তিনি রাতে বিশ্রাম না নিয়ে সফর অব্যাহত রাখলেন। বাকীরা রাতের মত তাঁবু টানিয়ে নিল।
আমের বিন উসমানকে রাখা হলো কাফেলার সাথে। সূর্য ডোবার সাথে সাথেই ক্যাম্প করে রাত কাটানোর ব্যবস্থা হলো।
রাজিয়া খাতুন ও শামসুন নেছার তাঁবু হেরেমের দাসী বাদীদের তাঁবু থেকে সামান্য দূরে স্থাপন করা হলো। এটা ইয়াজুদ্দিনেরই নির্দেশ ছিল। তিনি হুকুম জারী করে বলেছিলেন, ‘রাজিয়া খাতুনের মর্যাদার দিকে খেয়াল রেখো। ওদেরকে দাসী বাদীদের থেকে দূরে রাখবে।’
এলাকাটা ছিল শস্য শ্যামল এক পার্বত্য উপত্যকা। রাতে আমের বিন উসমান মশালের আলোয় তার গার্ড বাহিনী নিয়ে তাঁবুর চারদিকে পাহারা বসালো।
সময়টা ছিল শান্তিপূর্ণ। কোন যুদ্ধ বিগ্রহ ছিল না, কোন ভয়েরও আশংকা ছিল না।
সুলতান আইয়ুবী তখন মিশরে। খৃস্টান বাহিনীও সেখান থেকে বহু দূরে বসে সুলতান আইয়ুবীর পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে তাকিয়েছিল। তবুও আমেরের দায়িত্ব ছিল, ক্যাম্পের নিরাপত্তার জন্য টহলের ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে মরু ডাকাত বা হিংস্র পশুর আক্রমণ থেকে কাফেলাকে সুরক্ষা করা।
আমের ও তার বাহিনী তাঁবুর চারপাশে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল। আমের ডিউটি দিচ্ছিল হেরেমের দাসীদের তাঁবুর পাশে। ওখানে তখন সে একাই ডিউটি দিচ্ছিল।
হাঁটতে হাঁটতে সে তাঁবু থেকে বেশ কিছুটা দূরে চলে গেল। জায়গাটা আলো-আঁধারীর কারণে রহস্যময় হয়ে উঠেছে।
আমের বিন উসমান তাকালো পাহাড়ের দিকে। মনে হলো পাহাড়ের কাছে এক ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে।
সে আরেকটু এগিয়ে গেল। ছায়ামূর্তি এবং সে কাছাকাছি হলো। ‘কে তুমি?’ আমের বিন উসমান ছায়ামূর্তির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো।
‘আমি তোমাকে অন্ধকারেও এতদূর থেকে চিনতে পেরেছি, আর তুমি কাছে এসেও আমাকে চিনতে পারছো না?’ উনুশীর কণ্ঠস্বর।
আমের বিন উসমান তার কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে বলল, ‘উনুশী! তুমি এত রাতে এখানে কি করছো? যাও, তাঁবুতে ফিরে যাও।’
‘আমি তো তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আমি জানতাম ডিউটি দিতে দিতে তুমি এদিকে একবার আসবেই। সে আশাতেই অপেক্ষা করছিলাম আমি। এত তাড়া কিসের? চলো পাহাড়ের খাঁজে গিয়ে একটু বসি।’
‘না উনুশী, এখন আমি ডিউটিতে ব্যস্ত। ডিউটি ফেলে গল্প করার মত সময় আমার নেই। তুমি তাঁবুতে ফিরে যাও।’
‘ডিউটি দিতে তোমাকে কেউ নিষেধ করেনি। এখানে এই মরুভূমিতে তোমাকে কেউ কামড়াতে আসবে না সবাই ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক। এসো আমরা গল্প করি।’
