রাতে ডাক্তার আবার এলেন। আকিল ঘুমিয়ে পড়েছে। জেগে আছে শারজা। বারান্দায় চলে এল দু’জন। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বললেন, ‘তোমার ভাইকে যে ওষুধ দিয়েছি সকালের পূর্বে জাগবে না। আমার সাথে বাসায় চল।’
খানিকটা সংকোচ করলেও শারজা ডাক্তারের প্রস্তাব অস্বীকার করতে পারল না। ডাক্তার সুদর্শন যুবক। এখনো বিয়ে করেননি। বাসায় একা থাকেন। শারজা যুবতি এবং সুন্দরী। মনে মনে ভাবল, আজ রাতেই হয়ত ডাক্তার নিজের মুখোশ খুলে দেবে।
বাসায় ফিরে দু’জন দু’টো চেয়ার টেনে বসল। ডাক্তারের আচরণে প্রকাশ পাচ্ছিল নিরেট আন্তরিকতা এবং স্নেহ। আশ্চর্য হল শারজা। ডাক্তার এখনও তাকে খারাপ কোন প্রস্তাব দিচ্ছে না কেন? নিজের অজ্ঞাতেই প্রশ্ন করল, ‘আমি একজন মরুচারী বেদুইন। গরীব যুবতী। এমন এক অপরাধীর বোন যে সম্রাটকে হত্যা করার জন্য আক্রমণ করেছে। আপনি কেন আমার সাথে এত সুন্দর ব্যবহার করছেন? একজন বন্দীর বোন এ স্নেহ পাওয়ার উপযুক্ত নয়।’
মৃদু হাসলেন ডাক্তার। কোন জবাব দিলেন না।
‘আমি একজন তরুণী এবং রূপসী, এই জন্যেই কি আমার জন্য এ আন্তরিকতা।’
‘তুমি রূপসী এবং যুবতী। তোমার তৃতীয় সৌন্দর্যের কথা তুমি জান না। তোমার বয়সী আমার একটা বোন ছিল। দেখতে অবিকল তোমার মত। তোমার মতই আমাদের পিতা-মাতা শৈশবে মারা গেছেন। সংসারে দু’জন ছাড়া কেউ ছিল না। বোনটাকে আমিই লালন-পালন করেছিলাম। আমার সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছিলাম তার জন্য। বেঁচে ছিলাম ওর ভালবাসা নিয়ে। একবার ওর অসুখ হল। অনেক চিকিৎসা করলাম, কিন্তু ধরে রাখতে পারিনি। নিজের হাতেই ওকে কবর দিতে হয়েছে। আমি হয়ে গেলাম নিঃসঙ্গ, একা।
যেদিন তোমাকে প্রথম দেখলাম, চমকে উঠেছিলাম। মনে হল, আমার বোনটা আবার ফিরে এসেছে। তুমি দেখতে অবিকল আমার বোনের মত। যদি তুমি তোমার রূপ-যৌবনকে ভয় পাও, আমাকে সন্দেহ কর, তবে আর কখনও তোমার কাছে আম্র স্নেহময় আবেগ প্রকাশ করব না। কথাও বলব না তোমার সাথে। ভয় নেই, পূর্বের আন্তরিকতা নিয়েই তোমার ভায়ের চিকিৎসা করব। তাকে সুস্থ করে তোলা আমার দায়িত্ব। চলো, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’
শারজাকে বন্দীর কাছে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেলেন ডাক্তার। শারজার মনে এখন কোন সন্দেহ নেই। ডাক্তার তার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না নিশ্চিত সে।’
পরদিন নিয়ম করে ডাক্তার এলেন। বন্দীকে ওষুধ দিয়ে ফিরে গেলেন। শারজার সাথে একটি কথাও বললেন না। শারজা বারান্দায় এসে ডাক্তারের সামনে দাঁড়াল।
‘আপনি কি আমার সাথে রাগ করে চলে যাচ্ছেন?’ আমার সাথে একটি কথাও বলেননি কেন?’
‘তোমার সাথে রাগ করিনি শারজা। তবে তোমাকে কোন সন্দেহে ফেলতে চাই না।’
রাতে আকিল ঘুমিয়ে পড়ল। আলতো পায়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল শারজা। কি এক আকর্ষণে ছুটে গেল ডাক্তারের কাছে। তার মনে অনেক প্রশ্ন জমা হয়ে আছে। হয়ত ডাক্তারই এর সঠিক জবাব দিতে পারবেন।
‘খলিফা কি আল্লাহর প্রেরিত দূত।’ প্রশ্ন করল ও।
‘খলিফাও একজন মানুষ। আল্লাহর প্রেরিত দূত হলেন নবী এবং রাসূলগণ। আমাদের নবী (সা.) পর্যন্ত এসে আল্লাহ্ প্রেরিত নবীর আগমন ধারা শেষ হয়ে গেছে।’
‘সালাহদ্দীন সালাহুদ্দীনও কি আল্লাহর দূত।’
‘না তিনিও আমাদের মত মানুষ। তবে উঁচু মর্যাদা সম্পন্ন মানুষ। আল্লহ এবং নবীর (সা.) বাণী মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য চেষ্টা যাচ্ছেন।
‘সুলতান যে যুদ্ধ করছেন, মানুষ মারছেন, এটা কি বৈধ?’
‘মুসলমানের দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহর বিধান পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ চেষ্টা করা। এ প্রচেষ্টায় কেউ যদি বাঁধা দেয়, তা দূর করা ফরজ। সুলতান শুধু এ ফরজ আদায় করছেন। তিনি করও ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেননি, বরং ইসলামকে ঠেকাতে চাইছেন।’
এভাবেই অনেক প্রশ্ন করল শারজা। এখন সে সন্দেহ মুক্ত। সুলতান সালাহুদ্দীন সম্পর্কে তার এতদিনের ধারণা বদলে গেছে।
‘তা হলে আমার ভাই তো মহা অন্যায় করেছেন। আপনি যেভাবে বলছেন, এভাবে তাকে বললে তিনিও এ পাপের পথে পা দিতেন না। এখন তো তাকে ক্ষমা করা হবে না।’
‘হবে। সুলতান তাকে বাঁচিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, তাকে শাস্তি দেওয়া হবে না। তার উচিৎ পাপের প্রায়শ্চিত্য করা। আমার বিশ্বাস, সুলতান তাকে কোন শাস্তি দিবেন না।’
‘আমি জীবনভর সালাহুদ্দীন এবং আপনার খেদমত করব।’ কেঁদে বলল শারজা। ‘আমার ভাই আপনাদের গোলাম হয়ে থাকবে।’
ডাক্তারের একটা হাত দুহাতে তুলে নিয়ে ও বলল, ‘আপনি আমার কাছে যে মূল্য চাইবেন, আমি দেব। আপনার বাদী হয়ে থাকব সারা জীবন। বিনিময়ে আমার ভাইকে সুস্থ করে দিন। ওকে বাঁচিয়ে তুলুন।’
‘বিনিময় নেওয়া হয় আল্লাহর কাছ থেকে।’
শারজার মাথায় হাত বুলিয়ে ডাক্তার বললেন। ‘বোনকে ভায়ের পাপের শাস্তি দেওয়া হয় না। ভায়ের স্বাস্থের মূল্য বোন থেকে উসুল করা হয় না। পাপের প্রায়শ্চিত্য পাপ দিয়ে নয়। আমাদের সবার রক্ষক আল্লাহ্। প্রতিটি মুসলমান সকল নারীর ইজ্জতের রক্ষক। তোমরা আমাদের কাছে আমানত। তোমার ভাইয়ের সুচিকিৎসা করার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর কাছে দোয়া কর আমি যেন আমানতের খেয়ানত না করি। অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারি। তোমার ভায়ের সুস্থতার জন্য দোয়া কর একজন অসুস্থ ভায়ের জন্য বোনের দোয়া আল্লাহ্ নিশ্চয়ই কবুল করবেন।’
ডাক্তার মেয়েটাকে যেন যাদু করেছেন। তার মিষ্টি ব্যবহারের ফলেই এটি সম্ভব হয়েছে। শারজা যা ভাবছিল ডাক্তার তা নন। ডাক্তারের নৈতিকতাই ওকে বেশী প্রভাবিত করেছে। নিঃসঙ্গ রাতে এমন এক সুন্দরী তরুণীকে একা পেয়েও ডাক্তার অশালীন কোন ইঙ্গিত করেননি। ডাক্তার চাইলে তাকে বাঁধা দেওয়া সম্ভব ছিল না। ভায়ের চিকিৎসার জন্য হলেও তাকে ডাক্তারের প্রস্তাবে রাজি হতে হত। কিন্তু ডাক্তারের চোখে কামনার আগুন নেই। স্নেহ ভালোবাসার এক অব্যক্ত অনুভূতি তার চেহারায় আলো হয়ে জ্বলছে। মোহিত হল শারজা। কখন যে মাঝরাত পেরিয়ে গেছে টের পেল না। ও হারিয়ে গেল ভাবনার অতলে। সম্বিত ফিরল ডাক্তারের ডাকে।
‘চল তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। তোমার ভাইকেও দেখে আসব।’
দু’জন ঘর থেকে বেরিয়ে এল। আকাশে চাঁদ উঠেনি। আবছা অন্ধকার। ওরা হাঁটছে ধীরে ধীরে। ওরা দু’বাড়ির মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলছে। সামনের ছোট্ট গলিপথ পেরোলেই আকিলকে যেখানে রাখা হয়েছে সে বাড়ি। বাড়িটাতে সব সময় সশস্ত্র সেন্ট্রির প্রহরা থাকে। দু’জনের কারো মুখে কোন কথা নেই। হাঁটছে নিঃশব্দে।
গলির মুখে এসে পড়েছে ওরা। আকস্মাত ওদেরকে পেছন থেকে জাপটে ধরল কেউ। কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলা হল চোখ-মুখ। ওরা এখন শব্দ করতে পারছে না। ডাক্তার একজন শক্তিশালী যুবক। আচমকা আটকে পড়ায় কিছুই করতে পারছেন না। আক্রমণকারীরা চারজন। ওরা দু’জনের হাত-পা বেঁধে ফেলল। এরপর দুটো দেহ কাঁধে তুলে হারিয়ে গেল অন্ধকারে।
খানিক দূরে দু’টা ঘোড়া দাঁড়িয়ে ছিল। ডাক্তারকে একটা ঘোড়ায় চপিয়ে ওদের একজন পেছনে উঠে বসল। শারজাকে উদ্দেশ্য করে একজন বলল, ‘শব্দ করোনা শারজা। তোমার কাজ হয়ে গেছে। পঞ্চম ঘোড়াটায় উঠে বস।’
শারজার মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে হাত পায়ের বাধন খুলে দেওয়া হল।
‘ওকে ছেড়ে দাও।’ আক্রমণকারীদের বলল শারজা। ‘ওর কোন দোষ নেই, ও খুব ভাল মানুষ।’
‘ওকে আমাদের প্রয়োজন।’ বলল ওদের একজন।
‘ওকে তোমাদের কি দরকার?’
‘শারজা!’ ভেসে এল অন্য কণ্ঠ। ‘চুপচাপ ঘোড়ায় উঠে বস।’
চকিতে ওদিকে ফিরে শারজা বলল, ‘আপনি!’
‘উঠে বস। সময় নষ্ট করো না।’ ও খুব ভাল সওয়ারী। কায়রো পেছনে ফেলে ঘোড়াগুলো এগিয়ে চলল মর্যভূমির বালি মাড়িয়ে।
প্রভাত সূর্য উঁকি মারছে আকাশে। এখন সেন্ট্রি পরিবর্তনের সময়। নতুন প্রহরী ডিউটিতে এসে দেখল রাতের প্রহরী নেই। জানালা দিয়ে উঁকি দিল কক্ষের ভেতরে। আহত বন্দী কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। গেটে গিয়ে দাঁড়াল নতুন সেন্ট্রি। সে জানত, বন্দীকে দেখার জন্য সকালেই ডাক্তার আসবেন। তারপরে গোয়েন্দা প্রধান। বন্দীর সাথে আছে তার বোন। তার অনুমতি ছাড়া ভেতরে যাওয়া নিষেধ। কিন্তু বোনকে কোথাও দেখা করল না। কিছুক্ষণ পর আলী এসে সেন্ট্রিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডাক্তার কি প্রহরী দেখে চলে গেছে?’
ডাক্তার এখন আসেননি। আমি এসে রাতের প্রহরীকে পাইনি। বন্দীর বোনকেও কোথাও দেখছি না।
আলী ভাবলেন, বন্দীর অবস্থা খারাপ বলে মেয়েটা হয়ত ডাক্তারের কাছে গিয়েছে। শুধু মিসর নয়, মুসলিম বিশ্বের জন্য বন্দী অত্যন্ত মুল্যবান। তাকে দিয়ে ভয়ংকর এক ষড়যন্ত্রের রহস্য উদঘাটন করতে হবে।
কক্ষের ভেজানো দরজা ঠেলে দ্রুত ভেতরে ঢুকলেন আলী। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে বন্দী। এক ঝটকায় বন্দীর মুখের কম্বল সরিয়ে ভয়ে দু’কদম পিছিয়ে এলেন। যেন মানুষ নয়, কম্বলের নীচে শুয়ে আছে এক বিষধর সাপ।
সেন্ট্রিকে ডাকলেন আলী। দৌড়ে ভেতরে ঢুকল প্রহরী।
‘ওকে চিনতে পারছ? রাতের সেন্ট্রি নয়তো!’
