মিসরের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত এলাকা। এরপরই সুদানের বর্ডার। এখানে রয়েছে পুরনো পড়োবাড়ি। শত শত বছরের অব্যবহৃত বাড়িগুলো ভয়ংকর এবং দুর্গম। হয়ত ফেরাউনদের সময় এ এলাকা ছিল সবুজ শ্যামল। ছিল পানির ঝর্ণা। শুকনো ঝিল আর পানি শূন্য নদী তার সাক্ষ্য বহন করছে। এখানে ছিল পাথুরে পর্বত আর বালিয়াড়ি। পর্বতগুলো দেখতে ছিল বিশাল অট্টালিকার মত। থামের মত পর্বতশৃঙ্গ। কোথাও দেয়ালের মত। সমতল ভূমিতে বালি আর বালি।
এলাকার বাইরে কোথাও কোথাও পানি। গাছ-গাছালিও রয়েছে। অধিবাসীদের পেশা কৃষি। চল্লিশ মাইল লম্বা এবং বার মাইল চওড়া অঞ্চল জুড়ে জনবসতি। জনসংখ্যার বেশীর ভাগ মুসলমান। অন্য ধর্মেরও কিছু লোক রয়েছে। সবাই কুসংস্কারে বিশ্বাসী। ফারাওদের এসব অট্টালিকাকে মানুষ ভয় পেত। লোকজন ভুলেও মাড়াত না এসব এলাকা। তাদের বিশ্বাস, এখানে থাকে ফেরাউনদের অতৃপ্ত আত্মা।
দিনের বেলা পশুর রূপ ধরে ওরা ঘুরে বেড়ায়। ওদের কখনও দেখা যায় উস্ট্রারোহী সৈনিকের বেশে, আবার কখনও সুন্দরী যুবতীর রূপে। কখনও শোনা যায় ভয়ংকর শব্দ।
বছর খানেক থেকে এসব পড়োবাড়ি মানুষকে আকর্ষণ করতে শুরু করেছে। মুসলিম সেনাবাহিনীতে লোক ভর্তির জন্য সালাহুদ্দীন র লোকজন যখন ওখানে গিয়েছিল, এলাকার লোকজন তাদেরকে পড়োবাড়ি সম্পর্কে ভয়ংকর গল্প শুনিয়েছিল। ওরা ওখানে যেতে নিষেধ করেছে তাদের।
প্রথমবার অনেকেই ভর্তি হয়েছে সেনাবাহিনীতে। পরের বার চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। সীমান্ত প্রহরীরাও ভয়ে ও পথ মাড়ায় না। ওরা কোন মানুষকে পড়োবাড়িতে যেতে দেখেনি। ইদানীং ওখানে লোকজনের যাতায়াত শুরু হয়েছে। ওখান থেকে যখন ফিরে আসে, ওদের চোখে মুখে থাকে তৃপ্তি। দেখতে দেখতে প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে ওখানে মেলা বসতে শুরু করেছে। ঘটছে আশ্চর্য সব ঘটনা। সেদিন পাঁচজন সীমান্ত রক্ষী টহল দিতে দিতে পড়োবাড়ির কাছে গেল, কিন্তু তারপর কি যে হলো, ওদের আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সমগ্র মিসরে ছড়িয়ে ছিল সুলতান সালাহুদ্দীন র গোয়েন্দা বাহিনী। রহস্যঘেরা পড়োবাড়ি সম্পর্কে ওরা কেন্দ্রে রিপোর্ট পাঠাল। রিপোর্টে বলা হল, ‘এ অঞ্চলের মানুষের চিন্তাধারা বলে যাচ্ছে। মুসলিম সেনাবাহিনীকে ওরা ঘৃণার চোখে দেখে। সুলতান সালাহুদ্দীন র নামও ওরা শুনতে চায় না।’
এ রিপোর্ট পাঠানোর পর দু’জন গোয়েন্দা কর্মী নিহত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, গোপনে হত্যা করা হয়েছে ওদের। ধীরে ধীরে এ অঞ্চলের লোকজন ভয়ংকর পড়োবাড়িতে যাওয়া আসা শুরু করল। অথচ ক’দিন আগেও ওই স্থানের নাম শুনলে ভয়ে আঁতকে উঠত সবাই।
শুরুটা ছিল, একদিন গাঁয়ে এল একজন অপরিচিত উস্ট্রারোহী। লোকটি মিসরীয় মুসলমান। উটের মত তার চেহারাও নাদুশ নুদুশ। গাঁয়ের লোকদের একত্রিত করে সে বলল, ‘আমি অর্থ কষ্টে ছিলাম। দিনে একবেলার আহার জোটাতে পারতাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম ডাকাতি করব। বাড়ি থেকে বের হলাম একদিন। বাহন নেই। পায়দল হাঁটতে লাগলাম।
এ এলাকায় জনবসতি নেই। ভাবলাম ডাকাতি করে এখানে নিরাপদে লুকিয়ে থাকতে পারব, ধরা পড়ার ভয় থাকবে না। অনেকদিন ঘোরাঘুরি করলাম। কিন্তু কোন শিকার পেলাম না।
হাঁটতে হাঁটতে পড়োবাড়ি এলাকায় একটা পাহাড়ের কাছে পড়ে গেলাম। দেহে শক্তি নেই। অনেক কষ্টে দু’হাত ওপরে তুলে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলাম। কানে ভেসে এলো এক গুরুগম্ভীর শব্দ, ‘তুমি ভাগ্যবান, এখনও কোন পাপ করোনি, পাপের ইচ্ছে করেছ মাত্র। ডাকাতি করে এখানে এলে এতক্ষণে দেহের পরিবর্তে হাড়ের ছাউনি পড়ে থাকত। পাহাড়ী জন্তু জানোয়ার তোমার গোশত ছিঁড়ে খুঁড়ে খেত।’
সে বলল, ‘শব্দ শুনে আমি আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। মনে হল কে যেন আমাকে টেনে তুলছে। চোখ খুলে দেখলাম এক আজব দৃশ্য। সেখানে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। দেখলাম দুধ সাদা শুভ্র শুশ্রুমন্ডিত বৃদ্ধকে। বৃদ্ধের দুচোখ থেকে আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। তাহলে এ বৃদ্ধের কণ্ঠই শুনেছি আমি?’
