চিঠি খুলে চোখের সামনে মেলে ধরলেন আইয়ুবী। তাতে লিখা ছিল:
প্রিয় ভাই সালাহউদ্দিন আইয়ুবী! আল্লাহ তোমার ও তোমার বাহিনীর সকলের মদদ দান করুন। যদি আমার স্বামী বেঁচে থাকতেন, তবে বিশাল শত্রুর মোকাবেলায় নিশ্চয়ই এত অল্প সৈন্য নিয়ে তোমাকে ময়দানে এগিয়ে যেতে হতো না। তোমর সাহায্যে অবশ্যই তিনি সেনা সাহায্য পাঠাতেন। আমি তোমাকে তেমন কোন সাহায্য পাঠাতে পারছি না। তবে তোমার স্বান্তনার জন্য বলি, এখানে আমি বসে নেই। এ মুহূর্তে আমার দ্বারা যতটুকু সম্ভব হলো তা পাঠিয়ে দিলাম। এ মেয়েদেরকে আমি আহতদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরানো ও তাদের ক্ষতস্থানে ব্যাণ্ডেজ করার প্রশিক্ষণ দিয়েছি। ওদের সাথে ঔষধ এবং ব্যান্ডেজের সামগ্রীও পাঠিয়েছি। ওদের সাথে রয়েছে একশ স্বেচ্ছাসেবী পুরুষ সেনা। অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকরা ওদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এরা সকলেই রাতের অতর্কিত আক্রমণের ট্রেনিং পেয়েছে। এদের মধ্যে উৎসাহ ও উদ্দীপনার কোন অভাব নেই। তবে একটু বেশী আবেগপ্রবণ।
আমি জানি, তুমি মেয়েদেরকে যুদ্ধের ময়দানে রাখতে মোটেই পছন্দ করবে না। আমি তোমার এ মনোভাব জানার পরও বলছি, যদি এদের তুমি দামেশকে ফেরত পাঠাও, তবে দামেশকের জনসাধারণ খুবই কষ্ট পাবে। তাদের উৎসাহ ও মনোবল ভেঙ্গে যাবে। তুমি জানো না, দামেশকে এখন মানুষের মনে কি প্রচণ্ড জযবা বিরাজ করছে। সমস্ত পুরুষরাই এখন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য উন্মুখ। মেয়েরাও তোমার নেতৃত্বে যুদ্ধ করতে আগ্রহী। এ বাহিনীকে শহরের সর্বস্তরের জনতা তাদের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা দিয়ে তোমার কাছে পাঠিয়েছে। এখানে এখন শিশুরাও যুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছে। এ চেতনা অটুট থাকলে জেহাদের ময়দানে তোমার সৈন্যদের কোন ঘাটতি হবে না ইনশাআল্লাহ।’
–ইতি তোমার বিধবা বোন।
চিঠি পড়ে সুলতান আইয়ুবী আবগে অভভুত হয়ে পড়লেন। তাঁর চোখ ভরে উঠল আনন্দশ্রুতে। তিনি মেয়েদের দিকে ফিরে তাকালেন। অশ্বপৃষ্ঠে তাদেরকে দেখাচ্ছিল বীর যোদ্ধার মত। সুলতান আইয়ুবীর আদেশ মেয়েরা অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তিনি তাদের বললেন, ‘আমি তোমাদের সবাইকে যুদ্ধের ময়দানে খোশ আমদেদ জানাচ্ছি। দেশ ও জাতির খেদমতে তোমরা যে আবেগ ও প্রেরণা নিয়ে এসেছো, তার মূল্য আমি দিতে পারবো না, তার প্রতিদান আল্লাহই তোমাদের দেবেন। আমি কোন দিন চিন্তাও করিনি, মেয়েদেরকে আমি যুদ্ধ ক্ষেত্রে আহবান জানাবো। আমার বড় সংকোচ ও লজ্জা হয়, ইতিহাস হয়ত বলবে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর নারী সমাজকে নামিয়ে দিয়েছিলেন। আমি তোমাদের আশাকে আহত করবো না। তবে রনাঙ্গণে রাখার আগে আমি তোমাদের সুযোগ দিচ্ছি, তোমরা আবারো চিন্তা করো, যারা এখানে আবেগের বশে চলে এসেছো, তারা পৃথক হয়ে যাও নিজ নিজ সারি থেকে। আর তারাও সরে দাঁড়াও, যাদের মনে সামান্যতম ভয় এবং দ্বিধা রয়ে গেছে।’
কিন্তু একটি মেয়েও সারি থেকে সরে দাঁড়ালো না। সুলতান আইয়ুবী তখন তাদেরকে বললেন, ‘যদি তোমরা যুদ্ধই করতে চাও, তবে শুনে নাও যুদ্ধের নিয়ম। নেতার নির্দেশের বাইরে কেউ এক পা-ও এগুবে না। নির্দেশ পেলে কেউ তা পালন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাও করবে না। কোন নির্দেশ তোমার পছন্দ হোক আর না হোক বিনা প্রশ্নে তা মান্য করবে। এবার যুদ্ধে তোমদের অবস্থান জেনে নাও। আমি তোমাদেরকে তুলনামূলক নিরাপদ স্থানে থাকতে নির্দেশ দিচ্ছি। যুদ্ধের সময় পুরুষদের অতিক্রম করে কেউ সামনে যাবে না। এবার যুদ্ধের অবস্থা বর্ণনা করছি। যুদ্ধের সময় এ অঞ্চল শত্রুর কবলে পড়তে পারে। হয়ত তীরের আঘাতে তোমরা কেউ মারা যেতে পারো। লড়াইতে শরীক হওয়ার আগে তোমাদের জানা দরকার, বর্শা ও তলোয়ারের আঘাত বড় কঠিন ও বেদনাদায়ক। এবার বলো, কে কে এ যুদ্ধে অংশ নিতে চাও।’একটি মেয়ে হাত উপরে তুলে উচ্চ স্বরে বললো, ‘আপনি ইতিহাসের কথা বলেছেন। আমরাও ইতিহাসকে ভয় পাই। যদি আমরা আজ এখান থেকে ফিরে যাই, ইতিহাস বলবে, জাতির কন্যারা তাদের নেতা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে রণাঙ্গণে ফেলে রেখে নিজেরা ভয়ে ঘরের কোণে ফিরে গিয়েছিল। এ অপবাদ আমরা কেউ মাথা পেতে নিতে পারি না।’
অন্য এক মেয়ে বললো, ‘আল্লাহ সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বাহুতে অনেক শক্তি দান করেছেন। কিন্তু আমাদেরকে তিনি পঙ্গু করে পাঠাননি যে, জাতির দুর্দিনে শুধু গৃহকোণে বসে অশ্রু বিসর্জন করবো।’
আরেক মেয়ে কিছু বলার জন্য হাত তুলল। সুলতান বললেন, ‘বলো, তুমি কি বলতে চাও।’
‘মাননীয় সুলতান! তিন মাস আগে আমার বিয়ে হয়েছে। আমি আমার স্বামীর অনুমতি নিয়েই এখানে এসেছি। আমি আপনাকে বলতে চাই, আমাকে যুদ্ধের সুযোগ না দিলে আমি আর কোনদিন আমার স্বামীর ঘরে ফিরে যাবো না।’
‘তোমার স্বামী নিজে যুদ্ধে না এসে তোমাকে পাঠাল কেন?’সুলতান আইয়ুবী প্রশ্ন করলেন, ‘সে কেমন স্বামী, যে তার নববধূকে যুদ্ধে পাঠিয়ে দিল?’
