» » ভয়াল রজনী

বর্ণাকার

সমগ্র শহরে নীরবতা নেমে এলো। কোন বাড়িতে আলো নেই। সুনসান সড়ক।কেবল মাত্র সম্মিলিত সামরিক হেড কোয়ার্টারে এখনও আলো জ্বলছে।

পানশালায় হাজির হয়েছেন খ্রিষ্টান সম্রাটগণ। জমে উঠল পানশালা। আজকের আলোচনার বিষয় অপহৃত দু’জন মুসলিম যুবতী এবং লুণ্ঠিত ধন-সম্পদ।

একজন প্রশ্ন করল, ‘মেয়ে দুটো কি কাজে আসবে?’

জবাবে একজন সেনা কমাণ্ডার বললো, ‘মেয়েরা বুদ্ধিমতি এবং প্রাপ্ত বয়স্কা। একজনের বয়স ষোল, দ্বিতীয় জনের বাইশ। ওদেরকে দিয়ে গুপ্তচরের কাজ করানো যাবে না। কিছুদিন আনন্দ উপভোগে ব্যবহার করা যায়’।

‘এরপর কোন সেনা অফিসারের হাতে তুলে দিলেই হবে’। চীফ কমাণ্ডার বললেন। ‘অফিসাররাত াদের বিয়ে করে নেবে’।

মেয়েদের নিয়ে অশ্লীল আলোচনা চলল দীর্ঘক্ষণ। ওরা তখন ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে।

দু’জন মধ্য বয়েসী মহিলা ওদের গোসল করিয়েছে। মহিলা দু’জন এ বিষয়ে পারদর্শিনী। ওরা মেয়েদের কাপড় পরাচ্ছিল।

সকাল থেকে ওরা কিছুই মুখে তোলেনি। শুধু কাঁদছে। তাদের এমন খাবার দেওয়া হয়েছে যা তারা কোনদিন দেখেনি। কিন্তু ওরা সে খাবার ছুঁয়েও দেখেনি।

কে কোথায় আছে দু’জনের কেউই জানে না।

মহিলারা ওদেরকে এক স্বপ্নীল জগতের লোভ দেখাচ্ছিল। একজন বলছে, ‘ফ্রান্সের সম্রাট তোমাকে পছন্দ করেছেন। তুমি হবে ফ্রান্সের রাণী’।

অন্যজন বলছে, ‘তোমাকে জার্মানীর রাজার মনে ধরেছে। কি সৌভাগ্য তোমার’।

কখনো আবার মিষ্টি করে ধমকাচ্ছিল, ‘সম্রাটদেরকে নাখোশ করলে তোমাদেরকে সৈন্যদের তাহে তুলে দেওয়া হবে’।

মেয়ে দু’জন মরুচারী বেদুইন। ওরা ভীরু তাও নয়। কিন্তু অসহায়। নিজকে রক্ষা করার শক্তিও নেই।

পিতামাতা ওদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্যই খ্রিষ্টান এলাকা থেকে হিজরত করছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য ওদের, শেষ পর্যন্ত খ্রিষ্টানদের হাতেই ধরা পড়তে হল।

পিতামাতা নিহত। ভাইটা বন্দী। এখন আল্লাহ ছাড়া ওদের সাহায্য করার আর কেউ নেই।

নিজেদের সম্ভ্রম ছাড়াও ভায়ের জন্য ওরা উদ্বিগ্ন। আশফাক তখন বেগার ক্যাম্পে কাৎরাচ্ছে। আহত ভাইটিকে পশুরা অনেক পিটিয়েছে।

সন্ধ্যায় ডিউটি শেষে বেগার ক্যাম্পে ঢুকেছে বন্দীরা। ওরা নতুন বন্দীদের দেখল। শুনল ওদের ধরা পড়ার কাহিনী। পনের জনের মধ্যে আশফাকই বেশী আহত।

লুকিয়ে রাখা ওষুধ দিয়ে বন্দীরা ওর ক্ষতস্থানে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিল।

ব্যাণ্ডেজ বাঁধার পর আশফাক অনেকটা আরাম বোধ করল। ক্ষতস্থানে এখন আর ব্যথা অনুভব করছে না সে।

বোনদের কথা ওর বার বার মনে পড়ছে। বন্দীদের জিজ্ঞেস করল, ‘তার বোনেরা এখন কোথায়? এখান থেকে কিভাবে পালানো যায়?’

