» » সালাহুদ্দীন আয়ুবীর কমান্ডো অভিযান

বর্ণাকার

আঙ্গুক গোত্র ছিল ভীত সন্ত্রস্ত্র। দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়া যায়নি, পুরোহিত মারা গেছে, ভেঙে ফেলা হয়েছে দেবতার বিগ্রহ। তাছাড়া দেবতার অপমানের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নিহত হয়েছে হাজার হাজার যুবক। ঘরে ঘরে মাতম।

কেউ কেউ ভাবতে লাগল, যে দেবতার আশ্রম ভেঙে দিতে পারে, সে নিশ্চয়ই বড় দেবতা।

বর্তমান পুরোহিত গোত্রের অবস্থা দেখে বললেন, ‘দেবতাদের কুমীর ক্ষুধার্ত। ওদের খাবারের ব্যবস্থা কর।’

কাফ্রিরা উট, ভেড়া, ছাগল পাঠিয়ে দিল। কিন্তু মানুষের অন্তর থেকে দেবতাকে নাখোশ করার ভয় দূর হল না।

এক রাতে পুরোহিত গোত্রের সবাইকে একত্রিত করলেন পাহাড়ের বাইরে। বললেন, ‘আমি দেবতাদের সাথে কথা বলেছি। সময়মত বলি না দেয়ায় এ বিপদ এসেছে। দেবতারা বলেছেন, এক সঙ্গে দু’টো মেয়ে বলি দিলেই কেবল এ বিপদ দূর হবে। তা না হলে দেবতা কাউকে ছাড়বে না।’

দুঃসাহসী যুবকেরা উঠে দাঁড়াল। মিসৱ থেকে তুলে আনবে দু’টো মুসলমান বা ফিরিঙ্গী মেয়ে।

ফিলিস্তিন থেকে আসছে রজব। সাথে তিন যুবতী এবং দশজন সৈন্য। দীর্ঘ বিপজ্জনক সফর। সে সালাহুদ্দীনের ফৌজের বিদ্রোহী এবং পলাতক কমাণ্ডার। সীমান্তে পেট্রোল ডিউটি দিচ্ছে সুলতানের সৈন্য। ধরাপড়ার আশংকা রয়েছে। অনেক ঘুরপথ দিয়ে চলছে সে। খাবার এবং পানি বোঝাই তিনটি উট।ওদের বাহন ঘোড়া।

ক’দিন পর ওরা দেবতার আশ্রম পাহাড়ে পৌঁছল। এর একদিন আগে পুরোহিত মেয়ে বলি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

রজব প্রথমেই দেখা করল পুরোহিতের সাথে। তিনটে সুন্দরী যুবতী দেখে পুরোহিতের চোখ ঝলসে উঠল। বলির জন্য উপযুক্ত। মেয়েদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল পুরোহিত। রজব বলল, ‘এদেরকে বিশেষ উদ্দেশ্যে আনা হয়েছে।’

তিনদিকে পাহাড় ঘেরা এক মনোরম জায়গায় মেয়েদের নিয়ে গেল রজব। তাঁবু টানাল। সুযোগ পেলেই ওদেরকে কায়রো পাঠিয়ে দেবে। পথে কোন ঝামেলা হয়নি, নিরাপদেই পৌঁছতে পেরেছে এ খুশীতে রাতে উৎসব জমাল। জমল মদের আসর। খ্রিষ্টান সৈন্যরাও অংশ নিল এতে। পান করল মেয়েরাও।

মধ্যরাত। ঘুমিয়ে আছে সবাই। একটা মেয়ের হাত ধরে নিজের তাঁবুর দিকে যেতে চাইল রজব। উদ্দেশ্য বুঝে ফেলল মেয়েটি। বেঁকে বসল। বলল, ‘আমি পতিতা নই। এসেছি ক্ৰশের দায়িত্ব পালন করার জন্য। আপনার সাথে মদপান করতে পারি, কিন্তু বাজে প্রস্তাবে সাড়া দিতে পারি না।’

রজব হেসে ওকে নিজের দিকে আকর্ষণ করল, হাত ছাড়িয়ে নিল মেয়েটা। রজব বাড়াবাড়ি করতেই ও হাত ছাড়িয়ে এক দৌড়ে সঙ্গী মেয়েদের কাছে ছুটে গেল। তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল অন্য দু’জন। ওরা রজবকে বুঝিয়ে বলল, ‘বিশেষ উদ্দেশ্যে ওদের আসা।রজব যেন ওদের বেশ্যা মনে না করেন।’

ক্ষেপে গেল রজব। ‘তোমরা কেমন সতী আমি জানি। তোমাদের পেশাই হল বদমাইশি আর বেশ্যাগিরি।’

‘দায়িত্ব পালন করার প্রয়োজনেই কেবল আমরা এ পেশা ব্যবহার করি। ভোগবিলাসের জন্য করি না।’

রজব কোন কথা শুনতে নারাজ। তাকে বুঝাতে না পেরে মেয়েরা বলল, ‘আমাদের সাথে দশজন সৈন্য আছে। আমাদের হেফাজতের জন্য এসেছে ওরা। কাল ওদের ফিরে যাবার কথা। কিন্তু আমরা প্রয়োজন মনে করলে ওদের রেখে দিতে পারি বা বাড়বাড়ি করলে আমরা ফিরেও যেতে পারি।’

হুমকিটা ঠিকমতই কাজে লাগল, চুপ মেরে গেল রজব। কিন্তু চেহারা দেখে মনে হল সে মেয়েদের সহজে ছাড়বে না।

