» » ইহুদী কন্যা

বর্ণাকার

‘তোমাকে তো একটা ভাল ঘোড়াই দিতে হয়।’ খৃস্টান গোয়েন্দা কমান্ডার ইসহাক তুর্কীকে বললো, ‘মেরিনা আমাকে সব বলেছে। তুমি নাকি আমাদের সুলতানের জন্য গুরুত্বপুর্ণ সংবাদ নিয়ে যাচ্ছো। তুমি যাতে তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারো সে জন্য সে আমাদের শ্রেষ্ঠ ঘোড়াটি দাবি করেছে। তোমার ব্যস্ততা দেখে আমি তো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি। তুমি কি কোন খারাপ খবর নিয়ে যাচ্ছো?’

‘সে কথা আমি সুলতানকেই বলবো।’

‘তা তো ঠিকই। তবে আমরাও সুলতানের অনুগত এবং ভক্ত কিনা তাই জানার আগ্রহ জেগেছিল। তুমি যখন আমাদের বিশ্বাস করতে পারছো না তখন এ নিয়ে আর পীড়াপীড়ি করতে চাই না। তোমার জন্য ঘোড়া তৈরী। ঘোড়া এবং তোমার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও পানীয় ঘোড়ার সাথে বেঁধে দেয়া হয়েছে। তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।’

‘আল্লাহ তোমাদের মত অনুগত ও ভক্তদের থেকে সুলতানকে যেন রক্ষা করেন।’ ইসহাক তুর্কী কিছুটা ক্ষোভের সাথে বললো, ‘আমি অই মেয়েটাকে বলেছিলাম, মাঝরাতের পর আমাকে যেন জাগিয়ে দেয়। আমার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কায়রো পৌঁছা দরকার। কিন্তু তোমরা আমাকে জাগাওনি কেন?’

ইসহাক এ প্রশ্নের জবাবের অপেক্ষা না করেই মুখে বিরক্তি টেনে বললো, ‘ইস! কত বেলা হয়ে গেছে! রাতে ঘোড়া যত দ্রুত ছুটতে পারতো এখন এই গরমে তা কি আর পারবে! খামাখা একগাদা সময় নষ্ট হলো!’

ইসহাকের খেদ ও তিরস্কারে কেউ মন খারাপ করলো না, বরং সহানুভূতির সুরে কমান্ডার বলল, ‘তুমি খুব ক্লান্ত ছিলে, মেরিনা তোমাকে ডাকতে গিয়ে দেখলো, তুমি গভীর ঘুমে। তার এত মায়া লাগলো যে সে তোমাকে না জানিয়ে ফিরে গিয়ে বলল, এখন তাকে ডাকলে তার ওপর অবিচার করা হবে। চিন্তা করো না, তোমার ঘোড়া খুব ভাল। যেটুকু সময় নষ্ট হয়েছে, এ ঘোড়া তা পুষিয়ে দিতে পারবে।’

ইসহাকের চোখ জুড়ে তখনও ঘুম ঘুম ভাব জড়িয়ে ছিল। সে বুঝতে পারছিল না, এর কারণ কি? তাছাড়া ঘুমের পরে শরীরে যে স্বাভাবিক শক্তি ফিরে আসার কথা সে শক্তিও সে পাচ্ছিল না। কেমন একটা ক্লান্তি ক্লান্তি ভাব।

সে ভেবে পাচ্ছিল না, এত ঘুম তার কোত্থেকে এলো? তাকে কেউ ঘুমের ঔষুধ প্রয়োগ করেছে এমন চিন্তা তখনও তার মাথায় আসেনি।

যদিও সে যাত্রা করার জন্য অস্থির হুয়ে উঠেছিল কিন্তু যাত্রা করার মত অবস্থা তার ছিল না। রাজ্যের ক্লান্তিতে শরীরটা তার ভেঙ্গে আসছিল।

