দিন।’

হাদিদ একজনকে বলল, ‘আমার তরবারী খুলে নাও।’

তারবারী হাতে নিয়ে একজন মেয়ে সামনে না এসে পিছন দিকে সরে গেল। হাদিদ বলল, ‘দূরে যেয়ো না। তোমাদেরকে নাগালের মধ্যে পাওয়ার জন্যই ডাকাতদের এ আক্রমণ। বিচ্ছিন্ন হলে আর রক্ষে থাকবে না।’

ডিউকের কোন সাড়া শব্দ নেই।

দু’দলই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে এদিক-ওদিক। লড়াই করতে করতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে দল থেকে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, বিক্ষিপ্ত হাতাহাতি যুদ্ধ। এ অবস্থা চলল অনেকক্ষণ। রক্ষীরা পরস্পরকে ডেকে ওরা যে এখনো টিকে আছে তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছিল। একসময় থেমে গেল ডাকাডাকির শব্দ। যুদ্ধ শেষ।

হাদিদ সঙ্গীদের ডাকল, জবাব এল না। একটু পর শোনা গেল এক নারী কণ্ঠ, অনেক দূর থেকে তাকেই নাম ধরে ডাকছে।

হাদিদ কান পাতল। ভেসে এল মৃদু অশ্ব ক্ষুরধ্বনি। হাদিদ বুঝল, ডাকাতরা উটের পরিবর্তে রক্ষীদের ঘোড়ায় করে কোন মেয়েকে নিয়ে পালাচ্ছে। হাদিদ দৌঁড়ে নিজের ঘোড়ার কাছে গেল। এরপর পালিয়ে যাওয়া ঘোড়ার শব্দ লক্ষ্য করে ছুটতে লাগল।

অন্য মেয়েটা কোথায় তিনি জানেন না।

তার উন্নত জাতের তাজি ঘোড়া তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে। সামনের ঘোড়া উন্নতজাতের হলেও ওতে আরোহী দু’জন। ফলে হাদিদ আশা করল দ্রুতই ওদের ধরতে পারবে সে।

কিছু দূর যাওয়ার পর মাইল খানেক দূরে ওদের দেখতে পেল হাদিদ। গতি বাড়িয়ে দিয়ে দ্রুত কমিয়ে আনল দূরত্ব। হাদিদের মনে হল পেছনে আরেকটা ঘোড়া আসছে। পেছনের ঘোড়াটি রক্ষী না দস্যুদের বুঝার উপায় নেই।

হাদিদ পেছনে তাকাল। ঘোড়া এগিয়ে এসে কাছাকাছি হল।

‘কে?’ গলা চড়িয়ে জানতে চাইল হাদিদ। জবার এল না।

হাদিদ সামনের ঘোড়সওয়ারকে ধরার জন্য ঘোড়া ছোটাল আবার। সামনের দস্যুটা সোজা এগিয়ে যাচ্ছিল, ও কাছাকাছি হতেই বার বার ডানে বায়ে ঘুরে এগুতে লাগল।

কমে যেতে লাগল গতি। সম্ভবত মেয়েটি বলগা হাতে নিয়েছে।

দস্যুর কাছে পৌঁছলেন হাদিদ। হাতের বর্শা দিয়ে আঘাত করলেন দস্যুর পিঠে। ঘোড়া একদিকে সরে গেল। দস্যুটা বেঁচে গেলেও আঘাত লাগল ঘোড়ার পিঠে।

ঘুরলেন হাদিদ। দস্যুটা ঘোড়া ঘোরাতে চাইল। মেয়েটা বাধা দিচ্ছে।

হাদিদ মেয়েটাকে ডাক দিল। ও আরও সাহসী হয়ে উঠল।

যুবতীকে সাথে নিয়ে ঘোড়া থেকে লাফ দিল দস্যু। ঢাল হিসাবে ব্যবহার করল নিজের ঘোড়া। হাদিদ আঘাত করতে চাইলেই যুবতীকে সামনে এগিয়ে ধরছে।

ঘোড়া থেকে নেমে এলো হাদিদ। ততক্ষণে পৌঁছে গেছে পেছনের আরোহী। রক্ষী নয় দস্যু। সেও ঘোড়া থেকে নামল।

হাদিদ ধমকের সুরে বললেন, ‘তোমরা যুবতীকে নিয়ে যেতে পারবে না।’

এক ডাকাত ওকে ধরে রেখেছে। লড়ছে দ্বিতীয় জন। মেয়েটা নিরস্ত্র। হাদিদের সামনে টিকতে পারছে না দস্যুটা। তাই দেখে মেয়েটাকে ছেড়ে দু’জন একত্রে হাদিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

হাদিদ মেয়েটাকে বললেন, ‘ঘোড়া নিয়ে তুমি সুবাকের দিকে পালিয়ে যাও। এদের আমি ঠেকাচ্ছি।’

নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল তরুণী।

দস্যু দু’জন বার বার বলছিল, ‘একটা রমনীর জন্য নিজের জীবন হারিও না। তুমি পালাতে চাইলে আমরা তোমাকে বাধা দেব না।’

‘অসম্ভব। ওকে নিতে হলে আগে আমাকে মারতে হবে, তারপর ওকে পাবে।’ হাদিদের স্পষ্ট জবাব।

তিনি কয়েকবারই যুবতীকে পালিয়ে যেতে বললেন। ও বলল, ‘তোমাকে একা ফেলে রেখে আমি যাব না।’

