সালাহুদ্দীনের গোয়েন্দারা এ সুযোগ হাতছাড়া করল না। তারা বিভিন্ন গরি ও মহল্লায় ছুটাছুটি শুরু করে দিল। লোকজন বাড়ির গেট দিয়ে উঁকি মেরে জিজ্ঞেস করতে লাগল, ‘কি হয়েছে ভাই?’
‘সালাহুদ্দীনের বাহিনী শহরে আক্রমণ করেছে। ওরা খ্রিষ্টান বাহিনীর রসদপত্র জ্বালিয়ে দিয়েছে। উট, ঘোড়া সব ছেড়ে দিয়েছে। খ্রিষ্টান সৈন্যরা এখন শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। আমরাও পালিয়ে যাচ্ছি’।
মুহুর্তে সারা শহরে গুজব ছড়িয়ে পড়ল, ‘মুসলিম বাহিনী ক্রাক আক্রমণ করেছে। আগুন লাগিয়ে দিয়েছে শহরে’।
এ গুজব মুসলমানদের সাহস বাড়িয়ে দিল। ইহুদী ও খ্রীস্টানরা আতংকিত হয়ে পড়ল ভীষণভাবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তায় নেমে এল ভীত সন্ত্রস্ত লোকজন। ভয়ে পালাতে শুরু করল ইহুদী ও খ্রিষ্টান পরিবারগুলো।
খ্রিষ্টান সম্রাট এবং সেনা কমাণ্ডাররা আগুন লাগার স্থানে গেলেন। কোন জন মানুষের চিহ্নও নেই সেখানে। তারা ভাবলো, মুসলিম ফৌজ হয়ত সিঁড়ি লাগিয়ে পাঁচিল টপকে ভেতরে চলে এসেছে।
সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর একটা অংশকে তারা শহরের বাইরে পাঠিয়ে দিল। দ্বিতীয় অংশ প্রস্তুত হয়ে বসে রইল সালাহুদ্দীনের বাহিনীর সাথে মোকাবিলার জন্য।
কমাণ্ডার কয়েকজন সৈনিককে শহরের প্রাচীরের ওপর তুলে দিল। ভয়ে ভয়ে তারা তাকাল বাইরের দিকে।
বাইরে সুনসান নিরবতা। কোথাও কোন সৈনিকের নড়াচড়া চোখে পড়ল না। সালাহুদ্দীনের আক্রমণের চিহ্নমাত্র নেই বাইরে।
খ্রিষ্টান সৈন্যদের বাইরে যাবার জন্য দুর্গের পেছনের জরদা খুলে দেওয়া হল। রাতে কখনও এ ফটক খোলা হয় না।
শহরের বাইরে গিয়ে সুলতান সালাহুদ্দীনের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য এসব সৈন্যদেরকে বাইরে পাঠানো হচ্ছে।
তারা ধারণা করল, ভেতরে হয়ত সালাহুদ্দীনের দু’একটা সুইসাইড গ্রুপ ঢুকে এ কাণ্ড ঘটিয়েছে। এতে সৈনিকদের ভয় কিছুটা দূর হলো। সাহসে ভর করে অবশেষে তারা সিদ্ধান্ত নিল, সালাহুদ্দীনকে তারা কিছুতেই দূর্গের কাছেও ঘেষতে দেবে না।
আতংকের মধ্যে ফটক খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। অমুসলিম পরিবারগুলো পেছনের ফটক খোলা দেখে এলোপাথাড়ি ছুটতে লাগল সেদিকে।
দূর্গ থেকে বের হচ্ছিল সেনাবাহিনী। কিন্তু জনতার ভিড় তাদের পথরোধ করে দাঁড়াল। শহরের শান্তি শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে পলায়নপর এসব লোকদের প্রচণ্ড ভীড় সামলানো কঠিন হয়ে পড়ল।
আগুন প্রসারিত হচ্ছে। খড়ের গাদা থেকে এসে আগুন লাগল তাঁবুর সারিতে। সেখান থেকে সৈনিকদের মূল ব্যারাক, কিচেন, আস্তাবল আশপাশের সব কিছু গ্রাস করছে।
অবলিম্বে এ আগুন নেভানো দরকার। নইলে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়বে আগুন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল পানির স্বল্পতা নিয়ে।
শহরে কোন পুকুর নেই, আশপাশে নদীও নেই। শহুরে লোকজন পাত কুয়ার পানি ব্যবহার করে। সব বাড়িতে হাউজও নেই। কোত্থেকে কে পানি আনবে?