আতংকে বিবর্ণ হয়ে গেল সেন্ট্রির চেহারা। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, ‘রাতে ও-ই ডিউটি করেছে। ও এখানে ঘুমিয়ে আছে কেন? বন্দী কোথায়?’
‘ও ঘুমায়নি, মারা গেছে।’
কম্বল তুলে একদিকে ফেলে দিলেন আলী। বিছানা রক্তে লাল হয়ে গেছে। প্রহরীর বুকের মাঝ বরাবর খঞ্জরের দুটো আঘাত। বারান্দা এবং বাইরের অবস্থা গভীর মনযোগ দিয়ে দেখলেন আলী। এক ফোটা রক্ত নেই কোথাও। তার অর্থ সেন্ট্রিকে জীবিত কক্ষে ঢোকানো হয়েছিল। খঞ্জর মারা হয়েছে বিছানায় শুইয়ে। চেপে ধরার কারণে দাপাদাপি করতে পারেনি, তা নয়তো এদিক ওদিক রক্তের ছিটে ফোঁটা দেখা যেত। মৃত্যুর পর গায়ের ওপর কম্বল চাপিয়ে বন্দীকে তুলে নেওয়া হয়েছে। এ অপহরণে বোনটা সাহায্য করেছে। রূপের লোভ দেখিয়ে হয়ত সেন্ট্রিকে ভেতরে নিয়ে এসেছিল। মেয়েটার সঙ্গীরা ওকে হত্যা করে ভাই-বোন দু’জনকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। বন্দীর গ্রাম থেকে আসা চারজন লোককে দেখা করার অনুমতি দিয়ে ভুল করেছেন বলে আফসোস হল আলীর। নইলে ওরা এখানকার অবস্থা, পাহারা ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারত না। মেয়েটাকে তার সাথে থাকার অনুমতি দেয়াও ঠিক হয়নি। ও আসলেই বন্দীর বোন কিনা কে জানে? এখন মনে হচ্ছে, মেয়েটাও ওদের দলেরই সদস্য।
নিজের ওপর ক্রোধ হচ্ছিল তার। অনুতাপ করছিলেন ভুলের জন্য। অনুতাপ করছিলেন ভুলের জন্য। দক্ষ একজন গোয়েন্দা হিসেবে আলীকে ধোকা দেওয়া সহজ নয়, অথচ এরা তাকে বোকা বানিয়ে গেল! এক প্রশ্নের জবাবে সেন্ট্রি বলল, ‘আগের রাতে আমার ডিউটি পড়েছিল। দেখেছি মেয়েটা ডাক্তারের বাড়ি গিয়ে অনেক রাতে ফিরে এসেছে।
আলীর মনে সন্দেহ জাগল। মেয়েটা রূপ যৌবন দিয়ে ডাক্তারকে হয়ত হাত করে নিয়েছিল। সেন্ট্রিকে বললেন, ‘ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এসো। দ্রুত যাবে।’
চলে গেল সেন্ট্রি। আলী বাইরে পায়ের চিহ্ন পরীক্ষা করতে লাগল। বন্দী আহত। নিশ্চয়ই একা পালাননি। অস্পষ্ট পায়ের ছাপ থেকে আলী কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলেন না। বন্দীর গ্রামে কমাণ্ডো অভিযান চালানো যায়। কিন্তু কায়রো থেকে সে গ্রাম অনেক দূরে। কি করণীয় কোন কুল কিনারা পেলেন না আলী।
ফিরে এল প্রহরী। বলল, ‘ডাক্তার বাসায় নেই। তার বাসার চাকর বলেছে, কিছুদিন থেকে একটা মেয়ে ডাক্তারের কাছে আসত। অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলত। গত রাতেও মেয়েটা এসেছিল। অনেক রাতে দু’জনই বাসা থেকে বেরিয়েছে। আর ফিরে আসেনি।’
আলীর দৃঢ় বিশ্বাস জমল, ডাক্তারও বন্দীকে পালাতে সাহায্য করেছে। মেয়েটার রূপই ের জন্য দায়ী।
গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের ডাকলেন আলী, বন্দীর পালিয়ে যাওয়ার কথা বললেন ওদের গোয়েন্দা কর্মীরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। একস্থানে পাওয়া গেল অনেকগুলো ঘোড়ার পদচিহ্ন। আশ-পাশের লোকজন বলল, ‘গতরাতে অনেকগুলো ঘোড়ার পদশব্দ শোনা গেছে। ঘোড়ার পদচিহ্ন অনুসরণ করে শহরের শেষ সীমা পর্যন্ত গেল গোয়েন্দা দল। সামনে যাওয়া অনর্থক। রাতের ঘোড়ার পদচিহ্ন এখন অনেকটা মুছে গেছে। তবে ওরা কোন দিকে গেছে বুঝা যাচ্ছে।
সংবাদটা মিসরের ভারপ্রাপ্ত গভর্নরের কানে তোলা দরকার। আলী ভাবলেন, বন্দীর দেওয়া তথ্য নিশ্চয়ই ভুয়া। পালানোর পথ করার জন্যেই বন্দী অভিনয় করেছে। শুধু তাকে নয়, সুলতানকেও লোকটা বোকা বানিয়ে গেল। দুপুরের দিকে সংবাদ দেয়ার জন্য বেরিয়ে গেলেন আলী।
কায়রো থেকে অনেক দূরে ছ’টি ঘোড়া তীব্র গতিতে ছুটে চলছে। একটার পিঠে আকিল, অন্যটায় ডাক্তার। ডাক্তারের হাত পা বাঁধা। আড়াআড়িভাবে উপুড় করে তাকে শোয়ানো হয়েছে। একদিকে মাথা এবং অন্যদিকে পা ঝুলছে। নিঃসাড় পড়ে আছেন তিনি। চোখ বাঁধা বলে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। ঘোড়া যখন মোড় ঘুরছে, উঁচু নীচু টিলা অতিক্রম করছে, অমনি শুধু অনুভব করছেন।
ডাক্তারের সাথে রয়েছে অপহরণকারীদের একজন। খুরের শব্দে মনে হচ্ছে পেছনে আরো ঘোড়া আসছে। একই গতিতে ঘোড়া ছুটেছে রাতভর। পথে কোথাও বিশ্রাম নেয়নি অপহরণকারীরা।
আকাশে উঠে এসেছে মরু সূর্য। কিন্তু থামার কোন লক্ষণ নেই। রোদের তেজ বাড়ছে। সূর্য এখন মাথার উপরে। পেছন থেকে ভেসে এল কানফাটা চিৎকার। কেউ পড়ে গেছে ঘোড়ার পিঠ থেকে।
তার ঘোড়াটিও থামল। পেছনে গেল খানিক। কেউ একজন বলল, ‘তুলে ছায়ায় নিয়ে চল। অজ্ঞান হয়ে গেছে। হায়, হায়! রক্তক্ষরণ হচ্ছে।’
‘ডাক্তারের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দাও।’ মেয়েলী কণ্ঠ। ‘রক্তক্ষরণ বন্ধ না হলে আমার ভাই মরে যাবে।’
রাতভর তীব্র গতিতে ঘোড়া ছুটেছে। ঝাকুনিতে ফেটে গেছে আকিলের ক্ষতের সেলাই। লোকটি দাঁত কামড়ে ব্যথা সহ্য করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অত্যাধিক রক্তক্ষরণে অজ্ঞান হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গেছে।
একটা গাছের ছায়ায় চলে এল ওরা। পানি দেওয়া হল আকিলের মুখে। ভেতরে না গিয়ে গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। রক্তে লাল হয়ে গেছে তার কাপড়।
ডাক্তারের হাত-পা এবং চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হল। চোখ রগড়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলেন তিনি।
‘এদিক-ওদিক তাকিয়ো না। সোজা সামনে চল।’ পিঠে খঞ্জর ঠেকিয়ে বলল একজন অপহরণকারী।
হাঁটা দিলেন ডাক্তার। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আকিলকে ছায়ায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। পাশে বসে আছে শারজা। কাঁদছে। ডাক্তারকে দেখেই ও বলল, ‘দোহাই ডাক্তার, আমার ভাইকে বাঁচান।’
বসে রোগীর নার্ভ দেখলেন ডাক্তার। এদিক-ওদিক তাকাতে নিষেধ করা হয়েছে। এখনও পিঠে খঞ্জর ঠেকিয়ে রেখেছে লোকটা। আকিলের শিরা থেকে হাত সরিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন তিনি। চকিতে পেছনে ফিরলেন। মুখোশ পরা চারজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। একজনের হাতে খঞ্জর।
ক্রুদ্ধ স্বরে ডাক্তার বললেন, ‘গযব পড়ুক তোমাদের ওপর। বাঁচানোর পরিবর্তে লোকটাকে তোমরা মেরে ফেলেছ। তোমরা সবাই এর হত্যাকারী। আমি ওকে বিছানা থেকে নামতে দেইনি। তোমরা সারা রাত ঘোড়ার পিঠে রেখেছ ওকে। ক্ষতস্থান ফেটে দেহের সব রক্ত ঝরে ও মারা গেছে।
লাশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল শারজা। অনেক কাঁদল মেয়েটা। ওকে সরিয়ে লাশ ঘোড়ার পিঠে চাপানো হল। পাহাড়ের ঢাল থেকে সরে এসে পথে নামল কাফেলা। ডাক্তারের চোখ এবং হাত-পা বেঁধে দেওয়া হল। এখনও শারজার বিলাপ শোনা যাচ্ছে। ডাক্তার তার পেছনে বসা আরোহীকে বলল, ‘লোকটা সুস্থ হয়ে যেত। তোমরা মেরে ফেললে। সুলতান ওকে কোন শাস্তিই দিতেন না।
আমরা ওকে বাঁচানোর জন্য আসিনি। ওকে নয়, ওর ভেতরের গোপন তথ্য অপহরণ করেছি। সে মরে গেছে এ জন্য আমাদের কোন দুঃখ নেই। আমরা খুশি। কারণ, তোমরা এবং তোমাদের সুলতান কোন গোপন তথ্য জানতে পারল না ওর কাছ থেকে।
তোমরা আমাকে কোন অপরাধের শাস্তি দিচ্ছ?’
আমরা তোমাকে নবীদের মত সম্মানে রাখব। মরুর সামান্য বাতাসও তোমাকে স্পর্শ করবে না। পথে রোগীর কোন সমস্যা হলে তুমি চিকিৎসা করবে, এ জন্যই তোমায় এনেছি। তখন ভাবিনি, তোমার কাছে ওষুধ বা যন্ত্রপাতি কিছুই নেই, কি দিয়ে চিকিৎসা করবে?’
মেয়েটাকে আনার প্রয়োজন ছিল, তোমাকে ছেড়ে ওকে নিয়ে এলে তোমাদের গোটা সেনাবাহিনী আমাদের ধাওয়া করতো। আমাদের যাত্রা নিরাপদ করার জন্যই তোমাকে আনতে হয়েছে। তা ছাড়া আমাদের একজন ভাল ডাক্তারও দরকার। এখন থেকে তুমি আমাদের সাথে থাকবে।
‘দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এমন কোন লোকের চিকিৎসা আমি করব না। তোমরা খ্রিস্টান এবং সুদানীদের বন্ধু। ফাতেমীদের সাহায্যকারী। তোমরা ওদের হাতের পুতুল। ওদের নির্দেশে তোমরা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছ।
‘তবে তো তোমাকে মরতে হবে।’
‘তাই আমার জন্য ভাল।’
‘তোমার সাথে এমন ব্যবহার করব যা ভাল না। তখন আমাদের প্রতিটি নির্দেশ পালন করতে তুমি বাধ্য হবে। তবে আমার মনে হয়, তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করার কোন প্রয়জনই পড়বে না। তুমি সুলতান সালাহুদ্দীন র রাজত্ব দেখেছ, আমাদেরটা দেখলে বলবে এখান থেকে যাব না। এ তো এক স্বর্গ। আমাদের প্রস্তাব না মানলে নরকের ছবিটাও এক নজর দেখিয়ে দেব।
ঘোড়া ছুটছে। চোখ বাঁধা থাকায় ডাক্তার কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কল্পনায় নিজের ভবিষ্যৎ দেখার চেষ্টা করছেন শুধু। শারজার কথা বার বার মনে পড়ছে। কিন্তু হতাশ হচ্ছেন এই ভেবে যে, মেয়েটা হয়ত ওদের দলেরই সদস্য। ও তাকে কোন সাহায্য করবে না।
❀ ❀ ❀ ❀ ❀
সীমান্তে প্রহরাবত মুসলিম সৈনিকদের ভয়ে অপহরণকারীদেরকে অনেক পথ ঘুরে যেতে হচ্ছে। দিনভর একটানা চলেছে সন্ধ্যার পরও থামেনি। মাঝরাতে কাফেলা একটা উপত্যকায় এসে থামল। অন্ধকার রাত। ডাক্তারকে ঘোড়া থেকে নামিয়ে চোখ এবং হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিল। সামনে দিল খাবার এবং পানীয়। পথশ্রমে ক্লান্ত সবাই। ঘোড়াগুলোর জিন খুলে পানি খাওয়ানো হল। ঘাস পাতা দিয়ে বেঁধে রাখা হল একটু দূরে।
খাওয়ার পর হাত-পা বেঁধে ডাক্তারকে ওরা শুয়ে পড়তে বলল। ওরাও শুয়ে পড়ল। গতরাতে কেউ ঘুমুতে পারেনি, শোয়ার সাথে সাথে ঘুম নেমে এল সবার চোখে।
কিছুক্ষণ পর ডাক্তারের চোখ খুলে গেল। ভাবলেন হত্যা করার জন্য সম্ভবত তাকে জাগানো হচ্ছে। মরার জন্য ডাক্তার তৈরী। কে যেন পায়ের বাঁধন খুলছে। পায়ের কাছ থেকে ছায়ামূর্তি হাতের কাছে চলে এসেছে। ধীরে ধীরে হাতের বাঁধনও খুলে ফেলল। এরপর ডাক্তারের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘দুটো ঘোড়ার পিঠে জিন চাপিয়েছি।’ শারজার কণ্ঠ। ‘নীরবে আমার সাথে আসুন। ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে। এখুনি পালাতে হবে। ওরা অজ্ঞানের মত ঘুমুচ্ছে। সহজে জাগবে না।’
নিঃশব্দে শারজাকে অনুসরণ করলেন ডাক্তার। নরম বালিতে হাঁটার শব্দ হচ্ছে না। সামনে দুটো ঘোড়া প্রস্তুত। দু’জন দুটোর পিঠে উঠে বসল।
‘ঘোড়া ভাল চালাতে না পারলেও ভয় নেই’, শারজা বলল, ‘পড়বেন না। লাগাম ঢিলা করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিন। ডানে বায়ে ঘুরাতে পারবেন তো?’
