» » গাজী সালাহুদ্দীনের দুঃসাহসিক অভিযান

বর্ণাকার

মরুভূমিতে নেমে এসেছে অন্ধকার রাত। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু কমাণ্ডারের চোখে ঘুম নেই। কখন মেয়েটার কাছে পৌঁছবে এ ভাবনায় অস্থির সে।

জেগে আছে মেয়েটাও। ‘আজ কমাণ্ডারকে মাতাল করতে হবে’ মনে মনে বলল ও।

নীরব রাতে প্রহরীদের নাক ডাকার শব্দ ভেসে আসছে। মিসরী উঠল। পা টিপে টিপে পৌঁছল মেয়েটার কাছে। টিলা ওপাশে চলে গেল ওরা। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল অন্য টিলায়। গাছের ছায়ায় গাঢ় অন্ধকার। ওরা একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসল।

ছাউনিতে কমাণ্ডার নেই। প্রহরীরা সবাই ঘুমিয়ে আছে। কোন সেন্ট্রি নেই। এ অপূর্ব সুযোগকে কাজে লাগালো রবিন। নিঃশব্দে সঙ্গীদের জাগাল। হামাগুড়ি দিয়ে দূরে সরে গেল একে একে সবাই।

টিলার আড়াল হয়ে দৌড়াতে লাগল ওরা। পৌঁছল লাশের কাছে। তীর ধনু এবং বর্শা নিয়ে ফিরে এল। ঘুমন্ত প্রহরীদের পাশে এসে দাঁড়াল রবিন। বর্শা তুলল মারার জন্য, অন্য চারজনও তৈরী। ঘুমের মধ্যে একসঙ্গে পাঁচজনকে শেষ করতে পারছে এ আনন্দে উদ্ভাসিত ওদের চেহারা।

নিহতদের চিৎকার সঙ্গীদের কানে পৌছার আগেই বাকীদেরও নিরস্ত্র অবস্থায়ই হত্যা করতে হবে। রবিন পেছনের দিকে তাকাল একবার। দেখল একটু দূরে ঘুমিয়ে আছে উট চালক তিনজন। কমাণ্ডারকে নিয়ে মেয়েটা সরে গেছে দূরে।

রবিন একজন সৈনিকের বুক লক্ষ্য করে বর্শা নামিয়ে আনতে শুরু করেছে, হঠাৎ একটা তীর এসে তার বুকে বিঁধে গেল। অন্য একটা তীর লাগল তার সঙ্গীর গায়ে। ওরা কিছু বুঝে উঠার আগেই আরও দুটো তীর ওদের দুই সঙ্গীর বুকে এসে বিঁধল।

এগিয়ে এল তীর নিক্ষেপকারী সৈনিক দু’জন। কমাণ্ডারের সাথে এদেরই কথা কাটাকাটি হয়েছিল দিনের বেলা।

শুয়েছিল ওরাও। বন্দীরা ওদের পাশ দিয়ে যাবার সময় চোখ খুলে গেল একজনের। তাকিয়ে দেখল বন্দীরা পালিয়ে যাচ্ছে। ওরা একটু দূরে যেতেই পাশের জনকে জাগাল সে। ফিসফিস করে বলল, ‘ওরা পালাচ্ছে।’

‘কারা?’

‘বন্দীরা।’

‘কই? কোন দিকে গেছে?’ দ্রুত উঠে বসল সে। প্রথম সৈনিকটি হাত ইশারায় বন্দীদের গমনপথের দিকটা দেখাল ওকে। প্রথম সৈনিকটি উঠে দাঁড়াল।  বলল, ‘চল, ওদের পিছু নিতে হবে।’

সাবধানে বন্দীদের অনুসরণ করে এগিয়ে চলল দু’জন। দেখল বন্দীরা অস্ত্র কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে আসছে।

টিলার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল দু’জন। বন্দীরা ঘুমন্ত প্রহরীদেরকে হত্যা করতে উদ্যত হতেই এরা তীর ছুঁড়ল। ওরা পড়ে যেতেই কমাণ্ডারকে ডাকতে ডাকতে ছুটে আসল সৈনিক দু’জন।

তাদের ডাক চিৎকারে জেগে উঠল মেয়েগুলো। সাথে সাথে প্রহরীরাও। মেয়েগুলো লাশের দিকে তাকাল ভয়-বিস্ফারিত নয়নে। প্রত্যেকর বুকে একটা করে তীর বিঁধে আছে।

এদের পরিকল্পনা মেয়েরা জানত। হতাশা ফুটে উঠল ওদের চেহারায়। এদিক ওদিক তাকাল ওরা। দেখল মিসরী কমাণ্ডার ও একটা মেয়ে সেখানে নেই।

যখন বন্দীদের বুকে তীর বিঁধেছে ঠিক সে মুহূর্তে পাশের টিলায় একটা খঞ্জর কমাণ্ডারের পিঠে আমূল প্রবেশ করল। টিলার উপর পড়ে রইল তার লাশ।

মেয়েটাকে নিয়ে টিলার ওপর বসেছিল কমাণ্ডার। ওরা জানত না তার খানিক দূরে বালিয়ানের তাঁবু। ঘোড়াগুলো একটু দূরে। মুবিকে নিয়ে এদিকে এসেছিল বালিয়ান, রক্ষীদের চোখের আড়ালে। হাতে মদের বোতল, চাদর বিছিয়ে বসল মুবিকে নিয়ে।

