» » গাজী সালাহুদ্দীনের দুঃসাহসিক অভিযান

বর্ণাকার

মেয়েদের জন্য আলাদা তাঁবু টানাতে বললেন সালাহুদ্দীন আইয়ূবী। প্রয়োজনীয় প্রহরা এবং তাঁবুর স্থান নির্দেশ করতে না করতেই রক্ষীরা দু’জন আহত বন্দীকে নিয়ে এল। জীর্ণ বিধ্বস্ত চেহারা। রক্ত ও পানিতে ভেজা পোশাক। লাশের মত ফ্যাকাশে।

জানা গেল মাইল দেড়েক দূরে এক নৌকায় ছিল বাইশ জন লোক। এ দু’জন কোনভাবে বেঁচে গেছে, বাকী সবাই মারা পড়েছে। কিনারে এসে নৌকা ডুবে গেলে অনেক কষ্টে সাঁতরে তীরে উঠেছে ওরা।

সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর সামনে ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ল ওরা। ব্যথায় কোঁকাচ্ছে।

ওদের একজনকে সধারণ সৈনিক বলে মনে হল না। কাপড়ে রক্তের দাগ নেই, তবে কাতরাচ্ছে অন্যদের চেয়ে বেশী। মাঝে মাঝে মেয়েদের দিকে মুখ বিকৃত করে তাকাচ্ছে।

একে একে সবার ওপর দৃষ্টি বুলালেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবী। শেষ বন্দীর দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। সেনাপতিদের দিকে ফিরিয়ে আনলেন দৃষ্টি।

‘আলী এখনও এল না!’ বললেন আইয়ূবী, ‘এ পর্যন্ত যতজন ধরা পড়েছে তাদের এখনি জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার।’

শেষ বন্দীর দিকে তাকালেন আবার। বললেন, ‘মনে হয় কমাণ্ডার। আলী এলে ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলবে। সম্ভবত ভেতরে হাড়গোড় ভেঙেছে।’

রক্ষীদের দিকে ফিরে বললেন, ‘এদেরকে এখনি আহত বন্দী শিবিরে পৌঁছে দাও। চিকিৎসা এবং খাওয়া দাওয়ার দিকে খেয়াল রেখো।’

বন্দীদের পৌঁছে দেওয়া হল আহত শিবিরে। মেয়েরা তাকিয়ে রইল ওদের গমন পথের দিকে।

সেনা ছাউনি থেকে একটু দূরে মেয়েদের জন্য তাঁবু তৈরী হচ্ছিল। তার একটু দূরেই আহত বন্দীদের তাঁবু। মেয়েরা তাদের জন্য যে তাঁবু বানানো হচ্ছিল তার পাশে গিয়ে বসল। তাকিয়ে রইল আহত বন্দীদের তাঁবুর দিকে। নির্নিমেষ নয়নে ওরা দেখছিল নতুন বন্দীকে।

তাঁবু তৈরী হল। ওরা চলে গেল যে যার তাঁবুতে। বাইরে সশস্ত্র পাহারা। খাওয়া দাওয়ার পর তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল একটি মেয়ে। তাকাতে লাগল অন্য তাঁবুর দিকে। ভয়শূণ্য স্বাভাবিক দৃষ্টি। সেন্ট্রি তাকাল ওর দিকে। সেন্ট্রির চোখে চোখ রেখে মিষ্টি করে হাসল মেয়েটা। ইশারায় বুঝাল ওই তাঁবুতে যেতে চায়।

মাথা নেড়ে নিষেধ করল প্রহরী। দূরে কোথাও যাওয়া নিষেধ। দু’টো তাঁবুর মাঝে গাছগাছালি, বাঁয়ে ঝোপ ঝাড় ভরা উঁচু বালিয়াড়ি ও ছোট ছোট পাহাড়।

