» » ভয়াল রজনী

বর্ণাকার

সম্রাটগণ প্রাসাদের ভেতর পরামর্শ সভায় বসলেন। একজন সম্রাট বললেন, ‘এ এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। সালাহুদ্দীনের বাহিনী আমাদের আক্রমণ করেনি অথচ আমাদের সমস্ত রসদ সামান তছনছ হয়ে গেছে। সেনাবাহিনী বিপর্যস্ত হয়েছে। যুদ্ধের বিপুল পরিমাণ উট ও ঘোড়া হারিয়ে গেছে। জনগণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। কার জন্য, কিভাবে এত বিপুল পরিমান ক্ষতির সম্মুখীন আমাদের হতে আগে তার তদন্ত হওয়া দরকার’।

উপস্থিত সম্রাটদের সম্মতির ভিত্তিতে গোয়েন্দা প্রধান রেমুনের নেতৃত্বে গঠিত হলো তদন্ত কমিশন। তিনদিনের মধ্যে তদন্তের রিপোর্ট পেশ করতে বলা হলো তদন্ত কমিশনকে। কালবিলম্ব না করে কমিশন তদন্ত কাজে নেমে পড়ল।

সেন্ট্রির লাশ পাওয়া গেল খড়ের গাদা থেকে সামান্য দূরে। কেউ তাকে হত্যা করেছে এমন কোন আলামত পাওয়া গেল না তার লাশ দেখে।

ঘোড়ার পায়ে পিষে মুছে গেছে খঞ্জরের আঘাতের দাগ। ইউনিফর্ম দেখেই শুধু বুঝা গেল সে ডিউটিরত সেন্ট্রি ছিল।

একটু দূরে পাওয়া গেল চারটি মেয়ের মৃত দেহ। দেহের কোন অংশ অক্ষত নেই। হাজার হাজার ঘোড়া ওদের দেহের উপর দিয়ে ছুটে গেছে।

ওরা কার মেয়ে, কোন ধর্মের কিছুই বলার উপায় নেই। ছিন্ন বিচ্ছিন্ন কাপড়ের টুকরা থেকে ওদের মেয়ে বলে মনে হয়।

মেয়েদের লাশ দেখে আশ্চর্য হল সবাই। এখানে মেয়েরা এলো কি করে? নিষিদ্ধ এ এলাকায় কোন সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারে না। না কোন পুরুষ, না কোন মেয়ে। কেন এবং কোত্থেকে এ মেয়েরা এলো এ প্রশ্নের কোন জবাব নেই কারো কাছে।

কতগুলা লাশ পাওয়া গেল রসদের আশপাশে। লাশগুলো সব সাধারণ সৈনিকদের।

তদন্ত কমিশন মেয়েদের লাশগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল।

রাতে মেয়েরা কেন এসেছিল এর হদিস কেউ বের করতে পারল না। তদন্ত কমিশণ ধারণা করল, এসব নিহত সৈন্যরা হয়ত পেশাদার মেয়েদেরকে এখানে নিয়ে এসেছিল।

তাহলে আগুল লাগল কিভাবে? চলাচলের পথ থেকে খড়ের গাদা বেশ দূরে। আগুন নিয়ে সেন্ট্রির তো খড়ের গাদার কাছে যাওয়ার কথা নয়। মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করলেও মশাল তো রাস্তায় রেখে যাওয়ার কথা!

আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে রেমন মেয়ে চারটের লাশের ময়না তদন্ত করার প্রয়োজন অনুভব করলেন। দলে যাওয়া চারটে লাশ তুলে আনা হলো ময়না তদন্তের জন্য। প্রথমেই ওদের চোখে পড়ল প্রতিটি লাশের গলায় ঝুলে আছে একটি করে ক্রুশ।

এরা তাহলে খ্রিষ্টান মেয়ে? তদন্ত অফিসার খ্রিষ্টান পরিবাগুলোতে অনুসন্ধান করার জন্য বললেন সহকারীদের।

অনুসন্ধানের জন্য গোয়েন্দা বাহিনী ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। শহরের প্রতিটি খ্রিষ্টান পরিবারে খোঁজ খবর নেয়ার জন্য এলাকা ভাগ করে নিল তারা।

পরদিন তারা রিপোর্ট করল, অধিকাংশ এলাকারই অর্ধেকের বেশী খ্রিষ্টান পরিবার শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। ফলে মেয়েদের পরিচয় পাওয়ার কোন উপায় নেই এখন। পরিস্থীত শান্ত হলে যদি সে সব খ্রিষ্টান পরিবারগুলো ফিরে আসে তবেই এর হদিস নেওয়া সম্ভব।

আল নূর এবং অন্য তিনজন যুবতীর পরিজন উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় কাটাচ্ছিল। এখনও কেউ ফিরে আসেনি। তবে কি ধরা পড়ল ওরা?