রাতের নীরবতা ভেঙে ভেসে এল অস্ফুট শব্দ। চমকে উঠল ওরা। উৎকর্ণ হয়ে রইল। সতর্ক পা ফেলে দু’জনে এগিয়ে গেল শব্দ লক্ষ্য করে। দেখল, গাছের নীচে দু’টো ছায়ার অস্পষ্ট অবয়ব দেখা যাচ্ছে।

মুবি আরও এগিয়ে গিয়ে ওদের কথা শুনতে লাগল। মেয়েটার কথা শুনে সে স্পষ্ট বুঝতে পারল যে, এ তার সঙ্গিনীদের একজন।

কমাণ্ডারের তৎপরতা স্পষ্ট। বদমায়েশী করার জন্য অসহায় মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে।

পিছিয়ে এল সে। বালিয়ানকে বলল, ‘লোকটা মিসরী। আমার সঙ্গীনী একটা মেয়েকে ভোগ করার জন্য নিয়ে এসেছে। একে রক্ষা কর। মিসরী তোমার শত্রু, মেয়েটা বন্ধু। ও আমারচে বেশী সুন্দরী। ওকে এনে তোমার হারেমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি কর।’

বালিয়ান মদ পান করছিল, মুবির কথায় উঠে দাঁড়াল। খাপ থেকে খঞ্জর বের করে শিকারী বেড়ালের মত পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল। কমাণ্ডার কিছু বুঝে উঠার আগেই তার পিঠে আমূল বসিয়ে দিল খঞ্জর। টেনে নিয়ে আবার আঘাত করল।

আকস্মিক এ আক্রমণে ভয় পেয়ে মেয়েটা উঠে দাঁড়াল। ওকে দূর থেকে ডাকল মুবি। ও ছুটে গিয়ে মুবিকে জড়িয়ে ধরল।

‘অন্যরা কোথায়?’ মুবির প্রশ্ন।

সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে বলল মেয়েটা। বলল, ‘ওরা এখন পনরজন সৈনিকের পাহারায় রয়েছে।’

বালিয়ান দৌড়ে গিয়ে সঙ্গীদের ডেকে নিয়ে এল। সাথে অস্ত্র। কমাণ্ডারকে ডাকতে ডাকতে এদিকে এগুচ্ছিল এক প্রহরী। বালিয়ানের এক সঙ্গী তীর মেরে তাকে হত্যা করল। মেয়েটা ওদের নিয়ে এগিয়ে চলল ক্যাম্পের দিকে।

টিলার নীচে আলো জ্বলছে। বালিয়ান টিলার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখল মাটিতে গাঁথা লাঠির মাথায় দুটো মশাল। প্রহরীরা লাশগুলো ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েগুলো জড় হয়ে আছে পাশে। তা দেখে মুবি এবং মেয়েটা কাঁদকে লাগল।

বালিয়ান সঙ্গীদের বলল, ‘তীর ছোঁড়।’

একসঙ্গে দু’টো তীর নিক্ষিপ্ত হল। লুটিয়ে পড়ল দু’জন প্রহরী। ওরা তখনও বুঝে উঠতে পারছে না কি ঘটছে, আরও দু’টা তীরে পড়ে গেল আরও দু’জন সৈনিক। একজনের দেহে বিঁধল তিনটে তীর।

উট চালকরা অন্ধাকারে লুকিয়ে পড়ল। মুবি মেয়েদের কাছে ছুটে এল। হঠাৎ ওদের কানে ভেসে এল অশ্বক্ষুরের শব্দ।

‘এখানে আর দেরী করা যাবে না।’ বালিয়ান বলল, ‘ওদের একজন পালিয়ে যাচ্ছে কায়রোর দিকে। এখুনি আমাদের পালানো উচিত।’

প্রহরীদের ঘোড়াগুলো নিয়ে নিজের ক্যাম্পের দিকে চলল বালিয়ান। তার একটা ঘোড়া নেই। আহত মিসরী সিপাইটি এদের ঘোড়া নিয়েই পালিয়েছে। নিজের ঘোড়া পর্যন্ত যেতে পারেনি সে।

চৌদ্দটি ঘোড়ার পিঠে জিন চাপানো হল। মালামাল চাপাল দুটার পিঠে। রওনা হল কাফেলা।

মেয়েরা মুবিকে সব ঘটনা খুলে বলল। কিন্তু রবিনদের মৃত্যুর রহস্য বলতে পারল না। মুবি বলল, ‘সালাহুদ্দীনের ক্যাম্পে রবিনের সাক্ষাৎ যেমন অযাচিত ভাবে পেয়েছিলাম, তোমাদেরও পেলাম তেমনি আকস্মিকভাবে। এতে বলব না, পবিত্র যীশু আমাদের সফল করবেন। যে কাজেই আমরা হাত দিয়েছি, ব্যর্থ হয়েছি। রোম উপসাগরের পাড়ে আমাদের সৈন্যরা পরাজিত হয়েছে। মিসরে পরাজিত হয়েছে আমাদের বন্ধু সুদানী ফৌজ। রবিনের মত লোক নিহত হল। জানি না কি হবে আমাদের পরিণতি। মনে হয় যীশু আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট।’

‘আমি বেঁচে থাকতে তোমাদের গায়ে কেউ হাত তুলতে পারবে না।’ বালিয়ান বলল, ‘আমার সিংহদের কাজ কি দেখনি?’

