» » ছোট বেগম

বর্ণাকার

দিনের প্রথম প্রহর যখন শেষ হলো তখন দুর্বৃওদের জ্ঞান ফিরলো। হাবিবুল কুদ্দুসের বাহিনী তখন দুর্বৃওদের নিয়ে কায়রোর পথে রওনা হয়ে গেছে।

দুর্বৃওরা সজাগ হয়ে নিজেদের আবিষ্কার করলো অশ্বপৃষ্ঠে। হাত পা বাধাঁ অবস্থায় তারা তখন বিশজন সৈনিকের পাহারায় এগিয়ে চলেছে কায়রোর দিকে।

জ্ঞান ফিরলেও হাবিবুল কুদ্দুস তাদের সাথে কোনো কথাই বললেন না। তার নির্দেশে কোন রকম বিরতি ছাড়াই কাফেলা এগিয়ে চললো।

কায়রো শহর। মধ্য রাত। চমৎকার ‍নিরবতা বিরাজ করছিল শহর জুড়ে। হাবিবুল কুদ্দুস কাফেলা নিয়ে সোজা হাজির হলেন গভর্ণর হাউজে। ঘুম থেকে জাগানো হলো কায়রোর ভারপ্রাপ্ত আমীরকে।

একটু পর আলী বিন সুফিয়ানের চাকর তাকে জাগিয়ে বললো, ‘আমীর সাহেব আপনাকে এখুনি তার মহলে যেতে বলেছেন।’ বড় রকমের কোন সমস্যা হয়েছে ভেবে তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উপস্থিত হলেন। হাবিবুল কুদ্দুসকে সঙ্গে নিয়ে গিয়াস বিলকিস বসে ছিলেন সেখানে। আলী বিন সুফিয়ান গিয়াস বিলকিসের সঙ্গে হাবিবুল কুদ্দুস কে বসে থাকতে দেখে যারপরনাই বিস্মিত হলেন।

হাবিবুল কুদ্দুস আবার তার অপহরণ হওয়া থেকে শুরু করে মুক্তি ও দুর্বৃওদের পাকড়াও করার অভিযান কাহিনী ওদের সামনে তুলে ধরলেন। এরপর তিনি সবাইকে চমকে দিয়ে এমন কয়েকজন সামরিক অফিসার ও বেসামরিক নেতার নাম উল্লেখ করলেন, যারা ছিল খৃস্টান ষড়যন্ত্রকারী দুর্বৃওদের দোসর। এ নাম কয়টি তিনি পেয়েছিলেন বন্দী অবস্থায় খৃস্টান নেতা এবং মিশর ও সুদান থেকে আগত দুই আগন্তুকের কাছ থেকে।

এই অফিসার ও নেতারা সবাই গাদ্দার ও ষড়যন্ত্রকারী ছিল। আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘এরা সত্যি বিদ্রোহ সফল করার কাজে জড়িত ছিল কিনা আগে তা প্রমাণিত হওয়া দরকার। সত্যি ওরা দোষী সাব্যস্ত হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে ওদের।’

আমীরের আদেশে তখুনি কমাণ্ডো বাহিনী রাতের আধারে সংশ্লিষ্ট অফিসার ও নেতাদের বাড়ীগুলো ঘিরে ফেললো। বাড়ীতেই পাওয়া গেল সবাইকে। কমাণ্ডোরা তাদের সবাইকে গ্রেফাতার করে নিয়ে এলো দরবারে। তাদের ঘরে যে সব উপঢৌকন ও বিলাস সামগ্রী পাওয়া গেল তাতেই তাদের অপরাধ সত্য বলে প্রমাণ হয়ে গেল।

সে সময় সুলতান আইয়ুবী হলব শহর অবরোধের জন্য শহরের পাশেই আল আখদার ময়দানে সামরিক ঘাঁটি করে অবস্থান করছিলেন। তিনি সিরিয়া ও বিভিন্ন রাজ্যে তার যে সেন্য ছিল তা থেকে কিছু কিছু অংশকে ডেকে নিজের বাহিনীর সাথে সামিল করার কাজে ব্যস্ত।

হলব সম্পর্কে তিনি তার সেনাপতিদের আগেই জানিয়ে ছিলেন, এই শহরের নাগরিকবৃন্দ দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, তারা আগেও এমন প্রমান রেখেছে। ফলে এখানে বিজয় পেতে হলে কঠিন মোকাবেলার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

ওদিকে তার গোয়েন্দা সংস্থা হলবের অভ্যন্তরীন অবস্থা সম্পর্কে যে রিপোর্ট দিয়েছে তার চিত্র ভিন্ন। গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, দীর্ঘদিন গৃহযু্দ্ধ করার ফলে তাদের আগের সেই অবস্থা নেই। গৃহযুদ্ধের ফলে শুধু শক্তির দিক দিয়েই তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন নয়, তাদের চিন্তা-চেতনা এবং মানসিকতায়ও পরিবর্তন এসেছে। এ ক্ষেত্রে সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দারাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

সেখানকার শাসক সুলতান ইমামুদ্দিনকে এখন হলবের অধিকাংশ নাগরিক ক্ষমতালোভী ও সৈরাচারী মনে করে। বিলাসবহুল জীবন যাপনের কারনে তিনি এখন জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন।

সুলতান আইয়ুবী এ সব শোনার পরও তার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হলেন না। কারণ ইমামুদ্দিন যথেষ্ট হুশিয়ার ও কুশলী সমরনায়ক। ইয়াজউদ্দিনের চাইতে তিনি সাহসীও বটে। তাই সুলতান এদিক ওদিক থেকে সৈন্য এনে আল আখদার ময়দানে জড়ো করতে থাকেন।

