সূর্য এখনও ডুবেনি। সাতজন বন্ধুর সাথে দেখা করল ওসমান। ওদেরকে ইমাম সাহেবের কাছে যেতে বলে নিজেও মসজিদের দিকে পা বাড়াল।
পাগলের সাথে কথা বলার পর ওসমান ইমাম সাহেবকে নেতৃত্ব গ্রহণের অনুরোধ করেছিল। দলের সবাই কাজ করছিল তার নেতৃত্বে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বাড়িতে দলের গোপন বৈঠক চলত।
অপহৃত দু’জন যুবতীকে উদ্ধার করতে হবে, ওসমানের এ সিদ্ধান্ত ছিল আত্মহত্যার শামিল।
মুচির পরামর্শ অনুযায়ী ওমান ইমাম সাহেবের বাড়ি চলে এল। তিনি অস্থিরভাবে বারান্দায় পায়চারী করছিলেন, থেকে গেলেন ওসমানকে দেখে।
‘ওসমান! বন্দী ছেলেটার চিৎকার তুমি শুনেছো? সম্ভবতঃ মেয়ে দু’জন ওর বোন’।
‘তার চিৎকারের জবাব দিতেই এখানে এসেছি সম্মাতি ইমাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সাতজন বন্ধুও এখানে পৌঁছে যাবে’।
‘কি করবে তোমরা?
‘কি করবে তোমরা? আর কিইবা করতে পারি।……. জানি, আমাদের অনেক মেয়েই ওদের কাছে রয়েছে। কিন্তু এ দু’টো মেয়ে আমাকে পরীক্ষায় ফেলে দিল’।
পায়চারী করতে করতে বললেন ইমাম।
মুখ উপরের দিকে তুলে ইমাম সাহেব বেদনা মাখা কণ্ঠে বললেন, ‘খোদা, শুদু একটি রাতের জন্য আমার যৌবন ফিরিয়ে দাও। এক রাত পর আমার জীবন ছিনিয়ে নিয়ো। যদি বেঁচে থাকি মৃত্যু পর্যন্ত মেয়ে দুটোর অসহায় বিলাপধ্বনি আমার কানে বাজবে। আমি পাগল হয়ে যাবো’।
‘আপনি আমাদেরকে পরামর্শ দিন। আশা করি আজকের এ রাতের পর আর আপনাকে মেয়েদের নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতে হবে না’।
ওসমানের দু’জন সঙ্গী ভেতরে ঢুকল। পাশাপাশি তিনজন বসলো ইমাম সাহেবের বিছানায়।
ইমাম সাহেব বললেন, ‘আজকে মনে হয় আমার বুদ্ধি গুলিয়ে ফেলেছি। এতটা অধৈর্য্য হওয়া আমার সাজে না। কিন্তু কোন বিবেকবান মানুষ এ চিৎকার শুনে বসে থাকবে পারে না। স্বাভাবিকভাবেই তার ভেতরের আবেগ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এ আবেগকে কাজে লাগানোর জন্য যুবক হতে হয়। কিন্তু আমার সন্তানেরা! আমি অনেক বুড়ো হয়ে গেছি। সহ্য শক্তিও কমে গেছে। তোমরা যাই করতে চাও সাবধানে করো’।
একে একে সাতজন যুবক এসে পৌঁছল। কিছুক্ষণ পরই এল মুচি।
মুচির মাথায় টুকরিতে পুরতো জুতা এবং জুতা মেরামতের যন্ত্রপাতি। টুকরিটা এক পাশে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই হেসে উঠলেন তিনি। এখন কে বলবে এই লোকটা সারাদিন কুঁজো হয়ে বসে পৃথিবীর সাথে সম্পর্কহীনভাবে বসে বসে জুতো সেলাই করে।
ইমাম সাহেব দরবা বন্ধ করে দিলেন।
বারজেস একণ আর মুচি নন, গোয়েন্দা সংস্থার একজ অভিজ্ঞ এবং বুদ্ধিমান গুপ্তচর।
