» » সালাহুদ্দীন আয়ুবীর কমান্ডো অভিযান

বর্ণাকার

খলিফার রাতের মাহফিল জমজমাট। রজব নেই, সে চলে গেছে গুপ্তঘাতকদলের কাছে। যতশীঘ্র সম্ভব সালাহুদ্দীন আয়ুবীকে হত্যার ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত সে।

খলিফা বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে বেখবর, উম্মে আমারার মাদকতাময় রূপের সাগরে ডুবে আছেন তিনি।

খোৎবা থেকে তার নাম তুলে দেয়া হয়েছে একথা কেউ তাকে বলেনি। সালাহুদ্দীনকে হত্যার ব্যবস্থা হচ্ছে এজন্য তিনি ভীষণ খুশী।

বুড়োর হাত থেকে তাড়াতাড়ি নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য মেয়েটা তাকে মদের সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিল। ঘুমিয়ে পড়লেন খলিফা।

আলো নিভিয়ে ও কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল। এগিয়ে গেল নিজের বিশ্রামের জন্য আলাদা করে রাখা এক বিশেষ কক্ষের দিকে, যেখানে মাঝে মধ্যে রজব গোপনে এসে দেখা করে।

কামরায় ঢুকতে যাবে, পেছন থেকে কেউ তার ওপর কম্বল ছুঁড়ে মারল। কোন শব্দ করার আগেই আরেকজন তাকে কম্বল সহ জাপটে ধরল। চিৎকার করতে যাবে সে, কিন্তু ততক্ষণে কম্বলসহ আরেকটা কাপড় দিয়ে মেয়েটাকে বেঁধে কাঁধে তুলে নিয়েছে সে।

উম্মে আমারা তৃতীয় কোন লোকের অস্তিত্ব টের পেল না। বুঝল, ওরা মাত্র দু’জন।

তাকে নিয়ে চলতে শুরু করেছে ওরা।

ওরা এদিক ঘুরে, ওদিক ঘুরে যেভাবে দ্রুত ওকে নিয়ে এগুচ্ছিল তাতে তার মনে হল, প্রাসাদের পথঘাট অপহরণকারীদের চেনা।

অন্ধকারেই সিঁড়ি ভাঙতে লাগল অপহরণকারীরা। উঠে এল ছাদে। ছাদ থেকে নিচের দিকে রশি ঝুলে আছে। মেয়েটাকে সহ একজন রশি বেয়ে নেমে এল নিচে। পেছনে নামল দ্বিতীয় জন। তারপর দু’জনই অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

একটু দূরে চারটে ঘোড়া বাঁধা ছিল। দ্রুত ওখানে চলে এল অপহরণকারীরা। ঘোড়ার পাশে বসে ছিল দু’জন লোক। সঙ্গীদের আসতে দেখে ওরা ঘোড়াসহ এগিয়ে এল।

ঘোড়ায় চড়ল চারজন। একজন বলল, ‘সাবধানে চলতে হবে, নইলে ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে শহরের লোকজন জেগে যাবে।’

ধীরে ধীরে শহর থেকে বেরিয়ে এল ওরা।

○             ○             ○

‘নিশ্চয়ই এ সালাহুদ্দীন আয়ুবীর কাজ।’

‘গভর্ণর ছাড়া আর কেউ এমন সাহস করবে না।’

‘এ কাজ সে ছাড়া আর কে করতে পারে!’

রাজপ্রাসাদে কানাঘুষা চলছে সালাউদ্দিন আয়ুবী উম্মে আমারাকে অপহরণ করিয়েছেন।

রজব ফিরে এসেছে। তল্লাশী নেয়া হয়েছে প্রাসাদের প্রতিটি কক্ষে। রক্ষীদের উপর মনের ঝাল মেটাচ্ছে কমাণ্ডার। যেনতেন অপরাধ নয়, খলিফার হারেমের হীরকখণ্ড অপহৃত।