‘কোন কথা না বলে ঘোড়া ছুটালেন ডাক্তার। শারজা বলল, ‘আমার পেছনে আসুন, আমি পথ চিনি। সাবধান, অন্ধকারে যেন বিচ্ছিন্ন হবেন না।’
অশ্বের ক্ষুরের শব্দে জেগে উঠল অপহরণকারী দল। কারা যাচ্ছে প্রথম দিকে বুঝতে পারল না ওরা। শারজার পালানোর প্রশ্নই ওঠে না। ডাক্তারের হাত পা বাঁধা। তাহলে কে যাচ্ছে? চিন্তা-ভাবনা করে কিছু সময় নষ্ট হল ওদের। ঘোড়ার কাছে ছুটে গেল ওরা। দুটো ঘোড়া নেই। খোজাখুজি করে বুঝল, ডাক্তারও নেই, শারজাও নেই।
ঘোড়ার পিঠে জিন চাপাল ওরা। দ্রুতগামী দুই ঘোড়সওয়ার তখন অনেক দূর চলে গেছে। তবুও ওরা বারবার পেছন ফিরে চাইছিল।
অনেকক্ষণ শারজাকে বলল, ‘এখানে কোথাও সীমান্ত ফাঁড়ি রয়েছে। কোথায় জানি না।’ জানে না শারজাও। ফাঁড়ির রক্ষীদের দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য অনেক পথ ঘুরে ওরা এগিয়েছে। শারজা বলল, ‘সোজা পথে আমাদের গ্রাম এত দূরে নয়। আপনি নিশ্চিত থাকুন আমরা কায়রোর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি।’
দুপুরে ভারপ্রাপ্ত গভর্নর তকিদ্দীনের কাছে পৌঁছলেন আলী বিন সুফিয়ান। তাকে সব কথা খুলে বললেন। গভর্নর বললেন, ‘চারজন অপরিচিত লোককে বন্দীর সাথে দেখা করতে দেওয়া এবং সন্দেহভাজন মেয়েটাকে তার কাছে থাকতে দেয়াটা ছিল মারাত্মক ভুল। আপনার মত অভিজ্ঞ ব্যক্তি এ ভুল করার পরও আমি ততটা আশ্চর্য হইনি, যতটা আশ্চর্য হয়েছি ওদের দুঃসাহস এবং দক্ষতা দেখে।
‘আপনি ঠিকই বলেছেন’, আলী বললেন, ‘সেন্ট্রিকে হত্যা করে বন্দীকে অপহরণ করা নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিক কাজ।
‘আমার ধারণা ডাক্তার এবং যুবতী মেয়েটা এ অপহরণকে সহজ করে দিয়েছে। সুলতান আমাদের এ দুর্বলতা নিয়েই উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, নারী এবং ক্ষমতার লোভ এ জাতিকে ধ্বংস করবে। আমি ডাক্তারকে একজন ভাল মানুষ মনে করতাম। অথচ অবাক লাগছে, একটা সাধারণ মেয়ে তাকে অন্ধ করে ফেলল!’
‘বন্দীর গ্রামের ঠিকানা সংগ্রহ করে আমি এক প্লাটুন সৈন্য পাঠিয়ে দিয়েছি।’
‘দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের যে পর্বত ঘেরা পড়োবাড়ির কথা বন্দী বলেছে সে ব্যাপারে কি চিন্তা করেছেন?’
‘মনে হয় বন্দী মিথ্যা বলেছে। জীবন বাঁচানোর জন্যই একটা মিথ্যে গল্প ফেঁদেছিল ও, এরপরও খোজ-খবর নেয়ার জন্য ওখানে গোয়েন্দা দল পাঠাব।’
প্রহরী ভেতরে এসে বলল, ‘ডাক্তার একজন তরুণীকে নিয়ে এইমাত্র এখানে এসে পৌঁছেছেন, উনি আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন।
এ সংবাদ শুনে থ’হয়ে গেলেন দু’জনই। একজন আরেকজনের দিকে চাইতে লাগলেন। কারও মুখে কথা সরছে না।
‘অন্য কেউ হবে হয়ত’ বলে বেরিয়ে গেলেন আলী। পেছনে গেলেন গভর্নর। ডাক্তার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল সাথে বন্দীর বোন শারজা। ধূলোমলিন বিধ্বস্ত চেহারা ওদের, ঘোড়াগুলো হাপাচ্ছে।
‘বন্দীকে কোথায় রেখে এসেছ?’ আলীর কণ্ঠে ঝাঝ। হাত দিয়ে ইশারা করে ডাক্তার বুঝালেন, তারা ভীষণ ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত।
ভেতরে নিয়ে তাদেরকে পানি এবং খাবার দেওয়া হল। খাওয়া শেষে ডাক্তার সব ঘটনা খুলে বললেন।
‘আহত বন্দী আমাদের সাথে রয়েছে জানতাম না। পরদিন ঘোড়া থেকে পড়ে লোকটা যখন মারা গেল তখনই শুধু জেনেছি বন্দীকেও অপহরণ করা হয়েছে।
এরপর শারজার জবানবন্দী নেওয়া হল। তার কথা শুনে আলী বুঝলেন, যতটা চতুর মনে করা হয়েছিল ও ততটা নয়। গ্রামের একজন সাধারণ মেয়ে হলেও সাহস আছে।
শারজা বলল, ‘ভায়ের আশ্রয়ে এতদিন আমি বেঁচে ছিলাম তার জন্য জীবন দিতেও কুণ্ঠিত হতাম না। ডাক্তার নিষ্পাপ, আন্তরিকতা ও দরদ নিয়েই তিনি ভায়ের চিকিৎসা করেছেন। তার পবিত্র ব্যবহারে আমি মোহিত হয়েছি। ভেবেছি লোকটা মানুষ নয়, ফেরেস্তা। আমার সাথে যে চারদিন লোক এসেছিল। ওদের সাথে আমার আত্মীয়তার কোন সম্পর্ক নেই। যারা সুলতানকে হত্যা করতে চায় এরা তাদের দলের লোক।
আপনার লোকেরা যখন আমাদের গ্রামে গিয়েছিল তখন এ চারজন গ্রামে ছিল। ভায়ের বন্দী হওয়ার কথা শুনে ওরা সাথে এসেছে। ভাইয়া ওদের অনেক গোপন কথা জানতেন। ওদের আশংকা ছিল ভাইয়া না আবার সব প্রকাশ করে দেয়। ভাইয়া কোথায় এবং কি কাজে গিয়ে আহত হয়েছেন তাও তারা জানত। তাই সুযোগ পেলে ভাইয়াকে অপহরণ করার টার্গেট ছিল তাদের।
আমারও ইচ্ছা ছিল ভাইয়াকে ওরা অপহরণ করুক। দুটো কারণে আমি ভাইয়ার কাছে থাকতে চেয়েছি। প্রথমতঃ তার সেবা করা। দ্বিতীয়তঃ সুযোগ পেলে তাকে অপহরণ করতে সাহায্য করা।
আমার সাথে আসা সে চারজন লোক গ্রামে ফিরে যায়নি। কায়রোতে আত্মগোপন করেছি ওরা। আমার ইঙ্গিত পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। জিন্তু ডাক্তার আমার চিন্তা বদলে দিলেন। তিনি বলেছেন, ভাইয়াকে কোন শাস্তি দেওয়া হবে না। সুলতান সালাহুদ্দীন সম্পর্কে আমাদের এতদিন যা বলা হয়েছিল। ডাক্তার সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বললেন। আমরা সুলতানকে হত্যা করা বৈধ মনে করতাম, কিন্তু ডাক্তার বললেন, তিনি ইসলামের জন্য যুদ্ধ করছেন। ডাক্তারের উন্নত নৈতিক চরিত্র সুলতান এবং ইসলাম সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টে দিল। অধিকাংশ সময় তার কাছে গিয়ে এসব কথা শোনার জন্য বসে থাকতাম।
একদিন ডাক্তারের বাসায় যাচ্ছি। পথে সেই চারজনের সাথে দেখা হল। ওরা ভাইয়াকে অপহরণ করার কথা বলল। আমি বললাম, ‘আমার ইচ্ছে পরিবর্তন করেছি। ভাইয়া এখানেই থাকবেন।’
ওরা বলল, ‘শহরে এসে আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে।’
ওদের সহযোগিতা না করলে ওরা আমাকে হত্যা করে ভাইয়াকে নিয়ে যাবে বলে হুমকি দিল।
আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম। বললাম, ‘অপহরণের ব্যাপারে আমি তোমাদের কোন সাহায্য করবো না।’ ওদের একজন বলল, ‘ডাক্তারের বাসায় তোমার আসা-যাওয়া দেখে ভেবেছিলাম তুমি তাকে ফাঁসিয়েছ। এখন দেখছি নিজেই তার জালে ফেঁসে গেছ।
আমি ওদের ধমক দিয়ে বললাম, ‘এসব কথা আবার বললে পরিণতি ভাল হবে না। ডাক্তারের সাথে আমার খারাপ কোন সম্পর্ক নেই।’ ওরা এতটা দুঃসাহসী হয়ে এ কাজ করবে ভাবিনি, এ জন্য ডাক্তারকেও বলিনি কিছু।
রাতে ডাক্তারের বাসা থেকে বাসা থেকে ফেরার সময় ওদের হাতে ধরা পড়লাম। একটা ঘোড়ার পিঠে আমার ভাইকেও দেখলাম। ভাইয়া মুক্ত হয়েছেন দেখে খুশিও হলাম। পালানোর জন্য প্রস্তুত হলাম। ডাক্তারকে অপহরণ করুক আমি চাইনি। আমার বাঁধা উপেক্ষা করে ওরা তার হাত-পা বেঁধে ঘোড়ায় তুলে নিল।
ভাইয়াকে কিভাবে অপহরণ করেছে জানতে চাইলাম। ওরা বলল, ‘আমাদের দু’জন গিয়ে সেন্ট্রির কাছে একটা ঠিকানা জিজ্ঞেস করল। সেন্ট্রি তাদেরকে ঠিকানা বুঝাতে লাগল। এ সু্যোগে দু’জন ঢুকে গেল ভেতরে বাইরের দু’জনও সেন্ট্রিকে নিয়ে ভেতরে গেল। ভাইয়া তাদেরকে দেখে উঠে বসলেন।
ভাইয়ার বিছানায় সেন্ট্রিকে শুইয়ে দেওয়া হল। খঞ্জর দিয়ে বুকে দুটো আঘাত করে বেরিয়ে এল ওরা। ওরা ধারণা করেছিল, আমি ডাক্তারের বাসায় রয়েছি। ওদের ভয় ছিল, আমি অপহরণে বাঁধা দেব। এজন্য দু’জন লুকিয়ে রইল ডাক্তারের বাসায় যাওয়ার পথে। ডাক্তার যখন আমায় এগিয়ে দিতে আসছিলেন তখনই ওরা আমাদেরকে ধরে ফেলল। আর সাথে সাথেই সবাইকে নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল।
❀ ❀ ❀ ❀ ❀
দু’জনের জবানবন্দীর ওপর নির্ভর করেলেন না গোয়েন্দা প্রধান। এদের ফিরে আসাও ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে।
দু’জনকে আলাদা কক্ষে নিয়ে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। আলী বাধ্য হলেন ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করতে।
মেয়েটার প্রসঙ্গে ডাক্তার বললেন, ‘এর সাথে আবেগ জড়িত। ও দেখতে অবিকল আমার মৃত বোনের মত। এ জন্য ওকে আন্তরিকতা দেখিয়েছি, নিয়ে গিয়েছি আমার বাসায়। বন্দীর ঘরেও ওর কাছে বেশী সময় কাটাতাম। আমার ভেতর কোন পাপ বোধ ছিল না, এ কারণে ও বেশী প্রভাবিত হয়ে পড়েছিল। বিশ্বাস করেছে আমাকে। জানতে চেয়েছিল অনেক কিছু। ও মুসলমান এবং গ্রামের এক সহজ সরল মেয়ে। সুলতান সম্পর্কে ওর ভেতর কাজ করছিল বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া। গ্রামে যা শুনেছে তাই বিশ্বাস করেছে। আমি ইসলাম, সুলতান এবং মিসর সম্পর্কে ওর খারাপ ধারণা দূর করেছি। তার কথা শুনে বুঝতে পেরেছি, তাদের এলাকায় ইসলাম এবং সুলতানের বিরুদ্ধে প্রাকাশ্য ষড়যন্ত্রে চলছে।
শারজার নিয়মিত জবানবন্দী গ্রুহণ না করে আলী তাকে কিছু প্রশ্ন করলেন, ওর জবাবেও পড়োবাড়ির প্রসঙ্গ এসেছে। শারজা নিজেও পড়োবাড়ির রহস্যময় পীরের ভক্ত।
ও বলল, ‘ভাইয়া সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। বাড়িতে আমি থাকতাম একা। গ্রামের লোকেরা আমাকে ওখানে চলে যেতে বলেছে পবিত্র বাবা নাকি সুন্দরী যুবতী কুমারীদের পছন্দ করেন। আমাদের গ্রামের ক’জন সুন্দরী যুবতী রহস্য ঘেরা বাড়িতে গিয়ে ফিরে আসেনি। এক ছুটিতে ভাইয়া বাড়ি গেলেন। আমি পোড়োবাড়িতে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। তিনি নিষেধ করলেন।
পোড়োবাড়ি সম্পর্কে শারজা পরিষ্কার করে কিছুই বলতে না পারলেও ওখানে কি হচ্ছে বুঝা যায়। ডাক্তারের প্রসঙ্গ তোলা হলে ও বলল, ‘অপহরণকারীরা তাকে বন্দী করে রাখলেও আমি তাকে মুক্ত করে দিতাম। আমি বাঁচব কি মরব এ তোয়াক্কা করতাম না।
ভাইয়ার মৃত্যুর পর গ্রামে যাবার আর কোন আকর্ষণ আমার নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম পথেই ডাক্তারকে মুক্ত করব। ভেবেছিলাম অপহরণকারীরা আপন। কিন্তু ডাক্তার বলেছেন, ওরা পাপী এবং অপ্রাধী। নিজের দেশের বিরুদ্ধে ওরা ষড়যন্ত্র করছে। পরে বুঝেছি, ভাইয়ার জন্য ওদের কোন আন্তরিকতা নেই। ভাইয়া তাদের গোপন তথ্য জানতেন বলেই তাকে ওরা মেরে ফেলেছে।
‘এখন কি করবে?’ প্রশ্ন করলেন আলী। ‘নিজের ব্যাপারে কি ভেবেছ?’
