একদিন সকাল বেলা তিনি তাঁর কামরা থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রাসাদের বাইরে বাগানে নেমে এলেন।
বিরাট প্রাসাদের বাইরে বিশাল বাগান। মহলের এ অংশে এর আগে তিনি আর আসেননি, এ বাগানেও প্রবেশ করেননি।
তিনি দেখতে পেলেন পাঁচ ছয়জন যুবতী মেয়ে সেখানে খেলা করছে। তিনি তাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।
তখনও তিনি তাদের কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরে। এক মধ্যবয়সী মহিলা তাঁকে দেখতে পেল এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দিকে তেড়ে এসে বলল, ‘আপনি এখানে এসেছেন কেন? আপনি আপনার কামরায় চলে যান।’
‘কেন, কি হয়েছে?’
‘এটাই আমাদের সম্মানিত বাদশাহর হুকুম। চলুন, আমি আপনাকে সে জায়গা দেখিয়ে দেই যেখানে আপনি ঘোরাফেরা করতে পারবেন।’
‘না, আমি নিজেই মহলের বিভিন্ন অংশ ঘুরে ফিরে দেখতে চাই।’
‘কিন্তু বেগম সাহেবা, আপনার এখানে আসা নিষেধ।’ মহিলা ব্যাকুল কণ্ঠে রূঢ়ভাবে বলল।
‘যদি আমি এ আদেশ না মানি তবে কি হবে?’ রাজিয়া খাতুন প্রশ্ন করলেন।
‘আপনি আমার অপরাধ নেবেন না।’ মহিলা বিনয়ের সাথে বললো, ‘আমাকে আমার মালিকের আদেশ মানতে সাহায্য করুন।’
এ সময় মেয়েদের মধ্য থেকে অন্য এক মধ্য বয়সী মহিলা রাজিয়া খাতুনের পাশে এসে এগিয়ে তাঁর হাত ধরে বলতে লাগলো, ‘আমি আপনার দাসী। আমাকে সবসময় আপনার পাশে থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছে। আমাকেও বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট এলাকা ছাড়া আপনার বাইরে যাওয়া নিষেধ। আসুন, আমি আপনাকে আপনার বাগান ও মহলের সেই নির্দিষ্ট এলাকা চিনিয়ে দেই।’
সে রাজিয়া খাতুনের হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, ‘আসুন।’
রাজিয়া খাতুন একথা শুনে খুবই বিচলিত হয়ে পড়লেন। তিনি বাগানে পায়চারী বাদ দিয়ে নিজেই কামরার দিকে হাঁটা দিলেন। দাসী তার সাথে হাঁটতে হাঁটতে বললো, ‘আপনি শঙ্কিত হবেন না। আমি জানি আপনি কি স্বপ্ন নিয়ে এখানে এসেছেন। আপনার সকল স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। আমি আপনার দুঃখের দরদী ও স্বপ্নের গোপন সঙ্গী। আপনাকে এখানকার সব গোপন তথ্যই আমি আপনাকে জানিয়ে দেবো।’
‘গোপন তথ্য! কি গোপন তথ্য?’ রাজিয়া খাতুন বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন।
‘এই মহলের ওপর এখনও ক্রুসেড বাহিনীর অশুভ ছায়া বিরাজ করছে। আপনার সন্তান ছিল তাদের হাতের পুতুল। এখন যে শাসক আপনার স্বামী হয়েছেন তিনিও তাদের হুকুমেরই তাবেদারী শুরু করেছেন। এখানকার অধিকাংশ উজির উপদেষ্টা খৃস্টানদের কেনা গোলাম।’
‘সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সম্পর্কে মহলের লোকদের কি ধারণা?’ রাজিয়া খাতুন প্রশ্ন করলেন, ‘এখানে কি তার কোন প্রভাব নেই?’