মধ্যরাতে জেগে উঠার কথা ছিল। কিন্তু সে খেয়াল করে দেখলো, ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সূর্য প্রায় মাথার উপর উঠে এসেছে। এত বেলা পর্যন্ত তার মত একজন মানুষ কখনোই ঘুমাতে পারে না, কিন্তু সে ঘুমিয়েছে। কেন? এ প্রশ্নটা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল।

খৃস্টান কমান্ডার ও মেরিনা ঘুম ভাঙ্গার আগেই তার পাশে এসে বসে তার ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষা করছিল। সে যখন চোখ খুললো তখন তারা তার সাথে এমনভাবে কথা বলতে শুরু করলো যে, সে নতুন করে কিছুই ভাবতে পারছিল না।

তারা এমনভাবে কথা বলছিল, যেন ইসহাক তুর্কীর মনে তাদের সম্পর্কে সামান্যতম সন্দেহও না জাগে। তারা এমনসব কথা বলছিল, যাতে সে তাদেরকে মুসলমান এবং সুলতান আইয়ুবীর একান্ত ভক্ত মনে করে।

তারা সুলতান আইয়ুবীর কাছে কি খবর নিয়ে যাচ্ছে জানার জন্য নানাভাবে প্রশ্ন করতে লাগলো।

ইসহাক তুর্কী তাদেরকে মুসলমান মনে করলেও গোয়েন্দাসুলভ সতর্কতার কারণে তাদের প্রশ্নের সঠিক জওয়াব দিতে ইতস্ততঃ করছিল।

তার ইতস্ততা লক্ষ্য করে খৃস্টান কমান্ডার চকিতে চাইল মেরিনার দিকে এবং চোখ টিপে ইশারায় কিছু বলে বাইরে চলে গেল।

মেরিনা কমান্ডারের ইঙ্গিত বুঝতে পারল। সে ইসহাকের আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বপসে তাকে যৌবনের ফাঁদে আটকানোর জন্য আদিরসাত্মক গল্প জুড়ে দিল। কিন্তু ইসহাক তাতে উত্তেজিত না হয়ে বরং হতভম্ব হয়ে তার দিকে অবাক করা চোখে তাকিয়ে রইল।

মেরিনা বলল, ‘আচ্ছা! তুমি কি জাদু জানো?’

‘কেন?’

‘তোমাকে সে কথা বলতে সাহস হচ্ছে না।‘

‘কেন! আমিও তো ভয়ংকর কেউ নই? খুন বা ডাকাতি করে সিনাই মরুভূমিতে পালাতে আসিনি আমি।কিছু বলার থাকলে তুমি নির্ভয়ে তা বলতে পারো।’

‘তুমি ঠিক বলছো? আমার কথা শুনে আমার সম্পর্কে কোন বাজে ধারণা করবে না তো!’

‘না, অযথা তোমার সম্পর্কে আমি বাজে ধারণা করতে যাব কেন?’

মেরিনা তার আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে ফিসফিস করে বলল, ‘বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি। তোমাকে দেখার পর থেকেই আমার যে কি হলো আমি বুঝতে পারছি না। রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি। তোমাকে দেখার জন্য মন-প্রাণ ছটফট করে উঠলো। আমি উঠে এসে তোমার শিয়রের পাশে বসে রইলাম। সারা রাত আমি তোমার পাশেই বসেছিলাম। তোমার কাছ থেকে সরে গিয়ে দেখেছি, আমার কিছুই ভাল লাগে না।’

‘আমার এখন ভালবাসা ও মন দেয়া নেয়ার মত সময় নেই। কায়রো চলো, সেখানে অনেক সময় পাওয়া যাবে।’ ইসহাক বললো, ‘যদি তুমি আমাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালই বেসে থাকো তবে আমাকে আমার দায়িত্ব পালনে সাহায্য করো। আমাকে জলদি ঘোড়ার ব্যবস্থা করে দাও।’

সে উঠে দাঁড়াল এবং তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল।

মেরিনা তার পিছু পিছু তাঁবু থেকে বেরিয়ে তার একটি হাত ধরে বললো, ‘কিছু মুখে দিয়ে নাও। সন্ধ্যেবেলা অসুস্থ শরীরে সেই যে কিছু মুখে দিলে তারপর তো আর পেটে কিছু পড়েনি।’