‘কি বলছো তুমি! আমার এখন অনেক কাজ। বিশাল এলাকা জুড়ে ক্যাম্প। দূরে পশুর পাল। সর্বত্র আমাকে টহল দিয়ে বেড়াতে হবে। সবাই ঠিকঠাক মত ডিউটি করছে কিনা দেখতে হবে। এখন তো আমি বসতে পারবো না।’
উনুশী তার ঘোড়ার সামনে গিয়ে ঘোড়ার লাগাম টেনে নিয়ে বললো, ‘অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে এস আমের, যার ভয় ছিল তিনি ত মুসেল চলে গেছেন। এখন আর ভয় কি, নেমে এসো বলছি।’
উনুশীর কণ্ঠ অনুনয় নয়, আদেশের সুর। আমের অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নামলো। উনুশী তার হাত ধরে টেনে নিয়ে তাকে এক পাথরের ওপর বসিয়ে দেল। আমের পোষমানা বিড়ালের মত কোন বাঁধা ছাড়াই তার ইশারা মেনে নিল।
‘আমের!’ আবেগ মাখা স্বরে উনুশী বললো, ‘তুমি আমাকে পাপিষ্ঠা ও শয়তান মেয়ে মনে করে আমার থেকে পালিয়ে বেড়াও। আমি জানি, তুমি আমার সম্পর্কে ভালমতই জানো।
আমি এও জানি, তুমি নিজেকে দরবেশ ও পবিত্র মনে করো আর তোমার যৌবন ও আকর্ষণীয় দেহসৌষ্ঠব নিয়ে গর্ববোধ করে। কিন্তু তুমি এখনও সেই আসল সত্যটি উপলদ্ধি করতে পারছো না, যা তোমার জানা দরকার।
একদিন তোমার এই সুন্দর দেহ রক্তে রঞ্জিত লাশ হয়ে মাটিতে পড়ে থাকবে।
কারণ এখন সময়টা হচ্ছে যুদ্ধের। এখন সময়টা হচ্ছে, মানুষকে মারার ও মরার। কেবল যুদ্ধের ময়দান নয়, কেল্লা বা মহলের মধ্যেও চলছে হত্যার গোপন ষড়যন্ত্র। এই গোপন ষড়যন্ত্র কখন কাকে উঠিয়ে নেবে দুনিয়া থেকে কেউ জানে না। তুমি যে কখনো এমন হামলার শিকার হবে না তার নিশ্চয়তা কি? তাই বলছি, তোমার পৌরুষ ও সৌন্দর্য নিয়ে বড়াই করো না।’
‘তুমি কি আমাকে হত্যা করার হুমকি দিচ্ছ?’
‘না, তা নয়।’ উনুশী উত্তর দিল, ‘আমি তোমাকে এ কথা বুঝানোর চেষ্টা করছি যে, যদি তোমার ধারণা হয়, আমি তোমার সৌন্দর্য ও সুঠাম দেহ দেখে পাগল হয়ে গেছি, তবে সে ধারণা মন থেকে মুছে দাও।
দেহপসারিনীর দেহ বিলাসের অভাব হয় না। কিন্তু দেহ বিনোদনই সব কথা নয়। দেহের সাথে মানুষের একটা মনও থাকে। মানুষ যতই নিজেকে পাথর মনে করুক না কেন, মন কোনদিন পাথর হয় না। আত্মা শুকিয়ে যায়, কিন্তু মরে না।
মন ও আত্মাকে সেই ভালবাসাই জীবিত রাখে, যে ভালবাসার সঙ্গে দেহের কোন সম্পর্ক নেই। আমাকে আরও গভীরভাবে দেখো। আমার শরীরের সৌন্দর্য ও যাদু লক্ষ্য করো।
আমি এতই রূপসী যে, লোকেরা আমাকে শাহজাদী না বলে পরী বলে। তোমার বাদশাহ ও আমীররা আমার পদতলে এসে তাদের ঈমান বিসর্জন দিয়েছে। কিন্তু আমি এমন এক পিপাসায় মরছি, যে পিপাসা আমি আজও মিটাতে পারিনি। তোমাকে দেখে আমার এত ভাল লেগে গেল যে, আমি তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য অধীর হয়ে উঠলাম।