বারজেস ইমাম সাহেবকে বললেন, ‘এ যুবকেরা আজই যে মেয়ে দুটোকে ছাড়িয়ে আনতে চাইছে, এ কাজে শুধু ধরা পড়ার ভয় নয়, নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকিও আছে’।
‘আমরা জেনে বুঝেই মৃত্যুর এ ঝুঁকি নিচ্ছি সম্মানিত বারজেস’। বললো এক যুবক। ‘আপনি এ পথের গুরু। আমাদের পথ দেখান’
‘আমরা পরামর্শ চাইলে বলি, খ্রিষ্টানদের কাছে আমাদের অনেক মেয়ে রয়েছে। কাউকে এনেছে চুরি করে। কাউকে আবার কাফেলা থেকে লুট করেছে।
ওদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধেই গোয়েন্দাবৃত্তিতে ব্যবহার করছে। কাউকে পাঠাচ্ছে তোমাদের চরিত্র নষ্ট করতে। প্রতিটি মেয়েকে তো তোমরা ছাড়িয়ে আনতে পারবে না।
যতি আমার অভিজ্ঞতা কাছে লাগাতে চাও তো বলবো, দু’টি মেয়ের জণ্য আটজন যুবককে উৎসর্গ করা ঠিক হবে না। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে ধৈর্য ধারণ কর’।
‘এ অবস্থায় কি করে ধৈর্য ধরতে পারি?’ ঝাঁঝের সাথে বললো ওসমান।
‘আমার মত’। বললেন বারজেস।
‘আমি কি সত্যি সত্যি মুচি? মিসরে আমার রয়েছে উৎকৃষ্ট আরবী ঘোড়া। রয়েছে নিজের বাড়ি, রয়েছে অনুগত চাকর-বাকর। একজন সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালী ব্যক্তি হয়েও এখানে বসে সারাদিত আমি মানুষের ময়লা ছেড়া জুতা সেলাই করি।
তোমরা তোমাদের ঈমানী দাবী পুরণ করেছো দুটো মেয়ের মুক্তির জন্য নিজেদের জীবনকে পেশ করে। কিন্তু এ দু’জন মেয়েসহ অসংখ্য মেয়ের মুক্তি এবং ক্রাকসহ বিশাল এলাকা মুক্ত করার জন্য তোমাদের বেঁচে থাকা দরকার। এ জন্য ধৈর্যের সাথে উপযুক্ত সমেয়র অপেক্ষা করা উচিত তোমাদের’।
ইমাম সাহেব বললেন, ‘সম্মানিত বারজেস অভিজ্ঞ ব্যক্তি। আমি মেয়েদের মুক্তি অবশ্যই চাই, তবে বারজেসের যুক্তিও এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে তাঁর পরামর্শের বাইরে আমাদের কিছু করা উচিত নয়’।
ওসমান এবং তার সঙ্গীদের সহ্যের সীমা শেষ হয়ে গেল। বারজেস ও ইমাম সাহেবের কথা-বার্তা শুনেও তাদের মনে কোন প্রবোধ এলো না। ইমাম ও বারজেসের কথা ছাপিয়ে তাদের কানে বাজতে লাগল আশফাকের চিৎকার ও মেয়ে দুটোর করুণ চাহনি।
মেয়ে দুজনকে উদ্ধার করার অভিযান থেকে বিরত থাকার শত যুক্তি তাদের কাছে মেয়ে দুটোর চাহনির তুলনায় নিষ্প্রভ মনে হলো।
ওরা বলল, ‘মেয়েরা যেখানেই থাকুক, যে অবস্থায়ই থাকুক, আর তাদের উদ্ধার অভিযান চালাতে যত বড় ত্যাগই স্বীকার করতে হোক, আমরা সেখানে আক্রমণ করবোই’।
