» » সালাহুদ্দীন আয়ুবীর কমান্ডো অভিযান

বর্ণাকার

কমাণ্ডারের তাঁবুতে ঘুমিয়ে ছিল মেয়েটা। সারাটা দিন ঘুমিয়েই কাটাল। জাগল সূর্য ডোবার খানিক আগে। আহমদ কামাল বলল, ‘যাক বাবা, ঘুম তাহলে ভাঙল। দেখো, খাবার রাখা আছে। আবার ঘুমোনোর আগে চারটে খেয়ে নিও।’

খেয়ে দেয়ে ও ঘুমিয়ে পড়ল আবার। কমাণ্ডার ঘুমিয়েছিল মেয়েটার কয়েক কদম দূরে। তাঁবুতে জ্বলছে প্রদীপের আলো। ধীরে ধীরে রাত গভীর হচ্ছে।

গভীর রাতে হঠাৎ মেয়েটা চিৎকার করে উঠল। চোখ খুলে গেল কমাণ্ডারের। মেয়েটা বসে আছে। কাঁপছে। চোখে মুখে আতঙ্ক।

কাছে এলেন কমাণ্ডার। মেয়েটা কমাণ্ডারকে জাপটে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ওদের হাত থেকে আমাকে বাঁচাও। ওরা আমায় কুমীরের মুখে ছুঁড়ে দিবে। আমার মাথা কেটে ফেলবে ওরা।’

‘কারা?’

‘কালো কাফ্রিরা।’ মেয়েটার কণ্ঠে ভীতি। ‘ওরা এখানেও এসেছিল।’

কাফ্রিদের বলির কথা জানতেন কমাণ্ডার। ভাবলেন, একে হয়ত বলি দেয়ার জন্য নেয়া হচ্ছিল। মেয়েটাকে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তোমাকে কি বলি দেয়ার জন্য অপহরণ করা হয়েছিল?’

ও কমাণ্ডারের গলা জড়িয়ে রেখেই বলল, ‘আমাকে এ নিয়ে আর প্রশ্ন করো না। আমি দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম।’

কামাল তার ফ্যাকাশে চেহারা দেখে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘এখান থেকে কেউ তোমাকে নিতে পারবে না। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও।’

‘আমার আর ঘুম আসবে না। তুমি আমার সাথে কথা বলতে পারবে? একা একা জেগে থাকতে পারব না। আমি তাহলে পাগল হয়ে যাব।’

‘ঠিক আছে যখন ভয় পাচ্ছ, তোমার সাথে আমিও জেগে থাকব।’

মেয়েটাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, যতক্ষণ এখানে আছ ভয়ের কারণ নেই।’

তবে তিনি ওকে কাফ্রি বা নিজের সম্পর্কে আর কোন প্রশ্ন করলেন না। ওরা কথা বলে কাটিয়ে দিল বাকি রাতটুকু। কথার বেশীর ভাগ ছিল তুর্কিস্তান এবং মিসরের গল্প। এক সময় ও ঘুমিয়ে পড়ল।

সূর্য উঠার দেরী নেই। মেয়েটার ঘুম ভেঙে গেল। উঠে বসল সে। দেখল ফজরের নামায পড়ছেন আহমদ কামাল। ও নির্নিমেষ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে রইল। নামাজ শেষ করে দোয়ার জন্য হাত তুললেন কমাণ্ডার। মেয়েটা এক দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

‘তুমি খোদার কাছে কি চেয়েছ?’ মুনাজাত শেষ হলে প্রশ্ন করল তরুণী।

‘অন্যায় প্রতিরোধ করার শক্তি।’

‘তুমি স্বর্ণ এবং সুন্দরী যুবতী পাওয়ার জন্য খোদার কাছে প্রার্থনা করনি?’

‘না চাইতেই এ দু’টো খোদা আমায় দিয়েছেন। কিন্তু তার ওপর আমার কোন অধিকার নেই। হয়ত তিনি আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন।’

‘তুমি কি মনে কর তিনি তোমাকে পাপের মোকাবিলা করার শক্তি দিয়েছেন?’

‘কেন, দেখনি। তোমার স্বর্ণ এবং তোমার রূপ যৌবন আমাকে আমার কর্তব্যচ্যুত করতে পারেনি। এ হল আল্লাহর অনুগ্রহ এবং আমি তার কাছে এটাই চাই।’

‘তিনি কি পাপমোচন করেন?’

