‘ব্যাপারটা ঠিক সেই আগের ঘটনার মতই মনে হচ্ছে, যে কেসটা আমরা পূর্বেও ধরেছিলাম।’ গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান আনিসের কাহিনী শুনে বললেন, ‘ঠিক সেই মুরাকাবা, সেই চিল্লা ও জ্বীন বশীভূত করে লোকদের মনে ভয় ও ভক্তি সৃষ্টি করার অপচেষ্টা, মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে তাদের তাবেদার বানানোর খেলা।’
গোয়েন্দা বলল, ‘সে মসজিদের মুসল্লীদের জড়ো করে সৈন্যদের বিরুদ্ধে এমন সব উস্কানীমূলক কথা বলছিল, যা শুনলে যে কেউ বুঝবে, এ লোক পরিকল্পিতভাবে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।’
‘এতেই প্রমাণ হয়ে গেয়ছে, সে একা নয়। তার সাথে আরও অনেকেই আছে, যারা মসজিদে গিয়ে তার মতই মুসল্লীদেরকে সৈন্যদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে। এটা একটা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। নাটের গুরু ওই হুজুর। আর তার শাগরেদ হয়ে এ কাজ করছে দুশমন গোয়েন্দারা। আর এদের টোপ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে যুদ্ধে ফেরত মূর্খ কিছু সৈনিক ও হুজুরের অন্ধ ভক্তকূল। যারা আবেগ তাড়িত এবং হয়তো অনেকেই জানেও না তারা কি করছে।’
‘যারা যুদ্ধক্ষেত্রের মিথ্যা বর্ণনা শুনাচ্ছে আর কেউ যেন সেনাবাহিনীতে ভর্তি না হয় সে জন্য মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডা চালাচ্ছে তাদেরকে এ কথা বলে আপনি তাদের পাপ কমাতে পারবেন না।’
‘আমি তাদের পাপ কমোনা বা বাড়ানোর কথা বলছি না। আমি তাদের বুদ্ধির তারিফ করছি।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘মসজিদে মানুষ যে কথা শোনে তাকেই তারা ওহীর মত বিশ্বাস করে। মানুষ আবেগের দাস। মানুষ তাকেই মুরশিদ মান্য করে যে তার আবেগের উপর প্রথমে পা রাখতে পারে। ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য তারা ইসলামী লেবাসকেই বেছে নিয়েছে। মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বিধর্মীরা মুসলিম সমাজের নেতৃত্বও অবলীলায় কাঁধে তুলে নিয়েছে।
আর আমাদের আলেমরা? আমাদের আলেমরা রাজনীতি থেকে দূরে সরে নিজেদের ঈমান বাঁচানোর চেষ্টা করছে। যে আলেমদের দায়িত্ব মুসলিম জনগোষ্ঠীকে দিক নির্দেশনা দিয়ে সত্য সঠিক পথে পরিচালিত করা, সেই আলেম সমাজই এখন বিভ্রান্ত। দুশমনের প্ররোচনায় পড়ে ইসলামের অবিভাজ্য সত্ত্বাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করেও ভাবছে, তারা সত্য-সঠিক পথে আছে। তারা দ্বীন ও দুনিয়াকে আলাদা করে ইসলামের একক সত্ত্বাকেই দু’টুকরো করে ফেলেছে। তাদেরকে কে বুঝাবে, দুনিয়ার জন্যই দ্বীন এসেছে। দুনিয়ার জীবন মানুষকে কিভাবে চালাবে দ্বীনের বিধান শুধু তাই বলা আছে। পরকালে কিভাবে চলতে হবে সে কথা দ্বীনের বিধি-বিধানে নেই, কেননা পরকালে স্বাধীনভাবে চলার কোন অধিকার মানুষের থাকবে না।’
আলী বিন সুফিয়ানের হঠাৎ সম্বিত ফিরে এলো। তিনি তত্ত্বকথার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে এলেন। আনিসের দিকে ফিরে বললে, ‘থাক এস কথা, এবার কাজের কথায় আসি। তুমি কাল সময় মত আবার সেখানে যাও। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। যেভাবে অভিনয় করছো, সেভাবেই অভিনয় চালিয়ে যাও। তাদের আরো গভীরে প্রবেশ করতে চেষ্টা করো। যত বেশী সম্ভব তথ্য ও নিদর্শন জোগাড় করো। তোমার সংগৃহীত তথ্য ও নিদর্শনই আমার অভিযানের পথ খোলাসা করে দেবে। আর তার আগে তুমি আমাকে সেই বাড়ী ও গ্রাম চিনিয়ে দাও, যাতে আমি প্রয়োজনে সেখানে কমাণ্ডো অভিযান চালাতে পারি।’
‘আমার ভয় হয়, কমান্ডো অভিযান চালালে যদি জনগণ ক্ষেপে যায়?’ আনিস বললো, ‘রমলার সেই সৈনিক বলেছে, গ্রামের শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই তার মুরিদ হয়ে গেছে। এমনকি দূরদূরান্ত থেকেও লোকেরা তার দর্শন লাভের জন্য আসে।’
‘জনগণকে আমিও ক্ষ্যাপাতে চাই না। কিন্তু প্রয়োজনে কিছু ঝুঁকি নিতেই হবে। আমাদের এ কথা চিন্তা করলে চলবে না, লোকেরা কি বলবে। বরং আমাদের চিন্তা করতে হবে, লোকদের দিয়ে কি বলাতে হবে।’
আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘জনগণের আবেগ ও চেতনার মূল্য অবশ্যই দিতে হবে। তবে জনগণের সাথে কখনোই আমরা সেই আচরণ করতে চাই না, যেমনটি করে কোন ক্ষমতালোভী সরকার। ক্ষমতার স্বার্থে গণ আবেগকে নিজেদের পক্ষে রাখার জন্য সত্যকে তারা মিথ্যা বলতে পারে, আবার মিথ্যাকেও সত্য বলে চালিয়ে দিতে পারে। এমনটি শুধু সেই সরকারই করতে পারে, শাসন ক্ষমতা যাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।
কিন্তু মনে রেখো, আমাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। এ জন্য তিক্ত সত্যকেও দরকার হলে জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে আল্লাহর ভয়কে সামনে রেখে। জনগণকে খুশী রাখতে গিয়ে এমন কিছু করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না, যাতে আল্লাহ নাখোশ হন।’
গোয়েন্দা বললো, ‘আপনার নসিহত আমার মনে থাকবে।’
‘আমাদেরকে যেকথাটি সব সময় মনে রাখতে হবে, তা হলো, ইসলামী রাষ্ট্র ও কোরআনী শাসনতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব ও নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব চেপে আছে আমাদের কাঁধে। আমরা জনগণকে বাস্তবতা বুঝাতে চাই, সত্যের পথে পরিচালিত করতে চাই। কিন্তু আমরা কখনোই তাদেরকে সুলতান আইয়ুবীর মুরীদ বা গোলাম বানাতে চাই না।
আমাদের কাছে মানুষ হিসাবে সুলতান আইয়ুবী যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ দেশের অন্য যে কোন জনগণ আমরা তার হাতকেই শক্তিশালী করতে চাই যিনি ইসলামের অনুসারী ও খাদেম। তেমনি আমাদের কাজ ইসলামের শত্রুদের চিহ্ণিত করা এবং তাদের প্রতিহত করা।