পরদিন সৈন্যদের বিদায় করে দিল সে। দিন গড়িয়ে গেল। সন্ধ্যায় মেয়েদের সাথে গল্প করছিল রজব, পুরোহিত এলেন চারজন কাফ্রি সাথে নিয়ে। রজবকে বললেন, ‘আমাদের দেবতা অসন্তুষ্ট। তিনি দু’টি ফিরিঙ্গী অথবা মুসলমান মেয়ের রক্ত চেয়েছেন। এ মেয়েরা বলির জন্য উপযুক্ত। এখান থেকে দু’টো মেয়ে আমাদের দিতে হবে।’

রজবের মাথায় বাজ পড়ল যেন। বলল, ‘এদের বলি দেয়ার জন্য আনা হয়নি, এদের দিয়ে অন্য কাজ করাব। যারা তোমাদের অপমান করেছে তাদের হত্যা করব এদের সাহায্য নিয়ে।’

‘তুমি মিথ্যে বলছ।’ পুরোহিত বলল, ‘তুমি ভোগের জন্য এদের এনেছ। এদের দু’জনকে অবশ্যই আমরা বলি দেব।’

রজব অনেক যুক্তি পেশ করল, কোন কিছুই শুনতে রাজি নন পুরোহিত। দেবতা তার মনমানসিকতা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তিনি এগিয়ে পর পর দু’টো মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘আঙ্গুকের মুক্তি এ দু’টো মেয়ের হাতে।’

চলে যাওয়ার জন্য ফিরে দাঁড়ালেন তিনি। রজবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মেয়েদের নিয়ে পালানোর চেষ্টা করো না। তুমি যেখানেই যাবে, খুঁজে বের করে ফেলবে আমাদের ছেলেরা।’

চলে গেলেন পুরোহিত। মেয়েরা ওদের ভাষা বোঝেনি। ওরা সবাই রজবকে ঘিরে দাঁড়াল। বলল, ‘কি বলেছে কাফ্রিটা?’

রজব বলল, ‘পুরোহিত দেবতাদের নামে বলি দেয়ার জন্য তোমাদের দু’জনকে চেয়েছে।’

একটা মেয়ে বলির ব্যাপারে জানতে চাইলে সে বলল, ‘মাথা কেটে রোদে শুকাবে। দেহটা ফেলে দেবে ঝিলে। ওখানে অনেক কুমির রয়েছে।’

বিবর্ণ হয়ে গেল মেয়েদের চেহারা। বলল, ‘আমাদেরকে রক্ষা করার জন্য আপনি কি চিন্তা করেছেন?’

‘আমি অনেক বুঝিয়েছি, পুরোহিত কিছুই শুনতে চাচ্ছে না। এখন তার দয়ার ওপর নির্ভর করছে আমাদের জীবন। ওরা বলছে, আমার ফৌজে ওরা যোগ দেবে, তবে তার পূর্বে দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে হবে।’

রজবের কথায় ওদের সন্দেহ হল, পুরোহিতকে খুশী করতে চাইবে লোকটা। ওদের বাঁচানোর চেষ্টা সে করবে না। গত রাতেই তাকে চিনে ফেলেছে ওরা। লোকটা ওদের একটু সান্ত্বনাও দেয়নি।

মেয়েরা তাঁবুতে ফিরে গেল। ভাবতে লাগল কি করা যায়। দেবতাকে খুশী করতে বা রজবের ভোগের সামগ্রী হতে ওরা এখানে আসেনি। উদ্দেশ্যহীনভাবে মরতেও চায় না ওরা। সিদ্ধান্ত নিল, ওরা পালিয়ে যাবে। কিন্তু পালিয়ে ফিলিস্তিন পর্যন্ত যাওয়া সহজ নয়। তবু আত্মরক্ষার জন্য ওদেরকে এ ঝুঁকি নিতেই হবে। ওরা শুধু সুন্দরী নয়, জাতির খেদমতের জন্য দীর্ঘ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে ওদের। এভাবে মরার জন্য ওদের ট্রেনিং দেয়া হয়নি।

রাত কেটে গেল। দিনের বেলায় ওরা ঘোড়ার আস্তাবল দেখল। যে পথে এসেছে তাও দেখল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। পুরোহিত এসে রজবকে কি বলে চলে গেল।

রজব মেয়েদের বলল, ‘পুরোহিত আগামীকাল তোমাদের নিয়ে যাবে। বাধা দিলে আমাকে হত্যা করে ঝিলের কুমির দিয়ে খাওয়াবে বলে শাসিয়ে গেছে।’

মেয়েরা পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ কথা রজবকে বলল না।

‘মরুভূমিতে এত সবুজ কোত্থেকে এসেছে? কি সুন্দর পরিবেশ। আমাদের একটু ঘুরিয়ে দেখাবেন?’ বলল শায়লা, মেয়েদের একজন।

রজব ওদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল ঝিলের কাছে। কিনারে শুয়ে আছে পাঁচটি কুমীর। পানিতে দুৰ্গন্ধ। এক যুবতী বলল, ‘ঝিল কি পাহাড়ের ভেতরে চলে গেছে?’