‘হ্যাঁ, তিনি পাপমোচন করেন। তবে শর্ত হল সে পাপ বার বার করা যাবে না।’

মাথা নোয়াল মেয়েটা। ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। কমাণ্ডার ওর মাথায় হাত রাখলেন। ও আহমদ কামালের হাত দু’টো ধরে কয়েকবার চুমো খেল। কামাল হাত সরিয়ে নিলেন। ও বলল, ‘আজ আমায় পাঠিয়ে দেবে কায়রো, তোমার সাথে হয়ত আর কোন দিন দেখা হবে না। যাবার আগে আমি কে, কোত্থেকে এসেছি তোমাকে বলে যেতে খুব মন চাইছে। তুমি অনুমতি দিলে আমার বর্তমান অবস্থা বলব।’

‘যাত্রার সময় হয়ে গেছে। আমি নিজেই তোমার সাথে যাচ্ছি। এ ধরনের বিপজ্জনক দায়িত্ব সাধারণত আমি অন্য কাউকে দেই না।’

‘আমি কে, কোত্থেকে এসেছি তাও শুনবে না?’

‘চল, এ কথা শোনার দায়িত্ব আমার নয়।’ বলে কমাণ্ডার তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেলেন।

কায়রো অভিমূখে রওয়ানা হল দু’টি ঘোড়া। সামনে আহমদ কামাল। পেছনের ঘোড়ায় চেপেছে মেয়েটা। তার পেছনে আড়াআড়িভাবে চারজন রক্ষী সেনা। সব শেষ প্রয়োজনীয় খাবার দাবার সহ একটি উট। প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টার সফর। রেশমা দু’বার কমাণ্ডারের পাশাপাশি চলার চেষ্টা করল।

‘তোমার ঘোড়া সৈন্যদের মাঝখানে রেখো।’ কমাণ্ডার বললেন।

সূর্যাস্তের পর আহমদ কামাল কাফেলা থামিয়ে তাঁবু টানানোর নির্দেশ দিলেন। রাতে মেয়েটাকে শোয়ালেন নিজের তাঁবুতে। আলো জ্বলছে। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। গভীর রাতে কারো আলতো স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখেন মেয়েটা পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলাচ্ছে।

তড়াক করে উঠে বসলেন কমাণ্ডার। মেয়েটার চোখে চোখ রাখলেন। ও কাঁদছে।

আহমদ কামালের হাত নিজের দুহাতে তুলে নিল বিদেশিনী। ঠোঁট ছোঁয়াল তার হাতে। এরপর শিশুর মত ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে লাগল।

তাকিয়ে রইলেন কমাণ্ডার। মেয়েটা অশ্রু মুছে বলল, ‘আমি তোমার দুশমন। গুপ্তচর বৃত্তির জন্য তোমার দেশে এসেছি। এসেছি বড় বড় সরকারী কর্মকর্তাদের মাঝে শক্রতা সৃষ্টি করতে। সালাহুদ্দীন আয়ুবীকে হত্যা করার জন্য আমাকে ফিলিস্তিন থেকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করো, এখন আমার মনে কোন শক্রতা নেই।’

‘তুমি খুব ভীতু মেয়ে। কেন আপন জাতির সাথে গাদ্দারী করছ। শূলির কাঠে দাড়িয়ে বল, আমি ক্ৰশের জন্য জীবন বিলিয়ে দিচ্ছি।’

‘আমার মনে শক্রতা নেই কেন জান? তুমিই প্রথম পুরুষ যে আমার অনন্য রূপ যৌবনকে ঘৃণা করেছ। প্রত্যাখ্যান করেছ আমার আহ্বান। আপন পর সবাই আমাকে পাওয়ার জন্য উন্মুখ। পুরুষের ভোগের সামগ্রী হয়ে, ওদের সাথে প্রতারণা করে বিলাসিতার জীবনকেই জীবনের উদ্দেশ্য মনে করেছিলাম। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আমাকে ট্রেনিংও দেয়া হয়েছে।’

‘তোমাদের কাছে যা অশ্লীলতা, আমাদের কাছে তা শিল্প, এক মোক্ষম অস্ত্র। ধর্ম কি জানি না, খোদার বিধান বুঝি না। শৈশব থেকে পরিচিত হয়েছি ক্ৰশের সাথে। বলা হয়েছে ক্রশ হচ্ছে খোদার চিহ্ন। খৃষ্টানদের মর্যাদার প্রতীক। সমগ্র বিশ্ব শাসন করার অধিকার কেবল ক্রশধারীদের। মুসলমানরা হচ্ছে ক্ৰশের দুশমন। ওদের কাছে এই হচ্ছে ধর্মের মূলনীতি।’

‘ওদের ধর্মের মূলনীতি আমরা জানি। তোমার কাহিনী আমাকে বলার দরকার নেই, যা বলার কায়রো গিয়ে ব’লো।’

‘রজব নামের কোন কমাণ্ডারকে চেন!’