লোকজন যারা পালাচ্ছে তো পালাচ্ছেই, বাকীরা দরজা বন্ধ করে বাড়িতে অবস্থান করতে লাগল।
আগুন নেভানোর জন্য সৈন্যদেরকে নির্দেশ দেওয়া হল। কিন্তু সালাহুদ্দীনের আক্রমণের ভয়ে সবাইকে এ কাজে লাগানো সম্ভব হলো না। সেনাবাহিনীর মুষ্টিমেয় সদস্য প্রাণপণ চেষ্টা করেও আগুন আয়ত্বে আনতে পারছিল না।
এ অবস্থা দেখে একজন সেনা কমাণ্ডার বললেন, ‘বেগার ক্যাম্পের মুসলিম বন্দীদের দিয়ে পানি টানানো যায়’।
সাথে সাথে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষনা দেওয়া হল, ‘আগুন নেভাতে পারলে কাল ভোরেই বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হবে’।
বাইরের ডাক চিৎকারে জেগে উঠেছিল বন্দীরা। প্রহরী ওদেরকে সরকারী ঘোষণা শুনাল। বললো, ‘সরকার ঘোষণা করেছেন, আগুন নিভালে কাল সকালে সবাইকে মুক্তি দেওয়া হবে’।
আশফাক একজন সঙ্গী বন্দীকে বললো, ‘খ্রিষ্টানদের গোটা দেশ পুড়ে গেলেও আমি আগুন নেভাবে যাবো না’।
‘পাগলামী করো না আশফাক। ওরা বলেছে আগুন নেভাতে পারলে কাল ভোরে মুক্তি দেবে’।
আশফাককে বুঝাতে চাইল সেই বন্দী।
‘ওরা মিথ্যাবাদী, ওরা আমাদের সাথে প্রতারণা করছে। আমি এখনি পালাবো, তুমিও আমার সাথে চল। পানি দেয়ার ফাঁকে সুযোগ বুঝে ওখান থেকেই আমাদের পালাতে হবে, নইলে আর সুযোগ পাওয়া যাবে না’।
‘আমরা যেতে পারছি না। এরা আমাদের বাড়িঢ়র চেনে। তোমার তো সে সমস্যা নেই, তুমি যাও’।
‘কিন্তু পালিয়ে আমি যাব কোথায়?’
