তিন রাত পর। গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে সমগ্র কায়রো। একদিন পূর্বে ফৌজকে শহরের বাইরে যেতে দেখা গেছে। বলা হয়েছে সামরিক মহড়ায় অংশ নিতে যাচ্ছে ওরা। নীলনদের পাড়ে বালিয়াড়ি আর টিলা।
টিলা এবং নদীর মাঝখানে ছাউনি ফেলল ওরা। পদাতিক এবং অশ্বারোহী সৈন্য। মাঝরাতে অশ্বক্ষুরের শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠল কায়রোবাসী। শহরের বাইরে যেন রোজ কিয়ামত। ওরা মনে করল সামরিক মহড়া।
শব্দগুলো এগিয়ে আসছে। বাড়ীর ছাদে উঠে এল উৎসুক জনতা। দিগন্তের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। দেখা গেল নীলের শান্ত বুক থেকে উঠে আসছে অগ্নিগোলক। ছাউনি লক্ষ্য করে রাতের বুক চিরে এগিয়ে আসছে তীব্র গতিতে।
শহরময় ছড়িয়ে পড়ল অশ্বক্ষুর ধ্বনি। মানুষ জানল না সুদানী ফৌজের বেশীরভাগ জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধ হচ্ছে। সুলতান সালাহুদ্দীনের কৌশল আবারো অভ্রান্ত প্রমাণিত হল। নীল আর পাহাড়ের মাঝের বালিয়াড়িতে তাঁবু ফেলল তার ক্ষুদ্র বাহিনী।
সুদানী ফৌজ দু’ভাগে ভাগ হল। মধ্যরাতে একভাগ মার্চ করল রোম উপসাগরের দিকে। সেখানে পরাজিত হয়েছে খৃষ্টান বাহিনী। অন্যভাগ নীলের পাড়ের ছাউনিতে আক্রমণ করল। সুর্যোদয়ের পূর্বেই রাজধানী দখল করবে ওরা। দ্রুততার সাথে সুদানী বাহিনী সুলতানের ফৌজের ছাউনি দখল করল।
আচম্বিত তাঁবুতে নিক্ষিপ্ত হতে লাগল আগুনের গোলা। নীল থেকেও ছুটে আসছিল অগ্নিগোলক। তাঁবুতে আগুন ধরে গেল। অবাক হয়ৈ ওরা দেখল, সালাহুদ্দীনের একজন সৈন্যও নেই তাঁবুতে।
রাতের প্রথম প্রহরেই সৈন্যদের সরিয়ে নিয়েছিলেন সালাহুদ্দীন পাহাড়ে এবং নদীতে। ওদর দিলেন বহনযোগ্য কামান মিনজানিক। তাঁবুগুলো ভরে দিলেন তেলে ভেজা খড় এবং শুকনো ঘাস দিয়ে। সুদানী সৈন্যরা তাঁবুর কাছে এল। পাহাড় এবং নদী থেকে নিক্ষীপ্ত তোপের আঘাতে আগুন ধরে গের শুকনো খড়ে। সুদানী ঘোড়সওয়াররা পদাতিকদের পিষে ফেলতে লাগল। চারদিকে আগুনের লেলিহান শীখা। বেরোতে গিয়ে জীবন্ত পুড়ে মরল অনেক সৈন্য। বেরিয়ে এলে পড়ত মুসলিম বাহিনীর তীরের আওতায়।
সুদানী ফৌজের অন্য দল এগিয়ে যাচ্ছিল রোম উপসাগরের দিকে। তাদের ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন সুলতান সালাহুদ্দীন। পাহাড়ের ফাঁকে লুকিয়েছিল কমাণ্ডো বাহিনী। সুদানী ফৌজের পেছনে থেকে আক্রমণ করত ওরা। সৈন্যরা কিছু বোঝার আগেই পালিয়ে যেত। প্রচুর ক্ষতি স্বীকার করে আবার এগিয়ে চলত সুদানী বাহিনী। আবার পেছন থেকে আচমকা আক্রমণ।
অন্ধকার রাত। এ অন্ধকারে কমাণ্ডোদের ধাওয়া করা অসম্ভব। ভোর পর্যন্ত তিনাবর আক্রান্ত হল ওরা। ভয় পেয়ে থেমে গেল ফৌজ। সামনে এগিয়ে যাবার সাহস হারিয়ে ফেলেছে ওরা।
দিনের বেলা কমাণ্ডাররা তাদের বোঝাল। সাহস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল সৈন্যদের। রাতে আবার আক্রমণ হল। অদৃশ্য শত্রুর তীরের আঘাতে মারা পড়ল অসংখ্য সৈন্য। হঠাৎ মাল বোঝাই উটগুলো দিকবিদিক ছুটতে লাগল। মাঝ পথে আগুন জ্বলছে। মাত্র দু’রাতের কমাণ্ডো আক্রমণে সুদানী বাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল। সৈন্যদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে দিল আলীর গোয়েন্দারা। আরব থেকে বিশাল বাহিনী আসার সংবাদে ভয় পেয়ে গেল ওরা। যে যেদিকে পারল পালিয়ে গেল।
নিঃশেষ হয়ে গেল সুদানী বাহিনী।
ওদিকে জঙ্গীর পাঠানো ফৌজ কায়রো এসে পৌঁছল। ইচ্ছে করলে সুলতান সালাহুদ্দীন সুদানীদের নির্বিচারে হত্যা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলেন। সুদানী কমাণ্ডাররা বুঝেছিল তারা অপরাধী, নিঃশেষ হয়ে গেছে ওদের সামরিক শক্তি। ওরা যে অপরাধ করেছে তাতে একমাত্র মৃত্যুদণ্ডই ওদের প্রাপ্য।
কিন্তু সুলতান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। সৈন্যদেরকে সরকারী জমি দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হল। এরপর ঘোষণা করা হল মিসরের সেনাবাহিনীতে ভর্তিচ্ছুদের স্বাগত জানানো হবে।
জঙ্গীর পাঠানো সৈন্য, মিসরের ফৌজ এবং সুদানী বাহিনীর নতুন লোকদের নিয়ে সুলতান সালাহুদ্দীন এক সুশৃখল এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুললনে।
আলী বিন সুফিয়ান তৈরী করলেন দুঃসাহসী কমাণ্ডো এবং গেরিলা বাহিনী।
খৃষ্টানরাও অপরূপা সুন্দরী তরুণী এবং গুপ্তচরদেরকে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দিল। দু’পক্ষেরই সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন প্রায়।
