সূর্য মাথার ওপর উঠে আসার আগেই দ্বিতীয় চৌকিতে পৌঁছে গেল ওরা। কমাণ্ডার বলল, ‘রোদ না কমা পর্যন্ত এখানেই বিশ্রাম নেবো আমরা।
রাতে আকাশে চাঁদ থাকবে।পথ চিনতে অসুবিধা হবে না। সন্ধ্যার পর আমরা আবার যাত্রা করবো। খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নিন সবাই। পারলে ঘুমিয়ে নেঁবেন যাতে রাতে বেশী পথঅতিক্রম করতে পারি’।
কায়রো তিন দিনের পথ। আরো দুটি রাত তাদেরকে মরুভূমিতে কাটাতে হবে।
আশফাক ও মেয়েদের কাছ থেকে ঘোড়ার বাগ হাতে নিল দুজন কমাণ্ডো। ঘোড়াগুলো যত্ন নিয়ে তাদের দানাপানি দিয়ে ফিরে এল ক্যাম্পে। মেয়েরা খাওয়া দাওয়ার পর জোহরের নামাজ পড়ে শুয়ে পড়ল তাদের তাঁবুতে। দুজনকে পাহারার জন্য রেখে আশাফাক এবং কমাণ্ডোরাও ঢুকে গেল তাঁবুর ভেতর।
সূর্য ডোবার খানিক আগেই উঠে পড়ল সবাই। আছরের নামাজ শেষে প্রস্তুতি হলো আবার যাত্রার জন্য।
সামনে আরো একটা চৌকি পাওয়া যাবে সালাহুদ্দীনের। তারপর পাড়ি দিতে হবে বিশাল উন্মুক্ত মরুভূমি। মাঝে মধ্যে দু একটা বেদুঈল পল্লী ছাড়াসেই বিস্তীর্ণ প্রান্তরের পুরোটাই ফাঁকা।
সন্ধ্যায় রক্তলাল সূর্যটা হারিয়ে গেল দূর বালিয়াড়ির আড়ালে। একটু পরেই পূর্ব দিক থেকে উঁকি মারল গোলগাল চাঁদ। তারার মেলা বসল চাঁদের হাটে। যেন মস্ত কোন পুকুরে কেউ শাপলার চাষ করেছে।
শরীর জুড়ানো মৃদুমন্দ কোমল হাওয়া বইছে। উজ্জ্বল রূপালি চাঁদের ঠাণ্ডা আলোয় ভেসে যাচ্ছে সমস্ত মরুভূমি।
দীর্ঘ বিশ্রামের পর ঝরঝরে চাঙ্গা শরীর নিয়ে নিজ ঘোড়ায় চেপে বসল ক্ষুদ্র দলটি। কমাণ্ডারের সাথে সাথে কায়রোর দিকে ঘোড়া ছুটাল সবাই।
ধীরে ধীরে চাঁদ উপরে উঠতে লাগল। চাঁদের মায়াবী আলো গায়ে মেখে এগিয়ে চলল কাফেলা।
একটানা তিন ঘণ্টা চলার পর ছোট্ট একটা পাহাড় পড়ল সামনে। মেয়েরা একটানা পথ চলায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
কমাণ্ডার বলল, ‘আধ ঘণ্টার জন্য আমরা এ পাহাড়ের পাদদেশে বিশ্রাম নেবো। এর মধ্যে প্রাকৃতিক ক্রিয়া ও এশার নামাজ সেরে নিতে হবে সবাইকে। রাতের খাবার সবাই চাইলে এখানেই হতে পারে, নইলে আরো দু’ঘণ্টা চলার পর একটা ওয়েসিস পাবো, সেখাতে হতে পারে’।
মেয়েরা বলল, ‘আমরা এখন খাবো না। তাহলে ক্লান্তি এসে ভর করবে’।
কমাণ্ডার বলল, ‘তাহলে সামান্য নাস্তা হতে পারে। সবাই খেজুর ও পানি খেয়ে নাও, তাহলে আরো দু ঘণ্টা চললেও ক্ষুধায় কষ্টা পাবে না’।
ওরা যখন ওখান থেকে রওনা হলো তখন একজন কমাণ্ডোর মনে হলে চকিতের জন্য যেন পাহাড়ের চূড়ায় দুটো মুখ দেখতে পেল।
আরো ঘণ্টাখানেক চলার পর একটা বেদুঈন পল্লী সামনে পড়ল। পল্লীটাকে বায়ে রেখে দ্রুত ওরা সামনে বাড়ল।