সূর্য ডুবে গেছে। বোরকা পরা রাত নেমেছে আঁধার হয়ে। তাঁবুর ভেতরে কোলাহলের কণ্ঠ আঁকড়ে ধরেছে ক্লান্তি ও ঘুম। মরুভূমির বাতাসে রাতের স্তব্ধতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আহতদের করুণ কাৎরানি অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হচ্ছে। বাতাসে ভর করে ভেসে আসছে রোম উপসাগরের আন্দোলিত জলরাশি ও ঢেউয়ের মৃদুমন্দ ধ্বনি। প্রহরী এবং আহতরা ছাড়া সবাই ঘুমিয়ে গেছে।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর তাঁবুতে আলো জ্বলছে। রক্ষীরা টহল দিচ্ছে তাঁবুর বাইরে। তাঁবুর ভেতর সেনাপতি তিনজনকে নিয়ে  বসে আছেন সালাহুদ্দীন আইয়ূবী। চেহারায় উদ্বেগ।

‘আলী এখনও এল না!’ সালাহুদ্দীনের কণ্ঠে স্পষ্ট উদ্বেগ। ‘ওখানে বিদ্রোহের সম্ভাবনা ছিল বলে আলীকে রেখে এসেছিলাম। তার খোঁজ নিতে যাকে পাঠিয়েছিলাম, সেও তো এখনও ফিরে এল না!’

‘কোন সমস্যা হলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই সংবাদ পেতাম। হয়ত ওখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক।’ বলল এক সেনাপতি।

‘আমরা তো তাই কামনা করি। কিন্তু পঞ্চাশ হাজার বিদ্রোহী সৈন্যকে সামলানো সহজ ব্যাপার নয়। ওখানে আমাদের মাত্র দেড় হাজার ঘোড়সওয়ার এবং দু’হাজার সাতশো পদাতিক সৈন্য রয়েছে। এদের তুলনায় সুদানী ফৌজ কেবল সংখ্যায়ই বিপুল নয়, অভিজ্ঞতা এবং সমরাস্ত্রেও ওরাই শক্তিশালী।’

‘নাজি এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের দমন করার পর ওখানে প্রকাশ্যে কেউ বিদ্রোহ করবে বলে মনে হয় না। নেতৃত্ব ছাড়া বিদ্রোহ সম্ভব নয়।’ বলল অন্য এক সেনাপতি।

‘তবুও আমাদের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এ পরিস্থিতিতে কি করা যায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার।’

ছাউনিতে নিশুতি রাতের ভুতুরে নীরবতা। কিন্তু মেয়ে সাতটির চোখে ঘুম নেই। পর্দা তুলে তাঁবুর ভেতরে উঁকি দিল প্রহরী। প্রহরীর পদশব্দে ঘুমের ভান করে পড়ে রইল মেয়েগুলো। তাঁবুর ভেতর প্রদীপের আলো। গুণে দেখল প্রহরী, সাতজন। পর্দা ছেড়ে সরে এল সে।

প্রকৃতির সবকিছু নিরব, নিস্তব্ধ। সবকিচু সুস্থ স্বাভাবিক। একটানা একঘেয়ে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে প্রহরী।

একটু জিরিয়ে নেয়ার জন্য তাঁবুর একপাশে হেলান দিয়ে বসল প্রহরী। তাঁবু ঘেঁষে শুয়েছিল যে মেয়েটা সে তার পাশের জনের কানে কানে বলল, ‘বসে পড়েছে।’ এক কান দু’কান করে সাতজনের কাছেই পৌঁছল খবরটা। দরজার কাছে শুয়েছিল যে মেয়েটা সে এবার উঠে বসল। নিজের বিছানায় কম্বল ভাঁজ করে বিছিয়ে তার ওপর চাদর ছড়িয়ে দিল। এরপর সস্তর্পণে বেরিয়ে এল তাঁবু থেকে।