সৈন্য সংগ্রহ শেষ হলে তিনি তার সেনাপতিদের একত্রিত করলেন। অভিযান শুরুর আগে তিনি সেনাপতিদের শেষ বারের মতো নির্দেশ দিচ্ছিলেন। এ সময় কায়রো থেকে তার কাছে এক কাসেদ এলো।

কায়রোর কাসেদ এসেছে শুনেই তিনি বক্তৃতা বন্ধ করে কাসেদকে ডাকলেন। কাসেদ তাঁর হাতে আলী বিন সুফিয়ানের চিঠি তুলে দিলো।

আইয়ুবী মনোযোগ দিয়ে চিঠিটি পড়লেন। খুশীতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো তার চেহারা। তিনি হাসিমুখে সেনাপতিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার মন বলছিল, হাবিবুল কুদ্দুস আমাকে ধোঁকা দিতে পারে না। আল্লাহ ইসলামের প্রত্যেকটি মেয়েকে যেন জোহরার মত ঈমান ও জোশ দান করেন।’

আলী বিন সুফিয়ান সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুসের অন্তর্ধান থেকে শুরু করে ষড়যন্ত্রকারীদের গ্রেফতার করার কাহিনী পর্যন্ত বিস্তারিতভাবে লিখেছেন চিঠিতে। সব শেষে তিনি জানতে চেয়েছেন, ‘সেনাবাহিনীর যেসব অফিসার এই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত হয়েছিল তাদের ব্যাপারে আপনার নির্দেশ কি?’

তিনি দেরী না করে চিঠির উওর লিখতে বসে গেলেন। তিনি লিখলেন, ‘গাদ্দারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার, যাতে অন্যরা লোভে পড়ে এই রোগে আক্রান্ত হতে সাহস না পায়। ‍তুমি তাদের জন্য সে রকম শাস্তিরই ব্যবস্থা করবে। তাদেরকে ঘোড়ার পেছনে বেঁধে শহরের রাস্তায় ঘোড়া ছুটিয়ে দেবে। যতোক্ষণ তাদের মাংস ও চামড়া শরীর থেকে খসে না পড়বে ততোক্ষণ ঘোড়া থামাবে না।’

কাসেদকে বিদায় করার দু্’দিন পর। সুলতান আইয়ুবী তার মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে হলবের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালালেন। এবার আর অবরোধ নয়, সরাসরি আক্রমণ।

বড় মেঞ্জানিক দিয়ে শহরের মূল ফটকে পাথর ও পেট্রোলের বোমা নিক্ষেপ করা হলো। শহরের দেওয়ালেও নিক্ষেপ করা হলো পাথর। দূর থেকে দেয়ালের ওপর দিয়ে শহরের ভেতরে পেট্রোলের হাড়ি নিক্ষেপ হলো। প্রাচীরের উপর থেকে যেসব সৈন্য তীর বর্ষণ করে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছিল তাদের ওপর চালানো হলো অগ্নি তীর।

মেঞ্জানিকের পেট্রোল বোমা ও অগ্নি তীরের তুমুল আক্রমণের ফাঁকে একদল সৈন্য ছুটে গেল দেয়ালের পাশে। তারা ওখানে পৌঁছেই দেয়াল ভাঙ্গার কাজ শুরু করে ‍দিলো।

কিন্তু আইয়ুবীর বাহিনীর এই প্রবল আক্রমণের তুলনায় শহরবাসীর প্রতিরোধ ছিল খুবই অনুল্লেখযোগ্য। জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ততা তো ছিলই না, শহরের সৈন্যদের তরফ থেকেও প্রতিরোধের ধরন ছিল মামুলী।

কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ লিখেছেন, হলবের আমীর ইমামুদ্দিন, তার মন্ত্রীবর্গ ও অফিসাররা খৃস্টানদের কাছ থেকে সামরিক সাহায্য ছাড়াও প্রচুর আর্থিক সাহায্য পেয়েছিলেন। তারা খৃস্টানদের কাছ থেকে নিয়োমিত সোনা, রূপা ও মূল্যবান উপহার সামগ্রী পেতো। ইমামুদ্দিন, তার মন্ত্রী ও অফিসারদের দৃষ্টি সবসময় সেদিকেই নিবদ্ধ ছিল।

তারা জানতো এবং নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতো, একদিন সুলতান আইয়ুবী নিশ্চয়ই হলব আক্রমণ করবেন। ইমামুদ্দিনও আগে থেকেই সুলতান আইয়ুবীর প্রচণ্ড আক্রমণের আশঙ্কা করছিলেন। ফলে তাদের মধ্যে আইয়ুবী আতঙ্ক এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, আক্রান্ত হওয়ার পর তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো।

ইমামুদ্দিন অবস্থা বেগতিক দেখে হলবের কেল্লাধিপতি হিশামুদ্দিনকে পাঠালেন সুলতান আইয়ুবীর কাছে। তিনি হিশামুদ্দিনের মাধ্যমে সুলতানের কাছে এই আর্জি পাঠালেন, ‘মাননীয় সুলতান, এই কেল্লা ও রাজ্য আপনি গ্রহণ করুন। বিনিময়ে আমাকে এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিন।

আপনি যদি আমাকে মুশেলের কোথাও থাকার অনুমতি দান করেন তাহলে আমি ওয়াদা করছি, আমি আর কখনো আপনার বিরুদ্ধে কোন তৎপরতায় অংশ নেবো না।’

সুলতান আইয়ুবী তার এ শর্ত মেনে নিলেন। এ সংবাদ যখন শহরে পৌঁছলো তখন শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত বিদ্যুতবেগে ছড়িয়ে পড়লো এ খবর। শহরের জনগন দলে দলে এসে ইমামুদ্দিনের কাছে জানতে চাইলো, ‘আমরা যা শুনছি তা কি সত্য?’

