সুবাক এবং ক্রাক দুর্গ থেকে অনেক দূরে এক বিস্তীর্ণ মরু। চারপাশে উঁচু নীচু এবং পাথুরে পাহাড়। কাকর আর বালুকাময় ভূমিতে মাঝে মাঝে খানাখন্দ। একদিকে খ্রিস্টান শাসকগণ মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য বিপজ্জনক পরিকল্পনা তৈরী করছিল, অন্যদিকে দেড় মাইল দীর্ঘ এবং দেড় মাইল প্রশস্ত এ পাহাড় ঘেরা স্থানে চলছিল সালাহুদ্দীনের যুদ্ধের মহড়া, নতুন রিক্রুট করা মুসলিম সৈন্যদের প্রশিক্ষণ।
পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে সুলতান মহড়া দেখছিলেন। সাথে দু’জন সহকারী। প্রশিক্ষণরত সৈনিকগণ ঘোড়াসহ লাফিয়ে খানাখন্দ পার হচ্ছিল। প্রতিপক্ষের প্রচণ্ড আক্রমণ ঠেকিয়ে করছিলো পাল্টা আক্রমণ।
‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন সুলতান’, বললেন একজন সহকারী, ‘কিছুদিনের মধ্যেই এরা অভিজ্ঞ সৈনিকে পরিণত হবে। তীর-তরবারী, নেজা-বল্লম, সবকিছুতেই হয়ে উঠবে পারদর্শী।’
নতুন রিক্রুটদের মধ্যে সুবাকের লোক যেমন ছিল, গোয়েন্দাদের সহযোগিতায় ক্রাক থেকেও যুবকরা এসে শামিল হয়েছিল এতে। ক্রাকে এদের ওপর চলছিল অবর্ণনীয় নির্যাতন।
নতুনদের আগ্রহ উদ্দীপনায় সুলতান প্রীত হলেন। সহকারীদের বললেন, ‘সুবাক এবং ক্রাক থেকে আরও নতুন নতুন যুবকদের ভর্তি করে ওদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা কর।’
‘অস্ত্রের ব্যবহার জানলেই অভিজ্ঞ সৈনিক হওয়া যায় না। একজন অভিজ্ঞ সৈনিকের গুণ হচ্ছে বুদ্ধি এবং দূরদর্শিতা। যারা এলোপাথাড়ি দুশমনকে আক্রমণ করে, এমন সৈনিক আমার প্রয়োজন নেই। আমার সৈন্যরা জানবে কে তার শত্রু, যুদ্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে থাকবে পরিচ্ছন্ন ধারণা। বিশ্বাস থাকবে তারা আল্লাহর সৈনিক, আল্লাহর পথে লড়াই করছে। এদের মধ্যে দেখছি প্রচণ্ড আবেগ রয়েছে। কিন্তু যদি উদ্দেশ্য এবং নিজের অবস্থান জানা না থাকে অল্প ক’দিনের মধ্যেই এ আবেগ নিঃশেষ হয়ে যাবে। ওদের বুঝিয়ে বল আমরা কেন ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার করতে চাই। গাদ্দারীর পরিণাম ওদের বল। ওদের বল, কেবল মাত্র রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে নয় বরং দ্বীন এবং ঈমানের জন্য তোমরা যুদ্ধ করছ। সামরিক প্রশিক্ষণ শেষ হলে ওদের জন্য আত্মিক ও মানসিক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা কর।’
‘মহামান্য সুলতান’, একজন সহকারী বললেন, ‘প্রতি সন্ধ্যায় ওদের জন্য দ্বীনী আলোচনার ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা একদল পশু সৈনিক তৈরী করতে চাই না।’
‘আমাদের যে সব মেয়েদেরকে ওরা অপহরণ করছে, যেসব যুবতীদের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে তাদের কথা এদের খুলে বল। খ্রিস্টানরা পবিত্র কোরআন পদদলিত করছে, মসজিদ হয়েছে ওদেরই গোশালা। ওদের বল, নারীর সম্ভ্রম, পবিত্র কোরআন এবং মসজিদের সম্মান রক্ষা করা মুসলমানদের ঈমানী দায়িত্ব। যেদিন তোমরা এ দায়িত্ব ভুলে যাবে সেদিন এ পৃথিবী তোমাদের জন্য হবে জাহান্নাম। পরকালের শাস্তি তো মৃত্যুর পরে।
ট্রেনিং চলছিল পর্বতবেষ্টিত বিশাল এলাকা জুড়ে। এরপরও সুলতান পাহারার ব্যবস্থা করেছিলেন। যে কোন সময় খ্রিস্টান ফৌজ আক্রমণ করতে পারে। চার পাঁচজনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল পাহারায় নিয়োজিত ছিল। সুলতান যে পাহাড়ে দাঁড়িয়েছিলেন তার বিপরীত দিকের টিলার উঠে এল এদের একটা দল। তাদের দিকে সুলতানের পিঠ।
দলের একজন বলল, ‘মাত্র আড়াইশ গজ দূরে সে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে মারার জন্য একটা তীরই যথেষ্ট। কি বল?’
‘হ্যাঁ’, বলল দ্বিতীয়জন, ‘কিন্তু এরপর পালিয়ে যাবো কোথায়?’
‘তাও ঠিক। ওরা আমাদের মেরে ফেললে তো কোন কথা ছিল না, কিন্তু তা করবে না। এমন শাস্তি দেবে, আমরা আমাদের সঙ্গীদের নাম বলতে বাধ্য হব।’
‘এ কাজ তার দেহরক্ষীরাই করবে।’ তৃতীয়জন বলল, ‘সালাহউদ্দিনকে হত্যা করা এত সহজ হলে এতদিন তার বেঁচে থাকার কথা নয়।’
‘এ কাজ এখনই হওয়া উচিৎ। ফাতেমীরা বলছে আমরা শুধু ওদের কাছ থেকে অর্থ নিচ্ছি, কাজের কাজ কিছুই করছি না।’
‘ভেবো না, খুব শীঘ্রই ওর মৃত্যু হবে। শুনেছি ঘাতক দলের সদস্যরা খুব সাহসী। সুলতানের দেহরক্ষীদের মধ্যে ওদের তিনজন সদস্য রয়েছে। সম্ভবত ওরা ভয় পাচ্ছে, নয়তো একটা লোককে মারতে এতদিন লাগবে কেন?’