রোম উপসাগরের তীরে এসে লাগল একটি নৌকা। নেমে এল তিনজন লোক, পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল মুসলিম সেনা ক্যাম্পের দিকে। কথা বলছে ইটালীর ভাষায়।

ক্যাম্পে পৌঁছল ওরা। ওদের কথা শুনে ইটালীর খৃষ্টান বন্দীদের ডেকে আনা হল। ওরা বলল, ‘এরা ইটালী থেকে এসেছে হারিয়ে যাওয়া বোনের খোঁজ। সেনাপতির সাথে দেখা করতে চাইছে।’

ক্যাম্পের অধিনায়ক বাহাউদ্দিন শাদ্দাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হল ওদের।

তিনজনের একজন আধ বয়েসী, দু’জন যুবক। দোভাষী বলল, ‘ওদের যুবতী বোনকে খৃষ্টান সৈন্যরা তুলে নিয়ে এসেছে। এরা শুনেছে ওদের বোনেরা এখন সালাহুদ্দীনের ক্যাম্পে আছে। বোনদের খোঁজে সাগর পাড়ি দিয়ে এদ্দুর এসেছে এরা।’

তাদের বলা হল মেয়েরা এসেছে তিনজন নয় সাতজন। সবাই গুপ্তচর। তিনজনই বলল, ‘আমরা গরীব। গুপ্তচরীর সাথে আমাদের বোনদের কোন সম্পর্ক নেই। সাতজনকে আমরা জানি না। আমাদের বোনদের খোঁজে আমরা এসেছি।’

শাদ্দাদ বললেন, ‘যে সাতজন আমাদের কাছে এসেছে, তার মধ্য থেকে পালিয়ে গেছে একজন। বাকী ছ’জনকে আজই কায়রো পাঠিয়ে দিয়েছি। তোমরা বরং ওখানে যাও। আমাদের সুলতান ভাল মানুষ।’

‘বিশ্বাস করুন, আমাদের বোনেরা গোয়েন্দা নয়। আপনারা যাদের পেয়েছেন তারা গোয়েন্দা হলে ওরা আমাদের বোন নয়। আমাদের হতভাগী বোনেরা তাহলে হয়ত সাগরে ডুবে মরেছে। না হয় খৃষ্টানদের কাছেই আছে।’

শাদ্দাদের মনটা ছিল নরম। তিনজন গ্রাম্য লোকের দুঃখে তিনিও ব্যথিত হলেন। খাতির যত্ন করে বিদায় করলেন ওদের। চলে গেল ওরা। কোথায় গেল কেউ জানল না।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা নিরাপদ এলাকায় পৌঁছল। এক পাহাড়ের কোলে আঠারজন কমাণ্ডো ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল।

তিনজনের মধ্যে বয়সী লোকটি সেগনামা মারইউস। এসেছে মেয়েদের মুক্ত করতে এবং সুলতান সালাহুদ্দীনকে হত্যা করতে। সাগর থেকে পাহাড়ের ভেতর দিকে চলে গেছে এক সংকীর্ণ চ্যানেল। পাড়ে নেমে ওখানে নৌকা লুকিয়ে রেখেছিল ওরা।

ওরা কায়রো যাবে, কিন্তু কোন বাহন নেই। ক্যাম্পের ঘোড়া চুরি করাও সহজ নয়। সুর্য ওঠার এখনও অনেক দেরী, ওরা হাঁটা ধরল। পথে কোন সওয়ারী পাওয়া যায় কিনা দেখতে হবে। বন্দীদের পথেই ধরতে হবে, তা না হলে কায়রো গিয়ে ওদের মুক্ত করা কঠিন হবে।

মৃত্যু হাতে নিয়েই ওরা অভিযানে এসেছে। সফল হলে পুরস্কার পাবে। তা দিয়ে জীবন ভর বসে বসে খেতে পারবে। তিরিশ বছর মেয়াদের জেল খাটছিল মেগনামা মারইউস। ডাকাতির আসামী। আরও একটা কেস ছিল খুনের। ওটার রায় বেরোলে তার ফাঁসি হয়ে যেত।

তার সাথের দু’জনের শাস্তি ছিল চব্বিশ বছরের। কারাগারের নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য ওরা মৃত্যু কামনা করত। এদের শাস্তি মওকুফ করে এ অভিযানে পাঠানো হয়েছে।

এক পাদ্রীর হাতে শপথ করেছে ওরা। পাদ্রী বলেছেন, ‘যত মুসলমান হত্যা করবে, ঈশ্বর তার দশগুণ পাপ মোচন করবেন। সালাহুদ্দীনকে হত্যা করলে ক্ষমা করা হবে সারা জীবনের পাপ। পরকালে পবিত্র যীশুর সাথে একসঙ্গে স্বর্গে থাকবে।’

জেল থেকে মুক্তি আর স্বর্গপ্রাপ্তি ও পুরস্কারের লোভে ওরা এসেছে এ দলে। ওদের ভেতর ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা।