‘সে ছিল খলিফার রক্ষী ফৌজের কমাণ্ডার। সুদানী ষড়যন্ত্রের সাথে সেও শরীক ছিল।’

‘এখন কোথায়?’

‘জানি না, আমাদের শুধু বলা হয়েছে রজব সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে গেছে। দেখা মাত্র যেন তাকে গ্রেফতার করি। পালাতে চাইলে তীর মেরে শেষ করে দেয়ার অনুমতিও আছে। কেন? তুমি কিভাবে তাকে চেন? সে এখন কোথায় তুমি জান কিছু?’

‘সে এখন সুদানে কাফ্রিদের কাছে। ওখানে আছে এক মনোরম স্থান। কাফ্রিরা ওখানেই যুবতীদেরকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়। রজব ওখানেই আছে। ফিলিস্তিন থেকে তার সাথেই আমাদের তিনজনকে পাঠানো হয়েছে।’

‘অন্য দু’জন কোথায়?’

‘ওরা মারা গেছে।’ তরুণীর কণ্ঠে বিষন্নতা। ‘ওদের মৃত্যুই আমাকে বদলে দিয়েছে।’

‘কিভাবে ওরা মারা পড়ল?’

কাফ্রিরা দু’টো মেয়েকে বলি দিতে চেয়েছে, রজব ওদের বাঁচানোর চেষ্টা করেনি থেকে শুরু করে ওখান থেকে পালিয়ে আসা এবং ঝড়ের কবলে দু’জনের মৃত্যুসহ সকল কাহিনী কমাণ্ডারকে খুলে বলল সে।

মেয়েটা আরও বলল, ‘একদিন এই আমি নিজকে শাহজাদী মনে করতাম। আমি ছিলাম সম্রাটদের হৃদয়রাণী। খোদা বা মৃত্যু আছে এ কথা কখনও ভাবিনি। আমাদেরকে পাপের সাগরে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল, আমরাও সানন্দে তাতেই ডুবেছিলাম। সে ছিল ভোগ বিলাসের এক মোহময় জগত।

আমাদেরকে কুমীর দেখানো হল, মস্তকবিহীন যুবতীদের দেহ যাদের আহার। কিণারে শুয়েছিল কুমীরগুলো। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। যে দেহের সামনে বড় বড় সম্রাটদের মাথা নুয়ে থাকে, সে দেহ হবে কুমীরের খাদ্য!

আমার মাথা কাটার জন্য যে সব কুৎসিত কাফ্রিরা এসেছিল আমি তাদের দেখেছি। চোখের সামনে ভেসে উঠল মৃত্যর বিভীষিকা। আমার বিবেক জেগে উঠল। আত্মার ভেতর থেকে শব্দ হল, নিজের অনন্য রূপ আর মাদকতাময় দেহের পরিণাম দেখ।

মরণ পণ করেই বেরিয়েছিলাম আমরা। আমাদেরকে রজবের হাতে তুলে দিয়ে বলা হয়েছিল, ‘এ লোকটি তোমাদের হেফাজত করবে।’ কিন্তু ও আমাদের দিকে লোভের হাত বাড়াল, আমরা পালালাম।

ঝড়ের কবলে পড়ে ঘোড়াগুলো দিশেহারা হয়ে পড়ল। প্রথমে একটা মেয়ে পড়ে গেল। তার ওপর পড়ল ঘোড়াটা। চেয়ে চেয়ে দেখলাম, কিছুই করার ছিল না। এরপর দ্বিতীয় মেয়েটা ঘোড়ার সাথে ঝুলতে ঝুলতে মারা গেল। ওর কলজে ফাটা চিৎকার এখনও আমি শুনতে পাচ্ছি। যতদিন বেঁচে থাকব আমার কানে বাজতে থাকবে ওর সে বুকফাটা আর্তচিৎকার।