‘সুলতান! সে তো অনেক আগেই আপনার বাহিনীতে শামিল হয়ে আছে!’মেয়েটি উত্তর দিল।
এ মেয়ে থামতেই সমস্ত মেয়ে সমস্বরে চিৎকার শুরু করে দিল, ‘সুলতান! আপনি আমাদের সুযোগ দিন। আমরা আপনাকে নিরাশ করবো না।’
সুলতান হাত তুলে ওদের থামতে ইশারা করলেন। থেমে গেল মেয়েদের কলরব। সুলতান বললেন, ‘যুদ্ধের ময়দানে তোমাদেরকে পুরুষদের আগে এগিয়ে দেবো, এমন চিন্তা কারো থাকলে সে কথা ভুলে যাও। তোমাদের জন্য ছোট ছোট গ্রুপ করে দিচ্ছি। প্রত্যেকেই নিজ নিজ গ্রুপ লিডারের নির্দেশ মত চলবে। সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের কঠোর শাস্তি দেয়া হয়। তোমাদের কারো বিরুদ্ধে যেন শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ শুনতে না হয়।’
তিনি সে দিনই মেয়েদেরকে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে দিলেন। প্রত্যেক গ্রুপের সাথে দিলেন দু’জন করে পুরুষ স্বেচ্ছাসেবক। এসব স্বেচ্ছাসেবকরা সবাই ছিল সামরিক ট্রেনিং প্রাপ্ত। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী তাদেরকে যথারীতি আহতদের সেবা কাজে নিয়োগ করলেন। কারণ তারা সামরিক প্রশিক্ষণ পেলেও নিয়মিত সৈনিক ছিল না।
মেয়েদের ক্যাম্প পুরুষদের তাঁবু থেকে দূরে পর্বতের এক নিরাপদ স্থানে স্থাপন করা হলো। যারা আহতদের রণাঙ্গণ থেকে সরিয়ে আনা ও চিকিৎসার কাজে নিয়োজিত ছিল, তাদের জায়গায় নিয়োগ দেয়া হলো এ স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীকে, আর ওদেরকে ফেরিয়ে নেয়া হলো মূল সেনাবাহিনীতে। এসব স্বেচ্ছাসেবী সৈনিক ও মেয়েদের আরও প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য কয়েকজন অভিজ্ঞ সালারদের দায়িত্ব দিলেন সুলতান।
ফাতেমা, মানসুরা, হুমায়রা ও সাহারা এক গ্রুপে পড়ল। তাদের এই এক গ্রুপে পড়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। তাদের পরস্পরের মধ্যে এরই মধ্যে গড়ে উঠেছিল গভীর সখ্যতা ও বন্ধুত্ব। তারা একসাথে দামেশকে পৌঁছে ছিল এবং একসাথেই ট্রেনিংও নিয়েছিল। জেহাদে শরীক হওয়ার ব্যাপারে ওদের মধ্যে কাজ করছিল একই রকম চিন্তা-চেতনা ও আশা-আকাঙ্খা। তাদের সাথে পুরুষ স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে যারা পড়ল তাদের একজনের নাম ছিল আজাদ বিন আব্বাস। দেখতে খুবই সুপুরুষ ও নওজোয়ান। মেয়েদের বড় তাঁবুর দু’পাশে ছোট দুই আলাদা তাঁবুতে পুরুষ স্বেচ্ছাসেবীদের থাকার ব্যবস্থা হলো। উদ্দেশ্য, মেয়েদের কিছু লাগলে যেন দ্রুত তা জানাতে পারে এবং একজন কোন কাজে দূরে গেলে অন্যজন যেন পাহারায় থাকতে পারে মেয়েদের বড় তাঁবুর। এই মেয়েদের মধ্যে খতিবের মেয়ে মানসুরা শারীরিক দিক থেকে ছিল যেমন নিখুঁত, তেমনি ছিল হুশিয়ার ও অসম্ভব বুদ্ধিমতি।
বিকেল বেলা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে প্রায়। মনসুরা দেখলো, তাদের সঙ্গী স্বেচ্ছাসেবক আজান বিন আব্বাস এক পাহাড়ী টিলায় উঠে দ্রুত সরে যাচ্ছে ক্যাম্প থেকে। সে যাচ্ছে আর এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছে, কেউ তাকে দেখতে পেলো কিনা! আজাদের এ সতর্কতা দৃষ্টি এড়াল না মানসুরার। তার মনে খটকা লাগলো। সন্দেহ হলো, সে এমন কিছু করছে যা অন্যকে দেখতে দিতে চায় না।
মানসুরা পিছু নিল তার। একটু পর সেও টিলার উপরে চলে এলো। দেখলো আজাদ তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। আজাদের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেও সেদিকে দৃষ্টি ফেললো। সামনে পাহাড়ের ঢালুতে দেখা যাচ্ছে অনেক সৈন্য। আজাদ মানসুরার উপস্থিতি টের পেয়ে তার দিকে ফিরে মিষ্টি করে হাসল। বললো, ‘তাকিয়ে দেখো, আমাদের মূল ফৌজ। চলো, আরেকটু এগিয়ে আরো কাছ থেকে তাদের দেখে আসি।’