ঘণ্টা দুই চলার পর আরো একটা ওয়েসিস পড়ল ওদের সামনে। পাশে খেজুর বাগান। চাঁদ প্রায় চলে এসেছে মাথার ওপর। খেজুর গাছের ছায়াগুলো ছোট হয়ে এসেছে।
অভিযাত্রীর দলটি থামল ওখানে। রাতটা এখানেই কাটাবে ওরা। নয় জন লোকের জন্য তিনটি তাঁবু খাটানো হলো। ঘোড়াগুলোর ব্যবস্থা নিয়ে একত্রেই খাওয়া সারল সবাই।
একেক তাঁবুতে দুজন করে শোয়ার ব্যবস্থা হলো। কমাণ্ডার তিনজনকে পাহারার জন্য রাখলেন। তাঁবুর দু পাশে সশস্ত্র দুজন সেন্ট্রি পায়চারী শুরু করল। একজন চলে গেল তাঁবু থেকে অনতিদূরে একটা বালির ডিবির আড়ালে। বাকীরা পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল তাঁবুর ভেতর।
নির্বিঘ্নে সময় বলে চলল। কোথাও কোন শব্দ নেই। বাতাস এখন অনেক বেশী ঠাণ্ডা। শীত শীত ভাব।
দু ঘণ্টা পর ডিউটি পরিবর্তন হলো। পাহারারত কমাণ্ডোরা বন্ধুদের ডেকে দিয়ে ঢুকে পড়ল তাঁবুর ভেতর। কমাণ্ডার আজীম সঙ্গী দুজনকে তাঁবুর পাশে রেখে নিজেয চলে গেলেন বালিয়াড়ির আড়ালে। কোন রকম বিপদের সম্ভাবনার কথা তার মনেও এলো না। কিন্তু কমাণ্ডোর স্বভাবসুলভ সতর্কতা অটুট রেখে পাহারায় লেগে রইলো সবাই।
তাঁবুর পাশের সেন্ট্রি দুজন পায়চারী থামিয়ে প্রায় আধঘণ্টা যাবত বসে বসে পাহারা দিচ্ছে। বালির ঢিবির আড়াল থেকে তীর ধনুক প্রস্তুত রেখে পলকহীন ভাবে তাঁবুর দিতে তাকিয়ে আছে কমাণ্ডার আজীম।
হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠল তার ইন্দ্রিয়। মনে হলো আশপাশে কোথাও একাধিক মানুষ খুব সন্তর্পনে হেটে বেড়চ্ছে। সে বিন্দুমাত্র মাথা না নাড়িয়ে যতদূর সম্ভব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করল, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না।
সে পিছনটায় একবার দৃষ্টি বুলানোর জন্য মাথাটা যেই ঘুরাবে ভাবল, অমনি তার চোখ আটকে গেল খেজুর বাগানের মধ্যে। সে স্পষ্ট দেখতে পেল তাঁবুর দুদিক থেকে দুজন করে বেদুঈন শিকারী নেকড়ের মত পায়ে পায়ে তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসছে।
সম্ভাব্য হামলা প্রতিরোধের কথা চিন্তা করছিল কমাণ্ডার। তীর মেরে বড়জোর একজনকে কাবু করা সম্ভব। সাথে সাথে অন্য তিন জস সতর্ক হয়ে যাবে। বাগানের অন্ধকার ও গাছের আড়াল তাদের নিরাপদ আশ্রয় হতে পারে। কিন্তু ও সামান্য নড়াচড়া করলেই চাঁদের ফকফকা আলোয় পরিস্কার ওদের চোখে পড়ে যাবে।
শত্রুরা তাঁবুর ত্রিশ গড়ের মধ্যে চলে এসেছে। দ্রুত চিন্তা চলছে কমাণ্ডারের মাথায়। সেন্ট্রি দুজন এখনো উঠে দাড়াচ্ছে না কেন? ওরা কি কিছুই টের পায়নি এখনো? না কি ঘুমিয়ে পড়েছে ওরা? বেদুঈনরা আরো এগিয়ে এসেছে। ক্রমে তাঁবু ও ওদের মাঝের ব্যবধান ঘুচে যাচ্ছে। এখন বড়জোর আর বিশ গজ, না আরো কমে আসছে ব্যবধান।