দেখা গেল প্রাসাদের পেছনে একটা রশি ঝুলছে। পায়ের চিহ্ন খানিক দূর গিয়ে ঘোড়ার ক্ষুরের চিহ্নের সাথে মিশে গেছে। সন্দেহ নেই, মেয়েটাকে দড়ি বেয়ে নামানো হয়েছে।

মেয়েটা স্বেচ্ছায় কারো সাথে পালিয়ে গেছে এমন সন্দেহও প্রকাশ করল কেউ কেউ।

খলিফা একথা বাতিল করে দিলেন। ‘মেয়েটা আমাকে জীবনের চাইতে বেশী ভালবাসে।’

‘এ সালাহুদ্দীন আয়ুবীর কাজ।’ রজব খলিফাকে বলল, ‘প্রাসাদের সবাই বলছে সে ছাড়া এমন দুঃসাহস কারো নেই।’

প্রাসাদে এ কথা ছড়িয়েছে রজবই। মহল তল্লাশী নেয়ার সময় প্রতিটি লোককেই বলেছে, ‘এ সুলতান সালাহুদ্দীনের কাজ।’ তার এ রটনা কাজ দিয়েছে। মহলের প্রতিটি লোকের মুখে এখন এক কথা, ‘এ কাজ সুলতান সালাহুদ্দীন করেছে।’

খলিফা একবারও ভাবলেন না, এ অপবাদ মিথ্যেও হতে পারে। আগেই তাকে বলা হয়েছিল সুলতান হারেমের মেয়েদের নষ্ট করেছেন।

তিনি বিশেষ দূতকে ডেকে বললেন, ‘সালাহুদ্দীনকে গিয়ে বল মেয়েটাকে ফিরিয়ে দিতে, আমি তাকে কোন শাস্তি দেব না।’

দূত সালাহুদ্দীন আয়ুবীর কাছে পৌঁছল।

দূত যখন সালাহুদ্দীন আয়ুবীকে খলিফার নির্দেশ শোনাচ্ছিল, কায়রোর দশ বার মাইল দূরে ঘটছিল অন্য ঘটনা।

তিনটি উট ধীরে ধীরে কায়রোর দিকে এগিয়ে আসছে। আরোহী তিনজন মিসরীয় সৈন্য। পেট্রোল ডিউটি থেকে ফিরছিল ওরা।

রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুশমনের গুপ্তচরবৃত্তি, দেশদ্রোহীদের তৎপরতা এবং সুদানীদের হামলার আশঙ্কায় সালাহুদ্দীন আয়ুবী সৈন্যদের অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।

রাতের বেলা বিস্তীর্ণ মরু এবং পার্বত্য এলাকায় টহল দিয়ে বেড়াত ওরা। ওদের বাহন ছিল উট এবং ঘোড়া। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই ত্বরিত সালাহুদ্দীনের কাছে সংবাদ পৌঁছে দিত।

ডিউটি শেষে কায়রো ফিরে আসছিল তিন উষ্ট্রারোহী। সামনে মাটি এবং পাথুরে পাহাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা।

উপত্যকা দিয়ে চলছিল ওরা, একটা মেয়ের কান্নার শব্দ ভেসে এল। সাথে পুরুষালী কণ্ঠ। মনে হয় কাউকে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

উট থেকে নেমে এল একজন সৈনিক। পায়ে পায়ে পাহাড়ে উঠে গেল। শব্দ আসছে ওপাশ থেকে। লুকিয়ে পড়ল সৈন্যটা।

ওপাশে চারটে ঘোড়া বাঁধা। ক্লাছেই চারজন সুদানী কাফ্রী। একটা সুন্দরী মেয়ে দৌঁড়াচ্ছে। তার পেছনে ছুটছে এক কাফ্রী। কিছুদূর গিয়েই মেয়েটার নাগাল পেয়ে গেল সে। মেয়েটার বাহু ধরে সঙ্গীদের কাছে নিয়ে এল।

একজন কাফ্রী তার সামনে হাটু গেড়ে বসে বলল, ‘তুমি পবিত্র মেয়ে। নিজকে কষ্টের মধ্যে ফেলে আমাদের পাপী করো না। দেবতার অভিশাপে আমরা পুড়ে যাব। দেবতা আমাদের পাথরে পরিণত করবেন।’