জীবন বাজি রেখে এগিয়ে যাচ্ছিল ওরা। হয়ত সালাহুদ্দীনকে হত্যা করবে, নয়ত জীবন বিলিয়ে দেবে। বাকী আঠারজন পরাজিত বাহিনীর সেনা সদস্য। ওদের হৃদয়ে জ্বলছিল প্রতিশোদের আগুন। প্রজ্বলিত আবেগ নিয়ে ওরা এগিয়ে যাচ্ছিল কায়রোর দিকে।

দ্বিপ্রহর। সুলতান সালাহুদ্দীনের হেডকোয়ার্টারের সামনে এসে থামল এক ঘোড়সওয়ার। ঘোড়ার গা ঘামে জবজবে। ক্লান্তিতে আরোহীর মুখে কথা সরছে না। নেমে পড়ল আরোহী। কেঁপে উঠল ঘোড়ার শরীর। মাটিতে পড়ে মরে গেল ঘোড়াটা, টানা দেড় দিন একনাগাড়ে দৌড়িয়েছে। এর মধ্যে পেটে দানাপানি পড়েনি, বিশ্রামও জুটেনি কপালে।

সুলতান সালাহুদ্দীনের রক্ষীরা সওয়ারকে ঘিরে ধরল। পানি পান করাল। কথা বলার উপযুক্ত হতেই বলল, ‘কোন সালার অথবা কমাণ্ডারের সাথে দেখা করব।’

সালাহুদ্দীন আইয়ূবী নিজে বেরিয়ে এলেন। আগন্তুক দাঁড়িয়ে সালাম করে বলল, ‘আমি একটা দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছি।’

সুলতান তাকে ভেতরে নিয়ে বললেন, ‘এবার বল।’

‘বন্দী মেয়েরা পালিয়ে গেছে। আমাদেরও সবাই নিহত। আমি আহত, তবে কোনরকমে আমি বেঁচে গেছি। ওদের পুরুষ বন্দীদের আমরা হত্যা করেছি। আক্রমণকারী কে জানি না। আমরা ছিলাম মশালের আলোয়। আক্রমণকারী অন্ধকার থেকে তীর ছুড়েছে।’

সুলতান একজন কমাণ্ডার এবং গোয়েন্দা অফিসারকে ডেকে আনালেন। বললেন, ‘ও কি বলছে শোন।’

সিপাইটি ঘটনা শোনাল। বলল, ‘বন্দী মেয়ের সাথে কমাণ্ডারের সম্পর্কের কথা।’

সালাহুদ্দীন বললেন, ‘তার মানে মিসরেও তাদের কমাণ্ডো বাহিনী রয়েছে।’

‘হতে পারে।’ আলী বললেন, ‘আবার মরু ডাকাত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এমন সুন্দরী যুবতী তো ওদের জন্য মহা মূল্যবান।’

‘ওর কথা মন দিয়ে শোননি তুমি। বন্দীরা লাশের অস্ত্র তুলে এনে আক্রমণ করেছিল ঘুমন্ত প্রহরীদের। আমাদের যে দু’জন প্রহরী এটা দেখেছেন তারা তীর মেরে ওদের হত্যা করার পরপরই আক্রান্ত হয়েছে আমাদের প্রহরীরা। এতে মনে হয় কমাণ্ডো বাহিনী ওদের অনুসরণ করছিল।’

মহামান্য সুলতান, এ মুহূর্তে ওদের ধাওয়া করার জন্য বিশটি ঘোড়া এবং এই সৈনিককে প্রয়োজন। আক্রমণ কে করেছে পরে দেখা যাবে।’ বলল এক কমাণ্ডার।

‘আমার একজন সহকারীকে সাথে পাঠাব।’ আলী বললেন, ‘একে খাবার দাও। খাওয়ার পর ও বিশ্রাম করবে। প্রয়োজনে বিশের অধিক ঘোড়া নিতে পার।’

আগন্তুক বলল, ‘আমি যেখান থেকে ঘোড়া নিয়েছি ওখানে ঘোড়াটা বাঁধা ছিল, কিন্তু কোন লোক ছিল না। সম্ভবতঃ ওরাই আক্রমণকারী। ওখানে আমি আটটি ঘোড়া দেখেছি। নিশ্চয়ই ওরা আটজন ছিল।’

‘কমাণ্ডো বাহিনীতে বেশী লোক থাকে না। ইনশাআল্লা আমরা ওদের গ্রেফতার করতে পারব।’ কমাণ্ডার বলল।’

‘মনে রেখো ওরা কমাণ্ডো বাহিনী।’ সুলতান বললেন, ‘মেয়েগুলো গোয়েন্দা। ওদের একজন সৈন্য অথবা একটা মেয়েকে ধরতে পারলে মনে করবে দু’শ শত্রু সৈন্য পাকড়াও করেছ। এক নারী কারো তেমন ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু এক গুপ্তচর মেয়ে একটা দেশ এবং জাতি ধ্বংস করে দিতে পারে। ওরা অত্যন্ত বিপজ্জনক। একবার মিসরে ঢুকে গেলে গোটা সেবানাহিনী অকর্মণ্য হয়ে পড়বে।’

সুলতান আরও বললেন, ‘একজন পুরুষ বা মেয়ে গেয়েন্দাকে ধরার জন্য আমি একশত সিপাই কোরবানী দিতে প্রস্তুত। কমাণ্ডোরা ধরা না পড়লে কিছু যায় আসে না। কিন্তু যে কোন মূল্যেই হোক মেয়েগুলোকে গ্রেপ্তার করতে হবে। জীবিত ধরতে না পারলে তীর মেরে শেষ কর দিও।’

