ফিলিস্তিনের মেয়ে
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কক্ষে পায়চারী করছেন সুলতান সালাহুদ্দীন আয়ুবী। একপাশে বসে আছেন বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ এবং আলী বিন সুফিয়ান।
আলীর দিকে তাকালেন সুলতান। বিষন্ন দৃষ্টি।
‘আলী!’ বেদনা ঝরে পড়ছে সুলতানের কণ্ঠ থেকে, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব, কিন্তু উচ্চাভিলাষী, ক্ষমতালিপ্সু আমীর ওমরা এবং নেতারা জাতিকে গোপনে বিক্রি করে দেয়ার যে চক্রান্ত করছে তা রোধ করা বড় কষ্টসাধ্য। তোমরা দেখেছ আমাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের কোন অভিযোগ নেই। গাদ্দারী করছে শুধু বড়লোকেরা। আমার সাথে ওদের ব্যক্তিগত শক্রতা নেই। শক্রতা ক্ষমতার জন্য, গদির জন্য লালায়িত ওরা
জুন-জুলাইতে সুদানী বিদ্রোহ দমন করার পর পরই সালাহুদ্দীন আয়ুবী খলিফাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন। এর আগেও সুদানী সেনা বিদ্রোহ দমন করেছেন, বিদ্রোহী নেতা অথবা সেনা কমাণ্ডারদেরকে শাস্তি দেননি। কুটনীতি এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন।
এবার তা করেননি, পদ এবং মর্যাদার তোয়াক্কা না করে অপরাধীকে কঠোর শাস্তি দিয়েছেন। অধিকাংশকে দিয়েছেন মৃত্যুদণ্ড। কাউকে কারাদণ্ড দিয়েছেন, কাউকে তাড়িয়ে দিয়েছেন দেশ থেকে।
‘দু’মাস ধরে দেশের উন্নয়ন এবং কল্যাণের দিকে নজর দিতে পারছি না’, সুলতান বললেন, ‘অপরাধীদের আনা হচ্ছে, আদালত বসিয়ে বিচার করছি, বিদ্রোহীদের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। দুর্ভাগ্য আমাদের, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অধিকাংশই মুসলমান।’
‘সম্মানিত আমীর’, মুখ খুললেন বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ, ‘মুসলমান এবং কাফের সমান অপরাধ করলে মুসলমানের শাস্তি বেশী হওয়া উচিৎ। তার কাছে এসেছে সত্য সুন্দর জ্যোতির্ময় দ্বীন। কাফেরের তো ধর্ম এবং বিবেকের দুয়ার রুদ্ধ। মুসলমানদের শাস্তি দিচ্ছেন বলে দুঃখ করবেন না। ওরা গাদ্দার, দেশদ্রোহী। ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য বেঈমানদের সাথে গাটছড়া বেঁধেছে।’
‘আমার দুঃখ অন্যখানে শাদ্দাদ। আমি শাসক হয়ে মিসরে আসিনি। সম্রাট হতে চাইলে মিসরের বর্তমান পরিস্থিতি তার জন্য উপযুক্ত। যে শুধু গদিকে ভালবাসে সে মিথ্যাবাদী এবং ষড়যন্ত্রকারীদের দলে টানে। চরিত্রহীন লোকেরা হয় তার বেশী আপন। গালভরা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ছাড়া ওরা জনগণকে কিছুই দিতে পারে না। তাদের অধীনস্থরা নিজেদেরকে রাজকুমার মনে করে।
আমার হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নাও, তবে কথা দিতে হবে আমার পথে কোন বাধা সৃষ্টি করবে না। যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি ঘর ছেড়েছি তা আমাকে পূর্ণ করতে দাও।
মিসর এবং সিরিয়ার সাথে ঐক্য সৃষ্টির জন্য নুরুদ্দীন জঙ্গী হাজার হাজার জীবন কোরবান করেছেন। আরব মুজাহিদদের খুনে রঙিন হয়েছে নীলের পানি। এই সাম্রাজ্যের সীমা আরও বিস্তৃত করতে হবে। সুদানকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে মিসরের সাথে। খ্রিষ্টানদের নিয়ে যেতে হবে মধ্য ইউরোপে। আমার রাজ্য বৃদ্ধির জন্য নয়, বরং খোদার হুকুম প্রতিষ্ঠার জন্য ঐ বিজয় প্রয়োজন। কিন্তু মিসর আমার জন্য চোরাবালিতে পরিণত হয়েছে। এমন একটা এলাকার কথা বল, যেখানে ষড়যন্ত্র, বিদ্রোহ আর গাদ্দার নেই।’
‘এসব ষড়যন্ত্রের পেছনে খ্রিষ্টানদের হাত রয়েছে।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান। ‘ভাবতেও অবাক লাগছে, নিজের যুবতী মেয়েদেরকে অশ্লীলতার ট্রেনিং দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে ওদের বিবেকে বাধছে না। তাদের মনভুলানো হাসি, চোখ ধাঁধাঁনো রূপ যৌবন, পটলচেরা কটাক্ষ, মধুভরা কণ্ঠের আকর্ষণ থেকে মুসলমানদের রক্ষা করা না গেলে জাতির পতন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। এ বড় কঠিন অস্ত্র।’
