সেনা মহড়া দেখেছে জনগণ। সালাহুদ্দীনের সামরিক শক্তি দেখে ভীত হয়নি, বরং খুশী হয়েছে তারা।
বক্তৃতা বিবৃতিতে বিশ্বাসী নন সালাহুদ্দীন আয়ুবী, কিন্তু মহড়ায় তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন। জনতার সামনে খ্রীষ্টানদের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, আরবের মুসলমান আমীর ওমরাগণ ভোগবিলাসে মত্ত। সাধারণ মুসলমান খ্ৰীষ্টানদের অত্যাচারে জর্জরিত। খ্ৰীষ্টানরা কাফেলা লুণ্ঠন করে। অপহরণ করে মুসলিম যুবতীদের। ওদের আব্রু ইজ্জত হরণ করার পর বিক্রয় করে দেয়।
সুলতান জনতাকে জাতীয় চেতনাবোধে উজ্জীবিত করতে চাইলেন। মা বোনদের ইজ্জত রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে উদ্বুদ্ধ করলেন যুবকদের।
সালাহুদ্দীন আয়ুবীর আগুন ঝরা বক্তৃতায় আবেগে উদ্বেলিত হল দর্শকরা। সেদিন থেকেই সেনাবাহিনীতে নতুন ভর্তি শুরু হল।
দশদিনের মধ্যে নতুন ভর্তি দু’হাজারে গিয়ে পৌঁছল। এর মধ্যে দেড় হাজার নিয়ে এসেছিল উট, একহাজার ঘোড়া এবং খচ্চর। সুলতান পশুর দাম চুকিয়ে দিলেন। শুরু হল ওদের সামরিক প্রশিক্ষণ।
মেলার তিন মাস পর। দেখা গেল সেনাবাহিনীতে তিনটি অপরাধ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। চুরি, জুয়া এবং রাতে যেখানে যার থাকার কথা সেখানে না থাকা।
তিনটি অপরাধের মূল ছিল জুয়া। এক সৈন্য আরেক সৈন্যের ব্যক্তিগত জিনিস চুরি করে বাজারে বিক্রি করে ফেলত।
এক রাতে তিনটি ফৌজি ঘোড়া হারিয়ে গেল, অথচ দেখা গেল সৈন্যদের কেউ অনুপস্থিত নেই। ফলে কোন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হল না। আরেক রাতে দেখা গেল দশটি ঘোড়া নেই।
সৈন্যদের শাস্তির ভয় দেখানো হল কিন্তু অপরাধ কমল না।
একরাতে এক সৈনিককে গেটের বাইরে দেখা গেল। মাতালের মত তার পা কাঁপছে। সেন্ট্রি ডাকল তাকে। দাঁড়াল সিপাইটি। এরপর এগিয়ে আসতে গিয়ে ধড়াম করে মাটিতে পড়ে গেল।
এগিয়ে গেল সেন্ট্রি। সৈন্যটির দেহ রক্তে ভেজা। সেন্ট্রি তাকে সুবেদারের কাছে নিয়ে গেল। চিকিৎসা করা হল। কিন্তু তাকে বাঁচানো গেল না।
মৃত্যুর আগে সে বলল, ‘একজন সিপাইকে আমি হত্যা করে এসেছি। ক্যাম্প থেকে আধা মাইল উত্তরে এক তাঁবুতে পড়ে আছে তার লাশ।’
ওখানে ছিল তিনটি বেদুঈন তাঁবু। ওদের কাছে রয়েছে সুন্দরী যুবতী। দিনে সেজেগুজে ক্যাম্পের চারপাশে হাঁটত যুবতীরা। রাতে সৈন্যরা ওদের কাছে চলে যেত। একজনের কাছে শুনে আরেকজন।
এরা কোন সাধারণ পতিতা ছিল না। প্রতিটি খদ্দেরের সাথে ওরা প্রেমের অভিনয় করত। কে কখন আসবে বলে দিত যুবতীরা।
দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিন এক যুবতীর তাঁবুতে এক সাথে দু’জন সৈনিক এসে হাজির হল। এদের দু’জনের সাথেই অভিনয় করছিল যুবতী।
দু’জনই ওকে পাওয়ার জন্য ছিল উদগ্রীব।
সে রাতে দু’জন একসঙ্গে তাঁবুতে পৌঁছে মেয়েটাকে নিজের অধিকারে নেয়ার জন্য সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়ল। সংঘর্ষে একজন হল নিহত, অন্যজন আহত হয়ে ক্যাম্পে এসে মারা গেল।
একজন কমান্ডার কয়েকজন সিপাই নিয়ে লাশের জন্য ওখানে গেল। গিয়ে দেখে লাশ পড়ে আছে, কিন্তু তাঁবু নেই।
সৈন্যটার লাশ নিয়ে ফিরে এল সিপাইরা। রাতে আর খোঁজাখুজিতে গেল না। আয়ূবীর কাছে রিপোর্ট করা হল। বলা হল, ‘সৈন্যদের মাঝে অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
কেন অপরাধ বৃদ্ধির পাচ্ছে তার কারণ অনুসন্ধান করতে আলীকে হুকুম দিলেন সালাহুদ্দীন আয়ুবী। গোয়েন্দাদের তৎপর হতে বললেন এ কাজে। আল বারককে বললেন, ‘আপনিও একটু খোঁজ খবর নেন।’
শহরের এমন জায়গায় ছিল এ ‘কেনো’র জবাব, যেখানে যেতে পারত না আলীর গোয়েন্দারা। শহরের কেন্দ্রে কেল্লার মত বিশাল বাড়ী। মিসরের একটা পরিবার নয় বরং একটা বংশের সকলেই ওখানে থাকত।
এরা ছিল অভিজাত ও সম্মানিত। ওদের দানের হাত ছিল উন্মুক্ত। এতিম, বিধবা এবং গরীবরা কখনও ওখান থেকে শূন্য হাতে ফিরত না। এ বংশের সবাই ছিল ব্যবসায়ী। মহড়ার সময় সেনাবাহিনীকে আশরাফি দিয়েছিল দুই থলে ভর্তি করে।
সালাহুদ্দীন মিসরে আসার আগে সুদানী ফৌজের বড়বড় অফিসাররা এখানে এসে সময় কাটাত। সুদানীরা নিশ্চিহ্ন হরার পর এরা সালাহুদ্দীন সরকারের অনুগত হয়ে পড়ল।
সুলতান যখন আলী এবং আল বারককে নির্দেশ দিচ্ছিল সে রাতে ওই বাড়ীর এক কক্ষে চলছিল জমজমাট মদের আসর। আসরে বসেছিল বার জন যুবক ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি।
কক্ষে প্রবেশ করল এক বৃদ্ধ। সাথে একদল সুন্দরী। এদের মধ্যে এক যুবতীর মুখ নেকাবে ঢাকা।
উঠে দাঁড়াল সবাই। ওরা কক্ষে ঢুকতেই দরজা বদ্ধ করে দেয়া হল। নেকাব খুলে বৃদ্ধের পাশে এসে বসল মেয়েটা।
