» » ধাপ্পাবাজ

বর্ণাকার

গত রাতটি আলী বিন সুফিয়ানের কেটেছে অসম্ভব ব্যস্ততায়। সাদা দাড়িওয়ালা যে লোককে অনুসরণ করে কায়রো এসে পাকড়াও করেছিলেন তাকে রাতভর জেরা করে জেনে নিয়েছেন সমস্ত তথ্য। কালো দাড়িওয়ালা হুজুর কে তার এখানে আসার উদ্দেশ্য ও মিশন কি, অবশেষে সবই তিনি জানতে পেরেছেন। এই করতে করতেই দিনের অর্ধেক সময়ও অতিবাহিত হয়ে গেল।

তখনি তার মনে পড়লো গোয়েন্দা আনিসের কথা। আনিসের কথা মনে হতেই আলী বিন সুফিয়ান অধীর হয়ে উঠলেন। সে এখনো এলো না কেন? তিনি ব্যাকুল হয়ে আনিসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো আলী বুঝতে পারলেন, তাঁর পাঠানো গোয়েন্দা নিশ্চয় কোন বিপদে পড়েছে। হয়তো হুশিয়ার দরবেশ সন্দেহবশত তাকে গ্রেফতার করে নিয়েছে।

দিনের শেষ প্রহর। আলী বিন সুফিয়ান আর অপেক্ষা করা সমীচিন মনে করলেন না। তিনি আনিসকে উদ্ধারের জন্য একটি কমাণ্ডো দল গঠন করে রাতের অন্ধকার নেমে আসার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

যে বাড়ীটিকে ওরা আস্তানা বানিয়েছিল তা তিনি আগেই দেখে এসেছিলেন। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথে তিনি সেই গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

তাঁর কমান্ডো বাহিনী এত দ্রুতবেগে গ্রামে প্রবেশ করলো যে, গ্রামের কেউ কাউকে সতর্ক করার সুযোগ পেল না। গ্রামে ঢুকে চোখের পলকে তারা বাড়ীটিকে ঘিরে ফেলল। তারপর বাড়ীর দেয়ালের সাথে ঘোড়া লাগিয়ে লাফিয়ে পড়লো ভেতরে। বাড়ীর ভেতরের কেউ কিছু টের পাওয়ার আগেই কমাণ্ডোদের লাথির আঘাতে ভেঙ্গে গেল দরজা। কামরায় ঢুকে ওরা বাড়ীর সকলকেই গ্রেফতার করে নিল।

আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা তখনো বেহুশের মত পড়ে ছিল মেঝেতে। তার প্রাণবায়ু বেরোনোর জন্য যেন শেষ চেষ্টা করছে।

অপরদিকে পাশের কামরায় ছিল মেয়েটি। কমাণ্ডোরা ওকে গ্রেফতার করার জন্য গিয়ে দেখে মেয়েটি বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার বিছানা।

ওরা তাড়াতাড়ি মেয়েটিকে ধরে তুলতে গিয়ে দেখলো মেয়েটির বুকে একটি ছুরি বিদ্ধ হয়ে আছে। তখনো মারা যায়নি সে, কমাণ্ডোদের দেখে মুখে কষ্ট করে হাসির রেখা টেনে কোন রকমে বললো, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়, আমি নিজেই আত্মহত্যা করেছি।’

কথাটুকু বলে সে শেষ নিশ্বাঃস ত্যাগ করলো। কিন্তু কেউ জানতে পারলো না, কেন মেয়েটি আত্মহত্যা করলো।

পর দিন। সেই গ্রাম ও আশপাশের গ্রামের অনেক লোক বাড়ীর সামনে এসে জড়ো হলো। আলী বিন সুফিয়ান কালো দাড়িওয়ালা হুজুরকে সবার সামনে দাঁড় করীয়ে বললেন, ‘কি উদ্দেশ্য এবং কি মিশন নিয়ে তুমি ও তোমার সাথীরা এখানে এসেছো সবার সামনে খুলে বলো।’

লোকটি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আলী বললেন, ‘চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেই তুমি পার পেয়ে যাবে মনে করো না। তোমরা কে এবং কেন এখানে এসেছো সব আমি জানি। আমি এও জানি, রমলা থেকে ফেরার পথে সৈনিকদের যে কাহিনী তুমি শুনিয়েছিলে তা ভুল। কোত্থেকে কেমন করে রাতের আঁধারে তোমার কাছে খাবার পৌঁছাতো সে রহস্যও আমি উদ্ধার করেছি। তুমি সত্যি কথা জনতার সামনে স্বীকার করলে তোমার শাস্তি খানিকটা লাঘব হতে পারে। আর যদি তুমি মুখ খুলতে অস্বীকার করো তবে আমার হাতে এমন অস্ত্রও আছে যাতে তোমার মুখোশ খুলে যাবে। কেন তুমি সৈন্য বাহিনী ও সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে দুর্ণাম ছড়াচ্ছো, এর উত্তর যদি তুমি না দাও তবে তোমার হয়ে সে উত্তর দেবে কাল যাকে সাদা দাড়ি পরিয়ে কায়রো পাঠিয়েছিলে তোমার সেই বন্ধু।

আলীর মুখে এ কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে সে বললো, ‘আপনি তাকেও গ্রেফতার করেছেন?’