এক ঘণ্টা পর বিশজন দুঃসাহসী সৈনিক রওয়ানা হল। পথ দেখাচ্ছিল পালিয়ে আসা প্রহরী। কমাণ্ডার আলী বিন সুফিয়ানের সহকারী জাহেদীন। বিশজনের একজন ছিল ফখরুল মিসরী। আলী জানতো না ওরা মুবি এবং বালিয়ানকেই ধাওয়া করতে যাচ্ছে।

কাফেলার একুশতম ব্যক্তি কমাণ্ডার যাচ্ছেন মেয়েদের পাকড়াও করতে। ওদিকে খৃষ্টান কাফেলার একুশতম ব্যক্তিও কমাণ্ডার। তার উদ্দেশ্য মেয়েদেরকে মুক্ত করা। এরা যাচ্ছিল পায়ে হেঁটে। যাদের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে তারা, তাদের কারো জানা ছিল না, দু’দলের কে কোথায় আছে।

এখনও সূর্য ডুবেনি। অনেকদূর এগিয়ে এসেছে খৃষ্টান কাফেলা। সামনে চড়াই। উপরে উঠল ওরা। দূরে প্রশস্ত মাঠ, মাঠ পেরিয়ে মরুদ্যান। খেজুর গাছ ছাড়াও বিভিন্ন বৃক্ষে ঘেরা। অনেকগুলো উট দেখা যাচ্ছে। ওদের পিঠ থেকে মাল নামানো হচ্ছে। ঘোড়া রয়েছে বারচৌদ্দটি।

পরস্পরের দিকে তালাক ওরা। যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। এখন ওদের ঘোড়ার ভীষণ প্রয়োজন।

কমাণ্ডার কাফেলা থামাল। বলল, ‘আমরা ক্রুশে হাত রেখে সত্যিকার শপথ নিয়েছিলাম। দেখলে তো ক্রুশের মহিমা। ঈশ্বর আকাশ থেকে এ সওয়ার পাঠিয়েছেন। ঈশ্বরপুত্র তোমাদের সাহায্যের জন্য নেমে এসেছেন আকাশ থেকে।’

ক্লান্তির চিহ্ন মুছে গেল ওদের চেহারা থেকে। এখনও চিন্তা করছে না এগুলো হাত করবে কিভাবে?

শ’খানেক উট সেবানাহিনীর জন্য রেশন নিয়ে যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে শত্রুর ভয় নেই, এজন্য পাহারা তেমন জোরালো নয়। দশজন ঘোড়সওয়ার পাঠানো হয়েছে। উট চালকরা নিরস্ত্র।

ডাকাতরা ছোটখাট কাফেলা লুট করলেও সামরিক কনভয় আক্রমণ করে না কখনও। আগেও এভাবে সামরিক ঘাঁটির জন্য রসদ পাঠানো হয়েছে। নির্ভয়ে চলছে রসদবাহী কাফেলা। মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছে।

খৃষ্টান কমাণ্ডার অভিযাত্রীদের নিয়ে গেল পাহাড়ের আড়ালে। বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত ওরা। আবেগ এবং সাহসেরও অভাব নেই। গভীর রাতে দু’জন গিয়ে দেখে এল। ঘুমিয়ে আছে রসদবাহী কাফেলা। সশস্ত্র মাত্র দশজন।

ভের হওয়ার সামান্য আগে রওনা দিল ওরা। সাবধানে এগিয়ে গেল। ঘুমন্ত দশজন প্রহরীকে হত্যা করল। কোচম্যানরা বুঝতেই পারল না কি হচ্ছে। চিৎকার দিল কেউ, সে চিৎকার থেমে গেল তরবারীর আঘাতে।

ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য খৃষ্টানরাও চিৎকার করতে লাগর। জেগে উঠল সব কোচওয়ান। শুরু হল হত্যাযজ্ঞ। কমাণ্ডার গলা চড়িয়ে বলল, ‘এগুলো মুসলিম বাহিনীর রেশন। নিশ্চিহ্ন করে দাও। মেরে ফেল উটগুলি। উটচালকদের হত্যা কর।’

খৃষ্টানরা নির্বিচারে তরবারী চালাতে লাগল। বারোটা ঘোড়া দখল করল কমাণ্ডার। ভোরের আলো ফুটল। উট এবং মানুষের লাশে ভরে গেছে মাঠ। কেউ কেউ তড়পাচ্ছে এখনও। পালিয়ে গেছে কেউ। প্রতিরোধ করার মত কেউ নেই।

ঘোড়া নিয়ে সরে পড়ল খৃষ্টান অভিযাত্রীরা। ওদের বাহনের প্রয়োজন মিটেছে। এখন ওরা ছুটে চলছে পরবর্তী শিকারের উদ্দেশ্যে।

বালিয়ানের সমগ্র সত্ত্বায় জড়িয়ে আছে মুবি। মদ বিকল করে রেখেছে স্নায়ুগুলো। এখন তার কাছে সাত সাতটা রূপসী যুবতী। ভুলে গেছে বিপদের কথা।

মুবি বার বার বলছে, ‘কোথাও বিশ্রাম নেয়া ঠিক নয়। তাড়াতাড়ি সাগর তীরে পৌঁছার চেষ্টা কর। আমাদের পেছনে শত্রু ধেয়ে আসছে।’