‘যতই ‘দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথায় কান দিও না’ বলে প্রবাদ আওড়াও বাস্তবে তা কোন কাজে আসে না। জিহ্বা যাদু জানে। ভাষার আঘাত তলোয়ারের চেয়েও তীব্র। ওরা তোমার দুর্বলতা বুঝে এমন ভাষা ব্যবহার করবে যা তোমার তরবারী কোষবদ্ধ করতে বাধ্য করবে। স্বেচ্ছায় তুমি দুশমনের পদতলে রেখে দেবে তোমার অস্ত্র।
আমাদের চাইতে খ্রিষ্টানদের দুটি হাতিয়ার বেশী আছে। একটি ভাষার যাদু, অন্যটি মানুষের পাশব শক্তি উস্কে দেয়ার ক্ষমতা। এ পাশবশক্তিকে উস্কে দেয়ার জন্য ওরা ব্যবহার করছে সুন্দরী তরুণীদের। মুসলমান আমীর ওমরা এবং শাসকদের হৃদয় থেকে ওরা মুছে দিচ্ছে ন্যায়-অন্যায়বোধ! শুধু শাসকদের মন থেকেই নয়, সম্মানিত আমীর এমনকি সাধারণ মানুষও এখন পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। অশ্লীলতার বান ডেকেছে আজ অভিজাত ও বিত্তশালী মুসলমানের ঘরে ঘরে, এটা খ্রিষ্টানদের বড় রকমের সাফল্য।’
‘আর এটিই হচ্ছে আমাদের জন্য সবচে’ বড় সমস্যা।’
‘আমি সমগ্র খ্রিষ্টান শক্তির মোকাবিলা করতে পারি, কিন্তু তাদের এ আঘাত সামাল দিতে পারছি না। ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি শিউরে উঠছি। এ অবস্থা চলতে থাকলে মুসলমান থাকবে শুধু নামে। খ্রিষ্টানদের মতই হবে ওদের সভ্যতা সংস্কৃতি। অশ্লীলতা এবং বেহায়াপনায় ওদেরকেও ছাড়িয়ে যাবে। তুমিই বলো, আমার স্বভাব ও আচরণ যদি একজন অমুসলমানের মতই হয় তবে আমাকে মুসলমান বলার স্বার্থকতা কি?’
মুসলমানের দুর্বলতা হচ্ছে ওরা আপন পর চিনে না। বন্ধু আর শক্রর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। সহজেই দুশমনের আকর্ষণীয় ফাঁদে আটকে যায় ওরা।’
‘খ্রিষ্টানদের দুর্বলতাও আমি বুঝি। মুসলমানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হলেও ওদের হৃদয় চূর্ণ বিচূর্ণ। ফ্রান্স এবং জার্মান একে অপরের শক্র। বৃটেন এবং ইটালী কেউ কাউকে পসন্দ করে না। মুসলমানরা খ্রিষ্টানদের শত্রু বলেই কেবল ওরা একত্রিত হয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ওদের মধ্যে রয়েছে বিভেদ, বিসম্বাদ।’
‘অথচ অর্থবিত্ত আর নারীর রূপ যৌবন দিয়ে মুসলমানদেরকে অন্ধ করে রেখেছে ওরা।’
‘মুসলিম বিশ্ব ঐক্যদ্ধ হলে অল্প ক’দিনের মধ্যেই ওরা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। ফাতেমী খেলাফত বাতিল করে আমি শক্রর সংখ্যাই বাড়িয়েছি। গদির জন্য ফাতেমীরা সুদানী এবং খ্রিষ্টানদের সাথে ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে।’
‘ওদের একজন কবিকে তো কাল মৃত্যুদণ্ড দিলেন।’ আলী বললেন।
‘এতে আমারও দুঃখ হচ্ছে। আম্মারাতুল ইয়ামানীর কবিতা আমার হৃদয়েও দাগ কেটেছিল। কিন্তু তার শব্দ এবং ছন্দ অগ্নিশিখার মত ইসলামের আচ্ছাদন জ্বালানোর চেষ্টা করছিল।’
আম্মারাতুল ইয়ামানী ছিল একজন নামকরা কবি। তখনকার সময় মানুষ কবিকে পীরের মত সম্মান ও মান্য করত। তার কাব্যের ছন্দ এবং শব্দ সৈন্যদের মাঝে সৃষ্টি করত নতুন আবেগ। কবি সমাজে তার এ জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগানো শুরু করল। একদিকে সে মানুষকে যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করত, অন্যদিকে মানুষের মনে ফাতেমী খেলাফতের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করত।
ধীরে ধীরে তার কবিতার বিষয় হয়ে উঠল সুলতান সালাহুদ্দীন আয়ুবীর বিরোধিতা। ফাতেমীরা নিয়মিত অর্থ যোগান দিত তাকে। তার শেষ কবিতা ছিল:
‘ফাতেমী খেলাফতকে ভালবাসার অপবাদ দিচ্ছ আমায়।
আমাকে তোমরা অভিশাপ দাও। অথচ
আমার কাছে তোমরাই অভিশপ্ত।
অশ্রু ঝরাও ফাতেমীদের মহলের প্রাচীরে, দেয়ালের গায়।
মহলে এখনও যারা আছে তাদের বল,
তোমাদের জন্য যে ক্ষত হয়েছে আমার হৃদয়ে
তা মুছবে না কখনও, না কখনওই মুছবে না।
দুর্ভাগ্য ফাতেমীদের
তাদের এ দুর্ভাগ্যের কারণ যে মানুষটি
সে সালাহুদ্দীনকে আজও কোন দুর্ভাগ্য স্পর্শ করল না।’
একদিন অকস্মাৎ তার বাড়ীতে তল্লাশী নেয়া হল। দেখা গেল, শুধু ফাতেমীরাই নয়, মুসলমানদের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য তাকে নিয়মিত অর্থ যোগান দিচ্ছে খ্রিষ্টানরাও। সালাহুদ্দীনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করার জন্য ওরা তাকে নিয়োগ করেছিল। গাদ্দারীর অভিযোগে তাকে দেয়া হল মৃত্যুদণ্ড।
