» » তুমুল লড়াই

বর্ণাকার

আজাদ ছিল চরম ধড়িবাজ ও পাকা গোয়েন্দা। সে বললো, ‘বিশ্বাস করুন, আমি এখানকার আর কাউকে চিনি না। দামেশক থেকে আমি একাই এসেছি।’

‘এই মেয়ে তোমার তাঁবুতে অন্য যে লোকটির কথা শুনেছিলে, সে লোকটি কে?’

‘আমি তাকে চিনি না!’আজাদ উত্তর দিল, ‘সে লোকটি রাতের বেলা এসে সংকেতের মাধ্যমে আমার সাথে পরিচিত হয়েছিল এবং রাতের অন্ধকারেই আমাকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে চলে গিয়েছিল।’

হাসান বিন আবদুল্লাহ তার দু’জন কর্মীকে ডাকলেন। তাদের বললেন, ‘একে টর্চার সেলে নিয়ে যাও। জিজ্ঞেস করে বের করো কারা এর সঙ্গী আর তারা কোথায় আছে?’তিনি মানসুরাকে বললেন, ‘তুমি এবার তোমার তাঁবুতে গিয়ে শুয়ে পড়ো। ফজরের জামাতের পর তোমাকে আবার ডাকা হবে।’

সুলতান আইয়ুবী ফজরের নামাজ আদায় করলেন। হাসান বিন আবদুল্লাহও তার সাথে জামাতে শরীক হলেন। নামাজ শেষে তিনি সুলতানকে বললেন, ‘খতিব ইবনুল মাখদুমের কন্যা রাতের অন্ধকারে এক গুপ্তচরকে পাকড়াও করেছে।’তিনি সমস্ত ঘটনা সুলতানকে শোনালেন। সুলতান বললেন, ‘ইসলামের বীর নারীরা যুগে যুগে এমনি সব ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। বিবি খাওলার উত্তরসুরী এ মেয়েদের ত্যাগ তিতীক্ষা এবং কোরবানীও স্মরণীয় হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়। জাতি চিরকালই ওদের নিয়ে গর্ব করবে। সে গুপ্তচর কোথায়?’

‘ও আমার তত্বাবধানেই আছে।’হাসান বিন আবদুল্লাহ বললেন, ‘আগে আমি তার কাছ থেকে আমার যা জানা দরকার জেনে নেই, তার পরে আপনার কাছে নিয়ে আসবো। সে এক সুদর্শন যুবক। নিজেকে দামেশকের নাগরিক বলছে। এখানে সে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে এসেছিল।’

আজাদকে একটি গাছের ডালের সঙ্গে উল্টো করে লটকানো হলো। তার মাথা মাটি থেকে দেড়গজ উপরে ঝুলছে। নিচে আগুনের জ্বলন্ত কয়লার টুকরা। এক সৈনিক একটু পর পর আগুনে কি যেন ছিটিয়ে দিচ্ছিল। যার ধোঁয়া ও ঝাঁঝালো গন্ধে আজাদ ছটফট করছিল আর কাশতে কাশতে মরছিল।

হাসান বিন আবদুল্লাহ এসে তাকে নিচে নামালেন। তার চোখ অন্ধকার হয়ে এসেছিল। শরীরের সব রক্ত এসে জমা হয়েছিল মুখের ওপর। তাকে দাঁড় করিয়ে দেয়ার পরও সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। কিছুক্ষণ বেহুশের মত মাটিতে পড়ে রইলো। তার চোখে মুখে পানির ছিটা দেয়া হলো। একটু পর তো কেবল চোখ খুললো সে। হাসান বিন আবদুল্লাহ তাকে বললেন, ‘এ তো কেবল শুরু। যদি সব কথা খুলে না বলো তবে তোমার শরীরের হাড় একটা একটা করে আলাদা করে দেয়া হবে।’

সে পানি খেতে চাইলো। হাসান বিন আবদুল্লাহ বললেন, ‘তোমাকে দুধ পান করাবো। আমার প্রশ্নের জবাব দাও।’

তিনি এক সিপাইকে বললেন, ‘ওর জন্য দুধ নিয়ে এসো। সেই সাথে একটি ঘোড়া এবং রশিও নিয়ে আসবে। রশি ওর পায়ের সাথে বেঁধে ঘোড়ার পিছনে বাঁধতে হবে।’

এ কথা শুনেই আজাদ তার দুই সহযোগীর নাম বললো। এ দু’জনও স্বেচ্ছাসেবক দলের ছিল। রাতে যে তার সাথে কথা বলছিল, সে তাদেরই একজন। সে দামেশকে গুপ্তচরদের আড্ডার ঠিকানাও দিল হাসান বিন আবদুল্লাহকে। তিনি তৎক্ষনাৎ সেই দুই স্বেচ্ছাসেবককে গ্রেফতার করার আদেশ দিলেন। এরপর আজাদকে দুধ পান করিয়ে নিয়ে গেলেন সুলতান আইয়ুবীর কাছে।

‘তুমি কোন অঞ্চলের বাসিন্দা?’সুলতান আইয়ুবী জিজ্ঞেস করলেন।

‘দামেশকের!’