সে হাঁটা ধরলে মানসুরাও তার সাথে চলতে লাগল। আজাদ গল্প জুড়ে দিল মানসুরার সাথে। আজাদ যেমন সুদর্শন ছিল, তেমনি ছিল বাকপটু। কথা দিয়ে মানুষের মন জয় করায় ওস্তাদ। তার প্রাণ চাঞ্চল্য ও আবেগঘন কথায় বেশ পুলক অনুভব করল মানসুরা। সেই মজে গেল কথামালার রাজ্যে। আজাদ এখানকার পাহাড়ী এলাকা ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠল।
সে মানসুরার সাথে দীলখোলা আলাপ করতে করতে বাহিনীর কাছে গিয়ে পৌঁছল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিল, মানসুরা বলল, ‘চলো ফিরে যাই।’
ফিরতি পথ ধরলো ওরা। আজাদের মুখে তখন কথায় খই ফুটেছে। মানসুরা যত তার কথা শুনছে, ততই মুগ্ধ ও তার প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলো। সূর্য ডোবার সময় তারা তাঁবুতে ফিরে এলো। ইতিমধ্যে আজাদ মানসুরার মন জয় করে নিয়েছে।
ইফতারীর পর মেয়েরা তাদের তাঁবুতে খানা খাচ্ছিল। একজন সেনা কমাণ্ডার তাঁবুর পর্দা ঈষৎ ফাঁক করে মেয়েদের জিজ্ঞেস করলো, কারো কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা। মেয়েরা জানাল, তারা সবাই শান্তি ও নিরাপদে আছে। কমাণ্ডার সরে গেল সেখান থেকে। আজাদ তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়েছিল। সে কমাণ্ডারকে সরে যেতে দেখে এগিয়ে গেল তার দিকে, তারপর তার সাথে আলাপ জুড়ে দিল। অনেকক্ষণ তারা তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বললো। মানসুরা কান খাঁড়া করে ওদের কথা মনযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করছিল। আজাদ কমাণ্ডারকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এত অল্প সৈন্য নিয়ে বিশাল তিনটি বাহিনীর সাথে কেমন করে আমরা মোকাবেলা করবো?’
‘এ নিয়ে তোমাদের কোন দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই। শত্রুদের জন্য ফাঁদ তৈরি করা আছে।’কমাণ্ডার বললো ‘যুদ্ধ শত্রুরা যেখানে আশা করছে সেখানে হবে না। আমরা তাদেরকে সেখানে টেনে নিয়ে আসব, যেখানে তাদের জন্য আমরা ফাঁদ তৈরী করে রেখেছি।’কমাণ্ডার আজাদের কথার ফাঁদে পড়ে সুলতান আইয়ুবীর সমস্ত প্ল্যানের কথা বলে দিল তাকে। তারা কিভাবে সৈন্য ভাগ করেছে, কিভাবে ফাঁদ পেতেছে সবই অবলীলায় ফাঁস করে দিল তার কাছে।
তাদের আলোচনা শুনে মানসুরার মনে সন্দেহ সৃষ্টি হল! আজাদকে দুশমনের গোয়েন্দা ভাবতে কষ্ট হলো তার, কিন্তু তার উদ্দেশ্য যে ভাল নয়, এটা সে ঠিকই বুঝতে পারল।
সে রাতেরই ঘটনা। রাত তখন দ্বি-প্রহর! ঘুমিয়ে পড়েছিল মানসুরা, কিন্তু কিভাবে যেন তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভাঙতেই তার মনে পড়ে গেল আজাদের কথা। হঠাৎ আজাদের তাঁবু থেকে অস্ফুট স্বরে কথার বলার শব্দ ভেসে এলো তার কানে। মানসুরা সম্পূর্ণ সতর্ক ও উৎকর্ণ হয়ে বিছানায় বসে পড়ল। সে শুনতে পেলো, কেউ বলছে, ‘তুমি এক্ষুণি বেরিয়ে যাও। যথেষ্ট তথ্য তুমি জেনেছ। আর আমিও যা জানি সব বলে দিয়েছি। আমার পক্ষে এখান থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। ভালই হলো, তুমি এসে গেছ। এখন জলদি কেটে পড়ো। তুমি পালিয়ে গেলে কেউ কিছু মনে করবে না, সবাই ভাববে, ভয় পেয়ে পালিয়েছো তুমি।’
‘ঠিক বলেছো তুমি।’
লোকটি আজাদকে কোন রাস্তা ধরে পালাবে তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বললো, ‘তোমাকে এখান থেকে পায়ে হেঁটেই যেতে হবে। তারপরও ভোর হওয়ার আগেই তুমি সেখানে পৌঁছে যেতে পারবে। একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছার চেষ্টা করো। হয়ত এমনও হতে পারে। এখানে ফাঁদ পাতা আছে, মজবুত ফাঁদ। তারা যেন কোন অবস্থাতেই পর্বতশৃঙ্গের মধ্যে না আসে। খোদা হাফেজ!’