কথা বলতে বলতে ওরা সামনের দিকে এগিয়ে গেল। এরা ছিল খ্রিস্টানদের নিয়োজিত ভাড়াটে খুনী।
❀ ❀ ❀ ❀ ❀
ক্রাকে খ্রিস্টান সম্রাটদের মিটিং শেষ হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, আর অপেক্ষা নয়- সালাহুদ্দীন আক্রমণ করার পূর্বেই তাকে আক্রমণ করতে হবে। শুরু হল সৈন্য সেটিং-এর পালা। ফ্রান্সের বাহিনী সালাহুদ্দীনকে পথেই বাধা দেবে। রিমান্ডের ফৌজ আক্রমণ করবে মুসলিম বাহিনীর পেছন থেকে। ক্রাকের দুর্গ রক্ষা করবে জার্মান বাহিনী। তাদের সাথে থাকবে ইংল্যাণ্ড এবং ফ্রান্সের কয়েক প্লাটুন সৈন্য।
সালাহুদ্দীনের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আক্রমণ করে পালিয়ে আসার পরিকল্পনার বিরোধিতা করল গোয়েন্দা বিভাগ। তাদের যুক্তি হল, সুলতান সালাহুদ্দীন তার বাহিনী তিন ভাগে ভাগ করেছেন। একভাগ যুদ্ধের জন্য তৈরী হয়ে আছে। তার সৈন্যরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে সমগ্র মরুভূমিতে ছড়িয়ে আছে। গাছের একটা পাতা নড়লেও সালাহুদ্দীনের কানে সে সংবাদ পৌঁছে যায়।
সুলতানের এ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার কথা শুনে এই পরিকল্পনা বাতিল করে দেওয়া হল।
খ্রিস্টানদের সৈন্য সংখ্যা ছিল সালাহুদ্দীনের চেয়ে চারগুণ বেশী। এর বেশীরভাগ বর্মধারী এবং অশ্বারোহী। ওদের স্বাভাবিক আক্রমণ ঠেকানো মুসলিম বাহিনীর জন্য ছিল অসম্ভব। কিন্তু সুবাকের যুদ্ধ ওদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। আতংক ছড়াচ্ছিল পরাজিত সৈন্যরা। সুবাক ছিল ওদের কাছে লৌহ দুর্গ। সুলতানের বাহিনীকে পথে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য ওরা বিশাল এক বাহিনী পাঠিয়েছিল। দুর্গে বসে ছিল নেতৃবৃন্দ। সুলতান মুখোমুখি সংঘর্ষে না গিয়ে ওদেরকে মরুর বালুর সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। মুসলিম বাহিনীর নিক্ষিপ্ত গোলার আগুন দেখে আতংকিত হয়েছিল ঘোড়া এবং উঠগুলো। দীর্ঘদিন পর্যন্ত একটু আগুন দেখলেই ওগুলি ভড়কে যেত। সুলতানের প্রচণ্ড আক্রমণে লৌহ দুর্গের প্রতিরোধ বুহ্য ভেংগে পড়ল। কাঁপন ধরল খ্রিস্টানদের বুকে।
বিভিন্ন সম্রাটদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল সম্মিলিত বাহিনী। নিজেদের ভেতর ছিল চরম বিরোধ। সবাই চাইছিল নিজ নিজ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে। সম্প্রসারিত করতে চাইছিল স্বীয় রাজ্যের সীমানা। শুধু মুসলমানদেরকে নিঃশেষ করার জন্যই ওরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু হৃদয়ে লালিত বিরোধের কারণে সঠিক কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না ওরা।
খ্রিস্টানরা ছিল ষড়যন্ত্রে পারদর্শী। কোন মুসলিম এলাকা দখল করলে ওখানে চালাত হত্যাযজ্ঞ। লুণ্ঠন করত মুসলিম নারীদের সম্ভ্রম। অপরদিকে মুসলমানরা কোন এলাকা দখল করলে দূরদর্শিতা, বুদ্ধিমত্তা এবং ভালবাসা দিয়ে শত্রুকে আপন করে নিতেন সালাহুদ্দীন। মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে ছিল আত্মত্যাগের সুষমা। দশজন সৈনিকের কমাণ্ডো বাহিনী এক হাজার খ্রিস্টান সৈন্যকে পর্যুদস্ত করে দিত। জীবন বিলিয়ে দেয়াকে এরা সাধারণ ব্যাপার মনে করত। সুলতানের নিপুন পরিচালনায় অল্প সংখ্যক সৈন্য বিশাল বাহিনীর বুহ্য ভেংগে দিত। ক্রাকেও তিনি এ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। খ্রিস্টান বাহিনীর মনোবল ভেংগে পড়েছিল। সৈন্যদের শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা দেখে যুদ্ধের পরিকল্পনা আপাততঃ স্থগিত করা হল। মিসরে অভুত্থান ঘটাতে হবে। মিসর আক্রমণ করার জন্য সুদানীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সিদ্ধান্ত হল, যুদ্বাস্ত্রসহ এর সমস্ত ব্যয় খ্রিস্টান শাসকগণ বহন করবেন। মিসরের উপ-রাষ্ট্রপ্রধান খ্রিস্টান শিবিরে নিয়মিত সংবাদ পাঠাচ্ছিলেন। আশাব্যঞ্জক সে সব সংবাদ।
মিসরের অর্থ সচিব নিহত হয়েছেন এবং মুসলিম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এ খবর তখনও পৌঁছেনি খ্রিস্টানদের কাছে। ক্রাকে এ সংবাদ দেওয়া জরুরী। সংবাদ পৌঁছাতে পনর দিনের প্রয়োজন। চারদিকে সুলতানের ফৌজ ছড়িয়ে আছে বলে অনেকটা পথ ঘুরে ক্রাক যেতে হয় বলে খ্রিস্টান গুপ্তচররা চিন্তিত।
যেদিন সাবেরা অপহৃত হয় সেদিন ক্রাক পৌঁছল খবরবহনকারী। দূত বলল, ‘বিদ্রোহের জন্য সব তৈরী, কিন্তু সুদানীরা এখনও আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়নি। তাদের ঘোড়ার অভাব রয়েছে, তবে উট আছে অনেক। এ মুহূর্তে শ’পাঁচেক ঘোড়া পাঠানো দরকার।’
‘এখনি পাঁচশ ঘোড়া নিয়ে সাতজন খ্রিস্টান অফিসার রওয়ানা হয়ে যাও।’ নির্দেশ দিলেন ফ্রান্সের সেনা কমাণ্ডার। ‘সময় সুযোগ বুঝে তোমরা সুদানীদের দিয়ে মিসর আক্রমণ করাবে।’
খ্রিস্টানদের রয়েছে অসংখ্য ঘোড়া। এরপরও তিন দিনের মধ্যেই সাধারণ খ্রিস্টানগণ পাঁচশত ঘোড়া কমাণ্ডারের কাছে হাজির করল। রওয়ানা হল ঘোড়ার বহর। পথ দেখাচ্ছিল এক গোয়েন্দা। সুদানী এ গোয়েন্দাটি তিন বছর থেকে এ কাজে রয়েছে। সাথে ছিল আটজন খ্রিস্টান সেনা অফিসার। তাদের বলা হয়েছিল সালাহুদ্দীনকে এখান থেকে আর মিসরে যেতে দেওয়া হবে না।