প্রহরী জানত এ তাঁবুতে কয়েকজন অসহায় মেয়ে আছে মাত্র। যাদেরকে সাগর থেকে কুড়িয়ে এনে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এদের কাছ থেকে কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই ভেবে বসে বসে ঝিমুতে লাগল সে।

বিপরীত দিক দিয়ে মেয়েটা বেরিয়ে এল তাঁবুর বাইরে। সতর্ক পায়ে এগিয়ে গেল টিলার দিকে। টিলার কাছে পৌঁছে আহত বন্দীদের তাঁবুর দিকে হাঁটা দিল। গাছের ফাঁকে ফাঁকে এগিয়ে যাচ্ছিল ও। প্রহরীটি এখন বেশ দূরে। ওকে আর দেখে ফেলার ভয় নেই।

তাঁবুর কাছাকাছি পৌঁছে একটা ঝোপের আড়ালে বসে এদিক ওদিক ভাল করে তাকিয়ে দেখল। গভীর সাবধানী দৃষ্টি। দেখল এখানকার প্রহরী তখনও টহল দিচ্ছে। কালো একটা সচল ছায়া চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে তাঁবুর চারদিক। সে সচল ছায়ার ওপর আটকে রইল মেয়েটার চোখ।

এখন ও দু’সেন্ট্রির মাঝখানে মাটিতে শুয়ে আছে। প্রহরীটি হাঁটতে হাঁটতে সরে গেল তাঁবুর ওপাশে।

ও হামাগুড়ি দিয়ে পৌছুল তাঁবুর কাছে। অন্ধকাররে পর্দা একটু ফাঁক করে ঢুকে গেল তাঁবুর ভেতর।

ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। যন্ত্রণায় আহতদের অনেকেই ঘুমোতে পারছে না। ব্যথায় কাৎরাচ্ছে কেউ কেউ।

পর্দা ফাঁক করে কেউ একজন ভেতরে প্রবেশ করছে দেখে পাশের জন ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘কে?’

‘রবিন কোথায়! ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে ফিসফিসিয়ে বলল মেয়েটা।

‘এদিক থেকে তৃতীয়।’

মেয়েটা হাতড়ে হাতড়ে তৃতীয় ব্যক্তির পা স্পর্শ করল।

‘কে?’ বলল সে।

‘আমি মুবি।’

উঠে বসল রবিন। হাত বাড়িয়ে মুবিকে বিছানায় টেনে নিল। শুইয়ে দিল নিজের পাশে। ওর গায়ে চাদর তুলে দিতে দিতে বলল, ‘আমার সাথে লেগে থাক। প্রহরী এসে যেতে পারে।’

রবিন মুবিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ঘরে ফিসফিস করে বলল, ‘আমি আশ্চর্য হচ্ছি মুবি, কিভাবে আমাদের দেখা হল! এতে বুঝা যায়, পবিত্র যিশু আমাদের সাফল্য চাইছেন। আমরা পরাজিত হয়েছি একথা ঠিক নয়।’

‘তুমি কি আহত, হাড়গোড় ভাঙ্গেনি তো!’

‘ধুর, আমার কিছু হয়নি। একটা আঁচর পর্যন্ত লাগেনি কোথাও।’

‘এখানে এসেছ কেন?’

‘সুদানী সেনাবাহিনীর কাছে যাব। চারদিকে মুসলিম ফৌজ। অনেক চেষ্টা করেছি, যেতে পারিনি। দেখলাম ওরা আহত বন্দীদের চিকিৎসা দিচ্ছে। আহত হওয়ার ভান করে ওদের দলে ভিড়ে গেলাম।’

‘এখন কি করবে?’