মেরিনা তাকে হাত ধরে টেনে তাঁবুতে নিতে নিতে বললো, ‘আমি তোমাকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় যেতে দেবো ভাবলে কি করে! আর আমাকে সঙ্গে নিতে চাইলে আমাদের লোকেরা কি তা মেনে নেবে? তাহলে তো আমাকে এখান থেকে পালাতে হবে। পালাতে গেলে কিভাবে পালাবো তার বুদ্ধি বের করতে হবে না?’

মেরিনা ইসহাকের বুকে নিজের মাথা চেপে ধরে কান্নাকাতর কণ্ঠে বললো, ‘ইসহাক! তুমি কি আমাকে সঙ্গে না নিয়েই এখান থেকে চলে যাবে! তোমাকে না পেলে যে আমি বাঁচবো না!’

মেরিনা ইসহাকের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

ইসহাকের দায়িত্ববোধ তাকে পাথর বানিয়ে রেখেছিল। সে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না।

মেরিনাকে বুক থেকে সরিয়ে দিতে দিতে বললো, ‘আহ! কি পাগলামো করছো! থামো! থামো! মনকে শান্ত করো, কান্না থামাও। আমাকে একটু ভাবতে দাও।’

মেরিনা চোখ মুছে মুখে হাসি টেনে বলল, ‘ছি! কিছু মনে করো না, তুমি চলে যাচ্ছো ভেবে আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি।’

তারপর একদম স্বাভাবিক হয়ে তাঁবুর পর্দা সরিয়ে জোরে ডেকে বললো, ‘জলদি খাবার নিয়ে এসো, সময় বয়ে যাচ্ছে।’

বারবারা খাবার নিয়ে এলো। ইসহাকের সামনে খাবার রেখে মেরিনা পিছনে গিয়ে দাঁড়াল ইসহাকের খাওয়া দেখতে লাগল।

মেরিনার কথা শুনছিল আর খাচ্ছিল ইসহাক। তার দৃষ্টি গেল মেরিনার পিছনে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে। বারবারা ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলে হাত দিয়ে নিজের গলার ক্রুশটি কাপড়ের ভেতর থেকে টেনে বের করল এবং তার সামনে কয়েকবার নাড়াচাড়া করে আবার জামার ভেতর ঢুকিয়ে ফেলল।

মেয়েটির এ সামান্য ইঙ্গিতই একজন গোয়েন্দাকে সতর্ক করার জন্য যথেষ্ট ছিল। মুহূর্তে কেটে গেল তার মাথার জট। সে পুরোপুরি সচেতন হয়ে উঠলো।

সে আবার তাকাল মেয়েটির দিকে। মেয়েটি তার বুকে হাত রেখে মেরিনার দিকে ইশারা করলো এবং আঙুল দুলিয়ে নিষেধ করলো তার কথা বিশ্বাস করতে। তারপর সে তাঁবুর বাইরে চলে গেল।

এই ইশারা এত স্পষ্ট ছিল যে, ইসহাক সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে গেল। এরা যে খৃস্টান এবং তার শত্রু একথা বুঝতে আর তার কষ্ট হলো না।

সে ছিল এক সতর্ক গোয়েন্দা। তাই সে কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করে যেভাবে খাচ্ছিল সেভাবেই খেয়ে চলল। কিন্তু এর মধ্যেই সে তার মনের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল।

কেন তারা বার বার সুলতান আইয়ুবীর জন্য কি সংবাদ নিয়ে যাচ্ছে জানতে চাচ্ছিল, বুঝে ফেলল সে। তখন তার মনে পড়লো, ঘুম তো আমাকে কোন দিন এত দুর্বল করতে পারে না? তবে কি তারা আমার ওপর কোন ঔষধ প্রয়োগ করেছে?