বন্দীটি তার নিজের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে আশফাককে বললো, ‘পরিবেশ বুঝে আমাদের বাড়ি চলে আসতে পারো। মুক্তি পেলে আমিও ওখানেই উঠবো।
কিন্তু সেখানে বেশী দিব থাকতে পারবে বরে মনে হয় না। ধরা পড়লে ওরা যে কেবল তোমাকেই শাস্তি দেবে তা নয়, আমাদের পরিবারেরও কাউকে রেহাই দেবে না। তবু তুমি এসো, কতদূর কি করা যায় আমি দেখবো’।
বন্দীদেরকে বিভিন্ন কুয়া থেকে পানি টানার কাজে লাগানো হলো। সৈন্যরা পানি তুলে দিচ্ছে। বন্দীরা সে পানি এনে আগুনে ঢালছে।
কিছুক্ষণ বন্দীদের সাথে প্রহরী ছিল। কিন্তু একটু পরেই সৈন্য আর বন্দীরা সব একাকার হয়ে গেল।
কমাণ্ডার দ্রুত কাজ করার জন্য সমানে সৈন্যদের গালি গালাজ করছিল।
হঠাৎ একদিক থেকে ছুটে এল একপাল ঘোড়া। লোকজন এদিক ওদিক সরে গেল। ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা গেল কয়েকজন।
আশফাক সঙ্গী বন্দীকে বললো, ‘এই সুযোগ, চলে পালিয়ে যাই’।
সুযোগ পেয়ে বন্দীটিও আশফাকের সাথে সটকে পড়ল।
সালাহুদ্দীনের ফৌজ দূর্গে ঢুকেছে এ কথা ভেবে মুসলমানগণ বেজায় খুশি। তারা বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে এল।
বন্দী আশফাককে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। বন্দীল বাড়ির সবাই জেগেই ছিল সবাই বন্দীকে দেখে খুশি হল তারা। এগিয়ে আবেগে জড়িয়ে ধরল।
বন্দী আশফাককে পরিবারের লোকজনদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো, ‘ওকে লুকিয়ে রাখুন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে শহর থেকে বের করে দেবেন। খ্রিষ্টানরা বলেছে, কাল আমাদেরকে ছেড়ে দেবে। ওকে এখনও কেউ চেনে না। আমি এখন যাই, থেকে গেলে হয়ত কখনও ছাড়া পাব না’।
‘মুসলিম ফৌজ কি দূর্গে প্রবেশ করেছে?’ বন্দীর পিতা জিজ্ঞেস করলেন।
জানি না। আগুনের অবস্থা ভয়াবহ। কখন যে নিভে ঠিক নেই’।
‘আমাদের সৈন্যরা ভেতরে ঢুকে থাকলে ওকে লুকিয়ে রাখার ঝুঁকি নিতে পারি’।
‘আগামীকাল ও নিজেই এখান থেকে চলে যাবে’।
‘কিছুক্ষণ পূর্বে তোমার ছোট বাই দু’জন মুসলমান মেয়েকে নিয়ে এসেছে। সালেমের ছেলে ওসমান প্রাসাদ থেকে ওদের উদ্ধার করে এনেছে’।
‘ওদের পরিচয় কি?’
‘গতকাল খ্রিষ্টান সৈন্যরা একটি মুসলিম কাফেলা লুট করেছিল। মেয়ে দুটো সে কাফেলায় ছিল। ওদের ভাইকেও না কি বন্দী করেছে খ্রিষ্টান সৈন্যরা’।
চমকে উঠল আশফাক।
‘মেয়ে দু’জন এখন কোথায়?’ উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করল আশফাক।
‘ভেতরেই আছে’। জবাব দিল বন্দীর পিতা।
একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর যুবতীদের কানে এলো। পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল ওরা।
অপরিচিত একজন যুবকের সাথে আশফাককে সামনের ঘরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সবকিছু ভুলে ছুটে এলো দু’বোন। ছোট ভাইকে জড়িয়ে ধরল বুকের সাথে।
নিতজনের চোখেই বইছে আনন্দের অশ্রু। পিতামাতা হারিয়ে বন্দী হয়েছিল ওরা। সাহায্য করার মত কেউ ছিল না। ফরিয়াদ জানিয়েছিল খোদার কাছে। আল্লাহ তাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন।
অলৌকিক প্রাপ্তির আনন্দে ওরা কাঁদছে। বন্দী যুবকটি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আবেগময় দৃশ্য দেখল।
মেয়েদেরকে রেখে ওসমান এবং বন্দীর ছোট ভাই আবার বাইরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু বন্দীর আর অপেক্ষা করার সময় ছিল না। ফলে বন্দী যুবকটি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বন্দী বেরিয়ে যেতেই হঠাৎ ওসমান এসে ঘরে ঢুকল। সাথে বারজেস এবং তার বন্ধুরা।
ঘরে ঢুকেই বারসেজ যুবতীদের ডেকে বলল, ‘শীঘ্র তৈরী হয়ে নাও। শহর থেকে বের হবার সুেযাগ সৃষ্টি হয়েছে। এখুনি আমরা এখান থেকে পালিয়ে যাবো’।
ওসমান ও তার সঙ্গীরা আশফাককে দেখেই চিনতে পারল। এ ছেলেটির চিৎকার করে ওদের বিবেকের দুয়ারে আঘাত করেছিল।
ওসমান দ্রুত আশফাকের কাছে গিয়ে বললো, ‘তুমি এখানে! কি করে এখানে এলে তুমি?’