আলী বললেন, ‘তাহলে পেছন ফিরে দেখো তো, ওকে চিনতে পারো কিনা?’

লোকটি পিছন ফিরে সঙ্গীকে দেখতে পেয়ে বললো, ‘আমি যদি সব সত্য কথা স্বীকার করি তবে কি আপনি আমার মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করবেন?’

‘তেমন ওয়াদা করার কোন প্রয়োজন নেই আমার। সব তথ্য এখন আমার হাতের মুঠোয়। ইচ্ছে করলে তুমি সব স্বীকার করতে পারো আর যদি স্বীকার করতে না চাও, তাতেও কিছু আসে যায় না আমার।’

ছদ্মবেশী হুজুর বললো, ‘আমি অস্বীকার করছি না, এখানে আমরা গোয়েন্দাগীরি করতে এসেছিলাম। তারপর সে তার এবং তার সাথীদের এখানে আসার কারণ খুলে বললো।

‘এখানে একটি মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। আমি জানতে পেরেছি, মৃত মেয়েটা মুসলমান নয় খৃষ্টান ছিল। তার মৃত্যুর কারণ কি?’

ছদ্মবেশী হুজুর আনিসের সাথে তার প্রেমের কাহিনী খুলে বললো ভরা জলসায়।

‘আর পথে মরুভূমির মাঝে টিলার পেছনে যে আগুন ছিল এবং তার কাছে যে পানির মশক ও খেজুর ছিল, সে রহস্যের সমাধান কি?’

‘ওখানে আসলে কোন রহস্য ছিল না। খাদ্য ভাণ্ডার নিয়ে আমাদের একদল লোক সেই পথে লুকিয়ে ছিল। আমাদের কাফেলা থেকে দেখা যায় না এমন দূরত্ব বজায় রেখে তারা আমাদের অনুসরণ করে পথ চলতো। রাতে আমাদের কাছে এসে পাখীর ডাকের মাধ্যমে সংকেত দিলে আমরা সে খাবার সংগ্রহ করে নিতাম।

আলী বিন সুফিয়ান কারাগারের গোপন কক্ষে আগের রাতে বন্দী লোকটি যে জবানবন্দী দিয়েছিল তার সাথে মিলিয়ে নিচ্ছিলেন ধাপ্পাবাজ হুজুরের রিপোর্ট। লোকটির বর্ণনা থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে জানা গেছে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলাতক সৈন্যদলকে বিভ্রান্ত করার জন্য তারা একটি ফাঁদ পেতেছিল হুজুরের মাধ্যমে। সে ফাঁদ যথেষ্ট কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। কাফেলার সকলেই হুজুরের কথা কেবল বিশ্বাস করেনি, অন্ধ ভক্ত হয়ে পড়েছিল তার।

‘তোমরা এখানে কি পদ্ধতিতে কাজ হাসিল করছিলে?’ প্রশ্ন করলেন আলী বিন সুফিয়ান?

‘যেখানে লোক সমাগম বেশী, যেমন বাজার, মসজিদ, এসব এলাকায় মিশরের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও দুর্ণাম ছড়িয়ে আইয়ুবী ও তার বাহিনীর প্রতি জনতার যে আস্থা ও বিশ্বাস আছে তা ধ্বংস করে দেয়াই ছিল আমাদের দায়িত্ব। ইসলামী জনতাকে বিভ্রান্ত করার জন্য বিশেষভাবে আমরা বেছে নিয়েছিলাম মুসল্লীদের। আমাদের এ অপপ্রচারের উদ্দেশ্য ছিল সামরিক বিভাগ ও সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও সন্দেহ সৃষ্টি করা। এতে দেশের জনগণ ও সেনাবাহিনীর মাঝে বিভেদের এক অদৃশ্য দেয়াল খাঁড়া হয়ে যাবে। এ অনৈক্য খৃষ্টানদের অনেক উপকারে আসবে।’

‘তোমাদের এ মিশনে মিশর প্রশাসনের কে কে জড়িত?’

এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আবার চুপ করে গেল লোকটি।

আলী বললেন, ‘সে তালিকা আমি আগেই পেয়েছি। তোমার কাছ থেকে শুনে নিশ্চিত হতে চাই তালিকাটি সঠিক, নাকি দেশপ্রেমিক লোকদেরকে কায়দা করে ফাঁসিয়ে দেয়ার চক্রান্ত হচ্ছে।’

লোকটি মিশর প্রশাসনের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম করে বললো, ‘এরা সময় সুযোগ মত আমাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে আসছেন। তবে এরা কেউ আমাদের দলের লোক নন।’

‘প্রশাসনের লোক ছাড়া বিশেষভাবে আর কাদের সহযোগিতা পাচ্ছো?’