‘আমি মুসলমান!’ চিৎকার করে বলল মেয়েটা। ‘আল্লাহর গজব পড়ুক তোমাদের দেবতাদের ওপর। আমাকে ছেড়ে দাও, নইলে খলিফার কুকুর দিয়ে তোমাদের টুকরো টুকরো করে ফেলব।’

‘তুমি এখন খলিফার মালিকানায় নেই, দেবতাদের মালিকানায় রয়েছ। দেবতাদের রয়েছে বজ্রের শক্তি, নাগনাগিনীর বিষ আর সিংহের দাঁত। তোমাকে কেউ লুকানোর চেষ্টা করলে মরুভূমির উত্তপ্ত বালু তাকে ছাই ভস্ম করে দেবে।’

এক কাফ্রী বলল, ‘তোমাদেরকে থামতে নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম বিশ্রামের প্রয়োজন নেই। ওর হাত পা বাঁধা থাক। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা পৌঁছে যেতে পারব।’

‘আমাদের ঘোড়াগুলোর বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল। তুমি নিজেও জান, দ্রুত যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের কারোরই আপত্তি নেই।’

‘এখন কথা না বলে আবার ওকে বেঁধে ফেলো।’

একজন মেয়েটাকে ধরল। একটা তীর এসে বিঁধল তার পিঠে। ঢিলে হয়ে গেল মেয়েটাকে ধরা হাত। তাকে ধাক্কা দিয়ে আবার দৌঁড় দিল মেয়েটা।

একজন এসে আহত লোকটাকে ধরে ঘোড়ার আড়ালে নিয়ে গেল। আরেকটা তীর এসে বিঁধল অন্য কাফ্রীর ঘাড়ে।

একজন দৌঁড়ে গিয়ে মেয়েটাকে ধরে আনল আবার। দ্বিতীয় লোকটা তীরবিদ্ধ হতেই যে লোকটা মেয়েটাকে ধরে রেখেছিল সে উটের লাগাম তুলে নিয়ে দ্রুত নীচের দিকে নেমে গেল। সাথে তার সঙ্গীও ছুটল।

তীর দুটো ছুঁড়েছিল যে সেন্ট্রি সে পরে বলেছে, ‘দেবতাদের নাম শুনে প্রথমটায় আমি ভড়কে গিয়েছিলাম। মেয়েটা যখন বলল আমি মুসলমান, গজব পড়ুক দেবতাদের উপর, তখন জেগে উঠল আমার ঈমানী শক্তি। খলিফার নাম শুনে বুঝলাম ও হারেমের মেয়ে। পোশাক আশাকেও তাকে বড় ঘরেরই মনে হল। মেয়েটাকে অপহরণ করে সুদানীদের মেলার বিক্রি করা হতে পারে ভেবে আর স্থির থাকতে পারিনি, সাথে সাথে তীর ছুঁড়লাম।’

সেনাবাহিনীর প্রতি সুলতানের নির্দেশ ছিল এক ডজন মানুষ হত্যা করতে হলেও একটা মেয়ের ইজ্জত রক্ষা করতে হবে। এ জন্যই সৈন্যটি দু’জনকে হত্যা করেছে। দু’জনকে জীবিত ধরার জন্য নীচে এসেই ভুল করেছিল সে।

পাহাড় থেকে নেমে ও উটে সওয়ার হল। সঙ্গীদের নিয়ে অনেকটা পথ ঘুরে এসে দেখল দু’টো লাশ পড়ে আছে। মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেছে বাকী দু’জন।

উট নিয়ে ঘোড়ার পিছু নেয়া সম্ভব নয়। তিন জনের একজনের কাছে তীর, দু’জনের কাছে তরবারী এবং বর্শা। কাফ্রীরা চারটে ঘোড়াই নিয়ে গেছে।