একসঙ্গে তাকাল সবাই। কুমীর দেখে তিনটি মেয়ে একত্রে চিৎকার করে উঠল।

রজব বলল, ‘বলি দেয়া মেয়েদের দেহ এবং গোত্রের অপরাধীদের দেহ এসব কুমীরকে খেতে দেয়া হয়।’

এ ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে ওদের পালানোর চিন্তা আরও দৃঢ় হল। রজবের সাথে ঘুরে ফিরে পালানোর সম্ভাব্য পথ দেখে নিল ওরা।

সুসংবাদ শোনাতে আশ্রম ছেড়ে গাঁয়ে ছুটে গেলেন পুরোহিত। লোকদের ডেকে বললেন, ‘তোমাদের জন্য সুসংবাদ। আজ থেকে চার রাত পর ভরা পূর্ণিমায় দেবতার আশ্রমে দুটি ফিরিঙ্গী মেয়ে বলি দেয়া হবে। বলিদান শেষ হলেই মন্দির মেরামত করব। এরপর যারা আমাদের দেবতাদেরকে অপমান করেছে তাদের উপর প্রতিশোধ নেব।’

মধ্যরাত। মেয়েগুলো রজবের হাতে তুলে দিচ্ছে মদের গ্লাস। একটার পর একটা গ্লাস নিঃশেষ করে চলেছে রজব। অতিরিক্ত মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে গেল, ভোর পর্যন্ত জাগার সম্ভাবনা নেই।

নিজেদের তাঁবুতে ফিরে গেল মেয়েরা। সফরের প্রস্তুতি নিতে লাগল। জিন বাঁধল ঘোড়ার পিঠে, আলগোছে সওয়ার হয়ে দিনের দেখা পথ ধরে এগিয়ে চলল।

কাফ্রিদের চারজন পাহারাদার খানিক দূরে ঘুমিয়ে আছে। ওরা জানত, এখান থেকে পালানোর সাহস কারো নেই। পালিয়ে গেলেও হারিয়ে যাবে বিশাল মরুভূমির বিস্তারে। কিন্তু শ্যামল সবুজ এক ভয়ঙ্কর কারাগার থেকে বেরিয়ে গেল মেয়েরা।

যে পথে রজব ওদের এনেছিল সে পথ ধরেই ওরা ফিয়ে যাচ্ছিল। ওরা ছিল মেধাবী, বুদ্ধিমতি। ওদের ছিল সামরিক ট্রেনিং। তাই ওরা ভাবল, কাজটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। কিন্তু ওরা জানত না উষর মরুভূমির সীমাহীন বিস্তৃতিতে ধু ধু বালুর সমুদ্রে হারিয়ে যেতে সময় লাগে না। আদিগন্ত বালির রাজ্যে একজন বুদ্ধিমান মানুষও অবলীলায় প্রতারিত হতে পারে, দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে হারিয়ে যেতে পারে সীমাহীন সীমানায়। এজন্যই লোকেরা মরুভূমিতে ভ্রমণের সময় দলবদ্ধভাবে বের হয়। মরুভূমির এ বিপদ প্রতিরোধের কোন অস্ত্র ওদের হাতে ছিল না।

নিশীথ রাতের নিস্তব্ধতা মাড়িয়ে কিছু দূর পর্যন্ত ধীরে ধীরেই পথ চলল ওরা। এরপর ঘোড়া ছুটাল তীব্র গতিতে। রাতের উত্তাপহীন মরু বাতাস কেটে যতদূর সম্ভব দ্রুত এগিয়ে চলল ওরা। অনেক দূর গিয়ে গতি কমাল। ততক্ষণে রাত একদিকে হেলে পড়েছে। কমে এসেছে ধরা পড়ার আশঙ্কা। এরপর ঢিলেঢালা ভাবেই পথ চলল বাকী রাতভর।

ভোরে সূর্য উঠল। চারপাশে বালিয়াড়ী। সামনে দূরে দেখা যাচ্ছে উঁচু উঁচু পাহাড়। কোন দিকে কোন পথ নেই, যেদিকে চোখ যায় কেবল অন্তহীন বালু আর বালু। ওরা সূর্য দেখে দিক ঠিক করে উত্তরমুখো এগিয়ে চলল।

ঘোড়াগুলো তৃষ্ণাৰ্ত। ওদের পিঠে বাধা মশকে যে পানি আছে তাতে বড়জোর একদিন চলবে। মেয়েরা চারদিক তাকিয়ে কোন খেজুর বাগান বা ওয়েসিস পাওয়া যায় কিনা খুঁজতে লাগল।

আকাশে উঠে এসেছে সূর্য। তাপ বাড়ছে, উত্তপ্ত হচ্ছে মরুর পরিবেশ। কোন দিকে কোন ছায়া নেই, খর্জুর বীথি নেই, একফোটা পানির চিহ্ন নেই কোথাও।

মাথার উপরে উঠে এসেছে সূর্য। রজবের ঘুম তখনো ভাঙ্গেনি। তিনজন কাফ্রিকে সাথে নিয়ে তাঁবুতে এলেন পুরোহিত। প্রথমেই গেলেন মেয়েদের তাঁবুতে। নেই। ফিরে এসে রজবকে জাগালেন।

‘মেয়েরা কোথায়?’ পুরোহিত বললেন, ‘মেয়ে দু’টোকে আমার হাতে তুলে দাও।’

‘এমন মূল্যবান মেয়েগুলোকে নষ্ট করবেন না।’

কিন্তু পুরোহিত নিজের সিদ্ধান্তে অটল। চিৎকার করে বললেন, ‘মেয়েরা কোথায়?’

তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল রজব। ডাকল মেয়েদের। মেয়েদের তাঁবু থেকে কোন জবাব এল না। এগিয়ে গিয়ে মেয়েদের তাঁবুর ভেতর উঁকি দিল। তাকাল এদিক ওদিক। না, কোথাও নেই ওরা।

দৃষ্টি ফেলল আস্তাবলে, জিনসহ তিনটি ঘোড়া গায়েব। ফ্যাকাশে হয়ে গেল রজবের চেহারা। পুরোহিতকে বলল, ‘ওরা তোমাদের ভয়ে পালিয়ে গেছে। তোমরা আমার মহা মূল্যবান মেয়েগুলোকে তাড়িয়ে দিয়েছ।’

‘তুমিই ওদের ভাগিয়ে দিয়েছে।’ পুরোহিত সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওকে বেঁধে ফেল। ও আবার আঙ্গুকের দেবতাদেরকে অসন্তুষ্ট করেছে।’

পুরোহিতের সঙ্গীরা রজবের দিকে এগিয়ে গেল। পুরোহিত একজনকে বললেন, ‘গাঁয়ে যাও। দ্রুত ঘোড়া ছুটাতে পারে এমন যুবকদেরকে এখনি এখানে ডেকে নিয়ে আস। মেয়েরা নিশ্চয়ই এখনও বেশী দূর যেতে পারেনি। ওদের পিছু নাও।’

শত অনুনয় বিনয় সত্ত্বেও রজবকে পিছমোড়া করে গাছের সাথে বেঁধে ফেলল ওরা। তার সঙ্গীদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া হল। বলা হল, তাঁবুর বাইরে পা বাড়ালেই হত্যা করা হবে।

একটুপর জন দ্রুতগামী অশ্বারোহী মেয়েদের পেছনে ছুটল। বালিতে ঘোড়ার ক্ষুরের চিহ্ন স্পষ্ট। ট্রেইল ধরে এগিয়ে চলল ওরা। আট দশ ঘণ্টা আগে পালিয়েছে মেয়েরা। কিন্তু কাফ্রিরা মরু সন্তান। চরম কষ্ট সহিষ্ণু উপজাতি। ভয়ঙ্কর বিপদ মোকাবেলা করেই জীবন কাটে ওদের। ধুলোঝড় সৃষ্টি করে ওদের রেখে যাওয়া ট্রেইল ধরে ঘোড়া ছুটল তীব্র গতিতে।

সামনে ট্রেইল নেই। বালু উড়ে ঘোড়ার পদচিহ্ন মুছে দিয়ে গেছে। তবুও অনুমান করে দ্রুত এগিয়ে চলল ঘোড়সওয়ার দু’জন।

চার ঘণ্টা একটানা ঘোড়া ছুটিয়েছে ওরা। হঠাৎ দূর দিগন্তে দেখা গেল ধুসর লালচে বালু ধীরে ধীরে উপরে উঠে যাচ্ছে। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে চাইল ওরা। ছুটে আসছে মরু ঝড় সাইমুম।

ঘোড়া ঘুরিয়ে পেছন দিকে ছুটতে লাগল ওরা। প্রাণপনে সরে যেতে চাইছে ওরা সাইমুমের ছোবল থেকে।

সাইমুমের প্রচণ্ডতা ওদের চাইতে আর কেউ বেশী জানে না। এ ঝড় নিমেষে লণ্ডভণ্ড করে দেয় বালির পাহাড়। কেউ থেমে গেলে বা বসে পড়লে তার উপর মুহুর্তে তৈরী হয়ে যায় আরেকটা বালির পাহাড়। ছুটতে থাকলে উড়িয়ে নিয়ে যায় মাইলকে মাইল দূরে। পাথুরে কোন পাহাড়ের সুবিধাজনক খাঁজে লুকাতে পারলেই কেবল কিছুটা বাঁচার আশা করা যায়।

আশপাশে তাকাল ওরা। ঝড় থেকে রক্ষা পাওয়ার মত কোন শক্ত পাহাড় নেই ধারে কাছে। ওরা যেতে চাচ্ছিল সামনের পাহাড় শ্রেণীতে, যা এখনও অনেক দূরে।

ঝড় পৌঁছে গেছে দেবতার পার্বত্য আবাসে। কুমীরগুলো আশ্রয় নিয়েছে পাহাড়ের গর্তে। মড়মড় করে ভেঙে পড়ছে গাছগাছালী। মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পুরোহিত চিৎকার করে বলছেন, ‘আঙ্গুকের দেবতা! তোমার এ অভিশাপ তুলে নাও। আমরা খুব শীঘ্রই দু’টো রূপসী যুবতী তোমার উদ্দেশ্যে বলি দেব।’

পুরোহিত ঝড়কে দেবতার অভিশাপ মনে করছিলেন।

মেয়ে তিনটেও ঝড়ের কবলে পড়ল। আশ্রয় নেয়ার কোন আড়াল ছিল না। ওরা কাফ্রিদের নাগাল থেকে অনেক দূরে এক বিজন মরুতে। ঝড়ের আঘাতে আতঙ্কিত ঘোড়া এলোপাথাড়ি ছুটতে লাগল। সামরিক বাহিনীর ঘোড়া, শত বিপদেও তাই ওরা বিচ্ছিন্ন হলো না। এক সাথে ছুটছে ঘোড়াগুলো, কোথায় গিয়ে থামবে জানে না ওরা।

সাইমুম সরাসরি ওদের ওপর আঘাত হানেনি। নিস্তেজ একটি শাখার ঝাপটা খেয়েই মেয়েগুলোর অবস্থা কাহিল। কাহিল ঘোড়াগুলোও। ঘোড়াগুলো যেমন দ্রুত ছুটতে পারছে না, তেমনি মেয়েরাও ওদের সামলানোর শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

তৃষ্ণার্ত ঘোড়াগুলো মাঝরাত থেকে একনাগাড়ে ছুটেছে। ক্ষুধা তৃষ্ণায় দুর্বল হয়ে পড়েছে ঘোড়াগুলো। দৌড়াতে দৌড়াতে উপুড় হয়ে পড়ে গেল একটা ঘোড়া সাথে সাথে ছিটকে পড়ল আরোহিনী। ঘোড়াটা ডিগবাজি খেয়ে পড়ল গিয়ে মেয়েটা ওপর। উপরে ঘোড়া, নীচে মেয়েটা। বুঝতে পারল মারা যাচ্ছে ও।