‘যে জাতির কবিরা দুশমনের কাছে বিবেক বিকিয়ে দেয়, সে জাতির ভাগ্যে অপমান এবং লাঞ্ছনা ছাড়া আর কি থাকতে পারে?’ বললেন সুলতান।
প্রহরী ভেতরে এসে বলল, ‘পদচ্যুত খলিফার দূত এসেছে।’
সালাহুদ্দীনের কপাল কুঞ্চিত হল। বললেন, ‘খেলাফতের গদি ছাড়া এ বুড়ো আমার কাছে আর কি চাইতে পারে? দূতকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।’
দূত ভেতরে এসে সালাম দিয়ে বলল, ‘খলিফার সালাম গ্রহণ করুন।’
‘সে খলিফা নয়।’ সালাহুদ্দীন আয়ুবী বললেন, ‘দু’মাস আগেই সে পদচ্যুত হয়েছে। আল আযেদ এখন গৃহবন্দী।’
‘ক্ষমা চাইছি মাননীয় সুলতান। পুরনো অভ্যাস, মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। আল আযেদ আপনাকে সালাম দিয়ে বলেছেন, তিনি ভীষণ অসুস্থ। বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না। আপনার সাথে দেখা করার ইচ্ছে। সম্মানিত আমীর, একটু কষ্ট স্বীকার করলে তিনি কৃতজ্ঞ থাকবেন।’
সালাহুদ্দীন আয়ুবী নিজের উরু চাপড়ে বললেন, ‘সে আমায় ডাকছে কারণ, সে এখনও নিজকে খলিফা মনে করে।’
‘তা নয় মহামান্য সুলতান! তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। প্রাসাদের ডাক্তার সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি হার্টের রোগী। একটু রাগ হলেই রোগ বেড়ে যায়। এখন তো বিছানা থেকেই উঠতে পারেন না। দূত একটু থেমে সংকোচ জড়ানো কণ্ঠে বলল, আপনাকে একা যেতে বলেছেন। গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় কথা আছে। অন্য কারও সামনে তা বলা যাবে না।’
‘তাঁকে সালাম দিয়ে বলো সালাহুদ্দীন গোপন কথা সবই জানেন। এখন তিনি যেন খোদার সাথেই গোপন কথা বলেন। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন।’
নিরাশ হয়ে ফিরে গেল দূত।
সালাহুদ্দীন আয়ুবী বললেন, ‘সে আমায় একা যেতে বলেছে। এতে কোন ষড়যন্ত্র নেই তো?’
‘আমার মনে হয় প্রাসাদে ডেকে নিয়ে সে আপনাকে শেষ করে দিতে চাইছে।’
প্রহরীকে ডাকলেন সালাহুদ্দীন। বললেন, ‘ডাক্তারকে সালাম দাও।’
ডাক্তার এলে সুলতান বললেন, ‘আল আযেদের কাছে যাও। আমি জানি সে অনেকদিন থেকেই অসুস্থ। হয়ত তার পারিবারিক ডাক্তার নিরাশ হয়ে গেছে, তুমি গিয়ে তার চিকিৎসা কর। অবস্থা মারাত্মক হলে আমাকে খবর দিও।’
সাবেক খলিফা আল আযেদ তার প্রাসাদে গৃহবন্দী। তার প্রাসাদ ছিল পৃথিবীর স্বর্গ। হারেমের শোভা বৃদ্ধি করেছিল দেশ-বিদেশের রূপসী যুবতীরা। তন্বী তরুণী দাসী বাঁদীর সংখ্যা ছিল অগণিত। হাজার হাজার দেহরক্ষী সবসময় প্রস্তুত থাকত। সেনা অফিসাররা দাঁড়িয়ে থাকত নির্দেশ পালনের জন্য।
সুলতান সালাহুদ্দীনের নতুন বিপ্লব মহলের চেহারা বদলে দিল। খলিফার ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হলেও তার ভোগবিলাস সামগ্রীতে হাত দেয়া হয়নি, কিছু সৈন্য রয়েছে, যাদের কাজ এখন পাহারার সাথে সাথে ষড়যন্ত্রের এ কেন্দ্রের প্রতি গভীরভাবে নজর রাখা।
গৃহবন্দী আল আযেদ একে তো বৃদ্ধ তার ওপর হার্টের রোগী। গদি হারানোর দুশ্চিন্তা, বয়সের ভার আর অতিরিক্ত মদপান ও ভোগবিলাস তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিল।
ক’দিনেই চেহারা হয়েছে মরার মত। দু’জন আধ-বয়েসী মহিলা এবং একজন চাকর ছাড়া তার কক্ষে কেউ নেই। বৃদ্ধ চোখ খুলে ওদের দেখে আবার বন্ধ করে নিতেন চোখ।
একটু আগে ডাক্তার তাকে ওষুধ খাইয়েছেন। হারেমের দু’জন যুবতী ভেতরে ঢুকল। একজন তার হাত নিজের হাতে নিয়ে শরীরের অবস্থা জানতে চাইল। অন্যজন দু’হাতে তার মুখমণ্ডল ধরে সুস্থ হওয়ার জন্য দোয়া করল। এরপর পরস্পর চোখের দিকে তাকিয়ে একজন বলল, ‘বিশ্রাম করুন। এখন আপনার বিশ্রাম নষ্ট করা ঠিক হবে না। আমরা পাশের কামরায় আছি, প্রয়োজন হলে ডাকবেন।’ দু’জনই কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।
আল আযেদ দীর্ঘশ্বাস টেনে পাশের মহিলাকে বললেন, ‘এরা আমার সেবা করতে আসেনি। দেখতে এসেছে আমি কখন মরব। আমার সম্পদের সাথেই ওদের সম্পর্ক। ওরা শকুন, ওরা শুধু আমার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। ওদের লোলুপ দৃষ্টি আমার সম্পদের দিকে। তোমরা তিনজন ছাড়া আমার সমব্যর্থী আর কেউ নেই। না, কেউ নেই, কেউ নেই। যারা ফাতেমী খেলাফতের নামে শ্লোগান তুলত তারা এখন কোথায়?’
