» » সালাহুদ্দীন আয়ুবীর কমান্ডো অভিযান

বর্ণাকার

তিন দিন পর। উটে চড়ে দেবতার আশ্রমে পৌঁছল ছ’জন সৈন্য। পরনে সামরিক পোশাক। হাতে তীর ও বর্শা। কোমরে ঝুলানো তরবারী। মেয়েটার বর্ণনা শুনে এভাবে এদের পাঠিয়েছেন আলী।

আশ্রম প্রাঙ্গণে ঢুকতেই একটা বর্শা এসে ওদের সামনে মাটিতে গেঁথে গেল। থেমে গেল ওরা। এগিয়ে এলেন পুরোহিত। সাথে তিনজন কাফ্রি। হাতে বর্শা।

কাফ্রিরা বলল, ‘তোমরা এখন তীরন্দাজদের আওতার মধ্যে। নড়াচড়া করলে সবাইকে হত্যা করা হবে।’

কাফ্রিদের সামনে ওরা অস্ত্র ফেলে দিল। নেমে এল উটের পিঠ থেকে। দলনেতা পুরোহিতের সামনে এসে বলল, ‘আমরা তোমাদের বন্ধু। বন্ধুত্ব নিয়ে এসেছি, ফিরে যাব বন্ধুত্ব নিয়ে। তোমরা কি তিনটে মেয়েকে বলি দেয়ার কাজ শেষ করেছ?’

‘আমরা কোন মেয়ে বলি দেইনি!’ পুরোহিতের কণ্ঠে ক্ষোভ। ‘তোমরা এ প্রশ্ন করছ কেন?’

‘আমরা মিসরের বিদ্রোহী সৈন্য, মুসলমানরা তোমাদের দেবতার অপমান করেছে, এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য যে ফৌজ তৈরী হয়েছে আমরা সে দলের। আমরা পরাজিত হয়েছি। তোমাদের লোকেরা বলেছে, মেয়ে বলি দেয়া হয়নি বলে দেবতা আমাদের অভিশাপ দিয়েছেন।

‘আমরা ছিলাম রজবের সঙ্গী। একটার পরিবর্তে তিনটা ফিরিঙ্গী মেয়ে অপহরণ করে তার হাতে তুলে দিলাম। অনেক দূর থেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে লোভ দেখিয়ে ওদের এনেছি। রজব ওদের এখানে নিয়ে এসেছে। গত পরশু ওর ফিরে যাবার কথা ছিল। ও ফিরে না যাওয়ায় মেয়েদেরকে বলি দেয়া শেষ হয়েছে কিনা আমরা তা দেখতে এসেছি।’

দলনেতার কথায় গলে গেলেন পুরোহিত। বললেন, ‘রজব আমাদের সাথে বজ্জাতি করেছে। মেয়েদের এখানে এনে তার নিয়ত খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সে ওদের এখান থেকে ভাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমরা তাকে পালাতে দেইনি, শাস্তি দিয়েছি। মেয়েরা আমাদের হাত থেকে পালিয়ে গেছে। তোমরা কি আরও দু’টো মেয়ের ব্যবস্থা করতে পার? দেবতা আমাদের উপর ভীষণ অসন্তুষ্ট।’

‘অবশ্যই করব। কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা নতুন দু’টো মেয়ে নিয়ে ফিরে আসব। দেবতাকে অসন্তুষ্ট করে বারবার আমরা পরাজিত হতে চাই না। রজব বেঈমানী করে থাকলে ওকে আমরা খুন করে ফেলব। আমাদেরকে রজবের কাছে নিয়ে চল। দেখি বেঈমানটা কি বলে?’

পুরোহিত সকলকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। মাটির তৈরী একটা ভাঁড়ের কাছে গিয়ে থামলেন তিনি। অন্য একটা পাত্র দিয়ে ঢাকা ভাঁড়, পুরোহিত ঢাকনা তুলে ভেতরে হাত ঢুকালেন। ধীরে ধীরে বের করে আনলেন হাত।

হাতে রজবের কাটা মাথা। অক্ষত চেহারা, আধখোলা চোখ, মুখ বন্ধ। চুল থেকে পানি ঝরছে। নষ্ট না হওয়ার জন্য মাথাটা ওষুধে ডুবানো হয়েছে।