সেন্ট্রিরা পার্বত্য এলাকায় অনেক খোঁজাখুজি করল তাদের। ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ কানে এলেও ওরা তাদের নাগাল পায়নি।

মেয়েটার মুখে খলিফার নাম শুনেছে বলে লাশ দু’টোকে তুলে নিল ওরা। অপহরণকারীদের চেনার জন্য ওরা লাশগুলো সালাহুদ্দীন আয়ুবীর কাছে নিয়ে গেল।

○             ○             ○

কক্ষে পায়চারী করছেন সালাহুদ্দীন আয়ুবী। চোখে মুখে ক্রোধ আর উৎকণ্ঠা। কয়েকজন উপদেষ্টা মাথা নুইয়ে বসে আছেন। এর আগে সুলতানকে তারা কখনও রাগান্বিত হতে দেখেননি।

আবেগ তাকে কাবু করতে পারেনি কোনদিন। রাগান্বিত হবার মত ঘটনা ঘটলেও সব সময় ধীরে সুস্থে সিদ্ধান্ত নিতেন তিনি। শত্রু বেষ্টিত হয়ে যুদ্ধ করেছেন, কেল্লায় খাবার নেই, সাহস হারিয়ে ফেলেছে সৈন্যরা। সবাই অপেক্ষা করছে কমাণ্ডার আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেবেন, এ পরিস্থিতিতেও সুলতান সাহস হারাননি। ফৌজকে সাহসে উদ্দীপ্ত করে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন শক্রর ওপর। ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়। কিন্তু আজ সুলতান নিজেকে সংবরণ করতে পারছেন না। তার চেহারায় ক্রোধের সাথে ভয়। এ জন্য কক্ষের সবাই চুপ মেরে আছেন।

‘এই প্রথম আমার মাথা কাজ করছে না।’

‘সুলতান, আপনি কি খলিফার, এ নির্দেশটাকে ভুলে যেতে পারেন না?’ সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান আল নাসের বললেন।

‘চেষ্টা করছি, কিন্তু অপবাদের ধরণটা দেখেছেন? আমি হারেমের একটা মেয়েকে চুরি করেছি! আস্তাগফিরুল্লাহ্‌। আল্লাহ আমায় ক্ষমা করুন। সে আমাকে চরমভাবে অপমানই করেনি, দূত পাঠিয়ে ধমক দিয়েছে। আমাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারত!’

‘এরপরও আমার পরামর্শ হল আপনি শান্ত হোন।’ বললেন শাদ্দাদ।

‘ভাবছি, সত্যিই কি হারেমের কোন মেয়ে অপহৃত হয়েছে? আমার মনে হয় না। খোৎবা থেকে তার নাম বাদ দিয়েছি, হয়ত কোনভাবে জেনে ফেলেছে। মেয়ে চুরির অপবাদ দিয়ে সে তার জবাব দিয়েছে। প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করছে। মুফতি ঈশা, মিসরের প্রতিটি মসজিদে নির্দেশনামা পাঠিয়ে দিন, আগামী জুম্মা থেকে খোৎবায় কোন মসজিদেই খলিফার নাম নেয়া হবে না।’

‘আপনি নিজে গিয়ে খলিফার সাথে কথা বলুন।’ আল নাসের বললেন। ‘তাঁকে স্পষ্ট বলে দিন, খলিফা জাতির ইজ্জতের প্রতিভূ হলেও দেশে তার হুকুম কার্যকর করা এখন সম্ভব নয়। বিশেষ করে যখন দেশের ভেতরে বাইরে শত্রুর আক্রমণের ভয়া রয়েছে, আর খলিফা রয়েছেন মদে মাতাল। খলিফার গার্ড বাহিনীর সদস্য সংখ্যা কমিয়ে দিন। সুদানীদের পরিবর্তে মিসরী সৈন্য দিন। প্রাসাদের জন্য নির্ধারিত সম্মানীও কমিয়ে দিন। জানি, আমাদেরকে তার মোকাবিলা করতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের পুরোপুরি আল্লাহ্‌র উপর নির্ভর করা উচিৎ।’