আমার ঘোড়াটা ছুটছিল, কিন্তু আমার বশে ছিল না। আমি তখন একা। দুটি মেয়েকে মেরে খোদা আমাকে আমার পরিণতি বুঝিয়ে দিলেন। ওরা ছিল আমার চে’ সুন্দরী এবং হাসি খুশী। রূপ যৌবন নিয়ে ওদের অহঙ্কার ছিল। কত রাজা বাদশাকে আঙ্গুলের ইশারায় নাচিয়েছে ওরা। কিন্তু মরার পর কেউ জানলও না, বালির পরিচয়হীন কবরে ওরা সমাহিত হয়ে আছে।

আমি নিঃসঙ্গ। ঝড়ের ভেতর থেকে ভেসে এল মৃত্যুর অট্টহাসি। ডানে বায়ে ওপরে এবং নীচে প্রেতাত্মা আর ভূতপ্রেতের ক্রুর হাসি শোনা যাচ্ছিল।

আমি বুঝতে পারছিলাম, এ সবই আমার পাপের ফল। খোদাকে মনে পড়ল। পাপের জন্য তার কাছে বার বার ক্ষমা চাইলাম। বেঁচে থাকার জন্য সাহায্য চাইলাম তার কাছে। এরপর অজ্ঞান হয়ে গেলাম। জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম আমি তোমার কবজায়।

তোমার সাদা চামড়া দেখে খুশী হয়েছিলাম। তুমি ইউরোপীয়, আমি ফিলিস্তিনের। নিজের ভাষায় নিজের পরিচয় দিলাম। যখন বুঝলাম মুসলমানের হাতে পড়েছি, দমে গেলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঝড় থেকে বেঁচে এলাম শক্রর কাছে!

আমাদের বলা হয়েছিল, মুসলমানরা মেয়েদের সাথে পশুর মত ব্যবহার করে। কিন্তু আমি ধারণাও করিনি তুমি এমন ব্যবহার করবে। ফিরিয়ে দিয়েছ আমার দেয়া স্বর্ণ। গ্রহণ করনি আমার দেহের সৌরভ।

আমি ছিলাম আতঙ্কিত। যে কেউ আমাকে আশ্রয় দিলে তাকে বুকে স্থান দিতাম। তোমার উন্নত নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে তখনও আমার ধারণা ছিল না। ভেবেছিলাম রাতে বিরক্ত করবে।

স্বপ্নে কুমীর দেখলাম, কাফ্রি এবং ঝড় দেখলাম। জেগে গেলাম আতঙ্কে। তুমি শিশুর মত আমায় অভয় দিলে। তোমার গল্প শুনতে শুনতে আমার সব ভয় দূর হয়ে গেল। ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন জাগলাম তুমি নামাজ পড়ছ। দোয়া করার জন্য হাত তুললে, তোমার নিমিলীত চোখে আমি দেখেছি এক অনাবিল প্রশান্তি, এক অবিশ্বাস্য আলোর ঝলক। সন্দেহ হল তুমি মানুষ না দেব-দূত। কোন মানুষ সোনা আর আমার মত নারীকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে, এ আমার কাছে অবিশ্বাস্য।

তোমার চেহারার প্রশান্তি এবং আনন্দের দ্যুতি আমার চোখে অশ্রু এনে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম, তোমাকে কে দিয়েছে এ প্রশান্তি!

তোমাকে ভুলের মধ্যে রাখতে মন চাইল না। ইচ্ছে হল আমার ব্যাপারে সব কথা তোমাকে খুলে বলি। বিনিময়ে তুমি আমাকে তোমার সে প্রশান্তি দাও, দূর করে দাও আমার সকল ভীতি, যে আতঙ্ক এখনও আমাকে পিষ্ট করছে। কিন্তু তুমি আমার কথা শুনলে না। কর্তব্যবোধ তোমার কাছে সবচে’ প্রিয়।’

রেশমা আহমদ কামালের হাত ধরে বলল, ‘হয়ত এসব কথা তুমি প্রতারণার নতুন কৌশল মনে করছ। তুমি যা ইচ্ছে ভাবতে পার, কিন্তু আমি আমার আত্মার সাথে প্রতারণা করতে পারব না।