সুলতান এসব সুন্দরী তরুণীদের বিষাক্ত ছোবল কিভাবে মোকাবেলা করবেন আর খৃষ্টানরাই বা কিভাবে মোকাবেলা করবে সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর সুশৃঙ্খল বাহিনীর উভয় পক্ষ তা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইল।
কিন্তু এ পাঁয়তারা শেষ হতে বেশী দিন সময় লাগল না। অল্পদিনের মধ্যেই ভয়ঙ্কর সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ল ওরা।
রোমের এক উপশহর। জরুরী সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছেন খৃষ্টান নেতৃবৃন্দ। এর মধ্যে রয়েছেন সম্রাট অগাষ্টাস, সম্রাট রিমাণ্ড, এলমার্ক, সপ্তম লুইয়ের ভাই রবার্ট।
এদের মধ্যে সবচে’ ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছিল এমলার্ককে। খৃষ্টানদের সম্মিলিত নৌবাহিনীর প্রধান তিনি। সুলতান সালাহুদ্দীনের হাতে পর্যুদস্ত হয়ে মেজাজ বিগড়ে গেছে তারা। বিজয় দূরে থাক, উপকূলের কাছেও ঘেঁষতে পারেনি সে। যারাই মিসর উপকূলে পা রাখার দুঃসাহস দেখিয়েছে, তারা হয়েছে বন্দী, নয়ত নিহত।
সুলতান সালাহুদ্দীনের গোলন্দাজদের তোপের আঘাতে পুড়ে গেছে জাহাজের পাল এবং মাস্তুল। ভাগ্য ভাল যে সিপাইরা তার জাহাজের আগুন নিভাতে সক্ষম হয়েছিল।
পাল ছেঁড়া জাহাজ ঢেউয়ের দোলায় এগিয়ে গিয়ে পড়ল সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে। অনেক জাহাজ এবং নৌকা ঝড়ে ডুবে গেল। তার জাহাজের মাঝি মাল্লা সাহসিকতার সাথে ঝড়ের মোকাবিলা করল। একদিন পৌঁছল সমুদ্র উপকূলে। তীরে নেমেই মাঝি মাল্লাদের পুরস্কৃত করল এমলার্ক।
খৃষ্টান নেতারা তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সম্মেলনের উদ্দেশ্য পরাজয়ের কারণ নিয়ে পর্যালোচনা করা। কেউ কি তাদের সাথে প্রতারণা করেছে? কে সে, নাজি?
তার চিঠি পেয়েই নৌসেনা পাঠানো হয়েছিল। নাজির চিঠি তাদের কাছে নতুন নয়। আগের লেখাগুলোর সাথে এ লেখার হুবুহ মিল আছে।
ওরা আবার চিঠি খুলে বসল। কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে। কায়রো থেকে গোয়েন্দারা কোন সংবাদ দেয়নি। নাজি কোথায় তাও ওরা জানে না।
রাগে কাঁপছিল এমলার্ক। সালাহুদ্দীনকে হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে নিয়ে আসবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল সে। তার দর্প চুর্ণ হয়ে গেছে। এমলার্ক পরাজিত, ক্লান্ত।
কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলো না ওরা। সম্মেলন পরদিনের জন্য মুলতবী ঘোষণা করা হল।
রাতে মদের আসর চলছে। এক অপরিচিত মুখ ভেতরে এল। শুধু রিমাণ্ড চেনে তাকে। বিশ্বস্ত গোয়েন্দা। আক্রমণের দিন সন্ধ্যায় তাকে মিসরের উপকূলে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। তার চোখের সামনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে খৃষ্টানদের নৌবহর।
রিমাণ্ড গোয়েন্দার সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিল। ভিড় জমে উঠল তার চারপাশে। গোয়েন্দা বলল, ‘আহত হওয়ার ভান করে রবিন সালাহুদ্দীনের ছাউনিতে পৌঁছে গেছে। রবিনের সহযোগী পাঁচজন ছিল ব্যবসায়ীর পোশাকে। তাদের একজন ক্রিস্টোফার। সে তীর ছুঁড়েছিল সালাহুদ্দীনকে লক্ষ্য করে। লাগেনি।
‘ধরা পড়েছে পাঁচজনই। সাথে সাতটা মেয়ে। ওরা চমৎকার গল্প ফেঁদেছিল। সালাহুদ্দীন মেয়েগুলোকে রেখে ছেড়ে দিয়েছিল বাকী পাঁচজনকে। কিন্তু এদের গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান এসে সবাইকে গ্রেফতার করল। কথা আদায় করতে গিয়ে অত্যাচার করে মেরে ফেলল একজনকে। অপরাধ স্বীকার করল অন্যরা।
‘আমি নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়েছিলাম। সুলতান আমাকে আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব দিলেন। শুনেছি সুদানীদের বিদ্রোহ দমন করা হয়েছে। বড় বড় অফিসারদের গ্রেফতার করা হয়েছে। রবিনসহ এগারজনকে বন্দী করা হয়েছে। সুবিনা আর তালাশকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ছাউনিতে সালাহুদ্দীনও নেই, নেই আলী বিন সুফিয়ানও। অনেক টাকার বিনিময়ে একটা নৌকা জোগাড় করে আমি পালিয়ে এসেছি।
‘রবিন এবং অন্যদের উদ্ধার না করলে মারা পড়বে। ছেলেদের না হলেও মেয়েগুলোকে মুক্ত করা জরুরী। ওরা শুধু সুন্দরী ও যুবতীই নয়, মুসলমান আমীর ওমরাদের ফাঁসানোর জন্য ওদেরকে দীর্ঘদিন ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। এরকম সাতটা চৌকস মেয়ে তৈরী করতে অনেক সময় ও কাঠখড় পোড়াতে হবে আমাদের। মুসলমানরা তাদের কি অবস্থা করেছে কল্পনাও করতে পারবেন না।’
‘এ ধরনের সেক্রিফাইস তো আমাদের করতেই হবে।’ সম্রাট অগাষ্টাস বললেন, ‘মেয়েদের মেরে ফেলা হবে এ নিশ্চয়তা তোমাকে কে দিল?’