পুরোহিত বললেন, ‘ওর দেহটা কুমীরকে খেতে দিয়েছি। সঙ্গী দুটোকে ঝিলে ছেড়ে দিয়েছি জীবন্ত। আমার কুমীরগুলো ক্ষুধার্ত।’

‘মাথাটা আমাদের দিতে হবে। আমরা এ মাথা আমাদের সকল সঙ্গীকে দেখাব। ওদের বলব, আঙ্গুকের দেবতার অপমান করলে এই পরিণতিই হবে। ভবিষ্যতে আর এমন কাজ করতে সাহস পাবে না কেউ।’

‘নিতে পার, তবে আগামীকাল সুর্যাস্তের আগেই ফেরত দিতে হবে। আঙ্গুকের দেবতা এ মস্তিষ্কের মালিক। ফিরিয়ে না দিলে তোমাদের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।’

দু’দিন পর সৈনিকরা ফিরে এসে সুলতানের পায়ের কাছে রেখে গেল রজবের কাটা মাথা। গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন সুলতান সালাহুদ্দীন।

গভীর রাত। আহমদ কামাল ঘুমিয়েছিল নিজের কামরায়। তার পাশের বিছনায় শুয়ে আছে রেশমা। এ কক্ষে তাদের দু’দিন কেটে গেছে। রেশমা বার বার বলেছে, ‘আমি মুসলমান হব। তুমি আমায় বিয়ে কর।’

‘আগে কর্তব্য পালন কর।’ আহমদ কামালের স্পষ্ট জবাব।

আহমদ কামাল ওর কাছ থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করেছেন এ দু’দিন। রেশমা তাই তার সাথে প্রতারণা করা হতে পারে বলে কয়েকবার সন্দেহ প্রকাশ করল।

‘তোমার এ সন্দেহ ভিত্তিহীন। যে নীতি-নৈতিকতার কারণে তোমার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকছি সে নীতিই ওয়াদা পালনে আমাকে বাধ্য করবে। তুমি তোমার কাজ শেষ কর, আমি আমার ওয়াদা পালন করব।’

আহমদ কামালের এসব কথায় ওর মনের ভয় ও সন্দেহ দূর হয়ে গেল। তার মাঝে ফিরে এল স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করার শক্তি। গভীর ভাবনায় ডুব দিল ও।

এক রাতে দু’জন বারান্দায় শুয়ে আছে। বাইরে সেন্ট্রি। মাঝ রাতে সেন্ট্রি হাঁটতে হাঁটতে একদিক থেকে আরেক দিকে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে।

সহসা পেছন থেকে তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল কেউ। সাথে সাথে অন্য দু’জন এসে কাপড় দিয়ে তার মুখ বেঁধে ফেলল। শক্ত করে বেঁধে ফেলল হাত-পা।

অন্ধকারে চারজন বাড়ীর ফটকে গিয়ে দাঁড়াল। বন্ধ। একজন দেয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। অন্যজন তার কাঁধে পা রেখে দেয়াল টপকাল। ভেতর থেকে খুলে দিল ফটক। ভেতরে ঢুকল তিনজন।

একজন মেয়েটার মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলল। তুলে নিল কাঁধে। অন্য তিনজন আহমদ কামালকে রশি দিয়ে খাটের সাথে শক্ত করে বাঁধল। প্রতিরোধ করার কোন সুযোগই তিনি পেলেন না।

বাইরে গিয়ে মেয়েটার গায়ে কম্বল চাপিয়ে দিল। একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল চারটি ঘোড়া। চারজন চারটি ঘোড়ায় চেপে বসল। একজন তার সাথে তুলে নিল মেয়েটাকে। কেউ যেন সন্দেহ না করতে না পারে সে জন্য নির্জন পথ ধরে ওরা শহর থেকে বেরিয়ে এল।

শহরের পাঁচ মাইল দূরে ফেরাও পাহাড়ে ফেরাউনের আমলের পতিত ভাঙা বাড়ী। বাড়ীটা বিশাল এক পাথুরে টিলায়। টিলা কেটে বানানো হয়েছে কামরা, একটা দুটো নয় অনেকগুলো।

এ কামরাগুলোর নীচের দিকে এগিয়ে গেছে সিঁড়ি। সে সিঁড়ি ভেঙে নীচে গেলে ওপরের মতই পাওয়া যাবে সারি সারি কামরা, পেচানো বারান্দা, এক কামরা থেকে অন্য কামরায় যাওয়ার অপ্রশস্ত পথ। অচেনা লোক কখনও ওখানে গেলে পথ চিনে ফিরে আসা কষ্টকর।

