হলব, হারান ও মুশালের সম্মিলিত বাহিনীর পরাজয়ের পর নতুন অভিযানে বেরিয়ে পড়ার জোর প্রস্তুতি চলছে। সেই প্রস্তুতির ফাঁকে আইয়ুবী ও তাঁর সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন অফিসার এক জায়গায় বসে গল্পগুজব করছিলেন। সৈনিকদের সাহসিতকা ও বীরত্ব নিয়ে কথা হচ্ছিল ওদের মধ্যে। ওদের চোখের সামনে ভেসে উঠছিল বিগত দিনের যুদ্ধের অসংখ্য স্মৃতি। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এক সিপাহীর অপূর্ব বীরত্বের কথা আলোচনা করলেন এক অফিসার। সুলতান আইয়ুবী তার বর্ণনা শুনে বললেন, ‘কিন্তু ইতিহাসের পাতায় এসব আত্মত্যাগী সৈনিকদের কোন নাম লেখা থাকে না। সেখানে শুধু লেখা হয় সেনাপতির নাম। ঐতিহাসিকদের এটা বড় বে-ইনসাফী। তারা বাদশাহ, সুলতান ও সেনাপতিদের নিচে আর কাউকে দেখনে পান না। যদিও জয়-পরাজয় নির্ধারণের মালিক একমাত্র আল্লাহ, কিন্তু সে বিজয় আসে সৈনিকদের হাত দিয়ে। তাই তো বিজয়ের মাল্য সবসময় সৈনিকদের গলায়ই পরানো হয়।
আমাদের কমাণ্ডো সৈন্যরা শত্রুদের কাছে গিয়ে যদি তাদের বন্ধু হয়ে যেতো, তবে আমরা কি করতে পারতাম! যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যরা যুদ্ধ করার পরিবর্তে যদি বাঁচার চিন্তাই বেশী করে করতো, তবে কিভাবে বিজয় আসতো? গৌরব তো তাদেরই পাওনা, যাদের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে বিজয় অর্জিত হয়। ইতিসাসে আমাদের সেই বীর সৈন্যদের নাম অবশ্যই আশা উচিত, যারা অসংখ্য শত্রুর মোকাবেলায় যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে বা শাহাদাত বরণ করে। যারা কখনো দ্বীনের পতাকা মাটিতে পড়তে দেয় না। সেনাপতি বা কমাণ্ডারদের ভুলে যদি কখনো যুদ্ধের ময়দান পরাজয় দেখা দেয়, সে পরাজয় মেনে নেয় না ওইসব মুজাহিদ, যারা তাদের ঈমানের দাবী পূরণ করতে গিয়ে হাসতে হাসতে জীবন বিলিয়ে দেয়। ঈমানই তাদের গলায় পরিয়ে দেয় বিজয়ের মালা। শাহাদাতের গৌরব নিয়ে তারা হাজির হয়ে যায় আল্লাহর দরবারে।’
‘কিন্তু সুলতান আমাদের ব্যর্থতা ও জিল্লতির বড় কারণ নেতাদের ভুল সিদ্ধান্ত নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের ব্যর্থতা নেমে আসে গাদ্দারদের কারণে। আমাদের কোন ভাই যখন তার ঈমান বিক্রি করে মোনাফেকী করে, তখনই আমরা সবচেয়ে বেশী বেকায়দায় পড়ে যাই। সুলতান আপনি কি বলতে পারেন, গাদ্দারদের সৃষ্টি করে আল্লাহ আমাদের কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছেন?’
সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আল্লাহর মহিমা আমরা কতটুকুই বা বুঝতে পারি! হয়তো এ গাদ্দার সৃষ্টি করে তিনি সব সময় আমাদের সজাগ ও সতর্ক থাকার নির্দেশ দিচ্ছেন। হয়তো একের পর এক বিজয় লাভ করে যেন আমাদের হৃদয় স্ফীত না হয়ে উঠে তার জন্য সতর্ক করছেন। আল্লাহর ইচ্ছা আল্লাহই ভাল জানেন। তবে এটা ঠিক, দুশমন নয়, ইসলামের যদি কোন দিন পতন ঘটে তবে তা ঘটবে এ গাদ্দারদের জন্যই। এ গাদ্দাররাই জাতির হৃদয় থেকে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও শক্তি শুষে নেয়, মুসলমানদের ঈমান ক্রয় করে জাতিকে ডুবিয়ে দেয় পাপের অতল গহীন অন্ধকারে।
আপনাদের অজানা নেই, খৃষ্টানদের সাধ্য সাধনা ও যুদ্ধ আপনাদের সাথে নয়, তাদের যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে। ইসলাম পরিত্যাগ করলেই তারা আপনাদের শত্রু থেকে বন্ধু হয়ে যাবে। তারা বলে, যতদিন ক্রুশের পূজারী দুনিয়ায় থাকবে, ততদিন ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের এ যুদ্ধ চলতেই থাকবে। তারা তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এ শিক্ষা ও সংকল্পই রেখে যায়।