ওসমান এবং তার সঙ্গীরা আগুনের পাশে দর্শকদের মাঝে গিয়ে দাঁড়াল। চারটে মেয়ের মৃত দেহকেই সামনে দেখতে পেল ওরা। লাশগুলো এত বিভৎসভাবে থেতলানো যে দেখে চেনার কোন উপায় নেই। অন্যরা তো দূরের কথা, ওসমানের পক্ষেও সম্ভব হলো না তার নিজের বোনকে সনাক্ত করার।

ওসমানের চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে এল। অশ্রুতে ভরে গেল বন্ধুদের চোখগুলোও। ওরা জানে এ লাশ কার, কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে বোনের জন্য কান্নারও কোন উপায় নেই।

সাবধানে কলের দৃষ্টি এড়িয়ে ভীড় থেকে বেরিয়ে এল ওরা। বোনেরা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শহীদ হয়ে গেছে। ওদের দেহ কত ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হয়েছে কে জানে।

দু’জন যুবতীর সম্ভব রক্ষার জন্য জীবন বিলিয়ে দিল চারজন তরুণী।

ধরা পড়লে যেন আত্মরক্ষা করতে পারে এ জন্য বারজেস ওদের গলায় ক্রুশ ঝুলিয়ে দিয়েছিল। সে ক্রুশ গলায় নিয়েই সেখানে পড়ে রইল লাশগুলো।

ভাইয়েরা দেখল বোনদের লাশ কিন্তু সে লাশের জানাযা দিতে পারল না ওরা। লাশগুলো সেখান থেকে তুলেও আনতে পারল না। কারণ লাশগুলো যে খ্রিষ্টান মেয়েদের তার প্রমাণ ঝুলে আছে তাদের গলায়। সে পরিচয়কে মুছে দেওয়ার সাধ্য নেই কারো।

খ্রিষ্টানদের কবরস্থানেই সমাহিত করা হল চারজন মুসলিম তরুণীর মৃতদেহ। ওদের পরিবারের লোকজন গোপনে কোরানখানি করল। গায়েবানা জানাযা পড়ল।

এ সব মেয়েদের পিতা-মাতারা ইসলামের জন্য ছেলেদের উৎসর্গ করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ ছেলেদের আগেই মেয়েদেরকে পছন্দ করে নিলেন। এ কোরবানী বড়ই দুঃসহ, বড়ই বেদনাদায়ক।

অত্যন্ত গোপনে তাদের জন্য দোয়া অনুষ্ঠান হলো। অনুষ্ঠানে বাঁধ ভাংগা কান্না শুরু হলে ইমাম সাহেব বললেন, ‘আল্লাহর ফয়সালা বুঝার সাধ্য আমাদের নেই। আজ আপনারা নিজেদের মেয়েদের জন্য কাঁদছেন, কিন্তু ইসলামের ইতিহাস পড়লে আপনারা দেখতে পাবেন, মহানবীর (সা) নেতৃত্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন হয়েছিল সেখানেও প্রথম শহীদ ছিলেন একজন মহিলা।

আজ আপনাদের সৌভাগ্য দেখে নিজেকে বড় দুর্ভাগা মনে হচ্ছে। না নিজে শহীদ হতে পারলাম, না শহীদের পিতা বা ভাই হতে পারলাম!’

                                               

মুসলমানদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশী শুরু হয়ে গেছে। ধরা পড়ার আশংকায় ওসমানরা অস্ত্রশস্ত্র মাটির নীচে লুকিয়ে ফেলল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল মেয়েদের নিয়ে।

প্রতিবেশীরা যদি মেয়েদের কথা জিজ্ঞেস করে কি জবাব দেবে তারা?