‘ফৌজে অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ার সংবাদ গতকাল সুলতানের কানে দেয়া হয়েছে।’ বৃদ্ধ বলল, ‘এজন্য আমাদের আজকের এ বৈঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফৌজে গোয়েন্দাদেরকে অন্তৰ্ভূক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে সুলতান।’
‘আমরা ওদের তৎপরতা সফল হতে দিতে পারি না।’ বলল একজন।
‘তোমাদের জন্য সুসংবাদ হল দু’জন মিসরী সৈন্য এক যুবতীকে নিয়ে ঝগড়া করেছে। নিহত হয়েছে একজন, অন্যজন আহত হয়ে ক্যাম্পে ফিরে মারা গেছে, এ আমাদের প্রথম সাফল্য।’
তিন মাসে নিহত হল মাত্র দু’জন। এত ধীরগতির সফলতায় সন্তুষ্ট হওয়ার কিছু নেই। যখন আয়ুবীর এক সালার আরেক সালারকে হত্যা করবে তখনই শুধু বলা যাবে আমরা সফল হচ্ছি।’ বলল অন্য একজন।
‘কোন সেনাপতি বা কমান্ডার যদি সালাহুদ্দীনকে হত্যা করে তবেই আমরা সফল।’ বৃদ্ধের কণ্ঠ, ‘একহাজার সৈন্য নিহত হলেও কিছু যায় আসে না। আমাদের লক্ষ্য সালাহুদ্দীন। গত বছরের কথা তো তোমরা জান, সালাহুদ্দীনর প্রতি নিক্ষিপ্ত তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। রোম থেকে আসা লোকগুলো সব মারা পড়ল। ওদের দলের এক হারামী মুসলমান হয়ে গেল। এতে বুঝা যায়, সালাহুদ্দীনকে হত্যা করা এত সহজ নয় যা তোমরা মনে কর।’
‘এওতো হতে পারে, সালাহুদ্দীনকে মারলে তার স্থান দখল করবে তারচে গোঁড়া কোন ব্যক্তি? বাগদাদ ও দামেশকের আমীরদেরকে যেমন যুবতী মেয়ে দিয়ে ধ্বংস করেছি, সালাহুদ্দীনর ফৌজকেও সেভাবে নষ্ট করতে হবে।’
‘খ্রিষ্টান এবং সুদানীরা পরাজিত হয়েছে এক বছর হল,’ একজন বলল, ‘এ এক বছরে আপনারা কি করেছেন? আপনারা যে পথে এগুচ্ছেন এ পথ বড় দীর্ঘ। এ মুহুর্তে দু’জনকে হত্যা করা অত্যন্ত জরুরী। একজন সালাহুদ্দীন, অন্যজন আলী বিন সুফিয়ান।’
‘আপনি ঠিক বলেছেন। আলীকে হত্যা করলে সালাহুদ্দীন অন্ধ হয়ে যাবে।’ সমর্থন জানাল এক যুবক।
‘সালাহুদ্দীনর বুকের সব গোপনীয়তা দেখার চোখ এখন আমাদের হাতে।’ বৃদ্ধ যুবতীর পিঠ চাপড়ে বলল, ‘এ হল সে চোখ। এর চোখের যাদু দেখে নাও। তোমরা আল বারক নামে সালাহুদ্দীনের এক সচিবের নাম শুনেছ। কেউ কেউ তাকে দেখেও থাকবে। সালাহুদ্দীনর হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারে মাত্র দু’টো লোক, আলী এবং আল বারক। আলীকে হত্যা করা হবে বোকামী।’
‘আল বারকের মত আমরা তাকেও হাত করে নেব।’
‘আল বারক হাতে এসেছে?’
বুড়ো যুবতীর রেশম কোমল চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, ‘এ শিকল দিয়ে তাকে বেঁধে ফেলেছি। তোমাদের এই সুসংবাদ শোনানোর জন্যই আজ ডাকা হয়েছে।’
‘কি বলছেন আপনি! এ অসাধ্য কি করে সাধন করলেন?’ বিস্মিত প্রশ্ন করল বিড়ালমুখো ঢেঙ্গাপাতলা এক লোক।
‘আলী এবং আল বারককে ফাঁসানোর জন্য আমি এক বছর ধরে ঘুরছি। পারিনি। সেনা মহড়ার দিন এক অভাবিত সুযোগ ঘটে গেল। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত আসনে বসার জন্য মঞ্চে উঠলাম। আলী বিন সুফিয়ানকে দেখলাম না আশপাশে, তবে আল বারককে পেলাম।’
যুবতীকে দেখিয়ে বলল, ‘একে তো তোমরা চেনই, ওকে পুরুষ ধরার ট্রেনিং দিয়েছি দীর্ঘদিন। সে ট্রেনিং এবার কাজে লাগাবার পালা।
ওকে তার পাশে বসিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। আমি সরে যেতেই তার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলল ও। আমাকে অত্যাচারী বৃদ্ধ স্বামী বানিয়ে আমার কাছ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ও তার সাহায্য চাইল। তার মায়াবী রূপের জালে আটকে গেল আল বারক। গোপনে ওরা সাক্ষাৎ করল। সাক্ষাতের স্থানে আমরা একটা নাটক করলাম।
আমাদের লোকেরা তরবারী এবং বর্শা নিয়ে আক্রমণ করল ওদের। তার মোকাবেলায় রণরঙ্গিনী মূর্তি ধারণ করল ও। আল বারক ভেবেছে মেয়েটা তার জন্যই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এতসব করছে। অথচ বেকুবটা একবারও ভাবল না, এত লড়াইয়ের পরও দুই পক্ষের কেউই আহত হয়নি কেন। শেষ পর্যন্ত আমি ওকে তার হাতে তুলে দিলাম।
সবাই তাকাল মেয়েটার দিকে। তার মুখ থেকে কিছু শুনতে চায় সবাই। মেয়েটা বলল, তাকে আমার নাম বলেছি আছেফা। আশ্চর্য! এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক আমার ফাঁদে পা দিল! সে কখনও মদ খায়নি, আমি তাকে অভ্যস্ত করিয়েছি। ঘরে তার স্ত্রী সন্তান রয়েছে। ওদের ভুলেই গেছে সে। আল বারককে ফাঁসানোর বিস্তারিত কাহিনী বর্ণনা করল যুবতী।
বৃদ্ধ বলল, ‘এ তিন মাসে ও আমাকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। সুলতান বিশাল সেনাবাহিনী তৈরী করেছেন। অর্ধেক থাকবে মিসরে, অর্ধেক খ্ৰীষ্টান রাজাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য বাইরে নিয়ে যাবে। তার লক্ষ্যস্থল ফিলিস্তিন। আল বারক বলেছে, সালাহুদ্দীন পরিকল্পনা নিয়েছে সর্ব প্রথম মুসলমান শাসক ও সামন্ত প্ৰভুদের ঐক্যবদ্ধ করার।’
‘তার মানে আল বারক এখন আমাদের লোক?’
