» » ভয়াল রজনী

বর্ণাকার

পাগলের কথা শহরের লোকের মুখে মুখে। পাগলের মুখে মুসলমানদের ধবংসের ভবিষ্যত বানী শুনে সবাই খুশি। তাকে খুজছে সবাই। সরকারীভাবেও তাকে খোজা হচ্ছে। কিন্তু কোথাও নেই সে।

সরকার মুসলমানদের মানসিকভাবে দুর্বল করতে পাগলটাকে ব্যবহার করতে চাইছিলো। তাই সরকার তাকে ধরার জন্য গোয়েন্দা লাগালো।

শহরের কোথাও তাকে না পেয়ে তাকে ধরার জন্য শেষ পর্যন্ত শহরের বাইরেও ঘোড়সওয়ার পাঠানো হল। দশ-বার দিন খোজাখুজির পরও লোকটাকে কোথাও পাওয়া গেল না। যেন বাতাসের সাথে মিলিয়ে গেছে।

আজ পনের দিন ধরে ওসমান আল নূর এবং নূরের বান্ধবীদের অস্ত্রের প্রশিক্ষন দিচ্ছে। আল নূর সুলতান আইয়ুবীর বানী শুনিয়ে তার বান্ধবীদের অনেককেই ইতিমধ্যে দলে টেনে এনেছে। তাদেরকে তীর ও তরবারী চালনা শিখাতে ওসমানের যথেষ্ট কষ্ট হল।

মুসলমানদের মধ্যে অনেকেও অস্ত্রের কারিগর ছিল। ওসমান এবং তার বন্ধুরা অস্ত্র তৈরীর এ সব কারিগরদের সাথে গোপনে যোজাযোগ করলো। এসব কারিগররা সবাই খৃস্ট্রানদের চাকরী করতো। তবে এই সব কারিগরদের নিজেদের জন্য কোন অস্ত্র তৈরীর অনুমতি ছিল না।

প্রচলিত আইনে মুসলমানদের কন্য অস্ত্র বহন এবং বাড়িতে অস্ত্র রাখা নিষিদ্ধ ছিল। ওসমান ও তার বন্ধুরা এসব কারিগরদের গোপনে তীর, ধনুক এবং বর্শা তৈরী করে দেয়ার অনুরোধ করল।

ওসমান কারিগরদেরর বললো, ‘ এসব অস্ত্র ছাড়া নিজেদের জাতিকে বাচিয়ে রাখার আর কোন পথ নেই। জাতির এ দুর্দিনে আমরা আপনাদের সক্রিয় সহযোগিতা চাই। অবশ্যই আমরা এর বিনিময়ে আপনাদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেয়ার চেষ্টা করব’।

কারিগরদের মনে নতুন করা আশার সঞ্চার হলো, তাদের অনেকেই বিনা পারিশ্রমে সানন্দে তাদেরকে অস্ত্র তৈরি করে দিতে রাজি হয়ে গেল। যদিও তারা জানতো, এ কাজ খুবই ঝুকিপুর্ন। ধরা পড়লে নিজেদের জীবন বাচানোই দায় হয়ে পড়বে।

যুবকদের কাছ থেকে অর্ডার পেয়ে এসব কারিগররা নিজেদের বাড়িতে গোপনে অস্ত্র তৈরী করতে লেগে গেল।

সময়টা ছিল মুসলমানদের জন্য খুবই খারাপ। কারো উপর সরকারের সন্দেহ হলে তার বিপদের অন্ত থাকতো না। সন্দেহভাজনদের গ্রেফতার করে তাদেরকে ব্যপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হত। প্রশ্ন করা হত মুসলমানদের ঘরে কি হচ্ছে। কোথায় কোথায় গোয়েন্দা রয়েছে ইত্যাদি। এরপর শুরু হত দৈহিক নির্যাতন।

কারিগররা এ জন্য সীমাতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করছিল। এসব কারিগররা বলতে গেলে গরীব। কিন্তু শুধু অর্থের জন্য তারা এমন বিপদজনক কাজ করতো কিনা সন্দেহ। কিন্তু যখন তাদের সামনে ইসলাম ও মুসলমানদের অস্তিত্বের প্রশ্ন তুলে ধরা হলো তখন তারা একে নিজেদের ইমানী দায়িত্ব হিসেবে গ্রহন করলো।