ওরা এ সমস্যা নিয়ে ইমাম সাহেবের কাছে গেল। দূরদর্শী ইমাম চারজন মেয়ের পিতাকে নিয়ে গেলেন পুলিশের সদর দফতরে।

পুলিশ অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেব ক্রুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘আমি এদের ইমাম। আমার কাছে এরা এক গুরুতর নালিশ নিয়ে এসেছে। সবাই যখন আগুন নেভাতে ছুটে গেছে তখন সৈনরা এদের যুবতী মেয়েদেরকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে’।

‘সেনাবাহিনীর নামে কোন অপবাদ দেয়ার পূর্বে ভাল করে ভেবে নাও’। বললেন পুলিশ অফিসার।

‘মাননীয় পুলিশ সুপার, আমি একজন ধর্মীয় ইমাম। আপনি ইচ্ছা করলে আমাদের গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারেন। সৈন্যদের অপরাধ ঢেকে তাদেরকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেন। এ ক্ষমতা আপনার আছে।

কিন্তু আমি বলছি, আপনি শাসক হলেও খোদা নন। সৈন্যদেরকে বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য এরা সারা রাত আগুনের সাথে যুদ্ধ করেছে। আর এভাবেই আপনি তাদের সে সেবার প্রতিদান দিচ্ছেন? সৈন্যরা মেয়েদের তুলে নিয়ে গেছে এ কথাটুকু স্বীকারই করতে চান না?’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি সৈন্যদের নির্দোষ বলিনি, আমি শুধু বলেছিলাম সেনাবাহিনীর নামে কোন কথা ভলার আগে ভালভাবে ভেবে দেখতে। আপনি যদি তারপরও অভিযোগ করতে চান তাহলে আমি কথা দিচ্ছি, আমরা এর তদন্ত করে দেখবো’।

পুলিশ প্রধানের মুখে এ কথাটিই শুনতে চাইছিলেন ইমাম সাহেব। বাইরে এসে মেয়েদের পিতাদের বললেন, এখন এ কথা সর্বত্র ছড়িয়ে দাও যে, তোমরা যখন আগুন নেভাতে ব্যস্ত, তখন সৈন্যরা এসে ওদের ধরে নিয়ে গেছে। এখনো সেই মেয়ে ঘরে ফিরে আসেনি, সে কোথায় আছে, কেমন আছে তোমরা কেউ তা জানো না’।

সাথে সাথে পরিবারের লোকজন এ কথা সবার কাছে প্রচার করে দিল।

                                               

রাজকীয় ডাক্তার আশফাকের ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করছেন। বরজেস তাকে ডাক্তারের হাতে তুলে দিয়ে সুলতানের তাঁবুর দিকে পা চালালেন।

সুলতানের তাঁবুতে এসে ঢুকলেন বারজেস। সুলতান তাকে বসতে বলে বললেন, ‘এবার বলো কি খবর নিয়ে এসেছো?’

বারজেস সুলতানের কাছে সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। ঘটনা বর্ণনা শেষ হলে বারজেস সুলতানকে বললেন, ‘সুলতান, এখনই ক্রাক আক্রমণ করা দরকার’।

গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন সুলতান। একটু পর মাথা তুলে প্রহরীকে বললেন, ‘উপদেষ্টাদেরকে ডেকে আনো’।

প্রহরী বেরিয়ে গেলে তিনি তাকালেন বারজেসের দিকে। বললেন, ‘মেয়ে দুজন এবং ছেলেটাকে কায়রো পাঠিয়ে দাও। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে এদের থাকা খাওয়া ব্যবস্থা করা হবে’।

সামরিক উপদেষ্টাবৃন্দ এসে হাজির হলেন সুলতানের তাঁবুতে। উপদেষ্টারা সবাই এসে পৌঁছলে বৈঠক শুরু হলো। সুলতান বললেন, ‘বারজেস, এদের সামনে ক্রাকের অবস্থা বর্ণনা করো’।

বারজেস নতুন করে ক্রাকের পরিস্থিতি আবার বর্ণনা করলেন উপদেষ্টাদের সামনে। বর্ণনা শেষ হলে আবারো ক্রাক আক্রমণ করার জন্য অনুরোধ রাখলেন তিনি।