অন্য ঘোড়া দুটো খানিক এগিয়ে গেল। ওদের থামাতে চাইল মেয়েরা। টেনে ধরল লাগাম। হঠাৎ গতি পড়ে যাওয়ায় সামনের দিকে ঝুকে পড়ল আরেকটা মেয়ে। ঘোড়ার জিন ঢিলা হয়ে কাত হয়ে গেল একদিকে। মেয়েটা পড়ে গেল নীচে। পা দানিতে আটকে গেল বাম পা। দৌড় থামালেও ঘোড়াটা তার হাঁটা থামাল না, মেয়েটা মাটির সাথে হেঁড়াতে থাকল।

তৃতীয় মেয়েটা ওদের কোন সাহায্য করতে পারছে না। ওর নিজের ঘোড়াও বশে নেই, এলোমেলো ছুটছে সে। কানে ভেসে আসছে মেয়ে দুটোর হৃদয় ফাটা চিৎকার। দীর্ঘক্ষণ এ চিৎকার ধ্বনি তাকে আচ্ছন্ন করে রাখল। এক সময় থেমে গেল চিৎকার। একটা মেয়ের লাশ ঘোড়ার সাথে হিঁচড়ে যাচ্ছিল, সেদিকে বোবার মত তাকিয়ে রইল ও। ভয়ার্ত ও আতঙ্কিত দৃষ্টি। দুঃসাহসী গোয়েন্দা হলেও ও একটা মেয়ে। হঠাৎ কি হল, নিরবতা ভেঙে সেও চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।

তার চিৎকার শুনেই কিনা আল্লাহ্ মালুম, হঠাৎ থেমে গেল সামনের ঘোড়াটা। ও নিশ্চিত জানে, মরে গেছে তার বান্ধবী। তবু কি এক অব্যক্ত আশা নিয়ে সে তাকিয়ে রইল ওদিকে। জলে ভরে গেল চোখ। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে চাইল পেছন দিকে। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, ঘোড়ায় চাপা পড়া বান্ধবী বা ঘোড়া কিছুই দেখা গেল না সে অন্ধকারে।

তৃতীয় মেয়েটা এখন একা, নাম রেশমা। রেকাব থেকে পা খানিকটা পেছনে সরিয়ে নিল ও। বলগা ছেড়ে দিয়ে দু’হাত আকাশের দিকে তুলল মেয়েটা। চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘হে মহান প্ৰভু! হে আকাশের মালিক! আমায় ক্ষমা কর। পাপী আমি, পাপের সাগরে আকণ্ঠ ডুবে আছি। পাপ করার জন্যই এসেছিলাম দুনিয়ায়। বড় হয়েছি পাপের মধ্যে। খোদা আমার! আমি তখন খুব ছোট। বড়রাই আমাকে পাপের পথে টেনে এনেছে। পাপের প্রশিক্ষণ দিয়ে বড় করেছে আমাকে। ওরা আমায় বলেছে, যাও, এ চোখ ধাঁধানো রূপ আর দেহ দিয়ে মানুষকে নষ্ট কর, মিথ্যা কথা বল, একজনের হাত দিয়ে আরেকজনকে হত্যা করাও। প্রতারিত কর মানুষকে। ওরা বলেছে, এ হচ্ছে ক্ৰশের পক্ষে পবিত্র দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন করলে তুমি স্বর্গ পাবে।…’

ও প্রলাপ বকছিল আর চিৎকার করছিল পাগলের মত। শ্লথ হয়ে এল ঘোড়ার গতি। কাঁদতে কাঁদতে ও বলল, ‘তোমার কাছে যে ধর্ম সত্য, আমাকে তার মাজেযা দেখাও প্রভু। আমি তোমার সত্য দ্বীনকে চিনতে চাই। মৃত্যুর আগে একবার দেখতে চাই তোমার মহিমা।’

তার বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। অনুশোচনায় পিষ্ট হচ্ছে তার কোমল হৃদয়। সে কোন ধর্মের অনুসারী মৃত্যু ভয় তাও ভুলিয়ে দিয়েছে। সে শুধু  ভাবছে তার পাপে ভরা জীবনের কথা। চেতনার পরতে পরতে সে পাপের অনুভূতি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। ও ভাবছে, আমি কি কেবলই পুরুষের ভোগের সামগ্ৰী? মানুষকে প্রতারিত করার জন্যই কি আমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে? হায়! এখন আমাকে দেখার আর কেউ নেই।

মাথা ঝাঁকিয়ে তন্দ্রা দূর করে বিলাপের সুরে ও বলতে লাগল, ‘হে খোদা, আমাকে সাহায্য কর। এখনি আমি মরতে চাই না।’

হঠাৎ ওর মনে হল ও এক পিতৃহারা। মৃত্যু সামনে এলে মানুষ অতীতে ফিরে যায়। এক যুবতী তার হারানো অতীতে ফিরে যেতে চাইছিল। কিন্তু ওখানে কিছুই নেই। মা নেই, বাবা নেই, নেই কোন ভাইবোন। ওর শুধু মনে আছে, খ্রিষ্টানরা ওকে লালন পালন করেছে। ওরাই এ পথে নিয়ে এসেছে ওকে। ও এক মনকাড়া প্রতারণার যন্ত্র।