‘সুযোগ পেলেই পালিয়ে যাবো। কিন্তু এ মুহূর্তে তা সম্ভব হচ্ছে না। সালাহুদ্দীন বড় বজ্জাত আদমী, চারদিকে ওর চোখ কান খোল।’

‘ভালই গ্যাড়াকলে আটকেছ দেখছি।’

‘টিটকারী মারবে না।’ হঠাৎ খেপে গেল রবিন, ক্রোধের সাথে বলল, ‘বল তো সালাহুদ্দীন এখনও বেঁচে আছেন কেন? তীর কি শেষ হয়ে গিয়েছিল, না ওই বদমাশটা ভয় পেয়েছে? আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, তোমরা সাতজন একত্রে ধরা পড়লে কিভাবে? ওই পাঁচটা পাঠা কি মরে গেছে, না পালিয়েছে?’

‘ওরা সবাই বেঁচে আছে রবিন। তুমি তো বললে যিশু আমাদের বিজয় চাইছেন, আমি বলছি, ঈশ্বর আমাদের কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছেন। সালাহুদ্দীন বেঁচে আছে, কারণ তীল তার গায়ে লাগেনি। তীর বিঁধেছে তার দু’পায়ের ফাঁকে, মাটিতে।’

‘কোন মেয়ে তীর ছুড়েছিল?’ রবিনের কণ্ঠে ঝাঁঝ। ‘ক্রিস্টোফার কোথায় ছিল?’

‘ওই তীর ছুড়েছে। কিন্তু……’

‘ক্রিস্টোফারের তীর লাগেনি!’ রবিনের কণ্ঠে বিস্ময়। ‘লক্ষ্য ভেদের জন্য সম্রাট অগাষ্টাস নিজের তরবারি দিয়ে তাকে পুরস্কৃত করেছেন। এখানে এসে ছ’ফুট দীর্ঘ আর তিন ফিট চওড়া সালাহুদ্দীনের গায়ে ও তীর লাগাতে পারল না। তীর ছোঁড়ার সময় ভয়ে হারামিটার হাত কাঁপছিল নাকি?’

‘দুরত্ব ছিল বেশী। ক্রিস্টোফার বলেছে, তীর ছোঁড়ার সময় বাম চোখে একটা মাছি এসে বসায় লক্ষ্য স্থির থাকেনি।’

‘তারপর কি হল?’

‘যা হবার তাই। সালাহ্উদ্দীনের সাথে ছিল তিনজন সেনাপতি এবং চারজন দেহরক্ষী। ওরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ভাগ্য ভাল, পাহাড়ী এলাকা বলে বেঁচে গেছি। তীর বালির নীচে লুকিয়ে ফেলেছিলাম। সেপাইরা এলে ক্রিস্টোফার বলল, আমরা পাঁচজন মরক্কোর ব্যবসায়ী। এ মেয়েদেকে সাগর থেকে উদ্ধার করেছি। আমাদের মালপত্র তল্লাশী নেয়া হল। ব্যবসায়িক সামানাদি ছাড়া কিছুই পাওয়া গেল না। আমাদেরকে সালাহুদ্দীনের সামনে নেয়া হল। বোঝালাম আমরা সিসিলি ভাষা ছাড়া কিছুই জানি না। দোভাষীর কাজ করল ক্রিস্টোফার।’

মুবি পুরো ঘটনা শোনাল রবিনকে। ব্যবসায়ীরূপী পাঁচ ব্যক্তি এবং এই সাতটি মেয়ে ছিল খৃষ্টানদের বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গুপ্তচর। গোয়েন্দা কাজ ছাড়াও মেয়েদের দায়িত্ব ছিল মুসলিম সেনাপতি, কমাণ্ডার এবং দায়িত্বপূর্ণ লোকদের ফাঁসানো। রবিন এ গ্রুপের কমাণ্ডার।

‘তুমি আইয়ূবীকে রূপের জালে জড়াতে পারো না মুবি?’