স্বীকার করছি, আমি যখন প্রথম বার তোমার কাছে এসেছিলাম, আমার নিয়ত পাক ছিল না। তুমি যখন আমাকে প্রত্যাখান করে মিষ্টি ভাষায় আমাকে বুঝিয়ে দূরে সরে গেলে, তখনই আমার মনে আবার সেই পিপাসা জেগে উঠল। আমি তখন বুঝতে পারলাম, আমার পিপাসাটা আসলে কিসের এবং সে পিপাসা সেই থেকে আমাকে পেরেশান করে তুলেছে।
মন থেকে আমি তোমাকে গভীর ভালবেসে ফেলেছি। এর পেছনে তোমার সৌন্দর্য বা দেহ সৌষ্ঠব নয়, কাজ করেছে তোমার চরিত্র ও ভদ্রতার আকর্ষণ। এই আকর্ষণের প্রভাবই আমাকে অন্যদের ঘৃণা করতে শিখিয়েছে।
যারা আমাকে বিলাসিতা ও বিনোদনের খেলনা বানিয়েছে আমি তাদের ঈমান ছিনিয়ে নিয়েছি। তারা আমার হাতে তাদের জাতীয় গৌরব সঁপে দিয়ে আমার কাছ থেকে লুফে নিয়েছে শরাবের পিয়ালা।
আমি সেই পিয়ালায় ডুবিয়ে দিয়েছি তাদের নীতি নৈতিকতা। কিন্তু তোমাকে আমি সেভাবে চাইনি। তোমাকে ভেবেছি, পথশ্রান্ত মুসাফিরের সামনে সতেজ মরুদ্যানের মত। আমের, তুমি আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিও না।’
সে আবেগে আপ্লুত হয়ে নিজেকে উজাড় করে নিবেদন করছিল আমেরের কাছে। আমের বিন উসমান উৎকট মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে তার কথা শুনছিল আর মনে মনে ভাবছিল, ‘হায়, যদি কেউ দেখে ফেলে! এ মেয়ে তো আমাকে খুন করে ফেলবে!’
আবার অন্য ভয়ও তাড়া করছিল তাকে। যদি শামসুন নেছা তাকে খুঁজতে খুঁজতে এদিকে এসে পড়ে তবে তো তার ভালবাসাও শহীদ হয়ে যাবে।
এসব ভাবনা তাকে এতটাই অস্থির করে তুলছিল যা, সে উনুশীর বক্তব্য শুনছিল ঠিকই, কিন্তু গভীর রাতে নির্জন প্রান্তরে এক সুন্দরী মেয়ের আবেগ ভরা কথা তার কানে ঢুকলেও মনে কোনই প্রভাব ফেলতে পারছিল না।
‘তুমি কি ভয় পাচ্ছ?’ অস্পষ্ট আলোয় আমেরের মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে বলল উনুশী, ‘তুমি চুপ করে আছো কেন? কথা বলো। বলো, তোমার কি মন বলে কিছু নেই?’
উনুশী তার গাল দু’হাতে চেপে ধরে বললো, ‘যদি আমার মন মরে না গিয়ে থাকে তবে আমি মানতেই পারি না, তোমার মন মরে গিয়েছে।’
আমের কোন কথা বলছিল না, সে নিশ্চল পাথরের মত বসেছিল। উনুশীর আহবানে সে সাড়াও দিতে পারছিল না, সরেও যেতে পারছিল না।
উনুশী তার রেশম কোমল সৌরভমাখা নরম চুলের গোছা পেছনে সরিয়ে আমেরের বুকে মাথা রেখে বলল, ‘নিষ্ঠুর হয়ো না আমের, আমাকে ফিরিয়ে দিও না।’
সে আমেরের বুক থেকে মাথা তুলে আমেরের গাল মুখ মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, ‘কি ভাবছো আমের? তুমি কি আমার কোন কথারই জবাব দেবে না?’