বোনেরা এখন কোথায় এবং তাদের সাথে কি ব্যবহার করা হচ্ছে বন্দীরা শোনাল তাকে সে খবর।

বললো, ‘এখানে কোন প্রাচীর নেই। কারো পায়ে শিকলও পরানো হয়নি। তবুও পালানো সম্ভব নয়। পালিয়ে যাবেই বা কোথায়? ধরা পড়তেই হবে। আরধরা পড়লে মৃত্যু অবধারিত’।

কোন কোন বন্দী কয়েক বছর থেকেই এখানে আছে। পালিয়ে গেলে পরিবারের উপর নেমে আসবে অকথ্য নির্যাতন। এ জন্যই বন্দীরা পালাচ্ছে না। তবুও আশফাকের মনে বোনদের মুক্ত করার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। যদিও তার এখন চলার শক্তিও নেই।

সারাদিনের হাড়ভাংগা পরিশ্রমের পর শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়েছে বন্দীরা। জেগে আছে শুধু আশফাক। ওর দু’চোখে ঘুম নেই। অসহায় বোনদের নানা বর্ণের ছবি ভেবে বেড়াচ্ছে চোখের সামনে।

                                               

‘মেয়েরা না আবার ধরা পড়ল! ফিসফিসিয়ে বলল ওসমান।

‘এমন অলক্ষুণে কথা বলো না’। বললেন বারজেস। ‘আল্লাহকে স্মরণ কর। এখন আমরা মৃত্যুর মুখে আছি। মন থেকে সব ভয় দূর করে ওখানে খোদাকে বসাও। তোমার বন্ধুরা কি নির্ভরযোগ্য?’

‘ওদেরকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায়। আমি ওদের নিয়ে ভাবছি না। মেয়েদের নিয়ে চিন্তা হচ্ছে’।

‘আল্লাহর সাহায্য চাও। আমরা চুরি করতে আসিনি। অবশ্যই তিনি সাহায্য করবেন’।

সেনা হেড কোয়ার্টারের পাশে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিল ওরা। দৃষ্টি প্রাসাদের দিকে। কোন সংকেতের কি কাজ করতে হবে সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বারজেস।

ওসমানের মনে ঘুরে ফিরে উদয় হচ্ছিল চারজন তরুণীর কথা। মেয়েরা গিয়েছে অনেক আগে। এতোক্ষণে আগুণ লাগানোর কাজ শেষ কয়ে যাওয়া উচিত ছিল। ওদের অভিযান সফল হলে অগ্নিশিখা এখান থেকেও দেখা যাবে। প্রাসাদের সবাই তখন ছুটে যাবে আগুনের কাছে।

কথা ছিল ওরা চলে গেলেই যুবকরা প্রাসাদে ঢুকবে। কিন্তু আগুনের কোন শিখা এখনো দেখা যাচ্ছে না। তবে কি সেন্ট্রি ওদের যেতে দেয়নি। ধরে রেখেছে না ফিরিয়ে দিয়েছে কে জানে।

মেয়েরা তখনও সেন্ট্রিকে পায়নি। নির্দিষ্ট স্থানে নেই সেন্ট্রি। সেন্ট্রির এই না থাকাটা বিপদের লক্ষণ। তাকে জীবিত রেখে আগুন লাগাতে গেলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশীল। ওরা সেন্ট্রিকে খুঁজতে লেগে গেল। খড়ের পালান অতিক্রম করছিল ওরা।

অন্ধকারে সৈন্যতের তাঁবু নজরে আসছে না। একত্রে হাঁটছে চারজন।

সামনে একটা মশাল দেখা যাচ্ছে। মাটিতে পুতে রাখা হয়েছে। মশালের দিকে এগুল ওরা।

অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলা সেন্ট্রি। মশাল হাতে নিয়ে এগিয়ে এলো মেয়েদের দিকে।

থমকে দাঁড়িয়ে গেল মেয়রা। মশাল হাতে সেন্ট্রি মেয়েদের সামনে এসে দাঁড়াল।

ওদের ঝলমলে পোষাক দেখে ইতস্ততঃ করলো একটু তাকিয়ে দেখল একজন চাকরানীর মাথায় কাপড়ে ঢাকা একটা ঝাকা।