নিশ্চয়ই করেছে। নইলে দুপুর পর্যন্ত আমার ঘুমিয়ে থাকার কথা নয়। ঘুম থেকে জেগে উঠার পর কেন তার এত ক্লান্তি লাগছিল এ প্রশ্নেরও উত্তর পেয়ে গেল ইসহাক।

কিন্তু তার এ প্রশ্নের কোন উত্তর সে খুঁজে পেল না। অন্য মেয়েটা কেন তাকে ইশারা করে সতর্ক করে দিয়ে গেল। মেয়েটি কি তবে কোন মুসলমানের মেয়ে? সে কি তারই মত তাদের জালে আটকা পড়ে আছে?

মেরিনা তাকে তার কথা ও যাদুময় হাসি দিয়ে, অভিনয় দিয়ে জালে ফাঁসানোর চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছিল। আর ইসহাকের মাথায় খেলা করছিল এদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার চিন্তা।

সে এখন কি করবে, কেমন করে এ লোকদের হাত থেকে মুক্তি পাবে চিন্তা করে কোন কূল-কিনারা পাচ্ছিল না।

মেরিনাকে বলল, ‘পালাবো বললেই কি পালানো যায়! তোমাদের দলে এখন কত লোক আছে?’

মেরিনা ইসহাকের উদ্দেশ্য বুঝতে পারেনি, সে তার দলের লোকদের সংখ্যা বলে দিল।

ইসহাক বলল, ‘ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে। চলো, বাইরে চলো। খোলা হাওয়ায় মাথা ঠাণ্ডা করি আর ভেবে দেখি। তাড়াহুড়ো না করে আমাকে একটু ভাবতে দাও।’

সে বাইরে বের হয়ে এলো। দেখতে চাইলো এ কাফেলায় কত লোক আছে। এখান থেকে পালানোর কোন সম্ভাবনা আছে কিনা।

বাইরে বেরিয়ে সে অবাক হয়ে গেল। তাঁবুগুলোর কাছাকাছি কোন ঘোড়াই নেই! তাকে বলা হয়েছিল, তার জন্য বাইরে ঘোড়া প্রস্তুত। কিন্তু এটা যে মিথ্যা, তখন সে তা ভাবতে পারেনি।

মেরিনা তার পাশে এসে দাঁড়ালো। ইসহাক বললো, ‘আমার জন্য নাকি ঘোড়া প্রস্তুত করে রেখেছো? সে ঘোড়া কোথায়?’

‘আছে। দাঁড়াও, আমি আসছি।’

ইসহাকের সামনে থেকে সরে পড়লো মেরিনা।

‘তুমি ঠিক বলেছো।’ মেরিনা কমান্ডারকে গিয়ে বললো, ‘এ লোক সত্যি পাথর। সে ঘোড়া ছাড়া আর কোন কথাই বলছে না। আইয়ুবীর কাছে কি সংবাদ নিয়ে যাচ্ছে বের করতে চেষ্টা করেছিলাম আমি। কিন্তু সে বড় হুশিয়ার, আমার কথার ধারে-কাছেও যাচ্ছে না সে।’

‘তার মনে তো কোন সন্দেহ দেখা দেয়নি?’

‘দেয়ার কোন কারণ তো দেখি না।’ মেরিনা উত্তর দিল, ‘তবে সে কোন গোপন তথ্য বলবে বলে মনে হয় না।’

‘তার অর্থ হলো, তুমি ব্যর্থ হয়েছো।’ কমান্ডার মেরিনার দিকে তাকিয়ে বলল।

তারা বুঝতে পারেনি, বারবারা তার অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছে। সে এটাও প্রমাণ করে দিয়েছে, মেরিনার সকল যাদুই ব্যর্থ হয়েছে।

বারবারা ভেবেছিল, সে সুলতান আইয়ুবীর এই গোয়েন্দাকে মুক্ত করে দেবে। তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করবে। কিন্তু এখন তা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।

ইসহাক ক্যাম্পটি ঘুরে দেখতে চাইল। সে তাঁবুগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগল। কিছুদূর যাওয়ার পরই সে মেরিনা ও কমান্ডারকে দেখতে পেল এল জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। সে তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে কমান্ডারকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘আমার ঘোড়া কোথায়?’