সুলতান শুনেছেন মিসরের পরিস্থিতি ভাল নয়। মিসর যে এখন জীবন্ত অগ্নিগিরী তা তিনি জানতেন না। আলী তাকে বলেছিলেন, ‘মিসরে আমাদের গোয়েন্দাদের যে নেটওয়ার্ক রয়েছে তাতে যে কোন সংবাদ আমরা পেয়ে যাব। অর্থসচিব এবং উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের পরিণতির কথাও তাদের জানা ছিল না। সুলতানের কাছে সংবাদ পাঠানোর জন্য কেউ কেউ পুলিশ প্রধানকে পরামর্শ দিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘আগে সাক্ষী প্রমাণ যোগাড় করে নেই। সুলতানকে জানাব তারপর।’
❀ ❀ ❀ ❀ ❀
রাতে সাবেরাকে ভিন্ন একটা তাঁবুতে রাখা হল। তখনো সূর্য উঠেনি। তিনজন অপহরণকারী এবং সাবেরাকে কায়রো পাঠিয়ে দেওয়া হল। সাথে আটজন সশস্ত্র সৈন্য। দলটি যখন কায়রো পৌঁছলো সূর্য ডুবে গেছে। ওরা সরাসরি পুলিশ প্রধানের অফিসে গেল। গিয়াস বিলকিস মামলার তদন্ত নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সন্ধ্যার পর শাস্তি সেলে ঢুকেছেন। মুসলেহ উদ্দীনের বাড়িতে তল্লাশী নেওয়া হয়েছিলো। ফিরিংগী মেয়েটাকে পাওয়া গেছে। ও নিজের পরিচয় দিল উজবেক মুসলমান হিসেবে। পুলিশ প্রধানকেও বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করল উল্টাপাল্টা কথা বলে। চেষ্টা করল যৌবনের মায়াজালে আটকে দিতে।
গিয়াস বিলকিস যুবতীকে শাস্তি সেলের কয়েকটা কক্ষ দেখালেন। বিবর্ণ হয়ে গেল মেয়েটার মুখ। পুলিশ প্রধানের উদ্দেশ্য সফল হল, সব স্বীকার করল ও। বলল, ‘ আমার নাম মাথা। জাতিতে খ্রিস্টান। এসেছি জেরুজালেম থেকে।’
মেয়েটা পুলিশ প্রধানকে অর্থ এবং যৌবনের লোভ দেখাল। বলল, ‘মানুষ তো সুখের জন্যই এত কষ্ট করে। আপনি আমাকে মুক্তি দিলে সুখ ও সম্পদে আপনাকে ভরে দেব।’
মুসলেহ উদ্দীনের বাড়ি থেকে যেসব সম্পদ আটক করা হয়েছে এতেই তিনি হতবাক হয়ে গেছেন। তিনি অনুমান করতে পেরেছেন উপ-রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও মুসলেহ উদ্দীন কেন খ্রিস্টানদের ফাঁদে পা দিয়েছেন। অর্থ ছাড়াও যুবতীর মাতাল করা রূপ আর ভাষার যাদু থেকে বেঁচে থাকার জন্য পাথর হৃদয় মানুষের প্রয়োজন।
পুলিশ প্রধান ভাবনার অতলে ডুবে গেলেন। উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে রূপের জ্বলন্ত আগুন আর সম্পদের পাহাড় নিয়ে মেয়েটা জেরুজালেম থেকে। এসেছে একজন মুসলিমের কাছে খ্রিস্টানের উপঢৌকন হিসাবে। ফলে তিনি বুঝলেন, ষড়যন্ত্রের মূল অনেক গভীরে।
মেয়েটার দিকে তাকালেন পুলিশ প্রধান। ‘বল মেয়ে, এ দেশে কি জন্য এসেছ? কে তোমায় পাঠিয়েছে?’
যুবতীর ঠোঁটে মৃদু হাসির ঝিলিক। বলল, ‘যা বলছি তার বেশী আর কিছু বলার নেই। আর কিছু বললে ক্রুশের সাথে প্রতারণা করা হবে। ক্রুশ হাতে নিয়ে শপথ করেছি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রয়োজনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করব, তবুও গোপন তথ্য প্রকাশ করব না। এখন আমাকে যা ইচ্ছে করতে পারেন। একটা কথাও আর বলব না। আর যদি জেরুজালেম বা ক্রাক পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন, এ দেহ ছাড়াও পাবেন অঢেল সম্পদ। মুসলেহ উদ্দীন তো আপনার হাতে বন্দী, ওকে জিজ্ঞেস করুন, সে আপনার স্বজাতি, কিছু বললেও পারে।’
গিয়াস মারথাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না, মুসলেহ উদ্দীনের কক্ষে চলে এলেন। তার শারীরিক অবস্থা ভাল নয়। হাতের কব্জিতে রশি বেঁধে ছাদের আংটার সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ‘মুসলেহ, বন্ধু! যা জিজ্ঞেস করি জবাব দাও। তোমার স্ত্রী কোথায়? কারা তাকে অপহরণ করেছে? তোমার বান্ধবী মারথা সব গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে। এবার তোমাকেও বলতে হবে। আমি দেখতে চাই দু’জনের এক কথা বলছ কিনা। তুমি কতটুকু মিথ্যে বলতে পার সেটাও বুঝা যাবে তোমার কথা থেকে।’
‘আমার হাত খুলে দে বদমাশ।’ ক্রোধে দাঁত পিষে বলল মুসলেহ উদ্দীন। ‘সুলতান আসুক, তোকেও এভাবে ঝুলাবো।’
প্রহরী এসে পুলিশ প্রধানের কানে কানে কি যেন বলল। বিস্ফারিত চোখে সেন্ট্রির দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। ছুটে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। মুসলেহ উদ্দীনের স্ত্রী এবং তিনজন অপহরণকারী বসে আছে। অপহরণ থেকে শুরু করে এদের গ্রেপ্তার হওয়ার সমস্ত ঘটনা খুলে বলল সাবেরা। পুলিশ প্রধান চারজনকে নিয়ে চললেন আণ্ডার গ্রাউণ্ড শাস্তি সেলে। মুসলেহ উদ্দীনের কক্ষের তালা খুলে চারজনকে তার সামনে দাঁড় করানো হল। এদের দেখেই চোখ বন্ধ করে ফেলল সে।
‘এই তিন জনের মধ্যে হত্যাকারী কে?’ প্রশ্ন করলেন পুলিশ প্রধান।
মুসলাহ উদ্দীন নিরব। আবার প্রশ্ন করলেন। কিন্তু কথা বলল না উপ-রাষ্ট্রপ্রধান। গিয়াস বিলকিস একজন লোককে চোখের ইশারায় ডাকলেন। লোকটি ভেতরে এসে মুসলেহ উদ্দীনের কোমর জড়িয়ে ধরে ঝুলে পড়ল। ছিড়ে যাচ্ছে মুসলেহ উদ্দীনের হাতের কব্জি। চিৎকার দিয়ে বলল, ‘মাঝেরটা।’
তিনজনকে সরিয়ে নেওয়া হল। গিয়াস বিলকিস ওদের বললেন, ‘সমস্ত ঘটনা খুলে বল। তা নয়তো এখান থেকে জীবন নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না।’
নিজেদের মধ্যে কি কথা হল ওদের। এরপর বলল, ‘আমরা রাজি।’
ওদেরকে আলাদা আলাদা কক্ষে নিয়ে যাওয়া হল। সাবেরাকে নেওয়া হল ওপরে।