আশফাক তার মুক্তির কাহিনী বারজেস ও ওসমানের সঙ্গীদের কাছে বলল।
দুই বোন এবং আশফাককে নিয়ে আঙ্গিনায় নেমে এলো ওরা। তিনটে ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে আঙ্গিনায়।
তিন ভাইবোনকে তিনটে ঘোড়ায় তুলে দিয়ে ওসমান বলল, ‘এর থেকৈ বেশী কিছু কর আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। দোয়া করি তোমাদের সফল নিরাপদ হোক। আর এক মুহুর্তও এখানে অপেক্ষা করো না। পেছনের ফটক এখনো খোলা আছে। যে কোন মুহুর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাড়াতাড়ি করো, খোদা হাফেজ’।
আশফাক ও যুবতীদের চোখ কৃতজ্ঞতায় অশ্রুতে ভরে উঠল। আশফাক বললো, ‘সবকিছুই আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। এখনো আমি বুঝতে পারছি না আমি স্বপ্ন দেখছি, না আসলেই এ বাস্তব। যদি যা দেখছি তা সত্যি হয় তাহলে আপনাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানানোর কোন ভাষা আমার জানা নেই’।
আবেগে আশফাকের গলা বসে গেল। মাথা নিচু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘এ হয়ত আমাদের পূর্ব পুরুষের কোন মহত কাজের ফল। আমি আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করছি এবং তার কাছেই আপনাদের এ কাজের বদলা দেয়ার জন্য কায়মতোবাক্যে প্রার্থনা করছি’।
‘খোদা হাফেজ বন্ধুরা! বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। তোমরা সতর্ক থেকো’। বললো ওসমান।
বারজেস ও ওসমানরা হাঁটা দিল। কয়েক কদম গিয়ে পেছন ফিরে চাইল একবার। দেখল তিনটি ঘোড়া পেছন দরজার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।
ওসমান বন্ধুদের নিয়ে বাড়ির পথ ধরল, বারজেস শহরের পেছনের ফটকের দিকে এগিয়ে চললেন।
গেটে পলায়নপর মানুষের প্রচণ্ড ভীড়। খানিক পূর্বে বারজেস এসে দেখে গেছেন এ ভীড়। ভীড় দেখেই তার মনে এলো, এদের সাথে তিনিও মেয়েদের নিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন।
এ ভাবনা মনে আসতেই তিনি দ্রুত ওসমানের কাছে গেলেন এবং সংগ্রহ করলেন তিনটে ঘোড়া। দুটো দু’বোনের জন্য, নিজের জন্য একটা। কিন্তু আশফাক অতিরিক্ত হওয়ায় তিনি হেঁটেই গেটের দিকে যাত্রা করলেন।
চারজনই এসে গেছেন ফটকের কাছে। সেনা কমাণ্ডার যখন দেখল শহরের লোকজন দলে দলে পরিবার পরিজন নিয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে, তখন ফটক বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিলেন তিনি। প্রচণ্ড ভীড়ের কারণে ফটক বন্ধ করা যাচ্ছিল না। সৈন্যরা লোকজন সরিয়ে ফটক বন্ধ করার চেষ্টা করতে লাগল। লোকজনকে এদিক ওদিক হাকিয়ে ফিরতে লাগল তারা।
সৈন্যদের তাকডাকে জনতার চাপ কিছুটা কমে এল। সুযোগ পেয়ে ধীরে ধীরে ফটক বন্ধ করতে লাগল সৈন্যরা। মানুষের মিছিল ফটকের কাছে আটকে পড়ল।
বারজেস, আশফাক এবং যুবতীরাও আটকা পড়ল সেই সাথে। ফটক বন্ধ হয়ে গেলে আর বের হওয়া যাবে না। পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয় এলে ওদের ধরা পড়ারও সমূহ সম্ভাবনা। বিপদ টের পেল বারজেস। সাথে সাথেই সে ছুটে গেল গেটের কাছে। ওখানে পৌঁছেই বারজেস চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘পেছনে সৈন্যরা আসছে। তাড়াতাড়ি ফটক খুলে দাও। জলদি করো’।