বুকে হাত চেপে পাশ ফিরলেন বৃদ্ধ। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।
দূত কক্ষে প্রবেশ করে বলল, ‘গভর্ণর আসবেন না। তিনি আসতে অস্বীকার করেছেন।’
‘হায় হতভাগ্য সালাহুদ্দীন। আল আযেদের কণ্ঠে বিষণ্ণতা, আমার মৃত্যুর পূর্বে একবার তো আসতে পারত।’
তাঁর বুকের ব্যথা বেড়ে গেল। থেমে থেমে ক্ষীণ কণ্ঠে তিনি বলতে লাগলেন, ‘আমি ডাকলে দাসীবাঁদীরাই এখন আসে না, মিসরের গভর্ণর আসবে কেন? এ সবই আমার পাপের শাস্তি। আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ এখন পর্যন্ত আসেনি, ওরা আসবে জানাযায়, প্রাসাদের যা পাবে নিয়ে যাবে।’
কিছুক্ষণ ব্যথায় কাৎরালেন তিনি। দু’জন সেবিকা আতঙ্ক নিয়ে তার কথা শুনতে লাগল। সান্ত্বনা দেয়ার কোন ভাষা এল না ওদের মুখে। ওরা সে খোদার অভিশাপকে ভয় পাচ্ছিল, যিনি আমীরকে ফকীর আর সম্রাটকে ভিক্ষুকে পরিণত করেন।
ঘরের ভিতর কারো ছায়া পড়ল। চকিতে দরজার দিকে তাকাল ওরা। দেখল শুভ্রকেশধারী এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন দরজায়।
ধীরে ধীরে তিনি এগিয়ে এলেন আল আযেদের কাছে। নাড়িতে হাত রেখে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম, আমি গভর্ণরের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। আপনার চিকিৎসার জন্য তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন।’
‘আমাকে দেখে যাওয়ার সৌজন্যবোধটুকুও গভর্ণর হারিয়ে ফেলেছেন? আমি ডাকলাম, তারপরও এল না!’
‘কি জানি, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। তিনি আমাকে ডেকে আপনার চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। আপনার স্বাস্থ্য নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন, তা না হলে আমায় পাঠাতেন না।’
আল আযেদ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ডাক্তার তাকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘আপনি এখন কথা বলবেন না, তাহলে আপনার রোগ বেড়ে যেতে পারে।’
‘আমার চিকিৎিসা হয়ে গেছে, যা বলছি মন দিয়ে শোন। এর প্রতিটি শব্দ সালাহুদ্দীনকে পৌঁছে দেবে। নাড়ি থেকে হাত সরাও। তোমাদের পৃথিবীর চিকিৎসা এবং ওষুধ থেকে আমি এখন অনেক দূরে। সালাহুদ্দীনকে বলো, আমি তার শক্র নই। দুশমনের চালে আটকে গিয়েছিলাম। আমার অথবা সালাহুদ্দীনের দূর্ভাগ্য, এমন সময় অপরাধ স্বীকার করছি যখন আমি মাত্র কয়েক মুহুর্তের অতিথি।
সালাহুদ্দীনকে বলো, আমার হৃদয়ে সবসময়ই তার জন্য স্নেহ ছিল। তার জন্য ভালবাসা বুকে নিয়েই আমি পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছি। টাকা পয়সা এবং গদির লোভ আমার সব ভালবাসা কেড়ে নিয়েছিল। লোভ এবং মোহ আমার হৃদয়কে এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যা আমাকে ইসলাম থেকেও দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। এ ছিল আমার মস্তবড় ভুল। আজ আমার নেশা ছুটে গেছে।
আমার পায়ের কাছে বসে যারা কথা বলত, তারা এখন আমাকে চেনে না। যেসব দাসীবাঁদী আমার চোখের ইশারায় নাচত, তারা আমার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। উলঙ্গ নৃত্য করেছে যেসব মেয়েরা ওরাও আমাকে ঘৃণার চোখে দেখছে।
মানুষ আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে এবং আল্লাহর কাছেই মানুষকে আবার ফিরে যেতে হবে। সেখানে কারও পাপের বোঝা কেউ বহন করবে না। মানুষের কথায়, চাটুকারদের চাটুকারিতায় এ সত্যকে ভুলে যাওয়া ছিল আমার জীবনের সবচে’ বড় বোকামী। এ ভুল আমি করেছি।
ওসব কমবখতের দল আমাকে খোদার আসনে বসিয়েছিল। যখন আসল খোদার ডাক এসেছে, চোখ খুলে গেছে আমার। আমি বুঝতে পারছি, অপরাধ স্বীকার করার মধ্যেই আমার মুক্তি। সালাহুদ্দীনকে এমন সব তথ্য দেব যা সে জানে না। তাকে বলো, আমার গার্ড বাহিনীর কমাণ্ডার রজব মরেনি। সুদানের কোথাও না কোথাও সে আত্মগোপন করে আছে। সে আমাকে বলে গেছে, ফাতেমী খেলাফত পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য সে সুদানী এবং সালাহুদ্দীন বিরোধী মিসরীদের নিয়ে সেনাবাহিনী গড়ে তুলবে। সামরিক সাহায্য নেবে খ্রিষ্টানদের কাছ থেকে।