দশ গজ দূরে এসে খানিক থমকে দাঁড়াল ডাকাতরা। বোধ হয় সেন্ট্রিরা সজাগ না ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে চেষ্টা করল। তারপর খাপ থেকে সাবধানে তরবারী বের করে সেন্ট্রি দুজনের দিকে বা বাড়াল।
ওদের চলাফেরা এতটাই নিঃশব্দ ছিল যে তখনো পর্যন্ত সেন্ট্রিরা কোন কিছু টের পায়নি।
আততায়ীরা সেন্ট্রিদের দু’গজের মধ্যে এসে যখন তরবারী উপরে তোলা শুরু করল তখন কমাণ্ডারের প্রথম তীরটি একজন বেদুঈনের বক্ষ ভেদ করল এবং বলতে গেলে প্রায় একই সময়েঢ অন্য পাশের আরেক জনকেও ধরাশায়ী করল তার তীর।
চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে উঠে দাঁড়াল সেন্ট্রি দু জন এবং পাঁই করে ঘুরে তরবারীর প্রথম আঘাত ঢেকাল নিজের তলোয়ার দিয়ে।
দু জোড়া তলোয়ারের ঠোকাঠুকির আওয়াজ শেষ রাতের মরুভূমির নিস্তব্ধতা বিনষ্ট করে দিল। সতর্ক ও দুঃসাহসী বেদুঈনরা তীব্র আঘাত হানলো কমাণ্ডোদের ওপর। হতচকিত কমাণ্ডোরা কোন রকমে সে আঘাত ঢেকিয়ে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করল।
যখন ওরা বুঝল শত্রু মাত্র দুজন তখন পাল্টা আঘাত হানলো কমাণ্ডোরা।
ততোক্ষণে কমাণ্ডার অন্যদের ডাকতে ডাকতে সেখানে এসে পৌঁছল। কমাণ্ডারের ডাক চিৎকারে তাঁবুর ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো অন্যান্য কমাণ্ডোরাও।
আহতদের মধ্য থেকে একজন বেদুঈন উঠে দাঁড়িয়েছিল। সে তার তরবারী দিয়ে লড়াইরত কমাণ্ডো সৈন্যটিকে আঘাত করতে উদ্যত হতেই কমাণ্ডারের তলোয়ারের আঘাতে দেহ থেকৈ তার মাথাটা বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়ল।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই পরিসমাপ্তি ঘটলো এ লড়াইয়ের।
সৈন্যদের ডাক চিৎকারে আশফাক এবং যুবতী দু জনেরও ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাঁবুর বাইরে এসে তারা দেখতে পেলো চারজন বেদুঈনের লাশ।
কমাণ্ডার ওদের সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এরা সাধারণ ডাকাত মাত্র’।
সকাল হয়ে এসেছিল। কমাণ্ডার সবাইকে সফরের জন্য প্রস্তুত হয়ে নিতে বলল।
হাত মুখ ধুয়ে সফরের পোশাক পরে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলো আমিনা ও সামিনা। কমাণ্ডার বলল, ‘নামাজ সেরে নিন’।
ওরা নামাজ সেরে নিতে নিতে সৈন্যরা তাঁবু গুটিয়ে নিল। সবাই চড়ে বসল যার যার ঘোড়ায়।
সূর্য উঠার আগেই বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে গেল তারা। মরুভূমিতে কোমল আলো ছড়িয়ে সূর্য উঁকি দিল আবার। যেন মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে ঘনিষ্ট আপন জন। যাত্রীরা ঘোড়ার পিঠে বসেই মিঠে রোদের আলতো পরশ অনুভব করল সর্ব অঙ্গে।