ইমামুদ্দিন বললেন, ‘এ সংবাদ সত্য। আমি হলব শহর ত্যাগ করে চলে যাচ্ছি। তোমরা ইচ্ছে করলে নতুন আমীর মনোনীত করে সুলতান আইয়ুবীর কাছে পাঠাতে পারো। তোমরা সুলতানের সাথে আপোষও করতে পারো আবার ইচ্ছে করলে লড়াইও করতে পারো। আমি আর এসবের মধ্যে নেই, তোমরা যা ভালো মনে করো তাই করো।’

শহরের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ জার্দুক আন নুরী ও জয়নুদ্দিনকে প্রতিনিধি করে সুলতান আইয়ুবীর কাছে পাঠালেন। জার্দুক আন নুরী ছিলেন দাস বংশের। ১১৮৩ সালের জুন মাসে তারা সুলতান আইয়ুবীর কাছে গেলেন।

সুলতান আইয়ুবীর সাথে আলাপ শেষে তারা শহরে এসে সমস্ত সৈন্যদেরকে নিয়ে শহরের বাইরে গেলো এবং হলবের সেনাবাহিনীকে সুলতান আইয়ুবীর কাছে সমর্পণ করে দিল।

সেনাবাহিনীর সাথে হলবের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ, ইমামুদ্দিনের উজির ও সভাসদবৃন্দও সুলতান আইয়ুবীর সামনে হাজির হয়ে তার বশ্যতা স্বীকার করে নিল। তিনি সবাইকে মূল্যবান পোষাক পরিচ্ছদ প্রদান করে তাদের বরণ করে নিলেন।

অভিযানের ষষ্ঠ দিন। হলবের বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিপ্লবী মুজাহিদ বাহিনীর বিজয় সুসম্পন্ন হয়েছিল। সুলতান আইয়ুবী এই সফলতার আনন্দে ছিলেন উৎফুল্ল। সেই মুহূর্তে তার কাছে সংবাদ এলো, তাঁর ভাই তাজুল মুলক মৃত্যুবরণ করেছেন। তাজুল মুলুক এই রণাঙ্গনেই আহত হয়েছিলেন। তার শাহাদাতের খবর সুলতান আইয়ুবীর আনন্দকে নিরানন্দে পরিনত করে দিল।

তাজুল মুলকের জানাজা অনুষ্ঠিত হলো হলবের এক বিশাল ময়দানে। সুলতানের বাহিনী ছাড়াও এই জানাজায় শরীক হলো হলবের আত্মসমর্পিত বাহিনী। ইমামুদ্দিন তখনো হলব ত্যাগ করেননি। তিনিও জানাজায় শরীক হলেন।

জানাজার পর তাজুল মুলুককে নিয়ে যখন বিশাল মিছিল রওনা হলো তাকে দাফন করতে, ইমামুদ্দিন তখন তার দীর্ঘদিনের মসনদ, পরিচিত শহর ও তার সকল অনুগত সৈন্য, উজির-নাজির, চামচা-চাটুকার সবাইকে রেখে হলব থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলেন মুসলের দিকে।

সুলতান হলবকে নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে সেখানে নতুন প্রশাসক নিয়োগ করলেন। এরপর তিনি মনযোগ দিলেন নতুন একটি বিষয়ের প্রতি।

তার যে সমস্ত সৈন্য দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ করছিল তাদেরকে সাময়িক বিশ্রামের সুযোগ দেয়ার কথা ভাবলেন তিনি। তিনি পুরনো সৈন্যদের কিছুদিনের ছুটি দিয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দিলেন। নিজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন হলবের শাসন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো ও নবাগত সৈন্যদের প্রশিক্ষণ কাজে।

তার চোখে তখনো ভাসছিল অবরুদ্ধ বায়তুল মোকাদ্দাস। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বাহিনীকে সংগঠিত করে তাদের উপযুক্ত ট্রেনিং দিয়ে বায়তুল মোকাদ্দাস উদ্ধারে বেরিয়ে পড়তে চান তিনি। তিনি সেনাপতিদের হুকুম দিলেন, ‘আমার মূল বাহিনীর সদস্যরা ছুটি থেকে ফিরে আসার আগেই হলবের এই বাহিনীকে উপযুক্ত করে গড়ে নাও। এবার আমাদের টার্গেট হবে ফিলিস্তিন। আমাদের প্রথম কেবলা দুশমন মু্ক্ত না হওয়া পর্যন্ত আরামে ঘুমানোর কোন সুযোগ নেই।’

সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর চেহারায় খেলা করছিল আনন্দের আলো। তার এ উৎফুল্ল ভাব দেখেই তার সেনাপতি ও কমাণ্ডাররা বুঝে নিলেন, সুলতান কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন। কারন তাদের জানা ছিল, সুলতানের মুখে এমন আনন্দের আভা তখনি দেখা দেয়, যখন তিনি কোন ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান।

কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছার আগে তিনি বিস্তর ভাবেন। তখন তার চেহারায় খেলা করে গাম্ভীর্য। তিনি বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে আলাপ করেন। উপদেষ্টা ও সেনাপতিদের সাথে মত বিনিময় করেন। সবার মতামতের সাথে নিজের প্রজ্ঞা ও বুদ্ধি মিলিয়ে তিনি যখন কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছান তখনই এমন আলোকিত হয়ে উঠে তার চেহারা।

একটি কথা তার শত্রুরাও জানে, তিনি কোন ব্যাপারে একবার সিদ্ধান্ত নিলে সেখান থেকে সহজে ফেরেন না। শত বিপদ মুসিবতেও তিনি তার গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে থাকেন সদা তৎপর।

১১৮৭ সালের মার্চ মাস। হিজরী সন অনুযায়ী মুহাররম মাস চলছে। তিনি দামেশকে অবস্থান করছেন। ইতিমধ্যে তিনি সমস্ত মুসলিম জাহানের শাসকদেরকে তার অধীনে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছেন।

কেউ তার আনুগত্য কবুল করেছেন সানন্দে, কেউ বা নিরূপায় হয়ে। তিনি তার এই বিশাল বাহিনীর প্রত্যেকের ওপর কড়া নজর রেখেছিলেন। ছোট ছোট কেল্লার আমীররা কি করছে এটা যেমন তিনি জানতেন, তেমনি জানতেন দুশমনরা এখন কি ভাবছে। আর এ সবই সম্ভব হচ্ছিল তার চৌকশ গোয়েন্দা বাহিনীর কল্যাণে।

এখন তিনি জানেন, প্রকাশ্যে এমন একজন মুসলিম শাসকও নেই যিনি খৃস্টানদেরকে তার বন্ধু বলে ঘোষনা করতে পারে। যারা খৃস্টানদের বন্ধু বানিয়ে রেখেছিল এবং তাদের নিয়ে জোটবদ্ধ হয়েছিল, তিনি সেই সব গাদ্দারকে ক্ষমতার মসনদ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। আর এ কাজ তাকে কঠোর হাতেই সমাধা করতে হয়েছিল। এদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশী বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন হলব ও মুসলের আমীর ইয়াজউদ্দিন ও ইমামুদ্দিনের কাছ থেকে। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে গৃহযুদ্ধের পর তারা সুলতান আইয়ুবীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

তিনি তাদের পরাজিত করে তাদের সৈন্যবাহিনী নিজের সেনাবাহিনীর সাথে যুক্ত করে নিযেছিলেন। এভাবেই মুসলিম বিশ্বের বিশাল সামরিক শক্তি একটি একক কমাণ্ডের অধীনে চলে আসে।

তিনি তখনই দামেশকে ফিরে গিয়েছিলেন যখন তিনি তার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করেছিলেন। তিনি শপথ করেছিলেন, ফিলিস্তিন আক্রমণের আগে তিনি সমস্ত গাদ্দারদের বিষঁদাত ভেঙ্গে দিবেন। তিনি বিশ্বাসঘাতকদের মাথা হাটুঁর নিচে নামিয়ে তারপরই দামেশকে ফিরেছিলেন।

অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝেছিলেন, যতবার তিনি ফিলিস্তিন অভিযানকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবেন ততবারই জাতির ভেতর লুকিয়ে থাকা সাপ গর্ত থেকে বেরিয়ে পেছন থেকে তাকে ছোবল মারার জন্য ফনা তুলবে। তাই তিনি চাচ্ছিলেন, প্রথম কেবলা উদ্ধার অভিযানের প্রাক্কালে আর যেন তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে না হয়।

কিন্তু তিনি সাপের বিষদাঁত ভাঙতে গিয়ে জাতির শিরা উপশিরাকে রক্তাক্ত করতে চাচ্ছিলেন না। তিনি যেসব গাদ্দারকে তলোয়ারের ঝলক দেখিয়ে পথে এনেছিলেন তাদেরকে শুধু একারনেই নিঃশেষ করে দেন নি। তিনি তদের সঠিক পথে এনে কখনোই বলেননি, ‘দেখো, সুলতান আইয়ুবীর তলোয়ারের ধার দেখো।’

তিনি তাদের কথা স্মরণ করে শুধু একটি কথাই বলতেন, ‘হায়, ইসলামের ইতিহাসে এই অধ্যায়টা বড়ই ঘৃণিত অধ্যায় হয়ে থাকবে। কারণ ইতিহাসে লেখা থাকবে, সুলতান সালাউদ্দিনের যুগটা ছিল অন্ধকার যুগ। ফেতনার তুফানের মোকাবেলা করতে ‍গিয়ে তিনি সত্যের বীজটুকু বোনার মত সময়ও পাননি।

ইতিহাস আরো লিখবে, হাজার হাজার খোদার সৈনিক বর্তমান থাকার পরও মুসলমানদের প্রথম কেবলা খৃস্টান বিধর্মীদের দখলে ছিল। তারা যখন বায়তুল মোকাদ্দাসে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে বসেছিল তখন মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে প্রকারান্তে মদদ যোগাচ্ছিল খৃস্টানদের। আর যদি আমরা সবাইকে একত্রিত করে ফিলিস্তিন অভিমুখে অভিযান চালাতে পারি তখন ঐতিহাসিকরা লিখবে, ঐক্যবদ্ধ মুসলিম শক্তি খৃস্টানদের পরিকল্পনা ধ্বংস করে ছিল।