‘কার সন্তান তুমি?’

আজাদ দামেশকের এক জায়গীরদারের নাম বললো।

‘হ্যাঁ, আমার মনে হচ্ছে আমি তাকে চিনি।’সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘সে তো এখানে দামেশকেই আছে?’

‘না, আল মালেকুস সালেহের সৈন্যরা দামেশক থেকে পালিয়ে গেলে বাবাও পালিয়ে হলবে চলে যান।’

‘আর তোমাকে গুপ্তচরগিরী করার জন্য দামেশকে রেখে যান, তাই না?’সুলতান আইয়ুবী তার কথার রেশ ধরে বললেন।

‘আমি নিজেই দামেশকে থেকে গিয়েছিলাম।’আজাদ বললো, ‘আমার বাবা এক লোকের হাতে চিঠি দিয়ে জানালেন, গোয়েন্দাগিরী করো। বাবার নির্দেশেই আমি এ পথে আসি।’সে জোড় হাত করে সুলতান আইয়ুবীর কাছে ক্ষমা চেয়ে বললো, ‘আমি সত্যি মুসলমান! আমাকে বাবাই বিপথগামী করেছে। আপনি আমাকে এখানেই রেখে দিন। আমি আমার গোনাহের কাফফারা আদায় করতে চাই।’

‘আল্লাহ তোমার গোনাহ ক্ষমা করুন।’সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি আল্লাহর বিধানে কোন হস্তক্ষেপ করতে চাই না। এখানে তোমার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তও নিতে বসিনি। আমি শুধু আল্লাহর কুদরত ও মহিমা দেখছি, আর যত দেখছি ততাই বিস্মিত ও অভিভুত হচ্ছি। বলতে পারো, কোন সাহসে একটি যুবতী মেয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সশস্ত্র এক গোয়েন্দাকে পাকড়াও করতে রাতের আধাঁরে একাকী পথে বের হয়? আর সেই বা কেমন পুরুষ, যার হাত থেকে একজন নারী তলোয়র ফেলে দিয়ে তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়?’

আজাদ এ কথার কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল। সুলতান তাকে বললেন, ‘কথা বলো যুবক, আমার প্রশ্নের জবাব দাও। বলো, তোমার মত সুদর্শন ও বলিষ্ঠ এক যুবককে একটিমাত্র মেয়ে কেমন করে কাবু করল?’

‘যদি সে পিছন থেকে আমার পায়ের গোড়ালী অকস্মাৎ সজোরে টেনে না ধরতো, আমি পড়তাম না।’

‘তবুও তুমি পড়ে যেতে।’সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘যার ঈমান বিক্রি হয়ে গেছে, সে যে কোন আঘাতেই পড়ে যায়। আর সে পরলে মুখ থুবড়েই পড়ে। যদি তুমি সত্যের পথে থাকতে, ঈমানদারদের সাথে থাকতে, তবে তোমাকে দশ জন কাফেরও ফেলতে পারতো না। তুমি জানো না, আসল শক্তি বাহু ও তলোয়ারে নয়, ঈমানের বলই আসল বল।’

এরপর সুলতান তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি এখানে কি কি দেখেছো?’

‘আমি এখানে অনেক কিছুই দেখেছি।’আজাদ বললো, ‘আমাকে বলা হয়েছিল, মিনজানিক কামান ও তীরন্দাজ বাহিনী কোথায় আছে, সে সন্ধান নিতে। আমি সেগুলো দেখে নিয়েছি। এছাড়া আমার দুই সাথী আমাকে আরও কিছু তথ্য দিয়েছে।’

‘তোমার আগে তোমার কোন সাথী কি এমন কোন তথ্য নিয়ে এখান থেকে চলে যেতে পেরেছে?’সুলতান আইয়ুবী জিজ্ঞেস করলেন।

‘না।’আজাদ উত্তরে বললো, ‘আমার জানা মতে, আমরা তিনজন ছাড়া এখানে আর কেউ নেই। বিশ্বাস না হয় আপনি ওদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। আপনার কাছে আমি মোটেও মিথ্যে বলবো না।’সে কাতর কণ্ঠে বললো, ‘আপনি আমাকে দয়া করুন, একটু সুযোগ দিন। আমি আর কোনদিন বিপথে যাবো না।’

‘সে ফয়সালা মিশরের কাজী করবে।’সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি তোমার সাথে এ জন্যই কথা বলছি, তুমি মুসলমানের সন্তান! তোমার তো আমাদের সাথেই থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তুমি বিপথে চলে গেছ।

যুবক, আমি জানি দামেশকে তোমার ভালবাসার ফাঁদে একাধিক মেয়ে আটকা পড়ে আছে। তোমার চেহারা ও শরীরের গঠন যে কোন মেয়ের মন কেড়ে নেয়ার মত। কিন্তু এখন সেসব মেয়েরা তোমাকে ধিক্কার দেবে। তোমার মুখে ওরা থুথু দেবে। আল্লাহও তোমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। আমি বলতে পারি না, দামেশকের কাজী তোমাকে কি শাস্তি দেবেন। যদি তিনি তোমার মৃত্যুদন্ড দান করে, তবে মরার আগে আল্লাহর কাছে তোমার পাপের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিও। অন্তত: মরার আগে মুসলমান হয়ে মরতে পারবে।’