রিমাণ্ড বলল, ‘কিন্তু তাই বলে মুসলমানরা ওদের সাথে পশুর মত আচরণ করবে আর আমরা চুপ করে বসে থাকব, তা হয় না। আমি ওদের মুক্ত করার চেষ্টা করব।’
রবার্ট বলল, ‘ভাল ব্যবহার করে মুসলমানরা ওদেরকে আমাদের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করতে পারে। ওদের মুক্ত করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা অর্ধেক সম্পদ এর জন্য ব্যয় করতে প্রস্তুত।’
‘ওরা মেয়ে বলেই এত দামী তা নয়।’ গোয়েন্দাটি বলল, ‘ওরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, তাছাড়া এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজে এমন মেয়ে ক’টাই বা পাওয়া যায়? আপনাদের যুবতী মেয়েরা কি এমনিভাবে শত্রুর হাতে নিজেকে তুলে দিতে পারবে? পারবে কি শত্রুর ভোগের সামগ্রী হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতে? মৃদু হাসির যাদু দিয়ে পারবে বড় বড় দুশমনকে পদানত করতে?’
‘যদি শত্রুরা ওদের পরিচয় জানতে পারে তবে ওদের মৃত্যু অনিবার্য।’
‘হ্যাঁ, প্রচুর টাকার বিনিময়ে আমরা ওদের নিয়েছি। ট্রেনিং দিয়েছি, বিভিন্ন ভাষা শিখিয়েছি। এমন অভিজ্ঞ মেয়েগুলোকে হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না।’
সম্রাট অগাষ্টাস প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা কি মনে কর ওদের বের করে আনা যাবে?’
‘জ্বী। শুধু ক’জন সাহসী লোক প্রয়োজন। হয়ত দু’একদিনের মধ্যে ওরা ওদেরকে কায়রো নিয়ে যাবে। তখন উদ্ধার করতে ঝামেলা হবে। সময় নষ্ট না করলে ক্যাম্পেই ওদের পাব। আমাকে কয়েকজন সাহসী এবং ত্যাগী লোক দিন, আমি ওদেরকে উদ্ধার করে নিয়ে আসব।’ বলল গোয়েন্দা।
‘অবশ্যই মেয়েদেরকে ফিরিয়ে আনতে হবে।’ ক্রোধ কম্পিত কণ্ঠে বলল এমলার্ক। পরাজয়ের অপমান তার চোখে মুখে। কখনও টেবিলে ঘুষী মেরে, কখনও নিজের উরু চাপড়ে কথা বলছিল সে।
‘আমি মেয়েদের ফিরিয়ে আনবো, হত্যা করব সালাহুদ্দীনকে। রূপসী যুবতীদের দিয়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ছিন্নভিন্ন করে দেব।’
‘এমলার্ক!’ রিমাণ্ড বললেন, ‘আমি তোমার আবেগকে শ্রদ্ধা করি। ট্রেনিংপ্রাপ্ত মেয়েদরও সহজে হাতছাড়া করতে পারি না। তুমি তো জানোই আমাদের মেয়েরা সিরিয়ায় হারেমগুলো জমিয়ে রেখেছে। আমীর ওমরারা এখন ওদের হাতের পুতুল। নারী এবং সুরার গুণে মুসলিম বিশ্ব এখন তিনভাগে বিভক্ত। ঐক্য ভেঙ্গে গেছে ওদের। শুধু দুটো লোক আমাদের জন্য বিপজ্জনক। একজন নুরুদ্দীন জঙ্গী। অন্যজন সালাহুদ্দীন আইয়ূবী। এদের একজন বেঁচে থাকলেও ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা সহজ হবে না। সালাহুদ্দীন সুদানী বিদ্রোহ দমন করেছে, তার মানে লোকটা অত্যন্ত ধূর্ত। আমরা তার ওপর লক্ষ্য রাখছি।’
‘নিয়মিত যুদ্ধের পরিবর্তে গেরিলা যুদ্ধে তাকে হারাতে হবে। মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করতে হলে ট্রেনিংপ্রাপ্তা মেয়েদেরকে আমাদের প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজন।’
রবার্ট বলল, ‘হ্যাঁ, অভিজ্ঞতা আমাদের তাই বলে। মুসলমানরা নারীদেহের গন্ধ পেলে সব কিছু ভুলে যায়। এ যুদ্ধে ওদের হারাবার সহজ পথ হল ওদের হাতেই ওদেরকে মারতে হবে। বিনোদনের বিভিন্ন পথ উন্মুক্ত করে দাও, ওরা দ্বীন ঈমান ভুলে যাবে। শুধু যুবতী দেহের রূপ ও সৌন্দর্যের বিনিময়ে আরবের অনেক আমীর বাদশা এখন আমাদের হাতের পুতুল।’
মুসলমানদের দুর্বলতাগুলো নিয়ে এদের মধ্যে অনেকক্ষণ কথা হল। সিন্ধান্ত হল, মেয়েদের মুক্ত করা হবে। দুঃসাহসী ক’জন কমাণ্ডো পাঠানো হবে এ অভিযানে।
একটু পর পাঁচজন কমাণ্ডারকে ডেকে আনা হল। ওরা এলে বিস্তারিত পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেয়া হল ওদের।
একজন বলল, ‘আমরা আগে থেকেই দুঃসাহসী কমাণ্ডো ফোর্স তৈরী করে রেখেছি।’
‘কিন্তু এদের বিশ্বস্ত হতে হবে।’ অগাষ্টাস বলল, ‘ওরা কাজ করবে আমাদের দৃষ্টির আড়ালে। কিছু না করেও এসে বলবে অনেক কিছু করেছি।’
‘শুনে আশ্চর্য হবে, ওদের অনেককে আমরা কারাগার থেকে সংগ্রহ করেছি। ওরা ছিল চোর, ডাকাত এবং খুনী। কেউ কেউ যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী। স্বতস্ফূর্তভাবেই ওরা আমাদের বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। মেয়েদের উদ্ধার করার জন্য আমি এমন তিনজন লোক দিতে পারব, কুখ্যাত খুনী হিসাবে যাদের ফাঁসি হওয়ার কথা ছিল।’