‘খৃস্টানদের চেয়ে বেশী প্রভাব তাঁর নেই।’ দাসী বললো, ‘এই মহলেও সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা আছে। আমি তাদের সাথে যোগাযোগ রাখছি। আমি আপনাকে ভাল করে চিনি বলেই নির্ভয়ে আপনার কাছে আমার পরিচয় প্রকাশ করলাম।’
রাজিয়া খাতুন চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘এ আমি কি শুনছি! এখন আমি কি করবো?’
‘আপনি ইয়াজউদ্দিনকে জিজ্ঞেস করুন কেন তিনি আপনাকে মহলের এক কামরায় বন্দী করে রেখেছেন?’
‘হ্যাঁ, তা তো আমি জিজ্ঞেস করবোই। কিন্তু তুমি বলো তো এখানে কি ঘটছে?’
‘এক্ষুণি আপনাকে সমস্ত কথা বলা যাবে না। আগে আপনি তার কাছ থেকে তার নিয়ত ও উদ্দেশ্য কি বুঝতে চেষ্টা করুন।’
দাসী বললো, ‘পরে আমি আপনাকে সবকিছুই খুলে বলবো।’
‘তাহলে অন্তত এটুকু বলো, সে আসলে কি করতে চায়?’
‘আসল সত্য খুবই ভয়ংকর। তিনি আপনাকে বিয়ে করেছেন শুধু আপনাকে বন্দী করার জন্য। তিনি জানেন, সুলতান আইয়ুবীর সাথে আপনার সম্পর্ক ভাল। দামেশকের জনসাধারণ আপনার প্রচণ্ড ভক্ত এবং তারা আপনার কারণেই সুলতান আইয়ুবীর সমর্থক।
আপনাকে দামেশক থেকে বের করতে পারলে তারা অবাধে সেখানে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে পারবে।’
‘তিনি কি আইয়ুবী বিরোধী জোটে শরীক হয়েছেন?’
‘হ্যাঁ, তিনি আইয়ুবী বিরোধী জোটে শরীক হয়েছেন এবং খৃস্টানরা যাতে দামেশকে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে তার পথ করে দেয়ার জন্য আপনাকে দামেশক থেকে সরিয়ে এনেছেন।’
‘এর অর্থ হলো মুসলমানরা আবার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে?’
রাজিয়া খাতুনের চেহারা দুশ্চিন্তায় বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘খৃস্টানরা বিনা বাধায় আমাদের এলাকায় আবার আধিপত্য বিস্তার করে বসবে?’
কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। এক সময় রাজিয়া খাতুনই আবার মুখ খোললেন।
‘এই সংবাদ কি সুলতান আইয়ুবীকে পৌঁছানো যাবে?’ রাজিয়া খাতুন দাসীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
‘এ ব্যবস্থা আগেই হয়ে গেছে।’ দাসী বললো, ‘আমাদের বিজ্ঞ কমান্ডার একজন সাহসী লোককে দিয়ে এ সংবাদ সুলতানের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।’
‘লোকটি বিশ্বস্ত তো!’
‘হ্যাঁ, তার নাম ইসহাক তুর্কী। সে এক তুর্কী মুসলমান। আমি তাঁকে ভাল করেই চিনি। আপনার ছেলের মৃত্যুর পর ক্রুসেডদের বর্তমান তৎপরতা কেমন দেখার জন্য সে খৃস্টানদের অধিকৃত অঞ্চল বৈরুত গিয়েছে। ওখান থেকে সোজা সে কায়রোর উদ্দেশ্যে রওনা হবে। সুলতানের কাছে খবর পৌঁছে দিয়েই সে আবার ফিরে আসবে।’
‘সে ফিরে এলে আমাকে বলো। আমি এই গোয়েন্দার সাথে কথা বলতে চাই।’
‘অবশ্যই। সে এলেই আমি আপনার সাথে তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেবো।’
‘তুমি আরো আগে এসব জানালে না কেন?’