‘কিসের ঘোড়া? ঘোড়া তুমি পাবে না।’

কমান্ডারের কণ্ঠে সম্পূর্ণ ভিন্ন সুর। সে গম্ভীর স্বরে বললো, ‘তুমি কোথাও যেতে পারবে না।’

ইসহাক তার কোমরে হাত রাখলো। সেখানে না তার তলোয়ার আছে, না আছে খঞ্জর।

এরই মধ্যে বারবারার মাধ্যমে সে তাদের পরিচয় জানার পরও বললো, ‘আমি বিস্মিত হচ্ছি, মুসলমান হওয়া সত্বেও তোমরা আমার পথে বাঁধা দিচ্ছো?’

‘যদি তুমি তোমার ভাল চাও তবে বলে দাও, সুলতানের জন্য তুমি কি সংবাদ নিয়ে যাচ্ছো?’ কমান্ডার কঠিন কণ্ঠে তাকে জিজ্ঞেস করল।

‘সংবাদ তেমন কিছু নয়, আমাদের এক আমীর ইয়াজউদ্দিন মাসুদ সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী রাজিয়া খাতুনকে বিয়ে করেছে।’ ইসহাক বললো।

‘এ তো অনেক পুরনো খবর!’ কমান্ডার বললো, ‘তোমার সুলতান দু’মাস আগেই এ সংবাদ পেয়ে গেছেন। তিনি এখন তার বাহিনীকে প্রস্তুত করে রণাঙ্গনে যাওয়ার পায়তারা করছেন। বলো, সেটা কোন রণাঙ্গন? এবার সুলতান কোন দিকে অভিযান চালাবেন?’

‘কি বললে! সুলতানের বাহিনী প্রস্তুত হয়ে বসে আছে? অভিযানের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত? না ভাই, রণাঙ্গনের কোন খবর আমার জানা নেই।’

‘অহেতুক সময় নষ্ট করে লাভ কি?’ কমান্ডার বললো, ‘তোমার ব্যস্ততাই প্রমাণ করে তুমি কোন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়ে যাচ্ছো। আমি জানতে চাই, কি সেই খবর?’

ইসহাক দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বললো, ‘আমার কাছে এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ খবর পাবে না, যাতে তোমাদের পরাণ ঠাণ্ডা হতে পারে।’

‘কিন্তু আমরা জানি, কি করে কারো পেট থেকে আসল কথা বের করতে হয়।’ কমান্ডার বললো, ‘ঠিক আছে, আমাদের সাথে চলো, দেখি তোমার কাছ থেকে কোন তথ্য পাই কি না।’

‘তোমাদের সাথে কোথায় যাবো? কেন যাবো? ঠিক আছে, ঘোড়া না দাও আমি হেঁটেই চললাম। আমার পথে বাঁধা দিতে চেষ্টা করো না।’

‘তুমি এখন নিরস্ত্র, অসহায়। তুমি নিরস্র না হলেও আমাদের এতগুলো লোকের সাথে যুদ্ধ করে তুমি পারবে না। শোন বন্ধু, আমি তোমাকে বেঁচে থাকার এবং রাজপুত্রের মত জীবন যাপন করার একটা উপায় সৃষ্টি করে দিতে পারি। তুমি আমাদের প্রস্তাব মেনে নাও এবং আমাদের সাথে চলো।’

কমান্ডার আরো বলল, ‘আমাদের সাথেও সেই কাজ করো যেমন সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর জন্য করছো। আমাদের সাথে যোগ দিলে তুমি অর্থ সম্পদ ও ভোগ বিলাসে ডুবে থাকবে।’

সে মেরিনার দিকে ইঙ্গিত করে বললো, ‘এই ধরনের মেয়েরা তোমার খেদমতের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকবে। অযথা কেন মরুভূমিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছো!’