‘আমি সারা জীবন ডাক্তারের পায়ের ওপর পরে থাকব। তিনি আগুনে ঝাপ দিতে বললে তাও দেব। আমার চোখে ছিল পাপের পর্দা। ডাক্তার তা সরিয়ে দিয়েছেন। আপনারা যদি রহস্যঘেরা বাড়িতে যেতে চান, আমি নিয়ে যাব। আমাদের এলাকায় যারা সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে আমি সবাইকে চিনি। ওদের গ্রেফতার করতে চাইলে আমি সহযোগিতা করব। এ জন্য মরতে হলেও পিছপা হব না। ওরা দেশ ও জাতির শত্রু এ কথা ডাক্তার আমাকে ভালভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন।
আলীর পরামর্শে পদস্থ সেনা অফিসার এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মিটিং ডাকা হল। আলোচনা হল পরিস্থিতি নিয়ে।
অধিকাংশ সদস্যের অভিমত হল, তকীউদ্দীন যেহেতু মিসরে নতুন, কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে চিন্তা ভাবনা করা উচিৎ। এক বিশাল এলাকা জুড়ে যেহেতু ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত হয়েছে, এত লোকের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ হবে না। মনে হচ্ছে রহস্যময় বাড়ি ঘিরা নতুন মতাদর্শের জন্ম নিয়েছে। মতাদর্শের অনুসারীরা এর বিরুদ্ধে কোন সেনা অভিযান সহ্য করবে না। ওরা দ্বীনের সত্যিকার কথা তুলে ধরে আবেগকে আহত করা যাবে না।
কেউ পরামর্শ দিলেন, ‘ঘটনা সুলতানকে অবহিত করে তার নির্দেশ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ।’
‘এর অর্থ হচ্ছে আপনারা মানুষকে ভয় পাচ্ছেন।’ মুখ খুললেন ভারপ্রাপ্ত গভর্নর। যে আল্লাহ্ এবং রাসুলের দ্বীনকে বিকৃত করা হচ্ছে সে ব্যাপারে আপনাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। মিসরে কি হচ্ছে সব সুলতানকে জানিয়ে তাকে বিব্রত করা ঠিক হবে না। সুলতান এক শক্তিমান শত্রুর মোকাবেলা করছেন তা আপনাদের অজানা নয়। তাকে কি বুঝাতে চাইছেন আমরা দু’চার হাজার শত্রুর ভয়ে আতংকিত! আমি সরাসরি এবং কঠোর পদক্ষেপ নিতে চাই।
‘অপরাধ নেবেন না মাননীয় আমীর!’ বললেন একজন সেনাপতি। ‘আমাদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের অভিযোগ হচ্ছে আমরা তরবারীর জোরে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা এ অপবাদ মুছে ফেলতে চাই। আমরা ওখানে যাব প্রেম এবং ভালবাসার বাণী নিয়ে।’
‘তাহলে কোমরে তরবারী ঝুলিয়ে রেখেছেন কেন?’ গভর্নরের কণ্ঠে তিরস্কার। ‘এত টাকা খরচ করে কেন সেনাবাহিনী লালন পালন করা হচ্ছে? সেনাবাহিনীকে ছুটি দিয়ে একদল ধরমপ্রচারক তৈরী করি। ওরা গ্রামে গ্রামে, দেশে দেশে ঘুরে ধর্ম প্রচার করবে। অস্ত্রভাণ্ডার নীল দরিয়ায় ফেলে দিয়ে বলুন সবাই দরবেশ হয়ে যাই।’
গভর্নরের কণ্ঠে উথলে উঠল এক রাশ আবেগ। ‘রাসূল (সা.) এর বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের তরবারী উন্মুক্ত হলে ইসলামের তরবারী কোষমুক্ত থাকবে না। একবার যদি ইসলামের তলোয়ার কোষমুক্ত হয় তবে নবীর (সা.) সামনে মাথানত করতে অস্বীকারকারী প্রতিটি বেঈমানের শিরোচ্ছেদ করা হবে। কালিমার বিরুদ্ধাচারণকারী প্রতিটি জিহ্বা ছিঁড়ে ফেলা হবে।
ইসলামের তরবারীর জোরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ অভিযোগকারীদের কাছে আমরা ক্ষমা চাইতে যাব না। কেন সংকীর্ণ হয়ে এসেছে মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমানা? স্বয়ং মুসলমানই কেন ইসলামের শত্রুতে পরিণত হচ্ছে! কারণ, খ্রিস্টান যুবতীদের রূপ, মদ, সম্পদ, আর ক্ষমতার মোহ মুসলমানদের তরবারী ভোতা করে দিয়েছে। যুদ্ধ আমাদের ইতিহাস।
যেহেতু যুদ্ধের ময়দানে ওরা আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না তাই বিভিন্ন অভিযোগ দিয়ে ওরা আমাদের ইতিহাসের ঐতিহ্যকে নিঃশেষ করে দিতে চাইছে। ওদের পদাতিক এবং নৌ-অভিযান ব্যর্থ। আমাদেরকে নিঃশেষ করার জন্য ওরা বিছিয়েছে ষড়যন্ত্রের জাল। নারী, মদ আর সম্পদের মাধ্যমে দ্বীনের সামনে দাঁড় করিয়েছে বাধার প্রাচীর।
আমাদের চরিত্র, আমাদের নৈতিকতা আর আমাদের ঈমানী চেতনা ধ্বংস করার জন্য সামনে এগিয়ে দিচ্ছে রূপসীদের রাঙ্গা ঠোঁটের মৃদু হাসি। আপনারা এদের বিরূদ্ধে তরবারী কোষমুক্ত করতে নিষেধ করছেন!
শুনুন আমার বন্ধুরা! ভালবাসার অভিনয় করে শত্রু আপনাদের হাত থেকে তরবারী ছিনিয়ে নিতে চাইছে। আঘাত করতে চাইছে আপনাদের পিঠে। ‘কেউ তোমার এক গালে চড় মারলে অন্য গাল পেতে দাও’, ওদের এ শ্লোগান একটা প্রতারণা। ক্রাকের মুসলমান কি অবস্থায় আছে আপনারা জানেন না? ওদের তৈরী বেগার ক্যাম্প সুবাকে দেখেননি?’ ওখানে লুণ্ঠিত হয়েছে মুসলিম নারীদের সম্ভ্রম। অধিকৃত ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মুসলমান নারীরা হারাচ্ছে ইজ্জত। প্রচণ্ড আতংকের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে ওরা।
খ্রিস্টানরামুসলমানদের কাফেলা থেকে যুবতী এবং সুন্দরী মেয়ে ও শিশুদের অপহরণ করে নেয়ে যাচ্ছে। আসব জনোয়ারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে আপনারা নিষেধ করছেন? বলছেন এ অন্যায়! এ অন্যায় করতে আমি লজ্জিত হব না। নিরস্ত্র মুসলিম রক্তে রংগীন হচ্ছে খ্রিস্টানদের তরবারী। ওদের অপরাধ, ওরা আল্লাহ্ এবং রাসূলকে বিশ্বাস করে, ভালবাসে। ওরা ক্রুশ পুজা এবং শিরক করে না। যেখানে আল্লাহর বাণী কায়েম হবে শুধু সেখানেই তোমাদের তরবারী কোষবদ্ধ হবে।
‘ওদের আবেগকে আহত করা যাবে না’ আমি এ কথায় বিশ্বাসী নই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাসক আর অযোগ্য আমীর ওমরাহর দল আকর্ষণীয় কথা বলে মানুষকে প্রলুব্ধ করে। মানুষের মিথ্যে আকীদা বিশ্বাস ওদের পূঁজি। জনগণকে কুসংস্কারের সাগরে ডুবিয়ে নিজের লালসা এবং ভোগ বিলাসে মত্ত থাকলে চলবে না। সত্যের পথে চলতে গিয়ে কারও কারও কষ্ট হবে। এ ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে।
কয়েকজনের সন্তুষ্টির জন্য জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে পারি না। কিছু মানুষের আবেগ আহত হবে বলে দেশের এক বিশাল এলাকা ষড়যন্ত্রকারী গাদ্দারের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। আপনারা দেখেছেন ওখানকার মানুষ সহজ সরল এবং অশিক্ষিত। গোত্রপতিরা ধর্মের ইজারাদার হয়ে বসে আছে। শত্রুর পক্ষ হয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।
সভার সদস্যগণ কল্পনাও করতে পারেনি গভর্নর এমন কঠিন পদক্ষেপ নিবেন। তিনি যে সব যুক্তি পেশ করেছেন তা খণ্ডন করার ক্ষমতা কারও ছিল না। অন্য কোন পরিকল্পনা পেশ করার সাহস পায়নি কেউ।
গভর্নর বললেন, ‘বর্তমানে মিসরে অবস্থানগত সেনাবাহিনীর ময়দানের বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে। এদের মধ্য থেকে পাঁচশত ঘোড় সওয়ার, দু’শ উস্ট্রারোহী এবং পাঁচশত পদাতিক সৈন্য আজ সন্ধ্যার মধ্যে রওয়ানা করবে। এরা রহস্য ঘেরা বাড়ি থেকে এদ্দুর দূরে থাকবে, যেন, প্রয়োজনে আক্রমণ করতে পারে।
দামেশক থেকে যে দু’শ সওয়ার এসেছে তারা পার্বত্য এলাকায় গিয়ে পড়োবাড়ি অবরোধ করবে। বাড়ির ভেতরে চলবে কমাণ্ডো অভিযান। ওরা তৈরী করে একদল চাটুকার। চাটুকারের দল ঘুরে ঘুরে প্রচার করে, ওলি যা বলেছেন তা আল্লাহর কথা। আমির ওমরা বা রাজার কথা না মানলে পাপ হবে।
এ ভাবেই মানুষ লম্পট পাপীদের গোলামীর শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে। সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে দুটো শ্রেণীতে। একদল শাসক, আর একদল শাসিত। একদল অত্যাচারী, অন্যদল অত্যাচারিত। তখন জনগণ হয় ক্ষমতাসীনদের বলির পাঠা।
আমরা দেখছি শত্রু আমাদের মুলে আক্রমণ করছে। আমাদের ভাইদেরকে নিয়ে যাচ্ছে কুফরীর গহীন অন্ধকারে। এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে এর অর্থ হবে আমরা বেঈমানদের সহযোগিতা করছি। আমার ভাই সুলতান সালাহুদ্দীন বলেছেন, গাদ্দারী এবং গাদ্দারীতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি।
আমি দেখতে পাচ্ছি, সমাজে শাসক এবং শাসিত এ দুটো শ্রেনী সৃষ্টি হয়েছে। শাসক মদের পিয়ালায় ডুবিয়ে দেবে দেশের সম্পদ। অনাহারে অর্ধাহারে মারা পড়বে জনগণ। ভাইজানের কথাই ঠিক। তিনি বলেছেন, স্বীয় জাতি এবং ধর্মের ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য রাখা উচিৎ আমাদের। জাতির চিন্তা চেতনা এবং কর্মধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, আগামী প্রজন্ম আমাদের কবরের কাছে জবাব চাইবে। জাতি এবং ধর্মের জন্য কল্যাণকর কোন কাজ থেকে আমাদেরকে দূরে থাকলে চলবে না। সভা শেষ হল। সবাই যুদ্ধ যাত্রার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
❀ ❀ ❀ ❀ ❀