শত হলেও আমের এক যুবক। এমন নির্জন প্রান্তরে আগুনের মত টকটকে আর মাখনের মত নরম এক যুবতীর স্পর্শে তার সমগ্র সত্ত্বায় শুরু হলো ভীষণ তোলপাড়।
উনুশী একটু হাসলো। তার সে হাসিতে ছিল সুরের অপূর্ব মূর্চ্ছনা। সে হেসে বললো, ‘তোমার মন সতেজ ও সজীব আছে। আমি টের পাচ্ছি তোমার মন ভীষণ ধড়ফড় করছে। আমের, আমি তোমার কাছে কি চাই? কিছুই না। তুমি আমার কাছে চাও। হীরা, মানিক, মুক্তা ও স্বর্ণের টুকরো, বলো কি চাও তুমি?’
‘সুদানী পরী, তোমার কাছে আমি কিছুই চাই না।’
এতক্ষণে মুখ খুলল আমের। বলল, ‘এবার আমাকে যেতে দাও, আমাকে আমার ডিউটি পালন করতে দাও।’
‘আমাকে শুধু উনুশী বলো।’ মেয়েটি বললো, ‘সুদানী পরী বলার লোকেরা ভালবাসা জানে না। তারা পাপী! তুমি তাদের চেয়ে অনেক মহান, অনেক উঁচুদরের লোক। তুমি আমার সমস্ত সহায় সম্পদ নিয়ে নাও, তার বিনিময়ে শুধু একটু পবিত্র ভালবাসা দাও।’
সে কথা বলতে বলতে তার গাল আমেরের গালের কাছে নিয়ে গেল। আমের চমকে পিছনে সরে গেল। তার মনে হলো, সে ভয়ংকর কোন ফনা তোলা সাপের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পালাতে গেলেও ছোবল খেতে হবে, দাঁড়িয়ে থাকলেও রেহাই নেই।
‘মনে হচ্ছে তোমার অন্তর আগেই অন্য কারো কাছে বিক্রি করে দিয়েছো?’
উনুশীর স্বর পাল্টে গেল। সেখানে ক্রোধ ও ক্ষোভের উত্তাপ, ‘কে সেই ভাগ্যবতী! কার পায়ের তোলে নিজেকে সঁপে দিয়ে দেউলিয়া বলে গেছো তুমি? কার জন্য তোমার সব ভালবাসা উজাড় করে দিয়েছো?’
আমের এবার ভয়ে কাঁপতে লাগল। তার মুখ শুকিয়ে গেল। গলা দিয়ে কোন স্বর বেরোল না।
উনুশী তাকে ছেড়ে দিয়ে হিসহিস করে বলল, ‘আমার যাদুর ফাঁদে পড়ে কেউ তোমার মত এমন করে ছটফট ও অনুতাপ করেনি। তুমি কেমন করে রক্ষীদলের কমান্ডার হলে? পুরুষ মানুষ এমন ভীতুর ডিম হয় আমার জানা ছিল না।
কাউকে যদি ভালই বাসো মুখ ফুটে তার নামটা বলার বলতে দোষ কি? আর আমাকে যদি তোমার ভাল না লাগে সেটা সাহস করে বললেই পারো! তুমি আমাকে ভালবাস না এ কথাটা বলার সাহসও নেই তোমার?’