‘না।’ বৃদ্ধের জবাব, ‘সে সালাহুদ্দীনর যেমন একান্ত অনুগত তেমনি এ মেয়েটার প্রতিও তার টান অপরিসীম।’
‘আমি সুলতানের একজন অন্ধ ভক্ত। ইসলামের ব্যাপারে আমি যেমন ভীষণ আগ্রহী তেমনি মুসলিম জাতির উন্নতিই আমার একমাত্র স্বপ্ন। ইসলামের এমন একজন সেবিকার সাথে আলাপ করার সময় সে কোন রকম রাখঢাক করে কথা বলার প্রয়োজন মনে করে না।’ খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ল মেয়েটা।
‘হ্যাঁ, তা তো হবেই। অমন যুবতী দেহের আকর্ষণ যার, তার কাছে আবার গোপনীয়তা কি?’
বৃদ্ধ বলল, ‘তাকে আমাদের সঙ্গী করতে পারছি না, তার দরকারই বা কি? সে তো এখন আমাদের হাতের পুতুল।’
‘সুলতান সালাহুদ্দীন আর কি করতে চায়?’ প্রশ্ন করল আরেক সদস্য।
‘তার মাথায় এখন ঘুরপাক খাচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের স্বপ্ন। খ্ৰীষ্টান রাষ্ট্রগুলোতে ইসলামের পতাকা উড়াবার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সে। আমাদের গোয়েন্দাদের তৎপরতা নস্যাৎ করার জন্য আলীকে দিয়ে তৈরী করেছে গোয়েন্দা বাহিনী। আল বারকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী সে আলাদাভাবে ত্যাগী ও কর্মঠ যুবকদের নিয়ে এক বাহিনী গঠন করেছে। ট্রেনিংও শুরু হয়েছে ওদের। ট্রেনিং শেষ হলে ওদেরকে আমাদের দেশে গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য পাঠাবে। তার এসব পরিকল্পনা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।’
বিড়ালমুখো ঢেঙ্গা লোকটা মুখ খুলল এবার। বলল, ‘সেনা মহড়ার মাধ্যমে মুসলমানদের মনে সে আশার আলো জাগিয়ে তুলেছে। যুবকরা ফৌজে ভর্তি হচ্ছে প্রতিদিন। ছ’সাত হাজার নতুন সৈন্য ইতিমধ্যে যোগাড়ও করে ফেলেছে। ভর্তি এখনও চলছে। অনেক সুদানীও রয়েছে এর মধ্যে। সালাহুদ্দীন যথেষ্ট পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
‘এ তো এক মারাত্মক পরিকল্পনা!’
‘হ্যাঁ, তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বাহিনী বড় হলেই যুদ্ধে জেতা যায় না, যুদ্ধজয়ের প্রধান শর্ত যে শৃঙ্খলাবোধ তা আমরা ভেঙে দিচ্ছি। সালাহুদ্দীনর সেনাবাহিনীকে জুয়া এবং ব্যভিচারে লিপ্ত করার কাজ বেশ ভালই এগুচ্ছে। সেনাবাহিনীতে আমাদেরও অনেক লোক ভর্তি হয়েছে। ওরা ইতিমধ্যেই জুয়া খেলা জমিয়ে তুলেছে। আর কে না জানে জুয়া ও নারী মানুষকে নানা অপকর্ম, চুরি এবং খুনখারাবীতে সহজেই পৌঁছে দেয়।’
‘তা দেয় ঠিক, কিন্তু খুনখারাবী ব্যাপকভাবে শুরু হচ্ছে কই?’
‘হবে, হবে। যে সব বেশ্যাদের ট্রেনিং দিয়ে ছাউনির আশপাশে ছেড়ে দেয়া হয়েছে ওরা যে পেশাধারী তা প্রকাশ করে না। সুলতানের সৈন্যদের বিপথগামী করা ছাড়াও ওদের সাথে প্রেমের অভিনয় করে। গত পরশু এক মেয়ের জন্য দু’জন যুদ্ধ করে নিহত হয়েছে, এ তো সবে শুরু।’
‘কিন্তু সালাহুদ্দীন এ সংবাদ পেয়ে আলী এবং আল বারককে তদন্তের নির্দেশ দেয়ায় বুঝা যাচ্ছে ও এ ব্যাপারে সচেতন। এখন ধড়পাকড় শুরু না হলেই হয়।’
‘আমি ভাবছি এখন থেকে কিছুদিন ক্যাম্পের কাছে যেতে মেয়েদেরকে নিষেধ করবো।’
আছেফা জানাল, ‘সে পাঁচ ছ’দিন পর পর পর বৃদ্ধকে সংবাদ পৌঁছায়। আল বারককে মদের সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে সে চলে আসে বৃদ্ধের কাছে।’
মিটিং চলল গভীর রাত পর্যন্ত। আলোচনা হল অন্যান্য মিনি পতিতালয়গুলো নিয়ে। ফল আশাব্যঞ্জক। এতে সন্ত্রান্ত বংশের যুবকদের নষ্ট করা যাচ্ছে দ্রুত। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মেয়েগুলো এক্ষেত্রে যথেষ্ট সফলতা দেখাচ্ছে। এখন মুসলমান মেয়েদেরকেও অশ্লীলতা এবং বেহায়াপনার দিকে নিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে ছড়িয়ে দিতে হবে নেশার দ্রব্য।
গোপন বৈঠক শেষ হল। বেরুল একজন। তার পনের মিনিট পর আর একজন, এভাবে সবাই।
শেষ পর্যন্ত রইল যুবতী ও অন্য একজন গোয়েন্দা। নেকাবে মুখ ঢেকে যুবতীও গোয়েন্দাটির সাথে বেরিয়ে এল।
আল বারক দ্বিতীয় বিয়ের কথা গোপন রাখলেন, কাউকে বললেন না। দীর্ঘদিন এক স্ত্রী নিয়ে ঘর করেছেন, চল্লিশে এসে বিয়ে করলেন এক যুবতীকে, তার ভয় ছিল বন্ধুরা এ জানতে পারলে তাকে উপহাস করবে। কিন্তু অতি বুদ্ধিমানরা সহজ কথা একটু দেরীতেই বোঝে, এ কান ও কান করে তার এ বিয়ের কথাটা যে শেষ পর্যন্ত সবাই জেনে গেছে এ কথাটাও বুঝতে পারল না আল বারক।
○ ○ ○
সেনানিবাসের চারপাশে আলী গোয়েন্দাদের গভীর নেটওয়ার্ক গড়ে তুলল। একদিন আলীর কাছে রিপোর্ট করল এক গোয়েন্দা, মেলার পর শহরে জুয়া এবং বেহায়াপনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
আল বারকের ঘর থেকে একটা মেয়েকে বেরুতে দেখা গেছে। গত তিন মাসে চারবার গভীর রাতে কালো বোরকা পরে মেয়েটা বের হয়েছে। কিছু দূর গেলে তার সাথে যোগ দেয় একজন পুরুষ।