উপদেষ্টাদের কেউ কেউ এ প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে সুলতানকে পরামর্শ দিলেন, ‘বারজেস ঠিকই বলেছে, অবিলম্বে আমাদের ক্রাক অবরোধ করা উচিত’।

অনেকক্ষণ ধরে অভিযানের ফলাফল কি হতে পারে তাই নিয়ে আলোচনা হলো। আশু অভিযানের লাভ-ক্ষতি খতিয়ে দেখার পর দীর্ঘ আলোচনার শেষে উপদেষ্টাগণ অভিযানের স্বপক্ষেই তাদের মতামত ব্যক্ত করলেন।

সকলের মতামত শুনে সুলতান বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি শীঘ্রই ক্রাক আক্রমণ করবো। তবে আপনারা জানেন, তাড়াহুড়া আমি পছন্দ করি না।

খ্রিষ্টানদের সেনাবাহিনী এখন বাইরে ছড়িয়ে আছে। আমরা অবরোধ করলে ওরা বাইরে থেকে আক্রমণ করে আমাদের অবরোধ ব্যর্থ করে দিতে পারে।

তা ছাড়া ক্রাকের মুসলমানদেরকে আরও প্রস্তুত করা প্রয়োজন। তারা আল্লাহর মদদে এক আকস্মিক অভিযানে সফল হলেও সংঘবদ্ধ শক্তি হিসবে আবির্ভূত হওয়ার মত অবস্থায় তারা আসেনি।

আমি মনে করি, এ মুহুর্তে আমরা অভিযান পরিচালনা করলে, আমরা দূর্গ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেও যুদ্ধ হবে বাইরে। কারণ, খ্রিষ্টান বাহিনীর একটা বিপুল অংশ এখন শহরের বাইরে অবস্থান করছে। আমরা অবরোধ করার আগেই তারা আমাদের মোকাবেলায় ছুটে আসবে।

আমরা ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে দূর্গ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেও বাইরের শক্তিকে একেবারে নিঃশেষ করে যাওয়া সম্ভব হবে না। ফলে আমরা ভেতর-বাহির দু পক্ষের মাঝখানে পড়ে যাবো’।

‘মাঝখানে হস্তক্ষেপ করার জন্য ক্ষমা চাইছি সম্মানিত সুলতান’। বললেন বারজেস।

‘এ মুহুর্তে কিছু কমাণ্ডো সৈনিক ক্রাক পাঠানো যেতে পারে। যে সব লোক শহর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল ওরা আবার ফিরে আসছে। ওদের সাথে কমাণ্ডো বাহিনীও  ভেতরে ঢুকতে পারবে। পরে আর সম্ভব হবে না। যখনি অভিযান হোক এ সব কমাণ্ডোরা তখন কাজে দেবে’।

উপদেষ্টাগণ এবারও বারজেসকে সমর্থক করলেন। বললেন, ‘সুলতানের কথাই ঠিক। আজই অভিযান চালালে আমরা দুপক্ষের মাঝখানে পড়ে যেতে পারি। তবে কমাণ্ডো মাহিনী পাঠালে সে ভয় থাকে না’।

সুলতানও এ প্রস্তাবের পক্ষে একমত হলেন। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল, এ মুহুর্তে আক্রমণ না করে বরজেসের নেতৃত্বে একটি কমাণ্ডো বাহিনীকে ক্রাকে পাঠানো হবে।

বারজেস সুলতানকে সালাম জানিয়ে বিদায় নিলেন।

আশফাকের কাছে গিয়ে তাকে শোনালেন সুলতানের ইচ্ছার কথা।

‘আমার বোনেরা কায়রো যাক’, আশফাক বললো, ‘আমি আপনার সাথেই থাকবো। আমি আমার পিতা-মাতার খুনের বদলা নিতে চাই’।

‘যুদ্ধ আবেগ দিয়ে হয় না। এ জন্য কঠোর অধ্যবসায় এবং কঠিন প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। তুমি তোমার পিতা-মাতার রক্তের প্রতিশোধ নিতে চাইছো। আর আমরা খ্রিষ্টান পশুদের দ্বারা নির্যাতিত সকল পিতা এবং মেয়েদের ইজ্জতের প্রতিশোধ নিতে চাই। শান্ত হও বেটা, সুলতানের ফয়সালা মেনে নাও’।