‘আমাদের কমান্ডারের হুকুমে আজই এ তথ্যটুকু আপনাকে জানানোর জন্য বলেছেন। কমান্ডারের হুকুম ছাড়া আপনাকে কিছু বলা আমি ঠিক মনে করিনি।’
বৃদ্ধা দাসী রাজিয়া খাতুনের কাছে যখন মহলের অভ্যন্তরীণ অবস্থা ও ইয়াজউদ্দিনের গোপন রহস্য ফাঁস করে দিল তখন রাজিয়া খাতুনের পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল। তিনি যে স্বপ্ন নিয়ে এখানে এসেছিলেন, সে স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। যে কারণে তিনি হলবের আমীর ইয়াজউদ্দিনকে বিয়ে করতে সম্মত হয়েছিলেন সে স্বপ্ন তার দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত হলো।
রাজিয়া খাতুন এক মহীয়সী মহিলা। ইসলামের ইতিহাসের এই বীরাঙ্গনা মুজাহিদ তাঁর মরহুম স্বামী নূরুদ্দিন জঙ্গীর স্বপ্ন পুরণের আকাঙ্ক্ষা নিয়েই পা রেখেছিলেন ইয়াজউদ্দিনের মহলে। ইসলামের একনিষ্ঠ খাদেম নূরুদ্দিন জঙ্গী এবং তাঁর স্বপ্নের দোসর মহাবীর সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর মত রাজিয়া খাতুনও চাইতেন ইসলামী সম্রাজ্যের ঐক্য ও বিস্তৃতি।
দ্বীনের প্রয়োজনে খৃস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে ছুটে যাওয়ার জন্য তাঁর মন সব সময় উদগ্রীব থাকতো। আল্লাহ তাঁকে ইসলামের খেদমতের জন্যই সৃষ্টি করেছিলেন। সব সময় সচেষ্ট থাকতেন দ্বীনের মুজাহিদদের সহযোগিতায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার জন্য।
দাসীর কাছ থেকে যে গোপন তথ্য শুনেছেন তাতে তাঁর হৃদয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল। অজানা ভয় ও শঙ্কা এসে গ্রাস করতে চাইল তাঁর হৃদয়-মন। কিন্তু এই বীরাঙ্গনা মহিলা মুখ বুঁজে সব সহ্য করবেন এমনটি আশা করার কোন কারণ ছিল না। তিনি যখন দেখলেন তাঁর সব আশা গুড়িয়ে গেছে, তিনি রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
ইয়াজউদ্দিন ভাবছিল, ইসলামের একনিষ্ঠ এক খাদেমাকে সে নিস্ক্রিয় ও বন্দী করতে সমর্থ হয়েছে। ভাবছিল, ইসলামের এক ধারালো তলোয়ারকে সে ভোতা করে দিতে পেরেছে। কিন্তু ঈমানের আলোয় আলোকিত হৃদয়কে যে এত সহজে কাবু করা যায় না, জানা ছিল না তাঁর।
রাজিয়া খাতুন জানতেন তাঁর যুবতী মেয়ে শামসুন নেছা এই মহলেই আছে। যদিও এখনো তার সাথে তার সাক্ষাত হয়নি। মেয়ের কথা স্মরণ হতেই তিনি স্মৃতির জগতে হারিয়ে গেলেন।
তার মনে পড়ে গেল, সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গী যখন মারা যান তখন এ মেয়ের বয়স মাত্র আট কি নয়। তার একমাত্র পুত্র আল মালেকুস সালেহের বয়সও এগারো।
অথচ সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর ওফাতের পর স্বার্থপর আমীররা এই নাবালেগ শিশুকেই সুলতান বানিয়ে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। তাকে নামে মাত্র শাসক করে নিজেরা স্বাধীনভাবে নিজ নিজ এলাকার শাসক সেজে বসেছিল।
এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে ইসলামের স্বার্থে সুলতান আইয়ুবীকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। তার ডাক পেয়ে মিশর থেকে ছুটে এসেছিলেন সুলতান। তারপর তার সহযোগিতায় দামেশক তথা সিরিয়া সুলতান আইয়ুবীর শাসনাধীনে যুক্ত হয়।