সেদিন যখন সুলতান আইয়ুবী তাঁর সেনাপতি ও উপদেষ্টাদের সভা আহবান করেন, সবাই সুলতান আইয়ুবীর চেহারায় খুশীর ঝলক লক্ষ্য করে নিজেরাও উৎফুল্ল হয়ে উঠছিল। তারা বুঝতে পারছিল, সুলতান কোন অভিযানে বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। আর তাঁর সেই অভিযানের লক্ষ্যস্থল যে বায়তুল মোকাদ্দাস তাও তারা অনুমান করতে পারছিল।

তারা এ ব্যাপারে সুলতানের মুখ থেকে ঘোষণা শুনতে চাচ্ছিল। তারা জানতে চাচ্ছিল, কোন দিন কোন সময় তারা যুদ্ধ যাত্রা করবেন আর কি প্রক্রিয়ায় তিনি যুদ্ধ চালাবেন। তারা এটাও জানতে চাচ্ছিল, এ অভিযান কোন রাস্তা ‍দিয়ে অগ্রসর হবে।

‘হে আমার বন্ধুগণ! হে আমার সঙ্গীগণ!’ সুলতান আইয়ুব থেমে থেমে বলতে লাগলেন, ‘আপনারা অবশ্যই আমার কথা বুঝতে পেরেছেন। আমরা এখন বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে যাত্রা করার জন্য প্রস্তুত। আজ আমি আপনাদের সামনে যে কথা বলবো, আমি জানি তা একদিন ইতিহাস হয়ে থাকবে।

আপনারাও এ অভিযানের ব্যাপারে খোলামেলা মতামত প্রকাশ করুন। আপনাদের মতামত, আপনাদের সংকল্প ও প্রতিজ্ঞা সবই একদিন ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হবে।

আপনারা থাকবেন না, কিন্তু আপনাদের শপথের বাণী যুগ যুগ ধরে এমনকি শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রেরণা জোগাবে সত্য পথের সৈনিকদের। আমাদের কথা, আমাদের প্রতিজ্ঞা ইতিহাসের অংশ হয়ে পৌঁছে যাবে আমাদের শেষ বংশধর পর্যন্ত।

একটি কথা মনে রাখবেন, এ দুনিয়ায় আমরা আমাদের কর্ম রেখে যাবো, কিন্তু সঙ্গে নিয়ে যাবো আমাদের কর্মফল। দুনিয়ার প্রতিটি কর্মের ফলই সঙ্গী হবে আমাদের এবং আমরা সেই কর্মফল নিয়েই আল্লাহর দরবারে হাজির হবো।

এখন আপনাদেরকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যে সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য বয়ে নিয়ে আনবে কল্যাণ। যে সিদ্ধান্ত ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে আমাদের মুখ করবে উজ্জ্বল। যে সিদ্ধান্ত আল্লাহর দরবারে লজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা করবে আমাদের।

বিজয়ের নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। কারণ বিজয় দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ রব্বুল আলামীন। কিন্তু আমরা যে নিশ্চয়তা দিতে পারি তা হচ্ছে, আমরা প্রাণপণে যুদ্ধ করবো। আমরা মরবো কিন্তু পিছু হটবো না। আমরা আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবো পরিপূর্ণ নিষ্ঠার সাথে। আমরা শপথের মর্যাদা রক্ষা করবো।

লাশের পাহাড় আর রক্তের নদী সাঁতরে আমরা এগিয়ে যাবো আমাদের মঞ্জিলের দিকে। কোন ভয়-ভীতি, লোভ, দুনিয়ার টান, কিছুই আমাদের অগ্রযাত্রার গতি রোধ করতে পারবে না।’

সুলতান আইয়ুবী একে একে তাকালেন তার উপদেষ্টা ও সেনাপতিদের দিকে। দেখলেন সবার চোখে মুখে শপথের দৃঢ়তা। প্রতিটি চোখে খেলা করছে অনড় ও অনমনীয় আপোষহীনতার ছাপ।

তার মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হলো। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের বিজয়ের ব্যাপারে কোন নিশ্চয়তা দিতে পারবো না। কিন্তু তাই বলে আমাদের মধ্যে যেন কারো এ ভয় না হয় যে, খৃস্টান বাহিনী আমাদের ‍দ্বিগুন এবং আমরা বহু দূর থেকে যুদ্ধ করতে এসেছি।’

তিনি একটু দম নিলেন। তারপর সেনাপতিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে ‍দিতে চাই, আমরা এখন সংখ্যায় ততো নগন্য নই। বরং এর চেয়েও কম সংখ্যক সৈন্য নিয়ে বিশাল শত্রু বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে আমরা বিজয় লাভ করেছি।

যুদ্ধ শুধু সংখ্যা দিয়ে হয় না, বুদ্ধি, কৌশল ও প্রেরণা দিয়ে যুদ্ধ করতে হয়। যদি ঈমান মজবুত হয় তবে তার বাহু, তলোয়ার আর মনও দৃঢ় হয়ে যায়। আমাদের মাঝে ঈমানের দুর্বলতা নেই। অতএব বলা যায়, আমাদের কিছুই অভাব নেই।’ সুলতান থামলেন।

‘আমাদের মধ্যে এমন একজনও নেই, যে শত্রুর সাথে নিজের শক্তির তুলনা করে।’ কমাণ্ডো বাহিনীর সেনাপতি ছালেম মিশরী দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমাদের শুধু জানা প্রয়োজন, আমরা কোন দিক দিয়ে বায়তুল মোকাদ্দাসে গিয়ে পৌঁছবো আর আমাদের গতি কেমন হবে?’