প্রথম দু’বার তেমন গুরুত্ব না দেয়ায় এর বেশী অনুসরণ করা হয়নি। তৃতীয়বার আমাদের এক গোয়েন্দা মেয়েটার পিছু নেয়। শহরের এক সন্ত্রান্ত বাড়ীতে এসে ঢুকে ওরা। একটু পর মেয়েটাকে ওখানে রেখে পুরুষটা চলে যায়।
গত রাতেও তার পিছু নিয়েছিল গোয়েন্দা। এক প্রৌঢ়ের সাথে ওরা শহরের সম্মানিত বাড়িটায় পৌঁছল। লুকিয়ে রইল গোয়েন্দা। ভেতরে ওদের অনেকক্ষণ কাটল। একসময় বেরিয়ে এল একজন। তার পনের মিনিট পর আরও একজন। এভাবে এক এক করে এগার জন বেরিয়ে গেল। সব শেষে বেরোল মেয়েটা এবং একজন পুরুষ।
গোয়েন্দাটা অন্ধকারে ওদের পিছু নিল। আল বারকের বাড়ীর কাছে এসে পুরুষটা সোজা পশ্চিম দিকে চলে গেল, ভেতরে ঢুকে পড়ল মেয়েটা।
রিপোর্ট পেয়ে আলী যেমন চিন্তিত হল তেমনি খুশিও। খুশী হল এ জন্য যে, আলী গোয়েন্দাদের বলেছিল, ‘ব্যক্তি যত বড়ই হোক সন্দেহ হলেই রিপোর্ট করবে। এমনকি সুলতান সালাহুদ্দীনের কোন কাজে সন্দেহ হলেও রিপোর্ট করতে হবে,’ তার লোকেরা কথাটা তাহলে গুরুত্বের সাথেই নিয়েছে।
আলী আল বারকের স্ত্রীকে ভাল করেই জানত। রাতে অন্য পুরুষের সাথে বাইরে যাবার মত মহিলা তিনি ছিলেন না। তার কোন যুবতী মেয়েও নেই। এ নিয়ে আলী অনেক ভাবল।
বন্ধুর জন্য কিছু করা দরকার। আবার ভাবল, শহর ভাসমান পতিতায় ভরে গেছে। তবে কি তিনি কোন বাজে মেয়ের খপ্পরে পড়লেন!
গোয়েন্দা বিভাগের এক মেয়েকে পাঠালেন তার বাড়ীতে। মেয়েটা গিয়ে বলল, ‘আমি এক গরীব ও দুস্থ মহিলা। স্বামী মারা গেছে, একমাত্র ছেলেও বেকার। আমাকে একটু দয়া করুন। আমার জন্য কিছু সাহায্য ব্যবস্থা করে দিন।’
ওকে ভিক্ষুকের মত দেখাচ্ছিল না। দরিদ্র হলেও মনে হচ্ছিল যথেষ্ট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। আল বারক তখন ঘরে ছিলেন না। স্ত্রীর সাথে গল্প জুড়ে দিল সে। ভদ্রমহিলা তাকে বসতে দিলেন। বললেন, ‘সাহেব তো এখন বাড়ি নেই। তুমি অপেক্ষা করো।’
এটাই চাইছিল সে। একসময় ঘুরতে ঘুরতে চলে এল শোবার ঘরের পাশে। দেখল আছেফাকে। কথায় কথায় বলল, ‘আপনার এ মেয়ের কি বিয়ে হয়েছে?’
‘ও আমার মেয়ে নয়, আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী। তিনি মাস তিনেক আগে ওকে বিয়ে করে এনেছেন।’
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, ‘তিনি তো এলেন না। আমি না হয় পরে দেখা করবো। আপনি সাহেবকে একটু বলবেন, আমাকে যেন একটু দয়া করে,’ বেরিয়ে এল গোয়েন্দা মহিলাটি। রিপোর্ট করল এসে আলীকে।
এ সংবাদ শুনে আলী হতবাক হল। বুঝতে পারল, তার এ নতুন স্ত্রী-ই রাতের সে বাইরে যাওয়া যুবতী। কিন্তু রাতের আঁধারে সে কোথায় যায়? কেন যায়? কার কাছে যায়?
মহা চিন্তা এসে ঘিরে ধরল আলীকে।
আলী আল বারকের প্রথম স্ত্রীকে সংবাদ পাঠাল একটু দেখা করার জন্য। খবর পেয়ে শান্ত মনেই আলীর সাথে দেখা করতে এল ভদ্রমহিলা।
আল বারক তখন অফিসে ব্যস্ত। আলী মহিলাকে অত্যন্ত সম্মান করত। তাকে বসতে বলে বলল, ‘শুনেছি আল বারক দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন?’
‘আল্লাহর কাছে হাজার শোকর দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন, চতুর্থ বা পঞ্চম করেননি।’
‘নতুন বৌ দেখতে কেমন?’
‘ভীষণ সুন্দরী।’
‘সুন্দরীদের তো আবার পাখা থাকে, উড়াল দেয় না তো?’ কৌতুক করে বললেন আলী, ‘মানে, আপনি কোন সন্দেহ করছেন না তো!’
গভীর চিন্তায় ডুবে গেল মহিলা, কোন জবাব দিল না। আল বারকের স্ত্রীর এ মৌনতা থেকে যা বুঝার বুঝে নিল আলী। বলল, ‘যদি বলি ও প্রায় রাতেই বাড়ী থেকে বেরিয়ে যায়, কিছু মনে করবেন না তো?’
মৃদু হেসে মহিলা বলল, ‘আমিও ভাবছিলাম এ নিয়ে কার সাথে কথা বলব? আসলে আমার স্বামী এখন তার গোলাম। আমার সাথেও কথা বলেন না।’
‘আপনি স্বামীকে কিছু বলেন না? ওর ব্যাপারে স্বামীর সাথে কথা বলতে গেলে ভাববে হিংসা করছি।’
‘ওর যা মেজাজ, সাথে সাথেই আমাকে না আবার বাড়ী থেকে বের করে দেয়, এই ভয়ে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছি না।’
‘মেয়েটার স্বভাব চরিত্র কেমন?’
‘মেয়েটাকে আমার ভাল মনে হয় না। আমাদের ঘরে মদের গন্ধও ছিল না। এখন বোতলকে বোতল শূন্য হয়ে যায়।’
‘কি বললেন? মদ!’ চমকে উঠলেন গোয়েন্দা প্রধান আলী। ‘আল বারক মদ ধরেছেন?’
‘শুধু ধরেন নি, মদ খেয়ে মাতাল হয়ে থাকেন। মেয়েটা মাঝে মধ্যেই ওকে মদ খাইয়ে রাতে বেরিয়ে যায়, ফেরে অনেক রাতে। আমি নিজে দেখেছি। যে রাতে ও বেরিয়ে যায় সে রাতে আমার স্বামী বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকেন। সকালেও উঠেন অনেক দেরী করে। ভাবতে পারেন কি বদমাইশ মেয়ে, স্বামীকে ধোঁকা দিয়ে রাত কাটায় বাইরে?’