‘কি! আমি খৃস্টানদের হয়ে কাজ করবো?’

‘না করলে আমাদের কারাগারের কোন গোপন কক্ষে বন্দী থাকবে সাড়া জীবন।’ বলল মেরিনা।

কমান্ডার বললো, ‘সেটা এমন এক জাহান্নাম, তুমি সেখানে মরতেও পারবে না, বেঁচে থাকাটাও হবে সীমাহীন কষ্টের। যে শাস্তি সেখানে তোমাকে দেয়া হবে সে শাস্তির কথা তুমি এখন কল্পনাও করতে পারবে না। সে এ বিভীষিকার রাজত্ব। এবার চিন্তা করে জবাব দাও, তুমি স্বেচ্ছায় আমাদের সাথে যাবে, নাকি তোমাকে আমরা সেই জাহান্নামে ছুঁড়ে ফেলার জন্য ধরে নিয়ে যাবো।’

‘তোমরা আমার উপর কি করে নির্ভর করবে?’ ইসহাক তুর্কী বললো, ‘যদি তোমাদের দলে যোগ দেই তবে গোয়েন্দা হিসেবে তোমরা আমাকে আমাদের মুসলমান এলাকাতেই পাথাবে। সেখানে আমি তোমাদের পক্ষে কাজ করবো এটা তোমরা কেমন করে বিশ্বাস করো? একবার মুসলিম এলাকায় পৌঁছতে পারলে আমি তোমাদের সাথে প্রতারণা করবো না, এমন নিশ্চয়তা তোমাদের কে দেবে?’

‘এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমাদের কাছে তার ব্যবস্থা আছে।’

খৃস্টান কমান্ডার তাকে ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য আরো বললো, ‘তুমি তো কেবল তোমাদের এলাকার কথা বলছো! কিন্তু তুমি জানো না, আমি তোমাকে তোমার ঘরের গোপন কোণ থেকেও বের করে নিয়ে আসতে পারবো। তোমার কি ধারণা, তোমার দেশে আমাদের যে সব গোয়েন্দা আছে তারা সবই খৃস্টান? স্থানীয় মুসলমানরা আমাদের সঙ্গে নেই?

ভুল। হয়তো অবাক হবে, কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে, আমাদের দশজন গোয়েন্দার মাত্র দু’জন খৃস্টান, বাকি আটজনই স্থানীয় মুসলমান, তোমাদের ভাই। সেখানেও আমাদেরকে কেউ ধোঁকা দিতে সাহস করে না। তারা জানে, বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি কেমন হয়। আমরা তাদের শুধু হত্যাই করি না, আগে তার বিবি বাচ্চাকে এক এক করে তার সামনে জবাই করি। তারপর তাকে জাহান্নামে পাঠাই।

আর যে আমাদের বাধ্য ও অনুগত থাকে তার জন্য এ দুনিয়াকে আমরা স্বর্গের বালাখানা বানিয়ে দেই। এদের মধ্যে কেউ ধরা পড়লে তার স্ত্রী সন্তান্দের এমন অর্থ সম্পদ দান করি যাতে তারা কয়েক পুরুষ বসে বসে খেতে পারে।’

‘আমাকে একটু চিন্তা করতে দাও।’ ইসহাক বললো, ‘এখান থেকে কবে রওনা দেবে?’

‘আজকেই।’ কমান্ডার বললো, ‘মধ্যরাতের পর। তুমি এর মধ্যে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নাও। তবে মনে রেখো, তুমি অস্বীকার করলে যে পরিণতি তোমার হবে তার জন্য আমাদের দায়ী করতে পারবে না।’

‘তা আমি জানি।’

‘আর তোমাকে একথাও বলতে হবে, কি গোপন তথ্য নিয়ে তুমি কায়রো যাচ্ছিলে।’ কমান্ডার বললো।

‘হ্যাঁ বলবো।’ ইসহাক উত্তর দিল, ‘আমাকে একটু চিন্তা করতে দাও। যদি হাত মিলাই সব তথ্যই তুমি পাবে। আর হাত না মিলালে তো আমি তোমাদের হাতেই আছি।’