পূর্বের বলা কথাই আবার বলল সাবেরা। বলল, ‘আমার মা সুদানী, পিতা মিসরী। থাকতাম সুদানে। বছর তিনেক আগে আব্বার সাথে মিসরে এলাম। এক অনুষ্ঠানে মুসলেহ উদ্দীন আমায় দেখলেন। আব্বার কাছে লোক পাঠালেন। আব্বার সাথে তার কত টাকার চুক্তি হয়েছিল জানি না। আমাকে মুসলেহ উদ্দীনের বাড়ি রেখে আব্বা চলে গেলেন। যাওয়ার সময় হাতে ছিল এক থলি আশরাফি।
পরদিন মুসলেহ উদ্দীন একজন আলেম এবং ক’জন লোক ডেকে আমাকে বিয়ে করল। এখন আমি তার স্ত্রী। ও আমায় ভীষণ ভালবাসত। আব্বার স্নেহ আমি পাইনি বলে আমি ছিলাম ভালবাসার কাঙ্গাল। মনে হল বিক্রি করার জন্যই আব্বা আমায় মিসরে নিয়ে এসেছিলেন। মুসলেহ উদ্দীন এতটা নীচ কখনও ভাবিনি। ও কখনও মদ পান করেনি। বাইরে কি করত আমি জানতাম না, জানার চেষ্টাও করিনি।
সালাহুদ্দীন আইউবী সুবাক চলে যাবার পর মুসলেহ উদ্দীন কেমন যেন হয়ে গেল। অনেক রাত করে বাসায় ফিরত। আমার আব্বা মদ্যপ ছিলেন। আমি মদের গন্ধের সাথে পরিচিত। দেখতাম মুসলেহ উদ্দীনের মুখ থেকে মদের গন্ধ আসছে। ভালবাসার খাতিরে আমি চোখ বুজে এ সব সহ্য করতাম। তাকে কিছুই বলতাম না।
ক’দিন পর বাসায় অপরিচিত লোকের আনাগোনা শুরু হল। এক রাতে আমাকে দুই থলি আশরাফি এবং দুটি স্বর্ণের টুকরা দেখাল। অন্য এক রাতে মদে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরল। আমার কাছে এসে বলল, ‘তুমি কি মিসরের উত্তরে রোম উপসাগরের এলাকা, নাকি সুদান সীমান্তের এলাকা পছন্দ করবে? তুমি যে এলাকা চাইবে, সেখানকার রাণী হবে তুমি, আমি হব সম্রাট।’
আমি অতশত বুঝি না, চুপ করে রইলাম। ভাবলাম অত্যধিক মদ পান করে আমার স্বামীর মাথা বিগড়ে গেছে।
একরাতে তিনি একজন সুন্দরী ফিরিংগী যুবতীকে বাড়ি নিয়ে এলেন। সাথে আরো অপরিচিত দু’জন লোক ছিল। মেয়েটাকে থাকতে দেওয়া হল তার শোবার ঘরে। আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়নি ওদের। মেয়েটা আমার সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওকে আমি ঘৃণা করতাম। এ মেয়েটা আমার স্বামীকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে আমার কাছ থেকে। এ হল খিজরুল হায়াতের হত্যার আগের ঘটনা। ৪৭/৪৯
❀ ❀ ❀ ❀ ❀
অপহরণকারীরা পুলিশ প্রধানকে প্রথমে ভুল তথ্য দিচ্ছিল, কিন্তু সত্য বলতে ওদের বাধ্য করা হল। ওদের বর্ণনা অনুযায়ী ওরা তিনজনই ঘাতক দলের সদস্য। খ্রিস্টানরা মুসলেহ উদ্দীনের সাথে এদের পরিচয় করে দিয়েছিল। তাদেরকে দিয়েছিল প্রচুর অর্থ এবং সুন্দরী তরুণী। ওরা কথা দিয়েছে, সালাহুদ্দীন কে পরাজিত করতে পারলে মিসর সীমান্তে তাকে একটা এলাকার স্বাধীন সম্রাট করে দেওয়া হবে।
মুসলেহ উদ্দীন প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের লোকদের হাত করতে লাগলেন। খিজরুল হায়াত তার ফাঁদে পা দেননি। অর্থ বিভাগ কব্জা করতে হলে হয় তাকে বশ করতে হবে, নয়তো সরিয়ে দিতে হবে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীরা ছিল সুলতানের প্রতি অনুগত। তাদের ট্রান্সফার করে নিজের লোক বসাতে হলেও খিজরুল হায়াতকে সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। মুসলেহ উদ্দীন তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন। দায়িত্ব দিলেন ঘাতক দলের সদস্যদের। খ্রিস্টানদের কাছ থেকে ওরা নিয়মিত বখরা পেত। কাজ শেষ হওয়ার পর দেননি বলে ওরা ক্ষ্যাপে গেল। গোপন তথ্য জানিয়ে দিল তার স্ত্রীকে।
মুসলেহ উদ্দীন এখনও ঝুলে আছে। জবানবন্দী নেয়ার জন্য হাত খুলে দেওয়া হল তার। ততোক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে মুসলেহ উদ্দীন। জ্ঞান ফিরল অনেক পরে। কিন্তু প্রমাদ বকতে লাগল। চোখ বড় বড় করে তাকাতে লাগল সবার দিকে। মেয়েটার কক্ষে গিয়ে দেখা গেল মুখ থুবরে পড়ে আছে। ডাক্তার এসে নাড়ী পরীক্ষা করে বললেন, ‘বিষ খেয়ে মারা গেছে, তবে বেশীক্ষণ হয়নি। লাশের পাশে একটা প্যাকেটে বিষের চিহ্ন পাওয়া গেল।
রাতে বিলকিসের কাছে এলেন জয়নুদ্দীন আলী বিন নাজা আল ওয়ারেজ। তিনি মিসরের একজন সম্মানিত ব্যক্তি। ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সর্ব বিষয়ে তার হিল অগাধ পান্ডিত্য। পীর না হলেও প্রশাসনের পদস্ত কর্মকর্তারা তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। পুলিশ প্রধানকে বললেন, ‘শুনেছি দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের দু’একজন ধরা পড়েছে। আপনাকে আরও কিছু তথ্য দিতে চাই। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ক’জন লোক আমায় বলেছে সুলতানের অনুপস্থিতিতে শত্রুরা ফায়দা লুটছে। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কাজ করছে যেন ধরা না পড়ে। গোয়েন্দা উপ-প্রধান হামাসকে কিছু না বলেই আমি গোপনে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছিলাম। আমার জলসায় ফৌজ অফিসার, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং প্রশাসনের কর্মকর্তারা ছাড়াও বিভিন্ন পেশার লোকজন এসে থাকেন। আমার নিজস্ব এবং বিশ্বস্ত লোকদেরকেও তথ্য সঙ্গহের কাজে লাগিয়াছি। যদ্দুর বুঝতে পেরেছি, মিসরের বিরুদ্ধে বিরাট এক ষড়যন্ত্র চলছে। আপনি ক’জনকে গ্রেপ্তার করার পর গা ঢাকা দিয়েছে বাকীরা।’
জয়নুদ্দীন পুলিশ প্রধানের কাছে সমস্ত গোপন তথ্য প্রমাণাদি পেশ করলেন। গিয়াস বিলকিস ডেকে পাঠালেন হামাস বিন আবদুল্লাকে। এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হল এখনি সুলতানকে সংবাদ দেওয়া উচিৎ। দূত হিসেবে জয়নুদ্দীনকে নির্বাচন করা হল। পরের দিন বারজন রক্ষী সেনা নিয়ে সুবাকের পথ ধরলেন জয়নুদ্দীন।