‘আমি সব সময় আল্লাহর উপরই নির্ভর করেছি। তিনি নিশ্চয়ই এ অপবাদ ও অপমান থেকে আমাকে নিষ্কৃতি দেবেন।’

প্রহরী ভেতরে ঢুকল। সবাই তাকাল তার দিকে।

প্রহরী বলল, ‘একজন কমাণ্ডার এসেছেন। সাথে পেট্রোল ডিউটি থেকে আসা তিনজন সিপাই এবং সুদানীদের দুটো লাশ।’

প্রহরীর আগমনে কক্ষের সবাই বিরক্ত হলো। এ মূহুর্তে সুলতান এক জরুরী মিটিং করছেন। সালাহুদ্দীন আয়ুবী বললেন, ‘ওকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।’

কমাণ্ডার ভেতরে এল। ধুলোমলিন চেহারা।

তাকে বসিয়ে সুলতান প্রহরীকে বললেন, ‘ওর খাবারের ব্যবস্থা কর।’

কমাণ্ডার বলল, ‘টহলরত সৈন্যরা চারজন কাফ্রীর হাত থেকে একটা অপহৃত মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে তীর মেরে দু’জনকে মেরে ফেলেছে। বাকী দুই কাফ্রী মেয়েটাকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। ওরা বলেছে মেয়েটা বেদুঈন নয়, মনে হয় কোন বড় ঘরের মেয়ে। ও নাকি বলেছিল ও খলিফার প্রাসাদে থাকে।’

‘হয়ত’ সুলতান বললেন, ‘হয়ত আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন।’

তিনি কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। তাঁকে অনুসরণ করল সবাই।

বাইরে মাটিতে দু’টো লাশ পড়ে আছে। একটা উপুড় হয়ে। তীর বিঁধে আছে পিঠে। দ্বিতীয় লাশের তীর ঘাড়ে। পাশে দাঁড়ানো তিনজন সৈনিক। ওরা গভর্ণর এবং সেনাপতিকে এই প্রথম দেখেছে।

স্যালুট করে একপাশে সরে গেল ওরা।

সুলতান ওদের সাথে করমর্দন করে বললেন, ‘এ শিকার কোত্থেকে নিয়ে এলে?’

তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যটি এগিয়ে এসে সুলতানকে পুরো ঘটনা শোনাল।

‘এ মেয়েটাই কি খলিফার রক্ষিতা!’ উপদেষ্টাদের দিকে তাকিয়ে সুলতান প্রশ্ন করলেন।

‘তাই মনে হয়।’ দুটো খঞ্জর দেখিয়ে বললেন আলী।

সৈন্যটি যখন ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিল, আলী তখন লাশের তল্লাশী নিচ্ছিলেন। ওদের পরনে গোত্রীয় পোশাক। ভেতরে বেল্টের সাথে খঞ্জর আটকানো। খলিফার গার্ড বাহিনীর বিশেষ খঞ্জর। বাটে খেলাফতের মোহর অঙ্কিত।’

খঞ্জর দু’টো চুরি না করে থাকলে এরা গার্ড বাহিনীর সদস্য। এরাই খলিফার রক্ষিতা মেয়েটাকে অপহরণ করেছে।

লাশ তুলে নাও, খলিফার কাছে যাব।

‘আগে নিশ্চিত হতে হবে এরা গার্ড বাহিনীর সদস্য কি না।’ বললেন আলী।

কিছুক্ষণ পর রক্ষীদের একজন কমাণ্ডার এল। লাশ দেখানো হল তাকে। কমাণ্ডার বলল, ‘এরা গার্ড বাহিনীর সদস্য। তিনদিন আগে ওরা এক হস্তার জন্য ছুটি নিয়েছে।’

‘আর কেউ কি ছুটিতে আছে?’ প্রশ্ন করলেন সালাহুদ্দীন আয়ুবী।

‘এদের সাথে আরও দু’জন ছিল।’

‘এরা কি একত্রেই গেছে?’