আমরা জাতির বুকে হাত বুলিয়ে তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে চাই না, আমরা জাতিকে বাস্তবতার ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিতে চাই। তুমি গিয়ে সেই সূত্র অন্বেষণ করো যা তুমি দেখোনি। আমার বিশ্বাস, তুমি এমন কোন নিদর্শন পেয়ে যাবে, যা জনসমক্ষে তুলে ধরলে এসব ভণ্ড হুজুরদের বিরুদ্ধে তোমাকে কিছুই করতে হবে না, বরং ইসলামের প্রতি সামান্য মোহাব্বত পোষণকারী যে কোন ব্যক্তি তাদের টুকরো টুকরো করে ফেলার জন্য জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত হয়ে যাবে।’
সন্ধার পর গোয়েন্দাটির সেখানে পৌঁছার কথা। দুপুরে আলী বিন সুফিয়ান তার পোষাক পরিবর্তন করে সেই গ্রামের দিকে যাত্রা করলেন। তাকে দূর থেকে পথ দেখিয়ে চললো সেই গোয়েন্দা।
বাড়ীটার কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন তারা। ইশারায় বাড়ীটি দেখিয়ে দিল আনিস। আলী বিন সুফিয়ান বাড়ীটির অবস্থান ও চৌহদ্দি ভাল করে মনের ভেতর গেঁথে নিলেন। চারদিকটা ঘুরে ফিরে দেখার জন্য আপন মনে পা চালালেন।
বাড়ীর আশপাশের লোকালয়, দোকানপাট দেখলেন। টের পেলেন বাড়ীতে যারা আসা যাওয়া করছে তাদের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা ও অস্থিরতা বিরাজ করছে।
তিনি রাস্তার ধারের এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে লোকজনের কথা বার্তা শোনলেন। তাদের কথাবার্তা শুনে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। এখানেও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জনমনে ঝড় তোলার জন্য নানা রকম কুৎসা রটনা করা হচ্ছে একই কায়দায়।
আলী বিন সুফিয়ান দূর থেকে বাড়ীর পেছন দিকটা লক্ষ্য করলেন। বাড়ীর পেছন দিকে ছোট একটা খিড়কি দরজা। দরজাটা বন্ধ। এ পর্যন্ত একবারও কাউকে খুলতে দেখা যায়নি। দরজার পাশেই একটা গাছ। গাছটা বাড়ীর দেয়াল ছাড়িয়ে আকাশের দিকে উঠে গেছে।
বাড়ীটির ডানে এবং বামেও দু’টি বাড়ীর পেছনে আঙ্গিনা। সেদিকে কোন মানুষজন নেই। মানুষের ভীড় সামনের দিকে। তখনো তাঁর দৃষ্টি বাড়ীর পিছন দরজা ও তার আশপাশের এলাকাতেই ছিল। হঠাৎ তাঁকে অবাক করে দিয়ে বাড়ীটির পেছন দরজা খুলে গেলো। তিনি তাকিয়ে দেখলেন, সাদা দাড়িওয়ালা এক লোক ময়লা একটা পুরণো জোব্বা পরে দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছে।
চকিতে আলী বিন সুফিয়ানের দৃষ্টি গিয়ে আছড়ে পড়লো খোলা দরোজার ভেতর। সেখানে এক সুন্দরী যুবতী দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি বেরিয়ে যেতেই মেয়েটি চটজলদি দরজা বন্ধ করে দিল।
সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ লাঠি ভর দিয়ে সামনে ঝুঁকে ঝুঁকে পথ চলে গ্রাম থেকে বের হয়ে গেল। আলী বিন সুফিয়ান লোকটির পিছু নিলেন।
গ্রামের বসতি এলাকার বাইরে এসে বুড়ো এক কাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে গেল। তার পর অনুসন্ধানী চোখ মেলে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো।
একটু পর একদিক থেকে এক অশ্বারোহী এসে সেই গাছের ছায়ায় থামলো এবং ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে ঘোড়াটি তুলে দিল বৃদ্ধের হাতে। সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধা সেই ঘোড়ায় চড়ে কায়রোর দিকে রওনা হয়ে গেল।
যে লোক ঘোড়া এনেছিল সে এবার হাঁটা ধরলো এবং হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের মধ্যে ঢুকে গেল।
আলী বিন সুফিয়ান দূর থেকেই বৃদ্ধকে অনুসরণ করছিলেন। তিনি দাঁড়িয়ে সব দেখলেন। লোকটি গ্রামের মধ্যে ঢুকে গেলে আলী বিন সুফিয়ান ছুটলেন তার ঘোড়ার কাছে। তিনি ঘোড়ার কাছে পৌঁছেই লাফিয়ে চড়ে বসলেন ঘোড়ায়। সাদা দাড়িওয়ালাকে অনুসরণ করার জন্য নিজেও ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে ধরলেন কায়রোর দিকে।
আলীর বুঝতে বাকী রইলো না, এই বৃদ্ধ আসলে ঝানু গোয়েন্দা। লোকটি বৃদ্ধ নয়, কিন্তু বুড়োদের আচরণ সে নিখুঁতভাবেই করে দেখিয়েছে। গোয়েন্দাবৃত্তিতে সব ধরনের ট্রেনিংই আছে লোকটির। অতএব সতর্কতার সাথেই তাকে অনুসরণ করা দরকার।
আলী বিন সুফিয়ান নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে পথ চলছেন। তার চালচলনে কোন অস্থিরতা বা তাড়াহুরো নেই।
সেই সাদা দাড়িওয়ালা কয়েকবার পিছনে তাকালো। দু’একবার থেমে গভীরভাবে পেছনে লক্ষ্য করে দেখলো কেউ তাকে অনুসরণ করছে কিনা। কি বুঝলো সেই জানে আবার চলতে শুরু করলো।
আলী বিন সুফিয়ান তাকে অনুসরণ করা অব্যাহত রাখলেন।
কায়রো এখান থেকে আর বেশী দুরে নেই। দূর থেকে দেখা যায় শহরের প্রসাদ চূড়া। হঠাৎ সাদা দাড়িওয়ালা কায়রোর রাস্তা ছেড়ে ডান দিকের অপেক্ষাকৃত ছোট রাস্তায় নেমে গেল। ঘোড়ার গতি স্বাভাবিক। তার চালচলনেও কোন অস্বাভাবিকতা নেই।
এটা কি পেছনের অশ্বারোহী তাকে অনুসরণ করছে কিনা দেখার জন্য, নাকি এটাই তার গন্তব্য পথ বুঝতে পারলেন না আলী বিন সুফিয়ান। তিনি একটু দ্বিধায় পড়ে গেলনে। যদি তাকে পরীক্ষা করার জন্য লোকটি রাস্তা ছেড়ে থাকে তবে তার পিছু নিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। আবার পিছু না নিলে লোকটিকে হারাতে হবে। কি করবেন খানিক ভাবলেন তিনি, শেষে নিজেও অশ্বের গতি ও মুখ বৃদ্ধের ফেলে যাওয়া পথেই ঘুরিয়ে ধরলেন।
কায়রো শহর দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু সেদিকে গতি ছিল না ওদের কারো। ওরা যে পথে এগুচ্ছিল তার দু’পাশ এদিক ওদিক একটি দু’টি কুঁড়েঘর দেখা যাচ্ছে। কোথাও যাযাবরদের অস্থায়ী তাঁবু।