লোকটির চলে যাওয়ার পদধ্বনি শুনতে পেল মানসুরা। লোকটি চলে যেতেই মানসুরা তাঁবুর পর্দা সরিয়ে বাইরে উঁকি দিলো। দেখলো, আজাদ তার তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পর আজাদ তাঁবুর মধ্যে ঢুকল এবং সঙ্গে সঙ্গেই আবার বাইরে বেরিয়ে এসে একদিকে হাঁটা ধরলো। সে যাত্রা শুরু করতেই তাঁবুর অন্য মেয়েদের না জানিয়ে মানসুরা তার বিছানার তলা থেকে খঞ্জর বের করে সঙ্গে সঙ্গে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এল এবং সন্তর্পনে তার পিছু নিল।
আকাশে হালকা মেঘ। সে কারণে চাঁদের আলো অস্পষ্ট। মানসুরা আজাদের অস্পষ্ট অবয়বকে অবলম্বন করে কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে তার পিছু পিছু চলতে লাগলো। আজাদ পাহাড়ের একটি টিলা পার হয়ে এক উপত্যকায় নেমে গেল। মানসুরাও তাকে অনুসরণ করে নেমে এল সেই উপত্যকায়।
পথে কোন প্রহরী চোখে পড়ল না মানসুরার। এতে মানসুরা বুঝে গেল, যে ব্যক্তি আজাদের কাছে এসেছিল সে তাকে এমন পথ বলে দিয়েছে, যাতে সে সৈন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে চলে যেতে পারে। মানসুরা কোন ডিউটিরত সৈনিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছিল। কিন্তু তার জানা ছিল না, এ পথে কোথায় সৈন্য আছে, বা আদৌ আছে কিনা? সে মনে মনে প্রার্থনা করছিল, যদি কোন টহল গ্রুপের সাক্ষাৎ পেতো, তবু এর একটি সুরাহা সে করতে পারতো। কিন্তু এ ব্যাপারেও তাকে নিরাশ হতে হলো।
পাহাড়ী রাস্তা ধরে এগিয়ে চললো ওরা। আগে আজাদ, পেছনে মানসুরা। আরেকটু এগিয়ে এক সংকীর্ণ গিরিপথ ধরলো আজাদ। মানসুরা একটু থমকে দাঁড়াল। গিরিপথে প্রবেশ করবে কিনা ভাবল মুহুর্তকাল, তারপর দ্বিধা কাটিয়ে সেও ঢুকে পড়ল সেই সংকীর্ণ পথে।
গিরিপথটি বেশী বড় ছিল না। অল্প সময়েই ওরা পেরিয়ে এল গিরিপথ।
সামনে খোলা প্রান্তর। সে প্রান্তরের এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোট বড় নানা আকারের গাছ। গাছের নিচে ঘন অন্ধকার।
আজাদ একটি গাছের আড়ালে অন্ধকারে গিয়ে থেমে গেল। মানসুরা চট করে লুকিয়ে পড়ল এক ঝোপের আড়ালে। আজাদ ডানে-বামে এবং পেছনে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল কেউ তাকে অনুসরণ করছে কিনা! কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে যখন সে নিশ্চিত হলো, কেউ তাকে অনুসরণ করছে না, তখন সে আবার চলতে শুরু করল। এভাবে একটু পর পরই গাছের আড়ালে গিয়ে আজাদ থেমে যেতো এবং পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখতো কেউ তাকে দেখছে কিনা। মানসুরাও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সাবধানে তাকে অনুসরণ করে যেতে লাগলো।
মেয়েদের তাঁবু থেকে অনেক দূর চলে এসেছিল ওরা সামনে আরেকটি পার্বত্য গিরিপথ। আজাদ সে গিরপথে প্রবেশ করল। পেছন পেছন ঢুকল মানসুরাও। প্রচণ্ড শীত। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, সেই সাথে বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে হচ্ছে তুষারপাত।
মানসুরার ঠাণ্ডা পা ঠকঠক করে কাঁপছিল। শরীরও কাঁপতে লাগলো শীতে। হঠাৎ কোন পাথরে হোঁচট খেল মানসুরা। আওয়াজ পেয়ে চট করে পেছনে তাকালো আজাদ। ধমকে দাড়িয়ে কোথায় আওয়াজ হলো বুঝতে চেষ্টা করলো। মানসুরা বড় এক পাথরের আড়ালে বসে পড়লো। সন্দেহজনক কিছু দেখতে না পেয়ে আজাদ আবার চলতে শুরু করলো। আজাদ বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে গেলে মানসুরা উঠে আবার তার পিছু নিল। গিরিপথ থেকে ওরা খোলামেলা এক উপত্যকায় বেরিয়ে এলো। উপত্যকাটি সবুজ ও সমতল। মসৃন মাটিতে পা পড়তেই আজাদ দ্রুত পা চালালো। মানসুরা তার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে ছুটতে শুরু করলো। কিন্তু সে তো এক নারী। প্রচণ্ড শীত আর এবড়ো থেবড়ো রাস্তায় দীর্ঘ পথ হেঁটে সে ক্লান্ত হয়ে পড়লো। আবেগের বশে সে আজাদের পিছু ধাওয়া করছিল, কিন্তু কিভাবে তার গতি রোধ করা যাবে, এর পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে, তখন সে চিন্তা তার মাথায় আসেনি। এখন যদি আজাদ দৌড় দেয় তবে সে তাকে আর অনুসরণ করতে পারবে না।
সে সন্দেহের বশে নয় বরং আজাদ শত্রুদের খবর দিতে যাচ্ছে এটা নিশ্চিত হয়েই তার পিছু নিয়েছিল। আশা ছিল, পথে কোন প্রহরীর সাহায্য পাবে। এখন সে আশা আর নেই। কি করে আজাদকে বাঁধা দেবে ভাবতে লাগল মানসুরা। চিন্তু করে দেখল তাদে যদি ধরতে হয় তবে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। মানসুরার সঙ্গে ধারালো খঞ্জর আছে। মুশালে থাকতে সে বাবার কাছে খঞ্জর ও তলোয়ার চালানোর প্রশিক্ষণও নিয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল শুধুমাত্র ট্রেনিং। শত্রুর সাথে কোন দিন তার মোকাবেলা হয়নি। এখন এই স্বাস্থ্যবান এক সুপুরুষ কমাণ্ডো সৈনিককে মানসুরা কিভাবে কাবু করবে? মোকাবেলা করতে গেলে যে নিজেরই ধরাশায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশী!