❀ ❀ ❀ ❀ ❀
তৃতীয় সন্ধ্যায় জয়নুদ্দীন সুবাক পৌঁছেলেন। সুলতান হতবাক হয়ে গেলেন তাঁকে দেখে। খুশিও হলেন। জড়িয়ে ধরলেন পরস্পরকে। জয়নুদ্দীন বললেন, ‘আমি কোন ভাল সংবাদ আনিনি। অর্থ সচিব নিহত। হত্যাকারী ভারপ্রাপ্ত উপ-রাষ্ট্রপ্রধান মুসলেহ উদ্দীন এখন জেলে। মাথা খারাপ হয়ে গেছে তার।’
বিবর্ণ হয়ে গেল সুলতানের চেহারা। জয়নুদ্দীন তাঁকে সব ঘটনা খুলে বললেন। বললেন, ‘মিসরের সেনাবাহিনীতে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সুবাকের মুসলিম ফৌজকে স্বর্ণ, রৌপ্য এবং প্রচুর গনিমতের মাল দেওয়া হচ্ছে। আপনি খ্রিস্টান ও ইহুদী যুবতীদেরকে ফৌজের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। ওদেরকে আতংকিত করার জন্য বলা হচ্ছে, বিশাল এক সুদানী বাহিনী খুব শীঘ্রই মিসর আক্রমণ করবে। মিসরের স্বল্প সংখ্যক সৈন্য ওদের বাধা দিতে পারবে না। নিহত হবে প্রতিটি সৈন্য। সুলতান সালাহুদ্দীনও তাই চাইছেন। আরো বলা হয়েছে, সুলতান গুরুতর আহত হয়ে পড়ে আছেন। বাঁচার কোন আশা নেই। সুবাকের সেনা অফিসাররা ইচ্ছে মত উপভোগ করছে। আপনি গুরুতর আহত একথা এখন সবাই বিশ্বাস করছে। এ জন্যই মুসলেহ উদ্দীন দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে খ্রিস্টানদের সহযোগিতা করে যাচ্ছিল।’
সাথে সাথে নুরুদ্দীন জঙ্গীকে সব জানিয়ে চিঠি লিখলেন সুলতান। তার কাছে সামরিক সাহায্য চাইলেন। লিখলেন, ‘এখানে থাকলে মিসর হাতছাড়া হয়ে যায়। চলে গেলে পরাজয়ে বদলে যায় সুবাকের বিজয়। কোন কিছুর বিনিময়ে এ এলাকা ফিরিয়ে দিতে চাই না। সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না এখানে থাকব না মিসর ফিরে যাব।’
একজন দ্রুতগামী ঘোড়সওয়ারকে ডেকে বললেন, ‘রাতদিন ঘোড়া ছুটাবে। থামাবে না কোথাও। ঘোড়া ক্লান্ত হয়ে পড়লে সামনে যাকে পাবে তার অশ্ব বদলে নেবে। দিতে না চাইলে হত্যা করবে। শত্রুর হাতে পড়লে পালানোর চেষ্টা করবে, না পারলে চিঠি মুখে পুরে গিলে ফেলবে। কোন অবস্থাতেই যেন চিঠি দুশমনের হাতে না পারে।’
দূত রওয়ানা হয়ে গেল। দ্বিতীয় চিঠি লিখলেন ভাই তকিউদ্দীনের কাছে। ‘তোমার কাছে যা আছে এবং যে ক’জন যুদ্ধ করতে পারে তাদের নিয়ে চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে ঘোড়া ছুটাও। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া কোথাও থেমো না। তোমার সাথে কোথায় দেখা হবে অথবা আদৌ দেখা হবে কিনা জানিনা। যদি তোমার আমার সাক্ষাৎ না হয়, যদি আমি মারা যাই তুমি অনতিবিলম্বে মিসরের দায়িত্বভার গ্রহণ করো। মিসর বাগদাদ খেলাফতের অধীন। যাত্রার পূর্বে আব্বাজানকে কদমবুসি করে বলবে, তোমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে। এরপর আম্মাজানের কবরে গিয়ে ফাতেহা পড়ো। আল্লাহ্ তোমার সঙ্গী। আমি যেখানে থাকব সেখানে ইসলামের পতাকা নত হতে দেবো না। তুমিও মিসরে ইসলামের পতাকাকে উড্ডীন রেখো।’ আরেক জন দূত ডেকে তাকেও পূর্বের মত নির্দেশ দিলেন। রওয়ানা হয়ে গেল ২য় দূতও।
নুরুদ্দীন জঙ্গীর পায়ের কাছে গিয়ে আছড়ে পড়ল দূত। তার বা হাত তরবারীর আঘাতে ছিন্নভিন্ন। পিঠে বিঁধে আছে একটা তীর। ‘পথে দুশমনের হাতে পরেছিলাম। কিন্তু চিঠি নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছি।’ যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে বলল দূত। আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু কিছুই আর বলতে পারল না, তার কন্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল চির দিনের জন্য।
চিঠি তুলে নিলেন জঙ্গী। চিঠি পড়ে অনতিবিলম্বে সুবাকের কাছে পৌঁছল নুরুদ্দীন জঙ্গীর বিশাল বাহিনী। সুবাকবাসীরা দেখল এক ধুলিঝড় এগিয়ে আসছে। সকলের মনে শংকিত প্রশ্ন, ‘কারা এরা?’
খ্রিস্টানদের আক্রমণ ভেবে তৈরি হয়ে গেল মুসলিম ফৌজ। হঠাৎ ধূলিঝড়ের আড়াল থেকে উঁকি দিল কালিমা খচিত পতাকা। ভেসে এল সৈনিকদের তাকবীর ধ্বনি। তাই শুনে তাকবীর ধ্বনি দিয়ে তাদেরকে স্বাগত জানাল সুবাকের সৈন্যরা। মুসলিম ফৌজকে অভ্যর্থনা জানাতে দুর্গ থেকে বেরিয়ে এলেন সেনা কর্মকর্তাবৃন্দ।
❀ ❀ ❀ ❀ ❀
একদিন সকালে মিসরের সেনাবাহিনীকে ময়দানে জমায়েত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল। কেন্দ্রিয় সেনা কমান্ডের এ আকস্মিক নির্দেশে হতবাক হয়ে গেল সৈন্যরা। কেউ বলল, ‘সম্ভবতঃ দেশে বিদ্রোহ হয়েছে। আবার কেউ বলল, ‘সুদানীরা মিসর আক্রমণ করেছে। কিন্তু কেন জমায়েত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কমাণ্ডাররাও তা জানতেন না।
নির্দেশ পেয়ে ফৌজ ময়দানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ালো। একদিক থেকে ছুটে এল সাতজন ঘোড়াসওয়ার। সওয়ারদের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সৈন্যদের প্রশ্নমাখা চোখ। অশ্বারোহীদের প্রথমে রয়েছেন সুলতান সালাহুদ্দীন। খালি গা। পাজামা ছাড়া পরনে কিছুই নেই। সবাই জানে সুলতান সুবাকের রণাঙ্গনে। সারিগুলোর সামনে দিয়ে দুলকি চালে এগিয়ে গেল সালাহুদ্দীনের ঘোড়া। মাঝ বরাবর এসে ঘোড়া থামালেন তিনি। উচ্চস্বরে বললেন, ‘আমার দেহে কি কোন আঘাতের চিহ্ন দেখছো? আমি কি বেঁচে আছি?’