কিন্তু কে শোনে কার কথা। নিঃশঙ্কচিত্ত মহারাজা সে। হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে মুবির কথা।

মেয়েদের মুক্ত করার পরের রাতে এক জাগয়ায় বিশ্রাম করছিল ওরা। বালিয়ান মুবিকে বলল, ‘তোমরা সাত যুবতী। আমরা সাতজন পুরুষ। দেখেছ, আমার বন্ধুরা কত বিশ্বাসী। আজ ওদের পুরষ্কার দিব। আজ আমার ছয় বন্ধুর সাথে থাকবে তোমার ছয় বান্ধবী। তুমি থাকবে আমার সাথে। আজ আমরা আনন্দ করব।’

‘অসম্ভব!’ ক্রোধকম্পিত কণ্ঠে বলল মুবি, ‘আমরা বাজারের মেয়ে নই। ওরা তোমার কেনা বাদী নয় যে, যা ইচ্ছে তা করবে। বাধ্য হয়ে আমি তোমাকে দেহ দিয়েছি। এরা কারও ভোগর সামগ্রী হবে না।’

‘আনন্দ তুমি একাই লুটবে তা তো হয় না সুন্দরী। তোমার বান্ধবীদেরও কিছু ভাগ দাও।’ বালিয়ানের কণ্ঠে তরল রসিকতা।

‘বালিয়ান, তুমি ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ।’ রাগে ফেটে পড়ছে মুবি।

‘তোমরা কতটুকু ভদ্র তা জানা আছে আমার। আমাদের জন্য তো মরা দেহের উপঢৌকন নিয়ে এসেছ। এরা কতজনের শয্যা-সঙ্গী হয়েছে তার হিসেব দিতে পারো? তোমরা কেউ মেরী নও, এ কথা কে না জানে।’

‘কর্তব্য পালন করতে গিয়ে আমরা দেহের উপঢৌকন পেশ করেছি, ভোগের সামগ্রী হওয়ার জন্য পুরুষদের সঙ্গ দেইনি। আমাদের জাতি, ধর্ম আমাদের ওপর এক গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেছে। সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমরা দেহ, যৌবন, রূপলাবণ্য এবং সতীত্বকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করি। আমরা দেহ দিয়েছি আমাদের ওপর অর্পিত কর্তব্য ও দায়িত্বের অংশ হিসেবে, ভোগের জন্য নয়। এখন তুমি যা বলছ তা ভোগ বিলাস ছাড়া কিছুই নয়। যেদিন আমরা ভোগ বিলাসে জড়িয়ে পড়ব সেদিন থেকে শুরু হবে খৃষ্টানদের পতন। ক্রুশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।’

‘মুবি, আমার বন্ধুরা জীবন পণ করে ক্রুশের জন্য লড়ছে। ওদের উজ্জীবিত করা তোমাদের দায়িত্ব।’

‘ট্রেনিং দেয়ার সময় আমাদের বলা হয়েছে, এক মুসলিম নেতাকে করায়ত্ত করার জন্য দশ জনের শয্যাসঙ্গী হওয়া শুধু বৈধ নয় বরং পুণ্যের কাজ। মুসলমান ধর্মীয় গুরুকে দেহ দান করাকে আমরা সেরা পূণ্য মনে করি।’

‘তাহলে তুমি খৃষ্টানদের স্বার্থে আমাকে ব্যবহার করছ?’

‘কেন, এখনও সন্দেহ আছে?’

‘কিন্তু আমি তো খৃষ্টান নই।’

‘তা নও। কিন্তু খৃষ্টানদের সাথে তোমাদের বন্ধুত্বকে কি অস্বীকার করবে? বল তো খৃষ্টানদের সাথে তোমাদের এ বন্ধুত্ব কেন?’

‘সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য, খৃষ্টানদের রক্ষার জন্য নয়। আমি মুসলমান কিন্তু প্রথমে একজন সুদানী।’

‘আর আমি সর্বপ্রথম একজন খৃষ্টান। এরপর যে দেশের জন্ম নিয়েছি সে দেশের সন্তান।’

বালিয়ানের হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে মুবি বলল, ‘শোন, ইসলাম কোন ধর্ম নয়, এজন্য তুমি দেশকে প্রাধান্য দিচ্ছ। আমার সাথে চল সাগরের ওপারে। দেখবে আমাদের মহান ধর্ম। তখন নিজের ধর্মকে ভুলে যাবে।’

‘যে ধর্ম নিজের মেয়েদের অন্যের শয্যাসঙ্গী হওয়াকে পূণ্যের কাজ মনে করে, সে ধর্মকে শত ধিক।’ আচম্বিত জেগে উঠল বালিয়ানের ঈমানী চেতনা। ‘তুমি নিজের সতীত্ব হারাওনি—আমার ইজ্জত লুণ্ঠন করেছ। আমি নই, তুমিই আমায় ভোগ করেছ।’

‘এক মুসলমানের ঈমান ক্রয় করার জন্য সতীত্ব এমন বড় কিছু নয়। আমি তোমার ইজ্জত লুণ্ঠন করিনি, তোমার ঈমান কিনে নিয়েছি। তোমাকে এ অবস্থায় পথে ছেড়ে যাব না। নিয়ে যাব ঝলমলে আলোর কাছে। তোমার ভবিষ্যত এবং পরকাল হিরার মত উজ্জল হয়ে উঠবে।’

