» » ইহুদী কন্যা

বর্ণাকার

‘আমি কি উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি, তা আপনাকে আগেই বলেছি।’

রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘আমি শুধু আমার গর্ভে আপনার সন্তান জন্ম দিতে ও ঘরকুনো বিবি হতে এখানে আসিনি। আরাম আয়েশে গড়াগড়ি খাওয়া পাটরানী আমি নই। আপনি যদি ভেবে থাকেন কোন আলিশান কামরায় বন্দী থেকে আমি খুশী হবো, ভুল ভেবেছেন।

আমি আপনার স্ত্রী হিসাবে যদি এই মহলের রানী হয়ে থাকি তবে এখানে রানীর মতই বসবাস করতে চাই। আমি আমার মহল ঘুরে ঘুরে দেখতে চাই। জানতে চাই এ মহল খৃস্টানদের অশুভ ছায়া মুক্ত করতে কিনা। যদি তা না হয়ে থাকে তবে একে শত্রুর ছায়া মুক্ত করতে হবে। আমি এ সংকল্প থেকে একটুকুও বিরত হবো না।’

‘আমিও তোমাকে স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, আমার কোন কাজে তুমি হস্তক্ষেপ করবে না।’

ইয়াজউদ্দিন বললেন, ‘তুমি আমার বিবি, আর এটিই তোমার জন্য আমার হুকুম। যদি বাড়াবাড়ি করো তবে তোমার জন্য ঘোড়ার গাড়ীতে বেড়ানোর যে অনুমতি দেয়া হয়েছে তাও বন্ধ করে দেয়া হবে।’

‘আর আমি যদি আপনার এ হুকুম না মানি তখন কি হবে?”

‘তখন এই হবে যে, তুমি আর এ কামরা থেকে বেরোতে পারবে না, এখানেই বন্দী জীবন যাপন করবে।’

ইয়াজউদ্দিন একটু দম নিয়ে বললেন, ‘আর তোমাকে এটাও বলে দেয়া দরকার মনে করি, আমি তোমাকে কোন অবস্থাতেই তালাক দেবো না আর তোমাকেও তালাক দিতে দেবো না।’

ইয়াজউদ্দিন এটুকু বলেই রাগে কামরা থেকে বের হয়ে গেলেন।

‘আপনি বড্ড ভুল করে ফেললেন।’

ইয়াজউদ্দিন কামরা থেকে বেরিয়ে গেলে দাসী কামরায় প্রবেশ করে বললো, ‘যদি আপনি জিদ করেন তবে এ ব্যক্তি আপনাকে সত্যি সত্যি কয়েদী বানিয়ে ফেলবে। আমি তো আগেই আপনাকে বলেছি, আপনার স্বাধীনতা খর্ব করার জন্যই তিনি আপনাকে বিয়ে করেছেন।

আপনি যেনো আর কখনো আইয়ুবীর সহযোগিতা করতে না পারেন সে জন্যই এ পথ বেছে নিয়েছেন। এখন আপনার বাড়াবাড়ির ফলে তিনি আপনাকে এমন জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন, যা আপনি কখনো কল্পনা করেননি। আপনাকে নিকৃষ্টতম সাজা দিতেও বাঁধবে না তার।’

‘কিন্তু তাই বলে আমি তার বশ্যতা কবুল করে নেবো? আমাকে এত দুর্বল ঈমানদার ভেবো না।’

‘না, আপনাকে আমরা কখনো দুর্বল ঈমানদার ভাবি না। ঈমানের দাবী পূরণের জন্যই আমি আপনাকে সতর্ক হতে বলি। বোকামী নয়, বুদ্ধিমত্তাই ঈমানদারের গুণ। আপনি তো আপনার স্বামীর মতলব সম্পর্কে এখন নিশ্চিন্ত হতে পেরেছেন। এবার আপনার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথ আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে।’

‘কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব! যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্রের ঝনঝনানি কখনো আমাকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি। কিন্তু এমন মহা সংকটে আমি আর কখনো পড়িনি। এর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার কোন উপায় যে আমি দেখছি না।’