দলে উপদলে বিভক্ত করে সুলতান সেনাবাহিনীকে সমগ্র মরু এলাকায় ছড়িয়ে দিলেন। দখল করে নিলেন পানি এবং মরুদ্যান। শত্রু যেন এসব এলাকায় আসতে না পারে এ জন্য পাহারা দেয়ার জন্য স্থাপন করলেন মেনজানিক কামান। প্রস্তুত রইল তীরন্দাজ। পর্বত চূড়ায় বাংকার তৈরী করা হল।
মুসলিম ফৌজকে নির্দেশ দেওয়া হল, শত্রু মুখোমুখি আক্রমণ করলে চার দিকে ছড়িয়ে যাবে। ওরাও তখন ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হবে। সুলতান এমন ভাবে সৈন্যদের সঙ্গঠিত করলেন এমন ভাবে সৈন্যদের সঙ্গঠিত করলেন, কোনটা সামনের দিক আর কোনটা পেছনের বুঝার কোন উপায় রইল না।
সেনাবাহিনীর এক অংশ রিজার্ভ রাখা হল প্রয়োজনে কাজে লাগানোর জন্য। প্রস্তুত রইল কমাণ্ডো বাহিনী। সুলতান খ্রিস্টানদের তৎপরতার বিস্তারিত খবর পাচ্ছিলেন। ওদের প্রথম পরিকল্পনা ছিল সুবাক দুর্গ পুনরুদ্ধার করা। সুবাক অবরুদ্ধ হলে সুলতানের ক্ষুদ্র বাহিনীকে মরুভুনিতেই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যাবে।
ভেতরের সাহায্য থেকে সৈন্যবাহিনী সরিয়ে আনলেন। বাহ্যত সুবাক এখন অরক্ষিত। খ্রিস্টান গুপ্তচর ছুটল ক্রাকে। বলল, ‘সুবাক এখন অরক্ষিত। নিরদ্ধিধায় আক্রমণ করা যায়। বিনা বাধায় সুবাক দুর্গ দখল যাবে।’
সাথে সাথে মুখোমুখি আক্রমণকারী বাহিনীকে দিক পরিবর্তনের নির্দেশ দেওয়া হল। নতুন নির্দেশ পেয়ে খ্রিস্টানদের বিশাল বাহিনী এগিয়ে চলল সুবাকের দিকে। পেছনে রসদের বহর। রসদ বোঝাই হাজার হাজার গাড়ী পেছনে আসছে। বিস্তীর্ণ এলাকার কোথাও একজন মুসলিম সৈন্যও দেখা যায়নি। নির্ভয়ে এগিয়ে চলল রসদবাহী কাফেলা।
খ্রিস্টান সম্রাটদের খুশির আন্ত নেই। সুবাক দুর্গ তাদের হাতের মুঠোয়। রাত নেমেছে। কেউ ঘুমিয়েছে, কেউ আবার আনন্দ উৎসব করছে। অকস্মাৎ দৃষ্টি ছুটে গেল ফৌজের পেছনে। মাইল পাঁচেক দূরের আকাশ রংগীন হয়ে উঠছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আগুনের শিখা লকলকিয়ে উঠছে আকাশের দিকে। একদল দ্রুতগামী সওয়ার পাঠিয়ে দেওয়া হল। ওরা যখন সেখানে পৌঁছল তখন সব শেষ। ওরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সে আগুনের দিকে। ওদের চোখের সামনে পুড়ছে ওদের রসদ সামান। লাগামহীন ঘোড়াগুলো দিক-বিদিক ছুটাছুটি করছে। আগুনে পুড়ে গেছে পশুর খাবার, শুকনো ঘাস আর খড়ের স্তুপ।
সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সেনাপতিরা ছুটে গেলেন সেখানে। তাদের বিষণ্ণ চোখে অবাক দৃষ্টি। কিছু নেই। এক মাসের রসদ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ওরা বুঝতে পারল এবারও ওরা সুলতান সালাহুদ্দীন র ফাঁদে পা দিয়েছে। ‘রসদ’ ছাড়া দুর্গ অবরোধ করা যাবে না। এখন সুবাক যাওয়ার পথও নিরাপদ নয়।’ সেনাপতি সিদ্ধান্ত দিলেন, ‘অভিযান মুলতবী করা হল।’
গুপ্তচরের দ্বিতীয় সংবাদে আরও হতাশ হয়ে পড়ল খ্রিস্টান বাহিনী, ‘গত রাতে খ্রিস্টানদের দ্বিতীয় বাহিনীর রসদও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।’
খ্রিস্টান সম্রাট এবং সেনাপতিরা বৈঠকে মিলিত হলেন। পরিকল্পনা রদবদল করতে হবে। কি আশ্চর্য! মুসলিম বাহিনীর ‘টিকি’টি পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। গোয়েন্দারাও বলতে পারল না কোথায় জমায়েত হয়েছে মুসলিম বাহিনী। বিশাল মরুভূমির কোথাও নেই ওরা।
খ্রিস্টানদের দুই বিশাল বাহিনীর অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করে দিলেন সুলতান। কমাণ্ডারদের ডেকে বললেন, ‘খ্রিস্টান ফৌজ যুদ্ধ মুলতবী করলেও আমাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে। ওরা দুই বাহিনীর মুখোমুখি লড়াইকে যুদ্ধ বলে। আমি তা করব না। ওরা পিছিয়ে যাচ্ছে। ওদের নিশ্চিন্তে যেতে দেব না। কমাণ্ডো আক্রমণে ওদের ব্যস্ত রাখবে। পেছনে বা ডানে বায়ে ঝটিয়ে আক্রমণ করে পালিয়ে রণক্ষেত্রে। সেখানের ধূলিকণাও তোমাদের সহযোগিতা করবে।
সুলতান এক জায়গায় বসে থাকতেন না। আজ এখানে তো ওখানে। ঘুরে বেড়াচ্ছেন সমগ্র মরু এলাকা। খ্রিস্টান গোয়েন্দারাও জানে না সুলতান কোথায় আছেন। পরবর্তী বিপর্যয়ের ভয়ে তটস্থ রইল খ্রিস্টান ফৌজ।
❀ ❀ ❀ ❀ ❀
মিসরের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তের পার্বত্য এলাকা। এখানকার রহস্য বাড়িতে আকাশ থেকে নেমে আসলো হযরত ঈসা (আঃ)। ফেরাউনদের ভাংগা বাড়ি থেকে জন্ম নিয়েছে নতুন এক ধর্ম বিশ্বাস। এ অঞ্চলের অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ নতুন এ ধর্ম মত গ্রহণ করছে।
বৃহস্পতিবারের এক মনোরম সন্ধ্যায় বাড়ির প্রবেশ পথে দর্শনার্থীর প্রচণ্ড ভীড়। সারিবদ্ধভাবে ভেতরে ঢুকছে সবাই। ভেতরের প্রশস্ত কক্ষে গুঞ্জরিত হচ্ছে অদৃশ্য কণ্ঠ। পাশের দেয়ালে ভাসছে পাপীর শাস্তির দৃশ্য। প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মত আজও মানুষ আগ্রহ নিয়ে সে দৃশ্য দেখছে।
হঠাৎ কণ্ঠ থেমে গেল। যে পবিত্র বাবাকে পাপী চক্ষু দেখতে পায় না তার কণ্ঠের পরিবর্তে ভেসে এল নতুন কণ্ঠ, ‘পথভ্রষ্ট মানুষ! আজ রাতে বাড়ি ফিরে যেতনা। যে রহস্য উন্মোচনের জন্য তোমরা উদ্বিগ্ন, কাল সকালে তা দেখতে পাবে। যে বাবার দর্শক লাভের জন্য তোমরা ব্যাকুল, ভোরেই তার দেখা পাবে। এখনই এ পড়োবাড়ির বাইরে চলে যাও। হযরত ঈসা আসছেন। বাইরে গিয়ে সবাই শুয়ে পড়।’
কক্ষের দেয়ালে ভেসে উঠা তারকারাজী ম্লান হয়ে এসেছে। যুবতীরা হেঁটে বেড়াচ্ছে। সৈন্যদের পোশাক পরা কিছু লোক ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওদের। চিৎকার ভেসে আসছে। থেমে গেছে মেঘের গর্জন। পবিত্র স্থানে এসব কি ঘটছে! ভয়ার্ত মানুষ কক্ষ থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল।
কি ঘটছে দর্শনার্থীদের কেউ বুঝতে পারল না। সঙ্গী হচ্ছে কমাণ্ড সদস্যরা। কেউ কেউ ঢুকছে মশাল নিয়ে। ভেতরে মশাল নেয়ার নিয়ম নেই। আশ্চর্য হল দর্শনার্থী, বুঝতে পারছে না কেন মশাল নেওয়া হচ্ছে। প্রায় পঞ্চাশটি মশাল এবং একশজন গলি পথে এগিয়ে গেল ওরা। এ পথে বাইরের কারও চলাচল নিষিদ্ধ। এরা সবাই সশস্ত্র। কারও কাছে খঞ্জর, তারবারী আবার কারও হাতে রয়েছে তীর ধনুক। লোকজনের বেরোবার পথেও ঢুকে পড়েছে কমাণ্ডো সৈন্য। ছড়িয়ে প্রতিটি অন্ধকার গলিতে।
দামেশকের দু’শ অশ্বারোহী ঘিরে ফেলল বাড়ির চারদিক। ওরা ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা দর্শনার্থীদের একত্রিত করছিল। বাড়ির ভেতরটা অন্দ্রনালীর মত পেছানো। আঁকা-বাঁকা পথ পেরিয়ে কমাণ্ডো দল প্রশস্ত কক্ষে। চাঁদ অনেক উঁচু। কক্ষে অনেক নারী-পুরুষ। কারো কারো চেহারা নেকড়ের মত।
মিসরের ভারপ্রাপ্ত গভর্নর তকিউদ্দীন এবং আলী বিন সুফিয়ানের পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্ধ্যার পর সেনা সদস্যের একটি দল পার্বত্য এলাকায় পৌঁছল। পথ দেখাচ্ছিল শারজা। পাঁচশ ঘোড় সওয়ার, দু’শ উস্ট্রারোহী এবং পাঁচশ পদাতিক সৈন্যের বহর লুকিয়ে রইল খানিক দূরে। পড়োবাড়ি আক্রান্ত হলে সুদানীরা আক্রমণ করতে পারে।
সেনাদলের অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল সীমান্তের দিকে দৃষ্টি রাখা। সীমান্ত রক্ষীদেরকেও এ দলের অন্তর্ভুক্ত করা হল। সেনাদলের প্রতিটি সদস্য ছিল নির্বাচিত। দামেশক থেকে আসা দু’শ অশ্বারোহী এ অভিযানে অংশ নিয়েছিল। অন্যরা ছিল সুলতান সালাহুদ্দীন র বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সৈনিক। অনেকেই কমাণ্ডো আক্রমণে পারদর্শী।
সন্ধ্যায় কমাণ্ডো বাহিনী পড়োবাড়ির গেটে পৌঁছল। সারি বেঁধে লোকজন ঢুকছে। দু’জন লোক দাঁড়িয়ে দর্শনার্থীদের হাতে তুলে দিচ্ছে তিনটে করে খেজুর এবং পানি। দর্শনার্থীদের সাথে মিশে ছয় ব্যক্তি এগিয়ে গেল। দাঁড়াল গেটে দাঁড়ানো দু’জন লোকের সামনে। গেটে একটি মশাল জ্বলছে। সামনেটা আলোকিত, কিন্তু দরজার ভেতরে অন্ধকার। কিছু দূরে গিয়ে আলোকিত বড় কক্ষ।
ছ’জনের হাতে বেরিয়ে এল চকচকে খঞ্জর। দরজার অন্ধকারের আড়াল নিয়ে দাঁড়াল দু’জনের পেছনে। খঞ্জর ঠেকাল দু’জনের পিঠে। অনুচ্ছ কণ্ঠে বলল, ‘বাঁচতে চাইলে এখান থেকে সরে যাও। সেনাবাহিবী তোমাদেরকে ঘেরাও করে ফেলেছে।‘
প্রতিবাদ না করে দু’জন সরে এল। দু’জন কমাণ্ডো দখল করল ওদের জায়গা। চার কমাণ্ডো সরে আসা দু’জনকে বলল, ‘ভেতরে চল।’ ওদের ভয়ঙ্কর চেহারার দিকে একপলক তাকিয়ে ভেতরের দিকে পা বাড়াল ওরা। দেখা গেল ভেতরের কক্ষে অনেক সুন্দরী তরুণী ঝলমলে কাপড় পড়ে আছে।
একদিকে যুবক-যুবতী হাত ধরাধরি করে হাঁটছে, অন্যদিকে ছাদ থেকে মাটি পর্যন্ত পর্দা ঝুলানো। পর্দা একবার ডানে আবার বায়ে ঘুরছে। অন্যদিক থেকে ছুটে আসছে চোখ ধাঁধানো তীব্র আলো।
ভেতরে কোন ভূতপ্রেত বা দৈত্য দানো নেই, পূর্বে কমাণ্ডো সদস্যদের এসব কথা বলা না হলে ওরা ভয়ে ছুটে পালাত। কমাণ্ডো দু’জককে দু’জন গেটের দায়িত্ব দু’জন এসব কথা বলা না হলে ওরা ভয়ে ছুটে পালাত। কমাণ্ডো দু’জন গেটের দায়িত্ব নেয়ার পার একদল কমাণ্ডো সৈন্য ভেতরে ঢুকল।১৪১