‘আপনাদের দেহের খুন বাসি হয়ে গেলেও আমাদের শিরায় তাজা খুনের অভাব নেই। আপনাদের খুনের দিকে তাকিয়ে নয়, সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের দিকে তাকিয়ে’।
বলল আরেক যুবক।
ওসমান বললো, ‘অপারেশনে আপনারা নন আমরা যাবো, আপনারা শুদু বলুন, কোন পথে গেলে আমরা বেশী সফলতার আশা করতে পারি’।
ইমাম সাহেব ও বারজেস তৎক্ষণাত কোন জবাব দিতে পারল না।
কক্ষে দশ জন প্রাণী, কেউ মুখ খুলছে না। গুমোট নীরবতায় ছেয়ে গেল কক্ষ।এ যেন বিস্ফোরণের পূর্ব মুহুর্ত। আটজন যুবকের চেহারায় আগুন ঝরা দৃঢ়তা। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ওরা।
অনেকক্ষণ পর নিরবতা ভেংগে বারজেস বললেন, ‘খ্রিষ্টান রাজাদের পানশালায় আমাদের দু’ন গোয়েন্দা সাধারণ চাকরের কাজ করে। সুবাক বিজয়ের পর খ্রিষ্টানদের ছদ্মবেশে ওরা চলে এসেছিল। এখানে এসে পানশালায় চাকরি নিয়ে গুপ্তচরের কাজ করছে।
বৃটেন, ইটালী, ফ্রান্স, জার্মানী এবং অন্যান্য দেশের সম্রাটগণ যেখানে বসে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা করে তোমরা নিশ্চয়ই সে প্রাসাদ দেখেছে। সে প্রাসাদের বিশাল এক কক্ষ ওদের পানশালা।
রাতে সেখানে নৃত্য গীতের আসর বসে। আনন্দ স্ফুর্তি করার জন্য মেয়ে থাকে।মাঝ রাত পর্যন্ত মদ পান ও আনন্দ স্ফুর্তির জলসা চলে।
কক্ষটা উপর তলায়। ওখান থেকে সমগ্র শহর চোখে পড়ে।
কক্ষের চারপাশে কড়া সেনা প্রহরা। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, সম্রাটরা ছাড়া অন্য কোন মহা সম্মানিত ব্যক্তিও সে কক্ষের কাছে যেতে পারে না।
মেয়ে দু’জন রাতে কোথায় থাকবে আমি এ তথ্য সংগ্রহ করতে পারবো। কিন্তু ওরা সেখানে থাকলে সে পর্যন্ত যাওয়া তোমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না’।
‘সেখানে পৌঁছার কোনই উপায় কি আছে?’
‘না নাই। তবে বাইরে সেনাবাহিনী আক্রমণ করলেই কেবল ওখান পর্যন্ত যাওয়া যাবে।
সেনাবাহিনী আক্রান্ত হলে সম্রাটগণ কক্ষের বাইরে চলে আসবে আক্রমণ ঠেকানোর জন্য। কক্ষেরপ্রহরীরাও হয়ত তখন সরে আসবে সেখান থেকে। কিন্তু আজ রাতে ক্রাকে কোন সেনা অভিযান হচ্ছে না। সুলতান সালাহুদ্দীন কবে নাগাদ ক্রাক আক্রমণ করবেন তাও বলা যায় না’।
‘বাইরের দিক থেকে শুধু আক্রমণ করা দরকার?’
জানতে চাইল ওসমান।
‘আপনি বলতে চাইছেন, আক্রান্ত হলে লোকজন মেয়েদেরকে রেখে ওখান থেকে চলে আসবে। এসুযোগে এ ছেরো মেয়েদেরকে তুলে নিয়ে আসতে পারবে, এই তো?’
বরজেসের কাছে ইমাম সাহেব জানতে চাইলেন।
‘হ্যাঁ। আমি তাই বলতে চাইছি’।
‘শহরে বড় কোন ঝামেলা বা আক্রমণ হলে অথবা যুদ্ধের রসদে আগুন লাগলেও কি সবাই ওখানে ছুটে আসবে?’