‘কেবল তো প্রথম রাত। আমাদেরকে আরও অপেক্ষা করতে হবে। বুঝতে হবে কোন পথে এগোনো যায়। আমাদের ব্যাপারে সে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে তা যদি তার মনের কথা হয়, তবে বুঝতে হবে, সে মানুষ নয়, পাথর। সে জানে আমরা অসহায়। চাইলেই সে আমাদের পেতে পারে, অথচ একজনকেও সে তার তাঁবুতে ডাকেনি।’

‘তাকে হত্যা করাও সহজ নয়। সব সময় সে থাকে সেনাপতি আর রক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে। মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে সশস্ত্র প্রহরী।’

‘শুনেছি ওই পাজিটা নাকি মদও স্পর্শ করে না।’

‘তোমাদের সঙ্গী পাঁচজন এখন কোথায়?’

‘ওরা কাছেই আছে। ওদের নিয়ে তুমি ভোবো না, এরা এখানেই থাকবে।’

‘মুবি, পরাজয় আমাকে পাগল করে দিয়েছে। এর জন্য আমিই দায়ী। সকল সৈনিকই ক্রুশ হাতে নিয়ে শপথ করে। কিন্তু আমার আর তাদের শপথে আসমান জমিন ফারাক। পেছন থেকে আক্রমণ করে আমরা অর্ধেক বিজয় ছিনিয়ে আনি। কিন্তু আমরা কেউ আমাদের দায়িত্ব পালন করিনি।’

গলায় ঝুলানো ক্রুশ হাতে নিয়ে রবিন বলল, ‘এ ক্রুশ আমার কাছে জবাব চাইছে। একে আমি বুক থেকে সরাতে পারি না।’

নিজের ক্রুশ ছেড়ে রবিন মুবির জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিল। ওর বুকের সাথে সেটে থাকা ক্রুশ বের করে বলল, ‘তুমি তোমার পিতা মাতাকে ধোকা দিতে পার, কিন্তু এ পবিত্র ক্রুশের সাথে প্রতারণা করতে পার না। ঈশ্বর তোমায় ক্লিওপেট্রার চে’ বেশী রূপ দিয়েছেন। তোমার দেহের মাদকতা, রূপের জৌলুস পাহাড় কেটে তোমার জন্য পথ খুলে দেবে। আমাদের এ অযাচিত সাক্ষাতে মনে হচ্ছে, আমরা পরাজয়ের গ্লানি থেকে বাঁচতে পারবো। আমরা ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারলে আমরাই বিজয়ী হব। রোম উপসাগরের ওপারে আমাদের ফৌজ জমা হচ্ছে। যারা মরেছে, মরেছে। বেঁচে আছে যারা তাদের বিশ্বাস, প্রতারণার শিকার হয়ে আমরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি ঠিক, কিন্তু এ আমাদের চুড়ান্ত কোন পরাজয় নয়। নিজের তাঁবুতে ফিরে যাও। অন্য মেয়েদের বলো, তাঁবুতে পড়ে ঘুমানো এদের কাজ নয়। বার বার সালাহুদ্দীনের সাথে দেখা করবে। সাক্ষাৎ করবে সেনাপতিদের সাথে। প্রেমের অভিনয় করবে। লোভ দেখাবে দেহের। যৌবনের আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেবে ওদের ঈমানের আগুন। আর একবার যদি এতে সফল হতে পার সবকিছু আমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে।’

‘সবার আগে আসল ঘটনা জানতে হবে, জানতে হবে কেন এমনটি ঘটল। সুদানীরা কি আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে?’

‘নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারছি না। যুদ্ধের আগে আমাদের গোয়েন্দাদের রিপোর্ট ছিল সালাহুদ্দীন আইয়ূবী মিসরের গভর্ণর এবং ফৌজের সর্বাধিনায়ক হয়ে এসেছেন। নতুন ফৌজ গঠন করছেন মিসরীদের দিয়ে। নাজির পঞ্চাশ হাজার সৈন্য সে সাথে যোগ দেয়নি। নাজি আমাদের কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠায়। নাজির সে চিঠি আমি নিজে দেখেছি। তার লেখা আমি চিনি, ওটা যে তারই চিঠি ছিল এ ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু কি করে এমনটি ঘটল কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। এটা যদি প্রতারণা হয় তবে বলব, ইতিহাসের সবচে জঘন্য প্রতারণা করা হয়েছে আমাদের সাথে।’

‘রবিন, অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ে লাভ নেই। সবার আগে আমাদের জানতে হবে এসব কি করে হল? কে করল?’