আমি চাচ্ছি, আমরাও আমাদের সৈন্যদের কর্মকাণ্ড লিপিবদ্ধ করে যাবো। যেমন উত্তর মিশরের মরু এলাকায় এবং হিম্মাতের বরফ ঢাকা এলাকায় করা হয়েছে। বিশেষ করে জানবাজ কমাণ্ডোদের ইতিহাস ও ত্যাগের কাহিনী এমনভাবে লিপিবদ্ধ করতে হবে, যা আগামী প্রজন্মের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। এসব কমাণ্ডোরা যখন জীবন বাজী রেখে শত্রুদের মধ্যে ঢুকে যায়, পৃথিবী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। গুটিকয় কমাণ্ডো বিশাল শত্রু বহরে শংকা ও ত্রাসের এমন কাঁপন সৃষ্টি করে, যা অনেক সময় একটা সৈন্যবাহিনীও করতে পারে না। তাদের ত্যাগের কথা স্মরণ করুন, অভিযানে যায় দশজন, ফিরে আসে একজন, দু’জন, কখনো আবার একজনও ফেরে না।’
‘জ্বি, আপনি ঠিকই বলেছেন সুলতান। তারা জেনেশুনেই নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।’
‘না।’সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘বরং বলো তারা জেনেশুনে নিজের জীবন দিয়ে ক্রয় করতে ছুটে যায় শাহাদাদের নিশ্চিত সাফল্য ও গৌরব।’
‘হ্যাঁ, সুলতানে মুয়াজ্জাম!’সেনাপতি বললো, ‘এটা এমন এক অমূল্য সম্পদ, যা আমরা ভবিষ্যত সন্তাদের জন্য রেখে যেতে পারি। এ সম্পদ যতদিন এ জাতির হাতে থাকবে, ততদিন বিশ্বে তারাই থাকবে অমর, অজেয়। কে না জানে, প্রতিটি জাতিই বেঁচে থাকে তার বীরদের গৌরবগাথা নিয়ে।’
‘কিন্তু বন্ধু, এ ইতিহাস তোমরা কোনদিনই পূর্ণাঙ্গ কতে পারবে না।’বললেন অন্য এক সেনাপতি, ‘এ দুনিয়ায় কেবল আমরাই ইসলামের জন্য যুদ্ধ করছি, এমন নয়। দুনিয়ার প্রত্যন্ত প্রান্তরে এমন অনেক মুজাহিদ আছেন, যারা ইসলামের জন্য নিজের দেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন অন্য দেশে। যেখানে এখনো ইসলামের দাওয়াত এখনো পৌঁছেনি, ছুটে গিয়েছেন সেখানে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে। দেশের বাইরে জাতির দৃষ্টির আড়ালে তারা এমন যুদ্ধে লিপ্ত, যার সংবাদ হয়তো আমরা কোনদিনই পাবো না।’
‘তাতে হতাশ ও নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘তাদের সামনে যে ধর্মীয় অনুভূতি ও জযবা কাজ করছে, সে জযবা নিয়ে সেখানেও আল্লাহর বান্দারা শামিল হবে সত্যের কাফেলায়। তাদের মধ্য থেকেই জন্ম নেবে নতুন শেরে খোদা, নতুন খালিদ বিন ওয়ালিদ। সেখানে ইসলামের ঝাণ্ডা উঁচু করে ধরবে যে বীর মুজাহিদরা তাদের মধ্যে আমাদের মত আল্লাহর সৈনিকরাও থাকবে। তারাই একদিন সৃষ্টি করবে নতুন ইতিহাস।’
‘কিন্তু সুলতান, আমাদের সে সব ভাইদের ত্যাগ-তিতীক্ষার অনেক খবরই আমরা কোনদিন পাবো না, যারা শত্রুদের হাতে ধরা পড়ে অসহনীয় কষ্ট ও নির্যাতন ভোগ করে। শত অত্যাচার আর নির্যাতনেও তারা সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হয় না। শেষ পর্যন্ত অত্যচার সইতে সইতে জীবন বিলিয়ে দেয়। জাতি যখন বিজয়ের গৌরব লাভ করে, তখনও জাতি তাদের কথা জানতে পারে না। তারা দৃষ্টির আড়ালে থেকেই জাতির সম্মান ও গৌরবকে আরও গৌরবময় করে তোলে। তাদের অপরিসীম সাহস ও ত্যাগের কাহিনী আমরা কখনোই জানতে পারি না।’
‘হ্যাঁ, এমন সব মুজাহিদের কিছু কিছু কাহিনী কখনো কখনো প্রকাশ হয়ে পড়ে।’বললেন সুলতান আইয়ুবী, ‘যেমন উমরু দরবেশ। সে ছিল এক সুদানী মুসলমান। আমার ভাই তকিউদ্দিন সুদান আক্রমণ করে এবং শত্রুদের ধোঁকায় পড়ে সুদানের মরুভূমির গভীরে ঢুকে পড়লে যখন তাদের জন্য খাদ্য ও রসদ পাঠানো অসম্ভব হয়ে উঠেছিল, তখনকার ঘটনা। শত্রুরা রসদ পাঠানোর রাস্তা বদ্ধ করে দিয়ে তকিউদ্দিনের বিভিন্ন গ্রুপ ও দলের সাথে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে সেখানে মুসলিম বাহিনী অনেক ক্ষতি ও বিপর্যয়ের শিকার হয়। তাদের এগিয়ে যাওয়া বা বেরিয়ে আসার আর কোন সুযোগ ছিল না।