‘আব্বাসীয় খেলাফতের ক্ষমতাচ্যুত শাসকরা গোপন সংগঠন গড়ে তুলেছে। তারা আমাদের তৎপরতা সম্পর্কে জানে এবং যে কোন রকমের সহযগিতা করতে প্রস্তুত থাকে।’

আলী বিন সুফিয়ান বুঝলেন, শত্রুরা সব একজোট হয়ে গেছে। কেবল খৃস্টান নয়, আইয়ুবীর ক্ষমতারোহণে যাদের স্বার্থে আঘাত লেগেছে সেইসব মুসলমানেরাও জড়িত হয়ে গেছে এই জোটে।

‘যখন সামরিক বিভাগ ও জাতির মধ্যে ঘৃণা ও ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হয়ে যায়, মনে করবে সেই জাতির বিশ্ব জোড়া সুনাম ও শক্তি নিঃশেষ ও ধ্বংস হয়ে গেছে।’ সুলতান আইয়ুবী দৃঢ়তার সাথে এ কথা বললেন। আলী বিন সুফিয়ানকে লক্ষ্য করে তিনি আরো বললেন, ‘সকল মসজিদের ইমামকে এক জায়গায় সমবেত করো। রমলা যুদ্ধে পরাজয়ের প্রকৃত কারণ তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। তারাই পারবে সেই কারণ মুসল্লীদের সামনে বর্ণনা করে জাতির মধ্যে যে সন্দেহ ও অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করতে।’

দু’দিন পরের কথা। কায়রোতে সমবেত হয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় সকল ইমামগণ। গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তাদের সামনে তুলে ধরলেন রমলা যুদ্ধের পরাজয়ের প্রকৃত কারণ। ভাষণের শেষ দিকে সমবেত ইমামদের উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, ‘তারপরও আমি বলবো, যদি এ যুদ্ধে পরাজয়ের জন্য কাউকে দোষারোপ করতেই হয়, তবে সে জন্য আমি দায়ী। কাউকে অপবাদ দিয়ে যদি কেউ তৃপ্তি পেতে চায়, সে যেন সমস্ত অপরাধের দায়িত্ব আমার উপরেই অর্পণ করে। আমিও ফিলিস্তিনের ভাগ্যাহত মুসলমানদের জন্য জীবন কুরবানী করে এ অপরাধের কাফফারা আদায় করতে চাই। ফিলিস্তিনী মুসলমানদের মুক্তির জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে যদি আমি জীবন দিতে পারি, সেটাই হবে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওনা।

গদী ও রাজ্যের লোভ নয়, গনীমতের মালের লোভ নয়, যারা আমার সেনাবাহিনীতে শামিল হবে তাদের প্রত্যেককে এ শপথ নিতে হবে, আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ের জন্য আমরণ চেষ্টার মধ্য দিয়ে।

যতক্ষণ এ পরাজয়কে আবার বিজয়ে রূপান্তরিত করতে না পারবো ততক্ষণ আমার রক্তের প্রতিটি কণিকা থেকে সেই আওয়াজই ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলবে, এ পরাজয়ের দায়িত্ব একমাত্র আমার। আমার কোন সেনা সদস্য বা কোন গ্রুপ বা দল এ জন্য বিন্দুমাত্র দায়ী নয়। তার নিষ্পাপ জিন্দাদীল মর্দে মুমীন, যাদের অন্তরে সর্বদা বিরাজ করে আল্লাহর ভয় ও তার অসীম ক্ষমতার সীমাহীন কল্পনা। প্রতিটি পরাজয় থেকে মুজাহিদরা যেমন বিজয়ের পাঠ গ্রহণ করে তেমনি এ পরাজয় আমাদের জন্য বয়ে এনেছে বিজয়ের অমোঘ দুঃসাহস।

❀ ❀ ❀

হলব প্রদেশের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত একটি শান্তিপূর্ণ জনবসতি। এলাকাটার নাম হেমস। বর্তমানে ওটা লেবাননের অন্তর্গত এবং সিরিয়ার সীমান্তে অবস্থিত। এলাকাটা শান্তিপূর্ণ ছিল এ জন্য যে, তখনও যুদ্ধের কোন ঝুঁকি ও বেগ সামলাতে হয়নি তাদের।

হেমসের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটা নদী। নদীর তীর ধরে এগিয়ে গেছে ছোট রাস্তা। তেমন বিশাল সড়ক নয় বলে এ এলাকা দিয়ে সেনাবাহিনী নিয়ে চলাচল তেমন আরামদায়ক নয়, তাই যুদ্ধের তাণ্ডব সইতে হয়নি তাদের।

ইদানিং এ ক্ষুদ্র পথে মাঝে মাঝে খৃষ্টান বাহিনী যাতায়াত শুরু করেছে। বিশাল বাহিনী নয়, সামরিক বাহিনীর ছোটখাট কাফেলা নদী তীরের পথ ধরে এগিয়ে যেতে দেখেছে গ্রামবাসী।

এ অঞ্চলটিতে কোন খৃস্টান নেই। জনবসতির প্রায় সবাই মুসলিম। কয়েক ঘর ইহুদী থাকলেও সকলেই হেমসকে মুসলিম এলাকা বলে গন্য করতো। তারপর সেখানে ইহুদীদের পাশে এক সময় কয়েক ঘর খৃস্টানও এসে বসবাস শুরু করলো।

এই ইহুদী ও খৃস্টানরা সবাই ছিল ব্যবসায়ী। সে জন্য তারা এলাকার বাইরে দূর দূরান্তে কারবারের জন্য চলে যেত। ফলে তারা বাইরের দুনিয়ার খবরাখবর বেশী রাখতো।