‘আমার কথা শুনুন। আপনি এ সম্পর্কে আর তার সাথে কোন কথা বলবেন না। আপনার সংকল্প তার কাছে ফাঁস করবেন না। এখন আপনাকে কৌশলী হতে হবে। তাঁর সামনে সর্বদা হাসি খুশী মন নিয়ে থাকবেন। প্রকাশ্যে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নেবেন।

আজকের তিক্ত পরিবেশকে কিভাবে সহজ ও স্বাভাবিক হলে আপনার মুক্তির উপায় নিয়ে আমি আপনার সাথে কথা বলবো।’

‘আমি যে আশা ও স্বপ্ন নিয়ে এখানে এসেছি তার কি হবে?’

‘আপনার সে ইচ্ছা ও আশা আমি পুরণ করতে করতে চেষ্টা করবো। আপনি জানেন, আপনার মালিক আপনার ভ্রমণের জন্য বাইরে চার ঘোড়ার গাড়ী সাজিয়ে রেখেছেন। এই গাড়ীই আপনার মুক্তির পথ বের করে দেবে।

আমি আমার কমান্ডারের সাথে আপনার সাক্ষাত করাবো। ইসহাক তুর্কী এসে গেলে তার সঙ্গেও আপনার সাক্ষাত করাবো। তারপর তারাই আপনার মুক্তির একটা পথ বাতলে দেবেন।’

দাসীর কথা তখনো শেষ হয়নি, কামরার দরজা ধীরে ধীরে খুলে গেল। দু’জনই দেখলো, রাজিয়া খাতুনের কন্যা শামসুন নেছা সে দরোজার মুখ আগলে দাঁড়িয়ে আছে।

মুখটি তার হাস্যোজ্জ্বল বটে কিন্তু চোখে চিকচিক করছে অশ্রু। সহসা তার হাসি মিলিয়ে গেল, বাঁধভাঙ্গা অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে গেল চোখের মনি।

মা উঠে এগিয়ে গিয়ে কন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। দু’জনের চোখ থেকেই তখন গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। কান্নার আবেগ সামাল দেয়ার পরিবর্তে দু’জনেই ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।

দাসী বাইরে বেরিয়ে এল। মা-মেয়ে আল মালেকুস সালেহের কথা স্মরণ করে আরো কিছুক্ষণ কাঁদলো প্রাণ উজাড় করে।

‘তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?’ একটু শান্ত হয়ে রাজিয়া খাতুন জিজ্ঞেস করলেন।

‘চাচা ইয়াজউদ্দিন আপনার সঙ্গে দেখা করতে নিষেধ করেছিলেন।’

‘তাকে কি কোন কারণ জিজ্ঞেস করেছিলে, কেন তিনি দেখা করতে বারণ করেছেন?’

‘এসব প্রশ্নের তিনি কোন জবাব দেন না। শুধু বাজে প্যাঁচাল আর রহস্যভরা কথা বলেই তিনি বক্তব্য শেষ করেন।’ শামসুন নেছা উত্তর দিল।

‘তাহলে এখন এলে কিভাবে?’

‘এই মাত্র তিনি আমার কামরায় গিয়ে বললেন, শামসুন, এবার তুমি তোমার মায়ের সাথে দেখা করতে পারো।’

‘আর কি বললেন?’

‘বললেন, তিনি খুবই ব্যস্ত থাকবেন। আমি যেন মাকে বেশী করে সময় দেই।’

‘তিনি একথা বলেননি, তোমার মায়ের ওপর দৃষ্টি রেখো আর আমাকে জানিও, তার সাথে কে কে কথা বলে আর কি বিষয়ে আলাপ করে?’

‘হ্যাঁ।’ শামসুন নেছা সরলভাবে বললো, ‘তিনি এমন কিছু কথাও বলেছেন যার অর্থ আমি বুঝতে পারিনি। আমি বলেছি, ঠিক আছে, আমি খেয়াল রাখবো। তিনি বললেন, ‘তাহলে এখন তোমার মায়ের কাছে চলে যাও, পড়ে আমি তোমার কাছ থেকে সব জেনে নেবো।’

‘আমার সম্পর্কে আর কি বললেন?’