‘হ্যাঁ’। জবাব দিলেন বারজেস।
গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন ইমাম সাহেব। ইসলামী ইতিহাসের একটি ঘটনা ভেসে উঠল তার মনের পর্দায়। একে একে বারজেস এবং আটজন যুবকের দিকে তাকালেন তিনি।
বললেন, ‘সম্মানিত বারজেস ও আমার মুজাহিদ বন্ধুরা! আমাদের সামনে আজ এক কঠিন পরীক্ষা। এ পরীক্ষার মোকাবেলায় আমাদের করণীয় কি সে ব্যাপারে আপনারা নিজ নিজ মতামত পেশ করেছেন।
বারজেসের বক্তব্যে আছে বাস্তবতা ও যুক্তি, যুবক বন্ধুদের বক্তব্যে আবেগ। কিন্তু কোন সচেতন মুসলমান কেবল যুক্তি বা আবেগ দিয়ে এ ধরনের সমস্যার ফায়সালা করে না। তার সামতে থাকে কোরআন ও সুন্নাহ। কোরআন ও সুন্নাহর মূলনীতিই এ ক্ষেত্রে স্টাণ্ডার্ড হিসাবে আমাদের পথ দেখাতে পারে।
এ ধরনের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ইসলামী রীতি কি হতে পারে তা বুঝার জন্য আমি আপনাদের সামনে ইসলামী ইতিহাসের একটি ঘটনা তুরে ধরতে চাই। হয়ত ঘটনাটি আপনাদের সবার জানা, তবু এর উল্লেখ করছি এ জন্য যে, আজকের উদ্ভুত সমস্যা সমাদানে এ ঘটনা হয়ত আমাদের নতুন করে দিকনির্দেশনা দিতে পারবে।
মদিনায় ইসলামের ছোট্ট রাষ্ট্রটির সবেমাত্র উদ্ভব ঘটেছে। অস্ত্রবল নেই, জনবল নেই। মক্কা থেকে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় মুহাজিররা এসে আশ্রয় নিয়েছেন মদিনায়। তাঁদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করতেই হিমশিম খাচ্ছেন মদিনার গুটিকয়েক আনসার। মহানবী (স) আর তাঁর নিবেতিপ্রাণ সেই মুষ্টিমেয় সাহাবীদের সামনে এখন বেঁচে থাকার কঠিন পরীক্ষা।
একদিন তাঁরা খবর পেলেন, সিরিয়ার দিক থেকে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে বিপুল পরিমান মাল-সামানাসহ এগিয়ে আসছে একটি বাণিজ্য কাফেলা। এর পরপরই খবর এলা, উল্টো দিক থেকে অর্থাৎ মক্কা থেকে সশস্ত্র কাফেরদের এক বিশাল সেনাবাহিনী মদিনা আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসছে।
এ ধরনের নাজুক ও কঠিন পরিস্থিতিতে সাহাবীদের নিয়ে পরামর্শ সভায় বসলেন মহানবী (স.)। বললেন, ‘একদিকে উত্তরে বাণিজ্য কাফেলা, অন্যদিকে দক্ষিণ দিক থেকে ছুটে আসছে কুরাইশদের সৈন্যবাহিনী। আল্লাহ তায়ালা ওয়াদা করেছেন এর মধ্যে একটা তোমরা লাভ করবে। এখন তোমরাই বলো, কোনটার সাথে তোমরা মোকাবেলায় যেতে চাও?’
জবাবে বিপুল সংখ্যক সাহাবী বাণিজ্য কাফেলার ওপর হামলা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তাদের এ ইচ্চায় যথেষ্ট বাস্তবতা ছিল। কারণঃ
১.মুসলমানরা ছিল সহায় সম্বলহীন, দুর্বল এবং সংখ্যায় মাত্র তিনশ জনের মত।
২. যুদ্ধ করার মত কোন অস্ত্রপাতি এবং বাহন তাদের হাতে নেই। ঘোড়া মাত্র দু’তিনটি, উট সত্তরটি, ষাটটি বর্ম, ঢাল তলোয়ারের অবস্থাও তথৈবচ।
৩. যুদ্ধ শুরু হলে মদিনায় ইহুদীরা যে কোন ছুতায় কুরাইশদের সহযোগিতায় চলে যেতে পারে। কারণ, মদিয়ায় মুসলমানদের এ নব উত্থানকে তারাও খুব একটা ভাল চোখে দেখছে না।
৪. অপরদিকে কুরাইশ বাহিনীতে আছে আরবের নামকরা বীরেরা। মক্কার ঝানু ঝানু নেতা ও সমসবিশারবদ শামিল হয়েছে তাতে।