বাকী পথটুকু নিরাপদেই কাটলো তাদের। পরদিন সন্ধ্যার একটু আগেই ওদের চোখে পড়ল কায়রো শহর।
❀ ❀ ❀ ❀ ❀
কয়েকদিন থেকেই ব্যাপকভাবে মুসলমানদের ধরপাকড় চলছে ক্রাকে। স্রেফ সন্দেহের বশে অনেককে বেগার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
ক্রাকে শুরু হয়ে গেল মুসলিম নির্যাতনের নতুন অধ্যায়।
ওসমানের দু’জন বন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শত নির্যাতনের পরও ওরা মুখ খোলেনি।
ওদের কাছ থেকে কথা আদায় করার জন্য একদিন স্বয়ং হরমুন জেলে এলেন। একজন একজন করে সব বন্দীদের দিকে তাকালেন তিনি।
তার চোখ এসে আটকে রইল দুই যুবকের ওপর। চরম নির্যাতন করেও ওদের মুখ থেকে কোন কথা বের করা যায়নি।
হরমুন ওদেরকে নিজের দপ্তরে নিয়ে গেলেন। ভাল ব্যবহার করলেন ওদের সাথে।
ওদেরকে উন্নতমানের খাবার দেওয়া হলো। ডাক্তার ডেকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো। তারপর তাদের শোবার জন্য দেওয়া হল পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বিছানা। ধীরে ধীরে ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল ওরা। ঘুমন্ত দুই যুবকের মাঝখানে বসে রইরেন হরমুন। কিছুক্ষণ পর বিড়বিড় করে উঠলো একজন।
‘আমার দেহ টুকরো টুকরো করে ফেলো, আমি কিছুই জানি না। জানলেও আমি তোমাদেরকে কিছুই বলবো না। তোমরা গলায় ক্রুশ ঝুঁলিয়ে রাখো আর আমি বাঁধি পবিত্র কোরআনের আয়াত’।
‘তুমি সেনা ছাউনিতে আগুন লাগিয়েছিলে?’ হরমুন প্রশ্ন করলেন।
যুবক কোন জবাব দিলেন না।
হরমুন আবার বললেন, ‘তোমরা খ্রিষ্টানদের কোমর ভেংগে দিয়েছ। আমি স্বীকার করছি, তুমি অবশ্যই সাহসী। কিন্তু সাহস থাকলেই মরতে হবে এমন তো কোন কথা নেই। এই বয়সেই মরে গিয়ে কি লাভ হবে তোমার?’
‘মরে গেলে’ বিড়বিড় করল যুবক, ‘যদি মরে যাই, এ দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে ঈমানও আছে। দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে গেলেও ঈমান যাবে না’।
‘তাহলে তুমি কি চাও যে, দেহ থেকে তোমার প্রাণ বায়ু বেরিয়ে যাক? এই তোমার শেষ ইচ্ছা?’
‘না, আমি আরো হাজার বছর বেঁচে থাকতে চাই। আর যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন জেতাদ করতে চাই। কিন্তু কারো দয়ার ওপর বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই আমার। মরণকে ভয় পাই না আমি’।
‘কিন্তু এভাবে নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়ার মাঝে কোন স্বার্থকতা নেই যুবক। আমরা যা জানতে চাই বলো, কথা দিচ্ছি, তোমাকে আমরা মুক্তি দিয়ে দেবো’।
‘আমাদের জীবনে ব্যর্থতা বলে কিছু নেই হরমুন। জীবনেও লাভ, মরণেও লাভ। বাঁচলে বাঁচবো আল্লাহর দ্বীনের জন্য, মরবোও দ্বীনের পথে থেকে।