‘বললেন, তোমার মা বড় জিদ্দি মহিলা এবং ঝগড়াটে। তাকে বলে দিয়ো, আমি দেশের কাজে এত ব্যস্ত থাকি যে, ঘরে ফিরে তার এমন মেজাজ দেখলে আমি অধীর হয়ে পড়ি, কষ্ট পাই।’

‘শোনো বেটি!’ রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘এখন তোমার এই ছেলেমানুষী সরলতা বাদ দাও। তুমি এখন যুবতী হয়ে গেছো। আমি এটা বলতে চাই না যে, এখন তোমার বিয়ে হয়ে যাওয়া উচিত। মুজাহিদদের কন্যার হাতে মেহদীর পরিবর্তে রক্তের ছাপ থাকে।’

শামসুন নেছা মায়ের কথা মর্মার্থ কিছুই বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে।

মা বললেন, ‘শোন মেয়ে, উজ্জীবিতপ্রাণ কন্যাদের বিয়ের পালকি খুব কমই বইতে দেখা যায়। তাদের লাশই শুধু যুদ্ধের ময়দান থেকে উঠানো হয়।

তোমার দুর্ভাগ্য এই যে, তুমি তোমার ভাই ও তার উপদেষ্টাদের সাহচর্যে লালিত পালিত হয়েছো। এরা সবাই বিশ্বাসঘাতক, তোমার ভাইও একজন গাদ্দার ছিল।

তুমি তোমার ভাইয়ের সৈন্যদেরকে তার পিতার সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করতে দেখেছো। তোমার পিতার আদর্শের সৈনিক সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের সাথেও তাদের তুমি যুদ্ধ করতে দেখেছো। এ জন্যই তাকে আমি আমার ছেলে পরিচয় দিতেও ঘৃণা বোধ করতাম।

সে খৃস্টানদের বন্ধু এবং তাদের ষড়যন্ত্রের সহযোগী ছিল। আর এই খৃস্টানরা আমাদের জাতির শত্রু, ধর্মের শত্রু। তোমার বাবা আজীবন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছেন।’

‘কিন্তু ভাইয়া যে বলতেন, খৃস্টানরা বড় ভাল লোক, আমাদের অমায়িক বন্ধু!’ শামসুন নেছা বললো, ‘আর ভাইয়া সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে বলতেন, রক্তপিপাসু, খুনী।’

মা শামসুন নেছাকে খৃস্টানদের পরিকল্পনা ও সংকল্প কি বুঝিয়ে বললেন। বললেন, ‘তাদের বন্ধুত্বের মধ্যেও থাকে কঠিন শত্রুতা।’

রাজিয়া খাতুন কথা বলে যাচ্ছিলেন, ধীরে ধীরে শামসুন নেছার দৃষ্টি ও জ্ঞানের পর্দা খুলে যাচ্ছিল। মায়ের এক একটি কোথায় মেয়ের অন্তরে সৃষ্টি হচ্ছিল ভাবান্তর।

‘মুসলমানের বন্ধু কেউ না।’

রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘যারা আল্লাহর কালাম ও রাসুলের সুন্নতের অনুসারী নয় তারা মুসলমানের ভাল কামনা করতে পারে না।

শত্রুদের শত্রুতার সবচে কঠিন দিক হলো প্রকাশ্যে বন্ধুত্বের ভান করা। খৃস্টানরা হলব, মুশেল ও হারানের আমীরদের সাথে বন্ধুত্ব করে আমাদের জাতির ঐক্যবদ্ধ দেহকাঠামোকে কেটে টুকরো টুকরো করেছে।

তোমার ভাই তাদের হাতের পুতুল ছিল। আল্লাহ ও তার রাসুলের আদেশ হলো, তোমরা দ্বীনের রজ্জু ঐক্যবদ্ধভাবে শক্ত করে ধারণ করো। ইসলামের এই ঐক্যে ফাটল ধরানো মহা পাপ। কারণ অনৈক্যের এ ফাটল দিয়েই প্রবেশ করে ধ্বংসের বীজ। ভাইয়ে ভাইয়ে জড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষে। তাতে বিনষ্ট হয় মুসলমানদের অঢেল সহায় সম্পদ ও জীবন। বিলীন হয়ে যায় আপন অস্তিত্ব।