সকাল পর্যন্ত বিশজনের এক বাহিনী তৈরি করা হল। তাদের একজন মেগনামা মারইউস। সে ছিল রোমের জেলে। ডাক্তাররূপী এক গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান করা হল তাকে।
এদের প্রথম কাজ মেয়েদের মুক্ত করা। রবিন এবং তার সঙ্গীদের মুক্ত করতে না পারলে ঝুঁকি নেয়ার দরকার নেই। দ্বিতীয় কাজ হল সালাহুদ্দীন আইয়ূবীকে হত্যা করা।
প্রয়োজনীয় অস্ত্রসহ সেদিনই তাদেরকে নৌকায় তুলে দেয়া হল।
সুদানীরা ব্যর্থ হয়েছে, দমন করা হয়েছে ওদের সেনা বিদ্রোহ। অনেক অফিসার ওদের নিহত হয়েছে। সুলতান সালাহুদ্দীনের অফিসের সামনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছিল অনেকে। পরাজিত ও বিধ্বস্ত চেহারা। অস্ত্র সমর্পণ করে ওরা আনুগত্য মেনে নিয়েছে সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর।
সালাহুদ্দীন নিজের কমাণ্ডারদের বিভিন্ন নির্দেশ দিচ্ছিলেন। সাথে গোয়েন্দা প্রধান। এ বিজয়ে তার ভূমিকা অসামান্য। বলতে গেলে গোয়েন্দা যুদ্ধেই ওদের পরাজিত করা হয়েছে।
হঠাৎ আলীর দিকে তাকালেন সুলতান। বললেন, ‘আলী! ব্যস্তার কারণে সাতটি মেয়ে এবং তার সঙ্গীদের নিয়ে কিছু ভাবতে পারিনি। ওরা এখনও সাগর পারের ছাউনিতে। যত শীঘ্র সম্ভব ওদের এখানে নিয়ে এস।’
‘এখনি লোক পাঠিয়ে ওদের আনানোর ব্যবস্থা করছি। সুলতান! সম্ভবতঃ সপ্তম মেয়েটার কথা আপনি ভুলে গেছেন। ও এসেছিল সুদানী কমাণ্ডার বালিয়ানের কাছে। বালিয়ান বন্দী হয়নি, নিহত ও আহতদের মধ্যেও নেই। মেয়েটা সম্ভবতঃ বালিয়ানের সাথে পালিয়ে গেছে।’
‘আমার মনে হয় তুমি ঠিকই বলেছ। শোন, এখানে এখন তুমি না হলেও চলবে। বালিয়ান হয়ত রোম উপসাগরের দিকেই পালিয়েছে। খৃষ্টান ছাড়া কে আর ওদের আশ্রয় দেবে? যেখানেই পাও, ওকে এনে জেলে পুরে দাও। আর গোয়েন্দাদের একটা দল সাগরের ওপারে পাঠানোর ব্যবস্থা কর।’
‘নিজের দেশেই গোয়েন্দাদের ছড়িয়ে দেয়া বেশী জরুরী।’ নুরুদ্দীন জঙ্গীর পাঠানো সেনা কমাণ্ডার বলল, ‘খৃষ্টানদের চাইতে মুসলমান আমীর ওমরারা আমাদের জন্য বেশী ক্ষতিকর। গোয়েন্দাদেরকে ওদের হারেমে ঢুকিয়ে দিতে পারলে অনেক ষড়যন্ত্রই প্রকাশ হয়ে পড়বে। সুলতান জঙ্গী সব সময় উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকেন, বাইরের হামলা ঠেকাবেন, না ঘরের শত্রু প্রতিরোধ করবেন।’
কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন সুলতান সালাহুদ্দীন। বললেন, ‘যাদের হাতে অস্ত্র আছে তারা যদি বিশ্বস্ত এবং দৃঢ় ঈমানের অধিকারী হয় তবে ভেতরের ষড়যন্ত্র এবং বাইরের আক্রমণ আমাদের কিছুই করতে পারবে না। একটা কথা মনে রেখো, মুসলিম বিশ্বের কোন সীমানা নেই। যখনি ইসলামকে সীমার সংকীর্ণতায় আবদ্ধ করা হয়েছে তখনি বিপর্যয় এসেছে। দৃষ্টিকে প্রসারিত করে তোমার দৃষ্টি নিয়ে যাও রোম উপসাগরের ওপারে, দেখবে বিশাল জলরাশিও তোমার পথ রুখতে পারবে না। ঘরের যে আগুনকে ভয় পাচ্ছ তা এক ফুঁতে নিভে যাবে, সেখানে জ্বলবে দ্বীন এবং ঈমানের আলো।’
‘আমরা বেঈমানদের মোকাবেলা করার কথা বলছি সুলতান! আমরা নিরাশ হইনি।’ বলল কমাণ্ডার।
‘বন্ধুরা, তোমরা দুটো শব্দ থেকে দূরে থেকো ‘নৈরাশ্য’ এবং ‘মানসিক বিলাস’। মানুষ প্রথমে নিরাশ হয়, এরপর মানসিক বিলাসিতার মধ্যে দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়ায়।’
আলী বিন সুফিয়ান বেরিয়ে গেলেন। একজন দ্রুতগামী ঘোড়সওয়ার পাঠিয়ে দিলেন সাগরপারের ছাউনিতে। তাকে বললনে, ‘রবিন এবং মেয়েগুলোকে ঘোড়া বা উটে করে সেনা প্রহরায় রাজধানীতে নিয়ে এসো।’
ওদের পাঠিয়ে দিয়ে দু’জন সেপাই সাথে নিয়ে তিনি নিজে বেরোলেন বলিয়ানের খোঁজে। হেড কোয়ার্টারের বাইরে দাঁড়ানো সুদানী কমাণ্ডাররা বলিয়ান সম্পর্কে কিছু তথ্য দিল। ওরা বলল, ‘বালিয়ানকে যুদ্ধের ময়দানে দেখা যায়নি। উপসাগরের ছাউনিতেও যায়নি সে।’