সাদা দাড়িওয়ালা একাধিকবার রাস্তা পরিবর্তন করলো। বার বার পিছন ফিরে দেখলো আলী বিন সুফিয়ানকে। আলী বিন সুফিয়ানের লুকোবার কোন পথ ছিল না, বাধ্য হয়ে তিনি লোকটির পিছনেই লেগে রইলেন।
সাদা দাড়িওয়ালার মধ্যে অস্থিরতা জন্ম নিল। সেই অস্থিরতা প্রকাশ পেতে লাগলো তার তৎপরতায়। অনেক হিসেব করে দেখলো, যত দ্রুতই ঘোড়া ছুটানো হোক না কেন, অনুসরণকারীকে কিছুতেই খসানো যাবে না।
শেষে লোকটি তার চলার গতি আবার কায়রোর দিকে ফিরালো এবং গতি বাড়িয়ে দ্রুত ছুটতে শুরু করলো। আলী বিন সুফিয়ানও ঘোড়ার লাগামে ঝটকা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গেল ঘোড়ার গতি। দ্রুত ঘোড়া দু’টি দিক পরিবর্তন করে কায়রোর দিকে ছুটতে লাগলো।
আলী বিন সুফিয়ান লোকটিকে ধরার জন্য প্রচণ্ড জোরে চাবুক কষলেন ঘোড়ার পিঠে। ক্রমে উভয়ের মাঝখানের দূরুত্ব কমে আসতে লাগলো। ছুটতে ছুটতে তারা শহরের একদম কাছে এসে গেল। আরেকটু পরেই সাদা দাড়িওয়ালা শহরে প্রবেশ করবে।
ওদের মাঝে তখন দূরত্ব মাত্র পনেরো বিশ গজ। সাদা দাড়িওয়ালা লোকটি শহরে ঢুকার আগ মুহূর্তে ঘোড়া থামিয়ে মোকাবেলার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।
আলী বিন সুফিয়ানের পথ রোধ করে ধরতেই তিনিও দ্রুত তার অশ্বের লাগাম টেনে ধরলেন।
‘তোমাকে কোন ডাকাত বলে মনে হচ্ছে।’ সাদা দাড়িওয়ালা এই বলে খঞ্জর বের করলো আর বললো, ‘তুমি ভুল ঠিকানায় পা দিয়েছো। আমার কাছে তেমন মূল্যবান কিছু নেই। আমার পিছনে কেন লেগেছো?’
আলী বিন সুফিয়ান বুড়োকে কাছ থেকে দেখলেন। দাড়ি দেখে মনে হয় লোকটি সত্তর আশি বছরের হবে। কিন্তু তার চেহারা, চোখ ও দাঁত বলছে, এ লোকের বয়ষ ত্রিশ, চল্লিশ বছরের বেশী নয়।
আলী বিন সুফিয়ানও তখন ছদ্মবেশে। গিয়েছিলেন এক শিষ্যের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে দুশমন গোয়েন্দাদের একটি ঘাঁটির প্রকৃত অবস্থা জানতে। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েও গিয়েছিলেন তিনি।
লোকটিকে রুখে দাঁড়াতে দেখে নিজের কোমরবন্দ থেকে সোয়া গজ লম্বা তলোয়ারটা টেনে বের করে নিলেন। তলোয়ারটা তার জোব্বার মধ্যে লুকানো ছিল। চোখের পলকে তলোয়ার বের করে বললেন, ‘তোমার দাড়িটা ফেলে দাও।’ আলী বিন সুফিয়ান তার চোয়ালের পাশে তলোয়ারের মাথা ঠিকিয়ে বললেন, ‘আর আমার আগে আগে চলতে থাকো।’
সাদা দাড়িওয়ালার চক্ষু স্থির হয়ে গেল। আলী বিন সুফিয়ান তলোয়ারের মাথা তার দাড়ির পাশে ঠেকিয়ে একটু টান দিতেই তার দাড়ি মুখ থেকে খসে পড়ল। নিজের পরিচয় লুকানোর চেষ্টা বৃথা দেখে লোকটি মাথা নত করলো।
আলী বিন সুফিয়ান তাঁর মুখে বিস্ময় ও বিষন্নতা দেখে বললেন, ‘আমার দু’জনেই একে অপরকে ভালমত চিনি। ভনিতা না করে চলো এখন যাওয়া যাক।’
লোকটি শহরের খুব প্রভাবশালী ও উচ্চতর প্রশাসনিক অফিসার ছিল না বটে কিন্তু সে একেবারে অপরিচিত বা নিম্ম শ্রেণীরও কেউ ছিল না। সে মিশরেরই নাগরিক এবং মিশর সরকারের এক মধ্যমগোছের অফিসার ছিল।
তার সম্পর্কে আলী বিন সুফিয়ানের কাছে এ খবর আগেই পৌঁছে ছিল যে, তার গতিবিধি সন্দেহজনক। সম্ভবত সে দুশমনের গোপন চর। কিন্তু প্রমান না থাকায় এতদিন তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যায়নি।
সে খেলাফতের রাজধানী কায়রোতে দীর্ঘদিন যাবত সরকারী কর্মচারী হিসাবে নিযুক্ত আছে। সুলতান আইয়ুবী ক্ষমতায় আরোহণের সাত আট বছর আগেই সে চাকরীতে যোগদান করে। খলিফা আল আজিদ যখন ফেদাইন দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্রুসেড ও সুদানীদের সঙ্গে জোট গঠন করেছিল তখনই মূলত এ লোক তাদের সঙ্গে হাত মিলায়। এরপর থেকে এতটা বৎসর প্রশাসনের ভিতর ঘাপটি মেরে পড়ে থেকে সে দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে অপতৎপরতায় লিপ্ত ছিল।
সুলতান আইয়ুবী নুরুদ্দিন জঙ্গীর সাথে পরামর্শ করে খেলাফতের অনেক দুশমনকে অপরাসণ করেছিলেন। কিন্তু আব্বাসীয় খেলাফতের অনুসারী এই ধুরন্ধর ব্যক্তিটি নিজের পরিচয় গোপন করে কিভাবে এতদিন টিকেছিল, ভেবে অবাক হলেন আলী বিন সুফিয়ান। আরো অবাক হলে, এতকাল পরও লোকটি গোপন ষড়যন্ত ও চক্রান্তে লিপ্ত আছে দেখে।
রমলার পরাজয় এইসব দেশদ্রোহীদের জন্য এক সোনালী সুযোগ বয়ে নিয়ে এলো। সুলতান আইয়ুবী ও তার বাহিনীকে পাপিষ্ঠ, বিলাসপরায়ণ ও লুটেরা প্রমাণ করতে পারলে দীর্ঘদিন তারা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না ভেবে আব্বাসীয় খেলাফতের পরাজিত বাহিনী গোপন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠল। লোকটি ছিল সেই গোপন তৎপরতার ধুসন্ধর নায়ক।
আলী বিন সুফিয়ান লোকটাকে বন্দী করে সেই গোপন কারাগারে নিক্ষেপ করলেন, যেখানে রাষ্ট্রদ্রোহীদের জন্য বরাদ্দা থাকে সুকঠিন শাস্তি।
আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা রাতের আঁধারে গ্রামের বাইরে হুজুরের বলা সেই মসজিদের সামনে ঠিক সময়েই গিয়ে উপস্থিত হলো। গত রাতের সেই সৈনিক সেখানে তার জন্য আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। সে ওখানে পৌঁছতেই সৈনিকটি তার কাছে এসে আগ্রহ ভরে বলল, ‘এসে গেছো তাহলে? তোমার জন্য অনেক্ষণ ধরে বসে আছি। চলো, এখানে আর দেরী করার দরকার নেই।’
আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা গত রাতে দেখা সৈনিকটির নির্দেশ মত চলতে শুরু করলো। গ্রামে এসে সদর দরজা দিয়ে না ঢুকে ওরা পিছনের দরজা দিয়ে বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করল।
বাড়ীতে ঢুকে লোকটি গতকাল তাকে যে কামরায় নিয়ে গিয়েছিল সেখানে না নিয়ে অন্য এক কামরার দিকে পা বাড়াল। আনিস বলল, ‘ওদিকে কোথায়, হুজুর এ কামরায় বসে না?’
