» » ধাপ্পাবাজ

বর্ণাকার

সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছিল। হিম্মাতের পাহাড়ী এলাকা দিয়ে মুসলিম সেনাক্যাম্পের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তানভীর। সামনের দিক থেকে একদল ঘোড় সওয়ার ছুটে এলো। তানভীর রাস্তার এক পাশে সরে গেল। এক অশ্বারোহী ছুটে তার কাছে এসে রাগের সথে বললে, ‘হটো, হটো। রাস্তা থেকে সরে যাও, প্রধান সেনাপতি আসছেন।’

তানভীর আরেকটু সরে রাস্তার আরো পাশ ঘেঁষে চলতে লাগলো, কিন্তু দাঁড়াল না। অশ্বারোহী বললো, ‘আরে থামো। রাস্তা থেকে নিচে নেমে দাঁড়িয়ে যাও।’

এ কথায় তানভীর কিছুটা অপমান বোধ করলো। সে রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল বটে, কিন্তু নিচে নামল না, বরং তার সাথে তর্ক জুড়ে দিল।

সেনাপতি তকিউদ্দিন এগিয়ে আসছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, তার রক্ষী এক পথিকের সাথে রূঢ় আচরণ করছে।

তকিউদ্দিন ওদের কাছে এসে থেমে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে? তোমরা ঝগড়া করছো কেন?’

তানভীর শান্তভাবে বললো, ‘আমি হেমস থেকে যুদ্ধের অবস্থা জানতে এসেছি সুলতান। ও আমাকে জোর করে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে।’

‘কি জানতে চাও তুমি?’

‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সৈন্যদল এখন কি অবস্থায় আছে এবং ক্রুসেড বাহিনী কতদূর সাফল্য লাভ করেছে?’

‘কি জন্য জানতে চাও?’

‘হেমসের মুসলমানরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তারা সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করছে।’

‘কেমন প্রস্তুতি চলছে সেখানে?’

‘ওখানে পূর্ণোদ্যমে প্রস্তুতি চলছে। আমাদের বোনেরাও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রয়োজনে এখনো যারা একেবারে বুড়িয়ে যায় নি সেই সব বুড়োরাও যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। এমনকি আমরা আমাদের বাচ্চাদেরও অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।’

সেনাপতি তকিউদ্দিনের সঙ্গে ছিলেন আলী বিন সুফিয়ানের সহকারী গোয়েন্দা প্রধান হাসান বিন আবদুল্লাহ। তিনিই এখানে গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্ব পালন করছিলেন।

তানভীরকে তিনি গভীরভাবে লক্ষ্য করছিলেন। এ কি কোন গোয়েন্দা? প্রশ্নটা বার বার আঘাত করছিল তার মাথায়। কিন্তু ছেলেটির সরলতা বলছে, সে গেয়োন্দা নয়। তবুও তার সন্দেহ যায় না। সার্থক গোয়েন্দা তো সেই, যে তার পরিচয় গোপন করতে পারে। এই সরলতা ছেলেটির ছদ্মবেশ নয়তো? যদি সে চৌকস গোয়েন্দা হয়ে থাকে তবে সরল গ্রাম্য বালকের চাইতেও সে নিজেকে সরল হিসাবে প্রকাশ করতে পারবে, এটাই তো স্বাভাবিক!

তানভীরের কথা শুনে হাসান বিন আবদুল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের খতিবের নাম কি?’

তানভীর খতিবের নাম বললো। হাসান বিন আবদুল্লাহ তাকে আরো কিছু প্রশ্ন করে নিশ্চিত হলেন, এ ছেলে গোয়েন্দা নয়। তানভীরের ব্যাপারে সৃষ্ট সন্দেহ দূর হয়ে গেলে তিনি তকিউদ্দিনকে বললে, ‘এ লোক সত্যি কথাই বলছে। তার কথায় বুঝা যাচ্ছে, হেমসের লোকরা মনেপ্রাণেই জেহাদের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।’

তিনি তানভীরের দিকে ফিরে বললে, ‘তুমি ক্যাম্পে গিয়ে অপেক্ষা করো। আমরা একটু পরই ফিরে আসবো। তোমার সাথে আরো কথা আছে। আমার সাথে কথা না বলে হেমসে ফিরবে না।’

তকিউদ্দিন তাকে ক্যাম্পের মেহমানখানায় পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে তাকে যথেষ্ট খাতির যত্ন করা হলো। রাতে হাসান বিন আবদুল্লাহ তাকে নিজের তাঁবুতে ডেকে নিলেন। তার হাতে একটি চিঠি দিয়ে বললেন, ‘এ চিঠি খতিবের কাছে পৌঁছে দিয়ে বলবে, অবস্থা সংকটময় ঠিকই, কিন্তু তেমন কঠিন নয়, যেমনটি খৃষ্টান ও ইহুদীরা প্রচার করছে। লোকদের কাছে সত্য গোপন করার দরকার নেই। খতিবকে বলবে, বর্তমান নাজুক অবস্থা জনগণের সামনে তুলে ধরে তিনি যেন জনতাকে তার মোকাবেলার জন্য জাগিয়ে তোলেন। রমলার পরাজয়ের জবাব আমরা খৃস্টানদের দিয়ে দিয়েছি। ইনশাআল্লাহ আগামীতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে যেটা ওরা কল্পনাও করতে পারবে না। তারা অনেক বিশাল বাহিনী নিয়ে এসেছে, এজন্য তাদের কবর খুঁড়তে আমাদের কিছুটা বেশী সময় লাগছে।