৫. মাত্র শ’তিনেক মুসলমানের মোকাবিলায় ওখানে সমবেত হয়েছে সহস্র যোদ্ধা। তারা প্রত্যেকেই তেজী, বাহন ও উৎকৃষ্ট অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত।
স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধি দিয়ে বিচার করলে বলতে হয়, এ অবস্তায় কুরাইশ বাহিনীর মোকাবিলায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা আর আত্মহত্যার সিদ্ধান্তের মধ্যে কোন পার্থক্য করার উপায় নেই। কোন বিবেকবান সুস্থ মানুষই এধরনের আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে না।
অন্যদিকে রয়েছে বাণিজ্য কাফেলা। মক্কার প্রায় সকল ব্যবসায়ীর মালামাল ছিল এ বাণিজ্য বহরে। ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায়, পঞ্চাশ হাজার আশরাফীর পণ্যদ্রব্যে বোঝাই ছিল এ বিশাল কাফেলা। অথচ কাফেলার সাথে রক্ষী ছিল মাত্র ত্রিশ-চল্লিশজন। এ ধরনের একটা কাফেলা কব্জা করা মোটেই কঠিন কিছু ছিল না।
আর এ কাফেলা কব্জা করতে পারলে নিঃস্ব মুহাজিরদের অভাব ঘুচানো যাবে, আনসারকের দারিদ্র দূর করা সম্ভব হবে।
দারিদ্রের বদলে এ পরিমাণ অর্থ পেলে মদিনার প্রতিটি মুসলমান আরবের শ্রেষ্ঠ ধনীতে পরিণত হয়ে যাবে। শিশু ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনায় অর্থের কোন অভাব থাকবে না, উন্নয়নের গতিধারা ত্বরান্বিত করা যাবে। দ্বীনের তাবলীগ ও মানুষকে আকৃষ্ট করার কাজে এ অর্থ প্রভূত কাজে লাগবে।
সবচেয়ে বড় কথা, যে অস্ত্র আর বাহনের অভাবে আজ যুদ্ধের ময়দানে পা বাড়াতে পারছে না মুজাহিদরা, সে অস্ত্র আর যুদ্ধের বাহন ক্রয়ের পথে আর কোন বাধা থাকবে না।
তাই বাণিজ্য কাফেলা মোকাবিলা করার সাহাবীদের এ চিন্তাকে সকলেই সঠিক ও নির্ভুল মনে করবে এতে অবাক হবার কি আছে?
কিন্তু মহানবী (সা) চিন্তা করছিলেন অন্য রকম। তিনি চাচ্ছিলেন, বাণিজ্য কাফেলা নয়, মক্কা থেকে ধেয়ে আসা সামরিক বাহিনীটির মোকাবিলা করতে। এই কারণে প্রশ্নটি তিনি আবার করলেন। সাহাবীরা বুঝলেন তাঁদের দেওয়া এ প্রস্তাবের সাথে রাসূল (সা) পুরোপুরি একমত হতে পারছেন না।
মুহাজিরদের মধ্য থেকে তখন মিকদাদ ইবনে আমর (রা) দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার রব আপনাকে যেদিকে যেতে আদেশ করছেন আপনি আমাদের সেদিকেই নিয়ে চলুন। আপনি যেদিকেই যান আমরা আপনার সাথে আছি। বনি ইসরাইলের মত আমরা বলবো না, যেমন তারা মুসা (আ) কে বলেছিলঃ ‘তুমি আর তোমার খোদা গিয়ে লড়াই কর, আমরা এখানেই রইলাম’।
(আমা কথা দিচ্ছি) ততক্ষণ পর্যণ্ত আমরা আপনার সাথে প্রাণপণ লড়ে যাবো, যতক্ষণ আমাদের একটি চোখও দেখতে পাবে’।
এবার আনসারদের দিকে তাকিয়ে মহানবী (সা) প্রশ্নটি আবার করলেন। সাহাবীরা বুঝলেন, এবার তিনি আনসারদের মতামত জানতে চাচ্ছেন।
তখন আনসার সায়াদ ইবনে মুয়াজ (রা) উঠে দাঁড়ারেন এবং বললেন, ‘আমরা আপনার প্রতি ঈমান এনেছি, আপনাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছি, আপনি যা নিয়ে এসেছেন তাই চিরন্তন সত্য। আপনার কতা শোনা ও তা মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতিও আমরা আপনাকে দিয়েছি।