ধরা পড়লে নির্ঘাত মৃত্যু জেনেও তাই তারা নানা বিপদ মাথায় নিয়ে গোপনে মুসলমানদের জন্য অস্ত্র বানানোর কাজ কোন রকমে চালিয়ে যাচ্ছিল।

মুসলমান কারিগরদের বানানো এসব অস্ত্র রাতের মধ্যেই ওসমানরা বিভিন্ন বাড়িতে লুকিয়ে ফেলতো। দিনে বেলা মেয়েরা বোরকার নিচে খঞ্জর বহন করে পৌছে দিত নিজ গন্তব্যে। কিন্তু অস্ত্র তৈরী এবং লুকানোর এ কাজ চলছিল অত্যন্ত ধীরে।

এভাবে ওসমানদের তৎপরতা  এবং গোয়েন্দাদের নিরলদ প্রচেষ্টার গলে গ্রাম পর্যায়ে পৌছে গেল সুলতানের বানী। ওখানেও প্রস্তুতি শুরু হল।

সুলতানকে জানানো হল, মুসলিম গোয়েন্দা পাগলের ছদ্মদেশে ক্রাকের যুবকদের কাছে সুলতানের বানী পৌছে দিয়েছে।

সুলতান খুশি হলেন। বললেন, ;যে জাতির যুবকেরা জেগে ওঠে তাদের কেউ পরাজিত করতে পারে না’।

‘এ সাফল্য আমার সাহস বাড়িয়ে দিয়েছে মাননীয় সুলতান’। বললেন, সহকারী গোয়েন্দা প্রধান জাহেদীদ। ‘আপনার অনুমতি পেলে অধিকৃত অঞ্চলের যুবকদের উত্তেজিত করে ক্রাকে আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারি’।

‘না’। সুলতান বললেন, ‘দেখা যাবে এ আগুনে ওরা নিজেরাই পুড়ে মরছে। আমি চাই না যুব সমাজ আগুনে পুড়ে মরুক। তার পরিবর্তে ওদের হৃদয়ে আমি ইমানের আগুন জ্বালাতে চাই।

তিনি বললেন, ‘ যুবকদের উত্তেজিত করা সহজ। আবেগপুর্ন কথায় ওরা সহজের উত্তেজিত হয়ে পড়ে।এটা পাদের বয়সের ধর্ম। আবার কেও ওদের হাতে কয়েকটা টাকা তুলে দিলে দেখবে ওরা তার হাতের পুতুল হয়ে নাচবে। চেষ্টা করলে ওদের নিজেদের ভেতর দ্বন্দ্বো সৃষ্টি করতে পারবে শত্রুরা।

তবে ভেব না এসব যুবক মুর্খ বা বুদ্ধিহীন। বরং ওদের বয়সটাই এমন যে সামান্যতেই ওদের রক্ত গরম হয়ে উঠে।

এরা সাধারনত চঞ্চল, উত্তসাহী, কর্মতৎপর। শত্রুরা জানে, যুবকদের অস্থির মনকে যেদিকে ঘুরানো যায় ওরা সেদিকেই ছুটে চলে। এরা যেমন ভাল কাজ করতে পারে তেমনি খারাপ কাজও করতে পারে। শত্রুরা এই সুযোগটাই গ্রহন করছে।

ওরা যুবকদের ইন্দ্রীয়পরায়ন করে তুলছে। বিলাসিতা ও পাশবিক সত্তাকে উস্কে দিচ্ছে ওরা। ওরা জানে, কাউকে একবার মানসিক লালসার গহীনে ডুবিয়ে দিতে পারলে তাকে আমরা আর শত্রুর বিরুদ্ধে জেহাদে ব্যবহার করতে পারবো না।

তুমি ওদেরকে উত্তেজিত নয় বরং শান্ত রাখার চেষ্টা করবে। মহানবী (স) এর কথাকি মনে নেই? তিনি বলেছেন, নিজেদের জানো এবং শত্রুকে চিনে নাও।