খতিবকে বললে, জনতার মনের সাহসকে অটুট রাখার জন্য যেন তিনি সচেষ্ট থাকেন। কিছুতেই গুজবে কান দেবে না। হাওয়া থেকে পাওয়া খবরকে কখনোই সত্য মনে করবে না। তোমরা একটি বিপদসংকুল এলাকায় বসবাস করছো। তোমাদের এলাকার ইহুদী ও খৃস্টানদের দিকে কড়া দৃষ্টি রাখবে। এটাও খেয়াল রাখবে, তারা যেন তোমাদের সকল তৎপরতার খবর না পায়। গোপন তৎপরতা গোপন রাখবে। কতটুকু তাদের জানানো যায়, তিনি যেন হিসেব নিকেশ করে তা প্রকাশ করেন। নিজেদের সকল শক্তি দুশমনের সামনে প্রকাশ করা যেমন বুদ্ধিমানের কাজ নয়, ‘তোমনি তারা যেন তোমাদের শক্তি ও তৎপরতাকে অবজ্ঞার চোখে দেখার সাহস না পায় সেদিকে নজর রাখাও তোমাদের কর্তব্য।’

হাসান বিন আবদুল্লাহ তানভীরকে আরো কিছু সংবাদ দিলে, যে সংবাদ হেমসের মুসলমানদের মনোবল বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু তাকে জানতে দিলেন না, হেমসে যে তৎপরতা চলছে তা সুলতান আইয়ুবীর নির্দেশেই চলছে।

এই খতিব সামরিক বাহিনীর একজন অফিসার। সুলতানই তাকে হেমসে পাঠিয়েছেন। তাকে হেমসে বসিয়ে রাখার উদ্দেশ্য ছিল, প্রয়োজনের সময় তিনি যেন ক্রুসেড বাহিনীর উপর পেছন থেকে কমাণ্ডো আক্রমণ চালাতে পারেন।

কিভাবে গেরিলা আক্রমণ করে পালিয়ে যেতে হয়, হেমসের স্বেচ্ছাসেবকদেরকে তা শেখানো হচ্ছিল। এ জন্য হেমসে চার জন গেরিলা কমাণ্ডারকে আগেই পাঠানো হয়েছে। তারা সেখানে পরিকল্পনামাফিক ট্রেনিং দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এসব কথা তানভীর কিছুই জানতো না।

খতিব এখনো সেই সব কমাণ্ডোদের সাথে কোন যোগাযোগ করেননি। কারণ এখনো তিনি তাদের সাথে যোগাযোগ করার প্রয়োজন অনুভব করছেন না। তিনি তানভীরের কাছ থেকে যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এই পরিস্থিতি জানার ওপরই নির্ভর করছিল তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা।

পরের দিন সকালে তানভীর হেমসের দিকে যাত্রা করলো। সে যুগে লোকজন দূরের রাস্তা দল বেঁধে পাড়ি দিত। যারা একাকী পথ চলতো তারাও পথে নেমেই তালাশ করতো কোন কাফেলার। যখন কাফেলা দেখতে পেতো, তাদের সাথে যোগ দিয়ে এগিয়ে যেতো গন্তব্যে। এভাবে কাফেলা ধীরে ধীরে বড় থেক বড় আকার ধারণ করতো।

তানভীর একাই পথ চলছিল। সংবাদ নিয়ে দ্রুত দেশে ফিরে যাওয়ার তাড়া ছিল বলে কোন কাফেলায় শরীক হওয়ার জন্য সে উদগ্রীব ছিল না। পথে বিপদ সম্পর্কে নির্বিকার হয়ে সে একাকী পথ চলছিল।

কাফেলায় শরীর হওয়ার ব্যাপারে তার চেষ্টা ও ব্যস্ততা না থাকলেও বিনা চেষ্টাতেই পথিমধ্যে সে এক কাফেলার সাক্ষাৎ পেয়ে গেল। কাফেলাটি হেমসের দিকেই যাচ্ছিল। এ কাফেলায় ছিল হেমসের কিছু ইহুদি বনিক এবং দু’টো খৃস্টান পরিবার।

খৃস্টান পরিবার দু’টো ছিল উটের উপর সওয়ার। ইহুদীদের অধিকাংশই ছিল অশ্বারোহী। কিছুলোক আবার পদব্রজেও পথ চলছিল।

তানভীর সেই কাফেলায় যোগ দিল। কাফেলা চলছে তো চলছেই। দীর্ঘ রাস্তা অতিক্রম করতে হবে বলে ওদের মধ্যে কোন তাড়াহুড়ে ছিল না। বরং সকলেই সমানে পথ চলার জন্য কিছু শক্তি সঞ্চয় করে রাখছিল এবং আস্তে ধীরে এগুচ্ছিল।

দুটি দিন ও রাত কেটে গেল রাস্তায়। তৃতীয় দিন, সফরের শেষ দিন। আজ একটানা পথ চললে মধ্যরাতের আগেই কাফেলা হেমসে পৌঁছে যাবে।

পথে সামনে একটা নদী পড়বে। নদীটি বেশ বড় নয়। পানির গভীরতাও কম। খুব বেশী হলে কোমর পর্যন্ত পানি। এ নদীটি পারাপারের জন্য লোকেরা কোন নৌযান ব্যবহার করতো না, হেঁটেই নদী পার হয়ে যেত।

সূর্য মাথার উপর উঠে এসেছে। কাফেলা সূর্যের খরতাপ উপেক্ষা করে এগিয়ে চললো। বিকালের দিকে আকাশে কলো মেঘ দেখা গেল। দ্রুত সে মেঘে সারা আকাশ ছেয়ে গেল। সূর্যের খরতাপ মিলিয়ে গিয়ে মরুভূমিতে নেমে এলো অন্ধকার।

কাফেলা চলার গতি বাড়িয়ে দিল। ঝড় বা বৃষ্টি আসার আগেই ঠিকানায় পৌঁছে যেতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু তা সম্ভব নয়। কোন পাহাড় বা টিলার আড়ালে আশ্রয় নেয়ার জন্য দ্রুত ছুটছিল ওরা। উন্মুক্ত মরুভূমিতে ঝড়ে পড়ার বিপদ সম্পর্কে সবাই কম-বেশী অবগত।