এসব চিন্তা করতে করতে অগ্রসর হচ্ছিল মানসুরা। আজাদ সহসা থেমে গেল এবং পিছন ফিরে তাকালো। মানসুরা এবারও দ্রুত এক গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে সমর্থ হলো। গাছের গোড়ায় অজস্র পাথর। মানসুরার পায়ের চাপে হঠাৎ সে পাথর পিছলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেল মানসুরা। রাতের নিস্তব্ধতায় সে পতনের শব্দ বেশ জোরালো হয়ে বাজল আজাদের কানে। আজাদ শব্দের উৎসের দিকে তাকালো। মানসুরা মাটিতে পড়ে ছিল, সুতরাং এবারও তাকে দেখতে পেলো না আজাদ। সে গাছের দিকে এগিয়ে এলো। মানসুরা মাটিতে শুয়ে থেকেই দেখতে পেলো আজাদ এগিয়ে আসছে। সে শক্ত হাতে খঞ্জর চেপে ধরে চুপচাপ সেভাবেই পড়ে রইল।
আজাদ গাছের কাছে এসে গেল। মানসুরা দেখলো, তার হাতে খোলা তলোয়ার। আজাদ তার পাশ কেটে এগিয়ে যাচ্ছিল, মানসুরা সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে তার পা জড়িয়ে ধরে জোরে টান দিল। আজাদ মুখ থুবড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। চোখের পলকে মানসুরা তার পিঠের ওপর চড়ে খঞ্জরের তিক্ষ্ম মাথা তার ঘাড়ে চেপে ধরল।
আজাদ তখনো জানে না কে তাকে আক্রমণ করেছে। সে শুধু অনুভব করলো, তার ঘাড়ের ওপর চেপে আছে ধারালো খঞ্জর। একটু নড়লেই তা ঢুকে যাবে তার শাহরগ ভেদ করে। তার তলোয়ার হাতের মুঠো থেকে ছিটকে দূরে কোথাও পড়ে আছে সে জানে না। আজাদ বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করলো না। চুপচাপ শুয়ে থেকে অস্ফুটস্বরে প্রশ্ন করল, ‘কে তুমি?’
‘তোমার যম। যার হাত থেকে তুমি জীবন নিয়ে পালাতে পারবে না।’
মানসুরার উত্তর শুনে আশার বিদ্যুৎ খেলে গেল তার মনে। বলল, ‘ও, তুমি এক নারী?’
‘হ্যাঁ! তুমি আমার কণ্ঠস্বর শুনেই তা বুঝতে পেরেছ।’মানসুরা বললো, ‘আর তুমি আমাকে ভাল করেই চেনো। আমি মানসুরা।’
‘ওরে ও পাগলী মেয়ে!’আজাদ একটু সাহস পেয়ে হেসে বললো, ‘তুমি একি খেলা শুরু করেছো? আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। সরো, উঠতে দাও। তোমার খঞ্জর আমর চামড়ায় বিঁধে যাচ্ছে, ওটা সরাও জলদি।’
‘এটা কোন খেল তামাশা নয়। আগে বলো তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?’
‘আল্লাহর কসক! আমি কোন মেয়ের পিছনে যাচ্ছি না।’আজাদ কৌতুকের স্বরে বললো, ‘তোমার চেয়ে সুন্দরী কি আর আছে? সত্যি বলছি, তোমাকে দেখার পর সব মেয়েই আমার কাছে কুৎসিত হয়ে গেছে। বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে প্রতারণা করিনি।’
‘আমাকে নয়, তুমি আমার জাতির সঙ্গে প্রতারণা করতে যাচ্ছো। সত্যি করে বল তো, তুমি আমার জাতির সাথে গাদ্দারী করতে যাচ্ছিলে না!’একটু দম নিল মানসুরা। তারপর গাঢ়স্বরে বললো, ‘তুমি আমাকে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী মনে করতে, আমিও তোমাকে সুন্দর সুপুরুষ ভেবেছিলাম। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন আমিও তোমার জন্য ভাল নই! আর তুমিও আমার কাছে ভাল মানুষ নেই। তুমি আমার স্বপ্ন ও আশাকে ধূলিস্মাৎ করতে তাঁবুর আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে এসেছো। হয়তো এটাই তোমার দায়িত্ব। তুমি যেমন তোমার কর্তব্য পালন করছো, আমি তেমনি আমার ফরজ পালন করছি। তুমি যদি আমার স্বামী হতে, আমার সন্তানদের বাবা হতে, তবুও আমার খঞ্জর তোমর গর্দান থেকে সরানোর কথা ভাবতাম না আমি।’
‘তুমি আমাকে কি মনে করে হত্যা করতে চাচ্ছো?’জিজ্ঞেস করলো আজাদ।
‘কিছু মনে করে নয়। সন্দেহের বশে আমি তোমার পিছু নেইনি। তুমি মুসলিম নামের কলঙ্ক। তুমি খৃষ্টান ও তাদের দোসর মুসলমানদের গোয়েন্দা।’মানসুরা বললো, ‘আমি জানি, তুমি তোমার বন্ধুদেরকে সাবধান করতে যাচ্ছিলে। তাদের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছিলে ইসলামী লশকরের গোপন তথ্য। বলতে যাচ্ছিলে, সাবধান! তোমরা আইয়ুবীর ফাঁদে পা দিও না। তাকে আক্রমণ করতে এসে তোমরা পর্বত-শৃঙ্গের ভেতর ঢুকে পড়ো না। ওখানে আইয়ুবী তোমাদের জন্য ভয়ঙ্কর ফাঁদ পেতে রেখেছে।’
‘গেঁয়ো মেয়ের মত কথা বলো না তো! গোয়েন্দা কাকে বলে তুমি জানো? আমি তো শত্রুদের অবস্থান দেখতে যাচ্ছিলাম যাতে যুদ্ধের সময় আমরা সহজে তাদের ওপর চড়াও হতে পারি!’