‘মেয়েটা বদমাইশ নয়, গোয়েন্দা। ধোকা দিচ্ছে দেশ এবং জাতিকে।’
‘গোয়েন্দা!’ চমকে উঠলেন মহিলা। ‘আমার ঘরে গোয়েন্দা!’
‘আপনি জানেন আমি এক শহীদ কন্যা। আল বারক একজন খাঁটি মুসলমান। ইসলামের জন্য তার জীবন পণ। আমি আমার সন্তানদের জেহাদের জন্য তৈরী করছি, আর আপনি বলছেন আমার সন্তানের পিতা এক গোয়েন্দার খপ্পরে পড়েছে? সন্তানের পিতাকে আমি কোরবানী দিতে পারি, কিন্তু ইসলাম এবং জাতিকে কোরবানী দিতে পারি না। আমি দু’জনকেই হত্যা করব।’
রাগে কাঁপতে লাগলেন তিনি।
অনেক কষ্টে তাকে শান্ত করলেন আলী। বললেন, ‘ও যে গোয়েন্দা তা নিশ্চিত হতে হবে। জানতে হবে আল বারক সত্যিই কি ওদের দলে ভিড়েছেন, না মদ খাইয়ে স্বার্থ উদ্ধার করা হয়। ওর অন্য সঙ্গীরা কোথায় আছে জানার জন্য গোয়েন্দাদের হত্যা না করে গ্রেফতার করতে হয়।’
এ অবস্থায় মহিলার কি কি করা উচিত সে ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দিয়ে তাকে বিদায় জানালেন আলী।
মহিলা ফিরে গেলেন। মনে হল, আলীর কথা মত ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করবেন। কিন্তু আল বারকের স্ত্রীর মনে হচ্ছিল, যে কোন সময় সে ধৈর্য হারিয়ে ফেলবে। সে তো হারেমের মেয়ে নয়, স্বামীর অনুগত এক স্ত্রী। দেশ এবং জাতির জন্য আত্ম্যোৎসর্গকারী বংশের সন্তান।
আল বারকের ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখার জন্য গোয়েন্দা লাগালেন আলী। গোয়েন্দারা সারারাত জেগে থেকে তাকে পাহারা দিতে লাগল।
পাহারা জোরদার করার দুদিন পর। রাতে ঘুমিয়ে আছেন আলী। গাঢ় ঘুম। কিন্তু ঘুম যত গভীরই হোক, আলীর নির্দেশ ছিল, জরুরী কোন খবর থাকলে সাথে সাথে তাকে সে খবর দিতে হবে। প্রয়োজনে ডেকে তুলতে হবে ঘুম থেকে।
সে রাতে চাকর তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল, ‘ওমর এসেছে, আতঙ্কিত চেহারা।’
কক্ষ থেকে তীরের মত বেরিয়ে এলেন আলী। দু’তিন লাফে আঙিনা পার হয়ে গেটের বাইরে এলেন। ওমর বলল, ‘চাকরকে পাঠিয়ে দশ বারজন সওয়ার ডেকে নিয়ে আসুন। আপনার ঘোড়া তৈরী করান। কি হয়েছে পরে বলছি।’
চৌদ্দজন সওয়ার এবং নিজের ঘোড়া আনার জন্য চাকরকে পাঠিয়ে দিলেন আলী।
‘এবার বল ওমর, কি সংবাদ নিয়ে এসেছ?’
‘আমি এবং আজর আপনার নির্দেশে আল বারকের বাড়ীর ওপর নজর রাখছিলাম। কিছুক্ষণ পূর্বে তার বাড়ী থেকে আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা এক মহিলা বেরিয়ে এল। সে পঞ্চাশ কি ষাটগজ দূরে গেছে, বাড়ী থেকে সর্বাঙ্গ ঢাকা আরেকজন মহিলা আগের মেয়েটার পিছু নিল।
‘দ্রুত পা ফেলে তার দিকে এগিয়ে গেল মহিলা। হঠাৎ প্রথম মহিলা টের পেয়ে গেল যে তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে। দাঁড়িয়ে পড়ল সে। আমরা দু’জন লুকিয়ে দেখতে লাগলাম।
‘দু’মহিলা মুখোমুখি হল। তাদের মধ্যে কি কথা হল বুঝা গেল না, আগের মেয়েটা হাত তালি দিল। আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক।
‘দ্বিতীয় মহিলাকে ধরতে চাইল সে। মহিলা তাকে আঘাত করল। অন্ধকারে অস্ত্রটা শনাক্ত করতে পারিনি। পুরুষটা তাকে পালটা আঘাত করল। প্রথম মেয়েটা বলল, ‘ওকে তুলে নাও।’
দ্বিতীয় মহিলা প্রথম মহিলাকে আক্রমণ করল। চিৎকার করে উঠল প্রথম মহিলাটি। দ্বিতীয় মহিলা আবার আঘাত করার আগেই পুরুষটা ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। ও প্রতিহত করল পুরুষের আক্রমণ। ততোক্ষণে দু’জন মহিলাই আহত।
আমি এসেছি আপনাকে সংবাদ দিতে, ওরা কোথায় যায় তা দেখার জন্য আজরকে রেখে এসেছি সেখানে।
আকস্মিক অভিযানের জন্য আলী কিছু যুদ্ধবাজ সৈন্য তৈরী রাখতেন। ওরা ছিল অভিজ্ঞ এবং সাহসী। ঘুমাত ঘোড়ার পাশে। মাথায় থাকত ঘোড়ার জিন এবং অস্ত্র। দিনে রাতে যখনি প্রয়োজন প্রস্তুতি নিত কয়েক মিনিটের মধ্যে।
আলী বিন সুফিয়ান কাপড় পরে তৈরী হতে না হতেই ওরা এসে পৌঁছল। আলীর নেতৃত্বে ঘোড়া ছুটাল ওরা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেল আল বারকের বাড়ির পাশে, ঘটনাস্থলে।
দু’জনের হাতে মশাল। মশালের আলোয় তারা দেখতে পেল লাশের মত পড়ে আছে দু’জন মানুষ। একজন দ্বিতীয় মহিলা, অন্যজন ওমরের সঙ্গী আজর।
অন্তিম সময় ঘনিয়ে এলেও দু’জনই এখনও জীবিত। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটি।
আজর বলল, ‘মহিলাকে আহত করে ওরা চলে গেলে আমি তার কাছে গেলাম। হঠাৎ পেছন থেকে আক্রান্ত হলাম। খঞ্জর দিয়ে তিনটে আঘাত করল আমাকে। কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই আক্রণকারী পলিয়ে গেল। আগের মেয়েটি আল বারকের বাড়ী যায়নি। প্রতিদিনকার মত ওদিকেই গেছে।’
আলী মহিলাকে দেখলেন। আল বারকের প্রথমা স্ত্রী।