অন্ধকার ঘনীভূত হতে দেখে প্রমাদ গুনলো কাফেলার লোকজন। তারা দিশেহারার মত ছুটতে শুরু কললো।

কিন্তু এটা ছিল কাফেলার লোকদের নির্বুদ্ধিতা ও বোকামী। মেঘের গতি কাফেলার গতির চেয়ে অনেক বেশী বেগবান। কাফেলা কোন গন্তব্যে পৌঁছার আগেই মেঘ প্রবল বর্ষণ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো কাফেলার ওপর। কোথাও আশ্রয় নিতে না পেরে ভারী ভর্ষণে ভিজে একাকার হয়ে গেল সবাই।

কাফেলা যখন দীর পাড়ে গিয়ে পৌঁছলো তখনো মেঘ দুনিয়া অন্ধকার করে মুষলধারায় বর্ষণ করে চলছে। বৃষ্টির কারণে সমানে বেশী দূর দেখা যায় না। বৃষ্টির ঝাপটার ফলে চোখ খুলে পথ চলাও কঠিন হয়ে দাঁড়াল।

নদী তীরে পৌঁছে ওরা দেখতে পেল নদীর পানি বেশ বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় কি করবে ভেবে পেল না কাফেলা। এক বৃদ্ধ খৃস্টান চিৎকার করে বললো, ‘নদী ভরে যাচ্ছে। আমার বিশ্বাস, এখনও পার হওয়া যাবে। যদি ওপারে যেতে চাও দেরী না করে জলদি সবাই নেমে এসো।’

বৃদ্ধ চিৎকার করছিল আর নদীর পার বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছিল। তার দেখাদেখি কাফেলার অন্যরাও নদীতে নেমে পড়লো।

বৃদ্ধের সাথে উটের উপর এক যুবতী আরোহী ছিল। কাফেলার কেউ কেউ নদীতে নেমে গেলেও অনেকেই পাড়ে দাঁড়িয়ে নদীত পানির স্রোত লক্ষ্য করছিল। নদীর পানি ছিল ভীষণ ঘোলা, স্রোতও ছিল তীব্র।

পানির গভীরতা তখনও বেশী হয়নি, কিন্তু মুষলধারায় বৃষ্টি ও ঘন মেঘের কারণে অন্ধকার হয়ে এসেছিল চার ধার। সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই সন্ধ্যা নেমে এসেছিল নদীর তীরে।

বুড়োর দেখাদেখি যারা নদীতে নেমেছিল তাদের একজন ঘোাড়ার ওপর বসেই পেছন ফিরে ডেকে বললো, ‘তোমরাও নেমে পড়ো। দেরী করলে পানির গভীরতা বেড়ে যাবে। তখন আর নদী পেরোতে পারবে না। যারা পদাতিক তারাও নেমে আসতে পারো, এখনো নদীতে পানি তেমন গভীর হয়নি।’

আসলে নদী পার হওয়ার তাড়া তাদের ব্যাকুল করে তুলেছিল, তাই নদীর স্রোতের ভয়াবহতা কাউকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। কিন্তু একটু গভীরভাবে কেউ নদীর দিকে তাকালেই দেখতে পেতো, দ্রুত নদীর পানি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

আরো কিছু লোক নদীতে নেমে গেল। বর্ষণের বেগের সথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নদীর পানি। বাড়ছে স্রোতের তীব্রতা। লোকগুলো ছুটছে ওপারের দিকে। নদীর চেহারা কতটা বিকট ও ভয়ংকর হয়ে উঠছে তা নিয়ে ভাববার সময় পায়নি কেউ, কিন্তু উট ও ঘোড়া বিপদের তীব্রতা ঠিকই বুঝতে পারছিল।

স্বাভাবিক সময়ে এসব প্রাণী অনায়াসেই নদী পার হয়ে যায় কিন্তু প্লাবনের আশংকায় অবুঝ প্রাণীগুলোও ভয় পাচ্ছিল। পানি তখনো তেমন গভীর ছিল না, কিন্তু কাফেলার লোকদের বেশী দূর যাওয়ার সুযোগ হলো না। সহসাই উজান থেকে পাহাড়ী ঢলের পানি নেমে এলো তীব্র বেগে। দেখতে দেখতে ভরে গেল নদী। প্রবল ঢেউ আর কঠিন স্রোত কাউকে সতর্ক হওয়ার সুযোগ দিল না। নদীর পাড় ভাসিয়ে নিয়ে গেল সে স্রোত।

প্রথমে পানির নিচে তলিয়ে গেল পদাতিক যাত্রীরা। তারা তখন বাঁচার আশায় সাঁতার কাটতে লাগলো। যারা সামনে ছিল তারা অল্প দূরেই দেখতে পাচ্ছিল নদীর অপর পাড়। কিন্তু সেই পথটুকুও পার হতে পারছিল না তারা। প্রাণপণ চেষ্টা করে এক হাত এগোয় তো স্রোতের টানে দু’হাত পিছিয়ে পড়ে।

উট এবং ঘোড়াগুলো এ অবস্থা দেখে আর্তনাদ শুরু করলো। কাফেলার লোকজন দেখতে দেখতে একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। শেষে অবস্থা এমন হলে, কাফেলার কে কোথায় আছে কেউ তার খবরও নিতে পারলো না।

বুড়োর সাথে খৃস্টান মেয়েটা চিৎকার করে উঠলো। তানভীর তাদের নিকটেই ছিল, সে চিৎকার শুনে তাকালো মেয়েটির দিকে। দেখলো, মেয়েটি উটের পিঠে বসে থাকতে পারছে না। প্লাবনের সাথে লড়াই করতে গিয়ে উটটি বেদম দুলছে। সেই দুলুনির কারণে উটের পিঠ থেকে যে কোন সময় ছিটকে পড়তে পারে মেয়েটি।

সহসা মেয়েটির পা উটের পিঠ থেকে পিছলে গেল। মেয়েটি আবারো আর্তচিৎকার করে আঁকড়ে ধরলো উঠের রশি এবং হাঁচড়ে পাঁচড়ে তার পিঠে চড়ে বসলো।