অতএব হে আল্লাহর রাসূল (সা), আপনার যা ইচ্ছা আপনি তাই করুন। যে খোদা আপনাকে মহাত্য সহ পাঠিয়েছেন তাঁর শপথ, আপনি যদি আমাদের নিয়ে সাগরে গিয়ে পৌঁছেন এবং তাতে ঝাপিয়ে পড়েন তবে আমাদের একজনও পিছনে পড়ে থাকবেনা।
আপনি যদি কাল আমাদের নিয়ে দুশমনের মোকাবেলায় যান তবে তা আমাদের জন্য মোটেই দুঃসহ হবে না। যুদ্ধে আমরা দৃঢ় ও অটল থাকবো। লড়াইয়ের ময়দানে অকাতরে বিলিয়ে দেবো আমাদের প্রাণ।
অসম্ভব নয় যে, আল্লাহ আমাদের দ্বারাআপনাকে এমন কিচু দেখাবেন, যা দেখে আপনার চোখ খুশিতে শীতল হয়ে যাবে। কাজেই আল্লাহর বরকতের ওপর ভরসা করে আমাদের নিয়ে রওনা হোন’।
মুহাজির ও আনসারকের পক্ষ থেকে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ কোন সহজসাধ্য কাজ ছিল না। যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে কখনো এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব ছিল না। মুসলমানরা যখন ঈমানের বলে বলীয়ান হয় তখনই কেবল এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব। আর মুসলমানরা যখন এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখনই কেবল আল্লাহর সাহায্যের আশা করা যায়।
এসব বক্তৃতা-ভাষনের পর ঠিক হলো যে, বাণিজ্য কাফেলার পরিবর্তে শত্রু-সেনা বাহিনীরই মোকাবেলা করা হবে। এ সিদ্ধান্তের পর মুসলমানরা মক্কার দিকে রওনা হলো এবং বদর প্রান্তরে দুই বাহিনী মুখোমুখি হলো। ইতিহাসে এ যুদ্ধ বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধে মুষ্টিমেয় মুসলমানের হাতে বিশাল কুরাইশ বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটে। তাদের বাঘা বাঘা নেতাদের অধিকাংশই নিহত হয় এবং সত্তরজনের মত বন্দী হয়।
এ ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, তুলনামূলকভাবে সহজ পথটি ধরে চলতে চায় মানুষ, কিন্তু রাসূলের সুন্নাহ হচ্ছে, বিপদ থেকে পালিয়ে বেড়িয়ে লাভ নেই, বরং বিপদ যত কঠিন আর দুরূহ হবে ততই তাড়াতাড়ি তার মোকাবিলায় এগিয়ে যেতে হবে।
এটি শুধু রাসূলের সুন্নাহ নয়, আল্লাহও চান তাঁর প্রিয় বান্দারা যেন সহজ পথের পরিবর্তে ঝুকিপূর্ণ পথেই অগ্রসর হয়। সুরা আনফালে আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘স্বরণ করো সেই সময়ের কথা, যখন আল্লাহ তোমাদের কাছে ওয়াদা করেছিলেন যে, দু’টি দলের মধ্যে একটি তোমরা পাবে।
তোমরা চাচ্ছিলে দুর্বল দলটি তোমাদের হস্তগত হোক, কিন্তু আল্লাহ চাইলেন তাঁর বাণী দ্বারা সত্যকে সত্য রূপে প্রতিভাত করতে, কাফেরদের শিকড় কেটে দিতে ও বাতিলকে বাতিল বলে প্রমাণ করতে –পাপীদের পক্ষে তা যতই দুঃসহ হোক না কেন’।
আজে আমরা যে সমস্যায় পড়েছি সেখানেও আমাদের জন্য দু’টো পথ খোলা রয়েছে। ইচ্ছে করলে হেকমতের কতা বলে আমরা চুপ করে যেতে পারি।
তাতে এ আটজন মুজাহিদের জীবনই কেবল রক্ষা পাবে তা নয়, অভিযান পরিচালনা করলে এ এলাকার মুসলমানদের ওপর যে বিপদ নেমে আসার সম্ভাবনা আছে তার থেকেও তারা রেহাই পাবে।
আবার আমরা ইচ্ছে করলে চূড়ান্ত আগাত হেনে মেয়েদের উদ্ধার করার একটা প্রচেষ্টাও চালাতে পারি। ভাল করে ভেবে দেখুন কোন পথে আপনারা এগুবেন?’
দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে থামলেন ইমাম সাহেব।
ওসমান বললো, ‘আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের দেখানো পথেই আমরা এগুবো। কোন রকম ঝুঁকিরই আমরা পরোয়া করি না। যদি বলেন, এ আত্মহত্যার ফয়সালা তবু আমরা পিছবা হবো না।
সালাহুদ্দীন আইউবীর কাছ থেকেও আমরা এটাই শিখেছি যে, দুনিয়াতে ভীরু আর কাপুরুষের কোন জায়গা নেই। বরং যারা প্রতিদিন এমনি করে একবার আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে পারে পৃথিবীতে বেঁচে থাকে শুধু তারাই’।
বারজেস বললেন, ‘সে ক্ষেত্রে আমি বলবো, একটিমাত্র স্থানে আগুন লাগলেই কেবল মেয়েদেরকে উদ্ধারের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে’।
‘তাড়াতাড়ি বলুন!’
অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে ওসমান, ‘কোথায় আগুন লাগাতে হবে? বলেন তো সমগ্র শহরে আগুণ লাগিয়ে দেবো’।
বারজেস বললেন, ‘সামরিক ঘোড়া কোথায় বাঁধা থাকে তোমরা নিশ্চয়ই দেখেছো। একই স্থানে রয়েছে ছয়শ’ ঘোড়া। বাকিগুলো বিভিন্ন স্থানে। এর পাশেই রয়েছে সমপরিমাণ উট।
আরেকটু এগিয়ে গেলেই দেখবে শুকনো ঘাস এবং খড়ের স্তুপ রয়েছে। তারও পরে সৈন্যদের তাঁবু। ওখানে ঘোড়া ছাড়াও রয়েছে যুদ্ধের সরঞ্জাম।
শুকনো ঘাস এবং খড়ের স্তূপ আগুণ লাগার সাথে সাথেই সেগুলো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে।
তবে ওতে আগুন লাগানো সোজা ব্যাপার নয়। পুরো এলাকা পাহারা দিচ্ছে সশস্ত্র সেন্ট্রি।
রাতে ও পথে কেউ যেতে পারে না। তবে তোমরা যদি ঘাসের স্তুপে আগুণ দিতে পারো আমি হলপ করে বলতে পারি, পৃথিবী ভুলে সম্রাটগণ ওখানে ছুটে আসবেন। ঘাস, যুদ্ধের সামান এবং কাপড়ের আগুন আকাশ পর্যন্ত উঠবে। আতংকিত হয়ে পড়বে শহরবাসী।
আগুন লাগানোর সাথে সাথে ঘোড়ার রশি কেটে দিতে পারলে মহা প্রলয় ঘটিয়ে দেবে ঘোড়াগুলো।
এখন কথা হলো, ওখানে কে যাবে আগুন লাগাতে, কে ঘোড়ার রশি কাটবে, ওখানে যাবেই বা কি করে?;
‘মনে করুন আগুন লাগান হলো’, একজন যুবকের প্রশ্ন, ‘সম্রাটগণ কক্ষ খালি করে ওখানে ছুটে গেলেন। তখন আমাদের করণীয় কি?’
‘আমি তোমাদের সাথে থাকবো। আমাকে ছাড়া তোমরা ওখানে যেতে পারবে না। আমারা যে দু’জন লোক ওখানে আছে ওদের কাছ থেকে জেনে নিতে পারবো মেয়ে দু’জন কোথায় আছে’।
তিনি আরো বললেন, ‘কিন্তু আমাদের চিন্তা করতে হবে মেয়েদেরকে এনে লুকাবে কোথায়? তা ছাড়া, এ অভিযান সফল হলে ক্রাকের মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাবে। খ্রিষ্টানরা নিশ্চিত ধরে নেবে মুসলমানরা ছাড়া আর কেউ এ কাজ করেনি। সে অবস্থায় আমাদের করণীয় কি তাও আমাদের ভেবে দেখা দরকার’।
‘এখন মুসলমানরা কথ শাস্তিতে আছে!’
আক্ষেপ মেশানো কণ্ঠে বললেন ইমাম সাহেব। ‘আমার কথা হচ্ছে, এ কাজ আমরা করবো। ওদের বুঝিয়ে দিতে চাই মুসলমান অসহায় হলেও ওদের গোলাম নয়। ওদের আঘাত আমাদের কলিজায় বিদ্ধ হয়েছে’।