‘আমার বাবাকে কি শাস্তি দেবেন?’আজাদ রাগের সঙ্গে বললো, ‘এ পাপের পথে তিনিই আমাকে টেনে নামিয়েছেন। তিনিই আমার অন্তরে অর্থের লালসা সৃষ্টি করেছেন। তিনিই আমার মন থেকে ঈমানের আলো সরিয়ে দিয়েছেন।’

‘আল্লাহর বিধান তাকেও ক্ষমা করবে না।’সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘অর্থের নেশা ক্ষণস্থায়ী জীবনের জন্য, ঈমানী শক্তি চিরন্তন জীবনের কল্যাণের উৎস। এ উৎসধারা কোনদিন শেষ হয় না।’

‘মাননীয় সুলতান! আমি আপনাকে আরো কিছু কথা বলতে চাই।’আজাদ বললো, ‘আমার বাবা কোন ধনী লোক ছিলেন না। তিনি অর্থের কাঙাল ছিলেন। আমার দু’টি বোন ছিল। তারা দু’জনই সুন্দরী ও পরিপূর্ণ যৌবনা হয়ে উঠলো। বাবা দু’জনকেই দুই আমীরের হাতে তুলে দিয়ে তার বিনিময়ে দরবারে স্থান করে নিলেন। তিনি তার দুই মেয়ের মূল্যে অনেক কিছু লাভ করেছেন। পরে আমাকেও এ কাজে নিযুক্ত করে দেন। আমার মনে অর্থের লোভ তিনিই ধরিয়েছেন। নূরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যুর পর আমার বাবা আরও উঁচু পদে আসীন হন। তিনি আল মালেকুস সালেহের প্রভাবশালী ওমরায় পরিণত হয়ে যান। ততদিনে তিনি ষড়যন্ত্রে আরো অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। বিশাল জায়গীরের মালিক হয়েছেন। আপনার সেনাবাহিনী এলে তিনি আল মালেকুস সালেহ ও তার সভাষদদের সাথে পালিয়ে যান।’

‘কিন্তু তুমি পালাও নি কেন?’

‘বিশাল জায়গীরের দেখাশোনার জন্য বাবা আমাকে দামেশকে রেখে যান। কিছুদিন পর হলব থেকে একজন লোক এলো বাবার চিঠি নিয়ে। সে চিঠিতেই বাবা আমাকে গুপ্তচরবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়তে পরামর্শ দেন। লোকটি আমাকে দামেশকে তাদের এক গোপন আড্ডায় নিয়ে যায়। আড্ডা থেকে যখন আমি ফিরি তখন আমার হাতে অনেক টাকা। দু’তিন দিন পর আমাকে জানানো হলো, আমাকে কি করতে হবে এবং কেমন করে করতে হবে। সেই থেকে আমি তাদের সাথে মিশে গেলাম এবং বেশ স্বাচ্ছন্দ্য ও আরামেই দিন কাটাতে লাগলাম।

একদিন আমাদের দলের সরদার বললো, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবক যাচ্ছে। তোমরা কয়েকজন তাদের সাথে মিশে যাও।’তার নির্দেশেই আমরা তিনজন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে যোগ দিলাম। এখানে আসার সময় আমাকে বলে দেয়া হলো, এখানে আপনার সৈন্যদের অবস্থান ভালভাবে দেখে নিয়ে যেন তাদের জানাই। আমার সাথী দু’জন আমাকে এখানকার নকশা তৈরি করে দিয়েছে। তারা এ তথ্যও দিয়েছে যে, আপনি আপনার বাহিনীকে এখানকার পর্বতশ্রেণীর আড়ালে রেখে শত্রুদেরকে এই পার্বত্য অঞ্চলে টেনে আনতে চান। এ জন্য আপনি পর্বতমালার যেসব গোপন স্থানে তীরন্দাজ ও মিনজানিক লুকিয়ে রেখেছেন, আমরা সে সব দেখেছি।’

তার দু’চোখ দিয়ে সমানে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিলো। সে বললো, ‘আমি ধরা পড়ে গিয়ে এখন বুঝতে পারছি, আমি বিরাট পাপ করেছি। আপনার কথা আমার মনে ঈমানের জোশ এনে দিয়েছে। যদি আমার বাবা আমার মধ্যে অর্থের লোভ সৃষ্টি না করতেন তবে আমার ঈমান নষ্ট হতো না। সুতরাং এ পাপ তো আমার বাবার! মহানুভব সুলতান! আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। আমাকে দয়া করে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্য করার সুযোগ দিন। আমাকে ক্ষমা করুন।’

সুলতান আইয়ুবী হাসান বিন আবদুল্লাহকে ইশারা করলেন। তিনি আজাদকে নিয়ে তাঁবুর বাইরে চলে গেলেন।