কিন্তু আশফাক অটল। তার এক কথা, সে কায়রো যাবে না।

শেষ পর্যন্ত বারজেস তাকে বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমার মানসিক অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। আমার পরামর্শ শোন, যে কোন মুহুর্তে সেনাবাহিনী এ জায়গা ছেড়ে দিতে পারে। অসুস্থ অবস্থায় তাদের সাথে চলা তোমার সম্ভব হবে না। এখন তুমিও কায়রো চলে যাও, আমি কথা দিচ্ছি, সুস্থ হলে তোমাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবো’।

কমাণ্ডো বাহিনী গঠিত হলো। বারজেস যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। ওদের বিদায় জানানোর জন্য সেনা অফিসাররা বেরিয়ে এলো তাঁবুর বাইরে।

সুলতান কমাণ্ডো সৈন্যদের উদ্দেশ্যে করে বললেন, ‘তোমরা ক্রাকের মুসলমানদের মুক্তির জন্য ওখানে যাচ্ছো। ওরা তোমাদের সহযোগিতার করবে। কিন্তু ওদের ওপর নির্ভর না করে নিজের দায়িত্ব নিজে পালন করবে।

কমাণ্ডো অভিযানের সফলতা নির্ভর করে শত্রুর কাছ থেকে নিজেদের অবস্থান, শক্তি ও ক্ষমতা গোপন রাখার মধ্যে। ক্ষিপ্রতা ও সাহসিকতার মধ্যে। শত্রুর অবস্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখার মধ্যে। আশা করি এসব বিষয়ে তোমরা সজাগ ও সচেতন থাকবে’।

সুলতানের কতা নিষ্ঠার সাথে পালন করার শপথ নিয়ে বরজেসের নেতৃত্বে কমাণ্ডো বাহিনী সন্ধ্যার একটু পরেই ক্রাকের পথ ধরল।

আশফাক এখন মোটামুটি সুস্থ। আঘাতের ক্ষতগুলো শুকিয়ে এসেছে। তাঁবুর বাইরে বসে উন্মুক্ত প্রান্তরের দিকে তাকিয়েছিল সে। পিতা মাতার রক্তের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ছটফট করছিল তার অশান্ত হৃদয়। আমিনা ও সামিনা কখন এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করেনি সে।

আমিনা এগিয়ে তার কাঁধে হাত রাখল। আশফাক চমকে উঠে মুখ তুলে চাইল।

‘আশফাক, এখন কেমন বোধ করছিস?’

‘আল আপ্পু। দুদিন থেকে জ্বর আসছে না। গায়ে ব্যথা বেদনাও তেমন নেই’।

‘সেনাবাহিনী ক্রাকে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের অবিলম্বে কায়রো রওয়ানা হয়ে যাওয়া দরকার’।

‘হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছিলাম’।

‘ওরা জানিয়েছে তুই চলতে পারলেই ওরা আমাদের নিয়ে রওনা হবে। আমাদের সাথে ছয়জন প্রহরীও যাবে’।

‘আমি প্রস্তুত। তুমি ওদেরকে রেডি হতে বলো’।

সেদিনই রাতে সুলতান ওদের ডেকে পাঠালেন। ভাই বোন তিন জন সুলতানের তাঁবুতে পৌঁছলে তিনি তাদের বসতে বললেন।

ওরা বসলে সুলতান বললেন, ‘কাল সকালে ছ’জনের একটি কমাণ্ডো গ্রুপের সাথে তোমরা কায়রো যাত্রা করবে। বারজেস আমাকে জানিয়েছে, আশফাক পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধের ময়দানে থাকতে আগ্রহী। কিন্তু আমরা তো কেবল প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য যুদ্ধ করছি না, আমরা লড়াই করছি দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য। আমাদের লড়াই অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসত্যের বিরুদ্ধে, জালিমের বিরুদ্ধে। সেখানে ব্যক্তিগত আক্রোশ মিটানোর কোন সুযোগ নেই। কেবল দ্বীনের জন্য লড়াই করতে চাইলেই তোমাকে আমরা সাথে নিতে পারি’।

আশফাক বললো, ‘আমরা কি নির্যাতিত নই, আমাদের ওপর কি জুলুম করা হয়নি?’