‘আমি খুব ভাল করেই জানি, গোয়েন্দা কাকে বলে।’মানসুরা বললো, ‘আমি এক জাদরেল গোয়েন্দার কন্যা। ইবনুল মাখদুম কাকবুরীর নাম কি কখনও শুনেছো? তিনি মুশালের মসজিদের খতিব ছিলেন। আমি তার কন্যা শুধু নই, তার দলের এক বিশ্বস্ত গোয়েন্দাও। আমি আমার বাবাকে কারাগারের গোপন কক্ষ থেকে উদ্ধার করে মুশাল থেকে পালিয়ে এসেছি। তুমি তো একদম আনাড়ী গোয়েন্দা! অভিজ্ঞ গোয়েন্দা কখনো কারো তাঁবুর পাশে দাঁড়িয়ে গোপন কথা বলে না।’
‘মানসুরা, আমার পিঠের ওপর থেকে নামো। আগে খঞ্জর সরাও, আমাকে কথা বলতে দাও। তুমি তো এখনও আসল কথাই শোননি। আমি কি জরুরী কথা বলি, আগে শোন।’
‘তোমার মুখ তা খোলাই আছে!’মানসুরা বললো, ‘বলো, তোমার জরুরী কথা বলো, আমি মনোযোগ দিয়েই শুনবো।’
আজাদ মানসুরার এ কথায় হতাশ হয়ে পড়ল। সে কি বলবে, কি করবে বুঝতে পারল না। কোন নারী এতটা দৃঢ়তার পরিচয় দেবে ভাবতে পারেনি সে। সে আর কোন কথা বললো না। তার শরীর অসাড় হয়ে পড়লো। সে আশাভঙ্গের বেদনায় নিজেকে মাটিতে এলিয়ে দিল।
মানসুরার সামনে এখন একটাই প্রশ্ন, কেমন করে তাকে বাঁধবে, কেমন করে সঙ্গে নিয়ে যাবে তাকে। যদি তাকে হত্যা করার প্রশ্ন হতো, তবে কোন অসুবিধা ছিল না তার। হাতে খঞ্জরে একটু চাপ দিয়েই এ গাদ্দারের ইহলীলা সাঙ্গ করে দিতে পারে সে। কিন্তু মানসুরার ইচ্ছে, তাকে সুলতান আইয়ুবীর কাছে জীবিত হাজির করা। গোয়েন্দা দলে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, গোয়েন্দাদের কাছে অনেক রকম তথ্য থাকে। ধরতে পারলে তাদের জীবিত রাখতে হয়।
মনে মনে মনসুরা আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। বলতে লাগলো, ‘হে আল্লাহ, তুমি আমাকে মদদ দাও। এ গাদ্দারকে যেন আমি সুলতান আইয়ুবীর হাতে তুলে দিতে পারি’, সে তৌফিক দাও আমাকে।’
সহসা তার মাথায় একটি বুদ্ধি এলো। সে চিন্তা করে দেখলো, সে যদি এখানে বসে চিৎকার করে তবে সে চিৎকার কারো না কারো কানে পৌঁছবেই। রাতে চিৎকারের আওয়াজ নিশ্চয়ই অনেক দূর পৌছে যাবে। যদি আশেপাশে কোথাও কোন সৈন্য বা প্রহরী থাকে, তবে তারা অবশ্যই তার সাহায্যে ছুটে আসবে। দুশমন এলাকা এখনো অনেক দূর। তার চিৎকার শুনে কেউ যদি এগিয়ে আসে তবে সে আইয়ুবীর সৈন্য ছাড়া আর কেউ হবে না।
মানসুরা সহসা সেই দুঃসাহসিক কাজটিই করে বসলো। সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো, ‘আশেপাশে কে কোথায় আছো, জলদি এসো-ও-ও! আমাকে বাঁচাও-ও-ও! জলদি এসো-ও-ও! আমাকে বাঁচাও-ও-ও……..’
আজাদ অসাড় হয়ে পড়েছিল মাটিতে। সমানে চিৎকার করে চলছিল মানসুরা। গর্দান থেকে সরে পড়েছিল খঞ্জর। মানসুরার এ অন্যমনস্কতার সুযোগ হঠাৎ জোরে মাটি থেকে লাফিয়ে উঠলো আজাদ। পিঠের ওপর থেকে ছিটকে পড়ে গেল মানসুরা। আজাদ উঠে তার তলোয়ারের দিকে ঝুঁকলো, মানসুরা চোখের পলকে উঠে বসে সর্বশক্তি দিয়ে আজাদের পিঠে ধাক্কা দিল। তলোয়ার আর তোলা হলো না তার, হাচড়ে পাঁচড়ে কোন রকমে উঠেই দে ছুট। অসহায়ের মত আজাদের ছুটন্ত অবয়বের দিকে মুহুর্তকাল তাকিয়ে রইল মানসুরা, তারপরই মনে হলো, ‘আরে! একটি করছি আমি? ও তো পালিয়ে যাচ্ছে!’