তুমি ওদের বর্তমান চিন্তাধারাকে বদলে দাও। তাদের মধ্যে জাতীয় অনুভুতি জাফিয়ে তোল। জাতির প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করো। যুব সমাজ জাতির সবচে মুল্যবান সম্পদ। উত্তেজিত করে এ সম্পদকে নিঃশেষ করো না।

ওদের দ্বারা শত্রু নিধন কর- তবে তার আগে তাদের মধ্যে শত্রু মিত্র পার্থক্য করার যোগ্যতা সৃষ্টি কর’।

সালাউদ্দীন আইয়ুবী জাহেদীনকে আরো বললেন, ‘শোন জাহেদীন, তোমাকে একটা কথা বলা জরুরী মনে করছি। কোন মুসলমান আমাকে গালি দিলেই সে ইসলামের শত্রু হয়ে যায় না, গাদ্দারও হয়ে যায় না। বড়জোর সে আমার ব্যক্তিগত দুশমন হতে পারে।

তাকে শায়েস্তা করার দ্বায়িত্ব তোমার না। তাকে শাস্তি দেয়ার জন্য দেশে আইন রয়েছে, আদালত রয়েছে।

কিন্তু আইনের আশ্রয় নিলেও আমি তাকে শাস্তি দেয়ার বিরোধী। কারন আইন- দেশ, জাতি এবং ইসলামকে রক্ষা করার জন্য তৈরী করা হয়েছে। নেতার ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার জন্য নয়।

যে দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, যে শত্রুর হাত শক্তিশালী করে, গাদ্দার তো সে। নেতারা আসনে বসে কেউ অপরাধ করলে সেও গাদ্দারীর শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।

তুমি সহকারী গোয়েন্দা প্রধান। কেবল জনগন নয়, নেতাদের ব্যাপারেও তোমার চোখ কান খোলা রাখতে হবে। এমনকি আমার গতিবিধিও তোমার দায়িত্বের বাইরে নয়।

শয়তানের সাথে আমার এমন কোন আপোষ-রফা হয়নি যে, সে আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে না। আর আমি ফেরেস্তাও নই যে মানসিক দুর্বলতা থেকে আমি মুক্ত। তুমি আমার ব্যক্তিগত কর্মচারীও নও, তোমার দায়িত্ব জাতির স্বার্থ রক্ষা করা। এ স্বার্থ যার দ্বারাই বিঘ্নিত হবে তাকে পাকড়াও করার দায়িত্ব তোমার’।

জাহেদীন বললো, ‘আপনার কথা আমার মনে থাকবে সুলতান। এবার বলুন, ওখানে যে যুবক তৈরী হয়েছে ওদের আমরা কিভাবে ব্যবহার করবো’?

‘ওদের উত্তেজিত করো না। ওদের ভেতর সঠিক চিন্তা করার যোগ্যতা সৃষ্টি করো। কি করতে হবে অবস্থার প্রেক্ষিতে তারা সেটা নিজেরাই ঠিক করে নেবে। আবেগ দিয়ে কোন কিছু করা যাবে না।

ওখানে আরও বেশী করে গোয়েন্দা পাঠাও। দুশমন আমাদের নয়, আমাদের যুবকদের কর্মধারা নষ্ট করে দিতে চাইছে। ওরা জানে কোন জাতিকে পরাভুত করতে চাইলে সে জাতির যুব সমাজের মন-মানসিকতায় বিলাসিতা ঢুকিয়ে দিলে ওরা তখন যুদ্ধ আর কর্মের ময়দান থেকে নিজেরাই সরে দাঁড়াবে।

আরাম আয়েশ আর বিলাশদ্রব্য তাদেরকে জনগন থেকে দূরে সরিয়ে নেবে। স্বার্থ চিন্তা তাদের সাধারন মানুষ থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে। তারা তখন শুধু নিজেরা নয়, নিজেদের মেয়েগুলোকেও অন্যের হাতে তুলে দেবে প্রগতি আর সভ্যতার দোহাই দিয়ে।