সমস্বরে ধ্বনিত হল, ‘আমাদের সেনা প্রধান, জিন্দাবাদ। আমাদের বলা হয়েছিল আপনি গুরুতর আহত। বাঁচার সম্ভাবনা নেই।’
‘এ খবর যদি মিথ্যে হয় তবে তোমাদের যা বলা হয়েছে তার সবই গুজব। যে সব মুজাহিদদের ব্যাপারে তোমাদের বলা হয়েছে- তাদের স্বর্ণ-রৌপ্য দেওয়া হচ্ছে, খ্রিস্টান মেয়েদের নিয়ে স্ফূর্তি করছে ওরা, তার সবই গুজব। অথচ ওরা ঘুরে মরছে বিস্তীর্ণ মরুভুমিতে। ক্রাক দুর্গ, তার পরের এবং তার পরের দুর্গ পদানত করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ওরা। ওরা কেন অনাহারে–অর্ধাহারে পাহাড়ে-পর্বতে ঘুরে মরছে? ওরা ঘুরে মরছে শুধুমাত্র খ্রিস্টান পশুদের হাত থেকে তোমাদের মা, বোন এবং মেয়েদের সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য। সুবাকে দেখেছি যুবতী মেয়েরা খ্রিস্টানদের হারেমে, পুরুষ আর বৃদ্ধরা ওদের বেগার ক্যাম্পে। জেরুজালেম, ফিলিস্তিন এবং ক্রাকের প্রতিটি গ্রামে মুসলমানদেরকে একই অবস্থায় আমি দেখেছি। আমাদের অনেক মসজিদ এখন ওদের ঘোড়ার আস্তাবল। পবিত্র কোরআনের পাতাসমূহ শহরের অলিতেগলিতে পদদলিত হচ্ছে।’
একজন কমাণ্ডার চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘তাহলে এখানে আমরা কি করছি? আমাদেরকে কেন যুদ্ধের ময়দানে নেওয়া হচ্ছে না?’
‘আমিই সে প্রশ্ন করছি তোমাদের। তোমাদেরকে এখানে রাখা হয়েছে কি এই কারণে যে, শত্রুরা গুজব ছড়াবে আর তোমরা তা বিশ্বাস করবে? তাদের ছড়ানো গুজবে বিশ্বাস করে তোমরা দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে এবং খ্রিস্টানদের হাতে তুলে দেবে মিসরের পবিত্র ভূমি? লুণ্ঠিত হবে তোমাদের মেয়েদের সম্ভ্রম, কোরআনের পাতা ছিঁড়ে বাইরে ছুড়ে ফেলা হবে আর তোমরা তাকিয়ে তাকিয়ে তা দেখবে, এজন্য? তোমরা কি খ্রিস্টানদের হাতে কোরআনের অপমান দেখতে চাও? তোমরা নিজের ঈমানেরই হেফাজত করতে পারছ না, স্বাধীনতার হেফাজত কিভাবে করবে?’
একটু থামলেন তিনি। পিনপতন নিরবতা নিয়ে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে সৈনিকেরা। তিনি সবার চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে দু’একজন কমাণ্ডার দেখা যাচ্ছে না। ওরা কোথায় তোমরা কি জানো? জানোনা। ঠিক আছে ওদের দেখিয়ে দিচ্ছি আমি।’
সুলতানের ইশারায় একদিক থেকে দশজন লোককে সামনে নিয়ে আসা হল। ওদের হাত পিছমোড়া করে বাধা। ঘাড়ে রশি। অবনত মস্তক। সম্মুখ সারির সামনে দিয়ে ওদের হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। সুলতান বললেন, ‘এরা ছিল তোমাদের কমাণ্ডার। জাতির দুশমনের সাথে এদের বন্ধুত্ব। তোমাদের নবী এবং কোরআনের শত্রুর সাথে মিশে গেছে এরা। কিন্তু ধরা পড়েছে।’
সুলতান খিজরুল হায়াতের হত্যা এবং মুসলেহ উদ্দীনের গ্রেপ্তারের কথা শুনালেন। তাকে সামনে নিয়ে আসা হল। মুসলেহ উদ্দীন এখনো স্বাভাবিক হয়নি। গতরাতে সুলতান তাকে গারদে দেখে এসেছিলেন। মুসলেহ উদ্দীন সুলতানকে চিনতে পারছিল না।
তখনও দেশ ভাগ করে নিজে স্বাধীন সম্রাট হবার কথা বলে যাচ্ছিল। সুলতান তাকে সেনাবাহিনীর সামনে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দিলেন। সৈন্যদের দেখে মুসলেহ উদ্দীন চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘এ হল আমার বাহিনী। মিসর সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কর। আমি তোমাদের সম্রাট। সালাহুদ্দীন তোমাদের এবং মিসরের শত্রু। হত্যা কর তাকে।’ পাগলের মত বলে যাচ্ছিল মুসলেহ উদ্দীন।
সৈন্যদের মাঝখান থেকে শন শন শব্দে ছুটে এল একটি তীর। বিঁধল তার বুকে। পড়ে যাচ্ছিলেন তিনি, ততোক্ষণে আরও কটা তীর বিদ্ধ করেছে তার দেহ।
হুংকার দিয়ে তীরন্দাজকে থামিয়ে দিলেন সুলতান। কমাণ্ডারের নির্দেশে তীর নিক্ষেপকারী এগিয়ে এল। দাঁড়াল সুলতানের সামনে।
‘সম্মানিত সুলতান’, বলল সে, ‘আমি এক গাদ্দারকে হত্যা করেছি। এর জন্য মৃত্যুদণ্ড দিতে চাইলে আমি প্রস্তুত।’ মাথা এগিয়ে দিল তীরন্দাজ।
সুলতান তাকে ক্ষমা করে দিলেন। ডাকলেন জল্লাদকে। অন্য গাদ্দারদেরও হত্যা করা হল।
এরপর এক অবিশ্বাস্য নির্দেশ দিলেন সুলতান, ‘তোমরা এখান থেকেই যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে মার্চ করবে। তোমাদের ব্যক্তিগত জিনিষপত্র এবং রসদ যাবে পেছনে।
সঙ্গে সঙ্গেই মার্চ করে রওয়ানা হল বাহিনী। সুলতান চাইলেন কাটা মাথাগুলির দিকে। তাঁর চোখ ফেটে বেরিয়ে এল অশ্রুর বন্যা। কাপড় পরে একদিকে হাঁটা দিলেন সুলতান। সঙ্গীদের বললেন, ‘শত্রুরা মুসলমানদের মধ্যে এভাবেই গাদ্দার সৃষ্টি করতে থাকবে। এমন একদিন আসবে যখন সবাই গাদ্দারদের বিরোধিতাকারীদেরকেই শত্রু ভাবতে শুরু করবে। ইসলামের পতাকা উড্ডীন দেখতে চাইলে বন্ধু এবং শত্রু চিনে নাও।’