আলী পৌঁছলেন তার বাড়ীতে। দু’জন বৃদ্ধা চাকরানী ছাড়া কেউ নেই। ওরা বলল, ‘এখানে পাঁচজন যুবতী মেয়ে ছিল। কারো রূপ একটু ম্লান হলেই তাকে সরিয়ে দিত বালীয়ান। নিয়ে আসত তরতাজা উচ্ছল যুবতী। বিদ্রোহের আগে একটা ফিরিঙ্গী মেয়ে এসেছিল। ভীষণ সুন্দরী এবং সতর্ক। আমাদের মালিক ছিল তার হাতের পুতুল। বিদ্রোহের পর সুদানীরা যেদিন আত্মসমর্পন করল সে রাতে তিনি সাতজন ঘোড়সওয়ারসহ মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে যান। উনি চলে যাবার পর হারেমের অন্যান্য মেয়েরা হাতের কাছে যে যা পেয়েছে তাই নিয়ে ভেগেছে।’
আলী ফিরে আসার জন্য ঘুরলেন, এক দ্রুতগামী সওয়ার তার সামনে এসে লাফিয়ে পড়ল ঘোড়া থেকে। সওয়ারের নাম ফখরুল মিসরী।
হাঁফাতে হাঁফাতে সে বলল, ‘আমি আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছি। বালিয়ান এবং সে মেয়েটাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। ওরা কোন দিকে গেছে আমি জানি। ওদের পিছু নিয়েছিলাম আমি। কিন্তু ওদের সাথে সাতজন সশস্ত্র প্রহরী থাকায় আমি ফিরে এসেছি। আমি প্রতিশোধ নিতে চাই। ওদের দু’জনকে নিজের হাতে হত্যা করতে না পারলে আমি শান্তি পাব না। আমি একা, খোদার দিকে চেয়ে আমার সাথে কয়েকজন সিপাই দিন।’
‘ওরা কোথায়?
‘ওরা রোম উপসাগরের দিকে যাচ্ছে। তবে ওরা পথ চলছে খুব সাবধানে। সাধারণতঃ তারা বড় রাস্তা এড়িয়ে পার্শ্ববর্তী সরু রাস্তা মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
ফখরুল মিসরী দ্রুত নুয়ে আলীর পায়ে হাত রেখে অনুনয় করে বলল, ‘আমি ওদের পিছু নেব, হত্যা করব ওদের। দয়া করে আমার সাথে মাত্র চারজন সেপাই দিন।’
আলী তাকে শান্ত করলেন। ‘চারজন নয় বিশ জন সওয়ার দেব। ওরা এত শীঘ্র সাগর পারে পৌঁছতে পারবে না। আমরা ওদের পিছু নিচ্ছি, তুমিও থাকবে আমাদের সাথে।’
ওদের খোঁজ পেয়ে আলী এবার নিশ্চিন্ত মনে ওদের পিছু নিলেন।
অনেক পথ অতিক্রম করেছে বালিয়ান এবং মুবি। সাধারণ রাস্তা ছেড়ে এগিয়ে চলেছে ওরা। এসব পথঘাট বালিয়ানের চেনা থাকায় পথ চলতে ওদের কোন অসুবিধা হচ্ছে না।
সালাহুদ্দীন আইয়ূবী সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন তা জানত না বালিয়ান। ভয়ে পালাচ্ছে সে, মুবির মত সুন্দরী যুবতীকে হাতছাড়া করার ইচ্ছে নেই তার। ওর ধারণা ছিল, মিশর এবং সুদানেই রয়েছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সুন্দরীরা। কিন্তু ইটালীর এ যুবতীর রূপ তাকে অন্ধ করে দিয়েছে। তার জন্য উচ্চপদ, ধর্ম এবং দেশ ছাড়তেও কুণ্ঠিত হয়নি সে।
ও জানত না, মুবি তার কাছ থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। সে যে উদ্দেশ্যে দ্বিগুণ বয়েসী এ লোকের কাছে নিজরের হৃদয়, নিজের ইজ্জত বিকিয়ে দিয়েছে তা বরবাদ হয়ে গেছে।
মুবির মত যুবতীর ভালবাসা পেয়ে বালিয়ান ছিল তৃপ্ত। কিন্তু এখন মুবি তাকে ঘৃণা করছে। একজন নারীর পক্ষে একা পথ চলা সম্ভব নয় বলেই বাধ্য হয়ে তার সাথে যাচ্ছে সে। রবিনকে খুঁজে বের করাই এখন তার প্রধান কাজ। ওকে না পেলে সে ফিরে যাবে সাগরের ওপারে।
অনিচ্ছাসত্বেও তাকে বালিয়ানের ভোগের সামগ্রী হতে হচ্ছে। ও কয়েকবারই বলেছে, ‘বিশ্রাম কম করে তাড়াতাড়ি এগিয়ে চল।’ কিন্তু বালিয়ান একটু ভাল জায়গা পেলেই থেমে যেত।
একরাতে বালিয়ানকে মদ ঢেলে দিচ্ছে মুবি। ইচ্ছে করেই বেশী খাওয়ালো। নেশায় বুঁদ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল বালিয়ান। প্রহরীরাও শুয়ে আছে।
ধীরপায়ে এক প্রহরীর কাছে গেল ও। যুবক বয়স। সাহসী। বালিয়ানের বিশ্বস্ত। আলতো স্পর্শে তাকে জাগাল মুবি। নিয়ে গেল খানিক দূরে। বলল, ‘তুমি তো জান আমি কে? কেন এসেছি।’
যুবক কোন কথা না বলে মাথা নাড়ল।
‘তোমাদের জন্য সাহায্যের আশ্বাস নিয়ে এসেছিলাম। চেয়েছিলাম সালাহুদ্দীনকে সরিয়ে তোমাদেরকে ক্ষমতায় বসাব। কিন্তু তোমাদের এ কমাণ্ডার অপদার্থ। বিদ্রোহের পরিকল্পনা করবে তা নয়, প্রতিরাতে মাতাল হয়ে আামাকে ভোগ করা শুরু করল। আমি হলাম তা হারেমের বন্দিনী।’
সামান্য বিরতি নিয়ে মুবি আবার বলতে শুরু করল, ‘কোন চিন্তা ভাবনা না করেই ফৌজকে দু’ভাগে ভাগ করল ও। আক্রমণ করল বুদ্ধিহীনের মত। যার ফলে তোমাদের এক বিশাল বাহিনী শেষ হয়ে গেল। তোমাদের পরাজয়ের জন্য এ লোকটা সম্পূর্ণরূপে দায়ী। এখনও সে আমাকে ভোগ করে চলছে। আমাকে বলছে দেশে নিয়ে আমাকে বিয়ে করবে। কিন্তু ওকে আমি ঘৃণা করি।