বারজেসের চিৎকার শুনে বন্ধ হতে হতেও তা আর বন্ধ হলো না। আবার খুলে গেল গেট। সুযোগ পেয়ে গেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন হুড়মুড় করে পুনরায় বেরিয়ে যেতে লাগল। বেড়ে গেল মানুষের চাপ। বাধ ভাংগা জোয়ারের মত জনতার স্রোট ছুটে চলল বাইরের দিকে। সে স্রোতের সাথে মিশে বাইরে বেরিয়ে এল বারজেস ও তার সঙ্গীরা।
ফটকের বাইরে এসে বারজেস বললেন, ‘আশফাক, তুমি তোমার কোন বোনের সাথে উঠে বসো। একটা ঘোড়া আমাদের দু’জন পুরুষের ভার বইতে পারবে না। নিরাপদ জায়গায় পৌঁছতে হলে আমাদের অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে’।
আশফাক নিজের ঘোড়া থেকে নেমে ছোট বোনের ঘোড়ায় গিয়ে উঠে বসল। আশফাকের ঘোড়ায় উঠে বসলেন বারজেস। ছুটে চলল তিনটি ঘোড়া।
শহরের বাইরে খ্রিষ্টানদের টহল ছাউনিগুলো জানতেন বারজেস। তাই ওদের চোখ বাঁচিয়ে চলার জন্য বড় রাস্তা ছেড়ে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ে। দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে শহরের দাবানল।
মাঝ রাত পেরিয়ে গেছে। হিমেল বাতাস বয়ে চলেছে মরুভূমির বিশাল প্রান্তর জুড়ে। আকাশে অসংখ্য তারার মেলা। হালকা শাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে মাথার ওপর। মিটিমিটি জ্বলছে ধ্রুবতারা। আদম সুরাত উঠে এসেছে মাথার ওপর। অপরূপ এক নৈসর্গিক পরিবেশে নির্জন পথ ধরে ছুটে চলেছে ছোট্ট একটি কাফেলা। যে কাফেলার এখন মাত্র তিনটি ঘোড়ায় চারজন মানুষ।
অথচ গতকালও বিশাল এক কাফেলার সাথে পথ চলছিল ওরা। সে কাফেলায় ছিল প্রায় দুইশ সঙ্গী সাথী, ছিল প্রচুর মাল সামান, ছিল আত্মীয় পরিজন। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সবই এখন অতীতের দুঃখময় স্মৃতি হয়ে আছে।
চুপচাপ পথ চলছিল ওরা। কারো মুখে কোন কথা নেই। আশফাকের মনে পড়ল তার বাপ-মায়ের কথা। গতকালও তার পিতা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছিল, ফেলে আসা বাড়ি ঘরের কথা মনে করে মন খারাপ করো না। যেখানে যাচ্ছি সেখানে খ্রীস্টানদের নির্যাতনের ভয় নেই। ওখানে গিয়ে আমা নতুন করে ঘর বাঁধবো।
তার মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, বেটা অনেক বড় হয়ে গেছে। এবার একটা বউ ঘরে আনতে হয়।
আর আজ! আজ ওরা এতীম। আজ ওরা এতীম। দুটো যুবতী বোনের দায়িত্ব এখন তার কাঁধে। কোথাও তাদের আশ্রয় নেই। কোন সম্পদ নেই। এই রাতটুকু কেটে গেলে কাল সকালে তারা কি খাবে তারও কোন খবর জানা নেই আশফাকের। বোন দুটোকে নিয়ে কোথায় চলেছে, কোথায় এ সফরের শেষ সে কথাটুকু জানা নেই তার।
আশফাক জানে না বোনদের কিভাবে মুক্ত করা হয়েছে। সে কানিহী শোনারও সময় পায়নি সে। বারজেসও নীরব। দু’একবার শুধু জিজ্ঞেস করছেন ওরা ভয় পাচ্ছে কি না।
দাবানল পেছনে ফেলে তীব্র গতিতে ছুটে চলছে ঘোড়াগুলো। বারজেস ছাড়া বাকীরা জানে না তাদের গন্তব্য কোথায়।
আশফাক বোনকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভয় পাচ্ছো বুবু?’