সুদানীরা সে সময় অনেককে যুদ্ধবন্দী করে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। এদের মধ্যে তকিউদ্দিনের দু’তিন জন সেনা কমাণ্ডারও ছিলো। এ কয়েদীদের মধ্যে মিশরী ও বাগদাদীদের সংখ্যা ছিল বেশী, কিছু ছিল সুদানী মুসলমানও।
আমি যখন তকিউদ্দিনের বিচ্ছিন্ন সৈন্যবাহিনীকে সুদান থেকে বের করে আনি, তার আগেই ওরা ধরা পড়ে গিয়েছিল। আমি সুদানীদের কাছে চিঠি ও দূত পাঠিয়েছিলাম যুদ্ধ বন্দীদের মুক্ত করার প্রস্তাব দিয়ে। সুদানীরা সে প্রস্তাব অস্বীকার করে বললো, যেহেতু আমাদের কাছে তাদের কোন সৈন্য কয়েদী হিসাবে নেই, সেহেতু এ প্রস্তাব বিবেচনা করার কোন সুযোগ নেই তাদের। তবে তারা মিশরের কিছু এলাকার বিনিময়ে যুদ্ধবন্দী বিনিময় করতে পারে। তখন আমি তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেই, ইসলামী রাজ্যের এক ইঞ্চি জায়গাও আমি তোমাদের দিতে পারবো না। কিন্তু আমাদের সৈন্যদের ফেরত না দিলে সে জন্য তোমাদের কঠিন মূল্য দিতে হবে। আমাদের সৈন্যরা কোরবানী দিতে জানে, এ কথাটা তোমরা ভুলে যেও না।
তারপরের ইতিহাস তোমাদের জানা। সুদানীরা যে হাবশীদের দিয়ে মিশর আক্রমণ করিয়েছিল, তাদের একজনও দেশে ফিরে যেতে পারেনি। যারা বেঁচে ছিল তাদেরকে বন্দী করা হলো। আশা করলাম, সুদানীরা এবার বন্দী বিনিময় করবে। কিন্তু তারা কোন দূত পাঠাল না। তারা হাবশীদেরকে মিথ্যা আশ্বাস ও প্রতারণা করে মিশরে ঢুকিয়েছিল। এরা কেউ সুদানের নিয়মিত সৈন্য ছিল না। এ হাবশীদের আমরা মজদুর বানিয়েছিলাম। তাদের দিয়ে পাহাড় কাটিয়েছি, কিন্তু তাদের দিয়ে কোন বন্দী বিনিময় সম্ভব হয়নি। কিন্তু কেন তারা বন্দী বিনিময় করেনি, এ খবর পেয়েছি পরে।
সুদানীরা চাচ্ছিল, মিশরীয় বাহিনীর বন্দী সৈন্যদেরকে তাদের বাহিনীতে যুক্ত করে নিতে। তোমরা জানো, খৃস্টানরা সুদানীদের সামরিক উপদেষ্টা ছিল। তারাই সুদানীদেরকে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। তারা সুদানীদের পরামর্শ দিল, যে কোন প্রকারেই হোক, মিশরী সৈন্যদেরকে সুদানী সেনাদলে অন্তর্ভুক্ত করে নাও। তারা সে চেষ্টাই করেছে। কিন্তু তারা কতজন মুসলমান সৈন্যকে তাদের বাহিনীতে যুক্ত করে নিতে সমর্থ হয়েছিল সে খবর আমরা পাইনি। পরে জেনেছি, ভালবাসা দিয়ে, আদর দিয়ে, সৌজন্য ও ভদ্রতা দিয়েও যখন তারা ব্যর্থ হয়, তখন তারা নির্দয়ভাবে তাদের ওপর অত্যাচার চালায় এবং তাদের নির্মমভাবে হত্যা করে।
এই কয়েদীদের মধ্যে ইসহাক নামে আমাদের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার ছিল। সে আমাদের সেনাদলের গ্রুপ কমান্ডার থেকে ক্রমান্বয়ে অফিসার পদে উন্নীত হয়। সে ছিল সুদানের বাসিন্দা। যৌবনে মিশরের সেনাবাহিনীতে এসে যোগদান করে।
সুদানের এক পাহাড়ী এলাকায় চার-পাঁচ হাজার মুসলমানের বাস ছিল। বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল তারা। ইসলাম তাদের মধ্যে ঐক্যের বাঁধন তৈরী করে। বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা একটি ঐক্যবদ্ধ কমিটি দ্বারা পরিচালিত হতো। সব কবিলার লোকই এ কমিটির আদেশ ও মীমাংসা মেনে চলতো। তাদের মধ্যে একটি প্রথা গড়ে উঠল, তাদের সন্তানরা যৌবনে পা দিলেই অভিভাবকরা তাকে মিশরের সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য পাঠিয়ে দিতো। কিন্তু তারা কখনো সুদানী ফৌজে ভর্তি চাইলেও তারা আপত্তি করতো। পাহাড়ী সন্তান হিসাবে তারা ছিল অসম্ভব কর্মঠ, সাহসী ও বীর। যোদ্ধা হিসাবে ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তীরন্দাজীতে সিদ্ধহস্ত।