সৈন্যদের দেখে ভয়ংকর প্রাণীগুলো বিকট শব্দ করতে লাগল। বিভিন্ন অংগভংগীর মাধ্যমে সৈন্যদের ভয় দেখাতে চাইল। ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে একজন তেড়ে এল সৈন্যদের দিকে। সৈন্যরা ওদের ঘিরে ফেলল। ধস্তাধস্তির সময় কয়েক জনের মুখোশ খুলে পড়ল। সৈন্যরা সবার মুখ থেকে নেকড়ে বা বিভিন্ন পশুর মুখোশ খুলে নিল। বেরিয়ে এল মানুষের চেহারা। একপাশে পড়ে আছে মদের পাত্র।
সশস্ত্র প্রহরায় সৈন্যরা ওদের বাড়ির বাইরে নিয়ে গেল। বাড়ির অন্যপ্রান্তে তল্লাসী নেওয়া হল। এক ব্যাক্তি একটি সুড়ংয়ের মুখে মুখ লাগিয়ে বলছে, ‘পাপের প্রায়শ্চিত্য কর। হযরত ঈসা (আঃ) আসছেন……….।’
সুড়ংয়ের ওপর প্রান্ত শেষ হয়েছে আলোকিত প্রশস্ত কক্ষে। ওখানে দর্শনার্থীরা গায়েবী শব্দ শুনে আর পাপীদের শাস্তির ছবি দেখে আতংকিত হয়। লোকটাকে বেধে ফেলল সৈন্যরা।
একজন সৈন্য সুড়ংগ মুখে মুখ লাগিয়ে বলল, ‘পথভ্রষ্ট মানুষ আজ রাতে বাড়ি যাবে না। এতদিন যে রহস্যময় বাবাকে দেখার অপেক্ষা করছিলে, কাল ভোরেই তাকে দেখতে পাবে তোমরা।
বন্দীদের জিজ্ঞেস করে সৈন্যরা আলোর উৎসের কাছে পৌঁছল। এখানে জ্বলছে অনেকগুলো মশাল। পেছনে কাঠের পাটাতন। পাটাতনের ওপর স্থাপন করা হয়েছে বিশাল আয়না। মশালের আলো আয়নায় পড়ে তার প্রতিবিম্ব সামনে ছড়িয়ে পড়ে। কাঠের পাটাতন ঘুরিয়ে আয়নার প্রতিসরণ এদিকে ওদিক ঘোরানো যায়। কক্ষের দেয়ালে ঝুলানো পর্দার মাঝে মাঝে কাঁচ সেটে দেওয়া হয়েছে। আয়নার প্রতিবিম্ব কাঁচে পড়লে মনে হয় আকাশে তারা জ্বলছে।
দেয়ালের রঙের সাথে মিলিয়ে পর্দায় রং করা হয়েছে। একজন সচেতন ব্যক্তি দেখা মাত্রই বুঝতে পারত এ হল আলোর কারসাজি। কিন্তু নেশাযুক্ত খেজুর আর পানি পান করিয়ে দর্শনার্থীদের মোহগ্রস্থ করা হয় বলে এতদিন মনে করেছে সত্য।
সুড়ং পথে আসা শব্দে দর্শনার্থীরা আরও হতবাক হয়। এজন্যই একবার বেরিয়ে এলে প্রতিটি লোক আবার ভেতরে যেতে চাইত। এ ছিল নেশার প্রভাব। এজন্যই এতদিন মানুষকে নেশাগ্রস্থ করে ধর্মীয় অনুভূতির নামে প্রতারিত করা হয়েছে সবাইকে।
খেজুর এবং পানির মশক ‘সিজ’ করা হল। বন্দী করা হল ভেতরের সবাইকে। দুটো দলকেই জনগণের সামনে একটু উঁচুতে দাঁড় করানো হল। সেনা কমাণ্ডারের নির্দেশে মুখ থেকে মুখোশ খুলে ফেলল ওরা। বেরিয়ে এল মানুষের চেহারা।
লোকজনকে বলা হল সারি বেঁধে ওদের অতিক্রম করতে। আশ্চর্য হল গ্রামবাসীরা, এরা আকাশের অধিবাসী নয়, ওদেরই গাঁয়ের লোক। মেয়েগুলোও চেনা জানা। মেয়েদের মধ্যে চারজন ইহুদী, সাতজন খ্রিস্টান আর অন্যরা মুসলমান।
এরপর মূল অপরাধীদেরকে সামনে আনা হল। এদের ছ’জনই খ্রিস্টান। আরবদের মতই মিসরের ভাষায় পারদর্শী ওরা। এরা অর্থের লোভ দেখিয়ে এলাকার লোকদের হাত করেছে। চারটি মসজিদের ইমামও ওদের নিজস্ব লোক। ধর্মের নামে মানুষকে ধোকা দেয়ার জন্য এরা এসব ইমামদের নিয়োগ করেছিল।
এ অঞ্চলের মানুষ যাতে সেনাবাহিনীতে ভর্তি না হয় এ জন্য খ্রিস্টান নেতৃবৃন্দের নির্দেশে ওরা এ নাটকের অভিনয় করেছে। সফল হয়েছে ওরা। এলাকার মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছে সুদানীদের প্রতি ভালবাসা। সালাহুদ্দীন র বিরুদ্ধে ঘৃণার বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে মানুষের হৃদয়ে। এমনকি ওদেরকে ফাঁদে জড়িয়ে মানুষ নিজের ধর্মকেও বিসর্জন দিয়েছে।
কেউ পালিয়ে আছে কিনা দেখার জন্য খোঁজ করা হল প্রতিটি কক্ষ। বাইরে দু’শ ঘোড় সওয়ার বাড়ি ঘিরে রেখেছে। জ্বলছে শত শত মশাল। সেনাবাহিনীর এক অংশ সুদান সীমান্তে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে।
রাত গিয়ে ভোর হল। সুদানের দিক থেকে কোন আক্রমণ এল না। কোন বাধা এলনা পড়োবাড়ির ভেতর থেকে। গ্রামের কেউ বাড়ি ফিরে যায়নি, ওরা প্রতারক সেই অদৃশ্য বাবাকে দেখতে চায়।
❀ ❀ ❀ ❀ ❀
সকালে গ্রামে খবর পাঠানো হলো যে, অদৃশ্য বাবা একটু পর দর্শন দেবেন। দলে দলে গ্রামবাসীরা ছুটল পাহাড়ের পাদদেশে জমায়েত হল প্রায় চার হাজার গ্রামবাসী। ওরা সবাই নতুন ধর্ম মতের অনুসারী। সবাই বাবাকে এক নজর দেখার জন্য ব্যাকুল। বাবা তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেবেন।
সৈন্যরা লোকজনকে বসিয়ে দিল। সবাই তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে আছে পড়োবাড়ির দিকে। স্বর্গীয় জ্যোতিতে স্নাত দরবেশ এখনই বেরিয়ে আসবেন। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না।
হঠাৎ দেখা গেল পড়োবাড়ির দিক থেকে সেনাবাহিনীর প্রহরায় একটা মিছিল এগিয়ে আসছে। কারও চেহারা নেকড়ের মত, কারও বানর বা ভাল্লুকের মত। দর্শনার্থীরা বড় কক্ষের দেয়ালে এদের ছবি দেখেছিল। গায়েবী আওয়াজ বলেছিল পরকালে এদেরকে এভাবে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কারণ এরা যুদ্ধ করেছিল সেনা ফৌজে।
প্রায় পনর জন সুন্দরী তরুণী আসছে আলাদা ভাবে। এদের সাথে রয়েছে সুদর্শন যুবক। লোকজনকে পড়োবাড়ির ভেতর নিয়ে ওদের প্রতারণার পদ্ধতি দেখান হল। এতদিন কিভাবে ধোকা দেওয়া হয়েছে নিজের চোখে দেখল মানুষ। ভেতরটা দেখা শেষ হলে আবার তাদেরকে পাহাড়ের পাদদেশে একত্রিত করা হল।
ঈষৎ উঁচু জায়গায় দাঁড়ালেন মিসরের ভারপ্রাপ্ত গভর্নর তকিউদ্দীন। বললেন, ‘খেজুরের সাথে হাশিশ মিশিয়ে তোমাদেরকে নেশাগ্রস্ত করা হতো। দেখানো হতো স্বর্গ নরক। বলা হতো মুসা, ঈসা আর আল আযেদের কথা। এর সবই ছিল প্রতারণা। হাশিশের প্রভাবে তোমরা সবকিছুই বিশ্বাস করেছিল। এরা ধোকার জাল বিছিয়ে সমগ্র অঞ্চলকে বিভ্রান্ত করেছে।
তোমাদের শোনানো হয়েছে এক দরবেশের কাহিনী। দরবেশ মানুষকে উট, ঘোড়া এবং টাকা দেন। আসলে মিথ্যা বলে এরা তোমাদের লোভ দেখিয়েছে। মিথ্যা বলার বিনিময়ে পেয়েছে অঢেল সম্পত্তি। এরা এসেছে তোমাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে। এসেছে তোমাদের ঈমান নষ্ট করতে।’
জনতার মাঝে দেখা দিল মৃদু গুঞ্জন উত্তেজিত মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের ওপর। সেনাবাহিনী চেষ্টা করেও ওদের ঠেকাতে পারল না।
জনতার সম্মিলিত ক্রোধ অপরাধীদেরকে পিটিয়ে মেরে ফেলল। যুবক-যুবতী আর পুরুষদের কেউ রক্ষা পেল না।
সেনাবাহিনী ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র এলাকায়। বন্দী করা হল খ্রিস্টান গোয়েন্দা এবং চরদের। চারজন ইমামকেও গ্রেফতার করা হল। উত্তেজিত জনতা ভেংগে গুড়িয়ে দিল সে রহস্যময় বাড়ি।
কায়রো ফিরে গেলেন তকিউদ্দীন। শারজা এবং ডাক্তারকে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অনুমতি দিলেন। সুদান আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হল।
এ অভিযানে গিয়ে তিনি দেখেছেন মিসরে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবেশী দেশটি কি ষড়যন্ত্র করছে। ওদের আক্রমণ না করলে এ যড়যন্ত্র বন্ধ করা যাবে না। তিনি বুঝতে পেরেছেন সুদানীরা এখন খ্রিস্টানদের সহযোগী। সুদানের কিছু এলাকা দখল করতে না পারলেও আক্রমণের ফলে ওদের ষড়যন্ত্র নষ্ট হয়ে যাবে। কায়রোতে শুরু হলো যুদ্ধের প্রস্তুতি।
❀ ❀ ❀ ❀ ❀
চুরমার করে দেওয়া হল ষড়যন্ত্রের একটি কেন্দ্র। কিন্তু গভর্নর তকিউদ্দীন এতেও সন্তুষ্ট নন। খ্রিস্টানদের প্রত্যক্ষ মদদে সুদানীরা এ ষড়যন্ত্র বিস্তৃত করেছে। ওদের প্রতিহত না করলে নতুন ষড়যন্ত্র সৃষ্টি করবে। এ জন্যেই তিনি সুদান আক্রমণ করতে চাইছিলেন। ওখানেও ছিল সুলতান সালাহুদ্দীন র গুপ্তচর। নিয়মিত ওরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাঠাচ্ছিল। এসব তথ্য দিয়ে সুলতান যেভাবে উপকৃত হতে পারতেন তকিউদ্দীনের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। দু’ভায়ের আবেগ এক হলেও বুদ্ধিমত্তা এবং ধীরশক্তিতে ছিল বিস্তর ফারাক। দু’জনই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেন। কিন্তু একজনের সিদ্ধান্তে থাকত দূরদর্শিতা এবং ধৈর্য, অন্যজনের থাকত আবেগ এবং তাড়াহুড়ো।
সামরিক উপদেষ্টাগণ যখন গভর্নরকে বললেন, ‘সুদান আক্রমণ করার পূর্বে সুলতানের সাথে পরামর্শ করা উচিৎ।’
এ প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন গভর্নর। বললেন, ‘আপনারা কি সুলতানকে বুঝাতে চাইছেন, তাকে ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারি না। কি ঝড়ের মোকাবেলা করছেন সুলতান তা আপনাদের অজানা নয়। আমরা তার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকলে সুদানীরাই মিসর আক্রমণ করে বসবে। এখনই ফৌজকে মার্চ করতে বলুন। রসদ সামান ছাড়াই সেনাবাহিনী রওয়ানা করবে।’