রমলার পরাজয়ের পর তারা এলাকায় ফিরে এসে মুসলমানদের পরাজয়ের কাহিনী এমন ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করতে লাগলো যে, মুসলমানদের মনে তাতে ভীষণ ভয় ও আতংক ছড়িয়ে পড়লো। তারা ক্রুসেড বাহিনীর বিজয়ের কাহিনী এমন ফলাও করে প্রচার করলো, যাতে সবাই বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়, খৃস্টান বাহিনীই এখন দুনিয়ার অপরাজেয় ও দুর্ধষ বাহিনী।

তাদের এ প্রচারণা ছিল এক ষড়যন্ত্রেরই অংশবিশেষ। উদ্দেশ্য ছিল, হেমসের মুসলমানদের মনে খৃস্টান শক্তির ভীতি জাগ্রত করা, যাতে সেই ভয়ে এলাকার কোন মুসলমান সেনাবাহিনীতে যোগদান না করে।

কিন্তু কার্যতঃ সেখানে তার উল্টো প্রভাব পড়ে। দেখা গেল, মুসলমানরা ভয় ও আতংগ্রস্ত হয়ে ঘরে গুটিয়ে বসে থাকার পরিবর্তে দলে দলে জোরে শোরে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছে। মুশকিল হলো, ওদের এমন সামরিক প্রস্তুতিতে কেউ বাঁধাও দিতে পারে না। কারণ সেখানে খৃস্টানদের শাসন ছিল না, এলাকাটা ছিল মুসলিম অধ্যুষিত।

হেমসের মুসলমানরা অশ্বারোহন, বল্লাম বা বর্শা ছোঁড়া, অসি চালনা ও তীরন্দাজীর জোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করলো। মুসলমানদের মধ্যে এ জেহাদী জযবা জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে যিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি ছিলেন এলাকার বড় মসজিদের খতিব।

তিনি ছিলেন একজন জবরদস্ত পণ্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তি। এলাকার সবাই তাকে অসম্বব ভক্তি শ্রদ্ধা করতো। তিনি মুসলমানদের সব সময় স্মরণ করিয়ে দিতেন, ‘তোমাদের প্রথম কেবলা এখনো শত্রু কবলিত। মসজিদুল আকসায় উড়ছে দুশমনের পতাকা। হে আমার যুবক সম্প্রদায়! উঠো! জাগো! ছুটে যাও জেহাদের ময়দানে। আরবের পবিত্র মাটি থেকে খৃস্টান ও ইহুদীদের বিতারড়িত করতে ফিয়িয়ে আনো তোমার হৃত গৌরব।’

তিনি কোরআন ও হাদীসে বাণী আবৃত্তি করে মুসলমানদের বুঝাতেন যুদ্ধের গুরুত্ব, জেহাদের মরতবা। সুন্দর ও যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়ে খতিব মুসলমানদেরকে বার বার স্মরণ করিয়ে দিতেন তাদের দায়িত্ব কর্তব্য। তিনি বলতেন, ‘খৃস্টানরা সমগ্র আরব ভূখণ্ড দখল করে সেখানে খৃস্টান সম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ জন্য ওরা প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। আর আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি এখানে আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠা করতে। এ জন্যই আমরা আমাদের জান ও মাল কুরবানী করছি।’

তিনি সমগ্র আরববাসীদের সম্বোধন করে বলতেন, ‘মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর বাণী আরবদের ওপর নাজিল করেছেন। কিন্তু এই বাণী এসেছে সমগ্র বিশ্বাসীর জন্য। আরবদের ওপর এখন কঠিন দায়িত্ব এসে পড়েছে, এই বাণী সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেয়ার। আমাদের প্রিয় নবী রাসূল (সা.) হেরা পর্বতের গুহায় বসে যে আলোর সন্ধান পেয়েছিলেন সেই আলোয় বিশ্বের সকল মানুষকে আলোকিত করার মহান দায়িত্ব এখন আমাদের।

আমাদের পূর্ব পুরুষরা এ দায়িত্ব পালন করেছেন। স্মরণ করো মহাবীর তারেক বিন জিয়াদের কথা। তিনি ভূমধ্যসাগরের উপকূলে দাঁড়িয়ে মহান আল্লাহর দরবারে আবেদন জানিয়ে বলেছিলনে, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ধৈর্য্য ও সাহস দান করো। আমি তোমার নাম ও বাণী সাগরের ওপারেও নিয়ে যেতে চাই।’ ঈমানী জোশে তিনি এতটাই উদ্বেলিত হয়েছিলেন যে, প্রবল আবেগ ও জযবা নিয়ে তিনি তার ঘোড়া নিয়ে সাগরের উত্তাল তরঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

তার পরের কাহিনীও স্মরণ করো। আল্লাহ তাঁর মোনাজাত কবুল করে নিলেন। জাহাজ নিয়ে আরবের বন্দর থেকে তিনি ছুটে গেলেন স্পেনের মাটিতে। সেখানে পৌঁছে তিনি তাঁর জিন্দাদীল মুজাহিদ বাহিনীকে হুকুম দিলেন, ‘মুজাহিদ বাহিনী, ইসলামের পতাকা হাতে নিয়ে আমরা এখানে এসেছি ফিরে যাওয়ার জন্য নয়। হয় আমাদের চেষ্টায় এখানে আল্লাহর দ্বীন কায়েম হবে, নয়তো এ চেষ্টা করতে করতে আমরা পৌঁছে যাবো আমাদের মহান প্রভুর দরবারে। তাই যে জাহাজে চড়ে আমরা এখানে এসেছি সে জাহাজের আর কোন প্রয়োজন নেই আমাদের। জাহাজগুলোতে আগুন ধরিয়ে দাও, নিশ্চিহ্ন করে দাও ফিরে যাওয়ার সকল সম্ভাবনা।’