‘মুবি, মনে করো না এ রহস্য না জেনেই আমি এখান থেকে যাব। সম্রাট অগাষ্টাস গর্ব করে বলেছিলেন, মুসলমানদের ভেতরের খবর সংগ্রহ করে ওদের নিশ্চিহ্ন করে দেব। ভেবে দেখ মুবি, সম্রাটের হৃদয়ে এখন কি ঝড় বইছে। আমরা যা করেছি তাতে মৃত্যুদণ্ডই আমাদের প্রাপ্য। আমাদের কারণেই ক্রুশের এ বিপর্যয়। আমি ক্রুশের অভিশাপকে ভয় পাচ্ছি।’

‘আমি সব জানি রবিন। আবেগের কথা নয়, এখন কাজের কথা বল। আমাদের এখন কি করতে হবে, কোন পথে এগুবো আমরা তাই বল শুনি।’

পরাজয়ের গ্লানি রবিনের স্নায়ূগুলো বিকল করে দিয়েছিল। মুবির মত সুন্দরী যুবতী তার বুকের সাথে লেপ্টে আছে। তার রেশম কোমল চুল রবিনের গালের অর্ধেকটা ঢেকে রেখেছে। কিন্তু তার অনুভূতি যেন ভোতা হয়ে গেছে।

মুবির চুলে বিলি কেটে রবিন বলল, ‘তোমার এ মায়াময় চুলের শৃঙ্খলে সালাহুদ্দীনকে বাঁধতে পার না! মুবি, আমি জানি তুমি একটু চেষ্টা করলেই তোমার ধ্যানভাঙ্গা রূপ আইয়ূবীকে তোমার দাসে পরিণত করবে। তোমার প্রথম কাজ হল, ক্রিস্টোফারকে বলবে ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশেই সে যেন নাজির কাছে পৌঁছে রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করে। নাজি যদি সালাহুদ্দীনের সাথে মিশে গিয়ে থাকে, আমাদের যুদ্ধের পলিসি পাল্টাতে হবে। আমি বুঝতে পারছি, সংখ্যায় কম হলেও মুসলমানদের সহজে পরাজিত করা যাবে না। আগে ওদের জোশ ও ইসলামী জযবা ধ্বংস করতে হবে। বিজয়ের জন্য এটাই প্রথম শর্ত। আর এ জন্যই আমরা তোমাদের মত রূপসী তরুণীদের দিয়ে আরবের হারেমগুলো ভরিয়ে রেখেছি। তোমরা এতে সফল না হলে আমাদের সাফল্যের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত।’

‘আবার কথা বাড়াচ্ছ? আমরা নিজের ঘরে নয়, শত্রুর তাঁবুতে বসে কথা বলছি। চারপাশে কড়া প্রহরা। ওদিকে রাতও শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের মিশন ধ্বংস হয়ে গেছে। এ পরাজয়কে বিজয়ে রূপান্তরিত করতে হবে। এ জন্য এখান থেকেই শুরু করতে হবে কাজ।’

‘হ্যাঁ, সে কাজের কথাই বলছি, সবার আগে আমাদের দরকার নাজির খবর।’

‘সংবাদ সংগ্রহ করে তোমাকে কোথায় পাব?’