নিজের উপর ঘৃণা হল ওর। ও ক্ষমা চাইছে, মুক্তি চাইছে। আবার তন্দ্রা এসে জাপটে ধরল ওকে। ঘোড়াটা ধীরে ধীরে হাঁটছে। থেমে গেছে ঝড়। মরুভূমিতে নেমে এসেছে রাতের আঁধার। প্রকৃতির সে সীমাহীন বিশালতা, অন্ধকারে রাতে ঘোড়ার উপর পরে আছে এক অসহায় মেয়ে।

সীমান্ত পাহারার জন্য বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়েছিলেন সুলতান সালাহুদ্দীন। সীমান্ত রক্ষীদের হেডকোয়ার্টার ছিল মিসর এবং সীমান্তের চার পাঁচ মাইল ভেতরে এক পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। ওখানে ছিল তিন প্লাটুন সৈন্য। থাকত তাঁবু খাটিয়ে। সীমান্তের বিভিন্ন চেকপোস্টে পাঠিয়ে দেয়া হত সৈনিকদের। এক চেকপোস্ট থেকে আরেক চেকপোস্ট পর্যন্ত টহল বাহিনী নিয়মিত টহল দিয়ে বেড়াত।

আজকের ঝড়ে তাঁবুগুলোর যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। উট ঘোড়া সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিল সৈন্যরা। ঝড় থামার পর ওরা তাঁবু মেরামতে লেগে গেল। ওদের কমাণ্ডার একজন তুর্কি। আহমদ কামাল। চমৎকার দেহের গড়ন। ফর্সা আকর্ষণীয় চেহারা।

ঝড় থামতেই তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মালপত্র এবং উট ঘোড়া দেখলেন। দিগন্ত ফর্সা হয়ে গেছে। একজন সৈনিক দক্ষিণ দিকে ইশারা করে বলল, ‘কমাণ্ডার, ওই দিকে দেখুন, মনে হয় কোন সওয়ারী।’

‘হ্যা, তাই।’ দূরে নজর দিয়ে বলল কমাণ্ডার, ‘এবং মনে হয় সওয়ারী কোন পুরুষ নয় মহিলা।’

‘এ সওয়ারী ও ঘোড়া কি আমাদের?’

‘আমাদের সেনাবাহিনীতে এখনও কোন মেয়ে ভর্তি করা হয়নি। দেখছ না চুল ছড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি দু’টো ঘোড়া নিয়ে এসো, অন্ধকার গ্রাস করার পূর্বেই ওর কাছে পৌঁছতে হবে আমাদের।’

মেয়েটাকে নিয়ে ঘোড়াটা তখন ওদের দিকেই আসছিল। ওরাও ঘোড়া ছুটাল ওদিকে। সামনের পথটুকু চোরাবালিতে ভরা। তাই দ্রুত ছুটতে পারছিল না। মেয়েটার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল।

সিপাইকে সাথে নিয়ে কমাণ্ডার যখন ওখানে পৌঁছল তখন রাতের আঁধার নেমে এসেছে। ঘোড়াটা মাথা নুইয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছে। ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে যাচ্ছে তাঁবুর দিকেই। আরোহী এক যুবতী। মাথা নোয়ানো। ঘোড়ার ঘাড়ের খানিকটা পেছনে অবিন্যস্ত চুল ছড়িয়ে সামনের দিকে বুকে আছে। অজ্ঞান।

কমাণ্ডার রেকাব থেকে মেয়েটার পা ছাড়িয়ে পাঁজাকোলা করে নামিয়ে আনলেন। সিপাইকে বললেন, ‘বেঁচে আছে, মনে হয় ফিরিঙ্গী।’

‘তুমি ওর ঘোড়াটাকে সামলাও।’

মেয়েটাকে নিজের ঘোড়ায় তুলে ওরা যতটা সম্ভব দ্রুত ক্যাম্পে ফিরে এল। ওকে এক তাঁবুতে নিয়ে গেলেন কমাণ্ডার। চুলে বালি লেগে আছে। পানির ঝটকা দিলেন মেয়েটার চোখে মুখে। এরপর ফোঁটা ফোঁটা পানি দিতে লাগলেন মুখের ভেতর।

চোখ খুলল মেয়েটা। তাকাল আহমদ কামালের দিকে। কয়েক মুহূর্ত হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন কমাণ্ডার। রেশমা বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কি এখন ফিলিস্তিন?’

এদিক ওদিক মাথা দুলিয়ে কমাণ্ডার বোঝালেন, এ ভাষা তিনি বোঝেন না। মেয়েটা আরবীতে প্রশ্ন করল, ‘তুমি কে? আমি এখন কোথায়?’

‘আমি মুসলিম ফৌজের সাধারণ এক কমাণ্ডার, আহমদ কামাল বললেন, ‘তুমি এখন মিসরে।’

আতঙ্কে বিস্ফারিত হল মেয়েটার চোখ। যেন এখনি জ্ঞান হারাবে আবার। আহমদ কামাল বললেন, ‘ভয় নেই, সুস্থির হও, নিজকে সংযত কর।’

আহমদ কামালের কথায় তার ভয় ও আতঙ্ক মোটেই কমল না, বরং সে আরও অবাক হলো। তার সে অবাক করা ভাব ফুটে উঠল চেহারায়।

আহমদ কামাল আবার বললেন, ‘বুঝেছি, তুমি ফিরিঙ্গী। কিন্তু এখন তুমি আমার অতিথি। ভয়ের কোন কারণ নেই, আমি একজন মুসলমান। মুসলমান অসহায় নারীদের ইজ্জত করতে জানে। তুমি যে ধর্মেরই হওনা কেন, তোমার ইজ্জত আব্রুর হেফাজত করা এখানকার প্রতিটি সৈনিকের পবিত্র কর্তব্য।’