তিনি দু’জন সওয়ারের মাধ্যমে ওদেরকে ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। বাকী সওয়ারদের নিয়ে তিনি ছুটলেন অভিজাত সেই বাড়ীর দিকে। বিশাল প্রাচীন বাড়ি। বাড়িটার চারপাশ ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে– আরও কয়েকটা বাড়ি। দেখতে ছোটখাট পাড়া মনে হলেও আসলে, পুরোটা মিলেই একটা অভিন্ন বাড়ি।
বাড়ীর পেছন থেকে ঘোড়ার হ্রেষা ধ্বনি ভেসে এল। আলী দুদিক থেকে সওয়ারদের পেছনে পাঠালেন। দু’জনকে দাঁড় করালেন প্রধান ফটকে। বললেন, ‘কেউ বেরোলেই বন্দী করবে। পালাতে চাইলে তীর মেরে শেষ করে দিবে।’
ঘুরে পেছনে যাচ্ছে সওয়াররা, অশ্বক্ষুরের শব্দ ভেসে এল। আলী এক সওয়ারকে বললেন, ‘দ্রুত কমান্ডারকে গিয়ে বল এ বাড়ীটা ঘেরাও করে ভেতরের সবাইকে গ্রেপ্তার করতে।’
সওয়ার ক্যাম্পের দিকে ছুটলো, আলী উচ্চস্বরে অন্য সৈন্যদের বললেন, ‘ঘোড়া ছুটাও। ওদের অনুসরণ কর। একজন আরেকজনের প্রতি নজর রেখো।’
তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। সেনাবাহিনীর বাছাই করা ঘোড়া তীব্রগতিতে ছুটে চলল। পলায়নকারীরাও খাঁটি অশ্বারোহী। ক্ষুরের শব্দে মনে হয় ঘোড়াগুলোও বেশ ছুটতে পারে।
আঁকাবাঁকা গলিপথের শহরে ঘোড়া ছুটাতে কিছু সমস্যা হয়েছিল। শহর ছাড়িয়ে এল ওরা, সামনে খোলা ময়দান।
অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধু শব্দ লক্ষ্য করে ছুটতে হচ্ছে। খোলা মাঠে পলায়নকারীদের জন্য লুকানো কষ্টকর হয়ে পড়ল। দিগন্তে ওদেরকে ছায়ার মত দেখা যাচ্ছে।
চারজন, চলছে পাশাপাশি। আলীর নির্দেশে দু’জন সওয়ার ছুটন্ত ঘোড়া থেকে তীর ছুড়ল। সম্ভবতঃ লাগেনি। ওদেরকেও বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ল ওরা। একজন থেকে অন্যজনের দূরত্ব বেড়ে যেতে লাগল।
আলীর দল তীব্র বেগে ছুটছিল। কমে এল দূরত্ব। সামনে টিলা। টিলায় খেজুরগাছ, ঝোপ ঝাড়।
ওদের ঘোড়া দুভাগ হয়ে গেল। একভাগ ঝোপের ডানে, একভাগ বাঁয়ে। টিলা পেরোল ওরা। এরপর অদৃশ্য হয়ে গেল দৃষ্টি থেকে।
ধাওয়াকারীরা টিলায় উঠল। অনেক দূরে দেখা চারটে ছায়া। ছুটছে বিচ্ছিন্ন ভাবে।
আলী উচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘চার ভাগ হয়ে ওদের ধাওয়া করো। ঘোড়া আরও জোরে ছুটাও। দূরত্ব কমিয়ে আন। ধনুতে তীর জুড়ে নাও।’
সওয়াররা চার ভাগে ভাগ হয়ে ছুটতে লাগল। সবাই ধনুতে তীর গেঁথে নিল। বেড়ে গেল ঘোড়ার গতি। অশ্বক্ষুরধ্বনির মাঝে তীর ছোঁড়ার শন শন শব্দ হল।
একজন চিৎকার দিয়ে বলল, ‘একটাকে শেষ করেছি।’
আলীর আরেক সঙ্গী তীর ছুঁড়ল। ছুটন্ত ঘোড়া থেকে নিক্ষিপ্ত তীর ওদের গাঁয়ে লাগল না। দূরত্ব আরও কমে এল। আহত হয়ে একটা ঘোড়া পা ভেঙে পড়ে গেল। আলীর এক সঙ্গী দ্রুত আরোহীর কাছে পৌঁছে ঘাড়ে বর্শা দিয়ে আঘাত করল। নুয়ে আঘাত ঠেকাল সে। আরেকজন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল তার গলা। তার সামনে বসা একটা মেয়ে। অজ্ঞান।
সৈনিকরা পলায়নকারীদের ধরে ফেলল। ডাকাডাকি করে এক জায়গায় সবাইকে জড় করা হল। ওদের আহত ঘোড়া দু’টো মরুভূমিতে ছেড়ে দেয়া হল। পলায়নকারী পাঁচ জন, এর মধ্যে একজন তরুণী।
ওদের একজন বলল, ‘আমাদের সাথে যা ইচ্ছে কর। কিন্তু মেয়েটা আহত। আশা করব ওকে বিরক্ত করবে না।’
ঘোড়ার জিনের সাথে বাঁধা মশাল জ্বালানো হল। মেয়েটা সত্যি আহত। অনন্যা সুন্দরী। পাকা খেজুরের মত টসটসে চেহারা। কাপড় রক্তে ভেজা। কাঁধে, ঘাড়ের কাছে খঞ্জরের আঘাতের চিহ্ন।
আলীর এক সহকারী আঘাত পরীক্ষা করল। গভীর ক্ষত। রক্ত ঝরে মরার মত ফ্যাঁকাসে হয়ে গেছে চেহারা। এখনও অজ্ঞান। চোখ দুটো বন্ধ।
আলী একটা কাপড় ছিড়ে ক্ষতস্থান বেঁধে দিলেন। ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নিয়ে চল।
তাড়াতাড়ির প্রশ্ন অবান্তর। ওরা এখন শহর থেকে অনেক দূরে। বন্দীদের মধ্যে ছিল এক বৃদ্ধ।
দলটা কায়রোর দিকে ফিরে চলল। সূর্যোদয়ের সময় পৌছুল কায়রো। সুলতান আগেই শুনেছিলেন রাতের ঘটনা।
আলী হাসপাতাল গেলেন।
আজর এবং আল বারকের স্ত্রীর জ্ঞান ফিরলেও অবস্থা আশঙ্কাজনক। ডাক্তার মেয়েটার দিকে নজর দিল।
সুলতানও হাসপাতালে এলেন। আলীকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘আল বারকের জন্য লোক পাঠিয়েছিলাম। আশ্চর্য কথা শোনাল সে। আল বারক নাকি বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। কক্ষে মদের সোরাহী এবং গ্লাস। সে কি মদও ধরেছে? স্ত্রী আহত হয়ে বাইরে পড়ে আছে এ অনুভূতিও তার নেই? আমি মহিলার সাথে কোন কথা বলিনি। ডাক্তার নিষেধ করেছেন।’
আল বারকের এক স্ত্রী নয় দু’ স্ত্রীই আহত। মরুভূমি থেকে যে মেয়েটাকে এনেছি সে তার দ্বিতীয় স্ত্রী। কথা বলার মত হোক, আমরা অনেক বড় শিকার হাতে পেয়েছি সুলতান।’