সাথে সাথেই মানসুরাও উঠে দাঁড়ালো এবং চিৎকার করতে করতে ছুটলো তার পিছনে। সে অনুভব করলো, তার পায়ে আবার ফিরে এসেছে পূর্ণ শক্তি।
রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে সে চিৎকারের শব্দ পাহাড়ে পাহাড়ে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলছিল। আইয়ুবীর নৈশ প্রহরীদের কানে পৌঁছল সে চিৎকারের শব্দ। প্রহরীরা অবাক হলো, এমন গভীর রাতে কোন মেয়ে আর্তনাদ করছে এ নির্জন পার্বত্য প্রান্তরে!
তারা যেদিক থেকে মানসুরার আর্তনাদ ভেসে আসছিল সে দিকে ছুটে গেলো। ছুটতে ছুটতে আজাদ এক পার্বত্য নদীর তীরে এসে পৌঁছল। সামনে নদী দেখে বাধ্য হয়ে থমকে দাঁড়ালো সে। মানসুরাও এসে পৌঁছল নদীর তীরে। ঠিক সেই মুহুর্তে দু’জন প্রহরী সেনা সেখানে এসে পৌঁছে গেলো। আজাদ নিরূপায় হয়ে ঝাঁপ দিল নদীতে। মানসুরা চিৎকার করে বললো, ‘ওকে যেতে দিওনা, ও এক গুপ্তচর, জ্যান্ত ধরে আনো ওকে।’
প্রহরীরা ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীতে। একটু পর ওরা আজাদকে ধরে নদীর তীরে তুলে আনলো। আজাদ ধস্তাধস্তিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাকে নদীর পাড়ে ঘাসের ওপর শুইয়ে রাখা হলো। এতক্ষণ প্রহরীরা ঘটনা প্রবাহের সাথে এমনভাবে জরিয়ে পড়েছিল যে, কোন কিছু খতিয়ে দেখার সুযোগ পায়নি। এবার সুস্থির হয়ে ওরা তাকালো যুবতীর দিকে। মানসুরা ধৃত যুবক আজাদের দিকে তাকিয়েছিল। আজাদ ও মানসুরাকে দেখে প্রহরীদের মনো হলো, হয়তো এটা প্রেমঘটিত কোন ব্যাপার স্যাপার হবে। কিন্তু এ মেয়ে যে বলছিল, ‘ও গুপ্তচর!’ঘটনা কি জানার জন্য ওরা মানসুরাকে প্রশ্ন করলো, ‘তুমি চিৎকার করছিলে কেন?’
মানসুরা এ প্রশ্নের উত্তরে সব ঘটনা ওদের খুলে বললো। ওরা কেমন করে এ যুদ্ধের ময়দানে পৌঁছেছে তার উল্লেখ করে বললো, ‘এ যুবক দামেশক থেকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এখানে এসেছিল। গ্রুপ বিভাজনের সময় সে আমাদের গ্রুপে পড়ে। কিন্তু তার চালচলন ও কথাবার্তায় আমার সন্দেহ হয়, সে দুশমনের গোয়েন্দা। কিন্তু এখন আমি সে সন্দেহের ঊর্ধ্বে উঠে গেছি। সে যে দুশমনের গোয়েন্দা এ ব্যাপারে এখন আমি নিশ্চিত। একে সুলতান আইয়ুবীর কাছে নিয়ে চলো।’
‘হ্যাঁ, চলো। সেখানে গেলেই বুঝা যাবে কে গুপ্তচর।’আজাদ বললো, ‘বন্ধুরা! তোমরা আমার কথা শোন! নারী যে এত ছলনাময়ী আগে জানতাম না। এ মেয়ে আমাকে ফাঁসানোর জন্য এমন জঘন্য পথ ধরবে ভাবিনি। গুপ্তচর আমি নই, এ মেয়ে। আমাকে নয়, তোমরা আগে ওকে বন্দী করো।’
এক প্রহরী বললো, ‘তোমাদের কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যুক আমরা জানি না। ঠিক আছে, আগে সুলতানের ওখানে চলো, সেখানে গিয়েই দেখবো, কে গুপ্তচর, তুমি, নাকি এই মেয়েটা?’
আজাদ টহলদার সেনাদের বললো, ‘আসলে আমরা কেউ গুপ্তচর নই। মানসুরা, যথেষ্ট হয়েছে। আমি তো বার বার বলছি, ওই মেয়েকে আমি ভালবাসি না। আমি তোমাকেই ভালবাসি। ও আমাদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটানোর জন্য তোমাকে মিথ্যে বলে বিভ্রান্ত করেছে। ঠিক আছে, আমি ওয়াদা করছি, আর কোনদিন তার সাথে আমি কথাও বলবো না। এবার ক্যাম্পে চলো।’
‘আজাদ! আর কতো ভণ্ডামী করবে? কবে তোমার কাছে আমি প্রেম নিবেদন করেছি যে, আমাকে তুমি তোমার প্রেমিক সাজিয়ে ওদের হাত থেকে নিস্তার পেতে চাইছো?’