তার স্মৃতিতে ভেসে উঠে হারানো সেই দিনগুলোর কথা। প্রাণের টুকরো ছেলে আল মালেকুস সালেহ তার বাহিনী নিয়ে পালিয়ে গিয়ে হলবে আশ্রয় নেয়। সঙ্গে করে নিয়ে যায় ছোট বন শামসুন নেছাকেও।
বুকে পাথর বেঁধে কেবল ইসলামের স্বার্থেই সেদিন তিনি দামেশকে থেকে গিয়েছিলেন। শামিল হয়েছিলেন ক্রুসেডদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামে। এভাবেই কেটে গিয়েছিল আটটি বছর।
তারপর একদিন শামসুন নেছা ফিরে এলো মায়ের কাছে। তখন সে ষোল বছরের পূর্ণ যুবতী। জানালো, তার ভাই আল মালেকুস সালেহের অবস্থা মরণাপন্ন। মৃত্যু শয্যায় শুয়ে সে মাকে এক নজর দেখার জন্য কান্নাকাটি করছে।
শামসুন নেছা সেদিন বলেছিল, ‘চলো মা, ভাইয়া তোমার দুধের দেনার ক্ষমা চাইতে চায়।’
কিন্তু কেবল ইসলামের দিকে তাকিয়েই সেদিন মা মেয়েকে খালি হাতে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল। নিজের মরণাপন্ন ছেলেকে এক নজর দেখার ইচ্ছে কি সেদিন জাগেনি তার মনে!
কিন্তু মনের আবেগ দমন করে রাজিয়া খাতুন সরাসরি তার প্রস্তাব অস্বীকার করে বলেছিলেন, ‘তার মা তো সে দিনই মারা গেছে, যেদিন সে ইসলামের খাদেম সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছে।’
শামসুন নেছা ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছিল। সে হলবে পৌঁছার আগেই তার ভাই আল মালেকুস সালেহ মারা যায়।
রাজিয়া খাতুন ভাবছেন, এই মহলেই তো থাকতো আমার বেটা! সে মারা গেছে বলেই তো আজ ইয়াজউদ্দিন গদীনশীন হতে পেরেছে! হায়, ইয়াজউদ্দিনও আমার ছেলের মত গাদ্দার! এতদিন আমি ছিলাম এক গাদ্দারের মা আর এখন এক গাদ্দারের বেগম!
স্মৃতি থেকে বাস্তবে ফিরে এলেন তিনি। মেয়ের কথা মনে পড়ল তাঁর। শামসুন নেছা এই মহলেই আছে অথচ একবারও মায়ের সাথে দেখা করতে আসেনি!
মনের কষ্ট গোপন করে রাজিয়া খাতুন দাসীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার মেয়ে কোথায়? সে কি আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে?’
‘সে এই মহলেই আছে।’ দাসী উত্তরে বললো, ‘আপনি নিজেই আপনার স্বামীর কাছ থেকে জেনে নিতে পারবেন, সে আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারবে কিনা।’
‘কিন্তু যদি তাতেও নিষেধাজ্ঞা জারী করে গাদ্দার!’ রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘যে তার মুনিবের সাথে গাদ্দারী করতে পারে, সে পারে না এমন কোন অপকর্ম নেই। মুখে সে আল্লাহর গোলাম এবং আইয়ুবীর অনুগত বললেও সে সাক্ষাত শয়তানের চেলা ছাড়া আর কিছু নয়। আমি তার কাছ থেকে এখন আর ভাল কিছু আশা করতে পারি না।’
‘আপনি নিরাশ হবেন না।’ দাসী বললো, ‘তিনি নিষেধাজ্ঞা জারী করলে আমি গোপনে আপনার সাথে তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে পারবো।’
‘তুমি যে কমান্ডারের কথা বলেছো, তার সাথে আমার দেখা করাতে পারবে?’ রাজিয়া খাতুন বললেন।
‘কিছু দিন যেতে দিন। আগে জেনে নেই আপনার উপর কি কি নিষেধ জারী আছে।’ দাসী বললো, ‘কোন ব্যাপারেই তাড়াহুড়ো করা ঠিক হবে না। সব সমস্যারই সমাধান আছে। তবে ধীরে ধীরে সমাধানের দিকে যেতে হবে।’
‘আমি এমন কঠিন পরীক্ষায় পড়বো ভাবতে পারিনি। আগে বুঝতে পারলে এই ফাঁদে আমি পা দিতাম না।’
‘আপনার বিয়েটা এমন হুট করে হয়ে গেল যে, আমাদের আর করার কিছু ছিল না। আমরা আরেকটু আগে জানতে পারলে আপনাকে সতর্ক করে দিতে পারতাম!’