‘আমি এখান থেকে পালিয়ে যাব। তাঁর আগে সালাহুদ্দীনের ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও তার সৈন্য সংখ্যা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেব।’

‘আমারও মনে হয় সমগ্র মুসলিম বিশ্বে একটা লোকই ক্রুশের জন্য বিপজ্জনক।’

‘তাই, আর এ জন্যই সালাহুদ্দীনকে হত্যা করা জরুরী। আর ও বেঁচে থাকলে থাকবে আমাদের বন্দীশালায়।’

‘কিন্তু কিভাবে?’

‘শোন, প্রথমেই তাঁবুতে গিয়ে ওদের বলবে, যে করেই হোক আলী বিন সুফিয়ানকে ফাঁসাতে হবে। আলী এবং সালাহুদ্দীনের মাঝে তুলে দিতে হবে ঘৃণার দেয়াল। এরপর যাবে ক্রিস্টোফারের কাছে। বলবে, লক্ষ্য ভেদ না করে যে পাপ করেছ, দায়িত্ব পালন করে এবার তা মোচন করার চেষ্টা কর।’

‘ঠিক আছে রবিন। দোয়া করো যিশু যেন আমার সহায় হন।’

রবিন মুবির চুলে চুমো খেয়ে বলল, ‘ক্রুশের জন্য তোমাকে তোমার ইজ্জত বিলিয়ে দিতে হবে। তবে মনে রেখ, যিশুর কাছে তুমি থাকবে মা মেরীর মতই পবিত্র কুমারী। ইসলামের মূল উপড়ে ফেলে আমরা জেরুজালেম দখল করেছি, এবার মিসরও আমাদের হবে।’

রবিনের বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল মুবি। তাঁবুর পর্দা ঈষৎ ফাঁক করে তাকাল বাইরে। কোথাও কেউ নেই।

নিঃশব্দে বেরিয়ে এল মুবি। তাঁবুর সাথে সেঁটে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি বুলাল চারদিকে। দূর থেকে কারো গুনগুন শব্দ ভেসে আসছে। সম্ভবতঃ প্রহরী।

হাঁটা দিল মুবি। গাছের আড়ালে আড়ালে গা বাঁচিয়ে পৌঁছল টিলার কাছে। টিলা পার হয়ে চলতে লাগল নিজের তাঁবুর দিকে। তাঁবুর কাছাকাছি চলে এসেছে মুবি, দু’জন লোকের অনুচ্চ কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এল। থমকে দাঁড়াল মুবি, উৎকর্ণ হয়ে তাকাল সামনে। শব্দ আসছে তাঁবুর দিক থেকে।

ও তাঁবুতে নেই হয়ত ওরা জেনে গেছে, এ জন্য ডেকে এনেছে কমাণ্ডার বা অন্য কাউকে। ধরা পড়লে চলবে না।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গীদের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ও। এতে অন্য মেয়েগুলো বিপদে পড়তে পারে ভেবে দাঁড়াল আবার।

কয়েক পা এগিয়ে গেল লোক দুটোর কথা শোনার জন্য। কিন্তু ও কাছে পৌঁছার আগেই কথা থামিয়ে দিয়েছে ওরা। এখন কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না।

একপা দু’পা করে হাঁটছে ও, হঠাৎ বায়ে শব্দ হল। চমকে সেদিকে তাকাল মুবি। গাছের একটা ছায়া ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

ও টিলার কাছে ফিরে এল। উঠে দাঁড়াল টিলার ওপর। সাগর পাড়ের জোৎস্না ধোয়া রাত। এখন ওকে দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে।

ডিউটি পরিবর্তনের সময় হয়ে এসেছে। প্রহরীদের অবস্থা দেখার জন্য বেরিয়ে গেলেন কমাণ্ডার। টিলার ওপর একটা ছায়া দেখতে পেলেন। দাঁড়িয়ে পড়লেন কমাণ্ডার।

ছায়াটা তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। দু’হাতে সামনে আসা চুল ঠিক করল। দেহের গঠনে মেয়ে মনে হচ্ছে। কমাণ্ডার অপেক্ষা করছেন।