প্লাবন উটটিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। উটটি হাবুডুবু খাচ্ছিল নদীর মাঝে। ঝড়ের প্রকোপে নদীর ঢেউ কখনো উপরে আবার কখনো নিচে নামছিল। কখনওবা পাকে ঘুরপাক খাচ্ছিল।

ঝড়ের তাণ্ডবে এবং মানুষের চিৎকারের আওয়াজ একাকার হয়ে যাচ্ছিল। ফলে কারো চিৎকারের আওয়াজ কেউ শুনতে পাচ্ছিল না। যদি তানভীর মেয়েটির একদম সন্নিকটে না থাকতো, তবে মেয়েটির চিৎকারও সে শুনতে পেত না।

তানভীর ছিল অশ্বারোহী। তার ঘোড়াও ছিল যথেষ্ট তাগড়া। তারপরও সে ঘোড়া সোজা ওপারের দিকে যেতে পারছিল না। স্রোত তাকেও ভাটির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তানভীর প্রাণপণে চেষ্টা করছিল ঘোড়াকে ওপারে নিয়ে যেতে। ঘোড়াও সাধ্যমত চেষ্টা করছিল প্রভুর হুকুম তামিল করতে।

এ সময় তানভীর মেয়েটিকে পানিতে পড়ে যেতে দেখলো। সঙ্গে সঙ্গে সে ঘোড়া নিয়ে মেয়েটির সাহায্যে এগিয়ে গেল।

ঘোড়ার মুখ মেয়েটির দিকে ঘুরিয়ে নিলেও দ্রুত সেদিকে এগুতে পারছিল না তানভীর। অগত্যা ঘোড়া ত্যাগ করে নিজেই দ্রুত সাঁতরে মেয়েটির কাছে গেল।

মেয়েটি পানিতে পড়ে গেলেও উটের রশি ছাড়েনি। ফলে পানিতে পড়ার পরও মেয়েটি হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেল।

একটা ঢেউ যখন মেয়েটিকে উপরে উঠালো তখন তানভীর তাকে দেখতে পেল। যদিও তুফানের বেগ ছিল উল্টো দিকে তবু যুবক তানভীরের বলিষ্ঠ বাহু হার মানলো না। সে স্রোতের প্রবল তোড় উপেক্ষা করে মেয়েটির সাথে তার যে সামান্য দূরত্ব ছিল তা অতিক্রম করে গেল এবং মেয়েটিকে ধরে ফেলতে সক্ষম হলো।

উটের রশি ছাড়েনি বলে মেয়েটি ডুবে যায়নি ঠিক, কিন্তু তার আার সাঁতরানোর ক্ষমতা ছিল না। স্রোতের প্রতিকূলে লড়াই করতে গিয়ে তার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। তানভীরের পক্ষেও তাকে সামলানো কঠিন হয়ে দাঁড়ালো।

তাকে বাঁচাতে গিয়ে স্রোতের অনুকূলে অনেক দূর পিছিয়ে গেল তানভীর। স্রোত তাদের ভাটির দিকে বহুদূর টেনে নিয়ে গেল।

তানভীর মেয়েটাকে তার পিঠের উপর উঠিয়ে নিয়েছিল। স্রোতের অনুকূলে থেকে একটু একটু করে তীরের দিকে সাঁতরে চলছিল তানভীর।

মেয়েটি বার বার পিঠের উপর থেকে পড়ে যাচ্ছিল। তানভীর খেয়াল করে দেখল, মেয়েটি জ্ঞান হারিয়েছে। যদি তানভীরের বাহুতে প্রচণ্ড বল ও মনে প্রবল সাহস না থাকতো, তবে সে মেয়েটিকে আগেই ছেড়ে দিয়ে নিজের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করতো। কিন্তু দুঃসাহসী তানভীর মেয়েটিকে নিয়ে প্লাবনের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখলো। এক সময় তার বাহুও দুর্বল হয়ে এলো।

যে স্থান থেকে কাফেলা নদীতে নেমেছিল, সেখান থেকে কম বেশী দুই মাইল দূরে ভাটিতে তানভীর মেয়েটিকে নিয়ে নদীর কিনারে উঠতে সক্ষম হলো। এখানে নদীর পারে তানভীর দেখতে পেল মরুভূমির বদলে ছোট বড় অসংখ্য পাহাড়। সেই পাহাড়ের গায়ে কোনমতে আছড়ে পড়ে মেয়েটির পাশে কিছুক্ষণ নিঃসাড় হয়ে পড়ে রইলো তানভীর।

তখনো বৃষ্টি থামেনি, তবে বৃষ্টির তোড় কমে এসেছিল। একটু পর তানভীর উঠে বসে মেয়েটির নাড়ি পরীক্ষা করলো। দেখলো মেয়েটি তখনও জীবিত। সে মেয়েটিকে নিয়ে একটা সমান পাথরের ওপর শুইয়ে দিল।

মেয়েটি জীবিত থাকলেও তার তখনো জ্ঞান ফেরেনি। এই অসম লড়াইয়ে তানভীরের শরীর ও মন দুটোই ভেঙে পড়েছিল। ক্লান্তি ও অবসাদ ঘিরে ধরেছিল তাকে। মেয়েটিকে পাথরের ওপর শুইয়ে দিয়ে সেও তার পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো।

শুয়ে শুয়েই সে মেয়েটির হুঁশ ফেরার অপেক্ষা করতে লাগলো। হঠাৎ মেয়েটা নড়ে উঠলো এবং নড়তে গিয়ে উপুড় হয়ে গেল। ফলে মেয়েটির পেটের উপর চাপ পড়লো এবং তার মুখ দিয়ে নদীর ঘোলা পানি বের হতে লাগলো। তানভীর এ অবস্থা দেখে তার পিঠে ও কোমরে চাপ দিল। এতে মেয়েটির পেটের বেশীর ভাগ পানিই মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল। সে আরও জোরে চাপ দিল এবং পেটের দুই পাশ থেকেও চাপ দিল। তাতে মেয়েটার পেটের সমস্ত পানিই বের হয়ে পেট খালি হয়ে গেল।

