» » তুমুল লড়াই

বর্ণাকার

সুলতান আইয়ুবী প্রতি মুহূর্তেই সারা দেশের কোথায় কি ঘটছে সংবাদ পাচ্ছিলেন। জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর তৎপরতার খবর পেয়ে তিনি কেবল খুশীই হলেন না, নতুন আশা, উদ্দীপনা ও সাহসেও সঞ্জীবিত হলেন।

সুলতান আইয়ুবী দামেশক থেকে বের হবার পর এই মহীয়সী মহিলা নিজ উদ্যোগে একটি স্বেচ্ছাসেবক দল গড়ে তুলতে শুরু করেন। যুদ্ধের ময়দান থেকে আহত সৈনিকদের বের করে আনা, দ্রুত রক্ত বন্ধ করা, জখমে ঔষধ দিয়ে ব্যাণ্ডেজ করা, এসব ট্রেনিং দিতে শুরু করেন তাদের। সেই সাথে তিনি তাদেরকে তলোয়ার চালানো, বর্শা নিক্ষেপ ও তীরন্দাজীর প্রশিক্ষণও দিয়ে যাচ্ছেন। এ কাজে তিনি ব্যবহার করছেন অবসরপ্রাপ্ত পুরুষ সেনা অফিসারদের।

সুলতান আইয়ুবী যুদ্ধের ময়দানে নারীদের টেনে নেয়া পছন্দ করেন না, এ কথা তিনি জানতেন। মেয়েদেরকে সেনাবাহিনীতে পৃথক কোন বাহিনী হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করবেন আইয়ুবী, এমনটিও তিনি আশা করেননি। তারপরও তিনি মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছেন এক অন্তর্গত প্রেরণায়; যদি পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে যায়! যদি মেয়েদের সম্ভ্রম রক্ষায় নিজেদেরই এগিয়ে যেতে হয়!

জেহাদের জন্য মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করা এবং ট্রেনিং দেয়ার কাজ অব্যাহতভাবে চলতে লাগল। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, কাউকে এ কথা বলতে হয় না, তোমার মেয়েকে নার্সিং ও সামরিক ট্রেনিংয়ে পাঠাতে হবে। বরং লোকেরা স্বতঃস্ফুর্তভাবেই মেয়েদের ট্রেনিংয়ে পাঠিয়ে দেয়। দামেশকের পথে হাঁটতে গেলে দেখা যায়, দশ বারো বছরের কিশোরীরাও এখন কাঠের তলোয়ার বানিয়ে মাঠে মাঠে তলোয়ার ফাইট খেলে।

একদিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর কাছে এলো নতুন চারটি মেয়ে। সুলতান আইয়ুবীই ওদেরকে দামেশকে পাঠিয়েছেন। ওদের একজন হচ্ছে ফাতেমা, যাকে সুলতান আইয়ুবীর এক গোয়েন্দা গোমাস্তগীনের অন্দর মহল থেকে বের করে এনেছিল। দ্বিতীয় জন মুশালের খতিব ইবনুল মাখদুমের কন্যা মানসুরা সায়েকা-[তার বিস্তারিত পরিচয় পাবেন ক্রুসেড-১৩ পাপের ফল-এ]। আর অন্য দু’জন ছিল সেই মেয়ে, যাদেরকে হলব থেকে গুমাস্তগীনের কাছে উপহার স্বরূপ পাঠানো হয়েছিল এবং সেনাপতি শামস বখন ও শাদ বখত হারানোর কাজীকে হত্যা করে তাদের মুক্ত করে পাঠিয়ে দিয়েছিল আইয়ুবীর কাছে। এ দুজনের নাম ছিল হুমায়রা ও সাহারা।

এদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে সুলতান আইয়ুবীর কাছে পাঠানো হলে সুলতান তাদেরকে সেখান থেকে দামেশকে পাঠিয়ে দিলেন। এভাবেই অভিভাবকহীন এ চার মেয়ে ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছলো জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর কাছে।

যখন নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর হাতে ওদের তুলে দেয়া হলো, তখন দামেশকের মেয়েরা সেখানে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। ওরা দেখতে পেল, কেউ সেখানে অসি চালনা শিখছে, কেউ তলোয়ার চালাচ্ছে, কেউবা আবার আহত সৈনিককে কিভাবে দ্রুত ব্যাণ্ডেজ করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। মেয়েরা এসব দেখে উদ্দীপিত ও উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। আবেদনের সুরে বললো, ‘মোহতারেমা’, আমাদেরও আপনি এ প্রশিক্ষণার্থীদের দলে শামিল করে নিন।’

তিনি বললেন, ‘তোমাদের এ আশা অচিরেই পূরণ হবে। আমি তোমাদের নাম তালিকাভুক্ত করে নিচ্ছি। কিন্তু তার আগে তোমরা কে কোত্থেকে কিভাবে এখানে এলে সে কাহিনী শুনতে চাই।’

মেয়েরা প্রত্যেকেই জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর কাছে তাদের ঘটনার জীবন কাহিনী তুলে ধরলো। তিনি তন্ময় হয়ে তাদের কাহিনী শুনলেন এবং বললেন, ‘তোমাদের জীবন কাহিনী তো বড়ই বৈচিত্রময়! এ কাহিনী সবারই জানা দরকার।’