লোকটি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘আস্তে! তোমাকে ঠিক জায়গাতেই নিয়ে যাচ্ছি। ভয় নেই, এখানে আমারা হুজুরের নির্দেশ ছাড়া কিছুই করি না। সে গত রাতের কামরায় যাওয়ার পরিবর্তে লোকটির সাথে অন্য আরেক কামরায় গিয়ে প্রবেশ করলো। এ কামরায় সে অলৌকিক ক্ষমতাধর হুজুরকে কোথাও দেখতে পেল না।
সে কামরার চারদিকে চোখ বুলাল। কামরায় কোন আসবাবপত্র নেই। না কোন চেয়ার-টেবিল, না কোন খাট। এমনকি কামরায় কোন চাটাই বা চাদরও নেই।
গোয়েন্দার সব কটা ইন্দ্রিয় ততক্ষণে সজাগ হয়ে উঠেছে।
চট করে সে চাইল দরজার দিকে। ততক্ষণে দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। সে তাকিয়ে দেখলো, তাকে নিয়ে আসা সৈনিকটি কামরার বাইরে চলে গেছে। ঘুরে দ্রুত দু’পা এগিয়ে দরজায় হাত লাগলো, দেখলো দরজা বাইরে থেকে বন্ধ।
সে বুঝতে পারলো, তার অভিনয় সব বৃথা গেছে, তাকে তারা চিনে ফেলেছে। মুহূর্তে শত্রুর হাতে ধরা পড়ার চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। বুঝতে পারলো, এখন পালাবার আর কোন সম্ভাবনা নেই। সে সেই ঘরে বসে কি করা যায় একা একা চিন্তা করতে লাগলো।
রাত গভীর থেকে গভীরতর হলো। অন্ধকার কামরার মেঝেতে বসে আছে আনিস। কায়রোর মানুষ গভীর ঘুমে আচ্ছান্ন, কিন্তু তার চোখে কোন ঘুম নেই। সে খতিয়ে দেখছিল, কোথায় সে বোকামী করেছে, কেমন করে তার গোপন পরিচয় প্রকাশ হয়ে গেল? কিন্তু ঠিক বুঝতে পারল না কোথায় সে ভুল করেছে।
নিজেকে বড় অযোগ্য ও অপদার্থ মনে হচ্ছিল। এর মধ্যেই সে কামরার চারদিক খুঁজে দেখেছে, পালাবার কোন পথ বা ফাঁকফোঁকড় আছে কিনা? কিন্তু না, হতাশ হতে হলো তাকে।
মধ্য রাত। অন্ধকারে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে আনিস। হঠাৎ তার মনে হলো, কেউ একজন দরজা খোলার চেষ্টা করছে। উৎকর্ণ হলো সে, কে খুলতে পারে দরজা! যদি শত্রুই খুলবে তবে এত সতর্কতার দরকার কি? আর মিত্রই বা আসবে কোত্থেকে? মিত্রদের কেউ তো এখনো জানেই না, সে এখানে বন্দী হয়ে আছে। এক অনিশ্চিত শংকা নিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল আনিস।
আনিস দরজার দিকে পা বাড়াতে যাবে এ সময় খট করে খুলে গেল দরজা। সে দরজার দিকে তাকিয়ে যা দেখলো তা ছিল অবিশ্বাস্য, এক অনিন্দ্যসুন্দর মেয়ে দরজার আলো করে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে প্রদীপ।
এ ছিল সেই দুই মেয়ের একজন, যারা হুজুরের কন্যা পরিচয়ে রমলা থেকে এসেছে। মেয়ের পরণে এখন আর বোরখা ছিল না, তবে ইউরোপীয় মেয়েদের মত উলংগও ছিল না। তার পরণে ছিল মুসলমান, মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী আরবী পোষাক।
মেয়েটি কামরার ভিতর ঢুকতেই কেউ একজন বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে শিকল এঁটে দিল।
মেয়েটির হাতের আলোয় কামরাটি আলোকিত হয়ে উঠলো। গোয়েন্দার দিকে তাকালো মেয়েটি, তার চোখ মুখে মধুর হাসি। আনিস সেই হাসিমাখা মুখের দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে রইল।
‘আমাকে চিনতে চেষ্টা করছো তো?’ মেয়েটি বললো, ‘এত তাড়াতাড়িই ভুলে গেছো সব?’