ভয়ে কাঁপতে লাগলাম আমি। বৃদ্ধ দু’হাত বাড়িয়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘কোন ভয় নেই পথিক। যারা এখানে আসতে ভয় পায় ওরা হতভাগা। শয়তান ওদেরকে এখানে আসতে দেয় না। যাও, গাঁয়ের লোকদের গিয়ে বল ফারাওদের খোদা এখন আর নেই। এ এলাকা এখন মুসার খোদার রাজত্ব। হযরত ঈসা (আ.) আকাশ থেকে এখানেই অবতরণ করবেন। এ বিরাণ ভূমি থেকেই প্রজ্জ্বলিত হবে ইসলামের আলো। জ্যোতিতে জ্যোতিমান হবে সমগ্র পৃথিবী।যাও বতস, গাঁয়ের লোকদের আমার কথা বলবে। এখানে নিয়ে এস ওদের।’
আমি হাঁটতে পারছিলাম না। দেহ শক্তিহীন, দুর্বল। বৃদ্ধ আবার বললেন, ‘যাও গুণে গুণে পঞ্চাশ পা উত্তর দিকে এগুবে। খবরদার, একবারও পেছনে তাকাবে না। লোকদের কাছে আমার এ কথাগুলো পৌঁছে দাও। নয়তো তোমার ভীষণ ক্ষতি হবে। সামনে দেখবে একটা উট বসে আছে। তার সাথে রয়েছে ঘাস-পাতা, তোমার খাবার এবং পানি। উটের সাথে আর যা পাবে সব তোমার।’
এ কথা শুনে আমি হাঁটতে লাগলাম। কোন দুর্বলতা নেই। বৃদ্ধকে ফেরাউনের আত্মা ভেবে প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম, এ জন্য পেছনে তাকাইনি, যেন পালাতে পারলে বাঁচি।
গুণে গুণে পঞ্চাশ পা এগোলাম। এখানে এসে পথ খানিকটা বেঁকে গেছে। সামনে দেখলাম একটা উট। এগিয়ে গিয়ে উটের সাথে বাঁধা পুটুলী থেকে খাবার বের করে নিলাম। তৃপ্তির সাথে খেয়ে পানি পান করলাম। দেহে এল অবর্ণনীয় শক্তি।’
একটি থলির মুখ খুলল অপরিচিত লোকটি। লোকদের দেখিয়ে বলল, ‘এই দেখুন স্বর্ণ মুদ্রা, এটিও উটের সাথে বাঁধা ছিল। তাই উটে চাপে আপনাদের কাছে এলাম বৃদ্ধের বাণী শোনানোর জন্য।’
কথা শেষ করে অপরিচিত লোকটি ফিরে গেল। লোকটির বাচনভংগী গাঁয়ের মানুষকে ভয়ংকর স্থানে উদ্বুদ্ধ করল। মুরুব্বীরা বললেন, ‘লোকটি অপরিচিত। আমরা কেউ কখনও তাকে দেখিনি। লোকটি নিজেই ফারাওদের আত্মা কিনা কে জানে!’