তিনি তাদেরকে প্রশিক্ষণরত মেয়েদের কাছে নিয়ে গেলেন। সেখানে আবার তারা উপস্থিত মেয়েদের সামনে তাদের জীবনের ইতিহাস তুলে ধরলো। তাদের শোনালো, শত্রুরা তাদের ওপর কি কি নির্যাতন করেছে। খতিবের মেয়ে মানসুরা ছিল শিক্ষিত ও যথেষ্ট বুদ্ধিমতি। সে মেয়েদের বললো, ‘মেয়েদের বড় সম্পদ তার সম্ভ্রম। শত্রু যখন কোন দেশ বা শহরের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে, তখন বিজয়ী সেনা বাহিনীর হাতে প্রথমেই ধরাশায়ী হয় নারী জাতি। দীর্ঘদিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এসব সৈন্যদের লোলুপ দৃষ্টি গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মেয়েদের ওপর। তখন ওরা আর মানুষ থাকে না, হয়ে যায় বন্য পশুরও অধম। তোমরা হুমায়রা ও সাহারার কাছ থেকে শুনতে পেয়েছ, যে অঞ্চলে খৃষ্টানদের আধিপত্য রয়েছে, সেখানে খৃষ্টানরা মুসলমান নারীদের ওপর কি ভয়াবহ নির্যাতন চালাচ্ছে। সেখানে কোন মুসলমান মেয়েরা সম্ভ্রমই নিরাপদ নয়। আল্লাহ না করুক, যদি কোন দিন দামেশকেও খৃষ্টানদের আধিপত্য বিস্তার হয়, তবে তোমাদের অবস্থাও হবে সেইসব নির্যাতীতা বোনদের মত। যদি আজ আমরা দেশ ও জাতির জন্য কোরবানী দিতে এগিয়ে না আসি, তবে পরিস্থিতি আমাদেরকে একদিন এমন কোরবানী দিতে বাধ্য করবে, যার কথা কল্পনা করতেও আমার গা শিউরে ওঠে। খৃষ্টানরা আমাদের পুরুষদের বানাবে তাদের গোলাম আর আমাদের বানাবে তাদের দাসী। তোমরা হয়তো জানো, তারা আমাদের অনেক ওমরাকে ক্রয় করে নিয়েছে। ফলে এখন খৃষ্টানরা যেমন আমাদের শত্রু, তেমনি শত্রু খৃষ্টানদের দোসর মুসলমানরাও। যদি আমরা বিজয় লাভ করতে চাই, তবে প্রতি মুহূর্তে শত্রু-মিত্র সম্পর্কে আমাদের থাকতে হবে সতর্ক সজাগ। জেহাদের প্রেরণায় সব সময় আমাদের থাকতে হবে উজ্জীবিত। আমার শ্রদ্ধেয় পিতা বলেন, যে জাতি সেই সন্তানদের ভুলে যায়, যারা বিজাতি ও কাফেরদের বর্বরতার শিকার হয়েছে, সে জাতি বেশী দিন টিকে থাকতে পারে না।

প্রিয় বোনেরা! আমরা সম্মানিত সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর পতাকাতলে সমাবেত হয়েছি নিজেদের দ্বীন ও ঈমানকে হেফাজত করার জন্য। দ্বীনের কারণেই আজ আমরা তার অনুসারী! তিনি যদি দ্বীনের জন্য তাঁর জীবনকে বাজি রাখতে পারেন, তবে আমরা কেন পারবো না? তিনি যদি শাহাদাতের গৌরব অর্জনের জন্য নিজেকে পেশ করতে পারেন আল্লাহর দরবারে, তবে আমাদেরকে কেন তিনি সে গৌরবের হিস্যা থেকে বঞ্চিত করবেন? তিনি আমাদের নেতা, তাঁর হুকুমে আমরা আগুনে ঝাঁপ দিতে পারি, ফাঁসিতে ঝুলতে পারি, কিন্তু জেহাদের ময়দান থেকে সরে দাঁড়াতে পারি না। তাঁর এ নিয়ম আমরা মানতে রাজী নই যে, নারীরা যুদ্ধের ময়দানে যেতে পারবে না। নারীদেরকে এত দুর্বল মনে করা উচিত নয়। আজো যুবতী ও সুন্দরী মেয়েদেরকে ধনী ও আমীরদের মহলের সৌন্দর্য বাড়াতে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। আমাদেরকে পুরুষের ভোগের সামগ্রী বানানো হচ্ছে। এতে জাতির অর্ধেক শক্তি দুর্বল ও বেকার হয়ে যাচ্ছে। শত্রুরা যে সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসেছে, তার তুলনায় আমাদের সৈন্য অর্ধেকও নয়। আমরা পুরুষের পাশাপাশি যুদ্ধ করবো এবং পুরুষ সৈন্যের ঘাটতি পূরণ করবো। আমরা মুশালে গোয়েন্দাদের সঙ্গে ছিলাম, সেখানে আমরা যুদ্ধ করে এসেছি। পরিস্থিতির কারণে আমরা সেখান থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি। আমার আব্বা আবেগের অতিশয্যে মুশালের আমীরের কাছে দ্বিধাহীন চিত্তে তার মতামত ও সত্যকে ব্যক্ত করে ফেলেছিলেন। এর মাধ্যমে তার ঈমানের দৃঢ়তা প্রকাশ পেলেও হয়তো এটা ছিল হেকমতের খেলাফ। যদি তিনি সেখানে গ্রেফতার না হতেন তবে আমাদের প্ল্যান হতো অন্য রকম। আমরা আমাদের আরাধ্য কাজ সমাধা না করেই সেখান থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি।