‘আমি তোমার সে আলোর কাছে যাব না।’

‘দেখো বালিয়ান, পুরুষ যোদ্ধা। ওরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না। তুমি আমার পণ্য গ্রহণ করেছ। আমি তোমার ঈমান সুরার পাত্রে ডুবিয়ে দিয়েছি। তোমার ঈমান ক্রয়ের জন্য আমি দিয়েছি চড়া মুল্য। তোমার বাঁদী হয়ে, রক্ষিতা হয়ে থেকেছি আমি। হয় আমার সতীত্ব ফিরিয়ে দাও, নয় তোমার ঈমান দাও। তুমি এ ক্রয়-বিক্রয় থেকে মুখ ফেরাতে পার না। প্রতারণা করতে পার না এক দুর্বল মেয়ের সাথে।’

‘যে আলো সাগরে ওপারে দেখাতে চাইছ তা এখানেই দেখিয়েছ। আমি দেখতে পাচ্ছি হীরকের মত জ্বলজ্বল করছে আমার ভবিষ্যত।’

মুবি কিছু বলতে যাচ্ছিল, গর্জে উঠল বালিয়ান, ‘খামোশ বদমাশ মেয়ে! সালাহুদ্দীন আইয়ূবী আমার দুশমন হতে পারে কিন্তু আমি রাসূলের দুশমন নই। যে নবীর জন্য আমি সমগ্র মিসর এবং সুদান বিলিয়ে দিতে পারি সে পবিত্র নামের স্বার্থে আমি সালাহুদ্দীনের কাছেও অস্ত্র সমর্পণ করতে প্রস্তুত।’

‘কতবার বলেছি, মদ কম খাও। অত্যাধিক মদপান, রাত জাগা এবং প্রতিদিন আমার সাথে এইসব করে তোমার মাথাটাই বিগড়ে গেছে। আমি যে তোমার স্ত্রী তাও ভুলে গেছ?’

‘আমি এক বেশ্যার স্বামী নই।’

মদের বোতল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল বালিয়ান। বন্ধুদের ডাকতেই ওরা ছুঁটে এল।

‘এ মেয়েরা এখন তোমাদের বন্দী। ওদের কায়রো ফিরিয়ে নিয়ে চল।’

‘কায়রো?’ একজনের হতচকিত প্রশ্ন, ‘আপনি কায়রো ফিরে যেতে চাইছেন?’

‘হ্যাঁ, কায়রো। হতবাক হচ্ছ কেন? এ মরুভূমিতে আর কতকাল ঘুরে মরব? যাও, জলদি ঘোড়া তৈরী কর, আর প্রতিটি ঘোড়ার পিঠে একটি করে মেয়ে বেঁধে দাও।’

বালিয়ানের তাঁবু থেকে আধমাইল দূরে থাকতেই থেমে গেল খৃষ্টান কমাণ্ডার। বিশ্রাম নেয়ার চমৎকার এলাকা। আশপাশে আরও কেউ তাবুঁ ফেলেছে কিনা খোঁজ নেয়ার জন্য রাতে তিনজন উষ্ট্রারোহীকে পাঠিয়ে দিল। ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ হয়, উট চলে নিঃশব্দে। তিন আরোহী ছড়িয়ে গেল তিনদিকে।

বালিয়ান যখন মুবির সাথে কথা বলছিল, একটা উট এসে দাঁড়িয়েছিল পেছনে। বালিয়াড়ির আড়ালে। দূর থেকে মশালের আলো দেখে এগিয়ে এসেছিল আরোহী। উটের পিঠে বসে সে মেয়েদের দেখতে পাচ্ছিল। গল্প করছে বালিয়ানের সাথে। দূরে ক’টা ঘোড়া বাঁধা।

উষ্ট্রারোহী ফিরে এল সঙ্গীদের কাছে। বলল, ‘শিকার তোমাদের পাশেই রয়েছে।’

সময় নষ্ট করল না কমাণ্ডার। হেঁটে রওনা হল। ওরা যখন পৌঁছল বালিয়ান তখন মেয়েদের বেঁধে ফেলার নির্দেশ দিচ্ছে।

সঙ্গীরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তার দিকে। নেতার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তর্ক জুড়ে দিল ওরা। সময় নষ্ট হতে লাগল। বালিয়ান অনেক কষ্টে বোঝাল যে, কায়রো গেলেই ওদের ভাল হবে।

বিস্ফারিত চোখে বালিয়ানের দিকে তাকাচ্ছিল মেয়েরা। ঘোড়ার পিঠে জিন চড়িয়ে ওরা মেয়েদের ধরে ফেলল।

আচমকা আক্রমণ হল। সুলতান সালাহুদ্দীনের ফৌজ ভেবে বালিয়ান চিৎকার দিয়ে বলল, ‘আমরা অস্ত্র সমর্পণ করব। মেয়েদের কায়রো নিয়ে যাব।’