সুদানী সরকার তাদেরকে সৈন্যবাহিনীতে নেয়ার জন্য অনেক লোভ দেখাল। কিন্তু লাভ হলো না। তারপর তাদের ভয় দেখাল, তাতেও কাজ হলো না। অবশেষে সুদানী সরকার তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তাদের ওপর চাপিয়ে দিল যুদ্ধ। কিন্তু পাহাড়ী সে মুসলমানদের ওপর পর পর দু’বার আক্রমণ করেও ব্যর্থ হলো তারা। মুসলমান তীরন্দাজরা পার্বত্য উপত্যকা থেকে এমন তীর বর্ষণ করে যে, সুদানী অশ্বারোহীর তীর খেয়ে নিজেদের পদাতিক বাহিনীকেই ঘোড়ার পদতলে পিষে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়।
যা বলছিলাম, তকিউদ্দিনের সামান্য ভুলের জন্য সুদানীদের হাতে মিশরের বহু সৈন্য বন্দী হয়ে যায়। সেই বন্দীদের মধ্যে ওই পাহাড়ী কবিলার কমাণ্ডার ইসহাকও ছিল। নিজের কবিলার ওপর তার প্রভাব ছিল প্রচণ্ড। যুদ্ধ বন্দী হয়ে সুদানীদের হাতে পড়ার পর তাকে বলা হলো, যদি তুমি সুদানী বাহিনীতে যোগ দাও এবং তোমার সম্প্রদায়কে সুদানী সেনাবাহিনীতে ভর্তি করাও, তবে তোমাকে শুধু মুক্তিই দেবো না, বরং যে পাহাড়ী এলাকায় তোমরা বসবাস করো, সে অঞ্চলকে আলাদা প্রদেশ করে তার শাসনভার তোমার হাতে তুলে দেবো। তুমি হবে সেখানকার সুলতান।’
‘আমি সেখানকার সুলতান আগে থেকেই আছি।’ইসহাক উত্তর দিল, ‘ওটা তো আগাগোড়াই আমাদের স্বাধীন রাজ্য।’
‘সেটা তো সুদানেরই এলাকা।’সুদানীরা বললো, ‘আমরা যে কোন দিন সে এলাকা থেকে তোমাদের উচ্ছেদ এবং বন্দী করতে পারি।’
‘হ্যাঁ, তোমরা সে অঞ্চল আগে দখল করো।’ইসহাক বললো, সেখানকার মুসলমানদের ধ্বংস করা বা তাদেরকে তোমাদের সৈন্য দলে ভর্তি করার খায়েশ তোমাদের কোন দিনই পূরণ হবে না। তোমরা সে এলাকায় তোমাদের পতাকা নিয়ে গিয়ে দেখো, যদি তাদের পদানত করতে পারো, তারপরে আমাকে তোমাদের বাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য দাওয়াত দিও।’
এতসব কথার পরও ইসহাককে ওরা কারাগারে না রেখে একটি সুন্দর সাজানো বাড়ীতে রাখলো। এতই সুন্দর, যেন কোন শাহজাদার মহল। তারপর একদিন সুদানী সেনাপতি সেখানে এসে হাজির। তিনি তার কামরায় প্রবেশ করে দু’হাতে তলোয়ার নিয়ে নতজানু হয়ে তার সামনে রাখলো এবং বললো, ‘আপনার মত রণবীরকে আমরা মন থেকেই সম্মান করি! আপনি আমাদের কয়েদী নন, সম্মানিত মেহমান!’
‘আমি আপনার তলোয়ার গ্রহণ করতে পারি না।’ইসহাক বললো, ‘আমি মেহমান নই, কয়েদী। আমি পরাজিত এক বন্দী। আমি আপনার কাছ থেকে তলোয়ার সেভাবেই নেবো, যেভাবে আপনি আমার হাত থেকে তলোয়ার ছিনিয়ে নিয়েছেন। তলোয়ার তলোয়ারের শক্তি দ্বারাই নিতে হয়।’
‘কিন্তু আমরা আপনার শত্রু নই।’সুদানী সেনাপতি বললো।
‘কিন্তু আমি ত আপনার শত্রু।’ইসহাক হেসে বললো, ‘তলোয়ারের বদল এমন সুন্দর কামরাতে হয় না, তলোয়ারের বদলা যুদ্ধের ময়দানে হয়। আমি আপনার শুকরিয়া আদায় করছি, কারণ আপনি আমাকে সম্মান দেখিয়েছেন।’
‘আমরা এর চেয়ে বেশী সম্মান দেব আপনাকে।’সুদানী সেনাপতি বললো, ‘আপনার সিংহাসন খার্তুমের মসনদের সাথেই রাখা হবে।’
‘কিন্তু কিয়ামতের পরে সে সিংহাসন জাহান্নামের অতল তলে থাকবে।’ইসহাক বললো, ‘কারণ দুনিয়াতে খার্তুমের মসনদ ইসলামের দুশমনের করতলগত ছিল।’
‘আমি দুনিয়ার কথা বলছি।’
‘কিন্তু মুসলমান আখেরাতের চিন্তাই বেশ করে। যে সময় মানুষের আমলনামা আল্লাহর সামনে হাজির করা হবে।’ইসহাক বললো, ‘আমাকে বলুন, আপনার পরে কে আসবে, আর সে আমার জন্য কি উপহার নিয়ে আসবে?’