তারিক বিন জিয়াদের মতই আজ ক্রুসেডাররাও ইস্পাতকঠিন শপথ নিয়ে এখানে এসে আসন গেড়ে বসেছে। তাদেরও ইচ্ছা, তারা আর ফিরে যাবে না এখান থেকে। আরব ভূখন্ড তারা পদানত করতে চায় এ জন্য যে, আল্লাহর মহান বাণী এই আরবেই প্রথম অবতীর্ণ হয়েছিল। রাসূলে করীম (সা.) ও তাঁর মহান সাহাবীগণ বিশ্ববাসীর কাছে যে সত্য দ্বীন পৌঁছে দিয়েছিলেন সে দ্বীনের আলো বিচ্ছুরিত হয়েছিল এই পাথুরে প্রান্তর থেকেই। এ জন্যই তারা চায়, সমগ্র আরবে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে, যাতে আল্লাহর দ্বীনকে তারা সমূলে উৎপাটিত করতে পারে।

হে মুসলিম জাতি, তোমরা স্মরণ রেখো, ইসলাম কেবল কোন ধর্ম নয়, ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। যে বিধান মানুষের দেহ ও মনের সকল চাহিদা পূরণ করে দেয়। এর বিধানগুলো এমন, মানুষের অন্তরে একবার তা প্রবেশ করলে সে অন্তরকে মোমের মত গলিয়ে দেয়। মানুষের অন্তর যত কঠিন আর পাথরই হোক না কেন, কোরআনের বাণী সে পাথরকেও মোমের মত গলিয়ে দিতে পারে।

মুসলমান ভাইয়েরা আমার! কোরআনের বিধানগুলো কোন ব্যক্তির মর্যাদা ও গুরুত্ব রক্ষার জন্য তৈরী হয়নি। তৈরী হয়নি কোন বিশেষ জাতির সম্মান ও অধিকার রক্ষার জন্য। যিনি এ বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন তিনি এ বিশ্বের সকলের চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণ করার জন্যই এ বিধান তেরী করেছেন। কেবল মানুষ নয়, বিশ্বের সকল সৃষ্টির কল্যাণের কথা চিন্তা করেই এ বিধান তিনি তৈরী করেছেন।

তাই কোরআনের শিক্ষার মধ্যে মানুষের অন্তরের গভীর আকাংখাই ব্যক্ত হয়। এ জন্যই ইসলামকে বলা হয় মানুষের স্বাভাব ধর্ম। মানুষের অভ্যাস এবং মনের কামনা বাসনা ও আকুতির কল্যাণময় সমাধানই বিধৃত হয়েছে এর প্রতিটি বিধানের মধ্য দিয়ে। হক্কুল্লাহ ও হক্কুল ইবাদের সুষম সমন্বয় ঘটেছে কোরআনের ছত্রে ছত্রে। যিনি কোরআনের বিধান অুনসরণ করবেন কেবল তিনিই পারবেন আল্লাহর হক ও মানুষের হক যথাযথভাবে আদায় করতে।

বন্ধুরা, মনে রোখো, একমাত্র ইসলামই মানুষের সার্বিক অধিকারকে নিশ্চিত করেছে। ইসলাম শুধু ঈমান ও আকিদার সমষ্টি নয়, নয় কতিপয় বিশ্বাসের নাম। ইসলাম হচ্ছে জাগতিক জীবন যাপনের পূর্ণাঙ্গ নকশা। ইসলাম বলে, মানুষের ইহকালটিই সব নয়, মৃত্যুর পর তার রয়েছে আরেকটি জীবন। যে জীবনটি অনাদি অনন্ত। মৃত্যু পরবর্তী সে জীবনের কথা স্মরণ করেই এ দুনিয়ার জীবনকে পরিচালনা করতে হবে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, পরকালীন জীবনে কিভাবে চলতে হবে তার কোন বিধান কোরআনে দেয়া হয়নি। কোরআনের সব কথা এই দুনিয়ার জীবনকে ঘিরে। তাই দ্বীন ও দুনিয়াকে আলাদা করার কোন উপায় নেই। দ্বীন পুরোটাই দুনিয়ার জন্য। দুনিয়ায় কিভাবে চললে মানুষের সমাজ শান্তিময় হবে, তাকে সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য সফল হবে, কোরআনে সেই কথাই বলা হয়েছে স্পষ্ট করে। খৃষ্টান ও বিধর্মীরা জানে, যদি ইসলামের এই সার্বজনীন ও সার্বিক কল্যাণের কথা পৃথিবীবাসী জানতে ও বুঝতে পারে, তবে পৃথিবী নামক এই গ্রহটির সর্বত্রই ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।