সূর্য উঠার অনেক পর জাগলেন আল বারক। চাকর বলল, ‘সুলতান তাকে স্মরণ করেছেন।’
হাসপাতালে ছুটে এলেন তিনি। তার দু’ স্ত্রী আহত। পাশে চার গোয়েন্দা। এদের সাথে বৃদ্ধকে দেখে আশ্চর্য হলেন তিনি। তাকে তিনি আছেফার স্বামী মনে করছিলেন।
এদের বিচারের ভার নিজের হাতে নিলেন সুলতান। কারণ এর সাথে প্রতিরক্ষা সচিব জড়িয়ে পড়েছেন।
সুস্থ হওয়ার পর ওদের জবানবন্দী নেয়া হল। আল বারকের প্রথম স্ত্রী বললেন, ‘যখন শুননলাম মেয়েটা গোয়েন্দা, ভীষণ রাগ হল। ইচ্ছে হল স্বামীকে এবং তাকে হত্যা করে ফেলি। কিন্তু আলী যখন বললেন। সঙ্গীদের খোঁজ নেয়ার জন্য গোয়েন্দাকে জীবিত ধরতে হয়, রাগ সামলে বাড়ী গেলাম। নজর রাখলাম মেয়েটার ওপর। এমনকি রাতের ঘুমও ছেড়ে দিলাম। সুযোগ বুঝে তার শয়ন কক্ষের দরজায় একটা ফুটো করলাম। রাতে তাকিয়ে থাকতাম ছিদ্র পথে।
রাতে দেখতাম মেয়েটা আল বারককে মদ খাওয়াচ্ছে। অর্ধ উলঙ্গ দেহ। তার সাথে অশ্লীল আচরণ করছে। এমনভাবে সুলতানের কথা বলছে যেন সুলতান তার পীর মুর্শিদ। গালাগালি করছে খ্ৰীষ্টানদের। বিশেষ করে খ্ৰীষ্টানদের বিরুদ্ধে সুলতানের সামরিক পরিকল্পনার কথাই বেশী বলল। আল বারক হড়হড় করে সুলতানের সব পরিকল্পনার কথা তাকে বলে দিলেন।
এরপর এল প্রতীক্ষিত রাত। আছেফা আল বারককে মদ পান করাতে লাগল। পশু হয়ে উঠল সে। দু’টো গ্রাস নিয়ে পাশের কক্ষে চলে গেল আছেফা। মদ ভরে ফিরে এল। একটা তাকে দিল, অন্যটা নিল নিজে। এরপর অশ্লীলতার সীমা ছাড়িয়ে গেল।
এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। কাপড় পরল আছেফা। ধীরে ধীরে ডাকল তাকে। জবাব না পেয়ে আস্তে করে ধাক্কা দিল। আল বারক চোখ খুললেন না। সম্ভবতঃ মেয়েটা তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছে।
মধ্যরাত। আপাদমস্তক কালো বোরকায় ঢেকে কক্ষের আলো নেভাল মেয়েটা, বেরিয়ে এল বেড়ালের মত নিঃশব্দে।
ক্রোধে ফেটে যাচ্ছিলাম আমি। বোরকা পরে একটা খঞ্জর সাথে নিয়ে কক্ষ থেকে বেরোতে যাব, দেখলাম এক চাকরানীর সাথে ফিস ফিস করে কথা বলছে ও। বুঝলাম ও চাকরানীটাকেও হাত করে নিয়েছে।
বেরিয়ে গেল আছেফা। চাকরানী ফিরে গেল তার ঘরে। সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম আমি। পায়ের শব্দ লক্ষ্য করে আমি দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। আমি দেখতে চাচ্ছিলাম ও কোথায় যাচ্ছে?
আছেফা সম্ভবতঃ আমার পায়ের শব্দ শুনেতে পেয়েছে। মোড় ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়ল ও। অন্ধকারে ভাল করে দেখা যাচ্ছিল না, মোড় ঘুরেই ওর মুখোমুখি পড়ে গেলাম।
হঠাৎ মুখোমুখি হওয়ায় সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না কি করব। বললাম, ‘কোথায় যাচ্ছ আছেফা?’
‘ওর পাহারায় লোক আছে জানতাম না। দেখিনি কাউকে। আছেফা হাত তালি দিল। হেসে বলল, আপনি আমার পেছনে এসেছেন, না কোথাও যাচ্ছেন?’
অকস্মাৎ কেউ পেছন থেকে আমাকে জাপটে ধরল। এক ঝটিকায় নিজেকে মুক্ত করে দ্রুত খঞ্জর টেনে নিলাম। আঘাত করলাম লোকটাকে। ও পড়ে গেল। লোকটা দ্রুত উঠে আমার পেটের পাশে আঘাত করতে চাইল, সরে গেলাম আমি।
সরতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম আছেফার গায়ে। ঘুরে আমি আছেফাকে আক্রমণ করলাম। খঞ্জর ঢুকে গেল তার কাঁধে, ঘাড়ের পাশে। চিৎকার দিল ও।
লোকটা ছুটে এসে আমাকে আঘাত করল। পড়তে পড়তে সামলে নিলাম। আবার তাকে আঘাত করলাম তাকে। কিন্তু এ আঘাতও ঠেকাল ও।
আছেফা এসে জাপটে ধরল আমাকে। লোকটা আমাকে আঘাত করল, পড়ে গেলাম আমি।
আজর বলল, ‘ওমর চলে যাওয়ার পর দেখলাম দু’জন মহিলাই মাটিতে পড়ে আছে। সাথের লোকটা প্রথম মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গেল। দ্বিতীয় মহিলা আহত হয়ে পড়ে আছে মাটিতে।
আমি আড়াল থেকে বেরিয়ে এলাম। মহিলার অবস্থা আশংকাজনক। তার কাছে বসলাম। হঠাৎ কেউ আমাকে পেছন থেকে খঞ্জর দিয়ে আঘাত করল। পরপর তিনবার। এরপর পালিয়ে গেল। তারপরের কথা আমার মনে নেই।’
সন্ধার দিকে আল বারকের প্রথম স্ত্রী এবং আজরের অবস্থা খারাপের দিকে মোড় নিল। ডাক্তারদের শত চেষ্টায়ও তাদের বাঁচানো গেল না।
আল বারকের স্ত্রী আলীকে বলেছিলেন, ‘আমি আমার স্বামীকে কোরবানী দিতে পারি। কিন্তু জাতি এবং দেশের ইজ্জতকে কোরবানী দিতে পারি না। তিনি জাতির জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিলেন। সুলতান সালাহুদ্দীনের নির্দেশে আল বারককে জেলে নেয়া হল। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আমি স্বেচ্ছায় ঐ অপরাধ করিনি। এরা আমায় ধোঁকা দিয়েছে।’