‘হ্যাঁ, হয়েছে, কিন্তু এ জুলুমের হাত থেকে কেবল দ্বীনকে বিজয়ী করতে পারলেই নিস্তার পাওয়া যেতে পারে। আল্লাহ মহান। সারা দুনিয়ার সব কিছুই তাঁর সৃষ্টি। তার বিচারে কোন পক্ষপাতিত্ব নেই বলেই আল্লাহর বিধানের বিজয় চাই আমরা। যেখানে জুলুমের কোন অবকাশ নেই’।

‘আমি আপনার বাহিনীতে যোগ দিতে চাই’।

‘আশফাক, ক্রাকের বাহিনীতে এ মুহুর্তে তোমাকে শামিল করতে পারছি না। তবে তুমি চাইলে তারচে গুরুত্বপূর্ণ কাজে তোমাকে পাঠাতে পারি’।

‘আপনি আমাকে যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করবেন। আমি আমারা জীবন দ্বীনের কাজে আপনার হাতে তুলে দিলাম’।

‘আশফাক, তোমার মত যুবকদের চোখ, কান খুলে দেয়াই আমি আমার প্রথম কর্তব্য মনে করি। মুসলিম বিশ্বে আল্লাহর দ্বীনের পথে জীবন বিলিয়ে দেয়ার মত যুবকদের অভাব নেই। যে কোন মুসলিম জনপদে গিয়ে ডাক দিলে হাজার হাজার যুবক পাবে, যারা অকাতরে দ্বীনের জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া।

আমাদের আসল অভাব উপযুক্ত নেতৃত্বের, আর প্রধান শত্রু শয়তান। শয়তান আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে বিপথগামী করার শপথ নিয়েছিল। সে সব সময় আমাদের বিরুদ্ধে তৎপর। এখন তোমার যে আবেগ আছে কাল সে আবেগ নাও থাকতে পারে। সচেতন না তাকলে লোভ, ভয়, মোহ কখন তোমাকে তোমার পথ থেকে সরিয়ে নেবে তা তুমি টেরও পাবে না’।

‘আমি সব সময় সচেতন থাকবো সুলতান’।

‘কিন্তু কেবল নিজের ব্যাপারেই সচেতন থাকলে চলবে না। কায়রো পৌঁছে সেখানকার উর্ধতন সরকারী কর্মকর্তা, আমরা ও আমীর ওমরাদের উপর তোমাকে নজর রাখতে হবে। সেখানে গোয়েন্দা কাজের জন্য তোমাকে প্রয়োজনীয় ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে। ট্রেনিং শেষে কায়রোয় অবস্থিত আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের সাথে কাজ করবে তুমি’।

‘কিন্তু তাদের আমি কোথায় খুঁজে পাবো?’

‘তোমাকে খুঁজে পেতে হবে না, আমাদের লোকই তোমাকে খুঁজে নেবে’।

আমিনা সুলতানের দিকে অনুনয় ভরা চোখে বলল, ‘মাননীয় সুলতান, আপনি জানেন আমরা এতীম। সহায় সম্পদ বলতে আমাদের কিছু নেই’।

সুলতান বললেন, ‘এ নিয়ে তোমাদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তোমাদের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করার নির্দেশ ইতিমধ্যেই আমার কাছ থেকৈ চলে গেছে’।

‘মাননীয় সুলতান, আমরা এ কথা বলতে চাইনি। আমরা বলতে চাচ্ছি, আমরা কি আপনার কোন কাজে লাগতে পারি না?’

‘কেন নয় বোন, কাজের কি অভাব আছে? তোমরা চাইলে আশফাককে আমি বলে দেবো। সেই তোমাদের পছন্দ অনুযায়ী কোন কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে’।

‘সুলতান, আমরা এমন কাজে জড়িত হতে চাই যাতে জাতি উপকৃত হয়। এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে পুরুষের পক্ষে পৌঁছা কঠিন, অথচ মেয়েরা অনায়াসেই যেতে পারে। আমার মনে নয় গোয়েণ্দা কাজে আপনার মেয়ে কর্মীও দরকার। আপনি কি আমাদেরকে এ জাতীয় কোন কাজে লাগাতে পারেন না?’