দাসীর দেয়া সংবাদে রাজিয়া খাতুন এতটাই উদ্বিগ্ন ও দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন যে, স্বাভাবিক বিবেচনা বোধ তার লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তিনি দাসীর সাথে একান্ত বান্ধবীর মত অন্তরঙ্গ হয়ে আলাপ করছিলেন। হঠাৎ তার সম্বিত ফিরে এলো।
ভাবলেন, এ মেয়ে কি সত্যি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, নাকি গোয়েন্দা! ভাবনাটা মনে জাগতেই তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘আমি কেমন করে বিশ্বাস করবো, তুমি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী? তুমি যে গোয়েন্দা নও তার প্রমাণ কি?’
দাসীর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। রাজিয়া খাতুনের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘আমি যদি কোন ধনীর দুলালী হতাম বা নামী দামী মহিলা হতাম, তাহলে হয়তো এমন প্রশ্ন আপনার মনে জাগতো না। আমি কোন মহলের শাহজাদী বা বেগম হলে আপনি আমাকে এমন প্রশ্ন করতেন না। বরং তখন প্রতিটি মিথ্যাকে সত্য জেনে তা বিশ্বাস করতেন এবং প্রতারণার শিকার হতেন।
কিন্তু আপনার জানা উচিত, গাদ্দার গরীবের চাইতে ধনীর ঘরেই বেশী জন্মায়। আমাদের তো আল্লাহ ছাড়া কেউ নেই, তাই আমরা সত্যকেই আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকি।
জানি, এখন আপনার সামনে কঠিন পরীক্ষা, আপনি কাকে বিশ্বাস করবেন! দ্বীনের প্রতি মহব্বত পোষণকারী এক দাসীকে, নাকি আপনার স্বামী হলবের বাদশাহকে।
আপনার মনে যখন সন্দেহ দেখা দিয়েছে তখন পরীক্ষা দেয়া ছাড়া আপনার উপায় নেই। আমি যে গোয়েন্দা নই এ কথা প্রমাণ করার কোন উপায় নেই এখন। তবে আপনি যদি আমার উপর ভরসা ও বিশ্বাস করার ঝুঁকিটা নিতে পারেন তবে সেটাই হবে কল্যাণকর। আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, তিনি যেন আপনাকে ও আমাকে তাঁর নেক বান্দাদের মধ্যে শামিল করে নেন।’
রাজিয়া খাতুন এ কথার কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। দাসী তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে।
এক সময় তিনি মুখ তুলে বললেন, ‘আমাকে একটু একা থাকতে দাও।’
দাসী কামরা থেকে বেরিয়ে গেল। রাজিয়া খাতুন ভেসে বেড়াতে লাগলেন চিন্তার রাজ্যে। রাজকীয় মহলকে তাঁর মনে হচ্ছিল এক অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠ। কামরার মূল্যবান আসবাবপত্রগুলো বিষাক্ত সাপের মত ফণা তুলে নাচছিল তাঁর চোখের সামনে।