আমার কথায় তোমাদের মনে হতে পারে, সুলতান আইয়ুবী দ্বীন কায়েমের সংগ্রামে মেয়েদের অংশ গ্রহণের বিরোধী। কিন্তু এ ধারণা সঠিক নয়। এটা সঠিক হলে তিনি মোহতারেমা জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর তত্বাবধানে এই যে প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চলছে, তা বন্ধ করে দিতেন! মুশালে আমরা যে তৎপরতা চালাচ্ছিলাম, তাও নিষিদ্ধ করতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। এই ব্যাপকতর সংঘাত, সংঘর্ষ ও যুদ্ধেল নেতা হিসাবে তিনি যা চিন্তা করেছেন, ঠিকই করেছেন। তিনি চান, আমরা যেন আগে আমাদের স্বামী, ভাই ও সন্তানদের জেহাদের ময়দানে পাঠিয়ে দেই। জাতির যেসব সন্তান গাদ্দার হয়ে গেছে তাদেরকে যেন গাদ্দারীর পথ থেকে ফিরিয়ে আনি। জাতির মধ্যে যেন জাগরণ ও প্রাণস্পন্দন জাগিয়ে তুলি। আর সব সময় যেন চোখ-কান খোলা রেখে পাহারা দেই পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে। তিনি আমাদের সামরিক প্রশিক্ষণ অনুমোদন করে এ কথাও বুঝাতে চান আমাদের, সময় যদি কখনো নারীদের খুন দাবী করে ইসলামের জন্য, তিনি সে দাবী অগ্রাহ্য করবেন না। তাই সময় আমাদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেয়ার দাবী জানাচ্ছে। তিনি যখন সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার জন্য আমাদের ডাক দেবেন, তখন যেন আমরা তাদের বোঝা হয়ে না যাই। অদক্ষতা ও অযোগ্যতার অভিযোগ যেন আমাদের বিরুদ্ধে না উঠতে পারে সে জন্য পর্যাপ্ত ট্রেনিং দরকার আমাদের। আমাদের যোগ্যতাই বলে দেবে জেহাদের এ পর্যায়ে কোন ভূমিকা আমাকে পালন করতে হবে।’

সায়েকার এ ভাষণ এবং অন্য তিনজনের জীবন কাহিনী শুনে উপস্থিত মেয়েদের প্রাণে নবতরঙ্গের হিল্লোল বয়ে গেলো। জেহাদী জযবা ও জোশে উদ্দীপিত হয়ে উঠলো প্রতিটি অন্তর। চারশ মেয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল ওখানে। কয়েকদিন পরই তাদের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হলো। ময়দানে যাওয়ার জন্য প্রতিটি মেয়েই ছিল বলতে গেলে এক পায়ে খাঁড়া। তাদের আগ্রহ জযবা দেখে জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী তাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে সুলতান আইয়ুবীর কাছে পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

নবাগত এ চার মেয়ে মাত্র কয়েক দিন হয় প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেছে। তখনো তাদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়নি, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়েদের সাথে তারাও যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলো। কিন্তু তাদেরকে ট্রেনিং শেষ করার তাগিদ দিয়ে বলা হলো, ‘আগে ট্রেনিং শেষ করো, এরপর নিশ্চয় তোমাদের আশা পূরণ করা হবে।’

কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য ওরা জেদ ধরে বসলো। বললো, ‘আমাদের আপনি ময়দানে পাঠিয়ে দেখুন, আমরা আপনাকে নিরাশ করবো না। এখানকার প্রশিক্ষণ হয়তো আমাদের পূর্ণ হয়নি, কিন্তু জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের যে ট্রেনিং দিয়েছে, তার কোন তুলনা হয় না।’কিন্ত এবারও তাদের আবেদন অগ্রাহ্য হলো।

তাদের মনের মধ্যে তখন ধিকিধিকি জ্বলছিল অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার অসহ্য যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণার কথা স্মরণ হতেই মনের ভেতর প্রতিশোধের স্পৃহা জেগে উঠলো। কিন্তু যুদ্ধে যাবার অনুমতি না পাওয়ায় তার সাথে শামিল হলো অক্ষমতার খেদ। ফাতেমা, হুমায়রা ও সাহারা তিনজনই মনের দুঃখে কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে যখন তারা চোখ ফুলিয়ে ফেললো তখন মায়া হলো মরহুম জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর, তিনি দয়পরবশ হয়ে চারশ নারী স্বেচ্ছা বাহিনীর সাথে এ চারজনকেও যুক্ত করে দিলেন। তাদের সাথে রওনা হলো একশো সুশিক্ষিত পুরুষ স্বেচ্ছাসেবক। এ স্বেচ্ছাবাহিনীর কমাণ্ডারের দায়িত্বে নিয়োজিত হলো হাজ্জাজ আবু ওয়াক্কাস।

জঙ্গীর মহিয়সী বিধবা পত্নী হাজ্জাজ আবু ওয়াক্কাসকে একটি লিখিত চিঠি দিয়ে বললেন, ‘এ চিঠি ভাই সালাহউদ্দিনকে দেবে। আমি সবকিছু চিঠিতেই বলে দিয়েছি। তুমি তাঁকে বলবে, এ মেয়েদেরকে যুদ্ধে আহত সৈন্যদের সেবা ও চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। এ মেয়ে ও পুরুষ রক্ষীদের প্রতি তুমি সতর্ক দৃষ্টি রাখবে এবং তোমার নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখবে। পুরুষদের সবাইকেই কামণ্ডো আক্রমণের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। মেয়েরাও যুদ্ধ করতে পারবে। আহতদের সেবা করা ছাড়াও প্রয়োজনে তাদেরকে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে যেতে পারবে আইয়ুবী। আমি মেয়েদের বলে দিয়েছি, শত্রুদের হাতে পড়লে তোমরা কেউ জীবিত ফিরে আসবে না। তারা নিজেরাও অঙ্গীকার করেছে, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা লড়বে, কিছুতেই শত্রুর হাতে ধরা দেবে না।’

স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর চারশ মেয়ে ও একশ পুরুষ অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে বসলো। দামেশক শহরের সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে এলো তাদের বিদায় অভিনন্দন জানাতে। তারা যখন চলতে শুরু করলো, জনতা রাস্তার দু’পাশে দাড়িয়ে তাদের গায়ে ফুল ছিটিয়ে দিতে লাগলো। এক কবি মাইকে তখন কবিতা পড়ছে,

‘সামনে এগিয়ে চলো বীর মুজাহিদ

মুক্তির মিছিলে-দাও সাড়া দাও

জেহাদের ময়দান ডাকছে ব্যাকুল

তোমার দৃপ্ত পা-সামনে বাড়াও।

ভাইদের সাথে আজ বোনেরা শামিল

পুষ্পিত হাতে হাতে বিষমাখা তীর

বিষ্ময়ে হতবাক বিমুগ্ধ নিখিল

অবাক তাকিয়ে দেখে মহীয়সী বীর।’