কমাণ্ডার একজন সেপাইকে ডাকলেন। বললেন, ‘এর জন্য খাবার এবং পানি নিয়ে এস।’

পানি আনতেই মেয়েটা পানির গ্লাস লুফে নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করতে শুরু করল। আহমদ কামাল তার ঠোঁট থেকে গ্রাস সরিয়ে দিলেন।

‘আস্তে। আগে খেয়ে নাও, পরে পানি পান কর।’

মেয়েটা খাবার খেল, পানি পান করল। চেহারায় ফিরে এল দ্যুতি।

কমাণ্ডার ওর গোসলের ব্যবস্থা করলেন। গোসল শেষে তাঁবুতে ঢুকল ও। তাঁবুটা ছিল কমাণ্ডার আহমদ কামালের। কোন তাঁবু খালি না থাকায় এখানেই এনে তুলেছিলেন তিনি। ও যখন গোসল করছিল ততক্ষণে কমাণ্ডার পর্দা টানিয়ে তাঁবুটা দুভাগ করে নিলেন। ও তাঁবুতে ঢুকতেই পর্দা টেনে দিলেন তিনি।

ওর আতঙ্ক তখনো কাটেনি। ও জানে, এখন ও শক্রর আশ্রয়ে। এদের কাছে ভাল ব্যবহার আশা করা যায় না। শৈশব থেকেই ওকে বুঝানো হয়েছে মুসলমানরা হল পশু। নারীদের জন্য আস্ত জানোয়ার। এই সাথে ওর মনে ছিল কাফ্রিদের কুমীর এবং মরু ঝড়ের কবলে পড়ার দুঃসহ আতঙ্ক।

সঙ্গী দুজনের ভয়ঙ্কর মৃত্যু এখনও ওর চোখে ভাসছে। গোসল করার সময় ওর মনে হয়েছিল, সে এতটাই অপবিত্র যে পৃথিবীর সব পানি ঢাললেও তার সে অপবিত্রতা আর পরিষ্কার করা যাবে না।

এমন অসামান্য রূপবতী তরুণী কোন সাধারণ ঘরের মেয়ে হতে পারে না, আহমদ কামাল ভাবলেন। এ ফিরিঙ্গী তরুণী এই দুর্গম অঞ্চলে কি করে এল এ ভাবনা তোলপাড় করছিল তার মনে। জিজ্ঞেস করায় যদিও ও বলেছে, ঝড়ের কবলে পড়ে কাফেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ও, কিন্তু সে কথা বিশ্বাস হয়নি কমাণ্ডারের। গত দু’দিনেও এ অঞ্চলে কোন কাফেলা দেখা যায়নি, গেলে টহল বাহিনীর নজরে তা অবশ্যই পড়ত।

আহমদ কামাল আবারও বললেন, ‘সত্যি করে বলো তো, তুমি, এখানে কি করে এলে?’

‘বলেছি তো, কাফেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে।’

‘যদি বলতে, তোমাকে অপহরণ করা হয়েছিল, ঝড় তোমাকে অপহরণকারীর কাছ থেকে বিছিন্ন করে দিয়েছে, তবুও বিশ্বাস করতাম। কিন্তু তুমি যা বলছে তা বিশ্বাস করা যায় না। এ স্রেফ মিথ্যা। আমার কাছে মিথ্যে বলার কোন দরকার ছিল না।’

কমাণ্ডারের সাথের সিপাইটা তাঁবুর পর্দা ঈষৎ ফাঁক করে একটা থলি এবং মশক দিয়ে বলল, ‘ঘোড়ার জিনের সাথে বাঁধা ছিল।’

থলিটা খুলতে গেলেন কমাণ্ডার মেয়েটা চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কমাণ্ডার তা লক্ষ্য করে তার হাতে থলিটা দিয়ে বললেন, ‘নিজেই খোল, খুলে দেখ সব ঠিক আছে কিনা।’

মেয়েটা যেন বোবা হয়ে গেছে। থলিটা শিশুর মত পিছনে সরিয়ে নিল।

‘বলতে পারি না তুমি চলে যাও।’ কমাণ্ডার বললেন, ‘তোমাকে আটকে রাখার অধিকারও আমার নেই। কিন্তু যে মেয়েটাকে বিজন মরুতে ঘোড়ার উপর অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে তাকে একা ছেড়ে দিতে পারি না। তোমার হেফাজত করা আমার মানবিক দায়িত্ব। বাড়ীর ঠিকানা বল, সেপাইদের দিয়ে পাঠিয়ে দেব। দেখে মনে হয় তুমি মিসরী নও, সুদানীও নও।’

মেয়েটার চোখ থেকে অশ্রু বেরিয়ে এল। পেছনের ভয়ঙ্কর আতঙ্কগুলো ওর স্নায়ু অবশ করে রেখেছে। ও থলি আহমদ কামালের দিকে ছুঁড়ে দিল। থলির মুখ খুললো কমাণ্ডার। কিছু খেজুর, মেয়েদের ব্যবহার্য সামান্য টুকিটাকি জিনিস এবং একটি পুটুলী পাওয়া গেল। পুটুলীর মধ্যে অনেকগুলো স্বর্ণ মুদ্রা। একটা স্বর্ণের চেইনের সাথে কাঠের তৈরী ক্রশ। কমাণ্ডার ওকে বললেন, ‘এখানে আমার প্রশ্নের জবাব নেই।’

‘এ স্বর্ণ মূদ্রাগুলো যদি তোমাকে দেই, আমাকে সাহায্য করবে?’