‘হ্যাঁ।’

কমাণ্ডার এমন তথ্য প্রকাশ করল, শুনে সবাই চমকে উঠলেন। সে বলল, ‘এরা সুদানের জংলি উপজাতির লোক। ফেরাউনের সময় থেকে ওদের মধ্যে কিছু রসম চলে আসছে। প্রতি তিন বছর পর ওদের একটা উৎসব হয়, মেলা বসে। চলে তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত। চতুর্থ রাতে থাকে ভরা পূর্ণিমা।

এ গোত্রের লোক ছাড়া অন্যরাও মেলায় অংশ গ্রহণ করে। ওরা যায় ফুর্তি করার জন্য। ওখানে মেয়েদের বেচাকেনা হয়।

মেলা বসার একমাস আগে থেকেই কায়রো পর্যন্ত আশপাশের যুবতী মেয়েদের পিতামাতারা আতঙ্কে সময় কাটায়। যতটা সম্ভব সতর্ক থাকে ওরা। মেয়েদের একা বের হতে দেয় না। বেদুঈনরা মেয়ে চুরি করার জন্য অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায়। যুবতীদের ধরে এনে মেলায় বিক্রি করে।

এ চারজন সুদানীও মেলায় অংশ গ্রহণের জন্য ছুটি নিয়েছে। তিন দিন পর মেলা শুরু হচ্ছে।’

‘হারেমের মেয়েটাকে এরাই চুরি করেছে?’ আলী প্রশ্ন করলেন।

‘নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে এ সময় জীবনবাজি রেখেও ওরা, মেয়ে চুরি করে। কোন অভিভাবক মেয়েকে আনতে গেলে তাকেও হত্যা করে। মিসরের আমীর-ওমরা, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য ও সরকারী কর্মকর্তারাই এসব মেয়েদের গ্রাহক। মেলায় অস্থায়ী পতিতালয়ের ব্যবস্থা থাকে। মদ আর জুয়া চলে রাতভর। শেষ রাতটি হয় রহস্যে ঘেরা।

গোপন স্থানে অনন্যা সুন্দরী এক যুবতীকে বলি দেয়া হয়। মেয়েটাকে কোত্থেকে আনা হয় বা কিভাবে বলি দেয়া হয় কেউ জানে না। এ কাজ সম্পন্ন করে ধর্মীয় গুরু। জংলীরা তাকে ঈশ্বরের মত সম্মান করে।

বলি অনুষ্ঠানে ধর্মীয় গুরু ছাড়াও চার পাঁচজন যুবতী এবং ক’জন বিশিষ্ট লোক উপস্থিত থাকে। দর্শকদের দেখানো হয় মেয়েটার কাটা মাথা এবং রক্ত। জংলীরা তখন মদপান করে পাগলের মত নাচতে থাকে।

খলিফার গার্ড বাহিনীকে ষ্ট্যাণ্ডবাই করে রাখা হয়েছিল। সকাল থেকে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। এখন সূর্য ডুবোডুবো। খাদ্য পানি কিছুই দেয়া হয়নি।

রজব বার বার ওদের সামনে এসে ঘোষণা করছিল, ‘তোমাদের সহযোগিতা ছাড়া অপহরণ সম্ভব নয়। যে অপহরণকারীকে সাহায্য করেছ সামনে আস। না হয় সবাইকে না খাইয়ে মারা হবে। সে যদি স্বেচ্ছায় গিয়ে থাকে তবুও তোমরা দেখেছ।’

কিন্তু এতে কোন কাজ হচ্ছিল না। সবাই বলছে, তারা কিছুই জানে না।

খলিফা রজবকে একদম বিশ্রাম দিচ্ছেন না। ‘রজব! মেয়েটাকে অপহরণ করা হয়েছে এতে আমার দুঃখ নেই। ভাবছি এমন কঠোর প্রহরা থেকে যে মেয়েকে নিয়ে যেতে পারে সে আমাকেও হত্যা করতে পারে। সালাহুদ্দীন এ কাজ করেছে এর প্রমাণ হাজির কর।’