উল্লসিত জনতা ধ্বনি দিতে থাকে, ‘দামেশকের বীর সন্তান, সামনে এগিয়ে যাও, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে বলবে, দামেশকের সমস্ত নারী-পুরুষ আইয়ুবীর সৈনিক।’

মুরুব্বীরা তাদের দিকে হাত নেড়ে দোয়া করছিল, ‘আল্লাহ তোমাদের সফলতা দান করুন। ইসলামের কোন শত্রুকে জীবিত রেখে যেন তোমাদের ঘরে ফিরতে না হয়।

শহরের অনেক লোক ঘোড়া ও উটে চড়ে শহর থেকে বেরিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত তাদের সাথে এগিয়ে গেল। এক সময় হাজ্জাজ কাফেলা থামিয়ে আগত লোকদের দিকে ফিরে বললেন, ‘বন্ধুরা, এবার ফিরে যাও। এখন ফিরতি পথ না ধরলে ইফতারের আগে তোমরা শহরে পৌঁছতে পারবে না।’

রমজান মাস। বিকেলে এক জায়গায় তাঁবু টানানোর নির্দেশ দিলেন বাহিনী প্রধান হাজ্জাজ আবু ওয়াক্কাস। বিশ্রামের জন্য থেমে গেল কাফেলা। ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসছিল। যাত্রা বিরতির পর মেয়েরা রান্না-বাড়ার কাজে লেগে গেল। পুরুষরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল তাঁবু টানাতে।

তখন চলছিল এপ্রিল মাস, পুরো শীতের মওসুম। রাতে ভীষণ ঠাণ্ডা পড়ে। কাফেলার ঘোড়ার সাথে উটের বহরও ছিল। উটের পিঠে ছিল সামানপত্র ও তাঁবু। কিছু তাঁবুর মধ্যে তলোয়ার, বর্শা ও তীর-ধনুক লুকানো ছিল। স্বেচ্ছাসেবকরা উটের পিঠ থেকে সেসব তাঁবু নামাচ্ছিল।

সূর্য অস্ত যাওয়ার একটু আগে বারোজন অশ্বারোহী এসে উপস্থিত হলো সেখানে। সুলতান আইয়ুবীর টহল বাহিনী। চলাচলের পথ নিরপদ রাখার দায়িত্ব ছিল এদের ওপর। তারা কাফেলার কাছে এসে দেখতে পেল, কাফেলার মেয়েদের সংখ্যাই বেশী, পুরুষ কম। তারা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর গতিবিধি ও তৎপরতা লক্ষ্য করতে লাগল।

অশ্বারোহীদের আসতে দেখে কাফেলার সরদার হাজ্জাজ আবু ওয়াক্কাস সামনে এগিয়ে গেল। টহল বাহিনীর কমাণ্ডার ছিল আনতানুস! সে আবু ওয়াক্কাসকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমরা কারা? কোত্থেকে আসছো?’

আবু ওয়াক্কাস তাকে জানালো ‘আমরা স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী। সুলতান আইয়ুবীর পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য দামেশক থেকে এসেছি।’

আনতানুস তাকে আরো কিছু প্রশ্ন করে যখন নিশ্চিত হলো আবু ওয়াক্কাস সত্যি কথাই বলছে, তখন বললো, ‘কিন্তু তোমার বাহিনীতে পুরুষের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যাই দেখছি বেশী!’

‘জ্বী, আপনি ঠিকই বলেছেন। এর সবাই মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর তত্বাবধানে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে ময়দানে যাচ্ছে। আহত সৈনিকদের চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি সুলতান অনুমতি দিলে এরা সরাসরি যুদ্ধেও অংশ গ্রহণ করতে পারবে।’

কমাণ্ডোদের দেখে অনেকেই তাদের কাছে দিয়ে জটলা করে ওদের কথা শুনতে লাগলো। যুদ্ধের খবর শোনার জন্য সবাই ছিল উদগ্রীব। তারা প্রশ্ন করলো, ‘যুদ্ধের খবর কি?’

আনতানুস বললো, ‘যুদ্ধ এখনও শুরু হয়নি। তবে কখন শুরু হয়ে যায় তা বলা যায় না।’

পুরুষদের পাশাপাশি মেয়েরাও এসে জড়ো হয়েছিল সৈনিকদের পাশে। আনতানুস কথা বলতে হঠাৎ নীরব হয়ে গেল। তার দৃষ্টি আটকে গেল এক মেয়ের ওপর। সে একটু অবাক হয়েই বললো, ‘ফাতেমা! তুমি কেমন করে এখানে?’

ফাতেমাও এমনটি ভাবেনি। সেও অবাক হয়ে অধীর আগ্রহে তাকেয়ছিল আনতানুসের দিকে। আনতানুস তার নাম উচ্চারণ করতেই ভিড় ঢেলে সে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেল এবং তার হাত ধরে বললো, ‘আনতানুস! তুমি এখানে!’