‘না;। ছোট্ট করে জবাব দিল বোন।
‘দুশ্চিন্তা লাগছে?’
‘না। আল্লাহ যখন খ্রিষ্টানদের কবল থেকে একবার বেরিয়ে আসতে দিয়েছেন তখন নিশ্চয়ই তিনিই কোন নিরাপদ আশ্রয়েরও ব্যবস্থা করবেন’।
আর কোন কথা হলো না। শেষ রাতের বাতাস চিরে বারজেসের পিছু পিছু সমান তালে ছুটে চলল আশফাক ও তার বোনের ঘোড়া।
❀ ❀ ❀ ❀ ❀
সূর্যোদয়ের পর পরই বারজেস মুসলিম সেনাবাহিনীর এলকায় পৌঁছলেন। একটা পাহাড়ের মোড় ঘুরতেই সালাহুদ্দীনের টহল বাহিনীর সামনে পড়ে গেল ওরা।
টহল বাহিনী ওদের থামতে বলল। ঘোড়ার বাগ টেনে ধরলেন বারজেস। সাথে সাথে বাগ টেনে ধরল আশফাক এবং সামিরা। অজানা আতঙ্কে ছেয়ে গেল ওদের মন।
টহল বাহিনী এগিয়ে গেল ওদের কাছে। কমাণ্ডার সামনে বেড়ে ওদের পরিচয় জানতে চাইল।
বারজেস কমাণ্ডারের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলেন সুলতানের অবস্থান। বললেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ আছে। অবিলম্বে আমার সুলতানের কাছে পৌঁছা দরকার’।
তিনি খ্রিষ্টানদের সামরিক রসদ ধ্বংস হওয়ার সংবাদ সুলতানকে দিয়ে যতশীঘ্র সম্ভব ক্রাক আক্রমণের পরামর্শ দিতে চাইছিলেন। কমাণ্ডার সবার ওপর দিয়ে একবজার নজর ঘুরিয়ে বলল, ‘আমার সাথে আসুন’।
ক্রাকের দাবানল নিভে গিয়াছিল। তবুও কোথাও কোথাও কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছিল ধোঁয়া। রাতভর ছুটাছুটি করে ক্লান্ত ঘোড়াগুলো ধীরে ধীরে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। ফাঁকা ফটক দিয়ে কিছু ঘোড়া চলে গিয়েছিল শহরের বাইরে।
এখানে সেখানে পড়েছিল উন্মত্ত ঘোড়ার পায়ে পিষে মরে যাওয়া মানুষের লাশ।
সৈন্য এবং বন্দীরা মিলে এখনো কুপ থেকে পানি তুলে ক্লান্ত হয়ে সে পানি আগুনে ফেলছিল।
দূর্গের কোথাও মুসলিম ফৌজের চিহ্নও নেই। দূর্গের বাইরেও বিস্তৃত ময়দান জুড়ে খ্রিষ্টানদের সেনা ছাউনি। আগুন কিভাবে লাগল, কে লাগালো, কিছুই জানে না কেউ।