সুদানী সেনাপতি হেসে বললো, ‘তাতে কিছু যায় আসে কি? আমি সৈনিক, আপনিও সৈনিক। আমি আপনার সৈনিকত্বের মূল্য দিচ্ছিলাম। কিন্তু আপনি আমার মনটা ভেঙ্গে দিলেন।’
‘আপনি আমার সৈনিক জীবনের গৌরব কি দেখেছেন?’ইসহাক বললো, ‘আমাদের তো যুদ্ধ করার সুযোগই হয়নি। আমাদের সৈন্যরা মরুভূমির এমন প্রান্তে গিয়ে পৌঁছে ছিল, যেখানে পানির একটা ফোটাও নেই। চারটি দিন ভয়াল মরুভূমিতে আমাদের কেটেছে পানিবিহীন। আমাদের পদাতিক বাহিনী ও অশ্বারোহী দল পানির অভাবে কি যে কষ্ট করেছে তা বর্ণনা করার মত নয়। আমাদের ঘোড়াগুলো পানির অভাবে মরে গেলো। সৈন্যরা যখন উষ্ঠাগত প্রাণে জিহবা বের করে পানির অভাবে কাৎরাচ্ছিল, তখন আমরা সবাই আপনাদের হাতে ধরা দিলাম। আপনি আমাদের তলোয়ারের তেজ কোথায় দেখলেন? আমাদের তো পরাজিত করেছিল সেই মরুভূমি। আপনি আমার বীরত্বের উপহার দিতে এসেছেন?’
‘আমাকে বলা হয়েছে, আপনি একজন বীর যোদ্ধা, কুশলী সালার।’সেনাপতি বললো।
‘শোনা কথায় বিশ্বাস করতে নেই!’ইসহাক বললো, ‘আগামী কাল একটি তলোয়ার নিয়ে আমার কাছে আসবেন। একটি আপনি নিবেন, একটি আমি। সেই মোকাবেলার পর আশা করি আপনার কোন কথাতেই আমি অরাজী হবো না। কারণ, তখন তো আর আপনি জীবিত থাকবেন না!’
সেনাপতি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, ইসহাক বললো, ‘ভাল করে শুনে নিন সম্মানিত সেনাপতি। আপনারা আগামী কাল আমাকে যে কারাগারে পাঠাবেন, এক্ষুণি সেখানে পাঠিয়ে দিন। কারণ আপনাদের কোন আশাই সফল হবে না। আমি এ সুন্দর কামরা কেন, কোন কিছুর বিনিময়েই আমার ঈমান বিক্রি করবো না।’
‘কারাগারের জঘন্য পরিবেশে না থেকে আপনি এ মনোরম পরিবেশেই সুন্দরভাবে চিন্তা করতে পারবেন।’সেনাপতি বললো, ‘আমি আশা করবো, আপনার সামনে যে শর্ত রাখা হয়েছে সে বিষয়ে আপনি আরো গভীরভাবে চিন্তা করবেন। আপনার এক সৈনিক ভাই হিসেবে আমার পরামর্শ হচ্ছে, এমন কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না, যাতে আপনার ভবিষ্যত ঘোর অন্ধকারে ডুবে যায়। আল্লাহ আপনার ভাগ্যে বাদশাহী লিখে রেখেছেন, কেন আপনি ভাগ্যের সে লেখা নষ্ট করবেন?’