‘বিয়ে করতে হলে কাকে করব সে সিদ্ধান্ত আমার। তোমাকে আমি ভালবাসি। তুমি যুবক, সাহসী এবং বুদ্ধিমান। প্রথম দেখার দিন থেকেই তোমাকে আমার ভাল লেগেছে। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। এ বুড়ো হাবড়াটার হাত থেকে আমাকে উদ্ধার কর। তোমাকে আমি সাগরের ওপারে নিয়ে যাব। সেনাবাহিনীর বড় পদ এবং ধন সম্পদ থাকবে তোমার পদতলে। কিন্তু একে শেষ না করলে তা সম্ভব নয়। ও ঘুমিয়ে আছে। ওকে হত্যা করে চল আমরা দু’জনে পালিয়ে যাই।’
সৈনিকটার গলা জড়িয়ে ধরল মুবি। মুবির মাতাল করা রূপ তাকে পাগল করে তুলল। কিছুক্ষণ জড়িয়ে রেখে তাকে ছেড়ে সরে বসল ও। যুবক এগোল তার দিকে। আচমকা একটা বশা এসে বিঁধল যুবকের পিঠে। ‘আঃ!’ শব্দ করে লুটিয়ে পড়ল সে। বর্শা টেনে তুলল একজন। বলল, ‘নেমকহারামের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।’
আতঙ্কিত চিৎকার বেরিয়ে এল মুবির কণ্ঠ থেকে। দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোমরা লোকটাকে মেরে ফেললে!’
পেছন থেকে কেউ তার বাহু খামছে ধরল। ঝাঁকুনি দিয়ে টেনে নিয়ে চলল বালিয়ানের কাছে।
‘আমরা এ ব্যক্তির পালিত বন্ধু। তার সাথেই আমাদের জীবন মরণ। আমাদের কাউকে তার বিরুদ্ধে ক্ষেপাতে পারবে না। নিমকহারাম তার শাস্তি পেয়েছে।’
‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ ভেবেছ একবারও?’
‘সাগরে ডুবতে যাচ্ছি। তোমার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। বালিয়ান যেখানে যাবে, আমরাও সেখানে যাব।’
বালিয়ান তখনো মাতাল হয়ে পড়ে আছে। ওরা দু’জন শুয়ে পড়ল আবার। পরদিন বালিয়ানকে সব ঘটনা খুলে বলা হল। মুবি বলল, ‘লোকটা আমাকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।’
রক্ষীদের ধন্যবাদ জানাল বালিয়ান। আবার পথ চলতে শুরু করল ওরা। মুবি আবারও দ্রুত চলার জন্য তাগাদা দিতে লাগল। বলল, ‘যতশ্রীঘ্র সম্ভব এগিয়ে যাওয়া উচিৎ।’
বালিয়ান চলল তার নিজস্ব গতিতে। মুবির রূপ যৌবন তাকে বিবেকশূন্য করে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু পরিস্থিতি সম্পর্কেও সে ছিল সজাগ। চারদিক দেখেশুনে সাবধানে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল তার। মুবি বুঝেছে, বালিয়ানের হাত থেকে মুক্ত হওয়া এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। প্রয়োজনে এরা বন্ধুকে হত্যা করতেও কুণ্ঠিত হয় না।
বিদ্রোহ পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য সুলতান সালাহুদ্দীন আলী বিন সুফিয়ানকে নিজের কাছে রাখা জরুরী মনে করলেন। এ খবর পেয়ে আলী বিন সুফিয়ান ওদের পিছু নেয়া বাদ দিয়ে ছুটে এলেন সালাহুদ্দীনের কাছে। এসেই তিনি এমন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে, ওদের পিছু নেয়ার আর সুযোগ করে উঠতে পারলেন না।
রবিন ও মেয়েদেরকে পনেরজন সেন্ট্রির পাহারায় কায়রো পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বন্দীরা চলছে উটের পিঠে প্রহরীরা ঘোড়সওয়ার। স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলেছে ওরা। মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছে। নির্ভয়ে চলছে কাফেলা। কোন দিক থেকে শত্রুর আক্রমণের ভয় নেই। কয়েদীরা নিরস্ত্র, সাথে ছ’টা মেয়ে। ওরা পালিয়ে যাবে সে আশঙ্কাও নেই। কিন্তু প্রহরীরা জানেনা এরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দা। মেয়েরাও অবলা নয়, ওদেরও সামরিক প্রশিক্ষণ রয়েছে। ওদের রূপ যৌবন, মাদকতাময় দেহ এবং যে কাউকে প্রেমের ফাঁদে জড়ানোর মত অস্ত্র রয়েছে ওদের কাছে। ওদের কমাণ্ডার মিসরী।
একটা মেয়ে তার দিকে বার বার তাকাচ্ছে। চোখে চোখ পড়লেই হাসছে মিষ্টি করে। হৃদয় গলানো হাসি।
কমাণ্ডারের মনে তোলপাড় শুরু হল। বিশ্রামের সময় খাবার দেয়া হল। মেয়েটা খাবার ছুল না। কমাণ্ডারকে জানানো হল এ কথা। কমাণ্ডার মেয়েটাকে ডেকে না খাওয়ার কারণ জানতে চাইল। মেয়েটা কিছুই বলল না, কেবল মায়াময় চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
কমাণ্ডার বললেন, ‘কি ব্যাপার, তুমি খাচ্ছ না কেন?’