আকস্মিকভাবে যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাবার এ নির্দেশে অনেকে হতবাক হয়েছিল। সুলতান বলেছেন, ‘আমার এ আকস্মিক নির্দেশে আপনারা আশ্চর্য হয়েছেন। এখানকার ফৌজ অনর্থক বসেছিল। ওদের কোন কাজ ছিল না। প্রতিদিন মিসরের বাইরে নিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ এবং মহড়া দেয়ার জন্য আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার নির্দেশ পালিত হয়নি। আমি দু’জন পদস্থ সামরিক অফিসারকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছি। ওরাই শত্রুর যোগসাজসে মিসরের সেনাবাহিনীকে বেকার বসিয়ে রেখেছিল। সৈন্যরা মদ এবং জুয়ায় অভ্যস্ত হতে লাগল। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। ওদের মস্তিষ্ক নানান গুজব গ্রহণ করতে লাগল।
আপনারা ভাবছেন সেনাবাহিনী ছাড়া মিসর চলবে কি করে? চিন্তার কিছু নেই। সুবাক বিজয়ী যোদ্ধারা আমার পেছনেই যাত্রা করেছে। শ্ত্রুর পশুত্ব খুব নিকট থেকে দেখেছে ওরা। দেখেছে যুদ্ধের বিভীষিকা। ওদের কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারবে না। ওরা সঙ্গী সিপাহীদের রক্তের সাথে বেঈমানী করবে না। এখন যারা যাচ্ছে ওরা ক্রাক দুর্গ আক্রমণ করবে। শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হবে। তখন শত্রুমিত্র চিনতে পারবে। যে সৈনিক একবার শত্রুর চোখে চোখ রেখে যুদ্ধ করে কোন লোভ-লালসা ওদের বিচ্যুতি করতে পারে না।
নুরুদ্দীন জঙ্গী এবং ছোট ভাইকে চিঠি লিখে সুলতান গোপনে কায়রো রওয়ানা হয়েছিলেন। রণক্ষেত্রে তার অনুপস্থিতির কথা গোপন রাখার জন্য পদস্থ কর্মকর্তাদের কঠোরভাবে নিষেধ করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, জঙ্গী অবশ্যই সাহায্য পাঠাবেন। ওদের এখানে রেখে সমপরিমাণ মিসরী ফৌজ কায়রো পাঠিয়ে দেবে। পথে বিশ্রাম করবে কম। এতে সুলতানের ছিল দুটো উদ্দেশ্য। মিসরে বিদ্রোহ হয়ে থাকলে এরা তা দমন করবে, তা না হলে মিসরের ফৌজ আসবে রণক্ষেত্রে আর এরা থাকবে মিসরে। সুলতান মিসরে পৌঁছলে তার আগমন সংবাদ গোপন রাখা হয়। জয়নুদ্দীনের দেখানো বিদ্রোহীদের গ্রেপ্তার করা হল রাতের মধ্যে। ঘাতক দলের সদস্যরাও কয়েকজনের নাম বলেছিল, ধরা হল তাদেরও।
সুলতানের নির্দেশে জয়নুদ্দীনের হাতে তুলে দেওয়া হল সাবেরাকে। একজন ভাল লোক দেখে তার বিয়ের ব্যবস্থার কথাও বলা হল।
ছোট ভাইয়ের আসার অপেক্ষায় রইলেন সুলতান। তকিউদ্দীন এলেন তিনদিন পর। সাথে দু’জন অশ্বারোহী। তাকে মিসরের বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলেন সুলতান। তকিকে অর্পণ করা হল মিসরের ভারপ্রাপ্ত গভর্নরের দায়িত্ব। সুলতান বললেন, ‘সুদানের ওপর দৃষ্টি রেখো। যে কোন পরিস্থিতিতে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার জিম্মা তোমায় দেওয়া হল। সুদান আক্রমণ করার প্রয়োজন হলে তাও করবে।’
‘এবার ফিরতে হবে রণক্ষেত্রে’, সঙ্গীদের বললেন সুলতান।
তিনি গোয়েন্দা প্রধান আলীকে সাথে নিয়ে এসেছিলেন।
‘একটু অপেক্ষা করুন সুলতান’, আলী বললেন, ‘আপনাকে চমৎকার একটা উপহার দেব।’
আলীর সাথে বেরিয়ে গেলেন সবাই।
বিরাট এক মাঠে পাঁচশত অশ্ব। পিঠে জীন চাপানো। খানিক দূরে আটজন খ্রিস্টান সেনা অফিসার দাঁড়িয়ে আছে। হাত পা বাঁধা। প্রতেকের বন্দীর পাশে আছে একজন মিসরী সৈন্য।
‘এসব ঘোড়া কোথাকে এসেছে আলী?’ সুলতান প্রশ্ন করলেন।
‘ক্রাক থেকে আপনার জন্য উপহার এসেছে।’
আলী একজন লোককে ইশারায় ডাকলেন। লোকটি এসে সুলতানের সামনে দাঁড়াল।
‘সুলতান!’ আলী বললেন, ‘এ লোকটি আমার গোয়েন্দা দলের সদস্য। গত তিন বছর থেকে খ্রিস্টান গোয়েন্দা দলে যোগ দিয়েছে। ওরা ওকে নিজস্ব গুপ্তচর মনে করে। ও খ্রিস্টান এবং সুদানীদের মাঝে দূত হিসেবে কাজ করে। কয়েকদিন পূর্বে ও ক্রাকে গিয়েছিল। সুদানীদের পক্ষ থেকে খ্রিস্টান সাম্রাটদের বলেছে, মিসর আক্রমণ করার জন্য ওদের পাঁচশত যুদ্ধের ঘোড়া প্রয়োজন। ওরা পাঁচশত ঘোড়া পাঠিয়ে দিয়েছে। সাথে আটজন সেনা অফিসার। এরা মিসর আক্রমণে পেছন থেকে সুদানীদের নেতৃত্ব দেবে। আমাদের এ গোয়েন্দা উত্তর দিকে ঘুরিয়ে সীমান্তের সেনা চৌকিতে সংবাদ দিয়েছে। নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছে অফিসারদের বন্দী করতে। সীমান্তের সৈন্যরা এদের কায়রো নিয়ে এসেছে।’
খ্রিস্টান সেনা অফিসারদেরকে হাসান বিন আবদুল্লাহর হাতে তুলে দিয়ে আলী সুলতানের সাথে সুবাকের পথ ধরলেন।
কায়রোর বালুকারাশি গাদ্দারদের রক্ত শুষে নিচ্ছিল। কিন্তু বাস্তবে মনে হচ্ছিল দ্বীন এবং স্বাধীনতার পতাকার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের রক্ত গ্রহণ করতে কায়রোর মাটিও দ্বিধা করছে। সুলতান যখন লাশগুলো দেখেছিলেন, বললেন, ‘ওদের ছিন্ন মস্তক লাশের বুকের ওপর রেখে দাও। সবচে বেশী ব্যথা পেয়েছিলেন মুসলেহ উদ্দীনের মৃত্যুতে, তিনি তাকে বেশী বিশ্বাস করতেন। তাকেই করেছিলেন ভারপ্রাপ্ত গভর্নর। অথচ বিশ্বস্ত লোকটিই শত্রুর সাথে হাত মেলাল। সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ভেংগে যে সিপাইটি তাকে তীর ছুঁড়েছিল সুলতান তাকে ক্ষমা করেছিলেন। কারণ তিনি ঈমান এবং ইসলামের বিরুদ্ধে বেইমানী সহ্য করতেন না।