বাড়িটি দীর্ঘদিন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। ভয়ঙ্কর সব কথা প্রচলিত আছে বাড়িটি সম্পর্কে। ভয়ে কেউ ও পথ মাড়ায় না। কাছে গেলেই কেমন গা ছমছম করে। সবাই মনে করে ওখানে জিন ভূতের আড্ডা। বিষাক্ত সাপের ভয়ে ভেতরে ঢোকার সাহস করে না কেউ। এমনকি দিনের বেলায়ও কেউ বাড়িটার ধারে কাছে যায় না।

অপহরণকারীরা মেয়েটিকে নিয়ে ভূতুড়ে বাড়ীটার ভেতর প্রবেশ করল। ওরা এমন ভাবে হাঁটতে লাগল যেন ওটা ওদের নিজের বাড়ী। অবলীলায় পথ ভেঙে অতিক্রম করছে কামরার পর কামরা। সামনে মশালের আলো ধরে হাঁটছে একজন। পায়ের শব্দে চামচিকা, বাদুর, টিকটিকি ছুটে পালাচ্ছে। এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে মাকড়সার জাল।

পাথরের তৈরী বিশাল এক কামরায় প্রবেশ করল ওরা। মশালবাহী লোকটি দেয়ালের এক জায়গায় হাত রাখল। এক কোণার মেঝের খানিকটা জায়গার পাথর সরে গেল।

বেরিয়ে এল সুড়ঙ্গ সিঁড়ি। নীচের দিকে নেমে গেছে সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল ওরা। ওপরের কামরার মত বিশাল কামরা এখানেও। কামরায় ফরাশ বিছানো। ফরাশে চমৎকার চাদর। সাজানো গুছানো কক্ষ।

কামরায় পৌঁছে মেয়েটার মুখের কাপড় খুলে দেয়া হল।

মুখ খুলতেই রাগের সাথে চেঁচিয়ে উঠল ও, ‘কেন আমাকে ধরে এনেছ তোমরা? কি চাও আমার কাছে? বদমতলব থাকলে শুনে রাখ, মরে যাব, তবুও কাউকে কাছে আসতে দেব না।’

‘এভাবে তুলে না আনলে আগামীকাল ভোরে ওরা তোমাকে জল্লাদের হাতে তুলে দিত। আমার নাম ফয়জুল ফাতেমী। আমার কাছেই তোমাদের আসার কথা ছিল। অন্য দু’জন কোথায়? রজব কোথায়? তুমি একা ধরা পড়লে কিভাবে?’

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েটা বলল, ‘খোদার শোকর তিনি আমাকে এক ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। আমি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছতে পেরেছি।’

এরপর ফয়জুল ফাতেমীকে রজব এবং কাফ্রিদের কথা, ঝড়, আহমদ কামালের হাতে ধরা পড়া, সব ঘটনা খুলে বলল ও। শোনাল দু’টো মেয়ের মৃত্যুর করুণ কাহিনী। ফয়জুল তাকে সান্ত্বনা দিলেন।

অপহরণকারী চারজনকে ছ’টি করে স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে বললেন, ‘যে যার স্থানে চলে যাও। আমিও বেরিয়ে যাব একটু পর। ও এখানে তিন চার দিন থাকবে। প্রতিরাতেই আমি আসব। বাইরে ওর খোঁজাখুজি শেষ হলে নিয়ে যাব নিরাপদ আশ্রয়ে।’

লোক চারজন বেরিয়ে গেল। লুকিয়ে রইল বাড়ীর পাশে। ফয়জুল ফাতেমীর সাথে রইল একজন সেনা কমাণ্ডার।

ফয়জুলের খুশীর অন্ত নেই। তার অভিযান সফল হয়েছে।

মেয়েটার কাছ থেকে দুটো মেয়ের মৃত্যুর খবর শুনে যদিও তিনি দুঃখ পেয়েছেন, কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করলেন না।

রজবের পরিণতি তিনি জানেন না। বললেন, ‘রজবকে ওখান থেকে বের করে আনতে হবে। সে সালাহুদ্দীন এবং আলীকে হত্যা করার ব্যবস্থা করেছে। ঘাতকদলের সাথে কি কথা হয়েছে আমি জানি না। যতশীঘ্র সম্ভব এ দুটো লোককে হত্যা করতে হবে।’