এ জন্যই কুরআন বার বার ঐক্যের তাগিদ দিয়েছে। বলেছে, কাফেরকে বিরুদ্ধে তোমরা সীসা ঢালা প্রাচীরের মত ঐক্য গড়ে তোল। এ ঐক্য গড়ে তুলতে হয় নিজের ব্যক্তিগত লাভ ও লোভকে দমন করে।

যদি নিয়মিত নামাজ রোজা করার পরও নিজের মনে ব্যক্তিগত লাভ ও লোভের আকাঙ্ক্ষা প্রবল থাকে, মনে করবে তুমিই ইসলামের দুশমন। নিজের ব্যক্তিগত লাভ ও লোভের আকাঙ্ক্ষা জয় করতে না পারলে তোমার হাতেই ঘটতে পারে জাতির সমূহ সর্বনাশ।’

‘কিন্তু ভাইয়া তো নিজে লড়াই করে ক্ষমতা দখল করেনি, আমীররাই তাকে গদীতে বসিয়েছিল। এতে তার দোষটা কোথায়?’

‘দোষ তার নেতৃত্বের লোভের। যদি তার মনে বিলাসিতা ও নেতৃত্বের লোভ না থাকতো তবে আমীরদের ফাঁদে সে পা দিত না। এক নাবালক শিশুর এমন কি যোগ্যতা সৃষ্টি হয়েছিল যে, সে জাতির নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য এগিয়ে যায়?

জাতির যারা মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী তাদেরকে কখনো নিজের মত কোরবানী করতে হয়, কখনো ত্যাগ করতে হয় সহায় সম্পদের মায়া। ঐক্যের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে এমন কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকতে হয় তাকে। কিন্তু তোমার ভাই তা পারেনি।’

‘এক নাবালেগ শিশুর মধ্যে এমন অদূরদর্শিতা তো থাক্তেই পারে।’

‘হ্যাঁ, পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, অদূরদর্শিতাও এক ধরনের অপরাধ। কাফেররা এমন অদূরদর্শী মুসলমানই খুঁজে বেড়ায়। তাদের কাঁধে সওয়ার হয়ে কবর খোঁড়ে মুসলমানদের।’

‘মা, কি বলছো তুমি!’ বিস্মিত শামসুন নেছা বলল, ‘এ তো দেখি সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র!’

‘হ্যাঁ, এই ষড়যন্ত্রের পথই বেছে নিয়েছে খৃস্টানরা। তারা বিলাসিতা ও ভোগের সামগ্রী সরবরাহ করে মুসলমানদের ঐক্যের দেয়ালে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে।

নারী, মদ, সম্পদ ও ক্ষমতার নেশা মানুষের মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দেয়। মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হলে আর মানুষ থাকে না, হয়ে যায় শয়তানের চেলা।

শয়তানের কোথায় যাদু থাকে। সেই যাদুর প্রভাবে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় তার মানবিক সত্ত্বা।

শয়তানের এ কাজ এখন করছে খৃস্টানরা। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে মানুষের নৈতিকতা ধ্বংস করা, সে কাজই এখন করছে ওরা।

‘হ্যাঁ মা, তুমি ঠিকই বলেছো। আমি এই মহলেই এমন সব কার্যকলাপ হতে দেখেছি।’

শামসুন নেছা বলল, ‘আমি তখন খুব ছোট ছিলাম, কিছু বুঝতাম না। যখন ভাই আমাকে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর নিকট এজাজ দুর্গ চেয়ে পাঠালেন তখন আমি কিছু না বুঝেই সুলতানের কাছে গিয়েছিলাম। তখন আমাকে কেউ বলেনি, আমি কি সর্বনাশ করতে যাচ্ছি। তখন আমার এটাও জানা ছিল না যে, এটা এক গৃহযুদ্ধ এবং এ যুদ্ধ খৃস্টানরাই মুসলমানদের মধ্যে বাঁধিয়েছে।