আমের উপলদ্ধি করলো তার কিছু বলা দরকার। কিন্তু কি বলবে ভেবে পেল না। উনুশীই মুখ খুলল আবার।
সে রাগে দাঁত কটমট করে বললো, ‘তোমার এতটুকু অনুভূতি নেই যে, তুমি কাকে প্রত্যাখান করলে। তোমার চোখে এক পাপিষ্ঠা মেয়ে তোমার কাছে ভালবাসা ভিক্ষা চাচ্ছে। কিন্তু এমনও তো হতে পারতো, সে গোনাহ থেকে তওবা করে তোমার এক আল্লাহর পূজারী হয়ে যেতে পারতো।
অরে হতভাগা! তুই একটুও চিন্তা করলি না তুই কোন মেয়েকে নিরাশ করলি। যে মেয়ে তোর সরকারের গদীই উলটে দিয়েছে। যে মেয়ে ভাইয়ের হাতে ভাইকে হত্যা করায়, তুই তাকেই নিরাশ করলি! সেই তুলনায় তুই তো আমার কাছে একটা কীট পতঙ্গের বেশী কিছু না।’
‘তবে তুমি আমাকে তোমার পায়ের তলায় পিষে মেরে ফেলো।’ আমের বললো, ‘আমি তো বার বার বলেছি, আমি তোমার যোগ্য নই।’ সে উঠে দাঁড়ালো।
‘আমি তোমার কাছে কিছুই চাই না আমের।’ উনুশী আবার তার স্বর পাল্টে ফেলল। আমেরের হাত দুটি আঁকড়ে ধরে বললো, ‘শুধু এইটুকু দয়া করো, তুমি আরো কিছুক্ষণ আমার কাছে বসে থাকো। আমাকে তোমার আশ্রয়ে নিয়ে নাও।’
আমের তার এ আবেদনে সাড়া না দিয়ে জলদি সরে গিয়ে তার ঘোড়ার কাছে পৌঁছে গেল। উনুশী ছুটে গিয়ে তার পথ আগলাতে চাইল, কিন্তু আমের তার তোয়াক্কা না করে ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে একদিকে ঘোড়া চালিয়ে দিল।
আমের বিন উসমানের ঘোড়া সরে গেল সেখান থেকে। ঘোড়া চলছিল ধীরে ধীরে। আমের মাথা নত করে বসেছিল ঘোড়ার পিঠে। তার নাকে তখনো উনুশীর চুলের ঘ্রাণ লেগেছিল। গালের উপর অনুভব করছিল উনুশীর হাতের নরম ছোঁয়া। তার মাদকতাময় কণ্ঠের ধ্বনি সুর লহরী তুলে বাজছিল কানে।
আমের বিন উসমান এই মোহন ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল। সে অনুভব করছিল, যদি উনুশী এভাবে তার সাথে আরেকবার নির্জন অন্ধকারে সাক্ষাত করতে পারে, তবে তার প্রতিজ্ঞা টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
সে তার চিন্তার গতি শামসুন নেছার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। সন্ধ্যায় তাঁবু টানানোর সময় শামসুন নেছার সাথে তার সাক্ষাতের কথা স্মরণ হলো তার। সেই সাক্ষাতের সময়ই তারা রাতে কখন কোথায় মিলিত হবে ঠিক করে নিয়েছিল। সে তাড়াতাড়ি সেদিকে তার ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ধরলো।
এ সময় সে আবার উনুশীর ডাক শুনতে পেল। সে ফিরে পিছনে তাকালো, কিন্তু অন্ধকারে সে উনুশীকে দেখতে পেল না। সে এক টিলার পাশ ঘুরে সেই জায়গায় গিয়ে পৌঁছলো, যেখানে শামসুন নেছার আসার কথা।
আমের যেমন ভাবে উনুশীর ছায়া দেখেছিল ঠিক তেমনি সে শামসুন নেছার ছায়াও দেখতে পেলো। তার ঘোড়া সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল। কাছাকাছি গিয়ে আমের ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এলো।
‘এতক্ষণ তুমি কোথায় ছিলে?’ শামসুন নেছা উদগ্রীব কণ্ঠে তাকে বললো, ‘আমি অনেকক্ষণ ধরে এখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।’
‘আমার কাজ তো তুমি জানোই।’ আমের মিথ্যা বললো, ‘ডিউটি সাজাতে গিয়ে পথে পথে নামতে হলো, সে জন্য দেরী হয়ে গেছে।’
‘নিজের লোকদের কথাও মনে রেখো।’ শামসুন নেছা বললো, ‘তাড়া সবাই খুব সতর্ক। তাদের ওপর আস্থা রাখলে তোমার কাজ সহজ হবে।’
শামসুন নেছা সেই লোকদের কথা বলছিল, যারা হলবে সুলতান আইয়ুবী ও রাজিয়া খাতুনের হয়ে গোয়েন্দাগিরি ও তথ্যানুসন্ধানের কাজ করছে। এদের মধ্যে মহলের চাকর বাকরও আছে। তারাও এই কাফেলার সাথে যাচ্ছে। আরও কিছু লোককে সঙ্গে আনা হয়েছে যারা দিন মজুরের কাজ করতো।
তাদের আনা হয়েছে তাঁবু খাটানো, গুটানো ও অন্যান্য কাজের জন্য। তাদের সঙ্গে ওয়াদা করা হয়েছে, মুশেলে পৌঁছে তাদের কাজের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। রাজিয়া খাতুনের দাসী এসব মজুর সংগ্রহ করে দিয়েছে। শামসুন নেছা এবং আমের বিন উসমানও দেখেছে তাদের।
একটা পাথর দেখিয়ে আমের বলল, ‘এসো, এখানে বসি।’
শামসুন নেছা তার হাত ধরল। আমের তার কোমর বেষ্টন করে পা বাড়াল পাথরের দিকে।
কোমর বেষ্টন করার কারণে দু’জন একেবারে ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলো।
এক কদম সামনে এগিয়েই শামসুন নেছা থেমে গেল। সে তার নাক আমেরের বুকে লাগিয়ে শুকলো এবং সঙ্গে সঙ্গে তাকে ছেড়ে দিয়ে দু’কদম দূরে গিয়ে বললো, ‘সত্যি করে বলতো, তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে? কার কাছে ছিলে?’