‘আমার আল্লাহ আমার ভাগ্যে কি লিখে রেখেছেন সেটা তিনিই ভাল জানেন।’ইসহাক বললো, ‘আর আপনার ভাগ্যে কি লিখে রেখেছেন তাও জানেন। ভাগ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই, এখন আপনি যেতে পারেন।
আপনি যদি মনে করেন আমার আরো চিন্তা করা দরকার, তবে আমার বলার কিছূ নেই।’
সেনাপতি চলে গেলেন। একটু পর খাবার নিয়ে কামরায় ঢুকল তিনটি মেয়ে। রূপসী, সুন্দরী, যুবতী। নামে মাত্র পোশাক পরণে। হরেক রকম উপাদেয় খাবার ওরা টেবিলে সাজিয়ে রাখল। এতসব খাবার সে জীবনেও দেখেনি। সুন্দরীদের হাতে শরাবের পাত্র। ওরা তাকে খাবার গ্রহণের জন্য আহবান করলো।
ইসহাক প্রয়োজন মত খাবার গ্রহণ করলো। খাওয়া শেসে পানি পান করে উঠে এলো টেবিল থেকে। এটি মেয়ে তার কাছে এগিয়ে গেল। ইসহাক তার দিকে তাকালো, ঠোঁটে তার ব্যঙ্গের হাসি।
‘আমাকে কি আপনার পছন্দ নয়?’মেয়েটি বললো।
‘আমি তোমার মত বিশ্রী মেয়ে জীবনেও দেখিনি।’ইসহাক বললো।
মেয়েটার মুখের রং ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে কেবল সুন্দরীই ছিল না, পরিপূর্ণ যৌবনবতীও ছিল। ইসহাক তার মনের ভাব বুঝে বললো, ‘নারীর সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে তার লজ্জাবোধের মধ্যে। মেয়েরা উলঙ্গ হলে তার আকর্ষণ শেষ হয়ে যায়। তোমার এ অর্ধ উলঙ্গ দেহে আকর্ষণের কি আছে? তোমার সৌন্দর্যের যাদু তো তুমিই শেষ করে দিয়েছো! তোমাকে দেখে আমার লজ্জা আর ঘৃণাই বাড়ছে শুধু।’
‘আপনি কি আমাকে দেখেও আমার প্রয়োজনবোধ করছেন না?’মেয়েটি বললো।
‘না, নির্লজ্জ ও বেহায়া মেয়ের কোন প্রয়োজন নেই আমার।’ইসহাক বললো, ‘আমার প্রয়োজন একটি পবিত্র আত্মার, যা তুমি কোনদিনও আমাকে দিতে পারবে না। অতএব এবার তুমি যেতে পারো।’
‘কিন্তু আমাকে তো আপনার পাশে থাকার আদেশ দেয়া হয়েছে।’মেয়েটি বললো, ‘যদি আসি সে আদেশ অমান্য করি তবে শাস্তি স্বরূপ আমাকে হাবশী পশুদের হাতে ছেড়ে দেয়া হবে।’
‘দেখো মেয়ে, আমি একজন মুসলমান।’ইসহাক বললো, ‘আমাদের ধর্মীয় বিধান অমান্য করে আমি তোমাকে এ কামরায় রাখতে পারবো না। যদি তুমি এ কামরাতেই থাকতে চাও, তবে থাকো, আমি বাইরে চললাম।’
‘এতেও আমার অপরাধ হবে।’মেয়েটি বললো, ‘আপনি আমার উপর একটু দয়া করুন, আমাকে এ কামরাতেই থাকতে দিন। আপনিও থাকুন।’
‘তা হয় না। এমন দয়া আমি করতে পারবো না।’
মেয়েটি দেখলো, এ লোক বড়ই পাষাণ! সে ইসহাকের কাছে অনুনয় বিনয় শুরু করলো।
‘তোমার কাজটা কি?’ইসহাক জিজ্ঞেস করলো, ‘কি উদ্দেশ্যে তোমাকে আমার কাছে পাঠানো হয়েছে? তুমি তোমর উদ্দেশ্য বলে দাও, দেখি আমি তোমাকে কোন সাহায্য করতে পারি কি না!’
‘আমার দায়িত্ব? আমার দায়িত্ব পুরুষ মানুষকে মোমের মত নরম করা, তাদের চাহিদা মেটানো।’মেয়েটি উত্তরে বললো, ‘আপনিই প্রথম পুরুষ যে আমাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। আমি কত ধার্মিক পুরুষকে এ রূপের জালে জড়িয়েছি, সুদানীদের গোলাম বানিয়ে তবে ছেড়েছি তাদের। আপনি কি সত্যিই আমাকে বিশ্রী মনে করেন, না ঠাট্টা করছেন?’
‘তুমি যাকে সুন্দর মনে করো, আমার চোখে তা অসুন্দর। যাকে তুমি সুগন্ধ বলো, আমি তাকে বলি দুর্গন্ধ।’ইসহাক বললো, ‘আমার দৃষ্টিতে তুমি সত্যি কুৎসিত। ঠিক আছে, তুমি এ কামরায়ই থাকবে। তুমি যেখানে শুতে চাও শুয়ে পড়ো। তুমি পালঙ্কে শয়ন করলে, আমি নিচে বিছানা করবো।’
মেয়েটি বললো, ‘না, আপনিই পালঙ্কে শয়ন করুন, আমি নিচে বিছানা করছি।’
‘তোমার নাম কি?’ইসহাক মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো।
‘আমার নাম আশী!’
তুমি কি খৃষ্টান, না মুসলমান?’‘আমার কোন ধর্ম নেই।’
‘তোমার বাবা-মা কোথায় থাকেন?’