নিষিদ্ধ জিনিষের প্রতি মানুষের সহজাত আকর্ষণের ফলে যুবকরা সে ভয়ংকর স্থানে যেতে তৈরী হল। ওরা দেখতে চায় পড়োবাড়ির গোপন রহস্য। স্বর্ণ মুদ্রার হাতছানি এড়াতে পারল না গাঁয়ের লোকজনও।
❀ ❀ ❀ ❀ ❀
চল্লিশ মাইল দীর্ঘ এলাকায় এ অপরিচিত লোকটির সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল। কেউবা সিদ্ধান্ত নিল যাবার জন্য, কিন্তু মন থেকে ভয় দূর করতে পারছিল না। কিছু লোক পার্বত্য এলাকার কাছাকাছি গিয়ে ফিরে এসেছে।
ক’দিন পর দু’জন যুবক উস্ট্রারোহী সমগ্র এলাকা ঘোরাঘুরি করল। আগের লোকটির মত গল্প বললেও এদের বলার ধরন ছিল ভিন্ন। ওরা ঘোড়ায় চেপে অনেক দূরে যাচ্ছিল। সাথে ছিল অতিরিক্ত দুটো ঘোড়া। ওতে মূল্যবান মালপত্রে বোঝাই। ওরা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য নিয়ে যাচ্ছিল সুদান।
পথে ডাকাত দল ওদের সব কিছু কেড়ে নিয়ে ওদের তাড়িয়ে দিয়েছে। যুবক দু’জন হাঁটতে হাঁটতে পার্বত্য এলাকায় এসে ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হয়ে পরল। চলার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল ওদের। ক্লান্ত দেহ নিয়ে মাটিতে বসে পড়ল।
ওরা দেখল শুভ্র পোশাক পরা একজন বৃদ্ধ ধীরপায়ে ওদের কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘শয়তান তোমাদের সম্পদ লুট করেছে। তোমরা খুব ভাল। পঞ্চাশ কদম এগিয়ে দুটি উট দেখতে পাবে। উটের সাথে যা থাকবে সব তোমাদের। সোনা গয়না দেখে পরস্পর মারামারি করো না। তাহলে দু’জনই চিরদিনের জন্য অন্ধ হয়ে যাবে। গ্রামে গিয়ে লোকদের বলো পার্বত্য এলাকাকে যেন ভয় না পায়। এখানে ভয়ের কিছু নেই।
সাহস করে লোকজন পার্বত্য এলাকায় যাতায়াত শুরু করল। দেখা গেল অনেকেই পার্বত্য এলাকায় যাতায়াত শুরু করল। দেখা গেল অনেকেই ভয়ংকর পড়োবাড়িতে আসা যাওয়া করছে। ওরা বলল, ‘ভেতরে একজন দরবেশ রয়েছেন। তিনি গায়েব জানেন। আকাশের খবর বলতে পারেন।’
কেউ কেউ বলল, ‘তিনি ইমাম মেহদী।’ কেউ বলল, ‘তিনি মুসা (আ.)।’ আবার অনেকের ধারণা তিনিই হযরত ইসা (আ.)। তিনি যেই হোন একজন দরবেশ। পাপীদের সাথে দেখা দেন না, কেবলমাত্র মন পবিত্র করে গেলেই তাকে দেখা যায়। দু’একজন বলেই ফেলল, ‘তিনি মৃতকে জীবিত করতে পারেন।’
এসব রহস্যময় গল্প মানুষকে পড়োবাড়ির দিকে টানতে লাগল। ভয়ংকর স্থানে শুরু হল মানুষের আনাগোনা। ভেতরে গুহার মত কক্ষে ঢোকার আঁকাবাঁকা পথ। একটা বিশাল কক্ষের ছাদ অনেক উঁচু। ছাদে মাকড়সার জাল। কিন্তু ফুলের সুবাসে ম,ম করছে। কোথাও নীচের দিকে নেমে গেছে সিঁড়ি। পাতালপুরীতে গিয়ে শেষ হয়েছে শেষ ধাপ।
এসব প্রাসাদ ছিল ফারাওদের। ওরা নিজেরা খোদার আসনে বসেছিল। ওদেরকে সবাই দেখতে পেত না। মানুষকে এ প্রাসাদে একত্রিত করে শুধু কণ্ঠ শোনানো হতো। বড় কক্ষে মিশে ছিল এক সুড়ং মুখ। সুড়ংয়ের অপর প্রান্ত থেকে কথা বলা হত। কে কথা বলছে লোকেরা তা দেখত না, শুধু কণ্ঠ শোনা যেত।
এ শব্দটি খোদার কণ্ঠ ভেবে তৃপ্তি পেত মানুষ। বড় কক্ষে ছিল পর্যাপ্ত আলো। কোন প্রদীপ ছিল না। এ জন্য আয়না ব্যবহার করা হত। আলোর প্রতিবিম্ব কক্ষে এসে পড়ত। খোদাই নুরের এ কারিশমা দেখে হতবাক হয়ে যেত মানুষ।
শত শত বছরের সেই পুরনো পদ্ধতি ফিরে এল আবার। মানুষ সুড়ংয়ের শব্দকে খোদার শব্দ মনে করে মোহিত হল। দূর হয়ে গেল পড়োবাড়ির ভয়। অনেক পথ ঘুরে বিভিন্ন কক্ষ পেরিয়ে যেতে হত বড় কক্ষে। সবগুলো কক্ষে ছিল কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা। ইথারে ভেসে বেড়াত একটি কণ্ঠ। ‘আমি তোমাদেরকে আঁধার থেকে আলোতে নিয়ে এসেছি। মরে গেছে ফেরাউনের আত্মা। খোদার নূর দেখ। এ হল কোহে নূরের জ্যোতি। মুসা এ জ্যোতিই দেখেছিলেন। ঈসা (আ.) কে এ নূর জ্যোতিষ্মান করবে। আল্লাহ্কে ভয় কর। মুখে কালিমা পড়।’
হতবাক হয়ে লোকজন পরস্পরের দিকে চাইত। গুণ গুণ করে কালিমা পড়ত সবাই।
ইথারের শব্দে মুসা, ইসা এবং কালিমার কথা না থাকলে মানুষ হয়ত বিশ্বাস করত না। এরা সবাই মুসলমান। ধর্মের নামে ওরা সব কথাই বিশ্বাস করছে। ইথারে গুঞ্জরিত হল দ্বিতীয় কণ্ঠ, ‘আমাদের নবী (সা.) অন্ধকার হেরা গুহায় আল্লাহ্কে দেখেছিলেন। তোমরাও অন্ধকার কক্ষে আল্লাহ্কে দেখতে পাবে।
ভক্তির আবেশে মাথা নোয়াল সবাই। যিনি পথিকদের উট, খাবার এবং স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছেন এরা তার কাছে যেতে চাইছে। যিনি মৃত্যুকে জীবন দিতে পারেন, এরা তাকে দেখতে চায়।
মানুষের আগ্রহ এবং সেই সাথে উৎকণ্ঠা বেড়ে যাচ্ছিল। ওরা যখন বাড়ি ফিরল, মহিলারা বলল, ‘একজন অপরিচিত লোক এসে দরবেশের অলৌকিক কাজের বর্ণনা দিয়েছে। ওরা নাকি দরবেশকে দেখেছে।’
বড় মসজিদের ইমামের কাছে গিয়ে লোকজন দরবেশ সম্পর্কে প্রশ্ন করল। ইমাম সাহেব বললেন, ‘তিনি একজন পবিত্র মানুষ। হযরত ঈসার বাণী নিয়ে এসেছেন। ঈসার বাণী হল ভালবাসা আর সম্প্রীতির শিক্ষা। তিনি যুদ্ধ বিগ্রহ করতে নিষেধ করেছেন। বলেছেন, কাউকে আহত করোনা বরং আহত ব্যক্তির চিকিৎসা কর। তোমরা এ নিয়ম মেনে চললে দরবেশ বাবা অবশ্যই তোমাদের সাথে দেখা দেবেন।’ ইমাম সাহেবের মুখে শোনার পর দরবেশ সম্পর্কে মানুষের মনে আর কোন সন্দেহ রইল না। দলে দলে লোক পড়োবাড়িতে যেতে লাগল। দরবেশ ঘোষণা করল, ‘শুধুমাত্র বৃহস্পতিবার রাতে লোকজন এখানে আসতে পারবে।’
সে অনুযায়ী প্রতি বৃহস্পতিবার বাবার সাথে দেখা করার দিন ধার্য করা হল। পুরুষের সাথে মেয়েরাও ওখানে যেতে লাগল। এখন কেউ ইচ্ছে মত পড়োবাড়িতে যেতে পারে না। দূর-দূরান্ত থেকে উট, ঘোড়া আর খচ্চরে চেপে আসতে লাগল। রহস্য ঘেরা পড়োবাড়ির বাইরে বৃহস্পতিবার আসার অপেক্ষায় বসে থাকে দর্শনার্থী।
ভেতরের চিত্রও বদলে গেল। আলো আঁধারীতে পাপী আর পূণ্যবানের ছবি দেখানো হল। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখতো পাপীর ছবি শূন্যে ভাসছে, শাস্তি পাচ্ছে।
সূর্য ডোবার সাথে সাথেই খুলে যেত রহস্যে ভরা সুড়ং মুখ। সুড়ংটি মুলতঃ প্রাসাদের ভেতরকার প্যাসেজ। দু’পাশের দেয়ালে ছোট ছোট খুপড়ি। সুড়ং পথ দশজন পরে পরে ডানে বায়ে মোড় নিয়েছে। সুড়ং মুখে দাঁড়িয়ে থাকে দু’জন লোক। পাশে খেজুরের স্তূপ। মনে হত দর্শকদের দেওয়া খেজুরের তোহফা এখানে জমা করা হচ্ছে। খেজুরের পাশে পানির মশক। সুড়ং পথে যেতে চাইলে দর্শনার্থীদেরকে দুটো খেজুর এবং কয়েক ঢোক পানি দেওয়া হয়।
অন্ধকার সুড়ং পেরিয়ে এরা পৌঁছত আলো ঝলমলে বিশাল কক্ষে। ওখানে ভেসে আসত গায়েবী আওয়াজঃ ‘ কালিমা পড়, আল্লাহ্কে স্মরণ কর। হযরত মুসা এসেছেন। ঈসা (আ.) আসবেন। মন থেকে পাপ এবং শত্রুতা মুছে ফেল। যুদ্ধ বিগ্রহের কথা ভুলে যাও। বেহেস্তের লোভ দেখিয়ে যাদের দিয়ে সুদ্ধ করানো হয়েছিল তাদের পরিণতি দেখে নাও।
দর্শনার্থীদেরকে একদিকে মুখ করে দাঁড় করানো হত। শব্দ শেষ হলেই ছুটে আসত চোখ ধাঁধানো তীব্র আলো। একটু পর সে আলো কমে আসত ধীরে ধীরে। তারপর আবার তীব্র আলোতে ভরে যেত ঘর।
এভাবে কয়েকবার আলোতে খেলা চলার পর সামনের দেয়ালে ভেসে উঠত অসংখ্য ছবি। ধ্বনিত হত গায়েবী আওয়াজঃ ‘এরাও তোমাদের মতই যুবক এবং সুন্দর ছিল। খোদার বিধান মানেনি। কোমরে তরবারী ঝুলিয়ে ঘোড়ায় চেপে খোদার সৃষ্ট মানুষ হত্যা করেছে। ওদের ধোকা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছিল তোমরা যুদ্ধ করে শহীদ হলে স্বর্গ পাবে। ওদের পরিণতি দেখো। খোদা ওদেরকে শয়তানের রূপ দিয়েছেন।’
এর সাথে শোনা যেত মেঘের গর্জন আর বজ্রের চমক। শোনা যেত বিভিন্ন পশুর শব্দ। চোখ ধাঁধানো আলোয় দর্শকরা চোখ পিটপিট করে তাকাতো দেয়ালের দিকে। ভঙ্কর দাতালো পশুর দল একদিক থেকে অন্য দিকে যাচ্ছে। শুধু মুখটা মানুষের মত, বাকী সব ভয়ঙ্কর হায়নার মত।
একটু পর দেখা গেল, ওরা দু’বাহুতে জড়িয়ে রেখেছে দুই উলংগ সুন্দরী যুবতী। ছাড়া পাওয়ার জন্য তড়পাচ্ছে যুবতীরা। বজ্রের শব্দ ছাপিয়ে গম্ভীর কণ্ঠ ধ্বনিত হল, ‘এদের ছিল রূপের অহংকার। খোদার দেওয়া সৌন্দর্য সুষমাকে এরা অপবিত্র করেছে।’
এরপর দেয়ালে ভেসে বেড়াত সুন্দর যুবক আর রূপসী রমণীর দল। প্রাণোচ্ছল, হাসিখুশি। গায়েবী শব্দ তুলে ধরত এদের পরিচয়। এসব যুবক যুবতী যুদ্ধ বিগ্রহে যায়নি। মানুষকে শুনিয়েছে প্রেম ও ভালবাসার বাণী। কেউ কারো মনে আঘাত দেয়নি। ওরা সন্তুষ্ট করেছে মানুষকে, আল্লাহও ওদের প্রতি সন্তুষ্ট তাই।
এরপর ওদের নিয়ে যাওয়া হত অন্য একটি কক্ষে। ওখানে ছিল মৃত মানুষের হাড়গোড়। সুন্দরী যুবতীরা এদিক ওদিক হাঁটছে। ঠোঁটে মিষ্টি হাসির ঝিলিক।
একটু পর ভেসে আসত গায়েবী শব্দঃ ‘হযরত ঈসা আসছেন। যুদ্ধ বিগ্রহ এবং ঘৃণা বিদ্বেষ মন থেকে মুছে ফেল। খলিফা আল আযেদ পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন।
দৃষ্টিকাড়া রূপসীদের দিকে তাকিয়ে থাকতো দর্শকরা। কিন্তু ওদের বের করে দেওয়া হত অন্য পথে। দর্শকদের মনে হত এইমাত্র ওরা স্বপ্ন দেখে জেগে অনভূতিতে ভরা। ওরা আবার ফিরে যেতে চাইত সে স্বপ্নের জগতে। কিন্তু ওদের আর সুড়ং মুখে যেতে দেওয়া হতো না।
লোকজন ওখান থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরে যেতো না কেউ। রাত কাটাতো প্রাসাদের বাইরে পর্বতে, উপত্যকায়। দু’তিন জন বসে ফিস ফিস করে কথা বলত। আল্লাহর বাণী নিয়ে যিনি এসেছেন গায়েবী শব্দ তার। তিনি বললেন, হযরত ঈসা আসছেন। খলিফা আল আযেদ আবার পৃথিবীতে এসেছেন।
আল আযেদের মৃত্যুর পর ফাতেমীরা খ্রিস্টান এবং ঘাতক দলের সাথে মিশে সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। মিসর আক্রমণ করার জন্য সুদানে তৈরী হচ্ছিল শক্তিশালী বাহিনী। দিন দিন পড়োবাড়িড় অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে লাগল। সমগ্র দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে রটে গেল ঈসা (আ.) আসছেন। তিনি আল আযেদকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এরা শপথ নিয়েছে সালাহুদ্দীন র সেনাবাহিনীতে ভর্তি হবে না। যুদ্ধ বিগ্রহ করা মহাপাপ। সালাহুদ্দীন একজন পাপী সম্রাট। সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধির জন্যে তিনি যুবকদের স্বর্গের লোভ দেখিয়ে ফৌজে ভর্তি করছেন।
পোড়োবাড়ি এখন এ অঞ্চলের লোকদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। অনেকে পার্বত্য এলাকায় স্থায়ীভাবে থাকা শুরু করেছে। দরবেশকে একনজর দেখার জন্য এরা বাড়ি ঘর ছেড়ে অপেক্ষার প্রহর গোণে দিনের পর দিন। কখন আসবে সেই শুভ লগ্ন, কথন বাবা দেখা দেবেন। জীবন থেকে মুছে যাবে অভাব, আশান্তি আর মলিনতা।
❀ ❀ ❀ ❀ ❀
আহত বন্দীকে নিয়ে কায়রো পৌঁছলেন আলী বিন সুফিয়ান। বন্দীর নাম আকিল। আলাদা বাড়িতে রেখে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হল। বাড়ির সামনে সেন্ট্রি দাঁড় করিয়ে দিলেন আলী।আকিল তখনও সুস্থ হয়নি, সে-ই পড়োবাড়ির ঠিকানা দিয়েছিল। সিদ্ধান্ত হল, আকিল সুস্থ হলে গোয়েন্দা দল তাকে নিয়ে পার্বত্য এলাকায় যাবে। উদ্ধার করবে পড়োবাড়ির রহস্য। আলী কায়রো এসে সহকারী গোয়েন্দা প্রধান হাসান এবং পুলিশ প্রধানকে বললেন ওই এলাকায় যেন কোন লোক পাঠানো না হয়। ওখানকার লোকজনের ভেতর সেনাবাহিনী বিরোধী আবেগ সৃষ্টি করা হয়েছে। আলীর ধারণা ওখান থেকে রহস্যময় ষড়যন্ত্র বের করা যাবে।
আকিলের ধারণা সে মরে যাবে। বিলাপ করছিল সে। নিজের গ্রামের নাম নিয়ে বলছিল, ‘আমার বোনকে এলে দাও। আমি এ জীবনে ওকে আর কোনদিন দেখতে পাব না।’
তার এ দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছিলেন আলী বিন সুফিয়ান। তিনি বন্দীর কাছ থেকে সব গোপন কথা বের করার চেষ্টা করছিলেন। লোকটি বোনের জন্য আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল। একে একে সবকিছুই বলে দিল আলীর কাছে। গোয়েন্দা প্রধান বুঝলেন ওর কাছে আর কোন তথ্য নেই। দু’জন দূতকে ডাকলেন আলী। আকিলের গাঁয়ের ঠিকানা, বোনের নাম ধাম দিয়ে বললেন, ‘ওর বোনকে সাথে নিয়ে আসবে। মিসরের দক্ষিণ পশ্চিমে ওর বাড়ি।’
দূত দু’জন সাথে সাথে ঘোড়ায় চেপে বসল।
সুবাক দুর্গে পৌঁছে গেছেন সুলতান সালাহুদ্দীন। তাকে হত্যা করার জন্য এত বড় একটা আক্রমণ হল চেহারায় উদ্বেগের চিহ্ন মাত্র নেই। রক্ষীদের কমাণ্ডার এবং কর্মকর্তাদের নির্ঘুম রাত কাটে। ভয়ে তটস্থ থাকে সবাই। এই বুঝি সুলতান তাদেরকে ডেকে বলবেন, কেন এমনটি হল? শাস্তি না দিলেও অন্যত্র বদলি করে দিবেন। কিন্তু সুলতান নির্বিকার। এ প্রসঙ্গের ধারে কাছেও গেলেন না। কেন্দ্রীয় সেনা নেতৃবৃন্দকে ডেকে বললেন, ‘আপনারা দেখেছেন আমার জীবনের কোন ভরসা নেই। আমার যুদ্ধের চাল আপনাদের গভীরভাবে বুঝে নিতে হবে। শত্রুরা আরেকটা রণক্ষেত্র তৈরী করেছে। ওদের গুপ্তচরদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবেন। আমাদের গোয়েন্দাদের কেউ কি ফিরে এসেছে?’
‘মহামান্য আমীর। দু’জন গোয়েন্দা কর্মী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে এসেছেন।’ একজন সেনা অফিসার বললেন।
সুলতান তাদের ডেকে পাঠালেন। খ্রিস্টানদের সমস্ত পরিকল্পনা সুলতানকে অবহিত করা হল। নূরুদ্দীন জঙ্গীর পাঠানো ফৌজের সালার এবং মিসর থেকে আসা ফৌজের সালারকে আসতে বলে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন।
চারদিন পর আকিলের বোনকে নিয়ে দূত কায়রো ফিরে এল। সাথে চারজন লোক। ওরা বন্দীর চাচা এবং চাচাত ভাই। বোনটি মনকাড়া সুন্দরী। তার চোখে মুখে উদ্বেগের চিহ্ন। সেই আকিলের একমাত্র বোন। বাবা মা নেই ওদের।
বন্দীর সাথে দেখা করতে চাইল ওরা। আলীর অনুমতি প্রয়োজন। বোনকে অনুমতি দিলেন গোয়েন্দা প্রধান। সঙ্গীরা অনেক অনুরোধ করল। বলল, ‘আমরা তার সাথে কথা বলব না। এক নজর দেখেই চলে আসব।’
অনুমতি মিলল। কিন্তু সঙ্গে রইলেন আলী। পাঁচজনকেই বন্দীর কাছে নেওয়া হল। আকিলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েটা। ভায়ের চোখে মুখে চুমো খেয়ে কাঁদতে লাগল।
‘এদের সাথে হাত মেলাও।’ চাচা এবং চাচাত ভাইকে দেখিয়ে বললেন আলী।
করমর্দনের পর ওদের বের করে দেওয়া হল। আলী বললেন, ‘এর সাথে আর কখনও দেখা করতে পারবে না, এবার তোমরা বাড়ি যেতে পার।’
গাঁয়ের পথ ধরল ওরা। মেয়েটা আলীর পায়ের কাছে বসে পড়ল।
‘আমার ভায়ের সেবা-শুশ্রূষা করার সু্যোগ দিন।’ অনুরোধ ঝরে পড়ল যুবতীর কণ্ঠ থেকে।
বোনের এ আবেগ ফেলতে পারলেন না আলী। একজন মহিলাকে ডেকে বললেন, ‘ওর দেহ তল্লাসী কর।’
দেহ তল্লাশী করা হল। এরপর মেয়েটাকে বন্দীর কাছে রেখে সবাই ফিরে গেলেন। কক্ষে ভাই-বোন ছাড়া কেউ নেই। কি হয়েছে জানতে চাইলে ভাই সব ঘটনা খুলে বলল।
‘এখন ওরা আপনার সাথে কেমন ব্যবহার করবে?’
‘সুলতানের হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করেছি, এ অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। অনুগ্রহ করে মৃত্যুদণ্ড না দিলেও আজীবন কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
‘তবে কি আপনাকে আর কোন দিন দেখতে পাব না?’
‘না শারজা।’ বেদনা মাথা কণ্ঠে বলল আকিল। ‘কারাগারে আমি মরবও না আবার বাঁচবও না। কারাগার অত্যন্ত ভয়ংকর স্থান।’
শিশুর মত ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদতে লাগল শারজা। ‘আমি তখনই আপনাকে বাঁধা দিয়েছিলেম। এসব লোকের পাল্লায় পড়তে। কিন্তু আপনি বললেন সালাহুদ্দীন কে হত্যা করা বৈধ। আপনি ওদের লোভের ফাঁদে পা দিলেন। আমার কথা একবারও ভাবলেন না। এখন আমার কি হবে? আপনি ছাড়া কে আশ্রয় দেবে আমায়?’ আকিলের ভেতর চলছিল মানসিক দ্বন্দ্ব। কখনও ওর কণ্ঠে ধ্বনিত হত অনুশোচনা, ‘ওদের ফাঁদে পা দিয়ে ভুল করেছি। শারজা! সালাহুদ্দীন মানুষ নয়, ফেরেস্তা। আমরা চারজন তাগড়া যুবক তার কিছুই করতে পারিনি। একটু আঁচড়ও লাগেনি তার দেহে। অথচ শূন্য হাতে সে একা আমাদের তিনজনকে মেরে ফেলল। আর আমি মৃত্যুর দুয়ারে।’
‘লোকে যে বলে, সালাহউদ্দীনের ঈমান অত্যন্ত মজবুত। কোন পাপী তাকে হত্যা করতে পারে না, এ কথা তাহলে মিথ্যে নয়। আপনারা চারজনই মুসলমান। তাকে মারতে যাওয়ার আগে একবারও ভাবলেন না, সালাহুদ্দীন একজন মুসলিম।
‘সালাহুদ্দীন খলিফাকে অপমান করেছে।’ আকিলের কণ্ঠে উত্তেজনা। ‘তুমি জান না আল আযেদ আল্লাহর খলিফা।’
‘খলিফা যেই হোন আর সালাহুদ্দীন তার সাথে যে ব্যবহারই করুক তাতে আমার কুছু যায় আসে না। কিন্তু এখন আপনি যে আপনার একমাত্র বোনকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য আলাদা হয়ে যাচ্ছেন, এর থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোন উপায় বের করা যায় না না?’
‘হয়ত যায়। আমার শাস্তি মওকুফ করার আশ্বাস পেয়েই সব গোপন তথ্য প্রকাশ করেছি। কিন্তু আমার পাপ এত মারাত্মক যে ক্ষমা না-ও করতে পারে।
এতক্ষণে আকিলের ঘুমিয়ে পড়া উচিৎ ছিল। কিন্তু বোনকে কাছে পেয়ে আবেগে ও উত্তেজনায় অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল সে। এতে পেটের ক্ষতস্থানের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তবুও কথা বন্ধ করল না বন্দী।
হঠাৎ ক্ষতস্থানে ব্যথা হতে লাগল। পেট চেপে ধরে বোনকে বলল, ‘শারজা! সম্ভবত আমি মরে যাব। বাইরে লোক আছে, ওকে বল ডাক্তার ডেকে দিতে।’
ছুটে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল শারজা। বেরোতেই সামনে পড়ল এক সেন্ট্রির, বাইরে দাঁড়িয়ে অও পাহারা দিচ্ছিল। শারজা বলল, ‘রোগীর অবস্থা খারাপ। প্লিজ, একটু একটু দেখুন।’
সেন্ট্রি শারজাকে ডাক্তারের বাসা দেখিয়ে বলল, ‘আমি যেতে পারছি না, ডাক্তারকে বললেই তিনি চলে আসবেন।’
কাছেই ডাক্তারের বাসা। শারজা তাকে ভায়ের কথা জানাল। ডাক্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, বন্দীকে বাঁচিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। দৌড়ে বন্দীর কাছে পৌঁছলেন ডাক্তার। পেটের ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বন্দীকে দ্রুত রক্তক্ষরণ বন্ধ হওয়ার ঔষধ খাওয়ানো হল। তারপর ডাক্তার অনেক সময় নিয়ে পুরনো ব্যান্ডেজ খুলে নতুন ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন।
ঔষধের প্রভাবে আকিল ঘুমিয়ে পড়ল। অবাক চোখে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে রইল শারজা।
সুদর্শন যুবক ডাক্তারের জন্য তার হৃদয়ে সৃষ্টি হতে লাগল শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় মিশ্রিত অনুভূতি। এত রাতে একজন অপরাধীকে চিকিৎসা করার জন্য ব্যস্তসমস্ত হয়ে ডাক্তার ছুটে আসবেন, শারজা এতটা আশা করেনি। ব্যান্ডেজ বাধার সময় ডাক্তারের আন্তরিকতা ও লক্ষ্য করেছে। ব্যান্ডেজ শেষে দু’হাত ওপরে তুলে ডাক্তার অনুচ্চকণ্ঠে রোগীর জন্য প্রার্থনা করলেন। ‘জীবন এবং মৃত্যুতো তোমারই হাতে প্রভু! এ হতভাগাকে রহম কর। মালিক আমার, ওর জীবন ফিরিয়ে দাও। সুস্থ করে দাও ওকে।’
শারজার চোখ ভিজে উঠল। ডাক্তারের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল ওর মন। হাটু গেড়ে বসে ডাক্তারের দু’হাতে চুমো খেল শারজা।
‘বন্দীর সাথে তোমার সম্পর্ক কি?’ ডাক্তারের প্রশ্ন করলেন।
‘আমি ওর বোন। ডাক্তার সাহেব! আমার ভায়ের জন্য আপনাদের এত দরদ, এ ভালবাসা কেন? তিনি আপনাদেরকে সব গোপন কথা বলে দিয়েছেন এই জন্য কি তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছেন?’
‘ও কাকে কি গোপন তথ্য দিয়েছে তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। আমি ডাক্তার। ওকে সুস্থ করে তোলা আমার কর্তব্য। আমার কাছে মুমিন আর অপরাধীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।’
‘ও কি অপরাধ করেছে হয়ত আপনি জানেন না। জানলে ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ না করে ওখানে লবণ ছিটিয়ে দিতেন।’
‘আমি সব জানি। তবুও আমি ওকে বাঁচিয়ে রাখার সব চেষ্টা করব।’
শারজা ডাক্তারের কথায় প্রভাবিত হয়ে নিজের সব কথা ওকে খুলে বলল।
‘বাবা-মা মারা গেছেন, আমি তখন খুব ছোট। ভায়ের বয়স দশ কি এগার। তিনিই আমায় লালন-পালন করেছেন। আমি যুবতী হয়েছি। ভাইজান না থাকলে কেউ আমাকে হয়ত অপহরণ করে নিয়ে যেত। তিনি তার জীবন আমার জন্য উৎসর্গ করেছেন।’
গভীর মনযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছেন ডাক্তার। ওদের কথার শব্দে আহত লোকটা জেগে উঠতে পারে ভেবে দু’জন বারান্দায় চলে এলেন। অনেকক্ষণ পর যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তার। হাত ধরল শারজা, ‘আপনি চলে গেলে আমার ভয় করবে।’
‘কিন্তু তোমাকে আমি সাথে নিতে পারছি না, কারণ আমি একা থাকি। আবার এখানে তোমার সাথে রাতও কাটাতে পারছি না। ঠিক আছে, আরো কিছুক্ষণ থাকি।’
আবার বসে পড়লেন ডাক্তার। কথায় কথায় রাতের দুই প্রহর কেটে গেল। ডাক্তার শেষরাতে বাসায় ফিরলেন। পরদিন সূর্য উঠার আগেই আহত বন্দীকে দেখার জন্য আবার ফিরে এলেন ডাক্তার। নতুন করে ওষুধ দিয়ে ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। বন্দীকে দুধ এবং খাবার দেওয়া হল। হতবাক চোখে তাকিয়ে রইল শারজা। এমন খাবার কেউ বন্দীকে দিতে পারে ও জীবনে কখনও কল্পনাও করেনি।
নাস্তা খাওয়ার কিছুক্ষণ পর এলেন আলী বিন সুফিয়ান। বন্দীকে দেখে ফিরে গেলেন আলী। থেকে গেলেন ডাক্তার।
শারজা আবার কথার ঝাপি খুলে দিল। তার জীবন-পাতা মেলে ধরল ডাক্তারের সামনে। অনেক বেলা করে ঘরে ফিরলেন ডাক্তার।
আকিল লক্ষ্য করল, সন্ধ্যা পর্যন্ত ডাক্তার তিন বার বন্দীকে দেখতে এসেছেন, অথচ আগে দিনে একবারের বেশী আসতেন না। ডাক্তার ফিরে গেলে আকিল বোনকে বলল, ‘শারজা! এই ডাক্তারের হাতে আমার জীবন। বুঝতে পারছি তোমাকে দেখার পর সে আমার চিকিৎসার ব্যাপারে বেশী আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমি মরতে রাজি, কিন্তু ও তোমার কাছে যা চায় তা হতে দেব না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার জীবনের বিনিময়ে ও তোমার ইজ্জত নষ্ট করতে চাইছে।’
‘আপনি কি বলছেন ভাইয়া! আমি তো তাকে ফেরেস্তার মত পবিত্র মনে করি। আমি বড় হয়েছি। সবকিছু বুঝার বয়স হয়েছে। এই পর্যন্ত সে খারাপ ইশারা তো দূরের কথা, খারাপ কোন কথাও বলেনি। তার সাথে অনেক কথা বলেছি। তাকে আমার খারাপ মনে হয়নি।’
শারজার কথায় দ্বন্ধের মধ্যে পড়ে গেল আকিল। ডাক্তারের প্রতি তারও আগ্রহ বেড়ে গেল।
❀ ❀ ❀ ❀ ❀