এই সে ফাতেমা, যাকে আনতানুস গুমাস্তগীনের মহল থেকে মুক্ত করেছিল। আবু ওয়াক্কাস তাদের পরিচয়ের কাহিনী শুনে বললো, ‘আল্লাহ মেহেরবান! তিনি এভাবেই মুমীনের ইচ্ছা পূরণ করেন।’

এভাবেই আবু ওয়াক্কাস ও আনতানুসের অপরিচিতির ব্যবধান দূর হয়ে গেল। আবু ওয়াক্কাস আনতানুসকে বললো, ‘আপনারা আমার মেহমান। ইফতারীর সময় ঘনিয়ে এসেছে, এখন আর কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। আপনারা সবাই আমাদের সাথে ইফতারী করবেন।’

আবু ওয়াক্কাসের নির্দেশে লোকজন এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়লো। প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আনতানুস ও ফাতেমা দীর্ঘদিন পর একান্ত সাক্ষাতের সুযোগ পেয়ে অভিভুত হয়ে গেল।

একটু পরই দামেশক থেকে অনেক দূরে এ নির্জন এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো আজানের পবিত্র ধ্বনি। স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর সাথে ইফতারে শামিল হলো আনতানুস ও তার সাথে আসা অন্য এগারোজন কমাণ্ডো সৈনিক। ইফতারের পর জামাতের সাথে সালাতুল মাগরিব আদায় করলো সবাই। নামাজের পর খাওয়া দাওয়া শেষে সৈন্যরা যার যার তাঁবুতে ফিরে গেল। সারা দিনের বিরামহীন সফরের পর বিশ্রামের সুযোগ পেয়ে অনেকেই তাঁবুতে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো। কেউ কেউ মেতে উঠলো গল্প গুজবে। মেয়েরা তাদের তাঁবুর সামনে গোল হয়ে বসে গল্প গুজব ও গান শুরু করে দিলো। কমাণ্ডো দল স্বেচ্ছাসেবীদের তাঁবু থেকে একটু দূরে তাদের তাঁবু টানালো। আনতানুস তার দলকে বললো, ‘তোমরা বিশ্রাম নাও, আমি একটু আবু ওয়াক্কাসের ওখানে যাচ্ছি।’আনতানুস বেরিয়ে গেল তাঁবু থেকে।

রাত আরেকটু গভীর হলো। ফাতেমা এক ফাঁকে গোপনে সরে পড়লো মেয়েদের জটলা থেকে। তাঁবুর বাইরে এসে সে ব্যাকুল হয়ে আনতানুসকে তালাশ করতে লাগল। আনতানুস মেয়েদের তাঁবু থেকে একটু দূরে এক বালিয়াড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল। যখন নিশ্চিত হলো মেয়েদের তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসা মহিলা ফাতেমা ছাড়া আর কেউ নয়, আনতানুসও বেরিয়ে এল আড়াল থেকে।

আনতানুসের মনে পড়ছিল ফামেতার সাথে তার প্রথম সাক্ষাতের কথা। সে সময় আনতানুস ছিল সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা। হারানে গুমাস্তগীনের দূর্গে প্রবেশ করেছিল তথ্য সংগ্রহের জন্য। গুমাস্তগীনের অন্দর মহলের তথ্য সংগ্রহের জন্য তার দরকার ছিল অন্তপুরের কোন নারীর সাথে যোগাযোগ। এ কাজে ব্যবহারের জন্যই সে ফাতেমার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। কিন্তু সে সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত তাদের নিয়ে যায় প্রেমের রাজ্যে।

ফাতেমা ছিল হারানের শাসক গুমাস্তগীনের এক বেগম। তাকে গোয়েন্দা কাজে লাগাতে গিয়েই আনতানুস জড়িয়ে পড়েছিল বিপদে। ফাতেমা গুমাস্তগীনের এক খৃষ্টান উপদেষ্টাকে হত্যা করে ফেলে। আনতানুস গ্রেফতার হয়েও ফাতেমাকে নিয়ে পালাতে সমর্থ হয়েছিল সেনাপতি শামস বখতের সহায়তায়। সুলতান আইয়ুবী আনতানুসকে রেখে ফাতেমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দামেশকে। আনতানুসকে শামিল করে দিয়েছিলেন কমান্ডো বাহিনীতে। সেই থেকে ওদের মাঝে এই বিচ্ছিন্নতা। দীর্ঘদিন পরে তার সাথে ফাতেমার এই আকস্মিক দেখা।

আনতানুস এক সময় তীব্রভাবে অনুভব করতো, ফাতেমাকে ছাড়া তার জীবন একেবারেই অচল। এ মেয়ে তার অন্তরের গভীরে এমন আসন করে নিয়েছে, যেখান থেকে তাকে সরানো অসম্ভব। কিন্তু সুলতানের সাথে সাক্ষাতের পর সে প্রয়োজনের তীব্রতা কমে আসে। সে অনুভব করে, সবকিছুর আগে তার প্রয়োজন গোয়েন্দা হিসেবে সাফল্য অর্জন। ফাতেমাকে আজ নতুন করে দেখার পর সে অনুভূতিতে আবার ফাটল ধরে। তার মনে হতে থাকে, ফাতেমাকে ছাড়া তার জীবন অর্থহীন।

ফাতেমা আইয়ুবীর সামনে নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেছিল, ‘আমি এ যুবকের জীবন সাথী হতে চাই।’আইয়ুবী তাকে আশ্বাস দিয়েছিল, ‘সময় আসুক, তোমার আশা পূরণ করা হবে।’এ আশ্বাসের কথা স্মরণ করেই বিচ্ছেদের দিনগুলো সে পার করছিল আনতানুসের স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে। আনতানুসকে আজ এ অবস্থায় দেখতে পেয়ে তার আবেগের দরিয়ায় আবার অজানা স্রোতের ঢেউ উঠলো। ভালবাসার মধুর রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো মন।

তাদের এ সাক্ষাৎ হলো প্রচণ্ড আবেগময়। ক্ষণিকের জন্য ওরা উভয়েই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো। কিন্তু আনতানুস দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে ফাতেমার বাহু বেস্টনী থেকে মুক্ত হয়ে বললো, ‘ফাতেমা! এখনও আমাদের শাদীর ফরজ সম্পন্ন হয়নি। আবেগের বশে একবার আমরা শরীয়তের সীমারেখা লঙ্ঘন করেছি। তার খেসারত আমাদের কম দিতে হয়নি। এ জন্য আমি সুলতান আইয়ুবীর সামনে বড়ই লজ্জিত। লজ্জিত আমার জাতির সামনেও!