‘আপনারা কে? কোথায় যাচ্ছেন? প্রশ্ন করল সেন্ট্রি।

‘সম্ভবত ভুল পথে এসেছি’।

বান্ধবীদের দিকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে উঠল আল নূর।

‘শাহ রিমাণ্ডকে কথা দিয়েছিলাম রাতে আসব। একটু দেরী হয়ে গেছে। সামনে তো মনে হয় উট-ঘোড়া বেঁধে রাখা হয়েছে’।

সেন্ট্রিকে ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য রিমাণ্ডের নাম উচ্চারণই যথেষ্ট ছিল। খ্রিষ্টান সম্রাটগণ কি চরিত্রের জানতো সেন্ট্রি। হয়ত আনন্দ-স্ফুর্তি করার জন্য এদের ডেকে এনেছে, ভাবল সেন্ট্রি।

মেয়েদের পোষাক আশাক এবং কতা বলার ঢং দেখে সেন্ট্রি নিশ্চিত, রিমাণ্ডই এদের ডেকে পাঠিয়েছেন। সে ওদেরকে পথ বলে দিতে লাগল।

কথা বলার ফাঁকে একজন যুবতী সেন্ট্রির পেছনে চলে এল। তারপর সমস্ত শক্তি দিয়ে পিঠে খঞ্জর ঢুকিয়ে দিল।

মশালটি পড়ে গেল। সেন্ট্রির হাত থেকে। আল নূর পাঁয়ে পিষে নিভিয়ে ফেলল মশাল।

অন্য মেয়েরাও পড়ে থাকা সেন্ট্রির গায়ে পরপর কয়েকটি আঘাত করল। চিৎকার করারও সময় পেল না সেন্ট্রি। তার আগেই মারা গেছে।

চাকরানী বেশী যুবতী মাথা থেকে ঝাকা নামাল। টক জলদি খড়ের পালান এবং ঘাসের স্তুপে জ্বালানী ছড়িয়ে দিল। এরপর একে একে সবকটা স্তূপে আগুন ধরিয়ে দিল। জ্বলে উঠল শুকনো ঘাস।

এবার নজরে তাঁবুর সারি। সৈন্যদের রসদ এবং পোষাক। একদিকে হাজার হাজার টাংগা। ওরা তাঁবু এবং টাংগায় জ্বালানী ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল।

ঘাসের স্তূপ থেকে অগ্নিশিখা লকলকিয়ে আকাশ ছুইছে।

ঘোড়ার দিকে ছুটল মেয়েরা। সৈন্যরা এখনও জাগেনি। খঞ্জর দিয়ে ঘোড়ার রশি কাটতে লাগল ওরা। একেকটা রশিতে পঞ্চাশটা করে গোড়া বাঁধা।

দুজন ঘোড়ার রশি কাটা বাদ দিয়ে বাঁধা ঘোড়াগুলোর পাশে দিয়ে দাঁড়াল। কয়েকটা ঘোড়াকে পর পর খঞ্জর দিয়ে আঘাত করল ওরা। হ্রেষা শব্দ তুলে ছুটতে লাগল আতংকিত ঘোড়াগুলো।

একটু দূরে দাঁড়িয়ে উটগুলো নিশ্চিন্তে জাবর কাটছিল। ওদের পায়ের রশিও কেটে দিল মেয়েরা।

উট, ঘোড়া ছুটছে, পালাচ্ছে, আতংকে চিৎকার করছে। মেয়েরা ওদের ছুটোছুটির ভেতর পড়ে গেল।

ছুটন্ত উট ও ঘোড়ার হ্রেষা ধ্বনি ও কুরের শব্দে জেগে উঠল সৈন্যরা।

অপহৃত দু’জন যুবতীকে কনের সাজে সাজানো হয়েছে।

দুই কক্ষে একই সময় প্রবেশ করল দু’জন লোক, দুটি খ্রিষ্টান রাজ্যের সম্রাট। মদে মাতাল।

চাকরানীরা বেরিয়ে গেল। সম্রাটরা এগিয়ে গেল মেয়েদের দিকে। সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্য কক্ষের এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে লাগল মেয়েরা।