স্বাভাবিকভাবেই মানুষের স্বভাব ধর্মের বিপরীত, খণ্ডিত কল্যাণ আর আংশিক সমৃদ্ধির বার্তাবহ সকল ধর্ম দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে। বিদায় নেবে মানবিক রচিত সকল মতবাদ। তাতে ক্ষতিগ্রস্থ হবে জালেম, শোষক ও মানবতার অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী শাসক সম্প্রদায়।

তাই যারা নিজেদের সৃষ্ট মতবাদ দিয়ে বা ধর্মের লেবাসের আড়ালে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে ও বজায় রাখতে চায় তারা ইসলামের অগ্রযাত্রায় বাঁধা দেবেই। এ কারণেই খৃস্টানরা আজ সমস্ত শক্তি নিয়ে প্রবল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ইসলামে ওপর। তারা সৃষ্টিকুলের প্রতি আল্লাহতায়ালার এই অপরিসীম করুণা ও দানকে ধ্বংস করে দিয়ে মানুষের জীবন ও সমাজকে বিপর্যস্ত করে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এই দানবীয় শক্তিকে প্রতিহত না করলে মানবীয় সভ্যতা বিনষ্ট হয়ে যাবে।

ইহুদীদের সাথে খৃষ্টানরা এক গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। ইসলামের বিনাশ সাধনের জন্য এই দুই শক্তি একত্রিত হয়েছে। তারা এই আপোষরফায় উপনীত হয়েছে যে, যদি ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান সফল হয় তবে খৃস্টানরা বায়তুল মুকাদ্দাস ইহুদীদের হাতে তুলে দেবে। ইহুদীরা সেখানে একবার মজবুত আসন গাড়তে পারলে আমাদের প্রথম কেবলা মসজিদুল আকসায় ওরা হযরত সোলায়মানের বিশাল মূর্তি নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। এটা ইহুদীদের বহুদিনের পুরণো স্বপ্ন।

এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ওরা অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই পায়নি। সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যই ওরা হাত মিলিয়েছে খৃষ্টানদের সাথে। এ জন্য খৃষ্টানদের দান করেছে অগাধ অর্থ ও নিজেদের মেয়েদের। এই দুটি জিনিষ যে কোন দলের ভিতরই গাদ্দার সৃষ্টি করতে দিতে পারে।

আমি তোমাদের সবার কাছে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সংবাদ পৌঁছে দিতে চাই। এ সব কথা তোমরা তোমাদের অন্তরে গেঁথে নাও। রাসূলের একনিষ্ঠ সেবক সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তাঁর সেনাবাহিনী এবং জাতির কাছে বিষয়টি পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এ যুদ্ধে দুই পরস্পর বিরোধী সামরিক বাহিনী বা দুই প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যের ক্ষমতার লাড়াই নয়, এ যুদ্ধ হচ্ছে দুই ভিন্নধর্মী চেতনা ও ধর্ম বিশ্বাসের মধ্যে। এর একদিকে আছে ঈমান অন্য দিকে কুফর। এক পক্ষে আছে হক অন্য পক্ষে বাতিল। এক পক্ষে মানবিক শক্তি অপর পক্ষে পাশবিক শক্তি।

ভাইয়েরা আমার! আজ পাশবিক শক্তি আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এখন যদি আমরা এই পাশবিক শক্তিকে প্রতিহত ও নিঃশেষ না করি তবে তারা দুনিয়ার বুক থেকে মিটিয়ে দেবে মানবিক সভ্যতা। প্রেম-প্রীতি, স্নেহ-মমতা ও ভালবাসার দুনিয়ার আসন গাড়বে স্বার্থপতরা, হিংসা ও ঘৃণার যন্ত্রণা। ইতিহাস বলবে, আমরা ছিলাম বুজদিল, ভীরু ও আহাম্মক। আমাদের হাড়ের ওপর ইহুদী ও খৃষ্টানরা তাদের প্রসাদ গড়বে। ফিলিস্তিনের আকাশে উড়বে ইহুদীদের পতাকা। মসজিদুল আকসায় মুর্তি স্থাপন করে তারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়বে। আরবের উদার আকাশ জুড়ে উড়তে থাকবে নাসারাদের বিজয় নিশান।

হেমসের মুসলমানেরা, তোমরা সুলতান আইয়ুবীর সেনাদলে ভর্তি হয়ে যাও। আল্লাহর সৈনিকদের কাথায় নাম লেখাও হে বীর মুজাহিদবৃন্দ। মুসলমানদের উপর আজ জেহাদ করা ফরজ হয়ে গেছে। আল কোরআন তোমাদের মত মুজাহিদদের উদ্দেশ্য করেই বলেছে, দেশ, জাতি এবং ধর্মকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধের বাহন ঘোড়া আর সর্বপ্রকার অস্ত্র নিয়ে সব সময় লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে। কোরআনের হুকুম স্মরণ করো আর নিজেদের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি জোরদার করো।

তোমরা যারা জেহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য শপথ নিয়োছো তদাদেরকে একটি কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া আমি জরুরী মনে করি। মনে রেখ, দুশমন জেহাদের অভিনব ও অসংখ্য ময়দান তৈরী করে রেখেছে। সব কটি ময়দান সম্পর্কেই একজন মুজাহিদের স্পষ্ট ধারনা থাকতে হবে।