‘প্রিয় বোন, এ খুব কঠিন ক্ষেত্র। এ কাজে জড়াতোর আগে ভালভাবে চিন্তা করে নাও। যদি তোমরা তারপরও গোয়েন্দা বিভাগেই কাজ করতে চাও আমার আপত্তি নেই’।

‘সুলতান, আমাদের কোন পিছু টান নেই। আমাদের হারাবারও কিছু নেই। আপনি আমাদের নিশ্চিন্তে এ কাজে ব্যবহার করতে  পারেন’।

‘তোমরা আল্লাহর পথে নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে চাইলে তার থেকে নিবৃত্ত করার কোন অধিকার আমার নেই। আমি তোমাদের হেফাজতের দায়িত্ব আল্লাহর হাতে সোপর্দ করছি।

কিন্তু তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এ কাজ বড়ই কঠিন। প্রতিপক্ষের সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির তৎপরতাও থাকবে তোমাদের চোখের সামনে। নিজের প্রতিটি সহকর্মীর প্রতিও তোমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আস্থা ও সন্দেহের সম্পদে ভরা থাকবে তোমাদের হৃদয়।

কারো কোন কাজে সন্দেহ হলে তার অতীত বিশ্বস্ততার কথা স্মরণ করে না তার পদমর্যাদার কথা ভেবে সেদিক থেকে চোখ ফেরানোর কোন সুযোগ নেই তোমাদের। আবার নেতৃবৃন্দ ও সহকর্মীদের প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা না থাকলেও তুমি কোন কাজই করতে পারবে না।

এই আস্থা ও সন্দেহের সমন্বয় সাধন করা সবচে কঠিন কাজ। কিন্তু এই বিভাগে যারা কাজ করবে এ কঠিন কাজে তাদের স্বচ্ছ ও পারদর্শী হতেই হবে’।

সুলতানের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় হেদায়াত ও নির্দেশনা নিয়ে ভাই বোন বেরিয়ে এলো সালাহুদ্দীনের কামরা থেকে।

পরদিন ভোরে ছয়জন কমাণ্ডোর সাথে কায়রোর উদ্দেশ্যে ঘোড়ায় চড়ে বসল তিন ভাই বোন। দেখতে দেখতে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ও তার সেনাবাহিনীর তাঁবুগুলো পেছনে ফেলে চলে গেল দৃষ্টির আড়ালে। মরুভূমির ধূলি উড়িয়ে এগিয়ে চলল নয়টি ঘোড়া।

মরুভূমির সূর্য বেরিয়ে এল একটা বালির পাহাড়ের আড়াল থেকে। তিন সারিতে পথ চলছে ওরা। সামনে তিন জন কমাণ্ডো, মাঝখানে তিন ভাই বোন, পেছনে বাকী কমাণ্ডো তিন জন।

মাথার ওপর রোদের তেজ বাড়ছে। উত্তপ্ত হয়ে উঠছে মরুভূমির বাতাস।

ঘণ্টা দুই নির্বিঘ্নে চলার পর দলটির চোখে পড়ল প্রথম চৌকি। আরো বিশ মিনিট লাগল তাদের সে চৌকিতে পৌঁছতে।

ওখানে পৌঁছে তারা নাস্তা সারল। আধা ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে আবার ঘোড়ায় চাপল তারা। আরো দু’ঘণ্টা পথ চললে দ্বিতীয় চৌকিতে পৌঁছে যাবে ওরা। দুপুরের আগেই সেখানে পৌঁছতে চায় দলটি।

ধূলিঝড় তুলে এগিয়ে চলল ওরা দ্বিতীয় চৌকির উদ্দেশ্যে। আজকের মত যাত্রা বিরতি করবে ওরা ওখানে। গরম লু হাওয়া ঝাপটা মারছে ওদের চোখে মুখে। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত বালির সমুদ্র। রোদ পরে চিকচিক করছে।

ঘণ্টাখানেক চলার পর তারা একটি ওয়েসিসকে পাশ কাটাল, কিন্তু থামল না ওখানে।

ওয়েসিসের পাশে খেজুর গাছের ছায়ায় বসে আছে চারজন বেদুঈন। পাশে চারটি ঘোড়া বাঁধা।

ছোট্ট কাফেলাটিকে চলে যেতে দেখল ওরা। কেউ কোন মন্তব্য করল না।