আমার হৃদয়ের গভীরে তোমার জন্য যে ভালবাসা জন্ম নিয়েছে সে জন্য কি আমি দায়ী? আমি তো তোমাদের খুন করতেই এসেছিলাম, কিন্তু তোমার ব্যবহারে এবং তোমার হৃদয়ে প্রশান্তি দেখে আমারও লোভ  জাগল সে প্রশান্তিময় জীবনের প্রতি।

আমার মনে হয়, এ জীবনে আমি তোমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কখনও বাঁচতে পারব না। কাল তোমাকে পাপের জন্য আহ্বান করেছিলাম। এখন! জীবন ভর তোমার পায়ের কাছে বসে থাকব। আমায় দাসী হিসেবে গ্রহণ কর, বিনিময়ে সে প্রশান্তি দাও, যা নামাজ পড়ার সময় তোমার মধ্যে দেখেছি।’

আহমদ কামাল মুখ খুলল। বলল, ‘আমি বলব না, তুমি আমার সাথে প্রতারণা করছ। তবে এটুকু তোমাকে জানিয়ে দেয়া দরকার মনে করছি যে, আমি আমার জাতি এবং ফৌজকে ধোঁকা দিতে পারব না। তুমি আমার কাছে আমানত। এ আমানতের খেয়ানত আমি করতে পারি না। তোমার সাথে যে ব্যবহার করেছি তা ছিল আমার কর্তব্য। কায়রোর নির্দিষ্ট সংস্থার কাছে তোমাকে তুলে দিতে পারলেই আমার দায়িত্ব শেষ। এরপর আমাকে নির্দেশ দেয়া হবে, ‘কামাল, এবার তুমি ফিরে যাও।’

রেশমার চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছিল। কান্না একটু সামলে ওঠে মিনতি ঝরা চোখে তাকাল কামালের দিকে। বলল, ‘তোমার কাছে আমার ছোট্ট আবেদন, তোমাদের সুলতান আমাকে যখন মৃত্যুদণ্ড দেবেন তখন তুমি আমার হাত ধরে পাশে শুধু দাড়িয়ে থেকো।’

রেশমার চোখ আবারো জলে ভরে উঠল। কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, ‘এখন আর ফিলিস্তিন পৌঁছে দিতে তোমাকে অনুরোধ করব না। বাধা হয়ে দাঁড়াব না তোমার কর্তব্যের সামনে। শুধু একবার বল, তুমি আমার ভালবাসা গ্রহণ করেছ।’

এ অপবিত্র দেহ নিয়ে তোমার কাছে স্ত্রীর মর্যাদা চাই না, ট্রেনিং দিয়ে আমাদের হৃদয়টাকে পাথরে পরিণত করা হয়েছিল। ভাবতাম, আমাদের মধ্যে মানবিক অনুভূতি বলে নেই। কিন্তু খোদা আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, মানুষ পাথর নয়, কোন একদিন কাউকে না কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয়, মুসাফির, পথ আর কতদূর? ঠিক পথে চলছি তো! এসো না দু’জনে হাতে হাত রেখে আরও কিছু পথ চলি নীরবে।’

রাত এগিয়ে যাচ্ছে, কথা বলছে দু’জন। আহমদ কামাল প্রশ্ন করলেন, ‘তোমাদের মত মেয়েদেরকে ওরা আমাদের দেশে পাঠায় কেন? মেয়েরা কি কাজ করে এখানে?’

‘অনেক কাজ। মুসলমান আমীর ওমরাদের হারেমে মুসলমানের ছদ্মবেশে ঢুকিয়ে দেয়া হয় মেয়েদের। ওরা আমীর ওমরা এবং মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের হাত করে নেয়। খ্রিষ্টানদের মনোমত লোককে ক্ষমতায় বসাতে সহযোগিতা করে। খ্রিষ্টান বিরোধী আমীর ওমরাদের হত্যা করতে বা ক্ষমতাচ্যুত করতে প্ররোচিত করে।

মুসলিম যুবতীদের রূপের অহমিকা থাকলেও ওরা ততটা চতুর নয়। ইহুদী বা খ্রিষ্টান মেয়েরা কৌশলে ওদের দাসীবাঁদীতে পরিণত করে। ওদের কারণে আমীর, মন্ত্রী এবং কেল্লাদারদের অধিকাংশ থাকে আমাদের পক্ষে। কোন কোন মেয়ে পদস্থ ও বড় লোকদের রক্ষিতা হয়ে থাকে। এরা যুবক-যুবতীদের চরিত্র নষ্ট করে। যুবকদেরকে অশ্লীলতার পথে টেনে নিয়ে আসে। সংস্কৃতির নামে নারী পুরুষকে বেহায়াপনার শেষ সীমানায় পৌঁছে দেয়।