মনে রেখো, তোমাদের শত্রুরা শুধু সম্মুখ ময়দানেই যুদ্ধরত নেই, তাদের আরও অন্য অনেক যুদ্ধক্ষেত্র আছে। গুজব ছড়িয়ে তোমাদের সৈন্যদের মনে আতংক সৃষ্টি করা তেমনি এক ময়দান। সেনাবাহিনী সম্পর্কে জনমনে কু-ধারণা সৃষ্টি করা তাদের আরেকটি ময়দান। সৈনিক ও অফিসারদেরকে বিপথগামী করা তাদের আরেক যুদ্ধ সেক্টর। অর্থ আর নারী এ দুটি জিনিসই মানুষের কাছে বড় লোভনীয় বস্তু। এ দুইয়ের সামনে পড়লে মানুষ সহজেই দুর্বল হয়ে যায। এর সাথে যদি একটু মদ যুক্ত করা যায় তবে মুসলমান তার ঈমানের মত অমূল্য সম্পদও অজান্তে শত্রুর পদতলে সমর্পন করে দিতে পারে।

এমনটি হওয়া কেবল সম্ভব নয়, আজকাল অহরহই এমনটি ঘটছে। খৃষ্টানরা আমাদেরকে গৃহযুদ্ধে ঠেলে দিয়ে আমাদের সামরিক শক্তি দুর্বল করে দিয়েছে। খৃষ্টানদের পাতা ফাঁদে আটকা পড়ে এই পাপের কাজটি করেছে কতক ক্ষমতালিপ্সু আমীর ও শাসক। কিন্তু সেই পাপের প্রায়শ্চিত্য করতে হচ্ছে সমগ্র মুসলিম মিল্লাতকে।

শাসকদের এই ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই জীবন দিতে হয়েছে আমাদের নওজোয়ান বীর সেনাবাহিনীকে। আর এভাবেই ওরা দুর্বল করে দিয়েছে ইসলামী হুকুমাত।

গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া জাতি ভাইয়ের ভাইয়ে লড়াই করে। দুশমন হাততালি দিয়ে দুই দলকেই উত্তেজিত করে মার খাওয়ায়। ফলে ভাইয়ের হাতে নিহত হয় ভাই।

আফসোস! তখন তাদের শাসকরা মহলের হেরেমে মদ ও নারী নিয়ে মেতে থাকে। সেই মহলের নিষিদ্ধ কামরায় স্ফূর্তির যোগান দেয় ইহুদী ও খৃষ্টানেরা। তাদেরকে মদ ও নারীর বাহুডোরে বন্দী করে ভুলিয়ে দেয় তাদের দায়িত্ব কর্তব্য।

তোমরা মনে রেখো, যদি এই পাহাড়গুলো সব সোনা হয়ে যায় আর সেই সোনায় ভরে দেয়া হয় তোমাদের ঘরগুলো তবুও তা জেহাদের মূল্যের সমান হতে পারে না। জেহাদের পুরষ্কার পেয়ে আত্মা হয় তৃপ্ত। জীবন হয় সফল। এমন সফল যে, তাদের কখনো মৃত্যু হয় না। তাই আল্লাহ নিজে শহিদদের মৃত বলতে নিষেধ করেছেন।

আত্মা সোনা দানা চায় না, ধন সম্পদ দিয়ে আত্মাকে খুশী করা যায় না। আত্মা খুশী হয় প্রেম আর ভালবাসায়। আর সে ভালবাসা যখন আল্লাহর সাথে হয় তখন বান্দার জীবন হয় চূড়ান্তভাবে ধন্য।

হে আমার মুজাহিদ ভাইয়েরা! তোমরা কোরআন পড়েছো। তোমরা জানো, জেহাদের পুরষ্কার দেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। তিনি বলেছেন, যারা আল্লাহর পথে জীবন দেয় তারা কেউ মরে না, তারা হয় চিরঞ্জীব, অমর। শাহাদাতের পেয়ালা পান করে তুমিও নিজেকে অমর করতে পারো, নশ্বর পৃথিবীতে হতে পারো চিরঞ্জীব সত্তা।

এই দেহের কি মূল্য আছে যদি তা সভ্যতা ও মানবতার কোন কল্যাণে না লাগে? দেহ তো শয়তানের দোসর হতে পারে, হতে পারে অভিশপ্তদের অন্তর্ভূক্ত! সামান্য ভোগ ও তৃপ্তির জন্য মানুষ তার ভাইয়ের গলা কাটতে পারে। বন্ধুর বুকে পা রেখে হাসতে পারে শয়তানের অট্টহাসি। এই সব মানুষরাই ধর্মত্যাগী ও মুরতাদ হয়ে যায়। আল কুরআনের পথে এসো! কোরআনই তোমাদের আত্মাকে শান্তি ও তৃপ্তি দেবে।’

খতিব সাহেবের এ ধরনের নসীহত হেমসের মুসলমানদেরকে দ্বীনের পথে অটুট ও অটল রেখেছিল। তাই তারা পরিপূর্ণ তৃপ্তির সাথে যুদ্ধের ট্রেনিং ও প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। আর এ প্রশিক্ষণ তত্ত্বাবধান করছিলেন খতিব সাহেব নিজেই। তিনি তলোয়ার ও বর্শা চালনায় ছিলেন খুবই দক্ষ। তার কাছ থেকে সেই দক্ষতা অর্জন করছিল হেমসের যুব সম্প্রদায়।