বর্ষণের বেগ কমে গিয়ে ফর্সা হয়ে গেল আকাশ। পড়ন্ত সূর্যের কোমল আলো রাঙিয়ে দিল বর্ষণসিক্ত পাহাড়ের চূড়াগুলো।

তানভীর মেয়েটিকে আবার সোজা করে শুইয়ে দিল। মেয়েটি একটু নড়ে চড়ে চোখ খুললো এবং সঙ্গে সঙ্গেই আবার বন্ধ করে ফেললো চোখ। তানভীরের শরীর বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। সে আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল মেয়েটির পাশে।

তানভির তার ঘোড়ার কথা চিন্তা করছিল। ঘোড়াটি সে নদীতে ছেড়ে দিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। এখন একটি সংজ্ঞাহীন মেয়েকে নিয়ে সে ঘোড়া ছাড়া কেমন করে পথ চলবে? ঘোড়াটি নদীতে ডুবে মরেছে না তীরে উঠতে পেরেছে তাও তো জানা নেই।

তানভীর ঘোড়ার পরিনামের কথা ভাবতে লাগলো। যদি ঘোড়াটি তীরে উঠে থাকে এবং তাকে আবার ফিরে পাওয়া যায় তবে রাত্রি নাগাদ হেমসে পৌঁছার একটু আশা করা যায়। তানভীর উঠে পায়চারী শুরু করলো এবং এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলো, ঘোড়া বা কোন জনমানবের দেখা পাওয়অ যায় কি না।

পায়চারী করতে করতে তার ক্লান্তি কিছুটা কমে এলো। সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। সে ভাবলো, শিঘ্রই রাত নেমে আসবে। অসুস্থ একট মেয়েকে নিয়ে এই অন্ধকার রাতে পথ চলার চিন্তা করার অবকাশ নেই। তারচেয়ে রাত আসার আগেই কোথাও একটা আশ্রয় খুঁজে নেয়া প্রয়োজন।

এলাকাটা পাহাড়ী অঞ্চল। তার আশা ছিল, এখানে কোথাও না কোথাও পর্বত গহ্বর পাওয়া যাবে। দূরের যাত্রীরা বন্য প্রাণীর হাত থেকে বাঁচার জন্য পাহাড়ী এলাকায় রাত হলে আশ্রয়স্থল হিসেবে পাহাড়ের গর্ত ও সুড়ংই বেছে নেয়। তানভীর তেমনি একটা সুড়ং খুঁজছিল।

সে মেয়েটিকে পিঠের উপরে তুলে নিয়ে দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে চলতে লাগলো। কিছু দূর যাওয়ার পর ক্লান্তি এসে আবার তার কাঁধে ভর করলো। এক পাথরের ওপর মেয়েটিকে নামিয়ে বিশ্রাম নিতে লাগলো তানভীর।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সূর্য ডুবতে বসেছে। যে কোন মুহূর্তে টুপ করে হারিয়ে যাবে সূর্য। আশ্রয়ের কোন সন্ধান না পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লো তানভীর। কিন্তু সে আশা ছাড়লো না। মনে মনে এই বিপদ থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর সাহায্য কামনা করতে লাগল।

আলো কমে গিয়ে একটু একটু করে অন্ধকার হচ্ছিল প্রকৃতি। আবার মেয়েটিকে কাঁধে নিয়ে রওনা হলো তানভীর।

একটি পাহাড়ের টিলা পার হয়েই ও দেখতে পেল ওপাশে বেশ কিছুটা খোলামেলা জায়গা। সেখানে এক পাহাড়ের পাশে চারটি উট দাঁড়িয়ে আছে।

উটগুলো দেখেই সে বুঝে নিল, এগুলো কোন যাত্রীর উট নয়। কারণ উটের উপর কোন গদি বা জ্বীন আঁটা নেই।

সে উটের কাছে গেল এবং সেখানে গিয়েই সে নতুন বিষয় আবিষ্কার করলো। আশেপাশে কোথাও মানুষ আছে। কারণ সে পাহাড়ের এক দিক থেকে বালকদের শোরগোল ও চেঁচামেচি শুনতে পেল।

সে শব্দের উৎসের দিকে লক্ষ্য করে দেখলো সেখানে পাহাড়ের গায়ে একটু উঁচু টিলা এবং টিলার পাশে একটি গহ্বর। তেরো চৌদ্দ বছরের দুটি ছেলে সেখানে খেলছে। তানভীর অনুমান করলো, ছেলে দু’টি বৃষ্টির সময় দৌড়ে ওই গহবরের আশ্রয় নিযেছিল, বৃষ্টি চলে যাওয়ায় গহবরের বাইরে এসে খেলছে।

তানভীর মেয়েটিকে কাঁধে নিয়েই ছেলেদের দিকে এগিয়ে গেল। ছেলেরা ওদের দেখে বেশ অবাক হলো এবং কথা বন্ধ করে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে। ওরা কাছে যেতেই এক বালক বললো, ‘ওনার কি হয়েছে? আপনারা কি বানের সময় নদীতে নেমে ছিলেন?’