সুলতান সালাহুদ্দীনের উপর মেয়ে চুরির অপবাদ দেয়া সহজ, কিন্তু রজব তার প্রমাণ দেবে কিভাবে? সে মহা ফ্যাসাদে পড়ল।

রাগের চোটে সে একবার যাচ্ছে রক্ষীদের কাছে, আবার খলিফার ডাকে ছুটে যাচ্ছে তার কাছে।

রক্ষীদের ধমকাচ্ছিল রজব। প্রহরী ফটক খুলে ঘোষণা করল, ‘মিসরের গভর্ণর আসছেন।’

ভেতরে প্রবেশ করল সালাহুদ্দীনের ঘোড়া। সামনে দু’জন দেহরক্ষী। পেছনে আটজন ঘোড়সওয়ার। একজন ডানে, একজন বায়ে, উপদেষ্টারা পেছনে। এদের সাথে আলীও রয়েছেন।

রজব সুলতানের আগমনের সংবাদ দিল খলিফাকে। একে একে সবাই ভেতরে ঢুকল। পেছনে একটি টাংগায় দুটি লাশ। একটা রয়েছে চিৎ হয়ে, অন্যটা উপুড় হয়ে। তীর বিঁধে আছে দু’টো লাশের শরীরে।

খলিফা এগিয়ে এলেন। সালাহুদ্দীন আয়ুবী নামলেন ঘোড়া থেকে। সাথে সাথে সঙ্গীরাও নেমে পড়ল। সুলতান এগিয়ে খলিফাকে সালাম করে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন।

‘হারেমের চুরি যাওয়া মেয়েটাকে ফিরিয়ে দেবার নির্দেশ আমি পেয়েছি। আমি নিয়ে এসেছি আপনার দু’জন রক্ষীর লাশ। এরাই আমাকে নিরপরাধ প্রমাণ করবে। আপনাকে বিনয়ের সাথে বলতে চাই, সালাহুদ্দীন আপনার সেনাবাহিনীর সৈন্য নয়। আপনি যে খেলাফতের প্রতিনিধি, সালাহুদ্দীনকে সেখান থেকেই পাঠানো হয়েছে।’

সালাহুদ্দীনের মনের অবস্থা বুঝে ফেললেন খলিফা। পাপের ভারে পিষ্ট হচ্ছিল তার বিবেক। সালাহুদ্দীন আয়ুবীর ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়ানোর শক্তি তার ছিল না।

সুলতানের কাঁধে হাত রেখে খলিফা বললেন, ‘তোমাকে আমি নিজের সন্তানের চাইতে বেশী স্নেহ করি সালাহুদ্দীন।’

‘আমি এখন আসামী। আমাকে এখন নিজের সাফাই পেশ করতে হবে। আল্লাহ আমার সাহায্যে এ দু’টো লাশ পাঠিয়েছেন। ওদের নীরবতা এবং ওদের দেহের বিদ্ধ তীর বলবে, সালাহুদ্দীন অপরাধী নয়। নিজকে নিরপরাধ প্রমাণ না করা পর্যন্ত আমি ভেতরে যাব না।’

তিনি লাশের দিকে হাঁটা দিলেন। খলিফা কাঁচুমাচু হয়ে তার পেছনে চললেন। সুলতান গার্ডদের সামনে লাশ দুটি রেখে বললেন, ‘প্রথমে কমাণ্ডার ও পরে আটজন করে এক সাথে এগিয়ে এসে বল কার এ লাশ।’

এগিয়ে এল কমাণ্ডার। লাশ দেখে ওদের নাম বলল। এরা আমাদের গার্ডবাহিনীর সদস্য। আটজন করে এসে লাশ দু’টো গার্ড বাহিনীর বলে শনাক্ত করল।

‘সালাহুদ্দীন, বুঝলাম এ দু’টো গার্ড বাহিনীর সদস্যের লাশ। তার আগে বল এদের কে হত্যা করেছে?’