তারা তখন কতটা খারাপ হতে পারে সে তুমি ভাবতেও পারবে না। তুমি যাকে ভাল মানুষ ও সম্মানিত মানুষ ব্যক্তি বলে সমীহ করবে, সে তাদের ততটুকু ভাল যে, সে মানুষকে ভাল কাজের উপদেশ দেবে। তার নিজের স্বার্থ ও আনন্দের ব্যাঘাত সৃষ্টি না হলে, সে মনে মনে পৃথিবীর সব মানুষ ভাল হয়ে যাক এটাও চাইতে পারে। কিন্তু নিজের স্বার্থে আঘাত লাহলে তাও করবে কিনা সন্দেহ। নিজের চোখের সামনে ওরা তখন নিজের যুবতী বোনদের উলঙ্গ নাচিয়ে গর্ভবোধ করবে’।

বলতে বলতে হঠাৎ সুলতান বলে উঠলেন, ‘ক্রাকের যেসব যুবক অস্ত্র তৈরী করছে তাদের কাছে কোমায় ব্যবহৃত তরল জ্বালানী পৌছে দিয়ে তার ব্যবহার শিখাতে বলেছিলাম, তা কি করা হয়েছে’?

‘জী সুলতান, এ তরল জ্বালানি তৈরীর পদ্ধতি ওদের শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। খবর পেয়েছি, ওখানকার মুসলমানগন এরই মধ্যে তা তৈরী করা শুরুও করে দিয়েছে’।

                                               

ক্র্যাকে হঠাৎ এমন একটি ঘটনা ঘটলো যাতে সেখানকার যুবকরা উত্ততেজিত হয়ে পড়লো। অবস্থা এমন নাজুক পর্যায়ে গিয়েছিইল যে, যুব সমাজকে বাধ্য হয়ে এক কটিন সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে হল।

খৃস্ট্রানরা তাদের অধিকৃত এলাকায় যে সব মুসলিম কাফেলা যাতায়াত করতো সে সব কাফেলা লুট করা শুরু করে দিয়েছিল। মুসলিম ব্যবসায়ী ও অন্যান্য ভ্রমনকারীদের নিয়ে তৈরি হত এ সব কাফেলা। সংখায় দেড় থেকে দুইশ হলেই রওয়ানা করে দিত এই সব কাফেলা। কাফেলায় থাকতো উট, ঘোড়া এবং ব্যবসার মালপত্র। দুই চারটে পরিবারও থাকতো কাফেলার সাথে। খৃস্টানদের নির্যাতনের ভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোজে মুসলমান প্রধান অঞ্চলে হিজরতের জন্যই এরা কাফেলায় শামিল হতো।

প্রতিটা কাফেলায় সশস্ত্র পাহারার ব্যবস্থা থাকত। ফলে, সাধারন ডাকাত দল এসে কাফেলা লুট করার সাহস পেত না। খ্রিইস্টানরা সেনাবাহিনীকে এসব কাফেলা লুন্ঠনের দায়িত্ব দিল। ফলে মুসলমানদের কোন কাফেলার কোন সন্ধান পেলেই খ্রিইস্টান সৈন্যরা বেদুইন ছদ্মবেশে লুটতরাজ করার জন্য কাফেলার উদ্দেশ্যে ছুটে যেত।

যেসব খ্রিষ্টান সম্রাটগণ ইতিহাসের পাতায় আজো হিরো সেজে বসে আছেন, এসব লুণ্ঠন ছিল তাদেরই পরিকল্পনার ফসল। লুটের মাল থেকে তারাও নিয়মিত ভাগ পেতো।

কিছু কিছু মুসলমান আমীর ওমরাও এসব অপরাধের সাথে জড়িত ছিল। এরা ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম প্রদেশের শাসক। ওদের ছিল নিজস্ব সেনাবাহিনী।

লুণ্ঠিত কাফেলার কেউ এসে এ সব মুসলিম শাসকের কাছে অভিযোগ করলে তারা তা শুনেও না শোনার ভান করতো। কারণ লুণ্ঠনকারী খ্রিষ্টানদের পক্ষ থেকে ওদেরকে দেওয়া হতো মদ, নারী ও স্বর্ণমুদ্রা।

ইচ্ছে করলে এসব শাসকরা খ্রিষ্টানদের লুটতরাজ বন্ধ করতে পারতো। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নিতে মোটেই আগ্রহ প্রকাশ করল না।