মেয়েটা প্রশ্ন করল।

‘কেমন সাহায্য?’

‘আমাকে ফিলিস্তিন পৌঁছে দাও। কিন্তু কোন প্রশ্ন করোনা।’

‘তোমাকে অবশ্যই ফিলিস্তিন পৌঁছে দেব তবে প্রশ্নও করব।’

‘আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করলে অন্য পুরষ্কার পাবে।’

‘কি পুরষ্কার?’

‘আমার ঘোড়াটা তোমায় দিয়ে দিব। তিন দিনের জন্য আমার দেহ হবে তোমার।’

আহমদ কামাল এর আগে এত স্বর্ণ একত্রে দেখেননি। দেখেননি এমন অনন্যা সুন্দরী যুবতী। স্বর্ণমূদ্রার দিকে তাকালেন তিনি। চোখ ঘুরিয়ে নিলেন যুবতীর দিকে। তার রেশম কোমল চুল সোনার তারের মত ঝলমল করছে। তাকালেন ওর মায়াবী চোখের দিকে। ও চোখের যাদু এক সম্রাটকে আরেক সম্রাটের শক্রত্বে পরিণত করার জন্য যথেষ্ট। আহমদ কামাল এক স্বাস্থ্যবান যুবক, সীমান্ত রক্ষীদের কমাণ্ডার। তাকে জিজ্ঞেস করার বা বাধা দেয়ার কেউ নেই।

তিনি স্বর্ণমূদ্রা এবং ক্রশ পুটুলীতে বাঁধলেন। থলিটা ফিরিয়ে দিলেন মেয়েটার হাতে।

‘বিনিময় কি খুব কম?’ মেয়েটার প্রশ্ন।

‘অনেক কম! ঈমানের মূল্য আল্লাহ ছাড়া আর কেউ দিতে পারে না।’

মেয়েটা কিছু বলতে চাইল, কমাণ্ডার তাকে সে সুযোগ না দিয়ে বললেন, ‘আমি আমার কর্তব্য এবং ঈমান বিক্রি করতে পারি না। আমি আছি বলেই সমগ্র মিসর নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারে। মাস তিনেক পূর্বে সুদানীরা কায়রো আক্রমণ করার চেষ্টা করেছিল, আমার ঈমান বিক্রয় করলে ওরা দখল করে নিত কায়রো। ওদের চাইতে তোমাকে বেশী ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে। তুমি তো কোন গোয়েন্দা নও?’

‘না, বরং বল ঝড় এক অত্যাচারীর কবল থেকে তোমায় রক্ষা করেছে।’

মেয়েটার অর্থহীন জবাব শুনে কমাণ্ডার বললেন, ‘তুমি কে, কোত্থেকে এসেছ আমার জানার প্রয়োজন নেই। কাল তোমাকে কায়রোয় আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে পাঠিয়ে দেব। এরপর কি হবে তা তোমার আর তাদের ব্যাপার।’

‘অনুমতি পেলে খানিকটা বিশ্রাম করব। কাল কায়রো পাঠানোর সময় তোমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারব।’

গতরাতে ঘুমুতে পারেনি রেশমা। দুঃস্বপ্নের মত ভয়ঙ্কর এক ভ্রমণে ক্লান্ত, শ্ৰান্ত। শোয়ার সাথে সাথেই ও ঘুমিয়ে পড়ল। কমাণ্ডার তাকিয়ে রইলেন ওর ঘুমন্ত চেহারার দিকে। মেয়েটা ঘুমের মধ্যে বিড় বিড় করছে। মাথা নাড়ছে এদিক ওদিক। দুঃস্বপ্ন দেখছে হয়ত। স্বপ্নের মধ্যেই ও কাঁদছে। কমাণ্ডার সঙ্গীদের বললেন, ‘মেয়েটাকে সন্দেহ হচ্ছে। ওকে কাল কায়রো পাঠিয়ে দেয়া হবে।’

সঙ্গীরা কমাণ্ডারকে জানত। যুবতীকে নিজের তাঁবুতে রেখেছেন বলে কেউ তাকে সন্দেহ করেনি। আহমদ কামাল মেয়েটার ঘোড়া দেখলেন। উন্নত জাতের। জিনের নীচে মিসরী ফৌজের চিহ্ন। মেয়েটা যে গোয়েন্দা এখন আর সন্দেহ নেই।

ঝড়ের কারণে মেয়েদের ধাওয়া করা থেকে কাফ্রিদের বিরত থাকতে হল। জীবন নিয়ে কোনমতে পৌঁছল দেবতার আশ্রমে। পুরোহিত বললেন, ‘মেয়েগুলো ঝড়ের কবলে পড়েছে। ওদের কেউ বেঁচে নেই। বলি দেয়ার সময়ও চলে গেছে। সুতরাং ওদের পিছু নেয়া বৃথা।’

বিপদে পড়ল রজব। বার বার কাফ্রিরা প্রশ্ন করছিল, ‘বল মেয়েরা কোথায়?’

সে শপথ করে বলতে লাগল, ‘আমি জানি না।’

কাফ্রিরা এতে সন্তুষ্ট নয়। নির্যাতন শুরু হল। তরবাবীর মাথা দিয়ে খোঁচা মেরে একই প্রশ্ন করতে লাগল ওরা। অত্যাচার চলল রজবের সঙ্গীদের উপরও। ওরা দেশ এবং জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার পরিণাম ভোগ করছিল। সারা রাত চলল এ নির্যাতন। ঝাঁঝরা হয়ে গেল তিনটা দেহ।