দু’তিন দিন রাজিয়া খাতুন তার নতুন স্বামী ইয়াজউদ্দিনের কোন দেখা সাক্ষাত পেলেন না। তার কামরার দাসী ও চাকরানীরা খাবার ও যাবতীয় প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিয়ে গেল। তিনি সে সবের দিকে ভ্রুক্ষেপও করলেন না।
দাসিরা তার খেদমতে দাঁড়িয়ে থাকতো। তাঁর শান্তি ও আরামের জন্য কি লাগবে জানতে চাইতো। কিন্তু তিনি নির্বিকার।
তিনি জানতেন, তিনি আজ মহারাণী। অসংখ্য দাসদাসী তার সেবার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু এ বাদশাহী তাকে মানসিক যন্ত্রণা ও পীড়া ছাড়া আর কিছুই দিচ্ছে না।
তিনি আগেও একজন সুলতানের সহধর্মিণী ছিলেন। কিন্তু জীবনে কোনদিন নিজেকে ঘুণাক্ষরেও মহারাণী ভাবার অবকাশ পাননি। শুধু ভাবতেন জেহাদের কথা, ভাবতেন যুদ্ধের ময়দানের কথা।
দুর্গম পাহাড় ও মরুভূমিতে লড়াই করার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই বিভোর থাকতেন তিনি। ভাবতেন, একদিন তার সুযোগ আসবে। একদিন রক্তাক্ত শহীদদের সাথে তারও লাশ উঠানো হবে ময়দান থেকে। কিন্তু স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে গেল, তা আর পূরণ হলো না।
দু’তিন দিন পর সুলতান ইয়াজউদ্দিন তার কামরায় এলেন। কৈফিয়তের সুরে বললেন, ‘অনেক ঝামেলা ও ব্যস্ততার মাঝে আছি, এ জন্য এ কয়দিন আসতে পারিনি।’
‘আমি তো আপনার অনুপস্থিতির জন্য কোন অনুযোগ বা অভিযোগ করিনি!’ রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘আমি তো নতুন বউ সেজে এখানে আসিনি যে, সব সময় আপনি আমার পাশে পাশে থাকবেন। আমার মনে তেমন ইচ্ছাও নেই। আমার জীবনের বেশীর ভাগ সময়ই কেটেছে নিঃসঙ্গভাবে। সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গী মরহুম প্রায়ই রণক্ষেত্রে থাকতেন। যখন যুদ্ধ থাকতো না তখন রাজ্যের বিভিন্ন কাজ ও সৈন্যদের প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।
স্বামী সঙ্গ পাওয়ার জন্য আমি কখনো লালায়িত ছিলাম না। বরং আমি তাকে তাঁর কাজে ফাঁকে ফাঁকে সাহায্য করতাম। রাজ্যের টুকিটাকি কাজ ছাড়াও শহীদদের পরিবার দেখাশোনা ও তদারকের কাজ আমার উপর ন্যস্ত ছিল।
আমি যুবতী মেয়েদেরকে আহতদের সেবা করার ট্রেনিং দিতাম। তাদেরকে তিরন্দাজী, তলোয়ার চালনা এবং অশ্বারোহণের প্রশিক্ষণ দিতাম। আমি সুলতান জঙ্গীকে রণক্ষেত্রে বিজয়ী বা শহীদ হিসেবে পেতে আগ্রহী ছিলাম। আমি তাঁর মহলের কোন কামরায় বন্দী থাকতাম না, যেমন এখানে বন্দী হয়ে আছি। এ বন্দিখানা আমার মোটেই পছন্দ নয়।’