আনিস স্মৃতি হাতড়ে মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছিল। মেয়েটি তাকে সাহায্য করার জন্য বললো, ‘যখন তুমি আমার শহর থেকে পালিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলে তখন ভাবতে পারিনি তোমাকে আর কখনো হাতের নাগালে পাবো। কিন্তু দুর্ভাগ্য তোমার, নিজের শহরে এসে আজ আবার বন্দী হয়ে গেলে। এবার আর পালিয়ে যাওয়ার কোন মওকা তুমি পাবে না।’
আনিস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার দীর্ঘশ্বাসে যেমন প্রশান্তি ছিল তেমনই ছিল অস্থিরতা। তার স্মৃতিপটে তিন বছর আগের একটি দিনের কথা মনে পড়ে গেল। গোয়েন্দাগীরির জন্য তাকে আক্রা পাঠিয়েছিলেন আলী।
আক্রা তখন খৃষ্টানদের দখলে। সেখানে তাদের এক বড় পাদরী থাকতো। তাকে সবাই ডাকতো গ্রেট ফাদার বলে। আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্রুসেড রাজারা যেসব বাহিনী পাঠাতো, অভিযানের আগে তার সেনাপতিরা অবশ্যই একবার আক্রা আসতো সেই গ্রেট ফাদারকে অভিবাদন করে দোয়া নিতে। কারণ সামিক দিক থেকে স্থানটি ছিল খুবই গ্রুরুত্বপূর্ণ। আর এই ফাদারের কাছে এমন সব গোপন তথ্য থাকতো, যা অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণে অপরিহার্য বিবেচিত হতো।
এ ব্যাপারটি আলী বিন সুফিয়ানের নজরে এলে তিনি সেখানে নিজস্ব গোয়েন্দা পাঠানোর জরুরী মনে করলেন। তখন সেখানে যে বাহিনী পাঠানো হয় আনিস ছিল সেই দলের একজন।
ওরা সেখানে ছিল খৃষ্টান ছদ্মবেশে। সেখানে ওরা এক গোপন আড্ডা বানিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু গোয়েন্দাগীরি হচ্ছে এক মরনঘাতি খেলা। পদে পদে বিপদ, পদে পদে মৃত্যুর হাতছানি। মুহূর্তে আমূল পাল্টে যায় ঘটনার দৃশ্যপট।
তাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, হঠাৎ একদিন তাদের মধ্য থেকে তিন চারজন ধরা পড়ে যায়। মোকাবেলা করতে গিয়ে দুইজন শহীদ হয়। কিন্তু সৌভ্যাক্রমে আনিস বেঁচে যায়। দুশমনের দুর্ভেদ্য জাল কেটে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয় সে। তারপর সেখান থেকে পালিয়ে সোজা এসে রিপোর্ট করে কায়রো।
আনিসের গায়ের বর্ণ ফর্সা। দেহের গঠন এবং আকৃতিও ছিল খুবই নিঁখুত ও আকর্ষণীয়। সুন্দর মুখের জয় সবর্ত্র প্রবাদটি যদি সত্যি হয় তাহলে তার জীবনের সাফল্যের জন্য তার চেহারাটিই যথেষ্ট। কিন্তু এ বিষয়টি সম্পর্কে কখনোই তাকে সজাগ বলে মনে হয়নি। সে তার সাফল্যের জন্য বুদ্ধি ও মেধাকেই অধীক গুরুত্বপূর্ণ মনে করতো।
আলী বিন সুফিয়ান তাকে খুব বিচক্ষণ ও সতর্ক গোয়েন্দা মনে করতেন। অশ্বারোহী হিসেবে সে যেমন পটু ছিল তেমনি চৌকস ছিল তলোয়ার ও নেজাবাজিতে। সামরিক মহড়ায় সে দর্শকদের অভিভূত করে কুড়িয়ে নিত হাততালী। এমনকি অভিনয়েও তার দক্ষতা ছিল সকলের ঈর্ষার বস্তু।
হুজুরের সামনে সে গতকাল যখন কাঁদছিল, হুজুরও ভাবতে পারেননি, এটা বাস্তব নয়, অভিনয়। এতটা স্বাভাবিক ও আন্তরিক ছিল তার অভিনয়।
আক্রাতে এক খৃষ্টান নামে পরিচিত ছিল আনিস। সেখানে সে এক বেদনাময় জীবনের কাহিনী ফেঁদে মানুষের সহানুভূতি কুড়িয়েছিল। সে বলেছিল, ‘হলবে মুসলমান সৈন্যদের অশ্বারোহণ ও যুদ্ধের ট্রেনিং দেখে আমারও সৈনিক হওয়ার ইচ্ছে জাগে। আমি ঘোড়দৌড়ের বাহিনীতে ভর্তি হয়ে ঘোড়সওয়ারী শেখার সাথে গোপনে অস্ত্রের ট্রেনিং নেয়া শুরু করেছিলাম।
মুসলমানরা কেমন করে যেন এ খবর পেয়ে যায়। এক রাতে একদল ডাকাত আমাদের বাড়ীতে হামলা চালায়। তারা আমার পিতা-মাতাকে হত্যা করে এবং আমার দুই যুবতী বোনকে তুলে নিয়ে যায়। আমার ওপর হামলা হতে পারে এই আশংকায় এর কয়েক আগের রাত থেকেই আমি সাবধান হয়ে গিয়েছিলাম। রাতে আমি বাড়ীতে থাকতাম না, থাকতাম এক বন্ধুর বাড়ী। সে রাতে আমি বাড়ী ছিলাম না বলে প্রাণে বেঁচে যাই।
এ হামলার পর হলবে আমার পক্ষে আর থাকা সম্ভব ছিল না। আমি পরের দিন এক গোপন জায়গায় লুকিয়ে থেকে রাতের অন্ধকারে হলব থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসি। আসার সময় আমি আমার পৈত্রিক সম্পত্তির কিছুই আনতে পারিনি। সব হলবে ফেলে রেখে কেবল আমার প্রিয় ঘোড়াটি সঙ্গে নিয়ে হলব ত্যাগ করি। অনেক কষ্টে, অনাহারে অর্ধাহারে ভুগতে ভুগতে অবশেষে আমি এই আক্রাতে এসে পৌঁছতে সক্ষম হই।’