‘জানি না!’মেয়েটি বললো।
ইসহাকের চোখে ঘুম এসে গেলো, কিছুক্ষণ পরেই তার নাক ডাকার শব্দ শুনতে পেলো মেয়েটি।
আপনি অযথা এ লোকটির পিছনে সময় নষ্ট করছেন।’আশী বললো। তার সামনে সুদানী সামরিক বাহিনীর ঊর্ধতন অফিসার বসেছিল। আশী তাকে বললো, ‘এ লোকটির মধ্যে কামনা বাসনা বলে কিছু নেই। আপনি তো জানেন, কঠিন পাথরকে গলিয়ে মোম বানাতে আমার জুড়ি নেই। কিন্তু এমন লোক আমি জীবনেও কোথাও দেখিনি।’
‘আমার মনে হয়, তুমি কোথাও কোন ভুল করে ফেলেছো।’অফিসার বললো।
মেয়েটি ইসহাককে আকৃষ্ট করতে যে সব কথা বলেছিল সবই অফিসারের সামনে খুলে বললো। বললো, ‘আমার কথা শুনে লোকটি শুধু ব্যঙ্গের হাসি হেসেছে। শুয়ে কথা বলা শুরু করার কিছুক্ষণ পরই সে ঘুমিয়ে গেছে।’
চার পাঁচ দিন পর সুদানী সেনাপতি আবার ইসহাকের সাথে দেখা করে। সে ইসহাককে তার কথার মধ্যে আনার জন্য হেন চেষ্টা নেই, যা করেনি। রাতের শেষ প্রহর পর্যন্ত কথার জাদু প্রয়োগ করেও ব্যর্থ হয় সে। ইসহাক তার কথার জবাবে বার বার শুধু বলছিল, ‘আমি মিশরের সেনাবাহিনীর একজন অফিসার! এখন আমি তোমাদের কয়েদী। আমাকে যত খুশী শাস্তি দাও, কিন্তু আমি আমার ঈমান বিক্রি করতে পারবো না।’অবশেষে তাকে সে মহল থেকে বের করে কয়েদখানায় নিয়ে বন্দী করে রাখা হলো। লোহার শিকওয়ালা দরোজার সাথে তালা লাগিয়ে চলে গেল প্রহরী। কয়েদখানার কামরা দুর্গন্ধে ভরা। সে দুর্গন্ধে ইসহাকের দম বন্ধ হয়ে এলো।
তখনো রাত শেষ হয়নি। এক সিপাহী বাতি নিয়ে এলো। সে শিকের ফাঁক দিয়ে ইসহাকের হাতে বাতি দিল। ইসহাক বাতি নিয়ে বিছানার ওপর যখন বসলো, দেখলো কামরার মধ্যে একটি লাশ পড়ে আছে। সে পঁচা লাশের দুর্গন্ধই এতক্ষণ তাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। লাশের মুখ খোলা, চোখও খোলা। লাশটা ফুলে উঠেছে। ইসহাক কারাগারের সিপাইকে ডাকলো। তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এ লাশটা কার?’
‘তোমাদেরই কোন সাথীর লাশ হবে।’সিপাহী উত্তর দিলো, ‘কোন মিশরী সৈন্য যুদ্ধবন্দী হয়ে ধরা পড়েছিল। কঠিন শাস্তি দেয়ার পর সইতে না পেরে পাঁচ-ছয় দিন হয় কুঠরীতে মরে পড়ে আছে।’
‘লাম এখানে ফেলে রেখেছো কেন?’ইসহাক জিজ্ঞেস করলো।
‘তোমার জন্য!’সিপাহী ব্যঙ্গ করে বললো, ‘একে উঠিয়ে নিলে তুমি একা হয়ে যাবে।’সিপাহী হাসতে হাসতে চলে গেল।
ইসহাক বাতি নিয়ে লাশের কাছে এগিয়ে গেলো। বাতি উপরে তুলে লাশের মুখে আলো ফেললো। পোশাক দেখেই চিনতে পারলো, ঠিকই, এ এক মিশরী সৈন্যের লাশ। ইসহাক এতক্ষণ যে দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, সে দুর্গন্ধের অনুভূতি তার দূর হয়ে গেল। লাশের পচনে পোকা কিলবিল করছিল। ইসহাক তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বন্ধু, তোমার দেহ হয়তো পঁচে গলে নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তোমার আত্মা বেহেশতের পুস্পিত বাগানে বেঁচে থাকবে চিরদিন। আল্লাহর পথে যে ব্যক্তি জীবন দেয়, মৃত্যু তাকে কখনো স্পর্শ করতে পারে না। তুমি সৌভাগ্যবান! তুমি মহীয়ান, গরীয়ান! আমাদের চেয়ে অনেক বেশী শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাবান তুমি! তুমি জীবিত এবং চিরকাল তুমি বেঁচেই থাকবে। সিপাহী ঠিকই বলে গেছে, তুমি না থকালে আমি একা হয়ে যেতাম। এখন আমি আর একা নই। চিরঞ্জীব এক বন্ধু এখন শুয়ে আছে আমার পাশে।’