তোমার সাথে দেখা হওয়া একটা আকস্মিক ব্যাপার ছিল। প্রথম দেখার সময় এ কথা কখনো ভাবিনি, তোমার সাথে এভাবে প্রেমের বন্ধনে জড়িয়ে পড়বো। কিন্তু কয়েকদিনের মেলামেশা এবং বিপদের মোকাবেলা করতে গিয়ে কখন যে আমাদের দুটি হৃদয় এক হয়ে গেছে আমি তা টেরও পাইনি।

আমি কমাণ্ডো বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলাম একটি নির্দিষ্ট ফরজ আদায়ের জন্য। সে ফরজ আজো আমার আদায় হয়নি। সম্মানিত সুলতান একবার আমার অপরাধ ক্ষমা করেছেন। আমার ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন একটি কমাণ্ডো গ্রুপের। তোমাকে আমি গভীর ভাবে ভালবাসি কিন্তু আগে আমাকে আমার ফরজ আদায় করতে দাও।’

‘আমিও এক ফরজ আদায় করতেই বেরিয়েছি!’ফাতেমা বললো, ‘আমি তোমাকে বলতে চাই, গুমাস্তগীনকে হত্যা করবে এক নারী! এবং সে নারী এখন তোমার সামনে!’

‘অসম্ভব!’আনতানুস বললো, ‘সম্মানিত সুলতান কখনোই মেয়েদেরকে সম্মুখ যুদ্ধে পাঠাবেন না। আমার তো মনে হয়, তিনি তোমাদের সবাইকে ফেরত পাঠাবেন।’

‘না, আমাকে তিনি ফেরাতে পারবেন না।’ফাতেমা তেজোদীপ্ত কণ্ঠে বললো, ‘আমি প্রমাণ করে দেখিয়ে দেব, মেয়েরা শুধু অন্দর মহল ও গৃহ কোণে বন্দী থাকার জন্য জন্মায়নি, জিহাদের ময়দানেও তারা পুরুষের মতই সাহসী ভূমিকা রাখতে পারে।’

আনতানুস কিছু বলতে যাচ্ছিল, সহসা সে আনতানুসের হাত চেপে ধরে বললো, ‘আনতানুস, আমার একটি আশা তুমি পূরণ করো! আমাকে তুমি ‘সঙ্গে নিয়ে চলো। নারী নয়, আমি এক পুরুষের পোশাকেই তোমার সাথে পথ চলবো।’

‘না।’আনতানুস দৃঢ়তার সাথে বললো, ‘এমনটি কখনো হতে পারে না। তোমাকে আমার সঙ্গে রাখলে তোমাকে রক্ষা করার চিন্তাই আমার মন-মগজকে সব সময় আচ্ছন্ন করে রাখবে। তাহলে আমি আমার ফরজ পালন করতে পারবো না।’

‘না, আনতানুস, না। আমি কোন অবলা নারী নই। দুর্বল এবং ভীতুও নই। আমর স্বপ্ন ও সাহসের সাথে আজ একটু হলেও যুক্ত হয়েছে ট্রেনিং ও প্রশিক্ষণ। আমি কেবল আমাকে রক্ষা করবো ভেবে না, প্রয়োজনে তোমাকেও সহায়তা করতে পারবো। বিশ্বাস করো, কখনো আমাকে তোমার বোঝা ভাবতে দেবো না।’

‘না, তবু এমনটি সম্ভব নয়। কর্তৃপক্ষ যদি কখনো জানতে পারে, আমি সামরিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে কর্তৃপক্ষের অগোচরে কোন মেয়েকে সঙ্গে রেখেছি, তবে সে অপরাধে আমাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে। ফাঁসী না হলেও কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠের পথ আমি আড়াতে পারবো না। তোমার ও আমার অন্তর যতই পবিত্র হোক, আমাদের উদ্দেশ্য যতই সৎ ও মহৎ হোক, পৃথিবীর কোথাও আমরা এর যথার্থতা প্রমাণ করতে পারবো না। ফাতেমা! যুদ্ধ কখনো শুধু মনের আবেগ দিয়ে হয় না। সৈনিক কখনো মনের খেয়াল খুশী মত চলতে পারে না। তুমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করো যেখানে যাচ্ছিলে, যাও। হয়তো সুলতান আইয়ুবী তোমাদেরকে আহতদের সেবার কাজে লাগাতে পারেন। আল্লাহর যদি মঞ্জুর হয়, আজ যেমন আমাদের দেখা হলো, তেমনি আবার আল্লাহ আমাদেরকে একত্রিত করবেন।’

‘আনতানুস! এতদিন পর তোমার দেখা পেলাম। তোমাকে দেখে আমার মনে হচ্ছিল, আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন। তুমি যে ময়দানে লড়াই করছো, আমিও সে ময়দানের পথ ধরেছি। হয়তো আল্লাহ আমাকে এগিয়ে নেয়ার জন্যই তোমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। এখন থেকে আমরা দু’জন একই সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছুটে যাবো লড়াইয়ের ময়দানে। সে ময়দান থেকে আল্লাহর মঞ্জুর হলে আমরা বিজয়ী হয়ে ফিরে আসবো, আর নয়তো হাতে হাতে হাত ধরে একসাথে পান করবো শাহাদাতের পেয়ালা। আনতানুস! তুমি কি আমাকে বলতে পারো, আবার আদৌ আমাদের সাক্ষাৎ হবে? হলে সেটা কবে, কোথায়?’