তার সুন্দর চেহারা আর মায়াময় চাহনি দেখে সবাই তার কথা বিশ্বাস করে নেয়। গ্রেট ফাদার তার সৈনিক হওয়ার আগ্রহ দেখে তাকে গির্জায় না রেখে স্থানীয় সেনা ছাউনিতে পাঠিয়ে দেন। সেখানে সে অল্প সময়েই নিজেকে একজন ভাল অশ্বারোহী ও যোদ্ধায় পরিণত করতে সক্ষম হয়। সেনা অফিসার তার বুদ্ধি ও দক্ষতা দেখে তাকে অল্পদিন পরেই সেখানকার একজন প্রশিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেন। সেই থেকে সে আক্রার সেনা ক্যাম্পে একজন শিক্ষক হিসেবে কাজ করছিল।
নিয়মিত সৈনকিদের ট্রেনিং দেয়ার কাজ ক্যাম্পের পুরাতন ও নিয়মিত প্রশিক্ষকদের হাতেই ছিল। সে ট্রেনিং দিত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীতে ভর্তি হতে ইচ্ছুক যুবক-যুবতীদের।
এখানে যারা ট্রেনিং নিতে আসতো তাদের অধিকাংশই ছিল সুন্দরী ও যুবতী মেয়ে। বড় বড় সামরিক অফিসারদের সন্তানরাও ট্রেনিং নিতে আসতো। সে জানতে পারল, এ সব মেয়েদের ট্রেনিং দিয়ে মুসলমান এলাকায় গোয়েন্দাগীরি করতে পাঠানো হয়। পরে যেসব পুরুষরা তার কাছে ট্রেনিং নিতে এসেছিল, আনিস খোঁজ নিয়ে জেনেছে, এরা সবাই ছিল খৃষ্টান গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য। সে ওদের সাথে এমনভাবে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল যে, তাদের নিকট থেকে দামী দামী তথ্য ও রিপোর্ট সে অনায়াসেই সংগ্রহ করে নিতে পারতো।
যে মেয়েটি এখন কায়রোর শহরতলীর এক গ্রামের গোপন কামরায় বসে তাকে বলছে ‘এবার আর পালিয়ে যাওয়ার কোন মওকা তুমি পাবে না’ সে একদিন আক্রাতে তারই শাগরেদ ছিল। মেয়েটি গোয়েন্দাগীরিতে দক্ষ হলেও অশ্ব চালনা জানতো না। তাকে অশ্বারোহনের ট্রেনিং দেয়ার ভার পড়েছিল মার্করূপী আনিসের হাতে।
সুদর্শন মার্ককে প্রথম দেখাতেই ভাল লেগে গিয়েছিল মাইসার। ট্রেনিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে ওদের মধ্যে চলতে লাগলো মন দেয়া-নেয়ার খেলা। এভাবেই উস্তাদ শাগরেদের সম্পর্ক চুকিয়ে ওরা ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হলো। তারপর সেই বন্ধুত্ব গিয়ে ঠেকলো প্রেমিক-প্রেমিকাতে।
মেয়েটির ভালবাসায় কোন খাঁদ ছিল না। তাই মেয়েটি সিদ্ধান্ত নিল, গোয়েন্দাগীরি পেশা ত্যাগ করে সে মার্কের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসার জীবন যাপন করবে।
কিন্তু মার্ক মেয়েটির সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল নিছক দায়িত্বের কারণে। মেয়েটির সাথে তার সম্পর্ক যত মধুর হবে ততই তথ্য সংগ্রহের সুবিধা হবে ভেবে সে মেয়েটির সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল।
ওরা দু’জনই ভালবাসার জোয়ারে ভেসেছিল ঠিক, কিন্তু মাইসার মত মার্ক ভালবাসার টানে তার আসল দায়িত্বের বিষয়টি ভুলে যায়নি। মেয়েটির গোয়েন্দাগীরিতে মন ছিল না, তার মন তখন মার্ককে নিয়ে ভালবাসার প্রসাদ নির্মাণে ব্যস্ত।
একদিন আক্রাতে দুই মুসলমান গোয়েন্দা ধরা পড়ে গেল। তাদের একজন কঠিন শাস্তির মুখে তার দলের সমস্ত লোকজনের নাম ঠিকানা বলে দিল। যাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল তাদের মধ্যে ছিল গোয়েন্দা মার্কও। স্বাভাবিক ভাবেই সে মুসলিম গোয়েন্দা, একথা জেনে গেল খৃষ্টানরা।
খৃষ্টানরা মার্কের পেছনে টিকটিকি লেলিয়ে দিল। তারা মার্কের প্রতিটি গতিবিধির ওপর কড়া দৃষ্টি রাখা শুরু করলো। একজন গোয়েন্দা হিসাবে খবরটি জেনে গেল মাইসাও। সে একদিন আশ্চর্য হয়ে মার্ককে জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা, তুমিতো আর গোয়েন্দা নও, আর মুসলনামও নও? কিন্তু আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা তোমাকে সন্দেহ করছে কেন? তুমি কি জানো তোমার উপর আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ কড়া দৃষ্টি রাখছে?’