আমি এসবের কিছুই জানতাম না মা। তুমি এখন যা বললে তাতে আমার চোখ খুলে গেছে। এখন আমি বুঝতে পারছি কেন খৃস্টান মেয়েরা ভাইয়ার কাছে আসতো। কেন আসতো খৃস্টানদের দূত ও বণিকেরা। কেন তারা ভাইয়াকে নানা রকম উপহার সামগ্রী দিত।’

রাজিয়া খাতুনের চোখে অশ্রু এসে গেল। তাহলে মেয়েকে তিনি সত্য কথা বুঝাতে পেরেছেন! দীর্ঘদিন যে পর্দা দিয়ে তার চোখ ঢেকে রাখা হয়েছিল সেই আবরণ তিনি সরিয়ে দিতে পেরেছেন!

তিনি মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললেন, ‘মা, এই মহলে এখনও শয়তানের শাসন ও কর্তৃত্ব চলছে। ইয়াজউদ্দিন আমাকে রানী বানানোর জন্য বিয়ে করেনি, সে বিয়ে করেছে আমাকে বন্দী করার জন্য। আমি যাতে আর আল্লাহর সৈনিকদের উজ্জীবিত করতে না পারি সে জন্য এই রাজমহলের জিন্দাখানায় বন্দী করেছে আমাকে।’

শামসুন নেছা উদ্বিগ্ন হয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, ‘কি বলছো মা! তাহলে তুমি তাকে বিয়ে করলে কেন?’

‘আমি বিয়েতে এ জন্যই রাজী হয়েছিলাম, যাতে মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। সুলতান আইয়ুবীর ভাই সুলতান তকিউদ্দিন বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার সময় এ কথাই বলেছিলেন।

তিনি চাচ্ছিলেন আমি যেন ইয়াজউদ্দিনকে বিয়ে করে হলব ও দামেশকের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাই। খৃস্টানরা যেন ইয়াজুদ্দিনকে কব্জা করতে না পারে আমি যেন সেদিকে খেয়াল রাখি। আমি এ আশা নিয়েই তাকে কবুল করতে সম্মত হয়েছিলাম।

আমি চাচ্ছিলাম, আমার এ কোরবানীর বিনিময়ে জাতির মধ্যে আবার একতার বন্ধন সৃষ্টি হোক। ভ্রাতিঘাতি সংঘাতের পরিবর্তে তারা আবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে খৃস্টানদের বিরুদ্ধে গড়ে তুলুক সম্মিলিত সামরিক শক্তি।

কিন্তু জীবনে আমি এই প্রথম ধোঁকা খেলাম। আর এ ধোঁকা কোন সাধারণ ধোঁকা নয়, মারাত্মক এক ভুলের মাশুল গুণতে হবে এখন আমাকে। কিন্তু আমি তোমাকে বলতে চাই, আমি এত সহজে পরাজয় মেনে নেবো না। এ অবস্থার মধ্যেও আমি আমার স্বপ্ন পূরণের সংকল্পে অটুট।

এ জন্য তোমার সহযোগিতার প্রয়োজন হবে আমার। তুমি যাতে আমাকে সাহায্য করতে পারো সে জন্যই তোমাকে এত কথা বললাম।’

‘আমাকে বলুন, আমার কি করতে হবে।’

শামসুন নেছা ব্যাকুল কণ্ঠে বললো, ‘আপনি তো জীবনে এই প্রথম ধোঁকায় পড়লেন আর আমার তো জীবনটাই কেটে গেল ধোঁকার মধ্যে। এই প্রথম আমি আসল সত্য সম্পর্কে অবগত হলাম। মা, আমাকে বলুন, এখন আমাকে কি করতে হবে।’

‘গোয়েন্দাগিরী!’