ব্যর্থ তো তার জীবন, যে ভয়ে, লোভে বা মোহে পড়ে আপোষের পথ ধরে। নীতির সাথে আপোষ করে, সত্যের সাথে আপোষ করে, বিবেকের সাথে আপোষ করে। যত চেষ্টাই করো আমার কাছ থেকে কিছুই আদায় করতে পারবে না তুমি’।
অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন হরমুন। তার মনের কথা যুবকের মুখ দিয়ে কিছুতেই বের করাতে পারলেন না।
এবার তিনি ফিরলেন দ্বিতীয় যুবকের দিকে। চেষ্টা করলেন কথা বের করার। কিন্তু দ্বিতীয় যুবকের মুখ থেকেও কোন কথাই বের করতে পারলেন না তিনি।
শেষ পর্যন্ত হরমুন সঙ্গী গোয়েন্দাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অনর্থক চেষ্টা। ওদের মুখ থেকে কিছুই বের হবে না’।
‘মনে হচ্ছে এরা ঘটনার সাথে জড়িত নয়। থাকলে কোন না কোন সূত্র পাওয়া যেতোই। তবে নিজের বিশ্বাসের ওপর এরা বড় বেশী দৃঢ়’।
‘ওদের যে পরিমাণ হাশিস খাইয়েছি একটা ঘোড়াকে খাওয়ালে ঘোড়াও কথা বলত’।
‘এদের ভেতর জাতীয় চেতনাবোধ অত্যন্ত প্রবল। সে চেতনাকে ওরা বলে ঈমান। এ যুবকদের মধ্যে ঈমানী দৃঢ়তা বেশী এ কথা ঠিক, কিন্তু আমার মনে হয় এর নির্দোষ’।
বলল আরেক অফিসার।
এই দুই যুবক ছিল ওসমানের দুই সঙ্গী। এরা মূলতঃ নির্দোষ ছিল না। প্রাসাদ আক্রমণে ওরাও ওসমানের সাথে ছিল। কিন্তু এদের ঈমান ছিল এত দৃঢ় যে, সেখানে হাশিসও কোন কাজ করেনি।
অজ্ঞান অবস্থায়ই ওদের দু’জনকে অনেক দূরে নিয়ে মরুভূমির মধ্যে ফেলে আসা হলো। ওদের জ্ঞান ফিরল পরদিন সকালে।
জ্ঞান ফিরলে পরস্পরের দিকে চাইল ওরা। দেখল, বেগার ক্যাম্প নয়, ওরা দুজনই পড়ে আছে খোলা আকাশের নীচে।
ওরা একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরল। এরপর উঠে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল দু’জনেই।
ওসমানদের তৎপরতা আরও বেড়ে গেছে। পেছনে ছায়ার মত রেগে আছে রিনি।
একদিন পথে ওসমানের সাথে দেখা হলো রিনির। দাঁড়িয়ে পড়ল দু’জনই। রিনি জিজ্ঞেস করল, ‘ওসমান, আল নূর কোথায়?’
‘তোমাদের জাতির কোন পাপীর কাছে। তার ওপর আল্লাহর গজব নেমে আসুক’।
‘গজব নয় ওসমান, বল রহমত। আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মারাগেলে তাকে তোমরা শহীদ বলো। আমি জানি, আল নূর শহীদ হয়ে গেছে’।
ওসমান নির্বাক হয়ে গেল।
রিনিই আবার মুখ খুলল, ‘সেই দুই যুবতীকে প্রাসাদ থেকে যারা বের করে এনেছে তার মধ্যে তুমিও একজন। গ্রেফতার হচ্ছো না কেন জানো? তোমার গ্রেফতারের পথে আমি বাধা হয়ে আছি। বলো, আর কত ত্যাগ চাও ওসমান, আর কত পরীক্ষা নিতে চাও আমার প্রেমের?’
‘আমার কাছে কি চাও তুমি?’
‘প্রথমে তোমার ভালবাসা চাই। এরপর চাই তুমি এই বিপজ্জনক তৎপরতা থেকে সরে দাঁড়াও’।
‘তুমি তোমার জাতিকে ভালবাস। আমাকে ভালবাসলে আমার জাতিকে কেন ভালবাসো না?’