‘ডিউটি ভাগ করে একটু পশুগুলোকে দেখে এলাম।’ আমের আবারও মিথ্যা বলল।
‘তোমাদের পশুগুলোও এখন সুগন্ধি মাখতে শুরু করেছে নাকি?’
শামসুন নেছা তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে চাপা রাগের সাথে বলতে লাগলো, ‘তুমি তো কোনদিন সুগন্ধি ব্যবহার করো না! আর এ সুগন্ধ কোন পুরুষের শরীরের নয়, মেয়ে মানুষের।’
আমের নিরব হয়ে গেল। বুঝতে পারল, এভাবে মিথ্যে বলা ঠিক হয়নি তার। এখন সত্য কথাও শামসুন নেছার কাছে মিথ্যাই মনে হবে। একবার বিশ্বাস হারালে সেই আস্থা ও বিশ্বাস আর ফিরিয়ে আনা যায় না।
শামসুন নেছার কাছে সত্য গোপন করার পরিবর্তে ঘটনা খুলে বলার জন্য সে বললো, ‘বিশ্বাস করো, আমি তোমার কাছে মিথ্যে বলতে চাইনি। কিন্তু ভাবলাম, সব কথা তোমাকে শুনিয়ে লাভ কি? তাই একটি ঘটনা তোমাকে বলা হয়নি।’
‘বুঝতে পারছি, তুমি অই সুন্দরী ডাইনীর পাল্লায় পড়েছিলে। তাহলে তুমিও শেষে ওই ডাইনীর ফাঁদে পা দিলে?’
‘না শামছি, বিশ্বাস করো এখনও তেমন কিছু ঘটেনি।’
আমের বললো, ‘আমি আসার পথে সে আমাকে রাস্তায় আটকে দিল। আমি সে কথা তোমাকে জানাতে চাচ্ছিলাম না ঠিকই, কিন্তু এ নিয়ে তোমার সন্দেহ করা উচিত নয়। আমি এত নির্বোধ নই যে তার ফাঁদে পড়বো। স্বীকার করছি, তুমি আমার বুকে যে সুগন্ধির ঘ্রাণ পেয়েছো সে ঘ্রাণ তারই। কিন্তু এতেই যে আমি তার হয়ে গেছি এ কথা মনে করার কোন কারণ নেই।’
‘বাহ! কি চমৎকার কথা! তুমি কোনদিন আমার কাছে মিথ্যে বলবে, ভাবিনি। অথচ এক ডাইনীর শরীরের ঘ্রাণ বুকে নিয়ে বলছো তুমি আমার হওনি। তাহলে সে তোমার বুকের নাগাল পেল কেমন করে?’