তারপর রেশমার দিকে ফিরে বললেন, ‘এখন নতুন করে পরিকল্পনা করব, অন্যদের সাথে কথা বলে তোমাকে কি করতে হবে কাল বলব তোমায়। এখন বিশ্রাম কর, আমাকে জরুরী কাজে ফিরে যেতে হচ্ছে। তোমার দেখাশোনার জন্য লোক থাকবে এখানে, কোন অসুবিধা হবে না।’

‘সালাহুদ্দীন আয়ুবী আপনাকে কতটা বিশ্বাস করেন?’ প্রশ্ন করল রেশমা।

‘নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারেও আমার সাথে পরামর্শ করেন।’

‘শুনেছি উধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে সুলতান সালাহুদ্দীনের অনুগতদের সংখ্যা বেশী। সেনাবাহিনীও তার অনুগত।’

‘একথা ঠিক!’ কমাণ্ডার কথা বলল এবার। ‘তার গোয়েন্দা সংস্থা অত্যন্ত সতর্ক। কেউ কোথাও মাথা তুললে সাথে সাথে ওরা টের পেয়ে যায়। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যারা সালাহুদ্দীন আয়ুবীর বিরুদ্ধে কাজ করছে সম্মানিত ফয়জুল ফাতেমী আপনাকে বলবেন।’

ফয়জুল ফাতেমী ওদের নাম উল্লেখ করে মৃদু হাসলেন।

তোমাকে উচু পর্যায়ে কাজ করতে হবে। দু’জনের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করতে হবে। দু’জনকে খাওয়াতে হবে বিষ। এ দু’টো কাজই তোমার জন্য সহজ। তবে সমস্যা হল, তোমাকে কোন জলসা বা সভায় নেয়া যাবে না। পর্দানসীন মুসলমান মেয়েদের মত বোরকা না পরলে ধরা পড়ে যেতে পার। তা না হয় তোমাকে ফিলিস্তিন ফেরত পাঠিয়ে অন্য কোন অপরিচিত মেয়ে নিয়ে আসতে হবে। তবে একটু সমঝে চললে আশা করি কোন অসুবিধা হবে না।

আমার গ্রুপ অত্যন্ত তৎপর এবং চৌকস। ওরা সবাই প্রায় কমাণ্ডার পর্যায়ের। যে চারজন সাহসের সাথে তোমাকে তুলে এনেছে ওরাও আমার নিজের লোক। সালাহুদ্দীনের সেনাবাহিনীতে আমরা অশান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করছি। ফৌজের বিরুদ্ধে জনগণের মাঝে ঘৃণার বিষ ছড়িয়ে দেয়ার কাজ চলছে।’

‘সিরীয় এবং তুর্কী সৈন্যদেরকে মানুষ সম্মানের দৃষ্টিতে দেখছে। সুদানীদের পরাজিত করায় শহরের লোকজনও সেনাবাহিনীকে শ্রদ্ধা করে বলে শুনেছি।’

‘সাধারণ মানুষের এ অনুভূতিকে আহত করতে হবে। সেনা অফিসারদের অপদস্ত করতে হবে। তা না হলে খ্রিষ্টান বা সুদানীরা আমাদের কোন সাহায্য করতে পারবে না। এ ব্যাপারেও আমাদের কিছু পরিকল্পনা আছে, তবে এখনি সব বলা যাবে না।’

‘আমি এ কয়দিন ওদের হাতে থেকে বুঝেছি, সালাহুদ্দীনের বাহিনী বাইরের যে কোন আক্রমণ প্রতিহত করবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে একদিক থেকে খ্রিষ্টান বাহিনী অন্যদিক থেকে সুদানীরা আক্রমণ করলেও পরাজিত হবে। জনগণ সেনাবাহিনীর সাথে মিশে কায়রোকে এমন দূর্গে পরিণত করবে যা জয় করা সম্ভব হবে না।’

‘তুমি ঠিকই বলেছ। কায়রো জয়ের জন্য আমাদেরকে ময়দান তৈরী করতে হবে। সাধারণের মাঝে বিদ্বেষ ছড়াতে হবে। ধ্বংস করে দিতে হবে যুবকদের চরিত্র এবং নৈতিকতা।’

‘আমাকে বলা হয়েছে দু’বছর থেকেই এ কাজ চলছে।’