‘তোমার বা আমার কারো জাতির সাথেই আমার ভালবাসা নেই। বিপজ্জনক কাজ থেকে বিরত থাকতে বলছি, কারণ, নইলে তুমি মারা যাবে।
আমি কেবল তোমাকেই ভালবাসি ওসমান! তুমি মারা গেলে আমিও বেঁচে থাকবো না। আমি তোমায় জীবিত এবং হাসিখুশি দেখতে চাই’।
মাথা নিচু করে নিল ওসমান। এ কথার কোন জবাব ছিল না তার কাছে। কয়েক মিনিট সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এরপর কোনকিছু না বলেই হাঁটা দিল ওসমান।
রিনি গভীর প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়েছিল ওসমানের দিকে। ও যখন হাঁটা ধরল রিনি পেছন থেকে বলে উঠল, ‘ওসমান। অন্য জাতির এক নারীর কথা মনে করে আমার প্রস্তাব উড়িয়ে দিও না তুমি। আমার শৈশব ও কৈশোরের স্বপ্নকে তুমি ভেংগে দিও না’।
❀ ❀ ❀ ❀ ❀
‘আমি আবারও বলছি ক্রাক সুবাক নয়’। কমাণ্ডারদের সামনে শেষবারের মত যুদ্ধনীতি ও রণকৌশল ব্যাখ্যা করছিলেন সুলতান সালাহুদ্দীন।
‘খ্রিষ্টানরা আগের চাইতে অনেক বেশী সতর্ক। গোয়েন্দারা আমাকে যা বলেছে তাতে আমি নিশ্চিত, ক্রাকের যুদ্ধ হবে দুর্গের বাইরে।
ভেতরে মুসলমানদের তৎপরতা আপনাদের কোন কাজে আসবে বলে মনে হয় না। ওরা বেশী নড়াচড়া করলে অহেতুক মারা পড়বে। আমি ওদেরকে এত বড় পরীক্ষায় ফেল তে চাই না। ওদের রক্ষা করার একটাই মাত্র পথ, আমাদেরকে প্রচণ্ড আক্রমণ করতে হবে’।
এ ভাবে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে সুলতান সূর্যাস্তের পর ক্রাকগামী সৈন্যদেরকে মার্চ করার নির্দেশ দিলেন।
পরদিন ভোরে সৈন্যবাহিনী ক্রাকের সীমান্ত এলাকায় পৌঁছল। এখান থেকেই দূর্গ অবরোধের প্রস্তুতি নিয়ে এগোতে হবে।
পথে খ্রিষ্টান সৈন্যদের কোন টহল বাহিনী বা সশস্ত্র প্লাটুন চোখে পড়েনি ওদের। গোয়েন্দারা জানিয়েছে, খ্রিষ্টান বাহিনী দূর্গের বাইরে তাঁবু গেড়ে প্রস্তুত হয়ে আছে।
কোথায় তারা তাঁবু গেড়েছে জেনে নিয়ে মুসলিম বাহিনী অন্য পথে অগ্রসর হলো। ফলে বিনা বাধায়ই এরা দূর্গ অবরোধ করতে সক্ষম হলো। দূর্গ অবরোধ করার সাথে সাথে পাঁচিল থেকে শুরু হল তীব্র তীর বৃষ্টি।
মুসলিম বাহিনী জওয়াবী হামলায় কঠোর আক্রমণ করল না, বরং হালকা চালে যুদ্ধ চালিয়ে ফাঁকে ঘুরে ঘুরে দেখছিল ভেতের ঢুকার কোন সম্ভাবনা আছে কি না। সাথের গোয়েন্দারা কমাণ্ডারকে ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানের বর্ণণা দিচ্ছিল।
মুসলিমদ বাহিনীর অবরোধের খবর দূর্গের অভ্যন্তরে এখনও প্রচার হয়নি। অবরোধকারীদের পেছনটাও এখনো অরক্ষিত। হঠাৎ অভ্যন্তরে সামরিক এলাকায় অগ্নিগোলা নিক্ষিপ্ত হতে লাগল। পাঁচিলে উঠে এল খ্রিষ্টান সৈন্যরা।
শহরে আতংক ছড়িয়ে পড়ল। ইহুদী ও খ্রিষ্টানরা ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে ভেতরে বসে রইল।
মুসলিম বাহিনীর বিজয়ের জন্য মুসলমানগণ দোয়া করতে লাগল। ওসমান ও তার সঙ্গীরা দুর্গের মেইন ফটক খুলে দেয়ার বা পাচিল ভেংগে ফেলার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল।