সুলতান যতশীঘ্র সম্ভব রণক্ষেত্রে ফিরে যেতে চাইছিলেন। তাঁর আশংকা ছিল তাঁর অনুপস্থিতিতে খ্রিস্টান বাহিনী কোন পদক্ষেপ না নিয়ে বসে। নূরুদ্দীন জঙ্গীর পাঠানো সেনা সাহায্য ওখানে পৌঁছেছে। যাচ্ছে কায়রো থেকে পাঠানো ফৌজ। দু’দলকেই রণক্ষেত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে।
নিজের অফিসে গিয়ে ছোট ভাই, হাসান, পুলিশ প্রধান এবং আরও ক’জন পদস্থ কর্মকর্তাকে নিয়ে মিটিংয়ে বসলেন। তিনি তকিউদ্দীনকে মিসরের ভারপ্রাপ্ত গভর্নর এবং এখানকার সেনাপ্রধান ঘোষণা করলেন। বললেন, ‘আমার মতই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার সমস্ত ক্ষমতা তকীউদ্দীনকে দেওয়া হল।’
‘তকী উদ্দীন’, সুলতান বললেন, ‘তুমি আমার ভাই, এ কথা আজ থেকে মন থেকে মুছে ফেল। অযোগ্যতা, বিশ্বাস ভংগ, গাদ্দারী, ষড়যন্ত্র, দুর্বলতা, দায়িত্বে অবহেলা এবং শাস্তি ইসলামের বিধান অনুযায়ী তুমি পাবে।’
‘দায়িত্ব এবং কর্তব্য সম্পর্কে আমি ওয়াকিফহাল সম্মানিত আমীর’, তকীউদ্দীন বললেন, ‘মিসরের আকাশে বিপদের যে কাল মেঘ ঘনিয়ে আসছে তা আমি অবহিত।’
‘শুধু মিসর নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্ব বিপদের সম্মুখীন। এ ঝড় ইসলাম এবং মুসলিম সালতানাত বিস্তারের ক্ষেত্রে সবচে বড় বাধা। একটা কথা সবসময় মনে রেখ, মুসলিম বিশ্ব কোন একক জায়গায় নয়, কারো বাপ-দাদার সম্পত্তি নয়। এ জমিন আল্লাহর, আমরা সবাই এর রক্ষক। এ ভূমির প্রতিটি ধূলিকণা আমাদের কাছে আমানত। এ ভূমির মাটি ব্যবহার করার পূর্বে ভাবতে হবে তুমি কি কারও অধিকার খর্ব করছ? আল্লাহর দেওয়া আমানতের খেয়ানত করছ না তো? আমার কথা মন দিয়ে শোন তকি, বড় দুর্ভাগ্য হল, ইসলামের অনুসারীদের মধ্যেই গাদ্দার আর ষড়যন্ত্রকারীদের সংখ্যা বেশী। মুসলিম জাতি যত বিশ্বাসঘাতকের জন্ম দিয়েছে, অন্য কোন জাতি তা দেয়নি। এমনকি আমাদের গৌরবোজ্জ্বল জিহাদের ইতিহাসও বিশ্বাসঘাতকতার কালিতে কলংকিত। আলীকে জিজ্ঞেস করে দেখ, ওর গোয়েন্দারা খ্রিস্টান এলাকায় গুপ্তচর বৃত্তিতে লিপ্ত। তাদের রিপোর্ট হল- খ্রিস্টান শাসক, ধর্মীয় গুরু এবং সমাজের নেতারা জানেন মুসলমানরা নারী পাগল এবং ক্ষমতা লিপ্সু। নারী, ক্ষমতা এবং অর্থের জন্য এরা ধর্ম, দেশ এবং স্বীয় জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে পিছপা হয়না।
সুলতান উপস্থিত সকলের প্রতি দৃষ্টি বুলিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘আমাদের গোয়েন্দা বলেছে, খ্রিস্টান গুপ্তচরদের ট্রেনিং দেয়ার বলা হয়, মুসলিম ইতিহাসে যত বিজয় রয়েছে বিশ্বাসঘাতকতাও সে পরিমাণে। ওরা ততগুলি বিজয় লাভ করেনি যত গাদ্দার তৈরী করেছে। আল্লার রসূলের ওফাতের পর ওরা নিজেদের মধ্যে নিজেরাই খেলাফতের জন্য যুদ্ধ করেছে। খলিফার বিরুদ্ধবাদীরা ইসলামের শত্রুর সাথে হাত মিলিয়েছে। গদীকে নিষ্কণ্টক করার জন্য নেতাদের হত্যা করেছে। এভাবেই নিঃশেষ হয়ে গেল আমাদের জাতীয় চেতনা। দেশ জুড়ে চলল ব্যক্তি পূজার জয় জয়কার। সংকীর্ণ হয়ে এল বিশাল মুসলিম সালতালাত। শেষ হয়ে গেল মুসলমানদের প্রতিরোধ শক্তি। খ্রিস্টান জাতি আমাদের এ দুর্বলতার কথা জানে। মুসলমান ক্ষমতার জন্য দেশের বিশাল এলাকা ছেড়ে দিতেও প্রস্তুত। যুগে যুগে সে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
আমার বন্ধুরা। অতীত ইতিহাস আর বর্তমানকে যখন দেখি- আমার ভয় হয়, এমন এক সময় আসবে যখন এরা নিজের ইতিহাসের সাথেও বেঈমানী করবে। ঐতিহাসিকগণ লিখবেন, মুজাহিদরা দেশ এবং জাতির জন্য বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছে। ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে শত্রুর সব পরিকল্পনা। অথচ গোপনে ওদের কিছু সংখ্যক সঙ্গী শত্রুর সাথে বন্ধুত্ব করেছে। পরাজয়কে ঢেকে দিয়েছে মিথ্যার আড়ালে। সংকীর্ণ করেছে মুসলিম রাষ্ট্রের সীমানা।
বন্ধুরা, রাষ্ট্র প্রধান এর দায়দায়িত্ব অন্যের কাঁধে চাপানোর চেষ্টা করবেন। একদল মুসলমান থাকবে যারা হবে শ্লোগান সর্বস্ব। কেউবা গর্বের সাথে দুশমনের শ্লোগান অনুকরন করবে। এরা হবে আপন ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞ। ইসলামের পতাকাবাহীগণ দ্বীন ও ঈমান রক্ষার জন্য বিশাল মরু, পাহাড়, উপতাক্য আর দুরদেশে গিয়ে গিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, ওদেরকে একথা বলার মতও কেউ থাকবে না। এদের পূর্ব পুরুষ ঝড়-ঝঞ্ছার মধ্যে উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন, সমুদ্রের ভয়ংকর ঝড় তাদের গতি রোধ করতে পারেনি, ওরা এমন স্থানে গিয়ে যুদ্ধ করেছে যেখানে পাথরও ছিল ওদের শত্রু। ওরা যখন ক্ষুৎপিপাসায় অধীর এবং অস্ত্র ও ঘোড়া শূন্য তখনও যুদ্ধ করেছে। আহত হয়ে সহযোদ্ধাদের ব্যান্ডেজ করার সুযোগ দেয়নি, পান করেছে শাহাদাতের অমীয় সুধা, কিন্তু কবর খুড়ে সময় নষ্ট করার সুযোগ দেয়নি সঙ্গীদের। মরুর বালি সিক্ত হয়েছে নিজের এবং শত্রুর রক্তে। অন্যদিকে ওদের শাসক দল রাজপ্রাসাদের মধ্যে অকুণ্ঠ ডুবেছিল। উপভোগ করছিল উলংগ নৃত্য। ইহুদীরা যুবতীর রূপ আর সোনার মোহর দিয়ে ঠুলি এঁটে দিয়েছিল ওদের চোখে।
শাসকগণ যখন দেখলেন জনগণ যোদ্ধাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, ওদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া শুরু করলেন। যে বীররা ইউরোপ থেকে ভারত পর্যন্ত উড্ডীন করলেন ইসলামের পতাকা তাদের জন্য রসদের যোগান বন্ধ করে দেওয়া হল। কাসেমের যুবক সন্তানটির কথা আমি ভুলতে পারি না। ভারতের অত্যাচারী এক শক্তিধর শাসককে পরাজিত করে সে দখল করে নিয়েছিল তার রাজ্য। শাসকদের কাছে কোন সাহায্য চায়নি। তার সুন্দর ব্যবস্থাপনায় জনগণ প্রীত হল। তার ভালোবাসায় মুগ্ধ হল ভারতবাসী। ইসলাম গ্রহণ করল অনেকেই। খলিফা তার সাথে কি ব্যবহার করেছিলেন! ব্যভিচারের অপবাদ দিয়ে তাকে দেশে ডেকে পাঠানো হল। হত্যা করা হল এক বর্বর পন্থায়।’
কান্নায় গমকে হারিয়ে গেল সুলতানের ভাষা। নীরব হলেন তিনি। হাজার হাজার শহীদের লাশ দেখলে সুলতানের চোখে ফুটে উঠত অপার্থিব আলো। কিন্তু একজন গাদ্দারের মৃত্যুদেহ দেখলে কেঁদে ফেলতেন।
নীরবতা ভেঙ্গে সুলতান আবার বললেন, ‘মুহম্মদ বিন কাশিমকে নিজের জাতি হত্যা করলেও শত্রুরা তাকে বিজয়ী হিসেবে বরণ করে নিয়েছে।’ বলতে বলতে আবারো আবেগপ্রবণ হয়ে পরলেন সুলতান। অথচ তিনি ছিলেন বাস্তববাদী। তিনি অতীতকে ভুলতেন না, তবে তার দূরদৃষ্টি আটকে থাকত সোনালী ভবিষ্যতের প্রচ্ছদপটে।
‘খ্রিস্টানদের দৃষ্টি আমাদের ভবিষ্যতের ওপর নিবদ্ধ। ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার সংকল্প নিয়ে মাঠে নেমেছে খ্রিস্টান শাসক এবং সেনাপতিরা। ওরা আমাদের দেশ নয় দখল করতে চায় আমাদের ঈমান। আমাদের গোয়েন্দারা বলেছে, ইসলামের সবচে বড় দুশমন সম্রাট ফিলিপ অগাস্টাস এর কথা হচ্ছে, “আমার জাতির একটা বড় উদ্দেশ্য রয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ উদ্দেশ্য সাধনে তৎপর থাকবে। এ বিজয় তরবারীর জোরে হবে এমন কোন কথা নেই। ওদের চিন্তা চেতনা এবং সংস্কৃতি বদলে দিতে পারলেই আমরা বিজয়ী।”
‘তকীউদ্দীন, খ্রিস্টানদের মত আমাদের দৃষ্টিও ভবিষ্যতের ওপর নিবদ্ধ থাকবে। ওরা আমাদের মধ্যে গাদ্দার তৈরী করছে। আমরা গাদ্দারীর জীবাণু চিরদিনের জন্য নিঃশেষ করে দেব। গাদ্দার হত্যা করলেই এ পথ রুদ্ধ হবে না বরং বন্ধ করতে হবে গাদ্দার তৈরীর সকল পথ। মানুষের মধ্যে শুধু আল্লাহ্ এবং নবীর ভালবাসা সৃষ্টি করলেই এ পথ বন্ধ হবে। মানুষকে বুঝতে হবে খ্রিস্টানদের সভ্যতা সংস্কৃতি আর আমাদের সভ্যতা সংস্কৃতি এক নয়। বেলেল্লাপনা এবং উলংগ নৃত্য ওদের সংস্কৃতি। মদ এবং ব্যভিচার ওদের কৃষ্টি। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ওদের সৌন্দর্য। ওদের আর আমাদের মাঝে বড় পার্থক্য হল, আমরা ইজ্জত-আব্রুর রক্ষক আর ওরা তা দিয়ে ব্যবসা করে। আমাদের মুসলমান ভায়েরা এ পার্থক্য মুছে দিচ্ছে। তকি! তোমাকে বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ দুটো ক্ষেত্রেই যুদ্ধ করতে হবে। সামনাসামনি যুদ্ধ করবে শত্রুর সাথে, অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ করবে নিজেদের প্রতিকূলে। আমাদের মধ্যে গাদ্দার তৈরী না হলে এতদিনে আমরা থাকতাম মধ্যে ইউরোপে। ওরা আমাদের বিরুদ্ধে সুন্দরী যুবতিদের পরিবর্তে ব্যবহার করত অন্য অস্ত্র।
ঈমান দৃঢ় হলে তার আগুনে পুড়ে মরতো সমগ্র খ্রিস্টান জগত।’
‘আপনি কি সমস্যায় রয়েছেন এখানে এসে বুঝতে পেরেছি।’ তকিউদ্দীন বললেন। ‘আপনি যে গাদ্দারদের বেষ্টনীর মধ্যে আছেন হয়ত নুরুদ্দীন জঙ্গীও তা জানেন না। তার কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠালে ভাল হয় না?’
‘তকি, ভাই আমার! সাহায্য শুধু আল্লাহর কাছ থেকে চাইতে হয়। আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও কাছে সাহায্য চাইতে গেলে ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে। খ্রিস্টান বাহিনী বর্মাচ্ছাদিত। আমার সৈন্যরা সাধারণ কাপড় পরে মাঠে নেমেও ওদের পরাজিত করে। লোহার মত মজবুত ঈমান হলে বর্মের প্রয়োজন নেই। বর্ম এবং পরিখা নিরাপত্তার অনুভূতি সৃষ্টি করে, ফলে সৈন্যরা নিজেই নিজের মধ্যে বন্দী হয়ে পড়ে। মনে রেখো! ময়দানে পরিখার বাইরে থেকে এদিক ওদিক ঘুরে যুদ্ধ করতে হয়। কখনও শত্রুকে পিঠ দেখাবে না, সতর্ক থাকবে যেন শত্রু পেছন থেকে হামলা করতে না পারে। সেনাবাহিনীর কেন্দ্র অক্ষত রেখো। দুপাশে ছড়িয়ে শত্রুকে ঘেরাও করো। কমাণ্ডো বাহিনী ছাড়া যুদ্ধ করো না। কমাণ্ডো বাহিনী শত্রুর কাছে রসদ আসার পথ বন্ধ করে দেবে। শত্রুর বাহন হত্যা করে ওদের ভয় পাইয়ে দেবে। কখনও শক্তি সঞ্চয় না করে নিয়মিত লড়াইয়ে যাবে না। আত্মরক্ষামূলক লড়াই না করে উল্টো সব সময় শত্রুকে ব্যস্ত রাখবে যেন ওরা সুস্থির হতে না পারে। এখানে যে সব সৈন্য রেখে যাচ্ছি ওরা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে এসেছে। এরাই পদানত করেছে সুবাক দুর্গ। শত্রুর চোখে চোখ রেখে যুদ্ধ করেছে ওরা। ভাইকে শহীদ হতে দেখেছে চোখের সামনে। এদের সাথে রয়েছে সে কমাণ্ডো বাহিনী, সামান্য ইশারা পেলে যারা নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে পারে। আমি যাদের রেখে যাচ্ছি ওদের ভেতর রয়েছে ঈমানের অনির্বাণ শিখা। নিজে সম্রাট সেজে ওদের ঈমানের উষ্ণতা নষ্ট করো না।
খ্রিস্টানরা আমাদের ঈমানের ওপর আঘাত করেছে। তীব্র গতিতে মিসরের দিকে ধেয়ে আসছে ওদের অপসংস্কৃতির ঝড়। অপসংস্কৃতির এ ঝড় রোধ করতে না পারলে ঈমান টিকিয়ে রাখা যাবেনা। ফলে সাংস্কৃতিক লড়াই অস্ত্রের লড়াইয়ের মতই গুরুত্বপূর্ণ। একে অবহেলা করে যতই অস্ত্রের লড়াই জারী রাখো বিজয়ের নাগাল পাবে না কখনো। মনে রেখো, সাংস্কৃতিক সীমানা টিকিয়ে রাখতে না পারলে কোন রাজনৈতিক বিজয়ই টিকে থাকে না।’
সুলতান ছোট ভাইকে বুঝিয়ে বললেন, ‘সুদানে মিসর আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। মিসরের পালিয়ে যাওয়া বিদ্রোহী সৈন্যও রয়েছে ওদের সাথে। কিন্তু ঘরে বসে শত্রুর আক্রমণের অপেক্ষা করো না। গোয়েন্দারা সব সময় তোমায় সংবাদ দেবে। গোয়েন্দা উপ-প্রধান হাসান থাকবে তোমার সাথে।
শত্রুর প্রতিটি চাল সম্পর্কে সচেতন থাকবে। প্রতিপক্ষের তৎপরতা ও গতিবিধি সম্পর্কে সব সময় সুস্পষ্ট ধারনা যে কোন বিজয়ের পূর্বশর্ত। যদি মনে কর শত্রু আক্রমণের জন্য প্রস্তুত, সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণ করবে। তবে পেছনের ব্যবস্থাপনা অবশ্যই মজবুত রাখতে হবে।
যুদ্ধ ক্ষেত্র সম্পর্কে জাতিকে অন্ধকারে রেখো না। খোদা না করুক পরাজিত হলে নিজের ভুল স্বীকার করবে। জনগণের সামনে এর কারণ ব্যাখ্যা করবে। সাধারণ মানুষের রক্ত এবং অর্থ দিয়ে যুদ্ধ করা হয়। নিহত বা আহত হয় জাতির সন্তানেরা। এজন্য জাতির আস্থা অর্জন করতে হবে। যুদ্ধকে রাজা-বাদশার খেলা মনে করো না। এটা একটা জাতীয় সমস্যা। এ জন্য সব সময় জনসমর্থন প্রয়োজন। মনে রেখো, জনগণকে ভালবেসেই জনগণের আস্থা অর্জন করতে হয়। তোমার ভালবাসা নিখাদ হলে জনগণ তোমাকে ভাল না বেসে পারবে না। জনগণের ভালবাসা অর্জন করার এটাই একমাত্র পথ।
আমি ফাতেমী খেলাফতকে পদচ্যুত করেছি। তার অনুসারীরা আমার বিরুদ্ধে তৎপর। শুনেছি তারা গোপনে একজন খলিফা নিয়োগ করেছে। আল আযেদ মরে গেলেও ক্ষমতালোভীরা বেঁচে আছে। সুদানীদের দিয়ে ওরা গদি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। ফাতেমীরা ঘাতক দলের সমর্থক পাচ্ছে। আমি আলীকে সাথে নিয়ে যাচ্ছি, হাসান এবং পুলিশ প্রধান তোমার সাথে থাকবে। ফৌজে নতুন ভর্তি আরও জোরদার কর। ওদের প্রশিক্ষণ দাও।’
‘মহামান্য সুলতান, ইদানিং মিসরের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চল থেকে সেনাবাহিনীতে নতুন ভর্তি হচ্ছে না।’ হাসান বললেন, ‘এলাকার লোকজনও সেনাবাহিনীর ওপর বিরূপ হয়ে উঠেছে।’
‘এর কারণ অনুসন্ধান করেছ?’ আলীর প্রশ্ন।
‘আমার দু’জন গুপ্তচর ওখানে নিহত হয়েছে।। আমি নতুন গোয়েন্দা পাঠিয়েছি।’
‘আমি আমার মত চেষ্টা করছি।’ বললেন পুলিশ প্রধান। ‘সম্ভবত সে অঞ্চলের লোকজন নতুন কোন কুসংস্কারের পাল্লায় পড়েছে। ওখানকার যাতায়াত খুব কষ্টসাধ্য। এলাকার লোকজন কষ্ট সহিঞ্চু হলেও কুসংস্কারে বিশ্বাসী।’
‘কুসংস্কার এক গুজব’, সুলতান বললেন, ‘সে অঞ্চলের ওপর কঠোর দৃষ্টি রেখো। ওদেরকে কুসংস্কার থেকে রক্ষা করা তোমাদের দায়িত্ব।
❀ ❀ ❀ ❀ ❀
ক্রাক দুর্গে জরুরী মিটিং চলছে। এতে উপস্থিত রয়েছেন কয়েকজন খ্রিস্টান সম্রাট এবং পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ। সুবাক হাতছাড়া হয়ে গেছে। ক্রাকদুর্গ মুসলমানদের দখলে গেলে জেরুজালেম রক্ষা করা যাবে না। ওরা বুঝতে পেরেছে, কিছুটা সময় নিয়ে পূর্ণ প্রস্তুতির পর সালাহুদ্দীন চুড়ান্ত আক্রমণ করবে। তার আগ পর্যন্ত থেমে থেমে আক্রমণ চালাতে থাকবে সে। এ জন্য ক্রাকের প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা হচ্ছে। দুর্গের বাইরে এসে যুদ্ধ করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কিন্তু সে পরিকল্পনায় কিছুটা রদবদল আনতে হচ্ছে।
গোয়েন্দারা বলেছে, ‘এখানকার ফৌজ মিসরে নিয়ে মিসরের বাহিনীকে সুলতান রণক্ষেত্রে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে নূরুদ্দীন জঙ্গীর সেনা সাহায্যও পৌঁছে গেছে তার কাছে। মিসরের ভারাপ্রাপ্ত গভর্নর সালাহুদ্দীন র ভাই তকীউদ্দীন। সালাহুদ্দীন নিজে মিসর গিয়ে বিদ্রোহ দমন করেছেন। বিদ্রোহীদের দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।
গোয়েন্দাদের দেওয়া এ সংবাদে খ্রিস্টান সম্রাটগণ বিচলিত হলেন। আহত হলেন বিশ্বস্ত এজেন্ট মুসলেহ উদ্দীনের মৃত্যুতে। মিসরের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গোয়েন্দা প্রধান হরমুন বললেন, ‘মুসলেহ উদ্দীনের মৃত্যু ক্ষতিকর হলেও তকিউদ্দীনের ক্ষমতা গ্রহণ আমাদের জন্য আশাব্যাঞ্জক। সে সালাহুদ্দীন র ছোট ভাই হলেও সালাহুদ্দীন নয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সে আমার গোয়েন্দাদের জালে ধরা দেবে। সালাহুদ্দীন এবং আলী দু’জনের কেউ মিসর নেই।’
‘আমি আশ্চর্য হচ্ছি, ঘাতক দল কি করছে?’ বললেন রিমাণ্ড। ‘ওরা আবার দু’পক্ষেরই কাজ করছে নাতো? হারামীরা এখন সালাহুদ্দীন কে হত্যা করতে পারল না। ওদের পেছনে এ পর্যন্ত আমাদের অনেক টাকা নষ্ট হয়েছে।’
‘টাকা নষ্ট হয়নি।’ হরমুন বলল, ‘দেখবেন সালাহুদ্দীন যুদ্ধক্ষেত্র পর্যন্ত পৌছতে পারবে না। কায়রো যাবার সময় তার সাথে ছিল কুড়িজন দেহরক্ষী। এদের চারজন ঘাতক দলের সদস্য। সালাহুদ্দীন কে যেন পথেই শেষ করে দিতে পারি আমি সে ব্যবস্থা করে রেখেছি।’
মিথ্যা আশায় বসে থাকা উচিৎ নয়।’ বললেন ফিলিপ অগাস্টাস। ‘সালাহুদ্দীন নিরাপদে যুদ্ধ ক্ষেত্রে পৌঁছবে এ ধারণা করেই এখন পরিকল্পনা করতে হবে। তার সাথে রয়েছে নতুন সৈন্য। আনকোরা সৈনিকদেরও ট্রেনিং দেওয়া শেষ। নুরুদ্দীন জঙ্গীর পাঠানো সৈন্যও পৌঁছে গেছে। সুবাকের মত শক্তিশালী দুর্গ তার হাতে। এখন রসদপত্র কায়রো থেকে আনতে হবে না, সুবাকে প্রচুর রসদ জমা করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কি? সে ক্রাক অবরোধ করুক, আর আমরা অবরুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করি, এ সুযোগ তাকে দিতে চাই না।’
‘অবরোধ করার সুযোগই সে পাবে না’, বললেন একজন সেনা কমাণ্ডার। ‘আমরা দুর্গের বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করব এবং সুবাক অবরোধ করব।’
‘সালাহুদ্দীন মরুর শিয়াল’, বললেন ফিলিপ। ‘তাকে মরুভূমিতে পরাজিত করা সহজ নয়। সে আমাদেরকে সুবাক অবরোধ করার সুযোগ দিয়ে আমাদেরকেই অবরোধ করবে। আপনারা তার যুদ্ধ পলিসি এখনও বুঝতে পারেননি। যদি তাকে মুখোমুখি এনে লড়াই করা যায় তবে আমি বিজয়ের নিশ্চয়তা দিতে পারি। কিন্তু আপনারা তা পারবেন না। সালাহুদ্দীন কখনই সামনা সামনি যুদ্ধ করবে না।’
এ বিষয়ের ওপর কথা হল দীর্ঘক্ষণ। সিদ্ধান্ত হল অর্ধেক ফৌজ দুর্গের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ওরা মুসলিম বাহিনীর একটু দূরে তাঁবু ফেলে তাদের গতিবিধির ওপর দৃষ্টি রাখবে। এদের সংখ্যা হবে মুসলিম ফৌজের দ্বিগুণ। সালাহুদ্দীন কে পেছন থেকে আক্রমণ করার জন্য একদল সৈন্যকে নির্ধারণ করা হল। সুবাক থেকে মুসলিম ফৌজের কাছে রসদ আসার পথে পাঠিয়ে দেওয়া হল কয়েক প্লাটুন সৈন্য। কমাণ্ডারদের অভিমত হল, প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে নিরূপায় হয়ে সালাহুদ্দীন মুখোমুখি লড়াইয়ে বাধ্য হবে।
খ্রিস্টান সেনানায়কগণ লৌহ বর্ম পরিহিত সৈন্যদের ওপর নির্ভর করেছিলেন। তাদের বেশীর ভাগ ফৌজই ছিল বর্ম পরিহিত। এমনকি উটগুলোকেও বর্ম পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
যুদ্ধের জন্য ঘোড়া সংগ্রহ করেছিল ইউরোপ থেকে। কিছু ছিল আরবী ঘোড়া। কিছু সৈন্য আর কিছু মুসলিম কাফেলা থেকে চুরি করা। সুলতান সালাহুদ্দীন র সবকটা ঘোড়াই ছিল আরবী।
সামরিক প্রস্তুতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখা হল।
‘সুলতান সালাহুদ্দীন মিসরের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত এলাকাতে নতুন ভর্তির কোন লোক পাবে না।’ বললেন গোয়েন্দা প্রধান হরমুন। ‘ওরা প্রকৃতিগতভাবে যুদ্ধবাজ এবং পরিশ্রমী। আমরা ওখানে নিরবে কাজ করছি। সে এলাকার লোকজন এখন যুদ্ধের বিরোধিতা করছে। আমাদের গোয়েন্দাদের জন্য এলাকাটি মজবুত দুর্গের মত কাজ করছে। মুসলমানদের দু’জন গোয়েন্দাকে ওখানে গায়েব করে ফেলা হয়েছে। আমরা এখন সীমান্তের এলাকাগুলোতে কাজ করব। ধীরে ধীরে এর প্রভাব পরবে মিসরের কেন্দ্রে।
আমি এসব অঞ্চলে মুসলমানদের একটা দুর্বলতাকে কাজে লাগাচ্ছি। ওরা পীর, ফকির এবং দরবেশদের ভীষণ শ্রদ্ধা করে। কাউকে তসবিহ নিয়ে আল্লাহ্ আল্লাহ্ করতে দেখলে তার ভক্ত হয়ে যায়। তলিয়ে দেখে না ওরা খাঁটি না অখাঁটি। এ সব পীর এবং ফকীর এবং দরবেশরা ইসলামী আন্দোলন এবং জেহাদের বিরোধী।
যদি কোনক্রমে বিশ্বাস করানো যায় এসব ফকীরদের সাথে খোদার সম্পর্ক রয়েছে, ব্যাস, দলে দলে লোক পানি পড়া, তেল পড়া এবং তাবিজ কবজের জন্য ওদের পিছু নেবে। মুসলিম বাহিনী ঘাম এবং রক্ত দিয়ে যে সুনাম অর্জন করছে এসব পীর ফকীর তা বরদাশত করতে পারে না।
ওরা আন্দোলনের নাম শুনলে ভড়কে যায়, সন্ত্রস্ত্র হয় জিহাদের নামে। সুলতান এবং নূরুদ্দীন জঙ্গী মুসলিম সমাজের শ্রদ্ধার পাত্র। অন্যদিকে খলিফাদের কার্যকলাপে সচেতন মানুষ বীতশ্রদ্ধ। তাদের মধ্যে একদল আলেম জন্ম নিয়েছে যারা ময়দানকে ভয় পায়। খলিফাদের সহযোগিতায় এরা জিহাদের অর্থ বদলে দিচ্ছে। রাজনীতিকে হারাম বলে ফতোয়া দিচ্ছে। মানুষকে ইসলামী আন্দোলন থেকে বিমুখ করে নিজের স্বার্থ হাসিল করছে।
এরা কথা বলে বিশেষ পদ্ধতিতে। সাধারণ মানুষ মনে করে আল্লাহ্ যে সব গোপন রহস্য অন্যকে জানাননি এরা তা জানেন। সাধারণ মুসলমান সহজেই এসব পীর ফকির এবং দরবেশের ফাঁদে আটকা পড়ছে। আমি সে সব আলেম এবং পীর ফকিরদের ব্যবহার করছি। ইসলামের নামে মুসলমানদেরকে ইসলামের মৌলিক নীতিমালা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে ইহুদীরা মুসলমানদের ইসলাম থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে, আমিও তাদের পথেই এগিয়ে যাচ্ছি।’
খ্রিস্টানদের এ তৎপরতা নিয়ে সুলতান উদ্বিগ্ন ছিলেন। স্বজাতির লোকেরা অদৃশ্যে থেকে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে করছে। এ রণক্ষেত্রের দুশমন সুলতানের সামনে নেই। সরাসরি ওদের সাথে কোন যুদ্ধ হচ্ছে না, কন্তু দৃশ্যমান শত্রু একজনকে শহীদ করার সুযোগ পাওয়ার আগে এরা একশ’জনকে বিভ্রান্ত করে ফেলে।
ছোট ভাই এবং কর্মকর্তাদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে সুলতান রণক্ষেত্রে রওয়ানা হয়ে গেলেন। সঙ্গে চব্বিশজন দেহরক্ষী। খ্রিস্টান গোয়েন্দারা এ খবর জানত। চাতুর্যের সাথে ঘাতক দলের চারজন সদস্য দেহরক্ষী পদে চাকুরী নিয়েছিল। সুলতানকে হত্যা করাই ছিল তাদের কিন্তু সুযোগ হচ্ছে না। কারণ, চারজনের ডিউটি একত্রে পড়েনি। তাছাড়া সব সময় কমপক্ষে বিশজন পাহারায় থাকত। রক্ষীদের কমাণ্ডার ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক এবং বুদ্ধিমান। রক্ষী দলে ঘাপটি মেরে আছে ঘাতকদের চারজন সদস্য জানতেন না তিনি। সুলতান সফরে, সুতরাং তিনি আরও বেশী সতর্ক। সঙ্গে আরও বেশী রক্ষী নিতে চেয়েছিলেন কমাণ্ডার। সুলতানের আপত্তির জন্য রক্ষীদের সংখ্যা বাড়ানো যায়নি।
কায়রো থেকে সুলতানের যাত্রা শুরু হয়েছিল বিকেলে। সফর চলল মাঝ রাত পর্যন্ত। এরপর বিশ্রাম। ভোর রাতে আবার যাত্রা শুরু হল। দুপুরের মরু রোদে ক্লান্ত হয়ে পড়ল ঘোড়াগুলো। পানি, ছায়াদার বৃক্ষ এবং টিলা দেখে থামল কাফেলা। তাঁবু টানানো হল সুলতানের জন্য। রক্ষীদের দু’জন তাঁবুর সামনে, দু’জন পেছনে। অন্যরা ধারে কাছে ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে। কয়েকজন ঘোড়াকে পানি খাওয়াতে ব্যস্ত। আলী বিন সুফিয়ান এবং সুলতানের অন্য সঙ্গীরা তাঁবু টানাননি। একটা টিলার পাশে গাছের ছায়ায় সবাই শুয়ে পড়েছেন। ঝোপ ঝাপের কারণে সুলতানের তাঁবু ছিল দৃষ্টির আড়ালে। উত্তাপ ছড়াচ্ছে মরু সূর্য। যে যেখানে পারছে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে।
এই প্রথম একসঙ্গে সুলতানের তাঁবুর প্রহরায় এসেছে ঘাতক দলের দু’জন সদস্য। বাকী রক্ষীরা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। সহিসরাও উট এবং ঘোড়াগুলোকে পানি খাওয়াচ্ছে। ঘাতক দলের অন্য দু’সদস্য বাকী রক্ষীদের সাথে। প্রহরারত দু’সৈন্যকের একজন তাঁবুর পর্দা ঈষৎ ফাঁক করল। চকিতে ফিরে তাকাল দ্বিতীয় প্রহরীর দিকে। সুলতান ঘুমিয়ে আছেন। পিঠ তাঁবুর দরজার দিকে।
প্রহরী হাতের বর্শা তাঁবুর বাইরে রেখে আলতো পায়ে ভেতরে প্রবেশ করল। খাপে ভরা তরবারী, খজ্জরও হাতে নেয়নি। এ প্রহরী অন্যদের চাইতে শক্তিমান, বয়সে যুবক। শরীরে অসুরের শক্তি। সতর্ক পায়ে সে এগিয়ে গেল ঘুমন্ত সুলতানের কাছে।
আচমকা দু’হাতে চেপে ধরল সুলতানের ঘাড়। সুলতান ঘুমাননি, জেগেই ছিলেন তিনি। পাশ ফিরার সময় টের পেলেন দু’টো লৌহ কঠিন হাত গলায় চেপে বসছে।
আর কয়েক মুহূর্ত মাত্র। এরপর চিরদিনের জন্য নিভে যাবে তার জীবনের আলো। উপুড় হয়ে পড়ে আছেন তিনি। ঘাতক সুলতানের পিঠ হাটু দিয়ে চেপে ধরে ঘাড় থেকে একটা হাত সরিয়ে নিল। আরেক হাতে চেপে রাখল সুলতানের ঘাড়। কোমরের বেল্ট থেকে একটা কাগজের প্যাকেট বের করল। প্যাকেটের মুখ খুলে ভেতরের পাউডার ঢেলে দিতে চাইল সুলতানের মুখে।
লোকটার গায়ে অসুরের শক্তি। অসহায়ের মত পড়ে আছেন সুলতান। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঘাতকের হাতে প্যাকেট দেখে তিনি বুঝতে পেরেছেন লোকটা তাকে বিষ খাওয়াতে চাইছে। মুখবন্ধ করে ফেললেন তিনি।
বিষ খাওয়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠল প্রহরী, এ ফাঁকে কোমর থেকে খঞ্জর খুলে নিলেন সুলতান। ঢুকিয়ে দিলেন লোকটার পাঁজরে। বের করে আবার আঘাত করলেন। ষাঁড়ের মত শক্তিশালী প্রহরী এতেও কাবু হল না।
সুলতান খঞ্জর বের না করে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে লোকটার অন্ত্রনালী কেটে ফেললেন। ঢিলে হয়ে গেল আক্রমণকারীর হাত। পড়ে গেল হাত থেকে কাগজের প্যাকেট। ধাক্কা দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়ালেন সুলতান। লোকটা পড়ে গেল নিচে। ক্ষতস্থানে হাত চেপে পড়ে আছে, উঠার সাধ্য নেই।
পতনের শব্দে দ্বিতীয় প্রহরী তাঁবুর ভেতর উঁকি দিয়ে দেখল। সঙ্গীর অবস্থা দেখে তরবারী নিয়ে ছুটে এল। আঘাত করল সুলতানকে লক্ষ্য করে। চকিতে জায়গা বদল করে আঘাত ঠেকালেন সুলতান। সুলতান যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন তার পাশের খুটিতে আটকে গেলো তরবারী।
এ সুযোগে সুলতান প্রহরীকে খঞ্জর দিয়ে আঘাত করলেন। দেহ বাঁকিয়ে আঘাত এড়াল প্রহরী। সুলতান উচ্চস্বরে কমাণ্ডারকে ডাকলেন। দ্বিতীয় আঘাত করল প্রহরী। সরে আক্রমণকারীর পাশে চলে এলেন তিনি। আঘাত করলেন পাঁজরে। আমূল ঢুকে গেল খঞ্জর। সুলতানের ডাক শুনে আরও দু’জন প্রহরী ছুটে এল। ঝাঁপিয়ে পড়ল সুলতানের ওপর।
সুলতান সাহস হারালেন না। তিনজনের বিরুদ্ধে একা লড়ে যেতে লাগলেন।
কয়েকজন প্রহরী নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন কমাণ্ডার। ঢুকেই আক্রমণকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
একপাশে সরে দাঁড়ালেন সুলতান। মনে পড়ল, এর আগেও তিনি এমনি এক পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। দাঁড়িয়ে দু’জন প্রহরীর যুদ্ধ দেখতে লাগলেন সুলতান। শোরগোল শুনে আলী এবং তার সঙ্গীরাও এলেন। পরিস্থিতি দেখে বিবর্ণ হয়ে গেল আলীর চেহারা। রক্তাক্ত হয়ে চারজন প্রহরী মাটিতে পড়ে আছে। মারা গেছে দু’জন। তৃতীয় জন জ্ঞান হারিয়েছে। পাজর থেকে পেট পর্যন্ত ফাঁড়া। বুকে গভীর ক্ষত।
চতুর্থ জনের আঘাত লেগেছে পেটে এবং উরুতে। হাত জোড় করে সে জীবন ভিক্ষা চাইছে। ‘আমি বেঁচে থাকতে চাই। আমার বোনের জন্য আমায় বেঁচে থাকতে দিন। ক্ষমা করুন আমায়।’
সুলতান ইঙ্গিতে প্রহরীদের থামিয়ে দিলেন।
‘ওকে মেরো না, দ্রুত ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা কর।’
একটু পর তৃতীয় প্রহরীরও জ্ঞান ফিরে এল। এক দেহরক্ষী এগিয়ে ওর বুকে খঞ্জর বসিয়ে দিল।
ব্যক্তিগত চিকিৎসককে ডাকলেন সুলতান। বললেন, ‘যে কোন মূল্যে ওকে বাঁচাতে হবে। চিকিৎসার কোন ত্রুটি যেন না হয়।’
সুলতান সম্পূর্ণ সুস্থ। একটা আঁচড়ও লাগেনি তাঁর গাঁয়ে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কিছুই হয়নি। মৃদু হেসে বললেন, ‘আমি আশ্চর্য হইনি। এমনটি হওয়ারই কথা।’
আলীর অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। কপালে চিন্তার বলিরেখা। চেহারা বিবর্ণ। সুলতানের দেহরক্ষী নির্বাচন করার দায়িত্ব তাঁর। দলের অন্যান্য সদস্যরা বিশ্বস্ত কিনা এখনই দেখা উচিৎ।
সুলতানের বিছানা থেকে ঘাতকের হাত থেকে পড়ে যাওয়া কাগজের প্যাকেট তুলে নিলেন ডাক্তার। পরীক্ষা করে বললেন, ‘ভয়ংকর বিষ। এর সামান্য পাউডার কাউকে খাওয়াতে পারলে মৃত্যু অনিবার্য। নিশ্চিন্তে মারা যায় লোকটি।’ ডাক্তারের নির্দেশে বিছানা বাইরে নিয়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করে আনা হল।
আহত প্রহরীকে তুলে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিলেন সুলতান। পেটের চাইতে তাঁর উরুর ক্ষতটা বেশী মারাত্মক।
প্রহরী হাত জোড় করে সুলতানের কাছে জীবন ভিক্ষা চাইতে লাগল।
সুলতানের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত কোন শত্রুতা নেই। সে একজন ভাড়াটিয়া খুনী।
ক্ষতস্থানের ব্যথার চাইতে সে বেশী কাঁদছিল অবিবাহিত বোনের জন্য। বোনের নাম নিচ্ছিল বারবার।
‘মহামান্য সুলতান’, বলল সে, ‘আমি একজন মুসলমান। ক্ষমা করুন আমায়। আমার জন্য না হলেও আপনার একজন মুসলিম বোনের জন্য আমায় মার্জনা করুন।’
‘জীবন এবং মৃত্যু আল্লাহর হাতে,’ দৃঢ় অথচ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন সুলতান, ‘কে মারে কে বাঁচায় দেখলে তো? কিন্তু আমার বন্ধু! এ মুহূর্তে আমার হাতে তোমার জীবন তুমি দেখতে পাচ্ছ, কিন্তু সেদিকে না তাকিয়ে নিজের পাপের দিকে তাকাও। দেখ কত অসহায় তুমি।
তোমার মৃত সঙ্গীদের সাথে মরুভূমিতে ফেলে দেব, মারব না তোমায়। শিয়াল-শকুন ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে তোমার মাংস। তোমার জ্ঞান থাকবে, কিন্তু পালাতে পারবে না, এক সময় মরে যাবে। এভাবেই পাবে তোমার পাপের শাস্তি। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল প্রহরী। আঁকড়ে ধরতে চাইল সুলতানের হাত।
‘কে তুমি?’ প্রশ্ন করলেন সুলতান, ‘কোথেকে এসেছে? আমার সাথে তোমার কিসের শত্রুতা?’
‘আমি ফাতেমীদের লোক। আমরা চারজনই ঘাতক দলের সদস্য। তিন বছর পূর্বে আপনার সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়েছিলাম। কিভাবে আপনার দেহরক্ষীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায় আমাদেরকে বলে দেওয়া হয়েছিল।’
প্রহরীর মুখ থেকে বেরিয়ে এল অনেক মুল্যবান তথ্য। একদিকে ডাক্তার ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করছেন, অন্যদিকে লোকটি বলে যাচ্ছে। ফাতেমী খেলাফতের পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত সালাহুদ্দীন র বিরুদ্ধে কি কি ষড়যন্ত্র করেছে, কি চুক্তি হয়েছে খ্রিস্টান এবং ঘাতক দলের সাথে সব কথাই সে বলল।
ডাক্তার ব্যান্ডেজ শেষ করেছেন।
লাশগুলো বাইরে ফেলে দেয়ার নির্দেশ দিলেন সুলতান। আলীকে বললেন, আহত প্রহরীকে এখান থেকেই কায়রো নিয়ে যেতে। বললেন, ‘প্রহরী ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত যে সব লোকের নাম করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নাও।’
সাথে সাথে আহত প্রহরীকে নিয়ে উটে চাপলেন আলী। ছুটলেন কায়রোর দিকে।
❀ ❀ ❀ ❀ ❀