মেয়েটা কাঁদকে কাঁদতে বলল, ‘আমার খালী মায়ের কথা মনে পড়ে।’
মায়ের কথা শুনে কমাণ্ডারের মনটা কেমন নরম হয়ে গেল। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে খেতে পাঠাল তাকে। যাবার সময় মেয়েটা বলল, ‘কেবল আপনাকে খুশি করার জন্যই আমি এখন খাব, নইলে খাওয়ার প্রতি আমার কোন রুচি নেই।’
‘কিন্তু না খেলে যে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে।’
তীর্যক কটাক্ষ হেনে মেয়েটা বলল, ‘আমি অসুস্থ হলে আপনার কি? আমি কি আপনার ইয়ে…’ বলেই লজ্জায় আরক্তিম হয়ে ওখান থেকে সরে পড়ল। মেয়েটার এই কটাক্ষ গেঁথে রইল ওর মনে।
নিশুতি রাত। সবাই ঘুমিয়ে আছে। আলগোছে উঠল কমাণ্ডার। মেয়েটার কাছে গিয়ে আলতো করে টোকা দিল তার গায়ে। চোখ মেলে ওকে দেখেই হাসল মেয়েটা। ওরা সরে এল নিরিবিলি জায়গায়।
মেয়েটা বলল, ‘আমি এক অসহায় তরুণী। ভাগ্য খারাপ বলে আজ এই করুণ পরিণতি। খৃষ্টান সৈন্যরা আমাকে অপহরণ করে নিয়ে তুলেছে জাহাজে। অন্য মেয়েদের সাথে জাহাজেই পরিচয় হয় আমার। তাদেরকেও অপহরণ করা হয়েছে। হঠাৎ জাহাজে আগুন লাগল। আমাদের তুলে দেয়া হল একটা নৌকায়। নৌকা তীরে ভিড়ল। গোয়েন্দা ভেবে আমাদেরকে বন্দী করল সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর সৈন্যরা।’
কমাণ্ডার জানত না সুলতানকেও এ কল্পকাহিনীই শুনিয়েছে ওরা।
কমাণ্ডারকে শুধু বলা হয়েছে, ‘এরা অত্যন্ত বিপজ্জনক বন্দী। কায়রোর গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ওদের হস্তান্তর করতে হবে।’
কমাণ্ডার তাকে তার অপারগাতর কথা জানিয়ে বলল, ‘এ ব্যাপারে আমি তোমাদের কোন সাহায্য করতে পারছি না।’
মেয়েটা মাত্র তুনীর মাত্র একটা তীর ছুঁড়েছে। এখনও অনেক তীর বাকী। বলল, ‘আমি তোমার কাছে কোন সাহায্য চাই না। তুমি সাহায্য করতে চাইলেও আমি বাঁধা দেব। জানি না তোমাকে কেন এত ভাল লাগে। আমার জন্য তুমি কোন বিপদে পড়বে, তা আমি হতে দেব না। আমার সমব্যাথী কেউ নেই। মেয়েরা আমার আপন কেউ নয়, পুরুষদের চিনি না। মনে হল তোমার মনটা বড় ভাল এজন্য তোমার কাছে আমার দুঃখের কথা বলে মনটা হালকা করছি।’ যুবতি কমাণ্ডারে আরও কাছে সরে এল।
কাজ হল এতে। যুবতীর কাঁধে হাত রেখে সহানুভূতির সুরে বলল কমাণ্ডার, ‘তোমাদের জন্য আমার কষ্ট হয়। কিন্তু এ অবস্থায় তোমার জন্য আমি কিউবা করতে পারি।’
আরেকটা তীর ছুঁড়ল ও। বলল, ‘তোমাদের সুলতানকে আমার এ দুঃখের কাহিনী শুনিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তিনি দয়া করে আমাদের দেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু তিনি আমাকে তার তাঁবুতে ডেকে নিলেন। মদে মাতাল হয়ে সারারাত আমার দেহ নিয়ে খেলা করলেন। ও আস্ত একটা জানোয়ার। মদ খেলে সে আর মানুষ থাকে না। আমার হাড়গোড় সব ভেঙে দিয়েছে।’
কমাণ্ডারের রক্তে আগুন লাগল, জেগে উঠল তার পশু শক্তি। মিসরীয় পৌরুষ নিয়ে সমবেদনার সুরে তার গায়ে, মুখে হাত বুলাতে বুলাতে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘আমাদের বলা হয়েছে সালাহুদ্দীন একজন খাঁটি মুমিন। একজন ফেরেস্তা। মদ এবং নারীকে তিনি ঘৃণা করেন। অথচ…’
মেয়েটা তার দেহের ভার কমাণ্ডারের বুকে ছেড়ে দিতে দিতে বলল, ‘আমাকে তো এখন তার কাছেই নিয়ে যাচ্ছ। বিশ্বাস না হলে রাতে দেখো আমি কোথায় থাকি? আমাকে সুলতান জেলে দেবে না, রাখবে তার নিজস্ব হারেমে। ভয়ে এখনি আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।’
এ ধরনের কথায় সুলতানের ওপর কমাণ্ডারের মন বিষিয়ে উঠছিল। কমাণ্ডার জানতো না, যুবতী গোয়েন্দারা এ হাতিয়ার দিয়েই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে। মেয়েটার প্রেমে হাবুডুব খেতে লাগল সে।
‘যদি তুমি আমাকে এ অপমানকর জীবন থেকে মুক্তি দাও, আমি চিরজীবনের জন্য তোমার হয়ে যাব। আমার পিতা বিত্তশালী। আমাকে এ অপমানকর জীবন থেকে উদ্ধার করেছ জানতে পালে তিনি তোমাকে আনন্দের সাথেই গ্রহণ করবেন। চলো আমরা সাগরের ওপারে পালিয়ে যাই।’