‘ঠিক আছে যাও। এখন বিশ্রাম করো। সন্ধ্যার পর তোমার মতামত জানালেই চলবে।’ কমান্ডার বললো।

ইসহাক তুর্কী আর কথা না বাড়িয়ে নিজের তাঁবুর দিকে ফিরে গেল।

দুই মাস আগের ঘটনা।

ইয়াজউদ্দিনের প্রস্তাবকে নাকচ করে দেয়ার পরও সুলতান তকিউদ্দিনের অনুরোধে মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা পত্নী রাজিয়া খাতুন শুধু এই আশাতেই ইয়াজউদ্দিনকে বিয়ে করতে সম্মত হয়েছিলেন, যাতে ইয়াজউদ্দিনকে খৃস্টানদের ষড়যন্ত্র থেকে হেফাজত করে মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা বন্ধ করে দিতে পারেন।

হলবের সামরিক বাহিনী সুলতান আইয়ুবীর অনুগত ও সহযোগী থাকলে সেটা হবে মুসলিম মিল্লাতের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। এমনিতেই গত তিন বছরের গৃহযুদ্ধে মুসলমান সৈন্যদের বিরাট অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। এত সৈন্য নষ্ট হয়েছে, যা দিয়ে আরবের মাটি থেকে খৃস্টানদের বহিষ্কার করে ফিলিস্তিনও মুক্ত করা সম্ভব ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য মুসলিম মিল্লাতের, মুসলিম নেতৃবৃন্দ এ কথা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিল।

তকিউদ্দিনের কথায় রাজিয়া খাতুনের মনে হয়েছিল, ইয়াজউদ্দিন তাঁকে উপদেষ্টা হিসেবে গ্রহণ করবে। কিন্তু বিয়ের পরের দিন যখন দেশের অবস্থা নিয়ে রাজিয়া খাতুন তার সঙ্গে কথা বলতে গেলেন, ইয়াজউদ্দিন সে কথায় আগ্রহ না দেখিয়ে সেখান থেকে সরে পড়েছিল।

তারপরও কয়েকবার রাজিয়া খাতুন তার সাথে দেশের শাসন ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন। ইয়াজউদ্দিন নিজের একক চিন্তা ভাবনায় সিন্ধান্ত গ্রহণ করছে দেখে তিনি আহত হলেন। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে ইয়াজউদ্দিন তাঁর কামরা থেকে বেরিয়ে মহলের অন্য কামরায় গিয়ে শয়ন করলেন।

রাজিয়া খাতুন তবু আশাহত হননি। ভেবেছেন, সবেমাত্র হলবের শাসনভার গ্রহণ করে তিনি খুব চিন্তায় আছেন। হঠাৎ এত বড় দায়িত্ব গ্রহণ করা আসলেই কঠিন ব্যাপার। দু’দিন বাদে সব ঠিক হয়ে যাবে।

রাজিয়া খাতুন নিজে হলবের প্রতিরক্ষা বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করে তাঁকে সহযোগিতা করতে চাচ্ছিলেন। মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর অনেক কাজেও তিনি সহযোগিতা করতেন। তিনি দামেশকে মেয়েদের সামরিক ট্রেনিং দিয়ে একটি বাহিনী গঠন করে রেখে এসেছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন যোদ্ধা ও মুজাহিদ হিসেবেই নিজেকে কল্পনা করতেন।

তিনি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর একজন ভক্ত ও অনুগত হিসাবে তাকেও বিভিন্ন সময় সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে এসেছেন। তাঁর সামরিক জ্ঞান ও দক্ষতাকে সুলতান আইয়ুবীও শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। ফলে তিনি চাচ্ছিলেন এই জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে মুসলিম বিশ্বের খেদমত ও ইয়াজউদ্দিনকে সহযোগিতা করতে। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই ইয়াজউদ্দিনের ব্যবহার তাঁর কাছে প্রশ্নবোধক হয়ে উঠল।