রাজিয়া খাতুন অনুচ্চ কিন্তু দৃঢ় স্বরে বললেন, ‘তোমাদের খুঁজে বের করতে হবে, এই মহলে এখনও কারা খৃস্টানদের পক্ষে কাজ করছে। ইয়াজউদ্দিনের সাথে কাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং সে খৃস্টানদের কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।’

রাজিয়া খাতুন কিভাবে কি করতে হবে বিস্তারিত শামসুন নেছাকে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন।

যখন শামসুন নেছা রাজিয়া খাতুনের কামরা থেকে বের হলো তখন সে অনুভব করলো, সে আর আগের শামসুন নেছা নেই। তার জীবনে এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটে গেছে। জাতীয় চেতনা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ব্যাপারে উদাসীন কোন সাধারণ নারী সে আর নেই। সে এখন সত্যের সপক্ষে এক নির্ভীক বিপ্লবী। আল্লাহর রাহে জীবন বিলিয়ে দেয়ার মন্ত্রে উজ্জীবিত এক সত্য-সৈনিক।

যখন সে রাজিয়া খাতুনের কামরায় ঢুকেছিল, সে ছিল রাজমহলের আদরে লালিত এক স্বপ্ন-বিলাসী কন্যা, আর এখন সে আল্লাহর পথে জীবন কোরবানের সংকল্পে অটুট এক অকুতোভয় তরুণী। শামসুন নেছা তার এই পরিবর্তনে নিজেই অবাক হয়ে গেল।

‘আপনাকে কে বললো যে আমার মা ঝগড়াটে ও ভুল ধারণায় আছে?’

শামসুন নেছা ইয়াজউদ্দিনকে বললো, ‘আপনি কি জানেন তাঁর জীবনটা কিভাবে কেটেছে? তিনি আপনাকেও আমার পিতা নূরুদ্দিন জঙ্গীর মত প্রসিদ্ধ রণবীর ও ইসলামের বীর মুজাহিদ বানাতে চেয়েছিলেন।’

‘সে তো আমার কাজে বাঁধা দিতে চায়।’ ইয়াজউদ্দিন বললেন, ‘তাঁর ধারণা আমি খৃস্টানদের বন্ধু!’

‘আমি তাঁর সে ভুল ভেঙ্গে দিয়েছি।’ শামসুন নেছা বললো, ‘তাঁর চলাফেরায় অহেতুক বিধি-নিষেধ আরোপ করায় তার মনে আপনার সম্পর্কে সামান্য সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আমি তার সে সন্দেহ দূর করে দিয়েছি।

আপনি অযথা তাঁর সম্পর্কে কোন ভুল ধারণা পোষণ করবেন না। তাঁর চলাফেরায় অপ্রয়োজনীয় বিধি-নিষেধ আরোপ না করলে আপনার ব্যাপারে তার কোন খারাপ ধারণা সৃষ্টি হবে না।’

‘আমি তো তার প্রতি কোন বিধি-নিষেধ আরোপ করতে চাইনি।’ ইয়াজউদ্দিন বললেন, ‘গাড়ী সব সময় প্রস্তুত আছে। যখন খুশী তোমার মাকে নিয়ে তুমি বেড়াতে যেতে পারো।’

ইয়াজউদ্দিন শামসুন নেছার কথাকে সত্য বলে ধরে নিলেন। তাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল ইয়াজউদ্দিনের অফিসে বসে। কথা শেষ করে শামসুন নেছা সেখান থেকে বের হয়ে এলো।

বাইরে বেরিয়েই সে দেখতে পেল দরজার বাইরে আমের বিন উসমান দাঁড়িয়ে আছে।

আমের বিন উসমানের বয়স এখনও ত্রিশ পার হয়নি। ছেলেটা বেশ চালাক চতুর। চেহারা আকর্ষণীয়। তলোয়ার যুদ্ধ ও তীরন্দাজীতে তার সমকক্ষ কেউ নেই হলবে।

আল মালেকুস সালেহের দেহরক্ষীর দলের কমান্ডার ছিল আমের বিন উসমান। এই বয়সেই শারীরিক নৈপুণ্য ও বুদ্ধিমত্তার কারণে এতবড় পদে আসীন হতে পেরেছে সে।

এত বড় দায়িত্বশীল কাজের ভার তার ওপর ন্যস্ত করে কর্তৃপক্ষ মোটেই চিন্তিত ছিল না, বরং দক্ষতার কারণে সবাই তার ওপর সন্তুষ্ট ছিল।

এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে মহলের ভেতরই তার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা ছিল।

যুবতী শামসুন নেছার রূপ ও যৌবন কিছুদিন থেকেই এ যুবকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। যতই সে শামসুন নেছাকে দেখছিল ততই তার প্রতি তার আকর্ষণ বেড়ে যাচ্ছিল।

রাজমহলের বাসিন্দা হওয়ার কারণে শামসুন নেছার সাথে তার মেলামেশার অবাধ সুযোগ ছিল না। কিন্তু শামসুন নেছার ছিল খেলাধুলার শখ। সে রোজ বাগানে খেলতে নামতো আর দূর থেকে তার অপরূপ রূপের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকতো আমের বিন উসমান।

সুলতানের বোন হিসাবে মহলে ছিল শামসুন নেছার বিশেষ মর্যাদা ও আধিপত্য। ফলে সারা মহলে তার অবাধ বিচরণ ও খেলাধুলায় কোন বিধি-নিষেধ ছিল না।

চঞ্চল প্রজাপতির মতই মহলের সর্বত্র সে ঘুরে বেড়াতো মনের আনন্দে। ভাই মারা যাওয়ার পর ইয়াজউদ্দিন এসে দায়িত্ব গ্রহণের পরও তার অবাধ স্বাধীনতায় কোন বিঘ্ন সৃষ্টি হয়নি। ইয়াজউদ্দিন তাকে সরল, সহজ ও চঞ্চল আমুদে এক মেয়ে হিসাবেই গণ্য করেছিলেন।

এই বয়সী মেয়েরা একটু খেলাধুলাপ্রিয় ও চপল স্বভাবের হয়েই থাকে ভেবে তিনি শামসুন নেছার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন অনুভব করেননি।

এই সুবাদেই আমের বিন উসমানের দৃষ্টির সামনে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছিল শামসুন নেছা। এমনকি তার সাথে মেলামেশা এবং কথা বলারও সুযোগ পেয়েছিল। আমেরের মত শামসুন নেছাও কি বলিষ্ঠ এই সুশ্রী যুবকের দিকে দিন দিন ঝুঁকে পড়ছিল?

প্রশ্নটা মাঝে মাঝে নিজের মনেই উঁকি মারতো শামসুন নেছার। সে এখন পূর্ণ যুবতী, ষোড়শী কন্যা। এ বয়সে চোখে রঙ না লাগলে আর কবে লাগবে?

সে যুগে মেয়েদের আরো কম বয়সেই বিয়ে হয়ে যেতো।

কিন্তু অভিজাত ঘরের মেয়েদের বিয়ে একটু দেরীতেই হতো। সেই কারণে এবং উপযুক্ত ও দায়িত্ববান অভিভাবক না থাকার ফলে শামসুন নেছার বিয়ে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি, এমনকি সে নিজেও না।

শামসুন নেছা ছিল এক সুলতানের কন্যা। পিতার অবর্তমানেও এক শাহজাদার আদরের বোন হিসাবেই সে প্রতিপালিত হয়েছে রাজমহলে। ফলে কোনদিন তাকে অযত্নের শিকার হতে হয়নি।

প্রকৃতিও তার অফুরন্ত রূপ সুধা হাতে বিলিয়ে দিয়েছিল এই শাহজাদীর জন্য। স্বাভাবিক সৌন্দর্যের চাইতে একটু বেশীই সুন্দরী লাগতো তাকে। যেন এক অভিজ্ঞ মালীর সযত্ন পরিচর্যায় বেড়ে উঠা কোমল পেলব এক পুস্পকলি।

আমের বিন উসমানের প্রতি তার আগ্রহ যেমন ছিল সহজাত, তেমনি তার প্রকাশও ঘটেছিল স্বাভাবিকভাবেই।

সে তাকে যখন তখন বিরক্ত করতো। কিন্তু আমের ধরতে গেলেই পালিয়ে যেতো। এ ছিল চঞ্চলা কিশোরীর চপলতা মাত্র। কিন্তু এখনকার অবস্থা ভিন্ন।