‘তবে আমি চলার পথে প্রতি কদমে সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরী মনে করি। আমাদের অহংকারী হওয়া যেমন মানায় না, তেমনি স্বপ্নবিলাসী হওয়াও কোন সৈনিকের কাজ নয়।’ বললেল সুলতান।

সালেম মিশরী বললো, ‘আমি আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ হবে বাস্তবতার নিরিখে। আর আপনি যেমন বললেন, ঈমান, সাহস, বুদ্ধি ও কৌশল হবে আমাদের অস্ত্র।’

‘আমি আপনাদেরকে একথাই বলতে চেয়েছি।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি যুদ্ধের প্ল্যান পরিকল্পনা আপনাদের পরামর্শক্রমেই তৈরী করেছি। আমি গত কয়েক রাত চিন্তা ভাবনা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছি, আমাদের প্রথম লক্ষ্য হবে হাতিন। ‍যুদ্ধের কৌশলগত ক্ষেত্র হিসাবে আপনারা হাতিনের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত আছেন। সেখানে আমরা তেমন স্থান পেয়ে যাবো যেখানে আমরা খৃস্টানদেরকে ময়দানে পেতে চাই।

আমরা এবার কোন নীতিতে যুদ্ধ চালাবো সে কথা আমি আপনাদের আগেই জানিয়েছি। আমি আবারো বলছি, যুদ্ধের জন্য আপনারা সেই স্থান নির্বাচন করবেন, যেখানে ময়দানে আপনাদের প্রাধান্য বজায় থাকবে।

ময়দান নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখার পূর্ব শর্ত হচ্ছে অনুকূল স্থানে শত্রুকে টেনে আনা, যাতে ময়দান আপনাদের উপকারে আসে ও শত্রু বিপাকে পড়ে যায়। এমন ময়দানে একমাত্র হা’তিনেই পাওয়া সম্ভব।

যুদ্ধ জয়ের শর্ত হচ্ছে, গোপনীয়তার সাথে দ্রুত ও দৃঢ় পদক্ষেপে ময়দানে পৌঁছা এবং শত্রুকে সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা।’

তিনি সেনাপতিদের হা’তিনের ম্যাপ দেখিয়ে বললেন, ‘হা’তিন এলাকায় উচ্চ ভূমিও আছে, পানিও আছে। আপনারা এই দুটো জয় করতে যুদ্ধ অর্ধেক জয় হয়ে যাবে।

কিন্তু এমন ময়দানে শত্রুকে নিয়ে আসা সহজ নয়। আমাদের পরিকল্পনার প্রত্যেকটা অংশ কার্যকরী হতে হবে। নয়তো একটা অংশের জন্য সমস্ত পরিকল্পনাই ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হতে পারে।

আমরা এই মাসের মাঝামাঝি দামেশক থেকে যাত্রা করতে পারি। আমি হলব ও মিশরে কাসেদ পাঠিয়ে বলেছি তারা যেন প্রস্তুত থাকে। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা যেন দ্রুত গতিতে এসে আমাদের সাথে রাস্তায় মিলিত হয়।

তারপর আমাদের সমস্ত সৈন্য এক জায়গায় একত্রিত করে বাইরে থেকে আসা সৈন্য ও আমাদের নিয়মিত সৈন্যদের মিশিয়ে দিয়ে নতুন করে সাজাতে হবে। নতুন সৈন্য বিন্যাস ও প্ল্যান সেনাপতি ও কমাণ্ডারদের বুঝিয়ে তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দিতে হবে।

আমাদের অগ্রাভিযানের ধরন ও পথ হবে ভিন্ন। এ মুহূর্তে গোপনীতার দিকে আমাদের সবচেয়ে বেশী সতর্ক থাকবো। সেনাপতি ও কমাণ্ডাররা ছাড়া আর কেউই কিছু জানতে পারবে না। আমাদের গোয়েন্দারা শত্রু এলাকায় থেকে প্রতিনিয়ত তাদের গতিবিধি জানিয়ে যাচ্ছে। আমরা দুশমন গোয়েন্দাদের এমন সুযোগ দিতে চাই না।

এখন প্রয়োজন দুশমন গোয়েন্দাদের অন্ধ ও বধির করে দেয়া। বিভিন্ন পথে সৈন্য চালনা করে আমরা তাদের বিভ্রান্ত করে দিব যাতে তাদের পাঠানো সংবাদগুলো পরস্পর বিরোধী হয়।

হাসান বিন আবদু্ল্লাহ এ ব্যাপারে কাজ করছে। আমি এ ব্যাপারে তাকে কিছু নির্দেশ আগেই দিয়ে রেখেছি। আমি আপনাদের একটি ব্যাপার জানিয়ে রাখছি, সৈন্যদলের একটি অংশ আমার সাথে ক্রাকে পৌঁছবে। আমার গতি সম্পূর্ণ গোপন থাকবে। চার বছর আগের প্রতিজ্ঞা পূরণের সময় হয়েছে এখন।

সুলতান আইয়ুবীর প্রতিজ্ঞাটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। চার বছর আগের ঘটনা তিনি সবাইকে মনে করিয়ে দিলেন। তখন খৃস্টান সরকার মুসলমানদের হজ্জের কাফেলায় হামলা চালিয়ে পুরুষদের হত্যা ও মহিলাদের ইজ্জত লুট করতো। আর বাচ্চা মেয়ে শিশুকে নিয়ে এনে গোয়েন্দা ট্রেনিং দিয়ে পাঠিয়ে দিত মুসলমানদের চরিত্র হননের জন্য। ছেলে শিশুকে হত্যা করতো যাতে মুজাহিদের সংখ্যা বাড়তে না পারে।