আল্লাহ ছাড়া কেউ তাদের রক্ষা করতে পারে না। একজন হাটু গেড়ে বসে পড়ল। হাত উপরে তুলে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে লাগল।

অট্টহাসিকে ফেটে পড়ল খ্রিষ্টান সম্রাট। পা বাড়ল যুবতীর দিকে।

এ সময় হঠাৎ বাইরে থেকে ভেসে এল সৈনিকদের ডাক-চিৎকারের শব্দ। যেন প্রসাদে ডাকাত পড়েছে। বিরক্তিতে কুঞ্চিত হলো সম্রাটের কপাল।

শোরগোলের অস্বাভাবিক শব্দে মেয়েদের দিকে এগুনো বন্ধ করে দরজা খুলে বাইরে তাকালেন সম্রাট। দেখলেন আলোয় ভরে গেছে পুরো প্রাঙ্গণ।

তার মনে হল সমগ্র শহরে আগুন লেগে গেছে।

দেখলেন, আতংকিত ও ছুটন্ত ঘোড়ার কয়েকটি প্রাসাদেও এসে ঢুকে পড়েছে।

নেশা ছুটে গেল সম্রাটের। দ্বিতীয়জনও বেরিয়ে এলেন। কয়েকজন লোক ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো, ‘ঘাস, তাঁবু এবং গাড়ীতে আগুল লেগেছে। ছুটন্ত পশুর পদতলে পিষে যাচ্ছে সৈন্যরা’।

সমগ্র শহর পুড়ে গেলেও সম্রাটরা এত চিন্তা করতেন না। কিন্তু জ্বলচে ফৌজি রসদ, সৈনিকদের পোষাক আশাক, শত শত টাঙ্গা। যুদ্ধের বাহন হাজার হাজার উট, ঘোড়া পালিয়ে যাচ্ছে।

প্রাসাদের সবাই ছুটে বেরিয়ে গেল। দেখতে দেখতে জনশূন্য হয়ে গেল প্রাসাদ। প্রাসাদের চারপাশের সমগ্র প্রহরীরাও ছুটে গেছে আগুন লাগার স্থানে।

বারজেস যুবকদের দিকে তাকিয়ে বললে, ‘প্রাসাদে ঢুকার এই সুযোগ, চলো’।

ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল যুবকরা। ছুটে প্রাসাদে ঢুকে গেল আট জন যুবক।

বারান্দায় উঠেই দুই সঙ্গীর নাম ধরে ডাকতে লাগলেন বারজেস।

চাকর-বাকরদের মধ্যে পাওয়া গেল একজনকে। বারজেস তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজকের অপহৃত মেয়ে দুটো কোথায়?’

ও ইশারায় কক্ষের একটা সারি দেখিয়ে দিল। বলল, ‘এ সারিরই কোন ঘরে আছে ওরা’।

দৌড়ে কক্ষগুলোর দিকে এগুলো সবাই।

প্রাসাদে কোন দায়িত্ববান পুরুষ নেই। ভালই হয়েছে ওদের জন্য।

করিডোরে কয়েকজন অর্ধ উলংগ মেয়ে পাওয়া গেল। ওরা ভয়ে ছুটে পালাচ্ছে। পর পর কয়েকটা মেয়েকে থামিয়ে আজকের অপহৃত মেয়েদের সম্পর্কে যুবকরা ওদের কাছে জানতে চাইল। কিন্তু মেয়ে দুটো কোথায় আছে ওরা জানে না।

কয়েকটা কক্ষে খোঁজ করার পর একজনকে পাওয়া গেল এক রুমের ভেতর। মেয়েটি রুমের মাঝখানে বিহবল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ওসমান এবং তার সঙ্গীরা মেয়েটাকে দেখেই চিনতে পারল। কারণ দিনের বেলা ওদের নিয়ে আসার সময় যুবকরা মেয় দুটোকে দেখেছিল।

মুখোশধারী আট-দশজন লোক দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠল মেয়েটা। বারজেস বললেন, ‘ভয় পেয়ো না, চিৎকার থামাও, আমরা মুসলমান। তোমাদের উদ্ধার করতে এসেছি’।