সে দিনই আজাদকে দামেশকের পথে পাঠিয়ে দেয়া হলো। তার সাথে দিল দু’জন রক্ষী সেনা। তিনজনই অশ্বপৃষ্ঠে আরোহন করলো। আজাদের হাত রশি দিয়ে বাঁধা।

ইফতারীর সময় হয়ে এসেছে প্রায়। সূর্য ডুবতে বেশী বাকী নেই। তারা ততক্ষণে অর্ধেক পথ পেরিয়ে এসেছে। এক জায়গায় থেমে গেল তারা। ইফতারীর আয়োজন করলো। আজাদের হাতের বাঁধন খুলে দিল ইফতারীর জন্য।

রাতে তাদের বিশ্রামের প্রয়োজন। রক্ষী সৈন্য দু’জন তাঁবু খাটাল। রাতের খাওয়া ও এশার নামাজের পর সৈন্য দু’জন ঠিক করল, তারা পালা করে রাত জাগবে।

ইফতারী ও রাতের খাবারের সময় দুই রক্ষী তার কাছে শুনলো, তার অপরাধের কাহিনী। আজাদ লোক পটানোয় ছিল ওস্তাদ। এ সুযোগকে সে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগালো। তাদের সাথে এমন অন্তরঙ্গভাবে কথা বললো যে ওরা মধুর কথা ও ব্যবহারে একেবারে গলে গেলো। রাতে শোবার আগে ওরা আবার আজাদের হাত বাঁধবে বলে চিন্তা করেছিল, কিন্তু এ কথা বলতেই যেন সঙ্কোচ হচ্ছিল তাদের। তারা ভাবল, সে নিরস্ত্র, পালিয়ে যাবেই বা কোথায়? তাছাড়া কেউ একজন তো রাতে পাহারায় থাকছেই, সুতরাং ওরা আর তার হাত বাঁধার প্রসঙ্গ তুলল না।

রাত। তাঁবুর বেতর এক প্রহরী ও আজাদ শুয়ে আছে। বিছানার পাশেই রাখা প্রহরীর অস্ত্রপাতি। আজাদ শোয়া থেকে উঠে বসল। পাশের প্রহরী ঘুমিয়ে আছে। প্রহরীর অস্ত্রপাতি পড়ে আছে পাশে। সে প্রহরীর তলোয়ার নিজের কোমরে ঝুলিয়ে নিল। তারপর সন্তর্পনে বাইরে বেরিয়ে এল তাঁবুর। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার ভান করে সরে গেল তাঁবুর কাছ থেকে। ডিউটিরত প্রহরী দেখল, কিন্তু কিছু বলল না।

এমনি একটি সুযোগের অপেক্ষা করছিল আজাদ। হে হাঁটতে হাঁটতে ঘোড়াগুলোর কাছে গেল। তারপর সহসা একটি ঘোড়ায় চড়ে বসে তীর বেগে ছুটিয়ে দিল ঘোড়া। তাঁবুর পাশে দাঁড়ানো প্রহরী চমকে উঠে তাকালো বেঁধে রাখা ঘোড়াগুলোর দিকে। দেখলো একটি ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে আজাদ। সে ছুটে তাঁবুতে প্রবেশ করে সঙ্গীকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, ‘এই, জলদি ওঠো! বন্দী পালাচ্ছে!’

তারা দৌড়ে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসলো। হাওয়ার গতি ছুটলো তার পিছু ধাওয়া করে। কিন্তু ততক্ষণে আজাদ তাদের দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। রক্ষীরা অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়েও ব্যর্থতার পর্যবসিত হয়েছে বুঝতে পেরে ফিরে চললো তারা।

গভীর রাত। পথও উঁচু নিচু অসমতল। কোথাও উঁচু টিলা, কোথাও পাথর। তারা ব্যর্থতার বেদনা নিয়ে অনেক রাতে ফিরে এল তাঁবুতে।

পর দিন পরাজিত দুই সৈনিক মাথা নত করে শোচনীয় অবস্থায় পৌঁছলো হাসান বিন আবদুল্লাহর কাছে। এক রক্ষী বললো, ‘আমাদের গ্রেফতার করুন, কয়েদী পালিয়ে গেছে।’তারা আরও জানালো, ‘ইফতারী করার সুবিধার্থে আমরা কয়েদীর হাতের বাঁধন খুলে দিয়েছিলাম।’কর্তব্যে অবহেলার দায়ে হাসান বিন আবদুল্লাহ তাদেরকে বন্দী করলেন।

এদিকে ভয়ে ও আতংকে তার চেহারায় নেমে এলো দুশ্চিন্তার ছায়া। কারণ আজাদ কোন সাধারণ বন্দী ছিল না। তার কাছে আছে সুলতান আইয়ুবীর যুদ্ধ পরিকল্পনা ও সৈন্য সমাবেশের চিত্র। যার ওপর নির্ভরশীল যুদ্ধের জয়-পরাজয়। হাসান বিন আবদুল্লাহ ভাবছিলেন, কি করে তিনি ঘটনাটি সুলতান আইয়ুবীকে বলবেন। কোন মুখে বলবেন, গোয়েন্দা কয়েদী পালিয়ে গেছে! আমাদের সমস্ত প্ল্যান নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে আজাদ।