সালাহুদ্দীনকে বলো, তার দেহরক্ষীদের দিকে কড়া দৃষ্টি রাখতে। রাতে যেন একা বের না হয়। রজব তাকে হত্যা করার জন্য ঘাতকবাহিনীর সাথে চুক্তি করেছে। মিসর তার জন্য এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি।
তাকে বলো তুমি যাদের বন্ধু মনে কর তাদের সবাই তোমার বন্ধু নয়, এদের মাঝে অনেক শক্রও আছে। ইসলামী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য যারা তোমার কণ্ঠে কণ্ঠ মেলায় তাদের মধ্যেও রয়েছে খ্রিষ্টানদের পালিত বিষাক্ত সাপ। এমন অনেক আলেম পাবে ক্ষমতার লোভেই যারা ইসলামের পক্ষে কথা বলে।’
তিনি কয়েকজনের নাম বললেন, ‘এদের তোমরা মনে কর মস্ত বড় মুজাহিদ। অসংখ্য নিবেদিতপ্রাণ মুজাহিদ তাদের পিছনে জীবন বিলিয়ে দেয়ার জন্য কাতার বন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তারা জানে না এরা কখনও চরম সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। ওরা মুখে বলে পরকালের কথা, কিন্তু বাস্তবে পুঞ্জীভুত সম্পদ ও ক্ষমতা হারাবার ভয়ে সব সময় অস্থির থাকে। একদিন হয়ত তারাও নিবেদিতপ্রাণ ছিল, কিন্তু যতই ঐশ্বর্য ও ক্ষমতা বাড়ছে ততই তা হারাবার ভয়ও বাড়ছে, আর এ ভয় তাদেরকে ইসলাম থেকে ঠেলে দিচ্ছে দূরে। কেউ কেউ এগিয়ে গেছে আরও এক ধাপ। দুনিয়ার মোহে ওপরে দ্বীনের শ্লোগান দিচ্ছে আর গোপনে শক্রর সাথে হাত মিলাচ্ছে।
এদেরই একজন ফয়জুল ফাতেমী, সেনা সদর দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছে সে। বন্ধু ভেবে তাকে অনেক বড় পদ দিয়ে রেখেছে সালাহুদ্দীন। সে তোমাদের বন্ধুবেশী দুশমন। তোমরা জান না, কিন্তু আমি জানি সে রজবেরই সঙ্গী।
সেনাবাহিনীর মধ্যে তুর্কী, সিরীয় এবং অন্যান্য আরব বংশোদ্ভূত সদস্যদের ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করো না। এরাই তোমার অনুগত এবং ইসলামের সৈনিক।
মিসরী সৈন্যদের মধ্যে বিশ্বস্ত অবিশ্বস্ত দু’দলই আছে। তুমি যখন সুদানীদের আক্রমণ করেছিলে দুটো প্লাটুনের কমাণ্ডার সৈন্যদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলে। আরব সৈন্যরা কমাণ্ডারের নির্দেশ উপেক্ষা করেই আক্রমণ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল, তা না হলে যুদ্ধের ফল হত উল্টো।’
আল আযেদ ক্ষীণকণ্ঠে থেমে থেমে বলে যাচ্ছেন। ডাক্তার বাধা দিয়েছেন কয়েকবার, তিনি হাতের ইশারায় তাকে চুপ করিয়ে দিয়েছেন। ঘামে ভিজে যাচ্ছে তার শরীর। যেন কেউ পানি ছিটিয়ে দিয়েছে সারা শরীরে।
ঘাম মুচছে দু’জন সেবিকা। মনে হয় ঝর্ণা বইছে শরীর থেকে। তিনি সামরিক বেসামরিক কয়েকজন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে খ্রিষ্টানদের ষড়যন্ত্রের বর্ণনা দিলেন। বললেন, ‘এসব কর্মকর্তাদের মুসলমান মনে করো না। ওরা নিজেদের ঈমান বিক্রি করে দিয়েছে।
সালাহুদ্দীনকে বলো, আল্লাহ তোমায় সফল করবেন। মনে রেখো, একদল রয়েছে ধোকাবাজ, অন্যদল চাটুকার। চাটুকাররা খোদার আসনে বসিয়ে তোমাকে নিঃশেষ করে দেবে। এরা মোনাফেকদের চেয়েও বেশী ক্ষতিকর। দুশমনকে পদানত করে তুমি যখন নিশ্চিন্তে মসনদে বসবে, তখন আমার মত দুই জাহানের সম্রাট হয়ে যেও না। রাজত্ব আল্লাহর। এ পরিণতি থেকে রক্ষা করে চলো।’
জড়িয়ে এল আল আযেদের কণ্ঠ। চোহারার বিষণ্ণতা কেটে গিয়ে ফুটে উঠল প্রশান্তি। আবারও কিছু বলতে চেষ্টা করলেন তিনি, কিন্তু নিস্তব্ধ হয়ে গেল কণ্ঠ। মাথা কাত হয়ে গেল একদিকে আল আযেদ চিরদিনের জন্য নীরব হয়ে গেলেন।
এ ঘটনা ঘটেছিল ১১৭১ সনে।
ডাক্তার সুলতানের কাছে খবর পাঠালেন। প্রাসাদেও এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল। কান্না দূরে থাক, সামান্য আফসোসও কেউ করল না। শুধু সেবিকা দুজনার চোখ ছিল অশ্রুভেজা।