আমেরের বুকের ভেতরটা কেঁপে গেল। সে ভয়ের ভাব বুকে নিয়েই বলল, ‘আমি খুবই অস্থির আছি শামছি। আমাকে একটু শান্ত হতে দাও, সব তোমাকে খুলে বলবো। আমি কোন শাসক, আমীর বা সেনাপতি নই; সামান্য চাকরিজীবী মাত্র।
উনুশী আমাকে সহজেই তার প্রতিশোধের টার্গেট বানাতে পারে। আমি যে অবস্থায় তার হাত ফসকে বেরিয়ে এসেছি, তা সে সহজভাবে মেনে নাও নিতে পারে। বিশ্বাস করো, আমার খুব ভয় করছে।’
আমেরের কথার চেয়েও তার কণ্ঠস্বরে প্রভাবিত হয়ে শামসুন নেছা বললো, ‘মনে হচ্ছে আজ সে তোমাকে একটু বেশীই বিরক্ত করেছে?’
‘অনেক বেশী।’ আমের বিন উসমান উত্তর দিল, ‘আজ সে আমার কাছে তার হৃদয় উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে। সে এ পর্যন্ত বলেছে, সে গোনাহগার ও বদকার মেয়ে হলেও আমার সাহচর্য পেলে সে ভাল হয়ে যাবে।
কিন্তু আমি তাকে প্রত্যাখান করায় সে আমার ওপর ভীষণ ক্ষেপে গেছে। আমাকে হুমকি দিয়ে বলেছে, সে যেখানে সরকার পাল্টে দেয়ার ক্ষমতা রাখে, ভাইকে দিয়ে খুন করাতে পারে সেখানে আমি এক কীট-পতঙ্গের বেশী কিছু নই।
আমি যখন তাকে ফেলে সেখান থেকে পালিয়ে আসি তখনো সে আমার পিছু পিছু ছুটছিল আর আমাকে ডাকছিল। আমার খুব ভয় করছে শামছি!’
‘শান্ত হও! এত উতলা হলে বিপদ বাড়া ছাড়া কমবে না। সে যখন এত করেই তোমার ভালবাসা চাচ্ছে তখন কিছু ভালবাসা না হয় তাকে দিলেই!’
‘কি বলছো তুমি! সে তার যত ধন রত্ন সব আমার পদতলে রেখে দিয়ে তার বিনিময়ে আমার কাছে পবিত্র ভালবাসা চায়। কিন্তু জীবন গেলেও আমি তোমাকে ধোঁকা দিতে পারবো না, শামছি!’
‘তবে তুমি তাকেই ধোঁকা দাও। ভালবাসার ধোঁকা।’ শামসুন নেছা বললো, ‘তাকে সে ভালবাসা দাও যে ভালবাসা সে চায়। তার বিনিময়ে তুমি তার কাছ থেকে জেনে নাও সেই গোপন তথ্য, যা আমাদের দরকার।
সে তো তার ক্ষমতার কথা তোমাকে বলেই দিয়েছে। এখন সে ক্ষমতা তুমি তোমার স্বার্থে ব্যবহার করার ফন্দি বের করো। তুমি তো আর কোন আনাড়ি ব্যক্তি নও, তুমি এক সতর্ক সৈনিক। ব্যাপারটা কি করে সামাল দিবে ভাল করে চিন্তা করো। তার কাছ থেকে জেনে নাও তাদের ভেতরের খবর। তারপর সে খবর আমাকে জানাও।’
শামসুন নেছার কোথায় দৃষ্টিভঙ্গির নতুন দিগন্ত খুলে গেল আমের বিন উসমানের। বলল, ‘আমি তো এভাবে চিন্তা করিনি!’
‘এবার করো।’
‘আমি তো আরো ভয় পাচ্ছিলাম তুমি আমকে ভুল বুঝে বুঝবে।’
‘আমি তোমার ও আমার ভালবাসাকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দিয়েছি।’
শামসুন নেছা বললো, ‘মা আমাকে প্রতিদিন যে কথা বলেছেন, সে কথা আমার অন্তরে গেঁথে গেছে। আমার ভালবাসার মৃত্যু নেই। মায়ের আশা সফল করার জন্য সব রকম কোরবানীর জন্য প্রস্তুত হতে হবে আমাদের।
প্রথমে আল্লাহ ও পরে আমার কাছে শপথের কথা স্মরণ রাখবে, তখন আর কোন ভুল হবে না। সে কি জেনে গেছে, তুমি আমার সাথে দেখা করো?’