আনিসের জন্য এ ছিল এক অতি মূল্যবান খবর। মাইসার কাছ থেকে এ খবরটি সময় মত না পেলে তার জীবন প্রদীপ হয়তো সেখানেই নিঃশেষ হয়ে যোতো। প্রশ্ন শুনে মার্ক হেসে বলেছিল, ‘আমাকে সন্দেহ করছে শুনে খুশী হলাম। এতে প্রমাণ হলো, আমাদের গোয়েন্দারা যথেষ্ট তৎপর। এভাবে প্রতিটি লোককেই মাঝেমধ্যে যাচাই বাছাই করা দরকার। যখন সন্দেহ দূর হবে তখন আপনাতেই দৃষ্টি সরিয়ে নেবে।’
মুখে এ কথা বললেও ভেতরে ভেতরে সে খুব অস্থিরতা বোধ করছিল। রাতে সে এমন একজনের সাথে দেখা করল, আক্রার সাধারণ মুসলমান গোয়েন্দারা যার সম্পর্কে কিছুই জানতো না। কেবল কমাণ্ডাররা জানতো, বিপদে পড়লে তার সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
সে লোক আনিসকে দেখেই বললো, ‘আমি তোমার সাথে দেখা করবো ভাবছিলাম। তোমার দলের অনেক সদস্যের নাম পরিচয় প্রকাশ হয়ে গেছে। সেই তালিকায় তোমার নামও আছে। তোমার জন্য আর এক মুহূর্তও আক্রা থাকা নিরাপদ নয়। তোমাকে এখনি এখান থেকে পালাতে হবে। আমার পরামর্শ হচ্ছে, এখান থেকে বেরিয়ে তুমি আর তোমার আস্তানায় ফিরবে না, সোজা কায়রোর পথ ধরবে।’
এ লোকের পরামর্শই হুকুম। আনিস সেখানে আর দেরী না করে তাকে সালাম জানিয়ে বেরিয়ে এলো।
কামরা থেকে বেরিয়ে পথে নেমেই আনিস টের পেলো, দুটি লোক তাকে অনুসরণ করছে। সে অনুসরণকারীদের খসানোর জন্য আক্রার বিভিন্ন পথে হাঁটলো, নানা রকম চেষ্টা করলো, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।
অবশেষে সে এক ঘোড়ার আস্তাবলের কাছে এসে থেমে গেল। যে লোক দু’জন তাকে অনুসরণ করছিল এবার তারা এগিয়ে এলো তার কাছে। আনিস আস্তবলে ঢুকে দ্রুত হাতে একটা ঘোড়ার মুখে লাগাম পরিয়ে বাইরে নিয়ে এলো। আস্তাবল থেকে বেরিয়েই সে ওদের সামনে পড়ে গেল। লোক দু’জন তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় যাচ্ছো?’
এ প্রশ্নের যে জবাবই দেয়া হোক না কেন, লোক দু’জন তাতে সন্তুষ্ট হবে না, জানে আনিস। তার বুদ্ধি তাকে বললো, ‘এখন আর কোন কথা নয়, জলদি পালাও।’
সে লাফিয়ে ঘোড়ার উপর উঠে সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। এক লোক তাকে বাঁধা দিতে গেল, সঙ্গে সঙ্গে সে ঘোড়ার পায়ের তলে পিষে গেল। আনিস প্রাণপণে ঘোড়া ছুটিয়ে আক্রা থেকে বের হয়ে এলো।
‘মাইসা, আমি তোমাকে চিনে ফেলেছি।’ সে মেয়েটিকে বললো। তিন বছর পর তারা দু’জন একে অপরকে দেখছে। ‘আমি তোমাকে এখানে এই অবস্থায় দেখে মোটেই বিস্মিত নই। কারণ আমি জানি তুমি এখন পরিপূর্ণ এক গোয়েন্দা।’
‘তিন বছর আগে তোমার ফাঁদে পড়ে আমি গোয়েন্দাগীরি ত্যাগ করতে চেয়েছিলাম। গোয়েন্দাগীরি ছেড়ে আমি তোমাকে নিয়ে ঘরও বাঁধতে চেয়েছিলাম।’ তখন তুমি যদি বলতে, তুমি মুসলমান এবং গোয়েন্দা, তবুও তোমার সঙ্গে আমি প্রতারণ করতাম না। বরং তোমার সঙ্গে বিনা দ্বিধায় পালিয়ে যেতে প্রস্তুত ছিলাম। তুমি পালিয়ে যাওয়ার পর যখন জানতে পারলাম, তুমি মুসলমান এবং গোয়েন্দা ছিলে তখনও তোমার প্রতি আমার কোন ঘৃণা জন্মায়নি। কিন্তু তোমাকে হারিয়ে আমি ভীষণ ব্যথা পেয়েছিলাম। আমার ভালবাসাকে অপমান করেছো বলে কষ্ট পেয়েছিলাম।’
‘কেন, এখন কি তোমার মনে আমার জন্য কোন ভালবাসা নেই?’ আনিস বললো, ‘এখন তো তুমি আমার দেশেই আছো। এখানে যেমন আমার জীবনের নিরাপত্তা আছে, তেমনি তুমি চাইলে তোমার নিরাপত্তা দেয়ার সামর্থও আজ আমার আছে। তুমি জানো, সেদিন পালিয়ে আসা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। মৃত্যু আমাকে এমনভাবে তাড়া করেছিল যে, তোমার কাছ থেকে বিদায় নেয়ারও কোন উপায় ছিল না। আমি তোমাকে ধোঁকা দেইনি। নিরূপায় হয়ে বিচ্ছেদ মেনে নিয়েছিলাম। তবে আজ যদি তুমি আমার সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারো, কথা দিচ্ছি, আর কখনো ওমন বিচ্ছেদে তোমাকে পড়তে দেবো না।’
‘মন্দ বলোনি। হ্যাঁ, স্বীকার করি তোমার প্রতি ভালবাসা আমার এখনও আছে।’ মেয়েটি বললো, ‘কিন্তু সেই ভালবাসাকে ছাপিয়ে আছে আমার দায়ীত্বের বোঝা। আর এ জন্য তুমিই দায়ী। আমি তো তোমার জন্য গোয়েন্দাগীরি ছেড়েই দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমিই তা হতে দাওনি। তুমি আমার ইচ্ছাকে পদদলিত করে আমাকে এই জঘন্য পেশায় ডুবে থাকতে বাধ্য করেছো।
তুমি আমাকে ত্যাগ করার পর সেখানকার মরুভূমির ওপর দিয়ে অনেক লূ-হাওয়া বয়ে গেছে। আমার অন্তরের প্রেম আর ভালবাসা শুকিয়ে গেছে সেই লূ-হাওয়ায়। আম ট্রেনিং শেষে পরিপূর্ণভাবে মন দিতে বাধ্য হয়েছি গোয়েন্দাগীরিতে। এখন আমি কোন অনাড়ি গোয়েন্দা নই, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এক ঝানু গোয়েন্দা। এই ঝানু গোয়েন্দা হতে গিয়ে নিজের সব সুকুমার বৃত্তিগুলোকে কোরবানী করতে হয়েছে। এমন সব জঘন্য ও অপবিত্র কাজে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে, যার কথা কোনদিন কল্পনাও করনি। আমি এখন আর কোন প্রেম ভিখারী নারী নই, আমি এখন ছলনাময়ী এক নিষ্ঠুর ডাইনী।
তোমাকে নিয়ে যতদিন স্বপ্ন দেখেছি ততদিন তোমার ধর্মের প্রতি আমার কোন আক্রোশ বা ঘৃণা ছিল না। হয়তো তোমার সাথে তাোমার ধর্মকেও ভালবেসে ফেলতে পারতাম। কিন্তু আজ? আজ ইসলামের প্রতি চরম আক্রোশ ও ঘৃণা নিয়ে আমি ছুটে চলেছি তার বিনাশ সাধনের জন্য। এখন আমি জানি, মুসলমান নিধন করতে পারলেই নিঃশেষ হবে ইসলাম। তোমার প্রতারণা মুসলমাদের প্রতি আমার আক্রোশ ও নিষ্ঠুরতা আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
শোন আনিস, তোমার প্রেমে যখন হাবুডুবু খাচ্ছিলাম তখন তোমার জন্য মরতেও আমার কোন দ্বিধা ছিল না। আর এখন? এখন আমি এমন নিষ্ঠাবান গোয়েন্দা যে, প্রয়োজনে নিজের সকল ভাল লাগা বালবাসাকে নিজ হাতে হত্যা করতেও দ্বিধায় কাঁপবে না আমার হাত।
এখন তুমি আমার এক বন্দী ছাড়া আর কেউ নও। আমি আমার মিশনকে ধোঁকা দিতে পারবো না। আমি যার সঙ্গে এসেছি তিনি জানতেন না তুমি গোয়েন্দা। আমিই তাকে বলে দিয়েছি, তুমি এক গোয়েন্দা। আমি তাকে আক্রার সব কাহিনী বলে দিয়েছি। যদি আমি তোমাকে উঠান দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ দেখে না ফেলতাম তবে আমরা সবাই গ্রেফতার হয়ে যেতাম। অতএব বুঝতেই পারছো, তোমাকে আমিই ধরিয়ে দিয়েছি।’
‘যে পীর সাহেব অদৃশ্যের খবর বলতে পারেন, তিনি মুসলমান না খৃষ্টান?’ গোয়েন্দা আনিস তাকে প্রশ্ন করলো।
‘এখন এ প্রশ্ন করে আর কি হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা তোমার জন্য অবান্তর।’ মেয়েটি বললো।
‘গোয়েন্দাগীরির এটাই তো বড় দোষ। রক্ত মাংসের সাথে একাকার হয়ে মিশে গিয়ে তা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়।’ গোয়েন্দা বললো, ‘মৃত্যুর আগেও জানার আগ্রহ থেকেই যায়। এখন এ সংবাদ বলতে তোমারই বা এত আপত্তি কেন? এখন তো কোন খবর আর আমি বাইরে পাঠাতে পারবো না।’
‘ইনি মুসলমান!’ মেয়েটি বললো, ‘ইনি মুসলমানের দুর্বলতা সম্পর্কে এত কিছু জানেন যে, তাকে আমরা উস্তাদের উস্তাদ বলি!’
কামরার দরজা খুলে গেল। হুজুর এক লোকের সঙ্গে কামরায় প্রবেশ করলো। মেয়েটিকে বললো হুজুর, ‘যদি তোমার কথা শেষ হয়ে থাকে তবে বাইরে যাও।’
মেয়েটি দাঁড়িয়ে আনিসের দিকে কয়েক পলক করুণ নয়নে তাকিয়ে রইল, তারপর হঠাৎ ঘুরে শ্লথ পায়ে বাইরে চলে গেল।
কালো দাড়িওয়ালা হুজুর তাকে প্রশ্ন করলো, ‘বুদ্ধিমান যুবক, আমাকে শুধু এটুকুই বলো, আমাদের পরিচয় তুমি কাকে কাকে বলে দিয়
েছো। তুমি কি আলী বিন সুফিয়ানকে বলে দিয়েছো, আমি এক সন্দেহজনক লোক?’