‘আমি তাঁর সমালোচনা করবো না। সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গী তাঁর শাসন কার্যের কিছু দায়িত্ব বিবিকে দিয়ে ভাল করছিলেন কি মন্দ করেছিলেন, এ নিয়ে আমি কিছুই বলবো না।’
ইয়াজউদ্দিন বললেন, ‘কিন্তু আমি কাউকে এ কথা বলার সুযোগ দেবো না যে, হলবের ভাগ্য গড়া ও ভাঙ্গার পিছনে কোন মহিলার হাত আছে। আমি জানি তুমি আমার বিবি। আমি তোমার উপর এমন কোন বোঝা চাপাতে চাই না, যে কাজ আমাদের পারিবারিক বিষয় নয়।’
যেহেতু রাজিয়া খাতুন ইয়াজউদ্দিনের মনোভাব তাঁর দাসীর কাছ থেকেই জেনে নিয়েছিলেন সে জন্য স্বামীর এমন রূঢ় কথা ও ব্যবহার তিনি বেশী মনক্ষুন্ন হলেন না। তিনি বরং দাসীর কথা সত্য কিনা যাচাই করে দেখছিলেন।
যখন বুঝলেন দাসীর তথ্য নির্ভুল তখন তিনি স্বামীর সাথে আচরণে আরো হুশিয়ার হয়ে গেলেন। ইয়াজউদ্দিনের সাথে এখনই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া সমীচীন মনে করলেন না তিনি, তার বদলে ভালবাসার ভাব প্রকাশ করে বললেন, ‘কিন্তু যেভাবে আমাকে এই কামরাতে বন্দী করে রাখা হয়েছে এটা আমার পছন্দ নয়।’
রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘আপনার শাসন কাজে আমার সহযোগিতা দরকার না হলে নেবেন না, কিন্তু আমি তো আপনার হেরেমের কেনা দাসী নই?’
রাজিয়া খাতুন নববধূ বা কচি খুকি ছিলেন না, তিনি একজন অভিজ্ঞ ও রাজনীতির জ্ঞান সমৃদ্ধ মহিলা ছিলেন। ইয়াজউদ্দিনের সাথে সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই নতুন করে রাজনীতির খেলা শুরু করলেন তিনি।
‘রাজিয়া খাতুন!’ ইয়াজউদ্দিন কামরায় পায়চারী করতে করতে বললেন, ‘তোমাকে সে পারিবারিক জীবনের কথা ভুলে যেতে হবে, যে জীবন তুমি নূরুদ্দীন জঙ্গী মরহুমের সাথে কাটিয়েছো। তিনি তোমাকে যে স্বাধীনতা ও সুযোগ সুবিধা দিয়ে রেখেছিলেন, সেটাও আমি পছন্দ করি না। আর তেমন স্বাধীনতা কোন স্বামীই পছন্দ করবে না।’
‘তার মানে আমাকে এই ঘরে বন্দী জীবন কাটাতে হবে?’
‘তুমি কি তবে বাইরে ঘোরাফেরা করতে চাও? চার ঘোড়ার গাড়ী বাইরে প্রস্তুত আছে, যখন ইচ্ছা বাইরে বেড়াতে যেতে পারো।’
‘যার মহলের মধ্যে ঘোরাফেরার অনুমতি নেই তার বাইরে বেড়ানোর অনুমতি কেমন করে হয়?’ রাজিয়া খাতুন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি সত্যি মহলের মধ্যে আমার ঘোরাফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেছেন?’