আমার মত অভিজাত ও রূপসী খ্রিষ্টান মেয়েরা তোমাদের পদস্থ লোকদের কাছে আসে গোপনে। তখন কর্মকর্তারা হয় খ্রিষ্টানদের হাতের পুতুল। গোপন অভিসারে আমরা ওদের প্রেম নিবেদন করি, ভালবাসারজনকে দেই নানা উপহার, মূল্যবান সামগ্ৰী আর স্বর্ণমূদ্রা। কেউ যেন সন্দেহ করতে না পারে এজন্য মেয়েদের লুকিয়ে রাখা হয়।

সালাহুদ্দীন আয়ুবী এবং নুরুদ্দীন জঙ্গীর মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির জন্যও ওরা কাজ করছে। আমাদের তিনজনকে এ উদ্দেশ্যেই রজবের হাতে দেয়া হয়েছিল।

খ্রিষ্টানদের গোপন তৎপরতার কাহিনী বলে যাচ্ছিল মেয়েটা, নীরবে শুনছিলেন আহমদ কামাল।

সূর্য ডোবার খানিক আগেই-কায়রো পৌঁছল কাফেলা। কমাণ্ডার গোয়েন্দা প্রধানের সাথে দেখা করলেন। মেয়েটার ব্যাপারে সব কথা বলে তাঁর হাতে তুলে দিলেন। আরও বললেন, ‘রজব কাফ্রিদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। থাকে দেবতার আশ্রমে। অনুমতি দিলে তাকে জীবিত বা মৃত ধরে আনার জন্য অভিযান চালাব।’

আলী চারজন কমাণ্ডো সৈন্য তাকে দিয়ে বললেন, ‘এখন বিশ্রাম করগে।’

গোয়েন্দা প্রধান আলী মেয়েটাকে নিজের কাছে ডেকে নিলেন। প্রশ্নের জবাবে ও বলল, ‘আহমদ কামাল আমার সামনে বসে থাকলে সব প্রশ্নের জবাব দেব। তা না হলে আমাকে জল্লাদের হাতে তুলে দিলেও মুখ খুলব না।’

আলী আহমদ কামালকে ডাকলেন। বললেন, ‘তুমি ওর পাশে বসো।’

মৃদু হেসে রেশমা বলতে শুরু করল। সবকিছুই খুলে বলল সে, কিছুই গোপন করল না। শেষে বলল, ‘আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিন দুঃখ নেই, কিন্তু আমার একটা শেষ ইচ্ছে পুরণ করতে হবে। আমি আহমদ কামালের হাতে মরতে চাই।’

‘আহমদ কামাল তোমার কাছে একজন শত্রু সৈন্য, তার হাতে মরতে চাচ্ছ কেন?’

আহমদ কামালকে কেন এত ভালবাসে তা খুলে বলল ও। আলী ওকে জেলে না পাঠিয়ে আহমদ কামালের হাতে তুলে দিলেন। নিজে ছুটলেন সুলতানের কাছে। মেয়ের বলা কথাগুলো সুলতানকে শোনালেন। বললেন, ‘সুলতান! আপনার বিশ্বস্ত ফয়জুল ফাতেমী আমাদের দুশমন। মেয়েরা তার কাছেই আসছিল।’

‘মিথ্যে কথা।’ সালাহুদ্দীন আয়ুবীর কণ্ঠে ঝাঁঝ। মেয়েটা মিথ্যে কথা বলে তোমাদের বিভ্রান্ত করতে চাইছে। ফয়জুল ফাতেমী এমন হতেই পারেন না।’

সম্মানিত সুলতান সে ফাতেমী বংশের, আপনি তা ভুলে গেছেন। সম্ভবত এও ভুলে গেছেন, ফাতেমীরা ঘাতকদলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওরা আপনার অনুগত হতেই পারে না। খলিফা আল আযেদ তাকে আপনার শক্ৰ বলে উল্লেখ করেছিল।’

গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন সুলতান সালাহুদ্দীন আয়ুবী। কাকে আর তিনি বিশ্বাস করবেন! কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘আলী, প্রমাণ ছাড়া ফয়জুল ফাতেমীকে গ্রেফতার করার অনুমতি তোমাকে দেব না। প্রমাণসহ সুযোগ মত ধরতে হবে তাকে, সে সুযোগ সৃষ্টি করা তোমার দায়িত্ব। আমি হাতে নাতে ধরতে চাই তাকে। ফয়জুল সেনা প্রশাসনের প্রধান কর্মকতা। যুদ্ধের সব গোপন পরিকল্পনা সে জানে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রমাণ পেশ কর।’

‘সুলতান, এ জন্য আমি এক পরিকল্পনা পেশ করছি। মেয়েটার উপর দিয়ে ভয়ঙ্কর ঝড় বয়ে গেছে। আতঙ্ক জড়িয়ে আছে ওর মন মস্তিষ্কে। আহমদ কামালের জন্য আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে সে। আহমদ কামাল তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে, এ জন্য কৃতজ্ঞ সে। তা ছাড়া তার ব্যবহারেও সে চমৎকৃত হয়েছে। আহমদ কামালের অনুপস্থিতিতে সে কথাই বলতে চায়নি। আশা করি মেয়েটার এ দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে ওকে ব্যবহার করতে পারব।’

‘চেষ্টা করে দেখ। তবে মনে রেখ, বাস্তব প্রমাণ ছাড়া ফয়জুল ফাতেমীকে গ্রেফতার করার অনুমতি দেব না।’

আলী বিন সুফিয়ান মেয়েটার কাছে গেলেন। বুঝিয়ে বললেন উদেশ্য।

‘কামাল বললে আমি আগুনেও ঝাঁপ দিতে পারব।’

আলী চাইলেন আহমদ কামালের দিকে। চোখে চোখে কথা হলো দু’জনের।

‘হ্যাঁ, উনি যেভাবে বলেন কর।’ আহমদ কামাল বললেন, ‘কি করতে হবে বুঝে নাও।’

‘আমি সফল হলে আমাকে কি পুরষ্কার দেয়া হবে?’

‘তোমাকে নিরাপদে ফিলিস্তিনের সুবাক কেল্লায় পৌঁছে দেয়া হবে।’ বললেন গোয়েন্দা প্রধান। ‘এখানে যতদিন থাকবে সম্মানের সাথে রাখা হবে।’

‘না, এ বিনিময় খুবই নগণ্য। আমি আরও বড় পুরষ্কার চাই। আমি মুসলমান হব। আমায় বিয়ে করবে আহমদ কামাল।’

আহমদ কামাল এ প্রস্তাব সরাসরি অস্বীকার করলেন। তাকে বাইরে ডেকে নিয়ে গেলেন গোয়েন্দা প্রধান। বুঝিয়ে বললেন প্রস্তাবে রাজি হতে।

আহমদ কামাল বললেন, ‘জানি ও মুসলমান হবে। এরপরও ওকে আমি ইসলামের শক্রই মনে করব।’

‘ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে নয়, আল্লাহর ফয়সালার ওপর সন্তুষ্ট থাকাই একজন মুমিনের বৈশিষ্ট। ও আমার চাইতেও খাঁটি ঈমানদার হবে না এমন কথা আমি বলতে পারি না। দীলের মালিক আল্লাহ, ও ইসলামে ফিরে এলে শক্রর অনেক গোপন খবর জানতে পারব আমরা। বিয়েটা যদিও তোমার একান্ত নিজের পছন্দের ব্যাপার, তবু দেশ এবং জাতির স্বার্থে তোমাকে এ ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।’

গোয়েন্দা প্রধানের কথা মেনে নিলেন আহমদ কামাল। ওরা আবার ভেতরে গেলেন। আহমদ কামাল মেয়েটাকে বললেন, ‘তোমাকে এখনও আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। যদি তুমি আমার জাতির জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে পার, আমার ধর্মের প্রতি অনুরাগী হও, তোমাকে বিয়ে করতে আমার কোন আপত্তি নেই।’

মেয়েটা আলীকে বলল, ‘বলুন কি করতে হবে। দেখব মুসলমান প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে কিনা। তবে ওকে আমার সাথে থাকতে হবে?’

আলী তার এ শর্ত মেনে নিলেন। একজন অফিসারকে ডেকে ওদের থাকার ব্যবস্থা করতে বললেন। দরজা বন্ধ করে আহমদ কামালের সামনে ওকে দায়িত্ব বুঝাতে লাগলেন আলী বিন সুফিয়ান।