আহত হলেন হাদিদ। আবার যুবতীকে বললেন, ‘আমি আহত, মারা যাচ্ছি আমি। আমি আবারও বলছি, পালাও তুমি। আমি আরও কিছুক্ষণ ওদের ঠেকিয়ে রাখতে পারব, দেরী করো না, এখনও বলছি, পালাও।’

যুবতী পালিয়ে যায় কিনা তা দেখার জন্য ওদিকে ফিরল এক দস্যু। এ সুযোগে তার পাজরে বর্শা মারলেন হাদিদ। পড়ে গেল সে। অন্য দস্যুটার তরবারীর আঘাত লাগল তার কাঁধে।

তরুণী পড়ে যাওয়া ডাকাতের তারবারী তুলে নিয়ে পেছন দিক থেকে দ্বিতীয় ডাকাতের পিঠে আমূল বাসিয়ে দিল। আহত কাঁধ নিয়েই পাঁই করে ঘুরল হাদিদ।

পেছন থেকে যুবতীর তরবারী যখন আঘাত করছিল দস্যুটাকে তখন হাদিদের বর্শাও তার বুক ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে শুরু করেছে। দু’দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল দস্যু।

যুদ্ধ শেষ। ডাকাত দু’জন নিহত। দাঁড়াতে পারছিল না হাদিদ। পড়ে যাচ্ছিল, ধরে ফেলল যুবতী।

হাদিদ বললেন, ‘তুমি সুস্থ? আমায় ছেড়ে একটা ঘোড়া নিয়ে এক্ষুণি সুবাক রওয়ানা কর। সঙ্গীদের দিকে যেয়ো না। ওদের কেউ হয়ত বেঁচে নেই।’

‘কোথায় আঘাত লেগেছে আপনার?’

‘আমাকে মরতে দাও, চলে যাও তুমি। আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব তুমিই পালন কর। ডাকাতদের কেউ আবার এদিকে এসে পড়লে আর পালতে পারবে না।’

যুবতীর মনে এখন আর কোন সন্দেহ নেই। ও বুঝেছে তার জন্যই লোকটা নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।

সে তাকে একা রেখে যেতে অস্বীকার করল। দৌড়ে গেল ঘোড়ার কাছে। জিনের সাথে বাধা মশক এনে হাদিদকে পানি পান করাল। বলল, ‘দেখি, আপনার আঘাতটা কোথায় লেগেছে?’

হাদিদ ক্ষতস্থান দেখালেন। যুবতী তাড়াতাড়ি তার ওড়না ছিড়ে ক্ষতস্থান বেঁধে দিল।

‘আপনি আমার জন্য আপনার জীবন বিপন্ন করেছেন। আপনাকে একা রেখে আমি কিছুতেই এখান থেকে যাব না। যদি আমার ভাল চান তবে উঠুন। ভাগ্য ভাল হলে আমরা বেঁচে যেতেও পারি।’

‘তুমি …’

‘আমার নাম সিনথিয়া।’

হাদিদ তাকিয়ে দেখলেন যুবতীকে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন, ও যা বলেছে তাই করবে। বললেন, ‘কিন্তু সিনথিয়া, আমার যে যাওয়ার শক্তি নেই।’

যুবতী হাদিদকে ধরে দাঁড় করাল। ধীরে ধীরে নিয়ে গেল ঘোড়ার কাছে। এরপর অনেক কষ্টে ঘোড়ার পিঠে বসাল। নিজে অন্য ঘোড়ার উঠতে গেলে হাদিদ বলল, ‘আমি একা বসতে পারব না।’

দু’টো ঘোড়ার রশি একটার জিনের সাথে বেঁধে তরুণী হাদিদের পেছনে উঠে বসল। যুবতী হাদিদের মাথা নিজের কাঁধে নিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সুবাক কোন দিকে?’

হাদিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে ডানদিকে ইশারা করে বললেন, ‘ওদিকে চলো।’

এগিয়ে চলল ঘোড়া। হাদিদ আবার বললেন, ‘হয়ত আমি বাঁচব না । ক্ষতস্থান থেকে এখনও রক্ত ঝরছে। যেখানেই আমার মৃত্যু হয় মাটি চাপা দিয়ে রেখো। আমার ব্যাপারে কোন সন্দেহ হয়ে থাকলে তা দূর করে আমায় ক্ষমা করে দিও। আমি আমানতের খেয়ানত করিনি। আল্লাহ তোমাকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দিন।’

‘আল্লাহ আপনাকে সুস্থ করে তুলুন। দয়া করে এখন আর কথা বলবেন না।’

ঘোড়া এগিয়ে যাচ্ছে! এগিয়ে যাচ্ছে সময়। জনমানবহীন সুনসান দুস্তর মরুভূমিতে শেষ রাতের হিমেল ঠাণ্ডা। সে শীতার্ত ঠাণ্ডা মাড়িয়ে ঘোড়ার পিঠে আহত মুসলিম কমাণ্ডার হাদিদের মাথা কোলে নিয়ে এগিয়ে চলেছে সিনথিয়া নামের এক খ্রিষ্টান গোয়েন্দা যুবতী। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা তার কাছে মনে হচ্ছিল এক দুঃস্বপ্ন।

* * *