টহল সৈনিক মানসুরার দিকে ফিরে বললো, ‘দেখো মেয়ে, আমাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করো না। সত্যি করে বলো, তোমরা কে? যদি দু’জন এদিকে বদমাইশী করতে এসে থাকো, তাও খুলে বলো। প্রেমিককে রাগের বশে গুপ্তচর হিসাবে ফাঁসিয়ে দিলে পরে কিন্তু এর জন্য পস্তাতে হবে।’
মানসুরা বললো, ‘তোমাদের সন্দেহ দূর করার জন্য এটুকু বলাই আশা করি যথেষ্ট হবে, আমি মুশালের খতীব ইবনে মাখদুমের কন্যা। বাবার কাছেই আমি গোয়েন্দাবৃত্তির ট্রেনিং পেয়েছি। নইলে ও যে গুপ্তচর তা হয়তো আমি টের পেতাম না। তোমরা আমাদের দু’জনকেই ধরে আইয়ুবীর দরবাকে পেশ করে দাও, তিনিই আসল সত্য উদঘাটন করবেন।’
মানসুরার কথা মুনে আজাদের সব আশা ভরসা ধুলিস্মাৎ হয়ে গেল। সে আবার লুকোচুরি বাদ দিয়ে স্বরূপে আবির্ভুত হলো। বললো, ‘বন্ধুরা, আমার একটি কথা শোন। তোমরা এখানে কত টাকা বেতন পাও? সামান্য ক’টা টাকা ও দুই বেলার রুটির জন্য তোমরা এখানে মরতে এসেছো। আমার সাথে চলো, আমি তোমাদের শাহজাদা বানিয়ে দেবো। এর চেয়ে সুন্দরী মেয়ের সাথে বিয়ে দেব তোমাদের। অর্থ-সম্পদে ধনী বানিয়ে দিব।’
প্রহরীরা হেসে বললো, ‘ঠিক আছে বন্ধু। তোমার প্রস্তাব খুবই লোভনীয়। পরে না হয় আমরা তোমার সাথেই যাবো, কিন্তু আগে একটু কষ্ট করো। চলো আমাদের সঙ্গে, আগে সুলতান আইয়ুবীর সাথে একটু দেখা করি।’
সুলতান আইয়ুবীর তাঁবুর পাশেই হাসান বিন আবদুল্লাহর তাঁবু। প্রহরীরা আজাদ ও মানসুরাকে তাদের কমাণ্ডারের কাছে নিয়ে গেল। ঘুমিয়ে ছিলেন কমাণ্ডার। তিনি তাদেরকে নিয়ে সে রাতেই হাসান বিন আবদুল্লাহর তাঁবুতে হাজির হলেন। হাসান বিন আবদুল্লাহকে জাগিয়ে তাঁর কাছে মানসুরা ও আজাদকে সমর্পণ করলেন।
মানসুরা হাসান বিন আবদুল্লাহকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললো। যখন মানসুরা তাকে পিছু ধাওয়া করার বর্ণনা শোনাচ্ছিল, হাসান তখন গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন মানসুরাকে। হঠাৎ তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার চেহারা আমার কাছে খুবই পরিচিত লাগছে। সম্ভবত তুমিই মুশাল থেকে পালিয়ে এসেছিলে, তোমার সাথে মুশালের খতিব ইবনুল মাখদুমও ছিলেন।’
‘আমি তারই একমাত্র কন্যা!’মানসুরা বললো।
‘তুমি আমাকে বিস্মিত ও হতবাক করে দিয়েছ!’হাসান বিন আবদুল্লাহ বললেন, ‘আমাদের মেয়েদের সাহস ও বীরত্বে আমরা সকলেই কমবেশী চমৎকৃত, কিন্তু গোয়েন্দাবৃত্তিতে কেউ এমন তীক্ষ্ণ সতর্কতা, বুদ্ধি ও মেধার পরিচয় দিতে পারে তা আমাদের জানা ছিল না।’
‘আমাকে আমার শ্রদ্ধেয় পিতা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।’মানসুরা বললো, ‘আমার কানে এমন দু’টি শব্দ এসেছিল, যা থেকে আমি বুঝে নিয়েছিলাম, ব্যাপারটা কি ঘটতে যাচ্ছে।’
আজাদের দেহ তল্লাশি চালিয়ে কিছু কাগজ পাওয়া গেলো। কাগজের ওপর হিম্মাত পর্বত শ্রেণীর একটি নিখুঁত নকশা এবং তাতে সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য বাহিনীর পজিশন সুন্দরভাবে চিহ্নিত ছিল। এতে স্পষ্ট বুঝা গেল, সুলতান আইয়ুবীর যুদ্ধের পূর্ণ প্ল্যান শত্রুদের হাতে চলে যাচ্ছিল।
হাসান বিন আবদুল্লাহ কাগজটি আজাদের সামনে মেলে ধরে বললেন, ‘এর পরেও কি কোন সন্দেহ থাকতে পারে, তুমি দুশমনের গোয়েন্দা নও? যদি তোমার কিছু বলার থাকে, বলে ফেলো। যদি নির্দোষ হও তবে আমার কাছে তার প্রমাণ পেশ করো। তুমি যে খৃষ্টান নও, মুসলমান –তাও তোমাকে প্রমাণ করতে হবে।’
‘আমি গোয়েন্দা নই, এ ব্যাপারে আমি হাজার বার আল্লাহর কসম খেতে পারি।’
হাসান বিন আবদুল্লাহ তার মুখের ওপর এমন জোরে ঘুঁষি মারলেন যে, আজাদ চিৎ হয়ে পড়ে গেল। হাসান বিন আবদুল্লাহ ধীর কিন্তু গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘কাফেরদের চর সেজে আবার আল্লাহর কসম খাওয়া! আমি এখন আর তোমার কাছে জানতে চাই না, তুমি গুপ্তচর কি না। আমি শুধু জানতে চাচ্ছি, এখানে তোমার কয়জন সঙ্গী সাথী আছে। তুমি যদি বাঁচতে চাও, তবে তাদের প্রত্যেকের নাম ঠিকানা বলে দাও। তারা কে কোথায় কি অবস্থায় আছে কোন রকম চালাকির আশ্রয় না নিয়ে তা পরিস্কার করে বলে দাও।’
‘আমি মুসলমান!’আজাদ অনুনয় করে বললো, ‘আমি সব কথাই বলে দেবো, আমাকে ক্ষমা করুন! আমি সুলতানের প্রথম সারিতে যুদ্ধ করবো।’
‘আগে আমার কথার জবাব দাও।’হাসান বিন আবদুল্লাহ বললেন, ‘কোন রকম শর্ত আরোপ না করে আমি যা জিজ্ঞেস করছি শুধু তার জবাব দাও।’