শাসকদের মনোভাব জানতো বলেই কখনও কখনও এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম রাজ্যের ভেতরে এসেও খ্রিষ্টান সন্যরা মুসলিম কাফেলার ওপর হামলা করতে দ্বিধা বোধ করতো না।

মুসলিম শাসকদের এ দুর্বলতার সুযোগে খ্রিষ্টান সম্রাটগণ এবার মুসলিম রাজ্য সমূহের সীমান্ত হজম করতে শুরু করলো। কোন কোন মুসলিম শাসক এ অবস্থায় খ্রিষ্টানদের আনুগত্য স্বীকার করে তাদেরকে কর দেওয়া শুরু করলো। এভাবেই ক্রমে সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হয়ে আসতে লাগলো মুসলিম রাজ্যের সীমানা।

নূরুদ্দীন জঙ্গী এবং সালাহুদ্দীন আইউবী এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো খ্রিষ্টানদের হাতে তুলে দেয়ার পরিবর্তে নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন। তাদের কাছে এসব মুসলিম শাসকরা ছিল খ্রিষ্টানদের চাইতেও বিপজ্জনক।

সুলতান সালাহুদ্দীনের কাছে লেখা এক চিঠিতে নূরুদ্দীন জঙ্গী লিখলেন, ‘বিলাসিতা এব ভোগের জন্য এসব মুসলিম শাসকবর্গ ইসলামী রাজ্যগুলো খ্রিষ্টানদের কাছে বন্ধক দিয়ে রেখেছে।

খ্রীষ্টনরা ওদেরকে ধন-সম্পদ এবং অপহৃত মুসলিম যুবতী উপহার দিয়ে অন্ধ করে ফেলেছে। এদের হাতেই এখন বেশী করে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আল্লাহর দেওয়া জীবন বিধান পবিত্র ইসলাম। এরা কাফের বেঈমানদের চাইতেও ইসলামের জন্য বেশী বিপজ্জনক এবং অপবিত্র।

ক্ষমতার নেশায় বুঁদ হয়ে আছে এরা। এ সুযোগে খ্রিষ্টান শক্তি ইসলামের মূল উৎপাটনের তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে।

খ্রিষ্টানদেরকে পরাজিত করার পূর্বে এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো মুসলিম বিশ্বের সাথে একীভূত করা প্রয়োজন। কারণ, এদের হাতে মুসলমানদের জীবন ও সহায় সম্পদ খ্রিষ্টানদের মতই সমান নিরাপত্তাহীন। এ ছাড়া দ্বীন ও ঈমানকে টিকিয়ে রাখার অন্য কোন পথ নেই’।

এ কারণেই খ্রিষ্টানদের দ্বারা লুণ্ঠিত হওয়ার পরও দেখা যেতো, খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এবং খ্রিষ্টান প্রভাবিত কাফেলা নিরাপদ এলাকাগুলো থেকে বিরাট বিরাট মুসলিম কাফেলা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে নিয়মিত মরুভূমির বিশাল পথ অতিক্রম করে চলেছে।

এমনি এক কাফেলা ক্রাকের কয়েক মাইল দূর দিয়ে যাচ্ছিল। যাত্রীদের সাথে ছিল অনেক ঘোড়া এবং ব্যবসায়িক মালপত্র। ছিল কয়েকটি পরিবার। শিশু-কিশোর ছাড়াও কাফেলার ছিল দু’জন যুবতী। যুবতীরা দুই আপন বোন।

পথ চলছে কাফেলা। খ্রিষ্টানরা খবর পেয়ে সৈন্যদের একটা দল পাঠিয়ে দিল। দলটি দিনে দুপুরেই কাফেলায় আক্রমণ করে বসল।

কাফেলার যাত্রীরা প্রবল বিক্রমে প্রতিরোধ করল এ হামলা। আক্রমণের প্রথম ধাক্কা কেটে গেল দেখা গেল উভয় পক্ষেই বেশ হতাহত হয়েছে। সৈন্যরা এবার কাফেলাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করল। কাফেলাও সংহত হয়ে আস্তে আস্তে পেছনে সরে যেতে লাগল।