‘এতবড় এক অভিযানে যাওয়ার পূর্বে একটু চিন্তা-ভাবনা করা উচিৎ।’ বললেন একজন কমাণ্ডার/
‘স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমরা প্রস্তুতি নিতে পারব।’
‘সুলতানকে এ ব্যাপারে জানানো উচিৎ যাতে তিনি সম্মানিত জঙ্গীকে অবহিত করতে পারেন।’ বললেন আরেকজন।
‘আপনারা মিসরে একজন একজন করে গাদ্দার গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছেন, আমি গাদ্দারী এবং ষড়যন্ত্রের উৎসের উৎপাটন করতে চাই। এ জন্য আর কারও সাথে পরামর্শ করার প্রয়োজন নেই। আমার নির্দেশই যথেষ্ট।’ বললেন ভারপ্রাপ্ত গভর্নর।
তকিউদ্দীন এমন কতগুলো বিষয়ে মনযোগ দেননি যা তার জন্য পরাজয় বয়ে আনতে পারে। কায়রোতে ছিল খ্রিস্টান এবং সুদানের গুপ্তচর। সেনাবাহিনীর প্রতিটি নড়াচড়া ওরা লক্ষ্য করছিল। তকিউদ্দীনের দুর্ভাগ্য এসব গুপ্তচরের মধ্যে ছিল প্রশাসনের পদস্ত কর্মকর্তা এবং সুদানী অফিসার। কয়েক বছর পূর্বে মিসরের সুদানী বাহিনী ভেংগে এসব মেধাবী অফিসারদের রেখে দিয়েছিলেন সুলতান। সুলতানের যুদ্ধ পলিসি সম্পর্কে এরা ছিল অভিজ্ঞ। অন্যদিকে মুসলিম গোয়েন্দারা সুদানী ফৌজের যুদ্ধ পলিসি পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। খ্রিস্টান সম্রাটগণ সুদানী বাহিনীকে উন্নত অস্ত্রে সজ্জিত করে রেখেছিল।
সুদান আক্রমণ করতে হবে বিশাল মরু পেরিয়ে। জংগল এবং পর্বত ঘেরা অঞ্চলে রসদ পৌঁছনো সহজ নয় ভাবেননি তকিউদ্দীন। দেশের স্বাধীনতা এবং ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের ব্যাপারে প্রচণ্ড ক্ষোভ এসব দিকগুলো দৃষ্টির আড়ালে রেখেছিল।
তকিউদ্দিনের সদিচ্ছার কোন অভাব ছিল না, কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীনের মত দূরদর্শী হতে পারেননি তিনি। শুরু হল যুদ্ধের প্রস্তুতি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল এ ব্যাপারে সুলতানকে কিছুই জানানো হবে না।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর অনুভূতি নিয়েই তিনি একক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সুলতান প্রচণ্ড ঝড়ের মোকাবেলা করছেন তার এ ধারণা অমুলক ছিল না। তার চিন্তাধারা ছিল সঠিক।
তখন সুলতান ছিলেন ক্রাকের আট মাইল দূরে, অস্থায়ী ক্যাম্পে। তার হেড কোয়ার্টার ছিল বেদুইনদের মত। আজ এখানে তো কাল ওখানে। যে এলাকায় কমাণ্ডো আক্রমণ হবে তার আশেপাশেই থাকতেন তিনি। কোন সময় কোথায় থাকবেন কমাণ্ডাররা শুধু জানতেন।
কমাণ্ডোর বাহিনী খ্রিস্টানদের সকল রসদ ধ্বংস করে দিয়েছিল। এ অদৃশ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল ওদের জন্য ছিল আতংক। যদিও খ্রিস্টানদের ক্ষতি হচ্ছিল, পাশাপাশাই মুসলিম শহীদদের সংখ্যাও কম ছিল না। কখনও দশজনের কমাণ্ডো দল থেকে ফিরে আসত তিন কি চার জন। খ্রিস্টানদের বাড়তি সতর্কতার ফলে জানের ক্ষতি হচ্ছিল বেশি। নতুন করে যুদ্ধ পলিসি পরিবর্তন করার জন্য সুলতান চিন্তা-ভাবনা করছিলেন।
‘মনে হয় মুখোমুখি যুদ্ধের জন্য খ্রিস্টান আমাদের বাধ্য করছে’, সেনা অফিসারদের বললেন সুলতান। ‘ওদের এ ইচ্ছে পুরণ হবে না, মরতে দেব না এত বেশী কমাণ্ডো জওয়ান।’
‘এ জন্য কমাণ্ডো সৈনিকের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।’ একজন অফিসার বললেন। ‘শুধু আবেগের বশে দুশমনের শক্তিকে খাট করে দেখা ঠিক নয়। আবেগের বশে একজন সৈনিক যুদ্ধ করে জীবন দিতে পারে কিন্তু বিজয়ের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। খ্রিস্টানদের তুলনায় আমরা অনেক কম। এ ছাড়া ওদের বেশীর ভাগ সৈন্যই বর্মাচ্ছাদিত।’
মৃদু হেসে সুলতান বললেন, ‘যে লৌহবর্ম ওরা পরে থাকে তা তাদের নয়, আমাদের সাহায্য করবে। নিশ্চয়ই দেখেছেন ওরা রাতে বা ভোরে মার্চ করে। কারণ, সূর্যের উত্তাপে ওদের লৌহবর্ম আগুনের মত উত্তপ্ত হয়ে যায়। সৈন্যরা তখন ছুড়ে ফেলে দিতে চায় পরিধেয় বর্ম। বর্মের অত্যাধিক ওজন কমিয়ে দেয় ওদের চলার গতি। আমি ঠিক দুপুরে ওদের যুদ্ধ করতে বাধ্য করব। ঘাম ঝরে ঝাপসা হয়ে যাবে ওদের দৃষ্টি। আমরা সংখ্যায় কম, আবেগ এবং স্থান বদলে সে ঘাটতি পূরণ করব।’
আলীর সহকারী জাহেদীন এসে সালাম করল। সাথে দু’জন লোক। সুলতানের চোখে ফুটে উঠল আলোর দ্যুতি। দু’জনকেই পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওদিককার কি খবর?’
জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে দু’জনেই বের করে আনলেন গলায় ঝুলানো কাঠের তৈরী ক্রুশ। একটানে ঝুলানো রশি ছিড়ে ক্রুশ ছুড়ে ফেললেন দূরে। দু’জনই মুদলিম গোয়েন্দা। একজন বিস্তারিত রিপোর্ট দিলেন সুলতানের কাছে।
গোয়েন্দা রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে সুলতান যুদ্ধের নতুন পরিকল্পনা তৈরী করলেন। আক্রমণের স্থান নির্দেশ করে মানচিত্র তৈরী করলেন। গোয়েন্দা যখন ক্রাকে মুসলমানদের ওপর খ্রিস্টানদের অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করছিল সুলতানের চেহারার রং তখন বদলে গেল। উঠে দাঁড়ালেন তিনি, কপাল কুঞ্চিত। তাঁবুর ভেতর পায়চারী করলেন খানিক।
গোয়েন্দারা বলল, ‘সুবাক থেকে পালিয়ে যাওয়া খ্রিস্টানরা ক্রাকের মুসলমানদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছে। ব্যবসায়ীগণ দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। কোন অমুসলিম তাদের দোকানে যায় না। মুসলমানরা গেলেও তাদের ওপর খবরদারী করা হচ্ছে। মসজিদের বারান্দাকে ওরা উট, ঘোড়ার বাথান বানিয়েছে। আজান শুরু হলে হুল্লোড় করে গান গায় রেলিংয়ে বসে।’
মুসলমানদের মানসিক অবস্থা দুর্বল করার জন্য নানা গুজব ছড়নো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ‘সালাহুদ্দীন গুরুতর যখম হয়ে দামেশক গিয়ে মারা গেছেন। তার নেতৃত্বহীন যার যেদিকে ইচ্ছে পালাচ্ছে। সমগ্র মরুভূমির কোথাও মুসলিম সেনাবাহিনীর হাতে আসছে। এদিকে সুদানীরা মিসর আক্রমণ করেছে। মিসরের সেনাবাহিনী ওদের সাথে হাত মিলিয়েছে।’
প্রতিদিন সকালে পাদ্রীরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়েন। গ্রামে গ্রামে গিয়ে এসব গুজব ছড়িয়ে মুসলমানদের জন্য দোয়া করে। ভালবাসার কথা বলেন।
এতে একদিকে মুসলমানদের মানসিক শক্তি দুর্বল হচ্ছে, অন্যদিকে খ্রিস্টানদের মনের জোর বেড়ে যাচ্ছে। যুবতী মেয়েরা মুসলিম মেয়েদের বলে বেড়াচ্ছে, ‘সালাহুদ্দীন র সৈন্যরা অধিকৃত এলাকায় যুবতীদের নষ্ট করছে। তোমাদেরকেও ছাড়বে না। দেশ শত্রুমুক্ত হলে আমরা এবং তোমরা সবাই নিরাপদে থাকতে পারব।’
এর আগেও ক্রাকের মুসলমানদের দুর্দশা সম্পর্কে সুলতানকে বলা হয়েছে। ওরা সুলতানের বিরুদ্ধে কোন কথা শুনতে প্রস্তুত নয়, তবুও শুনতে হচ্ছে। দেয়ালেরও কান আছে, এ জন্য ওরা থাকে নির্বাক। দু’জন একস্থানে বসে কথা বলতেও ভয় পায়। মসজিদে, এমনকি শব যাত্রীদের সাথেও থাকে খ্রিস্টানদের গুপ্তচর।
ওদের দুর্ভাগ্য, মুসলিম ভায়েরাও খ্রিস্টানদের চর হিসেবে কাজ করে। নিজের বাড়িতে কথা বললেও ফিসফিসিয়ে বলতে হয়। ‘এরা খ্রিস্টান শাসকের বিরোধী’ বেগার ক্যাম্পে পাঠানোর জন্য এ কথাটুকু যথেষ্ট।
‘মাননীয় সেনাপতি’, অপর গোয়েন্দা বলল, ‘ক্রাকে খ্রিস্টানদের নতুন চাল শুরু হয়েছে। মুসলমানদের সাথে ভাল ব্যবহার করছে ওরা। ক’দিন পূর্বে সরকারী খরচে একটা ভাংগা মসজিদ মেরামত করা হয়েছে। বেগার ক্যাম্প থেকে মুসলমানদের মুক্ত না করলেও শ্রমের সময় কমিয়ে দিয়েছে। ওদের বলা হচ্ছে, ‘তোমরা সরকারের বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছ এরপরও তোমাদের সাথে ভাল ব্যবহার করা হচ্ছে।’
এ প্রেম এবং ভালবাসার অস্ত্র অত্যন্ত মারাত্মক। অমুসলিম যুবকরা মুসলিম যুবকদের চরিত্র নষ্ট করার কাজে লিপ্ত।
ক্রাক আক্রমণের দেরী হলে ওরা নামমাত্র মুসলমানে রূপান্তরিত হবে। কোরআন বাদ দিয়ে গলায় ঝুলাবে ক্রুশ। তখন ওরা আমাদের কোন সাহায্য করবে না।
প্রেমের কথা বললেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তি আরও জোরদার করা হয়েছে। গ্রেফতার হচ্ছে প্রতিদিন। এখন পর্যন্ত মুসলমানদের আবেগ টিকে আছে। দু’একজন ছাড়া ওদের ভালবাসার ফাঁদে এখনো পা দেয়নি। কিন্তু কতদিন পর্যন্ত এ আবেগ নিয়ে টিকে থাকতে পারবে ওরা তাই ভাববার বিষয়।’
সুলতানকে উদ্বিগ্ন দেখাল। তিনি জাহেদীনকে বললেন, ‘তোমরা কি মুসলমানদের সাথে কথা বলেছ? প্রেমের টোপ যেমন ভয়াবহ, চরিত্র হনন তারচে বেশী মারাত্মক।
আলীকে কি কায়রো থেকে ডেকে আনবো না তুমিই তার স্থান পূরণ করতে পারবে? মুসলমানদেরকে গুজব এবং ভালবাসার বিষাক্ত ছোবল থেকে রক্ষা করতে হবে।’
কায়রোর অবস্থা ভাল নয়। আলীকে ডাকার দরকার নেই, তিনি ওখানেই থাকুন। তার পরিবর্তে হাসান বিন আব্দুল্লাহ আমাদের সাথে থাকলেই চলবে। ক্রাকের ব্যাপার আমিই সামাল দেব।’
‘এ ব্যাপারে কি ভেবেছ তুমি?’