হাসান বিন আবদুল্লাহ যখন সুলতান আইয়ুবীকে আজাদের পালিয়ে যাওয়ার কথা বললেন, সুলতান আইয়ুবীর চেহারার রংও বদলে গেল। অনেকক্ষণ তিনি কোন কথা বলতে পারলেন না। তারপর তিনি দাঁড়িয়ে তাঁবুর মধ্যে পায়চারী করতে লাগলেন। ঐতিহাসিক আসাদুল্লাহ আল-আসাদী লিখেছেন, ‘সুলতান আইয়ুবী কঠিন বিপদেও হতাশ বা ভীত হতেন না। কিন্তু আজাদের পালিয়ে যাওয়ার খবর শুনে তিনি খুবই বিচলিত হয়ে পড়ছিলেন। তার চেহারা যেন রক্ত শূন্য হয়ে গেল। চোখ দুটো হয়ে উঠলো নিষ্প্রভ।

তিনি তাঁবুতে পায়চারী করতে করতে থেমে গেলেন এবং আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আল্লাহ জাল্লে জালালুহু! তোমর কি এটাই মঞ্জুর যে, আমি এখান থেকে চলে যাই? তবে কি তোমার করুণা ও ক্ষমা আমার প্রতি নেই? আমি কোনদিন অস্ত্র সমর্পণ করিনি, কখনও পিছু সরে আসিনি। তুমি কি চাও না, চতুর্মুখী শত্রুর মোকাবেলায় আমি তোমার দ্বীনের ঝাণ্ডাকে ঊর্ধ্বে তুলে রাখি?’ধীরে ধীরে তার স্বর গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হয়ে উঠল।

এরপর তিনি হাসান বিন আবদুল্লাহর দিকে ফিরে বললেন, ‘ঐ দুই সিপাইকে বেশী শাস্তি দেয়ার দরকার নেই। তাদের মনে কোন কালিমা নেই। শাস্তির ভয়ে যদি তারা পলাতক থাকতো, তবে তা হতো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। কিন্তু তারা তোমার কাছে ফিরে এসেছে। ভুলের শাস্তি তারা অবশ্যই পাবে। কিন্তু তাদের সততা ও ঈমানদারীর পুরস্কারও তাদের প্রাপ্য। যা ঘটে গেছে তা নিয়ে পেরেশান হয়ে লাভ নেই। এখন সেনাপতিদেরকে ডাকো, নতুন করে পরিকল্পনা নিয়ে বসতে হবে আমাদের।’সুলতান আইয়ুবীর চেহারায় একটু আগের হতাশা ও নৈরাশ্যের ছায়া মাত্র নেই, সেখানে দৃঢ়তা ও সংকল্প যেন টগবগ করে ফুটছিল।

সেনাপতিগণ উপস্থিত হলেন। সুলতান আইয়ুবী তাদের বললেন, ‘সেই গোয়েন্দা পালিয়ে গেছে, যে আমাদের প্রতিরক্ষা প্ল্যান সংগ্রহ করেছিল। যে যে নকশা করেছিল, সে নকশা আমরা উদ্ধার করে রেখে দিয়েছি। কিন্তু সে সচক্ষে দেখে গেছে আমরা কিভাবে শত্রুদের ভেতরে এনে ফাঁদে ফেলতে চাই। পলাতকের দুই সাথী এখনও আমাদের কাছে বন্দী আছে। তারা হাসান বিন আবদুল্লাহর হেফাজতেই রয়েছে এখনো। কিন্তু তাতে কোন লাভ নেই। আমরা শত্রুদের জন্য যে ফাঁদ তৈরী করেছিলাম, তা ওরা জেনে যাবে পলাতক আসামীর কাছ থেকে। ফলে শত্রুরা আর পাহাড়ের ঘেরাওয়ের মধ্যে আসবে না। হয়ত তারাই আমাদের অবরোধ করে বসবে এবং আমাদের রসদ আসার পথ বন্ধ করে দেবে। এখন বলো আমাদের আগের প্ল্যানই ঠিক থাকবে, নাকি আমরা সে প্ল্যান পরিবর্তণ করবো?’