আনতানুস কতক্ষণ মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইল। তাৎক্ষণিক এর কোন জবাব দিতে পারল না। এক সময় মাথা তুলে ধীর কণ্ঠে বললো, ‘ফাতেমা! তোমার এ প্রশ্নের জবাব দেয়া বড়ই কঠিন। এক অনিশ্চিত জীবনের পথ ধরে এগিয়ে চলেছি আমরা। হয়তো আবার আমাদের সাক্ষাৎ হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে! আবার এমনও হতে পারে, আমাদের দু’জনের যখন সাক্ষাৎ হবে তখন একজন জীবিত, অন্যজন মৃত। ফাতেমা! একজন কমাণ্ডো কখনো নিজের ব্যাপারে কিছু বলতে পারে না। কোন মানুষ যেমন বলতে পারে না কতক্ষণ সে বেঁচে আছে, তেমনি পারে না কোন কমাণ্ডোও। কিন্তু মানুষের একটি ঠিকানা থাকে, ভাল-মন্দ জানার একটি ব্যবস্থা থাকে। কমাণ্ডোদের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। সে নিজেই জানে না, কখন কোথায় সে থাকবে। আর আমার মত যারা গোয়েন্দা কমাণ্ডো, তাদের অবস্থা আরো করুণ! গোয়েন্দাদের লাশেরও কোন হদিস থাকে না। কিন্তু কথা দিচ্ছি, যদি বেঁচে থাকি, যুদ্ধ শেষে তুমি যেখানেই থাকে, আমি খুঁজে বের করে নেবো। আর কিছু নয়, যুদ্ধ শেষে তোমার সাথে দেখা করাই হবে আমার প্রথম এবং একমাত্র কাজ।’

‘এমনও তো হতে পারে, তুমি আহত হয়ে ফিরে আসবে ক্যাম্পে। আর তোমার ব্যাণ্ডেজে মলম লাগিয়ে দেয়া ও সেবা করার জন্য যে মানুষটিকে আল্লাহ মনোনিত করবেন, সে মানুষটি আমি?’বললো ফাতেমা।

আনতানুস পরিবেশকে একটু হালকা করার জন্য বললো, ‘এমনটি কল্পনা করতে দোষ কি! তবে গোয়েন্দা কমাণ্ডোদের মলম-পট্টি সাধারণত শত্রুরাই করে থাকে।’তারপর একটু বিরতি দিয়ে বললো, ‘ফাতেমা! বেশী আবেগপ্রবণ হয়ো না। মুজাহিদদের শুধু জীবনই কুরবানী দিতে হয় না, আবেগ এবং আশাকেও কুরবানী দিতে হয়। যদি তুমি চাও, তোমার মত মেয়েরা আর ধনী ও আমীরদের হেরেমের সৌন্দর্য সামগ্রী হবে না; খৃস্টানদের পশুত্ব ও বর্বরতা থেকে নিরাপদে থাকবে তারা, তবে আপাতত ব্যক্তিগত ভালবাসার কথা মন থেকে দূর করে দাও। দূর করে দাও ব্যক্তিগত ক্রোধ ও রাগ। গুমাস্তগীনকে হত্যা করার দায়িত্ব পালন করতে হবে নিষ্ঠার সাথে। কেবল সে দায়িত্বের কথাই শুধু মনে থাকবে তোমার, আর কিছু নয়।’

একটু পর। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে একে অন্যকে বিদায় জানালো ওরা। পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে এগিয়ে গেল নিজ নিজ তাঁবুর দিকে। আনতানুস যতই উপদেশ খয়রাত করুক, সে নিজে যেমন ফাতেমাকে ভুলতে পারল না, তেমনি ফাতেমাও ভুলে যেতে পারল না আনতানুসের প্রতি তার ভালবাসার কথা। এমনকি আনতানুসের উপদেশের পরও মন থেকে কিছুতেই দূর করতে পারল না গুমাস্তগীনকে খুন করার সেই অদম্য নেশাও।

সুলতান আইয়ুবীর সময় কাটছিল যুদ্ধ ক্ষেত্রের নকশা দেখে। কখনো তিনি নকশার রেখাগুলোর দিকে গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেন। কখনো অশ্বারোহী সৈন্যদের যুদ্ধ প্রস্তুতি ও মহড়া দেখতেন। কখনো নকশায় নতুন করে দাগ দিতেন। তিনি তাঁর মেধা ও বুদ্ধির সব শক্তি নিয়োজিত রেখেছিলেন যুদ্ধের পরিকল্পনাকে নিখুঁত ও পরিপূর্ণতা দান করতে।

তিনি মূল যুদ্ধ পার্বত্য উপত্যকা ও তৎসংলগ্ন সমতল ভূমিতে চালানোর পরিকল্পনায় অটল রইলেন। পরিকল্পনার ত্রুটিগুলো খুঁজে বের করতে গিয়ে তিনি দেখতে পেলেন, বাম দিকের উচুঁ প্রান্তর ও তার পিছনের পর্বতশ্রেণী মাড়িয়ে শত্রুর এগিয়ে আসার সম্ভাবনা মোটেই নেই। কিন্তু ডািন দিকের পার্বত্য টিলা তেমন দুর্গম ছিল না। টিলার পেছনের খোলা ময়দানে শত্রুসেনারা জমায়েত হলে এ পার্বত্য টিলা অতিক্রম করা তাদের পক্ষে তেমন দুঃসাধ্য নয়। দুশমন এদিক দিয়ে আক্রমণ করলে সুলতান আইয়ুবীর প্ল্যান হুমকীর সম্মুখীন হওয়ার আশংকা আছে। তাঁর কাছে এত অধিক সৈন্য নেই যে, তিনি সেদিকে সৈন্যদের প্রাচীর দাঁড় করাতে পারেন। অবশ্য এদিকের টিলার আড়ালে তিনি তীরন্দাজদের একটি ক্ষুদ্র বাহিনীকে মোতায়েন রেখেছেন। কিন্তু এ ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। এখানে যুদ্ধ করার জন্য তিনি দু’টি অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীকে প্রস্তুত রেখেছিলেন। কিন্তু তাদেরকে এক গোপন স্থানে লুকিয়ে রেখেছিলেন। নির্দিষ্ট সময়ের আগে তাদের ময়দানে আসার অনুমতি ছিল না। এ বিষয়টি সুলতান আইয়ুবীকে ভাবিয়ে তুললো। তিনি তাঁর সঙ্গের বাহিনীকে ডান দিকে আরেকটু এগিয়ে নেবেন কিনা এটা দেখার জন্য এক উচুঁ টিলার ওপর চড়ে সেদিকে তাকালেনা। সহসা দূর দিগন্তে তিনি দেখতে পেলেন ধূলি ঝড়। এমন ধুলি মেঘের সাথে সৈন্যরা ভালমতই পরিচিত। ধূলির এ মেঘ দেখেই তিনি বুঝতে পারলের, ওদিক দিয়ে ছুটে আসছে কোন অশ্বারোহী বাহিনী। একটু পরেই ঘোড়া চোখে পড়লো তাঁর। ধূলি মেঘের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, অশ্বারোহীরা এক লাইনে নয়, বরং পাঁচটি লাইন ধরে এগিয়ে আসছে। বাহিনী ছোট নয়, অন্তত চার-পাঁচশ অশ্বারোহীর এক বিশাল বাহিনী।