কিন্তু মেয়েটা বিশ্বাস করল না। সে রুমের একদিকে সরে গেল।

বারজেস ওকে বললেন, ‘বাঁচতে চাইরে এখুনি পালাতে হবে। জলদি এসো’।

ওরা দরজার দিকে পা বাড়াল। কিন্তু মেয়েটা তার জায়গা থেকে নড়ল না। ওরা আবার ডাকল ওকে। কিন্তু মেয়েটা তাও সাড়া দিল না।

বারজেস যুবকদের বললেন, ‘এখানে সময় নষ্ট করা যাবে না। ওকে ধরে নিয়ে এসো’।

যুবকরা ওকে ধরনের গেল। কিন্তু মেয়েটি সরে গেল সেখান থেকে। যুবকরা আবার এগুলো, এবারও সরে গেল সে, কিছুতেই ধরা দিচ্ছিল না।

বারজেস বললেন, ‘কুইক, তাড়াতাড়ি করো’।

শেষে আরো দুজন যুবক এগিয়ে গিয়ে জোর করে ওকে তুলে নিল।

আরো কয়েকটি কক্ষ পার হওয়ার পর পাওয়া গেল দ্বিতীয়জনকে। ওসমানরা তাকেও  জোর করে তুলে নিল।

মেয়েরা হাত-পা ছুড়ছিল আর চিৎকার করছিল, ‘ছাড়ো, ছাড়ো আমাদের’।

বারজেস ক্রুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘পাজী মেয়ে, বলছি না আমরা মুসলমান। তোমাদের চিৎকার শুনে খ্রিষ্টানরা এসে পড়লে আমরা সবাই মারা পড়বো। আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ করো, একটু শান্ত হও’।

‘আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?’ চিৎকার করতে করতেই বলল একটি মেয়ে।

‘আপাততঃ শহরে কোন মুসলমানের বাড়িতে লুকিয়ে রাখবো। তারপর সুযোগ বুঝে শহর থেকে বের করে যেখানে যেতে চাও পাঠিয়ে দেব’।

বরজেসের কথায় শান্ত হল মেয়ে দু’জন।

মুখোশধারী দলটি বেরিয়ে এলো প্রাসাদ থেকে। আশেপাশে বা সদর দরজা কোথাও কোন খ্রিষ্টান সৈন্যের দেখা পেল না ওরা। সবাই তখনও আগুনের কাছে।

বিনা বাধায় মেয়ে দুজনকে নিয়ে প্রধান ফটক দিয়ে বেরিয়ে এলো আটজন যুবক। কয়েক মিটিনের মধ্যেই সামনের রাস্তা পেরিয়ে ওরা একটা সরু গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল।

যুবকরা খুশি, কোন রকম লড়াই, লক্তপাত ছাড়াই ওদের অভিযান সফল হয়েছে। শেষ পর্যণ্ত মুক্তি পেয়েছে দুই মুসলিম যুবতী।

মেয়েরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, যাক, আল্লাহ তাদের আবেদ কবুল করেছেন। খ্রিষ্টানদের কবল থেকে বাঁচিয়েছেন তাদের জীবন ও সম্ভ্রব।

আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ ছুঁইছিল। আগুনে জ্বলছিল সেনাবাহিনীর সমস্ত রসদ-সামান। শহরের অলিগলি আর রাস্তায় ছুটছিল লাগামহীন ঘোড়া।

জেগে উঠেছে শহরবাসী। সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে অজানা আতঙ্ক। কি ঘটেছে কিছুই বুঝতে পারছে না তারা।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে পথে পথে উট-ঘোড়ার ছুটাছুটি দেখে দরজা বন্ধ করে বসে রইল মানুষ। কি ঘটেছে দেখার জন্য বাইরে বেরিয়ে আসতে সাহস পেল না কেউ।

উট ও ঘোড়ার লাফালাফি না থাকলে আগুন নেভানোর জন্য হয়ত বেরিয়ে আসতো লোকজন। কিন্তু একদিকে সেনা সদরে আগুন ও অন্য দিকে রাস্তায় রাস্তায় উট, ঘোড়ার দাপাদাপি দেখে লোকজন ভাবল, তবে কি সালাহুদ্দীন আইউবী শহরে আক্রমণ করেছে?

এ ভাবনা মনে আসতেই খ্রিষ্টান পরিবারগুলো ভীত বিহবল হয়ে পড়ল। কেউ কেউ পালিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিতে শুরু করল।