‘না।’ আমের বললো, ‘আমি এ ব্যাপারে তাকে কিছুই বলিনি।’
‘একটা কাজের কথা শোনো।’ শামসুন নেছা বললো, ‘হলবের থেকে বিদায় নেবার কিছুক্ষণ আগে কায়রো থেকে এক লোক এসেছে। সে জানতে চায়, ইয়াজউদ্দিনের নিয়ত কি আর খৃস্টানদের পরিকল্পনাই বা কি। তাকে সঠিক কোন উত্তর দেয়া সম্ভব হয়নি।
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী খুব শীঘ্রই কায়রো থেকে অভিযানে বের হবেন। সে লোক বলেছে, সুলতান আইয়ুবী এ জন্য আগেই অভিযান চালাতে বাধ্য হচ্ছেন যে, খৃস্টান বাহিনী মুশের, হলব ও দামেশকের দিকে অগ্রসর হলে কায়রো থেকে সৈন্য সঠিক সময়ে এসে পৌঁছতে পারবে না।
এখানে ভয় হলো, সুলতান আইয়ুবী তার সেনাবাহিনীকে এদিকে পাঠালেন, আর খৃস্টানদের চাল অন্য রকম হলো, তখন তাঁর সেনাবাহিনীকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হবে। আমাদেরকে অতি সত্বর জানতে হবে, গাদ্দার মুসলিম শাসকদের স্বপ্ন কি আর খৃস্টানদের সংকল্পই বা কি?’
‘আমি শুনেছি, সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দারা আকাশের খবরও নিতে পারে।’ আমের বিন উসমান বললো, ‘কেন, খৃস্টানদের এলাকায় কি তাঁর কোন গোয়েন্দা নেই?’
‘মা আমাকে যা বললেন, তাতে তিনি এ কথাই বললেন এ, ইসহাক তুর্কী নামে এক যোগ্য ও সুচতুর গোয়েন্দা আছে।’ শামসুন নেছা বললো, ‘সে বৈরুত গিয়েছিল। সঠিক খবর তারই দেয়ার কথা। কিন্তু তার কাছ থেকে কোন সংবাদ এ পর্যন্ত কায়রো পৌঁছেনি। ফলে সুলতান অন্ধকারে পড়ে গেছেন।
দেখো আমের, সৈন্যদের তৎপরতা ও আনাগোনা শুরু হলে সে খবর আর গোপন থাকে না, জানাজানি হয়ে যায়। কিন্তু এখানে তেমন কোন চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে না। ফলে ধরে নিতে পারো, গোপন পরিকল্পনা ও তথ্য যা আছে তা সবই ইয়াজউদ্দিন ও ইমাদউদ্দিনের মনের খাতায় লেখা। এসব উদ্ধার করা ভেতরের লোকের পক্ষেই সম্ভব। আর এ গোপন সংবাদ তোমাকে উনুশীই দিতে পারে।’
‘কিন্তু সে যে মূল্য চায় সে মূল্য তো আমি তাকে দিতে পারবো না।’ আমের বললো।
‘তোমাকে এ মূল্য দিতেই হবে।’ শামসুন নেছা বললো, ‘এর জন্য যে কোন মূল্য দিতে আমি প্রস্তুত। আমি আমার ভাইয়ের গোনাহের কাফফারা দিতে চাই। মুসলিম মিল্লাতের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমার অন্তরের ভালবাসা এবং জীবনের সব আশা আকাংখাও কোরবান করতে প্রস্তুত আমি। আমাদেরকে সেইসব শহীদদের ঋণ পরিশোধ করতে হবে, যারা ইসলামের জন্য তাদের যুবতী স্ত্রীদের বিধবা করে গেছে। আমের! আর কিছু চিন্তা করো না। সবকিছু কোরবানী দাও। আমি যা বলছি তাই করো।’
রাত গভীর হয়ে এসেছিল। উনুশীর ব্যাপারে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আর সংকল্প নিয়ে ওরা তাঁবুর দিকে হাঁটা ধরল।
সমাপ্ত