‘আমরা যথেষ্ট সফলতা লাভ করেছি। বেহায়াপনা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সালাহুদ্দীন দেশে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছে। খোতবা থেকে খলিফার নাম সরিয়ে ইসলামের সত্যিকার রূপ তুলে ধরছে। তা ছাড়া মেয়েদেরকে সামরিক ট্রেনিং দেয়া শুরু করেছে। তার এসব তৎপরতা আমাদের কিছুটা ক্ষতি করছে।’

‘এখন বাইরে যাবেন না।’ পাহারাদারদের একজন ভেতরে এসে বলল, ‘মনে হয় কিছু সমস্যা হয়েছে।’

ভয় পেয়ে গেলেন ফয়জুল ফাতেমী। মশাল নিভিয়ে লোকটার সাথে বেরিয়ে এলেন কি হয়েছে দেখার জন্য।

ফকফকা জ্যোৎস্না বাইরে। একটা উঁচু বেদীর ওপর লুকিয়ে তিনি চারদিকটা দেখলেন ভাল করে। বললেন, ‘তোমরা যথেষ্ট সতর্কতার সাথে কাজ করতে পারনি। মনে হয় সৈন্যরা ঘেরাও করে ফেলেছে বাড়ি। ঘোড়াও আছে, দেখো, আমি কোন দিক দিয়ে বেরোতে পারি।’

‘আমরা চারদিকই ভাল করে দেখেছি। ওরা আমাদের ঘেরাও করে ফেলেছে। আপনি ভেতরে যান। আলো জ্বালাবেন না। কক্ষ থেকে বের হবেন না। ওরা ভেতরে ঢুকতে চাইলে বাধা দেব আমরা, কেউ ওখান যেতে পারবে না।’

বাড়ীর ভেতর চলে গেলেন ফয়জুল ফাতেমী। ওপর থেকে নেমে এল পাহারাদার। ভেতরে না ঢুকে অন্ধকারে পা টিপে টিপে দেয়াল ঘেঁষে বেরিয়ে এল বাইরে।

পঞ্চাশজন পদাতিক ও জনাপঁচিশেক ঘোড়সওয়ার ঘিরে রেখেছে বাড়িটা। লোকটা একজন সৈন্যকে জিজ্ঞেস করে আলী বিন সুফিয়ানের কাছে গেল। আলীর সাথে দাঁড়িয়েছিল কমাণ্ডার আহমদ কামাল।

লোকটি বলল, ‘ভেতরে কোন সমস্যা নেই। আপনার সাথে দু’জন লোকই যথেষ্ট, আমার সাথে আসুন।’

আলী দু’টো মশাল জ্বালালেন। হাতে কোষমুক্ত তরবারী। আহমদ কামাল এবং চারজন সিপাইকে সাথে নিয়ে বাড়ীর ভেতর ঢুকে পড়লেন তিনি।

একজন পাহারাদার ভেতরের দিকে দৌড় দিল। আলীর সঙ্গী লোকটি বলল, ‘এ লোকটা তার নিজস্ব। ওদেরকে সাবধান করার জন্য গেছে।’

‘তাড়াতাড়ি চল।’

ছুটে যাওয়া পাহারাদারের পিছু নিয়ে ছুটলেন ওরাও। সঙ্গী লোকটি না থাকলে আকাবাঁকা পথে এতক্ষণে ওরা হারিয়ে যৈত।

একদিক থেকে ভেসে এল ছুটন্ত মানুষের পায়ের আওয়াজ। কেউ একজন অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘আমি আগে আগে যাচ্ছি, আপনারা দ্রুত আসুন।’

দলটি পাথুরে কক্ষে পৌঁছল। এখান থেকে সিঁড়ি নিচের দিকে নেমে গেছে। কেউ একজন বলছে, আমাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। এ দু’জন ওদের লোক।’

তলোয়ারে তলোয়ার টক্কর খেতে লাগল। সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ল দু’দল। ভেতর থেকে শব্দ এল, ‘ওকেও শেষ করে দাও। যেন সাক্ষী দিতে না পারে।’

আলী এবং আহমদ কামাল লাফিয়ে সিঁড়ি ভাঙলেন। কক্ষের মেঝেয় রক্ত বইছে। দুহাতে পেট চেপে ধরে বসে আছে রেশমা। তার মুখ ঢেকে রেখেছে তার এলোমেলো রেশমী চুল।

ফয়জুল ফাতেমীর সঙ্গী কমাণ্ডার এবং অন্য একজন ফয়জুল ফাতেমী আর এক পাহারাদারের সাথে লড়ছে। বিপক্ষের তলোয়ারগুলো দেখে দমে গেলেন ফয়জুল ফাতেমী। অস্ত্র ছেড়ে দিলেন।

রেশমার কাছে গেলেন আহমদ কামাল। পেট চিরে ফেলা হয়েছে তার। বিছানার চাদর চিরে কষে বেঁধে আলীকে বললেন, ‘অনুমতি দিলে ওকে বাইরে নিয়ে যাব।’

রেশমাকে কোলে তুলে নিলেন আহমদ কামাল। ব্যথা ভূলে গেল সে। মুচকি হেসে বলল, ‘আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি, ধরিয়ে দিয়েছি অপরাধীকে।’

অপহরণকারী দলের দু’জন সহ ফয়জুল ফাতেমীকে গ্রেফতার করা হল। বাকী দু’জন ছিল আলীর লোক।

সুলতান সালাহুদ্দীন বলেছিলেন, ‘খোঁড়া অজুহাত দিয়ে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়।’

আলী বিন সুফিয়ান রেশমার কাছ থেকে পারস্পরিক পরিচিতির নির্দিষ্ট সংকেত জেনে নিয়ে তিনজন চৌকস গোয়েন্দা পাঠালেন ফয়জুল ফাতেমীর কাছে। তিনজনের একজন কমাণ্ডার।

ওরা নির্দিষ্ট সংকেত ব্যবহার করে ফয়জুল ফাতেমীর সাথে দেখা করল। বলল, ‘একটা মেয়ে ধরা পড়েছে। ওরা তাকে একটা ঘরে বন্দী করে রেখেছে। একটু চেষ্টা করলেই মেয়েটাকে বের করে আনা যায়।’ ওরা আরও বলল, ‘মেয়েটাকে উদ্ধার করার জন্য রজব আমাদের পাঠিয়েছেন।’

গোয়েন্দাদের বিশ্বাস করলেন ফয়জুল ফাতেমী। তিনি ভাবলেন নির্যাতনের মুখে মেয়েটা তাদের পরিচয় প্রকাশ করে দিতে পারে। আত্মরক্ষার স্বার্থেই ওকে অপহরণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। কমাণ্ডারকে রাখলেন নিজের কাছে।

আলীর পাঠানো দু’জনের সাথে অন্য দু’জন সহ চারজনকে অপহরণের দায়িত্ব দেয়া হল। মেয়েটাকে তুলে ওরা ভাঙা বাড়িটায় চলে পাশে বসে থাক।

সুলতানের সামনে ওর কাছে বসতে আহমদ কামাল দ্বিধা করছিলেন। সুলতান বললেন, ‘তুমি ওর পাশে বস।’

সুলতান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন সুস্থতার জন্য।

তৃতীয় রাতে যুবতীর পাশে বসে আছেন আহমদ কামাল। আবেগ জড়িত কন্ঠে ও বলল, ‘আহমদ! তুমি আমায় বিয়ে করেছ? না, আমি আমার প্রতিশ্রুতি পুরণ করেছি, তুমিও তোমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছ। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, নইলে তোমাকে আমার কাছে পাঠাতেন না। আমি কি ভাগ্যবতী, আমার সব আশা ও স্বপ্ন আল্লাহ পূরণ করেছেন। তুমি আমার পাশে বসে থাকলে মরতে আমার মোটেই কষ্ট  হবে না।’

কথা জড়িয়ে গেল ওর। আহমদ কামালের হাত মুঠোয় চেপে ধরল ও। ধীরে ধীরে ঢিলে হয়ে গেল তার হাতের বাঁধন।

আহমদ কামাল ‘ইন্নালিল্লাহ’ বলে ঢেকে দিলেন ওর মৃতদেহ। পরদিন সুলতানের নির্দেশে তাকে মুসলমানদের কবরস্থানে সমাহিত করা হল।

দু’দিন পর ফয়জুল ফাতেমী এবং তার সঙ্গীরা অন্য সদস্যদের নাম বলে দিতে বাধ্য হল। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী গ্রেফতার করা হল ওদের।

ফয়জুল ফাতেমীর মৃত্যুদণ্ডের কাগজে দস্তখত দেয়ার সময় সুলতান সালাহুদ্দিন আয়ুবী কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।

(সমাপ্ত)