সংবাদ পেয়েই সুলতান কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তাকে নিয়ে প্রাসাদে পৌঁছলেন। চাকর-বাকরদের তৎপরতায় তার মনে সন্দেহ জাগল। তিনি পাহারাদার কমাণ্ডারকে ডেকে বললেন, ‘প্রাসাদের প্রতিটি কক্ষে ঢুকে নারী পুরুষ এবং হারেমের যুবতীদেরকে বাইরের বারান্দায় বসিয়ে রাখ। যতবড় প্রয়োজনই হোক কাউকে বাইরে যেতে দেবে না। আস্তাবলেও কাউকে যেতে দেবে না। গোটা প্রাসাদ নিজের কজায় রেখো।’
কি আশ্চর্য! সুলতান লক্ষ্য করলেন, যেই আল আযেদ ছিলেন এক সম্রাট, নারী আর মদ ছিল যার জীবন, যার হারেমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছিল রূপসী তরুণীরা, চাকর-বাকর দাস-দাসীতে গমগম করেছে যার মহল, তার জন্য এক ফোটা চোখের পানি ফেলার মত কোন লোক নেই।
ডাক্তার সুলতানকে নিভৃতে ডেকে আল যায়েদের শেষ কথাগুলো শুনিয়ে বললেন, ‘আপনার আসা উচিৎ ছিল।’
সালাহুদ্দীন আয়ুবী তাকে বললেন, ‘আল আযেদকে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি, আর যে ঈমান বিক্রি করে দেয় তাকে আমি ঘৃণা করি বলেই তখন আসিনি।’
ডাক্তারের কাছ থেকে আল আযেদের শেষ কথাগুলো শুনে সুলতান দুঃখ করলেন। বললেন, ‘আমি এলে আরও কিছু তথ্য বের করতে পারতাম।’
আল আযেদ যদিও বিলাসপ্রিয় ছিলেন এবং সালাহুদ্দীন আয়ুবী বিরোধী ষড়যন্ত্রে তিনি সহযোগিতাও করেছেন তবুও সালাহুদ্দীনের জন্য তার ভালবাসা ছিল। সুলতান বুঝতে পারছিলেন, আল আযেদের এ আহ্বানে কোন ষড়যন্ত্র ছিল না। তার অন্তিম কথাগুলো শুনতে পারেননি বলে সুলতান দীর্ঘদিন অনুতাপ করেছিলেন।
আলীকে ডাকলেন সুলতান। আল আযেদের দেয়া নামগুলো দিয়ে বললেন, ‘এদের পেছনে গোয়েন্দা লাগাও। প্রমাণ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। কারও প্রতি যেন ন্যূনতম জুলুমও না হয়। পরে প্রমাণিত হল প্রতিটি লোকই ষড়যন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত।
সুলতান আল আযেদের দাফনের ব্যবস্থা করলেন, দাফন করা হল সাধারণ কবরস্থানে। কালের প্রবাহে সে কবরের চিহ্ন মুছে গেছে।
মহলে তল্লাশী নেয়া হল। সোনা রূপা এবং সম্পদের স্তূপ দেখে হতবাক হয়ে গেলেন সালাহুদ্দীন আয়ুবী।
হারেমের রূপসী এবং অন্যান্য যুবতীদেরকে আলীর হাতে দিয়ে বলা হল, ‘খোঁজ খবর নিয়ে যার যার বাড়ীতে পৌঁছে দাও। ফিরিঙ্গী এবং অমুসলিম মেয়েদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নাও। সন্দেহ হলে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা কর।’
প্রাসাদের সমস্ত ধন সম্পদ সুলতান সালাহুদ্দীন আয়ুবী দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালে বণ্টন করে দিলেন।
মৃত্যুর পূর্বে আল আযেদ বলেছিলেন, রজব বেঁচে আছে। ফৌজ তৈরী করছে সালাহুদ্দীনের সাথে যুদ্ধ করার জন্য। দু’জন দুঃসাহসী গুপ্তচর বাছাই করলেন আলী বিন সুফিয়ান। দু’জনই রজবের পূর্ব পরিচিত। ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে ওদেরকে সুদান পাঠিয়ে দেয়া হল। নির্দেশ দেয়া হল রজরকে জীবিত ধরে আনতে। সম্ভব না হলে হত্যা করতে।
গুপ্তচর দু’জন সুদানের পথ ধরল। রজব তখন সুবাক কেল্লায়। সুবাক ফিলিস্তিনের খ্রিষ্টানদের হেড কোয়ার্টার। এখান থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করে ওরা।
ওদের অত্যাচারে মুসলিম পরিবারগুলো দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। কারও ইজ্জত নিরাপদ নয়। ফিলিস্তিনের খ্রিষ্টানরা ডাকাতের ভূমিকায় লুণ্ঠন করছে মুসলমানদের কাফেলা। মেয়েদের অপহরণ করছে। এ কারণেই সুলতান সালাহুদ্দীন ফিলিস্তিন অধিকার করতে চাচ্ছিলেন।
মুসলমানদের প্রথম কিবলা ওরা দখল করে রেখেছে। আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আছে নির্যাতিত মানুষের বুক ফাটা কান্নায়। ইজ্জত আব্রু লুণ্ঠিত নারীর অশ্রু শুষে নিচ্ছে মরুর বালুকারাশি। কিন্তু মুসলমান আমীর ওমরাদের সম্পর্ক সাধারণ মুসলমানদের চেয়ে অভিজাত খ্রিষ্টানদের সাথেই বেশী।