কিন্তু তিনি মদ আর সুন্দরীর মোহে সামরিক এবং বেসামরিক তথ্য খ্ৰীষ্টানদের দিয়েছেন তা প্রমাণিত হল। সুলতান হত্যাকারীকে ক্ষমা করতে পারতেন, কিন্তু মদ পান, ব্যাভিচার এবং শক্রর কাছে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য পাচারের অপরাধ ক্ষমা করতেন না।
সেদিনই আছেফার জবানবন্দী গ্রহণ করা হল। আহত হওয়ার চাইতে ও ভয় পেয়েছিল বেশী। সে ছিল গোয়েন্দা, সৈনিক নয়।
রাজকুমারী রূপে রাজকুমারদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করার ট্রেনিং তাকে দেয়া হয়েছিল। এ পরিণতির কথা কখনও সে ভাবেনি।
মুসলমানদের হাতে পড়ায় ও বেশী শঙ্কিত ছিল। ওর ভয় ছিল মুসলমানরা তাকে পশুর মত ব্যবহার করবে। ওর চিকিৎসা করবে না। তার কাছে যাওয়া প্রতিটি লোকের কাছেই সে এ শঙ্কা প্রকাশ করেছে।
ও কাঁদছিল ভয় পাওয়া শিশুর মত। আলী তাকে অনেক বোঝালেন। বললেন, ‘এক আহত মুসলমান মেয়ের সাথে যেমন ব্যবহার করা হয়, তোমার সাথেও তাই করা হবে।’ কিন্তু ও সুলতানের সাথে দেখা করতে চাইছিল।
সুলতানকে তার কথা বলা হল। তিনি এলেন। তার মাথায় হাত দিয়ে বলল ভয় করো না, তুমি আমার মেয়ের মত।
‘আমি শুনেছি সুলতান সালাহুদ্দীন তলোয়ারের নয়, হৃদয়ের সম্রাট।’ কাঁদতে কাঁদতে বলল আছেফা, ‘যে সম্রাটকে পরাজিত করার জন্য সকল খ্ৰীষ্টান রাজারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। এক অসহায় মেয়ের সাথে প্রতারণা করতে তাঁর কি ভাল লাগবে? আমায় বিষ দিতে বলুন। এ অবস্থায় আমি কোন কষ্ট সইতে পারব না।’
‘তুমি চাইলে আমি সবসময় তোমার কাছে থাকব। তোমাকে ধোঁকাও দেব না, কষ্টও দেব না। তুমি সুস্থ হও। ডাক্তার বলেছেন, তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে। তোমাকে কষ্ট দিতে চাইলে চিকিৎসা করাতাম না, এ অবস্থায়ই জেলে পাঠিয়ে দিতাম। লবণ ছড়িয়ে দিতাম তোমার ক্ষতস্থানে। তুমি চিৎকার দিয়ে অপরাধ স্বীকার করতে। বলে দিতে সঙ্গীদের নাম। কিন্তু আমরা মেয়েদের সাথে এমন ব্যবহার করি না। আল বারকের প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন। তুমি তার দ্বিতীয় স্ত্রী। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করবো আমি।’
‘সুস্থ হলে আমার সাথে কেমন ব্যবহার করবেন?’
‘তুমি যুবতী এবং সুন্দরী, এখানকার কোন পুরুষ তোমাকে সে চোখে দেখবে না। মনের সকল সন্দেহ মুছে ফেল। তোমার সাথে ব্যবহার হবে ইসলামী বিধান অনুযায়ী।’
অভিজাত ওই বাড়ীতে তল্লাশী নেয়া হল। কারো বসতবাড়ী নয় ওটা। বাড়ীটি ছিল খ্ৰীষ্টান গোয়েন্দাদের আড্ডাখানা। ভেতরেই ছিল আস্তাবল। ওখান থেকে পাঁচ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হল।
এ পাঁচজন এবং পলায়নকারী চারজন কোন জবানবন্দী দিতে অস্বীকার করল। ওদের পাঠানো হল নির্দিষ্ট কক্ষে, যেখানে পাথরও মুখ খুলতে বাধ্য হয়।
শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ স্বীকার করল, মেয়েটাকে দিয়ে সে-ই আল বারককে ফাঁসিয়েছে। প্রথম থেকে পুরো ঘটনা শোনাল সে। অন্যরাও বলতে বাধ্য হল। মানুষ যে বাড়ীকে সম্মানের চোখে দেখত, সেখানে ছিল অনেকগুলো মেয়ে। গুপ্তচরবৃত্তি, সরকারী কর্মকর্তাদের ফাঁসানো এবং যুবকদের চরিত্র হননের জন্য ওদের ব্যবহার করা হত।
ওরা বলল, ফৌজে নিজের লোক ভর্তি করে ওরাই সৈন্যদেরকে জুয়া, চুরি এবং ব্যভিচারে অভ্যস্ত করে তুলেছে। শহরে ছড়িয়ে দিয়েছে পাঁচশরও বেশী পতিতা। মিনি পতিতালয় খুলেছে। সুদানীদের উস্কানি দিয়েছে বিদ্রোহ করার জন্য।
ওরা প্রশাসন এবং ফৌজের বড় বড় ক’জন অফিসারের নাম বলল। এসব অফিসার সুলতানের বিরুদ্ধে কাজ করছে।
আছেফা ছিল খ্ৰীষ্টান। নাম ফিলমেংগো। বাড়ী গ্রীসে। তের বছর বয়স থেকে তাকে ট্রেনিং দেয়া শুরু হয়। তাকে শেখানো হয়েছে বিভিন্ন ভাষা, মিসরের সংস্কৃতি, আচার আচরণ।
মুসলমানদের এলাকায় কাজ করার জন্য এরকম হাজার হাজার মেয়ে তৈরী করা হয়েছে। অনেককে এদিকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সুস্থ হওয়ার পর অকপটে সবই বলেছে আছেফা, কিছুই গোপন করেনি।
আছেফা সম্পূর্ণ সুস্থ হল পনের দিন পর। তাকে বলা হল, ‘তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।’
সে বলল, ‘আমি সন্তুষ্ট চিত্তে এ শাস্তি গ্রহণ করছি। আমি ক্রশের মিশন সফল করেছি।’
ওকে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়া হল। অন্যদের এখনও প্রয়োজন ছিল। তাদের বর্ণনা অনুযায়ী অনেক লোক ধরা হল। এদের দু’একজন ছিল মুসলমান। সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হল।
আল বারককে দেয়া হল একশ বেত্ৰাঘাত।
তিনি সইতে পারেন নি। তার মৃত্যুর পর সরকার তার সন্তানদের দায়িত্ব গ্রহণ করল।
তার বাড়ীতে সরকারী খরচে চাকর বাকর এবং কেয়ারটেকার নিয়োগ করা হল। ওরা আল বারকের সন্তান নয়, এক শহীদ মায়ের সন্তান।