সেনাপতিরা তাদের নিজ নিজ অভিমত পেশ করলেন। কিন্তু অভিমতগুলো ছিল পরস্পর বিরোধী। তবে তারা সবাই আগের প্ল্যান পরিবর্তন করার ব্যাপারে একমত পোষণ করলেন। সুলতান আইয়ুবী তাঁদের বললেন, ‘কিন্তু প্ল্যান পরিবর্তনের জন্য সময়ের প্রয়োজন। ভয় হলো, যদি শত্রু এরই মধ্যে আমাদের ওপর আক্রমণ করে বসে, তবে আমরা বিপদে পড়ে যাবো। মুক্ত রনাঙ্গণে যুদ্ধ করার মত সৈন্যও আমাদের নেই, এ দিকটিও তোমাদের বিবেচনা করতে হবে।’

শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো, পরিকল্পনা পরিবর্তনের কোন প্রয়োজন নেই। কমাণ্ডো বাহিনীকে এখন থেকে তৎপর করে তুলতে হবে। তারা রাতে বেপরোয়া আক্রমণ চালিয়ে দুশমনকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে, যাতে তারা আক্রমণ করতে বাধ্য হয়। এ আক্রমণের মাধ্যমে শত্রুদের সম্মিলিত কমান্ডের যে শৃঙ্খলা আছে তা তছনছ করে দিতে হবে। তাদের কেন্দ্রীয় কমাণ্ডের তিন বাহিনীর ওপরও চালাতে হবে এ আক্রমণ। আমাদের খাদ্যশস্য আসার পথের নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কমাণ্ডো বাহিনীর সেনাপতিকে সুলতান বললেন, ‘তোমাদের প্রধান টার্গেট থাকবে শত্রুর পেট্রোল ও গোলাবারুদের গুদাম। শত্রু সৈন্য ধ্বংসের চাইতেও এগুলো ধ্বংসের দিকেই তোমাদের অধিক মনযোগী হতে হবে।’

কিছুক্ষণ পর বারোজন গোয়েন্দা কমাণ্ডো তাঁর সামনে হাজির হলো। তারা জানালো, ‘খৃষ্টানরা হলবে যে গোলা-বারুদ ও অগ্নেয়াস্ত্র পাঠিয়েছিল, সেগুলো যুদ্ধের ময়দানে আনা হয়েছে। এইমাত্র এগুলো এসে পৌঁছেছে যুদ্ধের ময়দানে।’কমাণ্ডোরা আরো জানালো, ‘এসব গোলা-বারুদ ও আগ্নেয়াস্ত্র কোথায় রাখা হয়েছে গোপনে আমরা তাও দেখে এসেছি।’

তিনি বললেন, ‘রাতে আক্রমণ চালিয়ে এসব গোলা-বারুদ ধ্বংস করে দিতে হবে।’

গোয়েন্দারা জানাল, ‘এ জন্য নতুন কোন দলাকে পাঠানোর প্রয়োজন নেই। এ কাজ আমরাই সমাধা করতে পারবো।’

তিনি জেহাদের জন্য পাগলপারা এ জানবাজ কমান্ডোদের দিকে গভীরভাবে তাকালেন। হঠাৎ একজনের ওপর তাঁর চোখ আটকে গেল এবং তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘আনতানুস, তুমিও এ দলে এসে গেছো?’

‘আমার তো এ দলেই আসা উচিত।’আনতানুস বললো, ‘আমি তো বলেইছি, আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।’

‘হে আমার প্রিয় বন্ধুরা! সুলতান আইয়ুবী কমাণ্ডোদের বললেন, ‘দ্বীন ও জাতির সম্মান রক্ষার্থে এখন তোমাদের বড় ধরনের কোরবানী দেয়ার সময় এসেছে। যুদ্ধের গতি ফিরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব এখন তোমাদেরই নিতে হবে। তোমাদের আশা সফল হোক, এজন্য আমি অন্য কোন দলকে পাঠাবো না। যদি তোমরা সেগুলো ধ্বংস করতে পারো, তবে আগামী দিনের সন্তানেরা তোমাদেরকে স্মরণ করবে কৃতজ্ঞতার সাথে। তোমরা দেখতে পাচ্ছো, আমাদের সৈন্য সংখ্যা কম। শত্রুদের তিনটি প্রবল বাহিনীর মোকবেলায় দাঁড়িয়েছে তারা। এ বিশাল বাহিনীর কবল থেকে তোমরাই তোমাদের সৈন্যদের বাঁচাতে পারো।’

‘ইনশাআল্লাহ, এ অভিযানে আমরা অবশ্যই কামিয়াব হবো। আপনার প্রতিটি কথা আমরা অন্তরে গেঁথে নিয়েছি। আমাদের ঈমান আমাদের বিজয়ের জামিন। আমরা আপনাকে আশাহত এবং জাতিকে নিরাশ হতে দেবো না।’বললো দলের কমাণ্ডার।

সুলতান তাদেরকে আরও কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে বিদায় করলেন।