অন্য বালকটি ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে বললো, ‘ওনাকে এই গর্তের ভেতরে নিয়ে আসুন। এখানে খুব ভাল জায়গা আছে।’

গর্তটি সত্যিই খুব সুন্দর ও নিরাপদ। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আশপাশের লোক ও রাখালেরা এখানে নিয়মিত যাতায়াত করে। গর্তটিকে কেটে কেটে তারা একটা কামরার মত বানিয়ে নিয়েছে। গহবরের খোলা মুখটা এমনভাবে বানানো, তুমুল ঝড়-বৃষ্টিতেও ভেতরটা সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে। তাইতো এত মুষলধারার পরও ভেতরটা সম্পূর্ণ শুষ্ক ও পরিষ্কার।

বালকেরা আগে থেকেই কামরায় আগুন জ্বালিয়ে রেখেছিল। তানভীর দেখলো, ভেতরে চাটাইয়ের বিছানাও আছে।

তানভীর মেয়েটিকে বিছানার উপর শুইয়ে দিল। পেট থেকে পানি বেরোনোর পর ক্ষণিকের জন্য ওর জ্ঞান ফিরেছিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আবার জ্ঞান হারিয়েছে সে। এখনো তার সেই জ্ঞান আর ফিরে আসেনি।

গহবরের এক পাশে শুকনো ঘাস ও গাছের শুকনো ডাল-পাতা গাদা করে রেখে দেয়া ছিল।

মেয়েটিকে কাঁধ থেকে নামিয়ে এবার সে ছেলেদের দিকে নজর দিল। বললো, ‘তোমরা এখানে কি করছো?

‘আমাদের বাড়ী নদীর ওপারে।’ এক বালক উত্তর দিল, ‘আমরা মাঝে মাঝে উট চড়াতে নদীর এপারেও চলে আসি। এক জায়গায় নদী বেশ প্রশস্ত। সেখানে নদীর পানি হাঁটু পর্য়ন্ত থাকে। আজকে আমরা এখানে আসার পর ঝড়-তুফান ও বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে আমরা আমাদের খেলার ঘরে আগুন জ্বালিয়ে খেলা করছিলাম। বৃষ্টি থামার পর বাইরে এসে দেখি আপনারা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন।’

‘বাড়ী কি করে যাবে?’ তানভীর প্রশ্ন করলো, ‘নদী তো পানিতে ভরে গেছে?’

‘এই নদী বৃষ্টিতে ভরতেও যেমন দেরী লাগে না, আবার পানি কমতেও দেরী লাগে না।’ এক বালক খুব শান্তভাবে বললো, ‘আমারা যেখান দিয়ে যাতায়াত করি সেখানে প্লাবনের তেমন ভয় থাকে না। কারণ ওখানে পানি ছড়িয়ে পড়ে।’

বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। সূর্যও ডুবে গিয়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যার আবছা আলো তখনো বিরাজ করছিল পাহাড় জুড়ে। অন্ধকার জেঁকে বসার আগেই ছেলে দুটি তাদের উট নিয়ে বাড়ী চলে যেতে চাইল। যাওয়ার আগে জানতে চাইল, ‘আপনারা কি আমাদের গাঁয়ে যাবেন?’

‘না, এই জায়গাটা চমৎকার। এখানেই আমরা রাতটা কাটিয়ে সকাল সকাল বাড়ীর পথ ধরতে চাই।’

‘আপনাদের কিছু লাগবে?’

‘না, রাত করে তোমাদের আর কষ্ট করতে হবে না। একটা রাতের ব্যাপার তো! একটু কষ্ট হলেও চালিয়ে নিতে পারবো।’

তানভীর তাদের কাছ থেকে কোন সাহায্য না নিয়েই বিদায় করে দিল ছেলে দু’টোকে।

ছেলেরা যাওয়ার পর সে মেয়েটিকে নিয়ে আবার দুশ্চিন্তায় পড়লো। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে সে প্রথমেই আগুনের উপর শুকনো ডাল চাপালো। নিভু নিভু আগুন আবার পূর্ণ তেজে জ্বলে উঠলো।

আগুন জ্বালিয়ে সে প্রথমেই তার গায়ের ভিজে জামাটি খুলে নিয়ে তা আগুনে শুকোতে দিল। জামা মানে এ্যারাবিয়ান জু্ব্বা, যা পা থেকে গলা পর্যন্ত ঢেকে দেয়। জামাটি শুকোতে দিতে পেরে সে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালো ছেলে দুটিকে। সেই সাথে শুকরিয়া প্রকাশ করলো আল্লাহর, যার কাছে একটু আগে সে সাহায্য প্রার্থনা করেছিল। তার মনে হলো, তার ডাকে সাড়া দিয়েই আল্লাহ ছেলে দুটিকে এই বিজন পাহাড়ে পাঠিয়েছিলেন, যেন তারা থাকার মত একটু জায়গা এবং একটু আগুনের সন্ধান পায়। কারণ এই রাতে একটু আগুন না পেলে তাদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠতো।

তানভীর এই সব ভাবছিল, এ সময় মেয়েটির জ্ঞান ফিরে এলো। চোখ খুলে নিজেকে এক অবাস্তব জায়গায় দেখতে পেল। তার চোখে মুখে বিস্ময় ও ভীতির ছাপ ফুটে উঠলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে তানভীরকে দেখে আতংকে হা করে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।

ঝড়-তুফান আর বিরূপ প্রকৃতির সাথে লড়াই করে তানভীরের চেহারা হয়ে উঠেছিল বিবর্ণ ও ভয়ংকর। চেহারায় লেগেছিল কাদা মাটি। চুল ছিল উস্কোখুস্কো। পানির ঝাপটায় চোখ দুটো হয়ে উঠেছে রক্ত বর্ণ। তার ওপর তার টান টান পেশীবহুল উদোম শরীরে আগুনের লাল আভা পড়ায় তাকে দেখাচ্ছিল ঠিক ডাকাতের মত। তাই মেয়েটি তানভীরকে দেখে ভয়ে কোন কথা বলতে পারল না।

তানভীর তার অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, ‘ভয় পেও না।’ তার পর শান্তনার স্বরে বললো, ‘আমাকে তুমি চিনতে পারছো না? আমি তোমাদের কাফেলাই এক যাত্রী, এক সাথেই হেমসে যাচ্ছিলাম আমরা।’

‘কিন্তু তুমি তো মুসলমান!’ মেয়েটি উঠে বসলো এবং বললো, ‘তোমার উপর আমি ভরসা করতে পারি না। তুমি আমাকে যেতে দাও!’ ‘