এর শত্রু ছাড়া আর কে হতে পারে? সুলতান আইয়ুবী গর্জন করে বললেন, ‘কেন, এ রাস্তায় প্রহরী, কমান্ডো বা গোয়েন্দাদের কেউ কি ছিল না? এত বড় বাহিনী এগিয়ে আসছে, এদের কেউ বাঁধাও দেয়নি, কোন খবরও দেয়নি, এটা কেমন করে হলো?’

তিনি দ্রুত টিলা থেকে নেমে এলেন এবং বাহিনীকে বললেন, ‘তোমরা জলদি তৈরী হও! মুজাহিদ, মনে রেখো, অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি থেকে বিজয় ছিনিয়ে নেয়াই বাহাদুর সৈনিকের কাজ!’যুদ্ধের নাকারা বেজে উঠলো। নাকারা বাজার সাথে সাথে সমস্ত সেনাবাহিনী প্রতিরক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে ময়দানে দাঁড়িয়ে গেল। সুলতান আবার ছুটে গেলেন সেই টিলার ওপর। তারপর ছুটে আসা বাহিনীর দিকে দৃষ্টি ছোড়ে অনড় দঁড়িয়ে রইলেন।

কিছুক্ষণ পর। ঘোড়া আরো নিকটতর হলো। এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে অশ্বারোহীদের। তাদের চলার ভঙ্গি আক্রমণাত্মক নয়। সহজ সচ্ছন্দ গতিতে এগিয়ে আসছে কাফেলা। সুলতান একটু অবাক হলেন। সঙ্গের এক কমাণ্ডারকে আদেশ দিলেন, ‘কয়েকজন অশ্বারোহী নিয়ে সামনে দৌঁড়াও। দেখো এরা কারা?’

চারজন অশ্বারোহী নিয়ে ছুটলো কমাণ্ডার। একটু পর ফিরে এলো বাহিনীর আগে আগে। দূর থেকেই চিৎকার করে ওরা বলছিল, ‘এর দামেশক থেকে এসেছে। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। তাদের সাথে নারী ফৌজও আছে।’

‘কি! নারী ফৌজ!’সুলতান আইয়ুবী বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘মেয়েদের সেনা দল?’

‘জ্বি, চারশ নারী ও একশ পুরুষ এ বাহিনীতে।’

তিনি আবেগে উদ্বেলিত হয়ে বললেন, ‘বুঝেছি, এ বাহিনী আমার বিধবা বোন পাঠিয়েছেন। ওস্তাদ জঙ্গীর বিধবা পত্নী আবারো প্রমাণ করলেন, তিনি মরহুমের উপযুক্ত সহধর্মিনী ছিলেন। যে জাতি এমন মায়েদের স্নেহ ও সেবা পায়, সে জাতির সন্তানদের চেয়ে সৌভাগ্যবান আর কে আছে?’

সুলতান আইয়ুবীর চেহারা আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। উৎফুল্ল কন্ঠে হাসতে হাসতে তিনি পাশে দাঁড়ানো সেনাপতিদের বললেন, ‘এ জাতির মেয়েরা দেখছি শেষ পর্যন্ত তোমাদেরকে বিজয়ী করেই ছাড়বে।’

‘আমরা এতে অপমানিত নই, বরং সম্মানিত বোধ করছি সুলতান। পুলকিত বোধ করছি এ জন্য যে, জেহাদের প্রেরণা জাতির প্রতিটি হৃদয়কে আলোকিত করে তুলেছে। জেহাদ করার দায়িত্ব গুটিকয় সৈনিকের নয়, সমগ্র জাতির। জাতি এখন সে দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে। আর এ সত্যের স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ময়দানে নেমে এসেছে অন্তপুরবাসী মায়েরা ও মেয়েরা। তবে ওদের কষ্ট করতে হবে না, আপনি এ বোনদের আশ্বস্ত করতে পারেন, তোমাদের ভাইদের শিরায় খুন এখনও নিঃশেষ হয়নি, ইনশাআল্লাহ তাদের খুনই তোমাদের মান-সম্ভ্রম ও বিজয়ের জামিনদার। এ জাতির একটি মেয়েও শত্রুদের হাতে লাঞ্ছিত হলে আমরা মরেও শান্তি পাব না।’

সুলতান আইয়ুবী উপত্যকা থেকে নেমে সামনে অগ্রসর হলেন। মেয়ে ও পুরুষ স্বেচ্ছাসেবকদের সম্মিলিত বাহিনী ক্রমশ এগিয়ে তার কাছে এসে থেমে গেলো। এ বাহিনীর কমাণ্ডার আবু ওয়াক্কাস ঘোড়া থেকে নেমে সুলতান আইয়ুবীর সামনে এসে যথারীতি সালাম দিয়ে নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর লিখিত চিঠি পেশ করলেন।