সে অনেকক্ষণ লাশের পাশে বসে বসে কথা বললো। যেন দুই বন্ধু গল্প করছে। গল্প করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টের পায়নি। সকালে এক প্রহরী এসে তাকে জাগালো।
ঘুম থেকে জেগেই সে দেখলো, সেই সুদানী সেনাপতি দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। তাকে জেগে উঠতে দেখে সেনাপতি বললো, ‘কোন কিছুর প্রয়োজন হলে বলবেন। আমার প্রহরীরা আপনার দিকে বিশেষ নজর রাখবে।’
‘আমি পরাজিত ও বন্দী বলে তুমি ইচ্ছে মত আমাকে গাল দিতে পারো। যত খুশী ব্যঙ্গ ও উপহাস করতে পারো।’ইসহাক বললো, ‘আর যদি আমার কোন প্রয়োজন পূরণ করতে চাও, তবে যুদ্ধের ময়দান থেকে মিশরের একটি পতাকা এনে দাও। আমি এ লাশটিকে সে পতাকা দিয়ে ঢেকে দিতে চাই।’
সেনাপতি হো হো করে হেসে বললো, ‘তোমাদের পতাকা কি আমরা বুকে বসে আছি? আমরা মিশরের পতাকা স্পর্শ করতেও দ্বিধাবোদ করি।’তারপর প্রহরীর দিকে ফিরে বললো, ‘একে এখান থেকে বের করে নিচে নিয়ে যাও। লাশ এখানেই পড়ে থাক।’
ইসহাককে কারাগারের অন্ধকার পাতাল কুঠরীতে নিয়ে গেল।
সেখানেও পড়ে ছিল অসংখ্য লাশ। বিশ্রী দুর্গন্ধে বাতাস গুমোট। সুদানী সেনাপতি নাকে রুমাল চেপে আগে আগে যাচ্ছিল। এক জায়গায় ছয় সাতজন মিশরী কয়েদীকে উল্টো করে বেঁধে লটকে রাখা হয়েছিল। তাদের বাহুর সাথে বাঁধা ছিল ভারী পাথর। আরেকটু এগুতেই দেখতে পেল, একজন মিশরীকে ক্রশ বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে। তার হাতের পাঞ্জা পেরেক দিয়ে গেঁথে রেখেছে দেয়ালের সাথে। তখনো রক্ত ঝরছে সে হাত থেকে!
আর এক জায়গায় টেবিলের ওপর এক কয়েদীকে দেখতে পেলো। কয়েদীকে পিঠমোড়া করে বাঁধা হয়েছে টেবিলের সাথে। পাঁয়ের সাথে শিকল বাঁধা। টেবিলের সাথে লাগানো বিশাল চাকা। চাকা যখন ঘুরাতো তখন সে লোকের হাত ও পায়ে এমন টান পড়তো যে, তা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হতো। মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করতো কয়েদী।
ইসহাককে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানো হলো জেলখানা। কোথায় কেমন শাস্তি দেয়া হচ্ছে সব দেখলো ইসহাক। স্থানে স্থানে রক্ত জমা হয়ে আছে। কোথাও কয়েদীরা বমি করছে। কোথাও বেহুশ হয়ে পড়ে আছে কেউ। শাস্তির বিচিত্র রূপ দেখিয়ে সুদানী সেনাপতি বললো, ‘আপনার কোন শাস্তি প্রয়োজন তা বলে দেবেন, আমি সেখানেই নিয়ে যাব আপনাকে। আর যদি আপনি এ শাস্তি ছাড়াই আমার কথা মেনে নেন, তবে তাতে আপনারই মঙ্গল হবে।’
‘যেখানে খুশী সেখানে নিয়ে যাও, জাতির সাথে বেঈমানী ও গাদ্দারী করতে পারবো না আমি।’ইসহাক দৃঢ়তার সাথে বললো।
‘আমি তোমাকে আবারও বলছি, আমরা তোমাকে দিয়ে যা করাতে চাই, তার বিনিময়ে তোমাকে আমরা মুক্তই করবো না, পাহাড়ী এলাকার সুলতানও বানিয়ে দেবো। কিন্তু তুমি আমাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছো। এখন শুধু এই শর্ত দিতে পারি, যদি মেনে নাও তবে তোমাকে কোন শাস্তি দেয়া হবে না। তোমাকে সুদানী বাহিনীর কোন ভাল পদে নিয়ে নেয়া হবে।’
‘আমি তোমাদের কোন পদ চাই না, আমাকে যা খুশী শাস্তি দাও।’ইসহাক বললো।
তার পায়ে শিকল বেঁধে ছাদের সাথে সে শিকল আটকে দেয়া হলো। উল্টো হয়ে শূন্যে ঝুলে রইল ইসহাক। সেনাপতি প্রহরীকে বললো, ‘সন্ধ্যা পর্যন্ত এভাবেই রাখবে। সন্ধ্যার পর উপরের ওই লাশের কামরায় ফেলে রেখে আসবে। আশা করা যায়, এতেই তার মাথা ঠিক হয়ে যাবে।’