রজব সালাহুদ্দীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, সামরিক সাহায্যের জন্য এসেছে সুবাক ঘাঁটিতে। তার সম্মানে নৃত্যগীতের আসর জমানো হল। নাচনেওয়ালী যুবতীদের অধিকাংশই মুসলমান। অল্প বয়সে অপহরণ করে ওদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে পুরুষ ঘায়েলের জন্য। রজব একবারও তা ভাবল না, স্বজাতির মেয়েরা অমুসলিমের আসরে উলঙ্গ নাচছে। সে উপভোগ করছে আর মদপান করছে। সাথে দু’জন মুসলমান কমাণ্ডার। রাত ভর আসরে মত্ত হয়ে রইল ওরা।
কথা শুরু হল সকালে, বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পুইলজিনান এবং কোনার্ড। এ ছাড়াও ছিলেন ক’জন পদস্থ সামরিক অফিসার।
রাতে রজব ওদের বলেছিল, ‘সালাহুদ্দীন সুদানে এক কাফ্রি গোত্রের মন্দির ভেঙে দিয়েছে। হত্যা করেছে পুরোহিতকে। সুদানীরা আক্রমণ করেছিল, সফল হয়নি। সে খলিফা আল আযেদকে সরিয়ে মিসরকে আব্বাসী খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছে। এতে মনে হয় সালাহুদ্দীন মিসরের একচ্ছত্র সম্রাট হতে চাইছে।’
রজব মিটিংয়ে আরও বলল, ‘আমি সামরিক সাহায্যের জন্য এসেছি। সুদান ফিরে ফৌজ তৈরী করবো। মিসরের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার জন্যও আমি আপনাদের সহযোগিতা কামনা করি।’
‘এ মুহুর্তে দুটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেয়া উচিৎ।’ বললেন কোনার্ড, ‘যে গোত্রের মন্দির ভাঙা হয়েছে তাদেরকে প্রতিশোধের জন্য উত্তেজিত করা। অন্যদিকে সুদানের সব ধর্মের লোকদের বলা যে, সুলতান সালাহুদ্দীন অন্য ধর্মের ইবাদতখানা, দেবতা এবং মূর্তি ভেঙে ফেলে। আঘাত হানে অন্য ধর্মের ওপর। সে যতদিন বেঁচে থাকবে কোন ধর্মই নিরাপদ নয়। ধর্মীয় আবেগ ব্যবহার করে সুদানীদের আয়ুবীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়।’
‘মিসরের মুসলমানদেরকেও আমরা সালাহুদ্দীনের বিরুদ্ধে দাড় করাতে পারব।’
এক খ্রিষ্টান কমাণ্ডার বলল, ‘মি. রজব, মনে কিছু না করলে বলব, মুসলমানদের ভেতর ধর্মীয় আবেগ সৃষ্টি করে একজনকে দিয়ে অন্যজনকে হত্যা করানো কঠিন নয়। আমাদের ধর্মে বান্দা এবং খোদার মাঝে এসে দাঁড়িয়েছেন কোন কোন পাদ্রী। ইসলামেও কোন কোন ইমাম মসজিদ দখল করে খোদার এজেন্সি নিয়ে বসে আছে।
আমাদের সম্পদ আছে। টাকা দিয়ে মৌলভী তৈরী করে আমরাও মিসরের মসজিদে বসিয়ে দিতে পারি। খ্রিষ্টানদের মধ্যে অনেকে কোরান এবং ইসলামের জ্ঞানে পারদর্শী। ওদেরকেও মুসলমানদের ইমাম হিসেবে নিয়োগ করা যায়। সালাহুদ্দীনের বিরুদ্ধে মসজিদে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। মৌলবীরা ওয়াজের মাধ্যমে মানুষকে কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ করবে। তখন স্বাভাবিক ভাবেই সালাহুদ্দীনের সম্মান কমে যাবে।’
‘এ কাজ এখনি শুরু করা উচিৎ।’ বলল রজব, ‘সালাহুদ্দীন মিসরে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছে। শিশু, কিশোর, যুবক সবাই ওখানে ধর্মের সঠিক শিক্ষা পাচ্ছে। সে আসার পূর্বে মিসরে এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। লোকজন মসজিদের খোৎবা শুনত, যেখানে বেশীরভাগ থাকত খলিফার প্রশংসা।
মানুষের জ্ঞানের চোখ খুলে গেলে আমাদের কাজ করতে কষ্ট হবে। দেশ শাসন করতে হলে মানুষকে দৈহিক এবং মানসিকভাবে পরিনির্ভরশীল রাখতে হয়।’
‘মি. রজব!’ এক কমাণ্ডার মৃদু হেসে বলল, ‘আপনার দেশে গোপনে কি হচ্ছে তাই জানেন না আপনি। সালাহুদ্দীন যেদিন আমাদের রোম উপসাগরের পাড়ে পরাজিত করেছিল, সেদিন থেকেই এ কাজ শুরু হয়েছে। আমরা সরাসরি কিছু করার পক্ষে নই,তবে মানসিকভাবে গোঁড়া মুসলমানদের বিকলাঙ্গ করার জন্য সবকিছুই করা হচ্ছে।
ভেবে দেখুন, দু’বছর আগে কায়রো শহরে কয়টা পতিতালয় ছিল, আর এখন ক’টা? বিত্তশালী পরিবারের তরুণ তরুণীরা অশ্লীলতা এবং বেহায়াপনায় ডুবে যায়নি?