‘যাবে? যাও!’ তানভীর বললো, ‘আমি তো কখনোই তোমার পথ আগলে রাখিনি।’

মেয়েটি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু তার চলার মত কোন শক্তি ছিল না। গহবরের বাইরে ছিল ভীষণ অন্ধকার। মেয়েটি দু’কদম হেঁটে গহবরের মুখে এসে বাইরে দৃষ্টি দিল। সেখানে সে রাতের অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না।

মেয়েটি আবার ঘুরে দাঁড়াল কামরার দিকে। ভেতরে আগুনের তাপ ও আলোতে যেটুকু জীবনের উত্তাপ আছে বাইরে তার কিছুই নেই। সে তানভীরের দিকে অনিমেষ নয়নে তাকিয়ে রইলো।

কামরার প্রজ্জ্বলিত আগুনের আভায় তাকে এক সহস্যময় মানুষ মনে হচ্ছিল। সেও তাকিয়ে ছিল মেয়েটির দিকে, দেখছিল তার কাজকর্ম।

মেয়েটির পায়ে তেমন শক্তি ছিল না। সে বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। তার পা দুটো আস্তে আস্তে ভাঁজ হয়ে আসছিল। সে দেয়াল হাতড়ে দু’কদম এগিয়ে বসে পড়লো। বসে পা দু’টো সামনে ছড়িয়ে দিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে অসহায়ের মত তাকিয়ে রইলো তানভীরের দিকে।

‘আমার ঘোড়াটি আমার খুবই প্রিয় ছিল। তোমার জন্য আমি আমার সেই ঘোড়াটিকে হারিয়েছি।’ তানভীর বললো, ‘তোমাকে নদী থেকে বাঁচাতে গিয়ে দেখলাম ঘোড়া আর তোমাকে এক সাথে বাঁচানো সম্ভব নয়। তাই ঘোড়া ছেড়ে তোমাকেই বাঁচালাম।’

‘আমার মূল্য বিশটি ঘোরার চেয়েও বেশী।’ মেয়েটি আহত কণ্ঠে বললো, ‘তুমি আমাকে বাঁচিয়ে কোন লোকসানের বোঝা ঘাড়ে নাওনি। হয়তো আমার মত মেয়ে তুমি কোনদিন চোখেই দেখোনি। তুমি ভেবেছো, আমাকে লাঞ্ছিত করে বেঁচে দিলেও ঘোড়ার চেয়ে অনেগ গুণ বেশী লাভ করতে পারবে।’

‘কে বললো আমি তোমাকে লাঞ্ছিত করবো? বিক্রি করে দেবো?’

‘কেন, এখন তুমি আমাকে নিয়ে যা খুশী করতে পারো। তোমাকে কে বাঁধা দিবে? কে প্রতিরোধ করবে বলো?’

‘আমাকে আল্লাহই প্রতিরোধ করবেন।’ তানভীর বললো, ‘আর আল্লাহই তো এতক্ষণ প্রতিরোধ করে রেখেছেন। এটা আল্লাহরই এক মোজেজা যে, তিনি আমাকে দিয়ে এই ঝড় ও প্লাবনের হাত থেকে তোমাকে বাঁচিয়েছেন। নইলে স্রোতের টানে তোমার উট বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর তোমার বাঁচার কোন আশা ছিল না।’

‘তাহলে বলো, এটাও আল্লাহর মোজেজা যে, তিনি এই শুকনো সুন্দর নিরাপদ গুহায় আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন?’

‘তা তো অবশ্যই। এটা তাঁর মোজেজা ছাড়া আর কি? আমি তো বিপদে পড়ে আল্লাহর কাছেই সাহায্য চেয়েছিলাম। তিনি আমার দোয়া কবুল করেছেন। আমাদেরকে এমন একটা গুহা দিয়েছেন যেখানে আগুনও আছে।’

‘আল্লাহর সাথে তোমার কোন গোপন সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায়নি তো! তুমি যেভাবে কথা বলছো তাতে মনে হয়, তুমি যা চাও তাই আল্লাহ দিয়ে দেন?’ ব্যঙ্গের সুরে বরল মেয়েটি।

‘আল্লাহ তাকেই সাহায্য করেন, যার অন্তর বিশুদ্ধ। আমার অন্তরে কোন কালিমা ছিল না বলেই এত তাড়াতাড়ি আল্লাহর সাহায্য পেয়ে গেছি। দুটি বালক এখানে এই আগুন জ্বালিয়ে রেখে গেছে। এটাও তো আল্লাহর ইশারা। আমি এক ঈমানদার। ঈমানদারদের সহায় সব সময়ই আল্লাহ। আর তাই তো ঈমানদারগণ কখনো আশাহত হয় না, নিরাশায় ডুবে যায় না।’

তানভীর বললো, ‘তুমি আমার সব কথা বুঝতে পারবে না। কারণ যারা ঈমানদার নয়, তারা ঈমানদারকে সব আচরণ বুঝতে পারে না। তুমি যে ভয় পাচ্ছো তার কারণও আছে। ঈমানের আলোয় আলোকিত নয় তোমার অন্তর। ফলে আমি যা দেখতে ও বুঝতে পারি, তুমি তা পারবে না। তোমার চোখে অন্ধত্ব ও অন্ধকারের কালিমা লেগে আছে। তাই তুমি ভয় পাচ্ছো। তোমার দেহের রূপ ও যৌবন নিয়ে তুমি উদ্বিগ্ন। ভাবছো, সেই আগুনে পতঙ্গের মত ঝাঁপ দেবো আমি। কিন্তু না, তোমার এ ভয় অমূলক। তোমাকে বিক্রি করার কথাও কখনোই উদয় হয়নি আমার মনে।’

মেয়েটি মন্ত্রমুগ্ধের মত তার দিকে তাকিয়ে রইল। বুঝতে চেষ্টা করলো তার কথা। বললো, ‘যদি আমাকে বিক্রি করার কোন ইচ্ছা তোমার না থাকে তাহলে আমাকে দিয়ে কি করবে? সারা জীবন আমাকে ভোগ করবে? দোহাই তোমার, এমন জুলুম তুমি আমার ওপর করো না। তোমার ভোগে আমি বাঁধা দিবো না। কিন্তু কথা দাও, দু’চার দিন বা মাসখানেক পর তুমি আমাকে আমার ঠিকানায় পৌঁছে দেবে?’