একটা খঞ্জর এসে বুকে বিঁধল তার। নিঃস্তব্ধ হয়ে গেল বালিয়ান চিরদিনের জন্য। তার সঙ্গীরা এত লোকের মোকাবেলা করতে পারল না। নিহত হল সবাই। মুক্ত হল মেয়েরা। কমাণ্ডারকে চিনতে পেরে খুশীতে উদ্বেলিত হয়ে উঠল মুবি। রাতে কাফেলার চারপাশে দাঁড় করানো হল সশস্ত্র সেন্ট্রি।

সুলতান সালাহুদ্দীনের পাঠানো সওয়াররা এখান থেকে অনেক দূরে। রাতেও পথ চলছিল ওরা। সময় নষ্ট করতে চাইল না কেউ। সাথে পথ প্রদর্শক। পথ ভোলেনি সে।

কাফেলাকে সে আক্রমণের স্থানে নিয়ে গেল। মশাল জ্বেলে দেখাল শৃগাল শকুনের আঁধ খাওয়া রবিন এবং অন্যদের লাশ।

সওয়ারীদের দেখে শেয়াল পালিয়ে গেল। রক্ষীদের লাশ একত্রিত করে দ্রুত দাফন সারল কমাণ্ডার। এরপর ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন ধরে এগিয়ে চলল। রাতে ট্র্যাক পেতে কষ্ট হচ্ছিল। বাধ্য হয়ে ছাউনি ফেলা হল ওখানে।

খৃষ্টানদের সবাই জেগে আছে। ওরা আনন্দিত। ভোরেই বেলাভূমির পথ ধরার সিদ্ধান্ত নিল খৃষ্টান কমাণ্ডার। মেগনামা মারইউস বলল, ‘এখনও উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বেঁচে আছে সালাহুদ্দীন।’

কমাণ্ডার বলল, ‘মেয়েদের অনুসরণ করে কায়রো পৌঁছতে পারলে তা সম্ভব হত।’

‘কায়রো অনেক দূর। এজন্য এ পরিকল্পনা বাতিল।’

‘মৃত্যু ছাড়া এ পরিকল্পনা কেউ বাতিল করতে পারবে না।’ মেগনামার ঝাঁঝালো কণ্ঠ। ‘আমরা ক্রুশ ছুঁয়ে তাকে হত্যা করার জন্য শপথ করেছি। কেউ না গেলে আমি একা যাব। শুধু একটা মেয়ে এবং একজন সঙ্গী প্রয়োজন।’

‘কি করতে হবে সে সিদ্ধান্ত আমি দেব।’ কমাণ্ডার বলল, ‘তোমাদের কর্তব্য হল আমার নির্দেশ পালন করা।’

‘আমি কারও হুকুম পালন করতে বাধ্য নই। আমরা সবাই ঈশ্বরের আজ্ঞাবহ।’

কমাণ্ডার তাকে ধমকাতে লাগল। মেগনামা মারইউস তরবারী কোষমুক্ত করে কমাণ্ডারের মাথার ওপর তুলতেই অন্যরা মাঝখানে এসে দাঁড়াল।

‘আমি পাপী, অভিশপ্ত। পাপ এবং অবিচারের মাঝে ধুঁকে ধুঁকে মরছিলাম। তোমরা কি জান আমার ত্রিশ বছরের শাস্তি কেন হয়েছিল?

‘পাঁচ বছর পূর্বে আমর এক যুবতী বোনকে অপহরণ করা হয়েছিল। ষোড়শী। আমি দরীদ্র। পিতা নেই, মা অন্ধ। সন্তানরা অবুঝ শিশু। গতর খেটে জীবিকা নির্বাহ করি। গির্জায় যীশুর মূর্তির কাছে অনেক দিন প্রশ্ন করেছিলাম, কেন আমি গরীব? কোন পাপ তো আমি করেনি! আন্তরিকতার সাথে পরিশ্রম করেও কেন ভূখা থাকি। আমার মা কেন অন্ধ? যীশু কোন জবাব দেননি। বোন অপহরণ হবার পর গির্জায় গিয়েছিলাম। মা মেরিকে প্রশ্ন করেছি, আমার বোনের ওপর তুমি এত ক্রুদ্ধ কেন! ও তো নিষ্পাপ। ওকে রূপ দিয়ে ঈশ্বরই জুলুম করেছেন। যীশুর মত মেরিও কোন জবাব দেয়নি।

‘একদিন এক আমীরের চাকর বলল, ‘তোমার বোন এক আমীরের ঘরে। আমীরটা বদমাশ। সুন্দরী মেয়েদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। কয়েকদিন আমোদ স্ফুর্তি করে। স্বাদ ফুরিয়ে গেলে গায়েব করে দেয়।

‘তার উঠাবসা রাজা বাদশার সাথে। মানুষ তাকে সমীহ করে, আইন তার হাতে বন্দী। আমি তার কাছে আমার বোনকে ফেরৎ চাইলাম। গলা ধাক্কা দিয়ে মহল থেকে বের করে দিল আমাকে। আবার গির্জায় গেলাম। যীশু এবং মেরীর মূর্তির সামনে কাঁদলাম। ঈশ্বরকে ডাকলাম। কেউ সাড়া দিল না। আমি গির্জায় একা ছিলাম। পাদ্রী এল, বের করে দিল ঘাড় ধাক্কা দিয়ে। বলল, ‘এখান থেকে মূর্তি চুরি হয়েছে। ভাগ, নইলে পুলিশের হাতে তুলে দেব।’

আমি আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘এটা কি ঈশ্বরের ঘর নয়?’