নারী ও শিশুদের নিয়ে কয়েকজন পেছনের পাহাড়ের দিকে সরে গেল। বাকীরা লড়ে যেতে লাগল প্রাণপণে। কিন্তু সৈন্যরা ছিল সংখ্যায় বেশী এবং নিয়মিত যোদ্ধা। ফলে এসব সৈন্যদের সামনে বেশীক্ষণ দাঁড়াতে পারল না ওরা। মরুর বালুকা রাশি লাল হয়ে যাত্রীদের তাজা রক্তে।

নারী ও শিশুদের নিয়ে যারা পাহাড়ের পাদদেশে জমা হয়েছিল ওদের দিকে এগিয়ে গেল সৈন্যরা। ওরা রা ততোক্ষণে পাহাড়ের ওপর গিয়ে বিভিন্ন পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছে। ঘাতকরা তীরের আওতায় আসতেই ওরা তীরের আঘাতে পড়ে গেল ঘোড়া থেকে।

থমকে দাঁড়িয়ে গেল  সৈন্যরা। সামান্য পেছনে সরে চলে এল নিরাপদ দূরত্বে। সৈন্যদের একদল চলে গেল পাহাড়ের উল্টো দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা পিছন থেকে হামলা করে বসল লুকিয়ে পড়া যাত্রীদের ওপর।

সাথে সাথেই সামনে থেকে ছুটে এলো সৈন্যদের মূল বাহিনী। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ইত ঘটলো লড়াইয়ের। ঘাতকদের তরবারী থেকে নারী ও শিশুরা পর্যন্ত রক্ষা পেল না। কাফেলার দু শ জন যাত্রীর অধিকাংশই নিহত হলো।

লড়াই শেষে দেখা গেল পনরজন আহত যুবক এবং দু’জন যুবতী ছাড়া কেউ বেঁচে নেই।

এদের বন্দী করে মাল সামান নিয়ে ডাকাত দল ক্রাকের পথ ধরল। ডাকাত দল যখন ক্রাকে প্রবেশ করছিল সামনে ছিল বন্দীরা। দুটো ঘোড়ার পিটে বসে ছিল যুবতী দু’জন।

ক্রাকের জনসাধারণ তাকিয়ে দেখল কাফেলাকে। যুবতী দুজনের পোষাক আশাক মুসলমানদের মত। মেয়ে দুটোর পেছনে মুখোশ পরা খ্রীস্টান সৈন্যদের সশস্ত্র পাহারা। তাদের পেছনে লুণ্ঠিত মাল সামানাসহ উট এবং ঘোড়ার বিশাল সারি।

মেয়ে দু’জন কাঁদছিল। ক্রাকের লোকজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো তামাশা দেখার জন্য। মুসলিম কাফেলা লুণ্ঠিত হয়েছে এ জন্য ওরা খুশি। হাততালি দিয়ে সবাই আনন্দ প্রকাশ করছে।

বন্দীদের মধ্যে এক যুবকের নাম ছিল আশফাক। মেয়ে দু’জন ওরই বোন। কপালে এবং কাঁধে আঘাতের চিহ্ন যুবকের। এখনও রক্ত ঝরছে আহত স্থান থেকে।

রাস্তার দুপাশে দর্শকদের দেখ আশফাক চিৎকার দিয়ে বললো, ‘ডুবে মর তোমরা। এই অসহায় মেয়ে দু’জনকে দেখো। এরাও মানুষ। তোমরা মানুষ হলে ওরা একা আমার নয় তোমাদেরও বোন। যদিও ওরা মুসলমান’।

একজন খ্রিষ্টান সৈন্য পেছন থেকে তার ঘাড়ে ঘুসি মারল। উপুড় হয়ে পড়ে গেল আশফাক।

অন্য একজন বন্দী তাকে আবার তুলে নিল। আবার চিৎকার দিয়ে বললো ছেলেটা, ‘ক্রাকের মুসলমানেরা, এ দু’জন তোমাদের মেয়ে। ওরা এখন খ্রিষ্টান ডাকাতদের হাতে বন্দী। একটু পর হয়ত তাদের সতীত্ব লুণ্ঠন করা হবে। তাদের আর্ত চিৎকারে বিষাক্ত হয়ে যাবে ক্রাকের বাতাস। সে বিষাক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে তোমরা কতক্ষণ বাঁচতে পারবে আমার জানা নেই’।