মেয়েটির কথা শুনে শরমে কান লাল হয়ে গেল তানভীরের। কোন মতে ঢোক গিয়ে বলল, ‘কি যা তা বলছো বদমাশ মেয়ে? কান খুলে শুনে নাও, আমি আমার আত্মাকে কখনও অপবিত্র করবো না। আমার অন্তরে পাপ লোভ প্রবেশ করাতে চেষ্টা করো না। অবশ্যই তোমার মত সুন্দরী মেয়ে আমি দেখিনি, কিন্তু মুসলমান আপন স্ত্রী ছাড়া অন্যের দিকে হাত বাড়ায় না।’

তানভীরের বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল, মেয়েটির মুখ দিয়ে আর কোন কথা বের হলো না। সে ভয় ও বিস্ময় নিয়ে তানভীরের দিকে তাকিয়ে রইলো। তানভীরের দৃষ্টিতে সংকল্পের যে দৃঢ়তা, সরলতা ও পবিত্রতা খেলা করছিল মেয়েটি যেন তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল।

মেয়েটির শরীর তখনো ভেজা কাপড় লেপ্টে ছিল। শীতে জড়োসড়ে হয়ে বসেছিল মেয়েটি। তানভীরের জামা আগুনের তাপে শুকোচ্ছে। গায়ে কাপড় না থাকায় তার শরীরও শুকিয়ে এসেছিল। মেয়েটির অবস্থা দেখে সে বললো, ‘আগুনের কাছে সরে বসো। বেশীক্ষণ ভেজা কাপড়ে থাকলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।’

মেয়েটি বাধ্য মেয়ের মত আগুনের কাছে সরে এলো, যেন তার আদেশ অমান্য করার কোন উপায় নেই।

তানভীর তার জামার এক প্রান্ত মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো, ‘এখানে ধরো। আগুনের উপরে দিয়ে এটি আগে শুকাই।’

সে জামার অপর দিকটা ধরে রাখলো, মেয়েটি ধরলো এক পাশ। তারা দু’জনেই জামাটি আগুনের উপরে দোলাতে লাগলো।

তানভীর বললো, ‘আমার জামাটি আগে শুকোতে দাও। এটু শুকিয়ে গেলে তুমি পরে নিয়ে তোমার কাপড়ও শুকিয়ে নিতে পারবে।’

‘না।’ মেয়েটি ভয় পেয়ে বললো, ‘আমি আমার কাপড় খুলবো না।’

‘তুমি তোমার চামড়া পর্যন্ত খুলে আগুনে শুকাবে।’ তানভীর ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললো, ‘আমার কর্তব্যের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না বলছি। আমি তোমার সামনে প্রমাণ করবো, মুসলমানরা বর্বর নয়।’

‘মুসলমানরা বর্বর না হলে ভদ্রঘরের এক যুবতীর সঙ্গে তুমি এমন ভাষায় কথা বলতে পারতে না। তোমার ভাষাই বলে দিচ্ছে তুমি কতটা শরীফ লোক।’ আবারও তীর্যক কণ্ঠে বললো মেয়েটি।

‘আমি ভাল করেই জানি তুমি কেমন পবিত্র মেয়ে! তুমি এখন আমার আশ্রয়ে, তাই আমি তোমার সাথে কোন অভদ্র ব্যবহার করতে পারি না। তুমি নারী। আমার ধর্ম আমাকে কোন নিরূপায় মেয়ের উপর শক্তি প্রয়োগের অনুমতি দেয় না। তোমার সাথে আমি যেটুকু রূঢ় ব্যবহার করছি, সেটুকু আমার নিরাপত্তার জন্য দরকার ছিল । আমি চাই না তুমি প্রশ্রয় পেয়ে আমাকে কোন পাপের জালে আটকে ফেলো। সে জন্যই এই সাবধানতা।’

‘তুমি আমাকে ঝড় তুফানের মধ্যে কেমন করে নদী থেকে উদ্ধার করলে?’ মেয়েটি প্রসঙ্গ পাল্টে প্রশ্ন করলো, ‘আমাদের অন্য সঙ্গীরা কি সবাই পারে আসতে পেরেছে?’

তানভীর তাকে সব ঘটনা খুলে বলল। আর এ কথাও বললো, ‘অনেক দূরে চলে আসায় অন্য সঙ্গীদের ভাগ্যে কি ঘটেছে আমার জানা নেই।’

মেয়েটির ভয় তবুও পুরোপুরি দূর হলো না, তবে কিছুটা লাঘব হলো। সে আগুনের আরো কাছ ঘেঁষে বসলো এবং আগুনের ওপর নিজের কাপড় মেলে ধরে শুকাতে লাগল।

একটু পর। আগুনের তাপে তার শারিরীক অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে এলো। তানভীর বললো, ‘তোমাদের বাড়ী কি হেমস?’

তানভীরের প্রশ্নের উত্তরে সে বললো, ‘না, হেমসে আমাদের আত্মীয় স্বজনরা বাস করে। আমরা দামেশকে বসবাস করতাম। বাবার ইচ্ছে, তিনি সে অঞ্চল ছেড়ে এখন থেকে হেমসে বসবাস করবেন। এ জন্যই আমরা হেমসে যাচ্ছিলাম।’

তানভীরের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই বৃদ্ধ বাবার কথা মনে পড়ে গেল মেয়েটির। সে তার বাবার জন্য খুব অস্থির হয়ে উঠলো।

❀ ❀ ❀