‘না সত্যই আমি গোয়েন্দা, কিন্তু এখানে গোয়েন্দাগীরির জন্য আসিনি।’ গোয়েন্দা বলিষ্ঠভাবে উত্তর দিল।
হুজুরের হাতে ছিল চামড়ার চাবুক। আনিসের কথা শেষ হওয়ার আগেই সে চাবুক আঘাত হানল তার পিঠে। একবার নয়, ক্রমাগত কিছুক্ষণ দ্রুত চাবুক চললো যে আনিস ঘটনার আকস্মিকতায় হতবুদ্ধি হয়ে গেল।
হুজুর হঠাৎই আবার মারপিট থামিয়ে বরলো, ‘আমি শুধু সত্যি কথাটা শুনতে চাই।’
আনিস এ কথার কোন জবাব না দেয়ায় হুজুর আবার চাবুক তুলল। দু’তিনবার চাবুক তুলতেই আকস্মাৎ খুব জোরে শব্দ করে খুলে গেলো দরজার পাল্লা। মেয়েটি দ্রুত ভিতরে ঢুকে বললো, ‘ওকে আর মারবেন না।’ সে হুজুরের দু’টি হাত আকড়ে ধরে অনুনয় করে বললো, ‘ওর কাছ থেকে আপনি যা জানতে চান আমাকে বলুন। আমি ওর কাছ থেকে সব কথা আদায় করে আপনাকে বলে দিচ্ছি।’
‘না, আমি কিছুই বলবো না।’ আনিসের কণ্ঠে দৃঢ়তা।
আনিসের কথা শেষ হতেই হুজুর সঙ্গে সঙ্গে আবার চাবুক তুললেন। তিনি চাবুকটি উঠিয়ে মারতে যাবেন, মেয়েটি দৌড়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো এবং চিৎকার করে বললো, ‘একে মেরো না। এর শরীরের প্রতিটি আঘাত আমার অন্তর ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে।’
‘তুমি একে বাঁচাতে চাও?’ সঙ্গের লোকটি গর্জন করে উঠলো।
‘না!’ মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘ও যদি কিছু না বলে তবে তলোয়ারের এক আঘাতে ওর মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দাও। কিন্তু এভাবে নির্যাতন করে কষ্ট দিয়ে মোরো না।’
কিন্তু এ আবেদনে কোন ফল হলো না। হুজুর সঙ্গের লোকটিকে চোখে ইশারা করে বললো, ‘একে বাইরে নিয়ে যাও।’
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটাকে টেনে বাইরে নিয়ে গেল লোকটি। ওকে পাশের কামরায় নিয়ে অন্য মেয়েটাকে বললো, ‘দরজা বন্ধ করে দাও। দেখো মাইসা যেন বাইরে যেতে না পারে।’
লোকটি ফিরে এলো কামরায়। আনিসের ওপর এবার শুরু হলে তথ্য আদায়ের জন্য অকথ্য নির্যাতনের নতুন মাত্রা। দুইজনে পালা করে তাকে দিচ্ছিল নানা রকম লোমহর্সক শাস্তি। এ শাস্তি চললো রাতভর।
সারা রাত ওরা তাকে শুতে দিল না, বসতেও দিল না। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে উত্যক্ত করলো তাকে, কিন্তু সে নির্বিকার। অনেক প্রলোভন দেখানো, কিন্ত তাতেও কাজ হলো না ।
প্রলোভনেও কাজ না হওয়ায় আবার শুরু হলো তার উপর আঘাতের পর আঘাত। সেই অসহ্য আঘাত খেয়েও মূর্তির মত অটল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে।
এভাবে আঘাতের পর আঘাত খেয়ে এক সময় সে লুটিয়ে পড়লো। সকালের দিকে জ্ঞান হারালো আনিস।
ভোর। সারা রাত কেঁদে কেঁদে সকালের দিকে মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু সে সামান্য সময়ের জন্য মাত্র। সহসাই সে আবার জেগে উঠলো এবং চারদিক তাকিয়ে দেখলো ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই রাতের অন্ধকার কেটে ফর্সা হয়ে এসেছে প্রকৃতি। মাইসা লক্ষ্য করে দেখলো, এখন আর চাবুকমারা বা আনিসের আর্তনাদ কিছুই শোনা যাচ্ছে না। সে সহসা উঠে বসলো এবং দ্রুত কামরায় কবাট খুলে বাইরে এসে গিয়ে ঢুকলো আনিসের কামরায়।
আনিস তখন অর্ধ-মৃত অবস্থায় মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছিল। তার সারা গায়ে চাবুক ও তলোয়ারের খোঁচার রক্তাক্ত দাগ। সে মেঝেতে পড়েছিল বেহুশ হয়ে। এখন তাকে আঘাত করা আর আদর করা সমান করা। কারণ কোন কিছুই অনুভব করার মত অবস্থা তার নেই।
মেয়েটি কামরায় ঢুকে দেখলো রক্তাক্ত শরীর নিয়ে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে আনিস। সে আনিসের এই করুণ পরিণতি সহ্য করতে পারলো না। কতক্ষণ বিহ্বল চিত্তে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল, শেষে সইতে না পেরে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার উপর। আনিসের বুকের ওপর পড়ে থেকে অনেক্ষণ অঝোর ধারায় কাঁদলো। বার বার বললো, ‘হায়! এ আমি কি করলাম! এ দশা যে আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’
অনেক্ষণ পরে বুক থেকে মাথা তুলে বলরো, ‘আমি তো তোমাকে অনেক বার বলেছি, তুমিই আমার প্রথম ও শেষ ভালবাসা। তোমার কষ্টই আমার কষ্ট, তোমার মৃত্যুই আমার মৃত্যু।’
আরো কিছুক্ষণ পরের কথা। মেয়েটি মনে তার দায়িত্বের কথা স্মরণ হলো। দায়িত্বের কথা মনে হতেই তার চোহারা পরিবর্তিত হয়ে গেল। বলল, ‘হ্যাঁ, আমার দায়িত্ব! আমি তো আমার দায়িত্ব ঠিকঠাক মতই পালন করেছি। আমি ও তো একে ধরিয়ে দিয়েছি! আমিও তো বলেছি, ওকে মেরে ফেলো। কিন্তু এতো কষ্ট! এতো কষ্ট! হায় খোদা, এ আমি কি করলাম।’
আনিস তখনো বেহুশের মত পড়েছিল। মাইসার মনে হলো, সামান্য নড়ে উঠলো আনিস। হ্যাঁ, তাইতো! তাহলে তার চেতনা ফিরে আসছে! সে তার হৃদস্পন্দ শোনার জ্যন্য আনিসের বুকের উপর কান পাতলো। আবার নড়ে উঠলো আনিস। আলগোছে একটি হাত তুলে দিল মাইসার পিঠের ওপর।
মেয়েটি তেমনি পড়েছিল তার বুকের ওপর। পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে এলো আনিসের। চোখ মেলেই দেখতে পেলো মাইসাকে। ক্ষীণ স্বরে বললো, ‘তুমি চলে যাও। শেষে এমন না হয় যে, আমি আমার কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যাই। এই কঠিন শাস্তি ও মৃত্যু আমার পাওনা ছিল। তুমি তোমার দায়ীত্বের উপরে কুবরানী হতে চাও, আমি আমার ধর্মের উপরে কুবরানী হতে চাই। দোহাই তোমার, আমাকে বাঁধা দিও না। আমার জীবন আজ কাণায় কাণায় ভরে উঠেছে। আমি আমার প্রভুর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছি। আমার বেহেশতী বন্ধুরা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তুমি যাও মাইসা! আমার বুকের ওপর থেকে সরো! দোহাই খোদার, সরে যাও তুমি!’
মেয়েটি এতক্ষণ ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আনিসের কথা শুনে পাগলের মত বিলাপ শুরু করলো, ‘দোহাই আনিস, থামো! চুপ করো! মরতে যদি হয় এক সাথেই মরবো। নিয়তি আমাকে আবার তোমার কাছে টেনে এসেছে আমরা এক সাথে থাকবো বলে। বাঁচলে আমরা এক সাথেই বাঁচবো আর মরতে হলেও এক সাথেই মরবো।.………’
মেয়েটির বিলাপ তখনো চলছিল, হুজুর কামরায় ঢুকে এ দৃশ্য দেখে কঠিন সিদ্ধান্তে এলো। সঙ্গের লোকটিকে বললো, ‘এই হতভাগী মেয়েটাকে অন্য কোন কামরায় নিয়ে বন্দী করে রাখো।’ তারপর পড়ে থাকা গোয়েন্দার পিঠে শপাং করে একটি বাড়ী দিয়ে বললো, ‘কিহে মুজাহিদ! জবান খুলবে, নাকি আরও ওষুধ দিতে হবে?’
❀ ❀ ❀