হিম্মাত পর্বত শৃঙ্গের অনতিদূরে সম্মিলিত বাহিনীর বিশাল ক্যাম্প। সারি সারি তাঁবুতে সৈন্যদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এক পাশে আস্তাবল, অন্য পাশে রান্নার ব্যবস্থা। রান্না ঘরের পাশেই সারি সারি গুদামঘর। সেখানে রয়েছে খাদ্য ভাণ্ডার, সৈন্যদের প্রয়োজনীয় নানা সামগ্রী, অস্ত্র ও গোলাবারুদের ডিপো। রাতে বারোজন কমাণ্ডো হলব থেকে আসা সেই গোলা-বারুদের ডিপোর কাছে গিয়ে পৌঁছলো, যেখানে গোলা-বারুদ ছাড়াও ছিল পেট্রোল ও তেলের গাদা দেয়া অজস্র ড্রাম। সৈন্যরা ড্রামের মুখগুলো খুলে শেষ বারের মত দেখে নিচ্ছিল, মুখগুলো দ্রুত খোলা যায় কিনা। তারপর সে মুখ এমনভাবে বন্ধ করছিল, যাতে প্রয়োজনের সময় সহজেই তা খুলে ফেলা যায়। সালার ওদের নির্দেশ দিয়েছে, ‘আগামী কালই আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সৈন্যরা মার্চ করবে। অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যরা এগিয়ে গেলে তাদের পেছনে যাবে এসব ড্রাম। আইয়ুবীর ক্যাম্পের কাছে নিয়ে রাখতে হবে এগুলো। যদি দিনের আক্রমণ ব্যর্থ হয় তবে যেন রাতে মিনজানিক থেকে অািগ্নগোলা নিক্ষেপ করা যায়।’

কেউ কেউ মুখ খুলতে গিয়ে বাইরে ছিটকে পড়া তেল টুকরো কাপড় দিয়ে মুছে দিচ্ছিল। কেউ সলতে বানানোর জন্য কাপড়ের বস্তা খুলে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করছিল কাপড়। এসব কাপড় ও তেলে ভেজা সলতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল এখানে ওখানে।

এ কাজের জন্য নিয়োজিত বাহিনী রাতের অন্ধকারেও এক মনে কাজ করে যাচ্ছিল, কারণ, ভোরেই সম্মিলিত বাহিনী অভিযানে বেরিয়ে পড়বে। আক্রমণ সফল করার জন্য এ আগুনে বোমা হবে মোক্ষম হাতিয়ার।

সুলতান আইয়ুবীর বারোজন কমাণ্ডো এসে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে গেল। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ওরা দেখতে লাগল ওদের কাজকর্ম। আনতানুস বললো, ‘দেরী কলে লাভ কি? এসো শুরু করা যাক।’

তারা ধনুকে সলতেওয়ালা তীর জুড়ল। তারপর তাতে আগুন ধরিয়ে একসাথে ছুঁড়ে মারল নেই তেলের ড্রাম লক্ষ্য করে। মুহুর্তে তেলে ভেজা ন্যাকড়া, স্তুপীকৃত কাপড়, ড্রামের গায়ে লেগে থাকা তেলে আগুন ধরে গেল। দেখতে দেখতে সে আগুন ছড়িয়ে পড়লো বিস্তৃত এলাকায়। আগুন লাগা কয়েকটি ড্রাম ফেটে গেল উত্তাপে। তেল গড়িয়ে গেল চারদিকে। তেলের সাথে পাল্লা দিয়ে লাফিয়ে ছুটলো আগুনের লকলকে শিখা। হতভম্ব সৈন্যরা কি ঘটেছে বুঝার আগেই সে আগুন স্পর্শ করলো গোলা বারুদের স্তুপ। সেখান থেকে সৈন্যদের পোশাক রাখার ঘর এবং খাদ্য গুদামেও ছড়িয়ে পড়লো দুরন্ত অগ্নিশিখা। আতংকে সেখানে হুলস্থুল কান্ড বেঁধে গেল।

সারি সারি ড্রাম সাজিয়ে রাখা হয়েছিল সেখানে। এক ড্রাম থেকে অন্য ড্রামে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটছিল আগুন।

সম্মিলিত বাহিনীর সাধারণ সিপাইরা তখন নিজ নিজ তাঁবুতে। কেউ গল্প-গুজব করছিল, কেউ রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পড়েছিল বিছানায়। প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের চোখ ধাঁধাঁনো আলো, ড্রাম ফাটার বিকট শব্দ আর ওখানকার কর্মরত আহত সৈনিকদের আর্তচিৎকার শুনে তাঁবুর বাইরে ছুটে এল সৈন্যরা। দিনের মত আলোকিত হয়ে উঠেছিল পুরো এলাকা। তীরের আঘাতে লুটিয়ে পড়ছে ছুটন্ত সৈন্যরা। পর্যাপ্ত আলো থাকায় তাদের প্রতিটি তীর লক্ষ্যভেদ করছিল।

প্রচণ্ড হট্টগোল ও হৈ-হাঙ্গামার কারণে পুরো সেনাবাহিনীতে ছড়িয়ে পড়েছিল আতংক ও ত্রাস। সৈন্যরা কি ঘটেছে দেখার জন্য হাতিয়ার ছাড়াই বেরিয়ে এসেছিল তাঁবুর বাইরে। আগুন দেখে খালি হাতেই ছুটলো আগুন নেভাতে। কিন্তু ততক্ষণে সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। এ আগুন নেভানো বা আয়ত্বে আনার সাধ্য ছিল না কারো। নিরস্ত্র সৈন্যরা বৃথা চেষ্টা বাদ দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে চাইলো, কিন্তু আইয়ুবীর কমাণ্ডোরা তাদের সে সুযোগও দিল না। তীরের আঘাতে ঘায়েল করে চললো তাদের।