আমাদের পাঠানো খ্রিষ্টান মেয়েরা মুসলমানের ছদ্মবেশ নিয়েছে। হত্যা করাচ্ছে। কায়রোর স্থানে স্থানে এখন আকর্ষণীয় জুয়ার আখড়া। দুটো মসজিদে রয়েছে আমাদের পাঠানো ইমাম। ওরা ইসলামের রূপ পাল্টে দিচ্ছে। জেহাদের তাৎপর্য ব্যখ্যা করছে ভিন্ন ভাবে।
ওখানে আলেমের ছদ্মবেশ নিয়ে আছে আমাদের বেশ কিছু লোক। ওরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বুঝাচ্ছে। বন্ধু এবং শক্রর ধারণা পাল্টে দিচ্ছে। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, ক’বছর পর ওরা নিজেরা মুসলমান বলে গর্ব করলেও ওদের মনমানসিকতায় থাকবে খ্রিষ্টানদের সভ্যতা সংস্কৃতি, কথা বলবে আমাদেরই ভাষায়, চিন্তা করবে আমাদের মস্তিষ্ক দিয়ে।’
‘সালাহুদ্দীনের গোয়েন্দারা অত্যন্ত সতর্ক,’ রজব বলল, ‘গোয়েন্দা প্রধান আলীকে শেষ করতে পারলে সালাহুদ্দীন অন্ধ এবং বধির হয়ে যাবে।’
‘এর অর্থ আপনি নিজে কিছুই করতে পারছেন না!’ কোনার্ড বলল, ‘একজন সরকারী কর্মচারীকেও আপনি হত্যা করতে পারছেন না। এতটা বুদ্ধিহীন হলে আমাদের লোকদেরকেও ধরিয়ে দেবেন। ওরাও মারা পড়বে, অহেতুক নষ্ট হবে আমাদের সম্পদ।’
‘ঠিক আছে, এ কাজ আমি নিজেই করব। ঘাতকদলের সাথে কথা বলেছি, ওরা সালাহুদ্দীনকে হত্যা করতে প্রস্তুত।’
‘আপনি সুদানের দিক থেকে মিসর সীমান্তে অশান্তি সৃষ্টি করবেন।’ কোনার্ড বললেন, ‘দেশের ভেতরে আমরা ওদের সভ্যতা সংস্কৃতি ধ্বংস করার তৎপরতা চালাব। আরবের কয়েকজন আমীর ওমরাকে আমরা হাত করে নিয়েছি। মুসলমানদের মধ্যে এখন দু’টো লোকই বেঁচে আছে, নুরুদ্দীন জঙ্গী এবং সালাহুদ্দীন। ওদের শেষ করতে পারলে পৃথিবী থেকে ইসলামের সূর্য ডুবে যাবে। তবে আপনাদেরকে অটল থাকতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এরপর মিসর হবে আপনাদের।’
এভাবে আলাপ চলল দীর্ঘক্ষণ। সালাহুদ্দীনকে প্রতিহত করার বিভিন্ন পরিকল্পনা নেয়া হল। বিদায়ের সময় রজবের হাতে তুলে দেয়া হল তিনটে অনিন্দ্যসুন্দরী যুবতী। দেয়া হল প্রচুর স্বর্ণমূদ্রা। কায়রোর দু’জন সম্মানিত ব্যক্তির ঠিকানা দিয়ে বলা হল, ‘মেয়ে তিনটিকে গোপনে তাদের কাছে পৌঁছে দেবেন।’
দু’জনের একজন ফয়জুল ফাতেমী।
‘মেয়েদের কিভাবে ব্যবহার করতে হবে তিনি জানেন। মেয়েরাও জানে কি করতে হবে ওদের। ওরা কয়েকটা ভাষায় পারদর্শী।’
বিদায় নিল রজব। সাথে তিনটে মেয়ে এবং দশজন সৈনিক।
আঙ্গুক গোত্রের কাছে যাচ্ছে সে। ওদের দেবতা এবং মন্দির ভেঙেছেন সালাহুদ্দীন। মিসর থেকে পালিয়ে এখানেই আশ্রয় নিয়েছিল রজব। জঙ্গী কাফ্রিদের নিয়ে মিসর আক্রমণ করেছিল, সফল হয়নি। গোত্রের বেশীর ভাগই মারা গেছে।
এখনও পাহাড় ঘেরা স্থানকে ওরা দেবতার আশ্রম মনে করে। ভয়ে কেউ ভেতরে ঢোকে না। গোত্রের ধর্মীয় গুরু আরও তিনজনকে নিয়ে দেবতার আবাসে গেলেন। নিজকে নিজে পুরোহিতের স্থলাভিষিক্ত করলেন। এ তিনজন তার দেহরক্ষী। দেবতার আশ্রমে কেবল এ চারজনই আসা যাওয়া করত।
পাহাড়ের এক নিভৃত স্থানে আস্তানা গাড়ল রজব। ওখান থেকেই একদিন ফিলিস্তিন অভিমুখে ছুটল।