‘কিন্তু…’
‘শোন, কোন কিন্তু নয়। দেশে গিয়ে আমি তোমাকে বিয়ে করব। বাবা তোমায় বাড়ী দেবেন, সম্পদ দেবেন। তুমি নিশ্চিন্তে ব্যবসা করে হেসেখেলে জীবনটা পার করতে পারবে।’
কমাণ্ডার বলল, ‘কিন্তু আমি আমার ধর্মত্যাগ করতে পারব না।’
মেয়েটা কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, ‘আমি আমার ধর্ম ছেড়ে দেব।’
এরপর ওরা বিয়ের পরিকল্পনা করতে লাগল। মেয়েটা বলল, ‘আমি তোমাকে বাধ্য করছি না, ভাল করে ভেবে দেখো কি করবে। আমি শুধু একটা কথা জানতে চাই, আমি তোমাকে যেমন ভালবাসি, তুমিও তেমনটি বাস কিনা। যদি তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও, তবে কায়রো যেতে দেরী করো। একবার কায়রো গেলে তুমি আমার গন্ধও পাবে না।’
মেয়েটা সফর দীর্ঘায়িত করতে চাইছিল, কারণ পলানোর পরিকল্পনা করছিল রবিন। তিনদিনের সফর শেষ হয়ে গেলে তা সম্ভব নয়। ঘুমন্ত প্রহরীদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের হত্যা না করলে পালানো যাবে না। এ জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ সময়ের। ওরা নিশ্চিন্ত না হলে ও সুযোগ পাওয়া যাবে না।
এ জন্য মেয়েটাকে কমাণ্ডারের পেছনে লাগিয়েছে ওরা। প্রথম সাক্ষাতেই মেয়েটা সফল। যৌবন পুষ্ট দেহটা কমাণ্ডারকে উজাড় করে দিয়েছে সে। কমাণ্ডার উচ্চপদস্থ কোন অফিসার নয়। এমন সুন্দরী যুবতী সে কখনও দেখেনি। কল্পনা দেবী তার হাতের মুঠোয়। ভুলে গেল সে কর্তব্য এবং ধর্ম।
সকালে কমাণ্ডার ঘোষণা করল, ‘পশুগুলো ক্লান্ত, আজ সফর করব না।’
ঘোষণা শুনে সবাই খুশী। ময়দানের কঠিন নিয়ম কানুনে ওরা হাঁফিয়ে উঠেছিল। কায়রো পৌঁছনোর কোন তাড়া ওদের নেই।
বিশ্রাম আর গল্পগুজবে কেটে গেল দিন। কমাণ্ডারের সময় কাটল মেয়েটার কাছে।
রাত নামল। ঘুমিয়ে পড়ল সবাই। মেয়েটাকে নিয়ে দূরে সরে এল কমাণ্ডার। সুখের অতলে হারিয়ে গেল দু’জন।
ভোরে কাফেলা রওনা হল। পথ পরিবর্তন করল কমাণ্ডার। বলল, ‘এদিকে যাত্রা বিরতির জন্য সুন্দর জায়গা পাওয়া যাবে। খাওয়ার জন্য পাশের গ্রাম থেকে ডিম এবং মুরগীও আনতে পারব।’
কমাণ্ডার তাদের বিনোদনের সুযোগ দিচ্ছে ভেবে প্রহরীরা ভীষণ খুশী। কিন্তু দু’জন প্রহরী কমাণ্ডারের এসব কাজে খুশী হতে পারেনি। ওরা তাকে বলল, ‘আমরা বিপজ্জনক বন্দীদের নিয়ে যাচ্ছি। ওদের সবাই গুপ্তচর। যতশীঘ্র সম্ভব ওদেরকে সংস্থার হাতে পৌঁছে দেয়া উচিৎ। অকারণে সফর দীর্ঘ করা ঠিক হবে না।’
‘তাড়াতাড়ি পৌঁছব কি দেরীতে পৌঁছব সে দায়িত্ব আমার। এ ব্যাপারে তোমাদের না ভাবলেও চলবে। জবাবদিহী করতে হলে আমি করব।’
ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেল প্রহরী দু’জন। তারপরও দু’জন আড়ালে আবডালে শলাপরামর্শ করতে লাগল।
দুপুর। দূর আকাশে একঝাঁক শুকুন উড়ছে। হয়ত লাশ আছে আশপাশে। এলাকাটা বালিয়াড়ি হলেও ছোট ভোট টিলায় মরুবৃক্ষ আছে।
কাফেলা একটা টিলায় পৌঁছল। চড়াই পেরিয়ে বিস্তীর্ণ মাঠ। মাঠে শুকুনের ভিড়। ওরা তাকিয়ে দেখল প্রান্তর জুড়ে অসংখ্য লাশ। সুলতান সালাহুদ্দীনের কমাণ্ডো বাহিনীর আক্রমণে নিহত সুদানী ফৌজ। সুদানীরা লাশ তুলে নিতে পারেনি, পালিয়ে গেছে জীবন নিয়ে। লাশের পাশে পড়ে আছে অস্ত্র। ঢাল, তলোয়ার, নেযা, বল্লম।
ময়দানের পাশ ঘেঁষে এগিয়ে চলল ওরা। পড়ে থাকা অস্ত্রের দিকে জুলজুল চোখে তাকাল রবিন। কথা বলল সঙ্গীদের সাথে।
ডান দিকে সবুজের সমারোহ। সুপেয় ঝরণা। চোখের ইশারায় কমাণ্ডারকে ডাকল মেয়েটা। এগিয়ে এল মিসরী। মেয়েটা বলল, ‘চমৎকার জায়গা, চলো না বিশ্রাম করি।’
কাফেলাকে থামতে হুকুম দিল কমাণ্ডার। ঝরণার পাশে থামল ওরা। আরোহীরা নেমে পড়ল উট এবং ঘোড়া থেকে। পশুগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে। রাতে থাকার জন্য তাঁবু খাটানো হল দুই টিলার ফাঁকে সবুজ ঘাসে ভরা প্রশস্ত মাঠে।