দু’জন মুখোশধারী ডাকাত এগিয়ে এসে তাকে পিটাতে লাগল। তাই দেখে মেয়েরা উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে বলতে লাগল, ‘আল্লাহর দোহাই লাগে, আমাদের ভাইকে মেরো না। আমাদের সাথে যেমন ইচ্ছা ব্যবহার করো, দয়া করে ওকে ছেড়ে দাও’।

এক বোন চিৎকার দিয়ে বললো, ‘আশফাক, চুপ করো। তুমি এদের কিছুই করতে পারবে না’।

মুসলিম দর্শকরা অনেক কষ্টে এ দৃশ্য হজম করছিল। ওদের বিবেক, ওদের আত্মমর্যাদা দৃষ্টির সামনে ধূলায় গড়াচ্ছে কিন্তু ওরা কিছুই করতে পারছে না।

যুবক দর্শকদের মধ্যে ওসমানও ছিল। সঙ্গীতের দিকে তাকাল ও। সবার চোখে মুখে ক্রোধের আগুন। দ্রুত লাফাচ্ছে হৃদপিণ্ড। যেন খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে যাবে।

ওদের পেছনে পেছনে কিছু দূর এগিয়ে গেল ওসমানরা। সামনে রাস্তার পাশে একজন মুচি জুতো সেলাই করছে।

ওসমান মুচির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। জুতা খুলে বসে পড়ল তার সামনে।

মুচিও আশফাকের কথা শুনেছে এবং মেয়েদের দুর্দশা দেখেছে। কিন্তু বেচারা গরীব মুচির কিই বা করার আছে! একজন মুসলমান অনুগ্রহ করে তাকে বারান্দায় থাকতে দিয়েছে, এই তার চরম সৌভাগ্য।

তাকে কেউ কোনদিন মসজিদ, গীর্জা বা ইহুদীদের উপাসনালয়ে যেতে দেখেনি। জুতা মেরামতের দরকার হলেই লোকেরা তার দিকে তাকায়। তাকে কেউ কোনদিন কথা বলতে দেখেনি। মনে হয় সংসার বিবাগী একজন লোক খ্রিষ্টানদের সাথেও কোন সম্পর্ক নেই, মুসলমানদের ব্যাপারেও কোন আগ্রহ নেই।

বন্দীর দল চলে গেছে।

মুচি জুতা সেলাই করছে। মাথা তুলে একবারও ওসমানের দিকে তাকাচ্ছে না।

ওসমান এদিক ওদিক তাকিয়ে অনুচ্চ কণ্ঠে বললো, ‘এ দু’জন মেয়েকে আজ রাতে মুক্ত করতে হবে’।

‘জান এরা আজ রাতে কোথায় থাকবে?’ মাথা না তুলেই ফিসফিসিয়ে বললো মুচি।

‘জানি। ওরা আজ রাতে খ্রিষ্টান সম্রাটের কাছে থাকবে। কিন্তু আমি কখনও ভেতরে যাইনি। ভেতরটা দেখিওনি’।

‘আমি দেখেছি। ওখান থেকে মেয়েদের বের কের আনা সম্ভব নয়’।

‘তাহলে তুমি কোন কাজের কাজী?’

ওসমানের কন্ঠ ঝলকে উঠল আবেগ এবং ক্ষোভে।

‘আমাদের পথ দেখাও। মেয়েদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেই হলো।

মুক্ত করার সুযোগ না পেলে ওদের হত্যা করবো। তবুও বদমায়েশ রাজাদের ভোগের সামগ্রী হতে দেব না। আমাদের দুই অসহায় বোনকে’।

‘এ জন্য ক’জন যুবকের জীবন উৎসর্গ করতে পারবে?’

‘আপনি যা চাইবেন’।

‘ঠিক আছে, কাল রাতে দেখা যাবে’।

‘না আজ রাতে’। ওসমানের দৃঢ় কণ্ঠ। ‘যা করার আজ রাতেই করতে হবে’।

‘ইমামের কাছে যাও’।

‘ক’জন যাবো?’

‘আটজন। অস্ত্র হবে খঞ্জর এবং কোমর ব্যবহৃত জ্বালানী’।

ওসমান জুতা পরে চলে গেল।