সে এলাকায় তিনটি মসজিদ ছিল। সেখানে তিনটি মসজিদেই জেহাদের বয়ান হতো। ফলে জনমত ছিল জেহাদের স্বপক্ষে। এই জনমতকে বিভ্রান্ত করার জন্য মেতে উঠলো খৃষ্টান ও ইহুদী চক্র। যে সব খৃষ্টান ও ইহুদী সেখানে বসবাস করতো তারা মুসলমানদের বন্ধু ও দরদী সেজে তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য ভয়ংকর সব গল্প ও খবর শোনাতে লাগলো।

মুসলমানরা অস্থির হয়ে খতিব সাহেবকে এই নিয়ে নানান প্রশ্ন করতে লাগলো। খতিব সাহেব হেমসের এক সাহসী যুবককে ডেকে বললেন, ‘তোমাকে দামেশক যেতে হবে। সেখানে গিয়ে জানতে হবে রমলার প্রকৃত ঘটনা। আইয়ুবীর সৈন্যদের বর্তমান অবস্থা ও মনোবল নিজ চোখে দেখে এসো তুমি। ইহুদী ও খৃষ্টানদের প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। যুদ্ধে জয়-পরাজয় একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এ নিয়ে এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই। একটি মাত্র ময়দানের জয়-পরাজয় দিয়ে যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় না।’

যুবক যুদ্ধের সঠিক তথ্য জানার জন্য দামেশকের পথ রওনা হয়ে গেল।

এ যুবকের নাম ছিল তানভীর। নির্ধারিত সময়েই আগেই যুবক যুদ্ধের সংবাদ ও তথ্য নিয়ে আবার হেমসের পথ ধরলো।

যুদ্ধের সংবাদ ও তথ্যে নেয়ার জন্য তাকে দামেশক পর্যন্ত যেতে হয়নি। রাস্তাতেই তার কাজ সম্পন্ন হয়ে গেল। সে হিম্মতের বহু দূর থেকেই ক্রুসেড বাহিনীর ক্যাম্প দেখতে পেল। তারা এক স্থানে তাঁবু টানিয়ে বিশাল এলাকা নিয়ে ক্যাম্প করেছিল। সে দূর থেকে পতাকা দেখেই চিনতে পারল, এটা খৃষ্টানদের সেনা শিবির।

তারপর কিছু দূর যেতেই তার চোখে পড়লো দুই উষ্ট্রারোহী। তারা কাছাকাছি হলে সে দেখতে পেল দু’জনই মুসলমান। সে হিম্মতের অদূরের সেনা ক্যাম্প দেখিয়ে ওদের কাছে জানতে চাইল, ‘ওটা কাদের ক্যাম্প?’

তারা বললো, ‘ওখানে ক্রুসেড বাহিনী ক্যাম্প করেছে।’ তারা আরো জানালো, ‘এই বাহিনী হিম্মাতে মুসলমানদের হাতে চরম মার খেয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে।’

তানভিল বললো, ‘আমি হেমস থেকে এসেছি। যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য আমি দামেশক যাচ্ছিলাম। আপনারা কি বলতে পারেন, ক্রুসেড বাহিনী কোন পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং এ পর্যন্ত কতটুকু এলাকা দখল করে নিতে পেরেছে?’

‘ওই যে পাহাড়ী অঞ্চল দেখা যাচ্ছে’, উটের আরোহীরা তাকে বললে, ‘ওই পাহাড়ী এলাকাতেই আমাদের সৈন্যরা আছে। দামেশক এখান থেকে অনেক দূরে, কেবলমাত্র এটুকু খবরের জন্য সেখানে যাওয়ার দরকার নেই। তুমি সোজা ও পাহাড়ে চলে যাও। এই রাস্তাই তোমাকে মুসলিম বাহিনীর কাছে নিয়ে যাবে। তুমি সেখানে সৈন্যদের যে কারো কাছে জিজ্ঞেস করলেই যুদ্ধের সব খবর জানতে পারবে।’

‘কিন্তু আমি শুনেছি রমলায় আমাদের বাহিনী পরাজিত হয়েছে!’

‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই শুনেছো। রমলাতে যে যুদ্ধ হয়েছিল যেখানে মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত হযে এদিক ওদিক ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। পরে হিম্মাত কেল্লার কাছে আবার মুসলমান ও ক্রুসেড বাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধে ক্রুসেড বাহিনী চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সেখানে থেকে পলায়ন করে এখানে এসে ক্যাম্প করে।’

‘তাহলে আর দামেশক যাওয়ার দরকার কি? আমি এখান থেকেই ফিরে যাই না কেন?’ প্রশ্ন করলো তানভীর।

‘না, এসেছ যখন সেনা ক্যাম্প পর্যন্ত হয়ে যাও। তবে সাবধান, কোন খৃষ্টান সৈন্যের মুখোমুখি পড়ো না। ওরা যদি জানতে পারে তুমি মুসলিম, তবে সঙ্গে সঙ্গে ওরা তোমাকে হত্যা করে ফেলতে পারে।’