সালাহুদ্দীন আয়ুবী পেট্রোল ডিউটির সৈন্য তিনজনকে ডাকলেন। ওরা খলিফাকে রাতের কাহিনী শোনাল। ওদের বলা শেষ হলে সুলতান খলিফাকে বললেন, ‘মেয়েটাকে আমার কাছে নেয়া হয়নি। নেয়া হয়েছে সুদানী কাফ্রীদের মেলায় বিক্রি করার জন্য।’

খলিফা সুলতানকে ভেতরে যেতে বললেন। তিনি ভেতরে যেতে অস্বীকার করে বললেন, ‘আমি মেয়েটাকে এনে আপনার সামনে হাজির হব। শুধু বলব, উপহার হিসেবে পাওয়া এ মেয়েটা আপনার স্ত্রী নয় রক্ষিতা। আমার কাছে এ মেয়ে মূল্যহীন। আল্লাহ আমাকে এরচে অনেক গুরত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন।’

‘একটা মেয়ে চুরি হয়েছে বলে আমি শঙ্কিত নই। আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে এভাবে মেয়েরা অপহৃত হতে থাকলে দেশের আইন শৃংখলা পরিস্থিতির কি হবে?’

‘আর আমার দুঃশ্চিন্তা হল মুসলিম বিশ্ব অপহৃত হচ্ছে, এর থেকে জাতিকে কিভাবে রক্ষা করা যায়। আপনি ভাববেন না, আমার গোয়েন্দারা মেয়েটিকে উদ্ধারের জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করছে।’

সালাহুদ্দীন আয়ুবীকে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে খলিফা বললেন, ‘সালাহুদ্দীন, কিছুদিন থেকে দেখছি তুমি আমাকে এড়িয়ে চলছ। আমি তোমার পিতা নাজমুদ্দীনকে ভীষণ সম্মান করতাম। কিন্তু তুমি আমাকে মোটেও সম্মান কর না। আজই শুনলাম জামে মসজিদের খতিব আমিরুল আলেম নাকি খোৎবা থেকে আমার নাম বাদ দিয়েছে। তার এ অপরাধের শাস্তি আমি দিতে পারি। কিন্তু ভাবছি, সে তো তোমার আশকারা পেয়ে এমনটি করেনি?’

‘আমার আশকারা পেয়ে নয় আমার নির্দেশে খতিব এ কাজ করেছেন। শুধু আপনার নাম নয়, এখন থেকে আপনার পরে যত খলিফা আসবেন খোৎবায় কারও নামই থাকবে না।’

‘এ পদক্ষেপ ফাতেমী খেলাফতকে দুর্বল করার জন্য নেয়া হয়েছে। মনে হয় এখানে আব্বাসী খেলাফত নিয়ে আসার পরিকল্পনা হচ্ছে।’

‘হুজুরের অনেক বয়স হয়েছে। মাথাটাও ঠিকমত কাজ করে না। কোরানে মদ হারাম করেছে কারণ মদ মানুষের মস্তিষ্ক দুর্বল করে দেয়। আমি ভাবছি আপনার গার্ডবাহিনী পরিবর্তন করব। রজবের স্থানে অন্য কমাণ্ডার দেব।’

‘কিন্তু রজবকে তো আমি রাখতে চাই।’

‘সামরিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার জন্য হুজুরের কাছে অনুরোধ করব।’

আলীর দিকে তাকালেন সালাহুদ্দীন আয়ুবী। পাঁচজন কাফ্রী সেপাই নিয়ে এগিয়ে আসছেন তিনি।

এ পাঁচজন সেই গোত্রের। কমাণ্ডার বলেছে, ‘এরা আগামী পরশু ছুটিতে যাচ্ছে। আমি এদেরকে সাথে নিয়ে যাচ্ছি। অপহরণে ওদের হাত থাকতে পারে।’

সালাহুদ্দীন আয়ুবী রজবকে ডেকে বললেন, ‘কাল থেকে এখানে অন্য কমাণ্ডার আসবে। তুমি যাবে আমার কাছে। তোমাকে মেনজানিক কামানের দায়িত্ব দেব।’ রজবের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

○             ○             ○