‘আমি এ আদেশ তোমার নিরাপত্তার জন্যই দিয়েছি।’ ইয়াজউদ্দিন বললেন, ‘তুমি তো জানো, হলব ও দামেশকের মধ্যে কেমন রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ বেঁধেছিল। সুলতান আইয়ুবী তোমার ছেলেকে পরাজিত করে তার আনুগত্য আদায় করেছিলেন। কিন্তু এখানকার জনগণের মন থেকে এখনও সে শত্রুতা দূর হয়নি।
মহলে এমন সব লোক আছে যারা তোমাকে ও সুলতান আইয়ুবীকে শত্রু ভাবে। সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের হাতে তাদের অনেকের ঘর ও পরিবার ধ্বংস হয়েছে। তাদের যুবক সন্তানরা মারা গেছে। তারা জানে, তুমি সুলতান আইয়ুবীর সমর্থক এবং তার একনিষ্ঠ ভক্ত। দামেশকে সুলতান আইয়ুবীর আধিপত্য কায়েমের মূল শক্তি ছিলে তুমি। এদের যে কেউ তোমাকে হত্যা করে তার প্রতিশোধ নিতে পারে।’
‘তবে তো তারা আপনাকেও হত্যা করতে পারে! কারণ আপনিও সুলতান আইয়ুবীর বন্ধু এবং আইয়ুবীর ঐক্যজোটের একজন বিশ্বস্ত শরীক।’ রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘এ অবস্থায় আমাদের দায়িত্ব কি এই নয় যে, এ ধরনের লোক যারা ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে, যারা জাতীয় ঐক্যের মূলে আঘাত হানতে পারে, তাদেরকে ধরে ধরে বন্দী করা? আপনার কাছে কি এমন গোয়েন্দা নেই, যারা জাতির দুশমনদের চিহ্নিত করে আপনার সামনে হাজির করতে পারে?’
‘আমি সে ব্যবস্থাই করছি।’
ইয়াজউদ্দিন এমন টেনে টেনে উত্তর দিলেন, যেন তার কাছে যথার্থ ও গ্রহণযোগ্য আর কোন উত্তর নেই। তিনি দুর্বল কণ্ঠে বললেন, ‘আমি তোমার জীবন বিপদের মধ্যে ফেলে দিতে চাই না।’
‘তবে কি এ ভয় ও আশংকা শুধু আপনার মহলের মধ্যেই রয়েছে?’
রাজিয়া খাতুন প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি তো আমাকে চার ঘোড়ার গাড়ীতে চেপে যেখানে ইচ্ছা বেড়ানোর আদেশ দিয়েছেন। তবে কি বাইরে আমাকে হত্যা করার কেউ নেই? মানুষ মহল বানায় নিরাপত্তা জন্য, অথচ আপনি বলতে চাইছেন, বাইরের চেয়ে মহলই এখন অধিক নিরাপত্তাহীন?’
ইয়াজউদ্দিনের চেহারায় স্পষ্ট বিরক্তি ও অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। তিনি এ প্রশ্নের কি জবাব দেবেন ভেবে পেলেন না। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে রাজিয়া খাতুনই আবার মুখ খোললেন। বললেন, ‘আমি আপনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলাম এ জন্য যে, মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর অসমাপ্ত কাজ আপনি ও সুলতান আইয়ুবী মিলিতভাবে তা সম্পন্ন করবেন। কারণ আমি যতদূর জানি, আপনিও সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিশ্বস্ত উপদেষ্টা ও হিতাকাঙ্ক্ষী ছিলেন।
আপনার এখন কর্তব্য, এখনও যারা আবার একটা গৃহযুদ্ধ বাঁধানোর চেষ্টায় ময়দান সমান করছে, তাদেরকে অতি সত্বর নির্মূল করা। জাতির মধ্যে অটুট ঐক্য সৃষ্টি করে খৃস্টানদের আরব ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করাই এখন সময়ের দাবী।’
‘আমি জানি এবং সে জন্য আমার চেষ্টার অন্ত নেই।’ ইয়াজউদ্দিন নিজেকে সামলে উত্তর দিলেন।
‘আপনি কি আমাকে এই আশ্বাস দিতে পারবেন, এই মহলে খৃস্টানদের সেই প্রভাব নেই, যা আমার ছেলে সৃষ্টি করে রেখে গিয়েছিল?’ রাজিয়া খাতুন আবেগের সাথে বললেন, ‘আপনার সমস্ত আমীর ও সেনাপতিরা কি বাগদাদের খেলাফতের অনুগত?’
‘তুমি কি আমার এখানে আইয়ুবীর দূত হয়ে এসেছো, নাকি আমার বিবি হিসেবে?’ ইয়াজউদ্দিন বিরক্তির স্বরে তিক্ত কণ্ঠে বললেন কথাগুলো।