হজ্জ মৌসুমে ক্রাকের খৃস্টান সম্রাট আরনাতের নির্দেশে খৃস্টান সৈন্যরা হাজীদের লুট করার জন্যে ওত পেতে বসে থাকতো। এ জন্য সম্রাট আরনাত গর্ব করে বেড়াত। নিরস্ত্র হাজীদের লুট ও খুন করার সংবাদে তার বুক আনন্দে ও গর্বে ভরে উঠতো। এই ডাকাতি করাটাই তার কাছে যুদ্ধ জয়ের সমান বলে পরিগণিত হতো।

১১৮৩ সালের হজ্জ মৌসুমে হেজাজ থেকে মিশরের পথে অগ্রসর একটি হজ্জ কাফেলা লুট করলো আরনাতের সেনাবাহিনী। এই কাফেলায় ছিল সুলতান আইয়ুবীর এক কন্যা।

এই খবর যখন সুলতানের কানে পৌঁছলো, সুলতান আইয়ুবী চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘হায়! এ কাফেলায় যে আমার মেয়ে ছিল।’ সুলতান তখুনি এর প্রতিশোধের কসম খেয়ে বললেন, ‘আরনাতের এই অমানবিক ও পাশবিক অত্যাচারের মাধ্যমে সে শুধু আমার মেয়েকেই অপবিত্র করেনি, পুরো মুসলিম নারী সমাজকে কলঙ্কিত করেছে। আমি কসম খেয়ে বলছি, আমি তাকে ক্ষমা করবো না, আমি নিজ হাতে তাকে হত্যা করবো।’

উপস্থিত সবারই চোখ পানিতে ভরে গেল। তাদের মনে পড়ে গেল চার বছর আগের সেই দুঃসহ স্মৃতি। তারা সবাই সুলতানের মনোবেদনা অনুভব করে নিজেরাও কাতর হয়ে পড়লো। সুলতানকে তারা এমন ভঙ্গিতে আর কখনো কথা বলতে দেখেনি।

মাথা নিচু করা লোকগুলো এক সময় চোখ তুলে তাকাল সুলতানের দিকে। দেখলো রাগে, ক্ষোভে, কষ্টে সুলতানের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেছে। সেখানে খেলা করছে শপথের দৃঢ়তা ও তীব্র উত্তেজনা।

পরিস্থিতি যাই হোক, সুলতান উত্তেজিত ও ক্ষিপ্ত হওয়া পছন্দ করতেন না। কিন্তু আজ তার ক্ষিপ্ত ও এই উত্তেজিত চেহারা দেখে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে। সবাই বুঝে নিল, যে আজকের এই প্রতিজ্ঞা থেকে সুলতানকে কেউ ফেরাতে পারবে না।

সকল খৃস্টান সম্রাটই ইসলাম বিরোধী ও মুসলমানদের শত্রু। তবে সম্রাট আরনাতের সাথে আর কারো তুলনা চলে না। সে রাসুল (সাঃ) কে অবমাননা করতো। বন্দী মুসলমানদের নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে রাসুল (সাঃ) কে অপবাদ দিত ও গালমন্দ করতো। বন্দীদের বলত, এখন ডাকো তোমার আল্লাহকে। ডাকো তোমার রসুল কে। পড় তোমার আল্লাহর বানী। দেখি কেমন করে তুমি ছাড়া পাও। হা হা হা।’

এভাবে বন্দী ‍মুসলমানদের তিরষ্কার করতো এবং উচ্চস্বরে হাসতো। তার এ আচরণ সম্পর্কে সবাই জানতো, আইয়ুবীও জানতেন।

আজ চার বছর পর যখন তাঁর মনে হলো চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে, তখনি তার মনে পড়ে গেল অতীতের সেই বেদনাদায়ক স্মৃতি। তিনি কমাণ্ডার ও সেনাপতিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই হতভাগা আরনাতের সাথে বোঝাপড়ার সময় হয়েছে। আমি নিজে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে চাই। বন্ধুরা তোমরা দোয়া কর যাতে আল্লাহ আমাকে সেই সুযোগ ও সাহস দান করেন, যাতে আমি আমার প্রিয়তম রাসুলের অবমাননাকারীর অপমানের প্রতিশোধ নিতে পারি।’

আমি আশা করি, তিন মাসের মধ্যেই আমি তোমাদের সাথে মিলিত হতে পারি। তিন মাস পর নতুন ঋতু শুরু হবে। তার আগেই আমি হাতিন এলাকায় পৌঁছে যাবো।

তোমরা জানো যে আগামী ঋতুতে প্রচণ্ড গরম থাকবে। মরুভূমি তখন ফুটতে থাকবে জলন্ত অঙ্গারের মত। আমি খৃস্টানদের তখন যুদ্ধে নামাবো। প্রচণ্ড গরমে তাদের লৌহবস্ত্রগুলো আগুনের মত গরম হয়ে তাদের সিদ্ধ করে ফেলবে। আমরা আঘাত হানার আগেই খৃস্টানরা নিজের দেহে জড়ানো অগ্নিকুণ্ডে ভস্মীভূত হয়ে যাবে।’