লাশগুলো দেখে সুলতানের চেহারায় আনন্দের দ্যুতি ঝলকে উঠেনি। এতগুলো গাদ্দার ধরতে পেরে যেখানে খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু সুলতান ছিলেন বেদনা ভারাক্রান্ত। চোখ ফেটে গড়িয়ে পড়েছিল বিন্দু বিন্দু অশ্রু। কিন্তু ভেতরে ছিল প্রচণ্ড ক্ষোভ। ক্রোধের সাথেই তিনি বললেন, ‘এদের কারও জানাজা পড়া হবে না। লাশ ফেরত দেওয়া হবে না। লাশ ফেরত দেওয়া হবে না আত্মীয়-স্বজনের কাছে। রাতের অন্ধকারে একই গর্তে কাফন ছাড়া সবাইকে পুঁতে রাখতে হবে। এমনভাবে মাটি সমান করবে, পৃথিবীতে যেন কবরের কোন চিহ্ন না থাকে।
‘সম্মানিত আমীর’, মুখ খুললেন সুলতানের বন্ধু বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ, ‘আপনি যা করেছেন। ঠিক করেছেন। তবুও পুলিশ সুপার এবং সাক্ষীদের জবানবন্দীসহ কাজির লিখিত রায় সংরক্ষণ করা উচিৎ। নয়তো কোন এক সময় কেউ বলতে পারে আপনি আদালতের কাছে যাননি। ওদের মৃত্যুদন্ডের সিদ্ধান্ত আপনি একাই দিয়েছেন।’
‘যারা বেঈমানের সাথে মিশে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ওরা আল্লাহ্ এবং রসূলের (সা.) অনুসারীদের মিথ্যেবাদী প্রমাণ করবে, কোরআন কি এই নির্দেশ দিয়েছে? এতগুলো লোক অন্যায়ভাবে হত্যার অপরাধে যদি আমি শাস্তি পাওয়ার যোগ্য হই, হত্যা কর আমায়। আমার লাশ ফেলে দাও শহরের বাইরে কোন বিজন এলাকায়। লাশের গোশত খুবলে খাবে পাহাড়ী শিয়াল আর কুকুরের দল। তবে বন্ধুরা, আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পূর্বে পবিত্র কোরানের আলিফ লাম থেকে ওয়াননাছ পর্যন্ত পড়ে নিও। কোরআন যদি আমাকে মৃত্যুদণ্ডের ফয়সালা দেয়, আমার মস্তক হাজির রয়েছে।’
‘অবিচারের কথা নয় মাননীয় সুলতান,’ উপস্থিত লোকদের মধ্য থেকে একজন বলল, ‘সম্মানিত শাদ্দাদ-এর উদ্দেশ্য হল আইনের অবমাননা যেন না হয়।’
‘আমি বুঝেছি,’ সুলতান বললেন, ‘তার উদ্দেশ্য আমার কাছে দিনের আলোর মত পরিষ্কার। শুধু বলতে চাই, গাদ্দারীর অপরাধে কোন আসামীকে যদি রাষ্ট্র প্রধানের সামনে উপস্থিত করা হয়, রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব হল বিলম্ব না করে তাকে শাস্তি দেয়া। যদি রাষ্ট্র প্রধান তাকে শাস্তি দিতে গড়িমসি করেন বুঝতে হবে তিনি হয় গাদ্দারের সঙ্গী, অযোগ্য অথবা বেঈমান। তার ভয় বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে আসামী তাঁকেও অন্তর্ভুক্ত করবে। কিন্তু আমি পরিচ্ছন্ন। আমাকে গাদ্দারদের সারিতে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দাও, আল্লাহর কুদরতী হাত আমাকে আলাদা করে দেবে। তোমাদের বুক যদি কাবার প্রভূর নূরে আলোময় থাকে, তবে অপরাধীর মুখোমুখি হতে ভয় পেয়ো না। বন্ধু বাহাউদ্দীন যে পরামর্শ দিয়েছেন সে অনুযায়ী কাগজপত্র তৈরী কর। কাজীর দ্বারা রায় লিখিয়ে নাও। তবে এ রায় কাজীর হবে না, কাজী লিখবেন মিসরের গভর্নর এবং সেনাপ্রধান নিজস্ব বিশেষ ক্ষমতাবলে আসামীদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। সাক্ষী প্রমাণে আসামীদের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। তকিউদ্দীনের দিকে তাকালেন সুলতান। তার চেহারায় দীর্ঘ ভ্রমণের ছাপ। সুলতান বললেন, ‘তোমার চেহারায় আমি দুশ্চিন্তা এবং ক্লান্তি দেখছি। কিন্তু তুমি বিশ্রাম করতে পারবে না। তোমার সফর শেষ হয়নি, সবেমাত্র শুরু হয়েছে। আমাকে সুবাক যেতে হচ্ছে, যাওয়ার আগে তোমার সাথে জরুরী কিছু কথা আছে।’
‘মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের স্ত্রী এবং সন্তানদের ব্যাপারে কি নির্দেশ মাননীয় আমীর?’ জানতে চাইলেন পুলিশ প্রধান।
‘অতীতের গাদ্দারদের পরিবারের ব্যাপারে যে নির্দেশ ছিল এখানেও তা কারজকার। ওদের বিধবা স্ত্রীদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নাও। দেখবে খ্রিস্টানদের সাথে কারও সম্পর্ক রয়েছে কিনা। নারী পূজা আমাদের মধ্যে গাদ্দার সৃষ্টি করছে। তোমরা দেখেছ খ্রিস্টানরা সুন্দরী যুবতীদের বিনিময়ে ওদের ঈমান কিনে নিচ্ছে। নিরাপরাধ বিধবাদেরকে তাদের পছন্দ পাত্রের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা কর। জোর করে কাউকে বিয়ে দেবে না। লক্ষ্য রাখবে, কোন নারী যেন আশ্রয়হীন না হয়। রুটি রুজির জন্য ওদেরকে যেন কারও মুখাপেক্ষী হতে না হয়। বিধবাদেরকে কেউ যেন বলতে না পারে তাদের স্বামীদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। বরং ওদের বুঝিয়ে বল, বেঈমান পাপী স্বামীর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ায় ওরা ভাগ্যবতি।
বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ওদের সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা কর। ওদের সমস্ত খরচ। বহন করে সমস্ত খরচ বহন করবে রাষ্ট্র। মনে রেখো, ওরা পিতৃহীন এ অনুভূতির কখন যেন ওদের ব্যথিত না করে। সন্তানদের যেন পিতার পাপের প্রায়শ্চিত করতে না হয়।
❀ ❀ ❀ ❀ ❀