কমাণ্ডোদের তীরের আঘাতে কেউ কেউ ঘায়েল হলো। কেউ কেউ তীরের আঘাত বাঁচিয়ে ছুটে গেল তাঁবুতে। অল্পক্ষণের মধ্যেই একদল শত্রু সেনা সংগঠিত হয়ে তাদেরকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করলো। শুরু হয়ে গেল এক রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধ। ক্রমেই দুশমনের দল ভারী হতে লাগলো। বারোজন কমাণ্ডোর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল শত শত সৈন্য।

প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছে কমাণ্ডো বাহিনী। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে অগ্নিশিখা। ক্যাম্প জুড়ে তুমুল তোলপাড়। উট আর ঘোড়াগুলো দড়ি ছিঁড়ে যে যেদিকে পারছে ছুটে পালাচ্ছে। তাদের পায়ের তলে পিষে যাচ্ছে অনেক সৈন্য। দেখতে দেখতে অন্ধকার রাতের শান্তিময় পরিবেশ নরক গুলজার হয়ে উঠলো।

সুলতান আইয়ুবীর ক্যাম্প। সৈন্যরা রাতের খাওয়া শেষ করে তাঁবুতে ফিরছিল। যাদের রাতের ডিউটি, তারা পোশাক পাল্টে ডিউটিতে চলে গেল। এতক্ষণ যারা ক্যাম্প পাহারা দিচ্ছিল তারা ইফতারের পর থেকেই অপেক্ষা করছিল বদলী সৈন্যের আগমনের। তাদের প্রত্যাশা পূরণ হলো। নৈশ প্রহরীরা যে যার ডিউটি বুঝে নিল। সুলতান কেবল ক্যাম্পের আশপাশই নয়, অনেক দূর দূরান্ত পর্যন্ত পাহারাদার নিয়োগ করে রেখেছিলেন। পাহাড়ের বিভিন্ন টিলায় উপত্যকায়, সংকীর্ণ গলিপথে সুলতানের নিয়োজিত পাহারাদাররা ডিউটি দিচ্ছিল।

অন্ধকারে পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়েছিল এক সৈন্য। হঠাৎ সে চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘আগুন! আগুন! আগুন লেগেছে কোথাও! ওই দেখো আগুনের জিহবা আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে!’

সুলতান আইয়ুবী প্রহরীর চিৎকার শুনে দ্রুত ছুটে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেলেন। দেখলেন, শত্রু ক্যাম্পের অগ্নিশিখায় আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। অজ্ঞাতেই তাঁর মুখে থেকে বেরিয়ে এলো, ‘সাবাস! সাবাস জিন্দাদিল আল্লাহর সৈনিক! আল্লাহ তোমাদের পুরস্কৃত করবেন।’

পরদিন সকাল। এক অশ্বারোহী তীরবেগে ছুটে এলো সুলতান আইয়ুবীর তাঁবুর দিকে। সুলতান তখন তাঁবুতেই ছিলেন। আরোহী এসে দ্রুত ঘোড়া থেকে নেমে সুলতানের খেদমতে হাজির হয়ে সংবাদ দিল, ‘শত্রুরা আসছে। তারা এখন মাইলখানেক দূরে আছে। তাদের গতি পর্বত শৃঙ্গের দিকে।’

এ কাসেদ তখনও বিদায় হয়নি, ছুটে এলো আরও এক আরোহী। সে খবর দিল, ‘ডান দিক থেকেও শত্রু সৈন্য এগিয়ে আসছে।’

এ খবর পেয়ে সুলতান আইয়ুবী বুঝলেন, শত্রুরা ডান দিন থেকেও আক্রমণ চালাচ্ছে। এ নিয়েই সুলতান আইয়ুবী বড় দুশ্চিন্তায় ছিলেন। খবর ফেয়ে তিনি আরও অস্থির হয়ে উঠলেন। কারণ এ দিকের রণসজ্জা আজাদ দেখে গেছে। তিনি অনুমান করলেন, আজাদ হয়তো গত রাতেই ওদের কাছে পৌঁছে গেছে। তার কাছ থেকে তথ্য পেয়েই তারা আজ আক্রমণ চালিয়েছে।

সুলতান আইয়ুবী তার বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে আদেশ দিলেন। কাসেদরা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়লো খবরের সন্ধানে। প্রতি মুহুর্তে ময়দানের পরিস্থিতি সুলতানকে অবহিত করার দায়িত্ব তাদের।

পর্বত শৃঙ্গের ওপর তাঁবু টানানোই রইলো। আইয়ুবীর সৈন্যরা পরিকল্পনা পরিকল্পনা মত কিছু তাঁবুতে আর কিছু চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। শত্রুরা দেখলে মনে করবে, এরা এখনও যুদ্ধের খবর পায়নি। মোকাবেলার কোন প্রস্তুতিই নেই ওদের। উপত্যকার মাঝে শত্রুর দৃষ্টির আড়ালে তীরন্দাজ বাহিনী ততক্ষণে গোপন স্থানে পজিশন নিয়ে বসে গেছে।