জাহেদীন আলীর স্থান পুরণ করতে পারবে কি না সুলতান তা বুঝতে চাইছিলেন। জবাবের প্রতীক্ষা না করে তিনি আবার বললেন, ‘জাহেদীন! আমি কখনও যুদ্ধের ময়দানে পরাজির\ত হইনি। এ ক্ষেত্রেও পরাজয় চাই না। খ্রিস্টান শক্তি মুসলমানদের সাংস্কৃতিক অংগনে আক্রমণ করেছে। আমি খ্রিস্টানদের সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক আগ্রাসন থেকে মুসলমানদের রক্ষা করতে চাই।’
‘আপনি জানেন ক্রাকে আমাদেরও গোয়েন্দা কর্মী রয়েছে। ওরা ওখানকার অধিবাসীকে আপনার ব্যাপারে, আমাদের ফৌজ এবং মিসরের ব্যাপারে সঠিক তথ্য দেবে, আপনার বাণী পৌঁছাবে প্রতিটি মুসলমানের কানে।’
‘ওখানকার নারীদের মধ্যে জাতীয় চেতনাবোধের অভাব রয়েছে।’ বলল একজন গোয়েন্দা।
‘আমরা যুবতী মেয়েদের বলব, প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে যেন মুসলিম নারীদের চিন্তাধারা পরিবর্তন করার চেষ্টা করে। আমি দেখেছি, ওখানকার মেয়েরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।’
‘মেয়েরা যদি সন্তানের শিক্ষা দীক্ষার দিকটা ঠিক মত দেখে তাহলে মুসলিম জাতি আরও উন্নত হবে।’ বললেন সুলতান। ‘প্রতিটি শিশু ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত হলে অমুসলিমরা তাদের অপচেষ্টায় ব্যর্থ হবে। শিশুদের কচি মনে ইসলাম এবং নবীর ভালবাসা সৃষ্টি হলে বড় হয়ে ওরা অন্য কোন মতবাদ গ্রহণ করবে না। এ জন্য ওদের সঠিক ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টা কর। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্রোক আক্রমণ করব। সুবাকের মুসলমানদের মত ক্রাকের মুসলমানদেরকেও মুক্ত করব ইনশাআল্লাহ। জাহেদীন, এ জন্য কাকে ক্রাক পাঠাতে চাও।’
‘এ দু’জনকে। এরা ক্রাকের নিয়ম নীতি যেমন জানে; পথ ঘাটও চেনে। এরা মেধাবী এবং বুদ্ধিমান।’
❀ ❀ ❀ ❀ ❀
ক্রাকের মুসলমানদের উপর ভালবাসার বিষাক্ত অস্ত্র চালানো হচ্ছিল গোয়েন্দা প্রধান হরমুনের পরামর্শে। সুবাক হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর হরমুন খ্রিস্টান সম্রাটদের বলেছিল, প্রেমের অভিনয় করে ক্রাকের মুসলমানদেরকে আমাদের পক্ষে নিয়ে আসা সম্ভব। পক্ষে না এলেও সালাহুদ্দীনের ওপর ওদের মন বিষিয়ে তোলা যাবে। কিন্তু খ্রিস্টান সম্রাটগণ মুসলমানদের ঘৃণা করতেন। ভালবাসার অভিনয় করতেও তারা রাজী নান। তাদের ধারণা, শক্তি প্রয়োগ করেই এদের জাতীয় চতনা নিঃশেষ করা যাবে।
হরমুন ছিলেন একজন মনোবিজ্ঞানী। তার মতে মন জয় করতে পারলে গোটা জাতি হাতের মুঠোয় এসে যাবে। শেষ পর্যন্ত তিনি সম্রাটগণকে তার স্বমতে আনতে পেরেছিলেন। বলেছিলেন, সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গোপনে গ্রেফতার করে গায়েব করে দিন, কিন্তু অন্যান্য মুসলমানদের আতংকিত করা যাবে না। মেয়েদের দিয়ে মেয়েদের বেপর্দা করতে হবে। যুবকদের করতে হবে মাদকাসক্ত। মানসিক গোলামীর মাধ্যমে ওদের বিলাসপ্রিয় করে তুলতে হবে।
সংস্কৃতির নামে যুবক-যুবতীদেরকে ঘর থেকে বের করে বেহায়াপনার তামিল দিতে হবে। ওদের বোঝাতে হবে, প্রগতির জন্য এসব নাচগান প্রয়োজন। ধর্মান্ধরা তোমাদের নিষেধ করবে, কিন্তু সংস্কৃতিবান না হলে উন্নতির শিখরে উঠা যাবে না।
হরমুন বললেন, একদিন দেখা যাবে, এরা নামে মুসলমান থাকলেও কথাবার্তা, আচার-আচরণ এবং চিন্তা-ধারায় থাকবে খ্রিস্টান। ওরা ওদের সমাজে আমাদের হয়ে কাজ করবে।’
সেদিন থেকেই হরমুনের এ প্রস্তাবের বাস্তবায়ন শুরু হল। প্রস্তাব মতে নির্বাচিত করা হবে একজন সুদর্শন মুসলিম যুবক। তাকে দেওয়া হবে শক্ত সামর্থ্য ঘোড়াগাড়ী, মুল্যবান পোশাক এবং সম্পদ। তাকে এবং তার পরিবারকে রাজ দরবারে নিমন্ত্রণ করে সম্মান দেওয়া হবে। এভাবে তাদের মন থেকে উপরে ফেলতে হবে ইসলামী আবেগ এবং ভালবাসা।
হরমুন খ্রিস্টান সম্রাটদের বললেন, মুসলমানদেরকে গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করতে চাইলে ওদের মাথায় রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পোকা ঢুকিয়ে দিন। অমনি আপনাদের চোখের ইশারায় সে নাচবে। মদপান করবে, নিজ জাতির যুবতীদেরকে নিজের হাতে উলংগ করে আপনাদের হাতে তুলে দেবে।
মুসলমানদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করতে চাইলে আমার এ ফর্মূলা পরীক্ষা করে দেখুন। নৈতিক চরিত্র নষ্ট করার জন্য ইহুদীরা পূর্ব থেকেই নিজের যুবতী মেয়েদেরকে মুসলমানদের হাতে তুলে দিচ্ছে। মুসলমানরা ইহুদীদের সবচেয়ে পুরনো শত্রু তা আপনাদের অজানা নয়। ইসলামকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ইহুদীরা মেয়েদের আব্রু এবং শেষ সম্বলটুকুও ত্যাগ করাতে প্রস্তুত। লড়াই জারী রাখতে হবে, তবে লড়াই দিয়ে ইসলামকে শেষ করা যাবেনা।
ইহুদী জাতি মুসলিম নিয়ম-নীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ। ওদের মেয়েদের গড়ন প্রায় মুসলমানদের মত। কোন ইহুদী নারী বোরকা পরে ওদের বাড়িতে প্রবেশ করলে কেউ সন্দেহ করে না। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে ইহুদীরা। মুসলিম সমাজ এবং সংস্কৃতিতে বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে।
জাহেদীনকে বিদায় করার বিশ দিন পর ক্রাকের রাস্তায় একজন নতুন পাগলের আবির্ভাব ঘটল। মুখে দাড়ি, গায়ে লম্বা জুব্বা, মাথায় পাগড়ী, কাঁধে ঝুলানো রুমাল। চেহারা এবং পোশাক ময়লা। দেখলে মনে হয় দূর থেকে এসেছে। হাতে কাঠের তৈরী ক্রুশ।
ক্রুশ উপরে তুলে পাগল চিৎকার দিয়ে বলছে ‘মুসলমান ধ্বংসের শেষ সীমায় এসে গেছে। সুবাকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মুসলিম যুবতীদের ইজ্জত আব্রু নিধনের পালা। মিসরের সব মুসলমান মদে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। প্রভু যিশু বলেছেন, এ জাতি পৃথিবীতে আর বেশীদিন থাকবে না। নূহের দ্বিতীয় প্লাবন না হলে ইহুদীদের খোলাকে সিজদা কর। মসজিদের সিজদা তোমাদের কোন কাজে আসবে না।’
পোষাকে এবং কথাবার্তায় লোকটাকে পাগল মনে হচ্ছিল। কেউ ডাকলে থেমে যেত, কিন্তু কোন প্রশ্নের জবাব দিত না। যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে আগের কথাগুলোই বলে যেত। লোকটা কে, কোথাকে এসেছে জানতে চাইল না কেউ।
তার হাতে ক্রুশ এ জন্য খ্রিস্টানরা খুশি। ইহুদীদের কথা বলছে বলে তারাও সন্তুষ্ট। মুসলমানদের ধ্বংসের সংবাদ দিচ্ছে বলে দু’দলই আনন্দিত। ক’জন টহল সৈনিক তার ধমক শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। পাগল ভেবে এড়িয়ে গেল পুলিশের লোকেরা। কোন মুসলমান সাহস পেল না পাগলটার মুখ বন্ধ করে দিতে। ক্রোধে ফেটে যাছিল মুসলিম হৃদয়গুলো, কিন্তু ওরা অসহায়।
লোকটি শহরের অলিতেগলিতে ঘুরে একই কথা বলে যাচ্ছিল। কখনও আগের কথার সাথে নতুন কথা যোগ করত। ‘মুসলিম বাহিনী আর ক্রাকে আসবে না। তাদের সালাহউদ্দন মরে গেছে।’ আবার কখনও এমন অর্থহীন কথা বলত যাতে মনে হচ্ছিল লোকটা আসলেই পাগল। তার পেছনে হাঁটছিল একদল শিশু-কিশোর। বয়স্করা খানিক গিয়ে ফিরে আসত। অনেকক্ষণ থেকে এক যুবক তাকে বলল ‘ওসমান, ক্রুশের আশ্রয়ে চলে এসো।’
ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে চুপ রইল ওসমান। ওসমানের কাপড়ের নীচে লুকানো খঞ্জরের কথা ওরা জানে না। পাগলটাকে হত্যা করার জন্যই তার পিছু নিয়েছে।
ওসমান সালেমের পিতামাতা বেঁচে আছেন। ছোট বোন আল নূরের বয়স কুড়ি। ওসমানই সংসারে বড়। দারুণ আবেগপ্রবণ ছেলে। ইসলামের নামে জীবন দিতে প্রস্তুত। খ্রিস্টান গোয়েন্দাদের সন্দেহভাজনদের তালিকায় তারও নাম আছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, মুসলিম যুবকদেরকে খ্রিস্টান সরকারের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে এ যুবক। তবে গোয়েন্দারা এখনও তাকে হাতেনাতে ধরতে পারেনি।
পাগলের চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল সে। পাগলটা ক্রুশ হাতে নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কথা বলছে দেখে রক্ত গরম হয়ে গেল ওসমানের। লোকটা আসলেই পাগল কিনা তাও ভাবে দেখল না। বাড়ি ফিরে খঞ্জর তুলে নিল। জামার নীচে কোমরে গুঁজে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পিছু নিল পাগলটার।
পথে দুইজন খ্রিস্টান যুবকের কথায় রক্ত চড়ে গেল মাথায়। কিন্তু নীরব রইল সে। পাগলটাকে হত্যা করার ইচ্ছে আরও জোরালো হল। পাগলটার পেছনে অনেক শিশু-কিশোর। বড়রাও রয়েছে। এখানে কিছু করা যাবে না।
বিকেল হয়ে এসেছে, কমে এসেছে পাগলের গলার জোর। তার পেছনের জটলাও হালকা হয়ে এসেছে। সূর্য ডোবার আর একটু বাকী।
গলির মোড়ে মসজিদের কাছে গিয়ে পাগলটা বসে পড়ল। এখনও ক্রুশ উঁচিয়ে রেখেছে। বলল, ‘এটা এখন থেকে গির্জা, মসজিদ নয়।
পাশে এসে দাঁড়াল ওসমান। সে জানত পাগলটাকে হত্যা করলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। কারণ তার হাতে রয়েছে ক্রুশ, কথা বলছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। ওসমান পাগলের আরও কাছে এসে অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘ক্রুশসহ এখনি এখান থেকে পালিয়ে যাও। নয়তো খ্রিস্টানরা তোমার লাশ তুলে নেবে।’
পাগল অনেকক্ষণ ওসমানের দিকে তাকিয়ে রইল। সামনে এখনও কয়েকজন ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওসমানের কথার কোন জবাব না দিয়ে কিশোরদের ধমক দিল। ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল ওরা। পাগল মসজিদের ভেতর ঢুকে পড়ল। হত্যা করার সুবর্ণ সুযোগ। কিছু না ভেবেই ওসমান ভেতরে ঢুকে গেট বন্ধ করে দিল। দ্রুত খঞ্জর বের করল। পেছনে ফিরে চাইল পাগল লোকটি।
ওসমানের খঞ্জর দিয়ে আক্রমণ করেছে। কাঠের ক্রুশ দিয়ে আঘাত ঠেকাল পাগলটা। ‘থাম যুবক। ভেতরে চল। আমি মুসলমান।’