ঐতিহাসিকগণ ও ইউরোপের যুদ্ধ অভিজ্ঞ সমালোচকগণ সুলতান আইয়ুবীর এই পদক্ষেপের প্রশংসা করে বলেছেন, ‘তিনি যুদ্ধের জন্য যে ঋতু বেছে নিয়েছিলেন সেটা ছিল জুন মাস। এ সময় মরুভুমি জ্বলন্ত কয়লার মত গরম থাকে।

গ্রীষ্মের এ প্রচণ্ড দাবদাহ খৃস্টান সৈনিকদের জন্য ছিল মৃত্যুর ফাঁদের মত। লোহার শিরস্ত্রান ও পোষাক তাদের নিরাপদ না করে বরং তন্দুরের মত ভাজা ভাজা করছিল।

খৃস্টান নাইটরা আপাদমস্তক লৌহবর্ম ও মোটা চামড়ার পোষাক পরতো। তাই তীর ও তলোয়ারের আঘাত তাদের সহজে ক্ষতি করতে পারতো না। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী তাদের এ লোহার বর্ম ও পোষাককে তাদের জন্য বড় বিপদ ও ক্ষতির কারন বানিয়ে দিলেন।

একে তো তিনি কমাণ্ডো ধরনের যুদ্ধ করতেন। সামান্য সৈন্য দিয়ে পাশ থেকে বিদ্যুৎ বেগে আক্রমণ চালিয়ে প্রতিপক্ষের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে সরে পড়তেন। এই ধরনের আক্রমণ চালানোর জন্য দরকার ক্ষীপ্ত গতির সৈনিক। কিন্তু লোহার পোষাক পড়ে খৃস্টান সৈন্যদের পক্ষে দ্রুত গতিতে চলা সম্ভব ছিল না। আইয়ুবী এই সুযোগটাই নিতেন। তার সৈন্যরা ক্ষীপ্ত গতিতে আক্রমণ চালাতো এবং দ্রুত গতিতে সরে পড়তো।

জুনের খরতাপে রোদ্দুর যখন মাথার উপর থাকে মরুভুমি তখন আগুনের কুণ্ড হয়ে যায়। লোহার পোষাক তপ্ত তাওয়ার মত জ্বলতে থাকে। পিপাসায় কন্ঠ ও শরীর শুকিয়ে যায়।

মরুভুমির ঝলসানো তাপ মুসলিম সৈন্যদেরও অসুবিধার সৃষ্টি করতো। কিন্তু তাদের পোষাক হালকা পাতলা হওয়ায় তাদের অবস্থা থাকতো তুলনামূলকভাবে ভালো।

যুদ্ধের আগেই সুলতান আইয়ুবী পানি নিজের দখলে নিয়ে নিতেন। আর তিনি তার সৈন্যদের এমন কঠিন প্রশিক্ষণ দিতেন যাতে যুদ্ধের সময় কেউ ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর না হয়। তিনি সৈন্যদের বলতেন, ‘বদরের যুদ্ধ হয়েছিল রমজান মাসে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা জয় করে জেহাদের প্রেরণা আমাদের সেখান থেকে নিতে হবে।

শারিরীক ট্রেনিং ছাড়াও তিনি মানসিক ও আধ্যাত্নিক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতেন। তিনি বলতেন, ‘মানসিক শক্তি শারিরীক শক্তির চেয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে অনেক বেশী উপকারী। যেই সেনাপতি তার সৈন্যদের এই শক্তিতে বলীয়ান করতে পারে তারা যুদ্ধ বিজয়ী হয়।

তিনি সৈন্যদের বলতেন, ‘তোমরা আল্লাহর সৈনিক। ইসলামের সতন্ত্র প্রহরী। কারো চাকর নও যে তোমাদের ত্যাগ বিফলে যাবে। আল্লাহই তোমাদের এই বিরল সম্মানের অধিকারী করেছেন, আর মৃত্যুর পর তোমাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। গনীমত জিহাদের আসল পুরস্কার নয়, আসল পুরস্কার আল্লাহর হাতে।

সৈন্যদেরকে জাতীয় দায়িত্বের কথা ও বিশ্বের নির্যাতিত মুসলমানদের কথা শুনানো হতো। বলা হতো, ‘তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে মজলুমের পাশে দাঁড়ানো। তোমাদের মা, বোন যাদেরকে খৃস্টানরা ধরে নিয়ে গেছে তাদের আহাজারিতে আল্লাহর আরশ কেপে উঠছে।

তোমরা জানো খৃস্টান শাসিত অঞ্চলে মুসলমানদের পশুর মত জীবন যাপন করতে হয়। তাদের অশ্রু মোছানোর দায়িত্ব তোমাদের। পৃথিবীর যেখানেই অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, সেখানেই তোমরা জালিমের মুলোচ্ছেদ করবে। এখন হোক সে জালিম খৃস্টান, ইহুদী অথবা নামধারী মুসলমান। যদি কোন মুসলমান মানবতার বিরুদ্ধে যায়, সে মুসলমান নামের কলঙ্ক, সে রাসুলের সুন্নাতের বিরোধী, আল্লাহর নাফরমান।’

তিনি বলতেন, যারা শহীদদের ভুলে যায়, নির্যাতিত মানুষের কথা ভুলে যায়, তারা বিজাতির গোলাম হয়। যে জাতি গাদ্দারদের মাথায় তুলে নাচে তাদের অন্ধকার রজনী কোনদিন ভোরের আলো দেখেনা। আর গাদ্দাররা মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির প্রয়াস খুজে পায়। বিবেক বর্জিত পথে ঠেলে দেয় মানুষকে।