জ্বীন ভূত হলে অদৃশ্য হয়ে যাবে, কিন্তু ছায়াটা ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। কমাণ্ডার বুঝে ফেললেন, এ জ্বীন নয়, মানুষ। সুলতান আইয়ূবীর সতর্কবাণী তার মনে পড়ল। তাদের বলা হয়েছে খৃষ্টানরা গুপ্তচর হিসেবে মেয়েদের ব্যবহার করছে। কখনও বেদুঈন আবার কখনও ভিক্ষুক সেজে ওরা আসবে। নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে আশ্রয় চাইবে। আরও তাকে বলা হয়েছে, সুলতান সন্দেহভাজন সাতজন মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছেন। অপেক্ষা করছেন গোয়েন্দা প্রধান আলীর জন্য। তিনি এলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে।

প্রহরীদের ডিউটি পরিবর্তনের সময় কমাণ্ডার ফখরুল মিসরি তাঁবুর পর্দা তুলে দেখলেন সাতটা মেয়েই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। কম্বল সরালে দেখা যেত সপ্তম মেয়েটা বিছানায় নেই। টিলার ওপরই যে ওই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে কমাণ্ডার তা বুঝতে পারেনি।

মেয়েটা হাঁটা শুরু করতেই কমাণ্ডার টিলার দিকে এগিয়ে গেল। বলল, ‘কে তুমি, নীচে নেমে এস।’

চঞ্চল হরিণীর মত মেয়েটা দ্রুত টিলার অন্যদিকে নেমে গেল।

কমাণ্ডার একলাফে টিলার ওপর উঠে এল। রাতের নীরবতা ভেঙ্গে তীব্রগতিতে ছুটছে মেয়েটা। তাকে ধরার জন্য তার পিছনে ছুটল কমাণ্ডার।

দু’জনের মাঝে বেশ খানিকটা দুরুত্ব। দু’জনেই ছুটছে তীব্র গতিতে। কিন্তু ফখরুল একজন সৈনিক, ছুটছে চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতা নিয়ে। অসমতল মাটি, শুকনো ঝোপঝাড় আর গাছগাছালি মাড়িয়ে নিশুতি রাতে মরুদ্যানের বুকে ছুটছে দু’জন। দূরত্ব কমে আসছে দু’জনের মাঝে। সামনে খণ্ড খণ্ড অনেকগুলো এলোপাথারি ঝোপঝাড়।

মুবি মেয়ে হলেও একজন গোয়েন্দা। শত্রুর চোখে ধুলো দেয়ার হাজারো কায়দা কানুন শিখেছে দীর্ঘদিনের অনুশীলনে। তার সে ট্রেনিং কাজে লাগানোর সময় এসেছে। দ্রুত ঝোপের আড়ালে আত্মগোপন করল মুবি। কমাণ্ডার কিছুদূর এগিয়ে দেখল সামনে কেউ নেই। মেয়েটার পায়ের শব্দও শোনা যাচ্ছে না। দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল সে। গতি কমিয়ে অনির্দিষ্টভাবে এগিয়ে গেল সামনে।

গাছের আড়ালে লুকিয়ে কমাণ্ডারকে এগিয়ে যেতে দেখল মুবি। কমাণ্ডার এগিয়ে যেতেই ও আবার ছুটতে লাগল। হঠাৎ পেছনে পায়ের শব্দ শুনে কমাণ্ডারও ছুটল পেছন ফিরে। আবার কোন শব্দ নেই। অনুমান করে ছুটছে কমাণ্ডার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পেছন থেকে আবার ভেসে এল পদশব্দ। ঘুরে দৌড় লাগাল কমাণ্ডার। থেমে গেল পদশব্দ লুকোচুরি খেলার ট্রেনিং ভালই কাজে লাগাচ্ছে মুবি।

এভাবে চলল কিছুক্ষণ। মেয়েটা যেন তার সাথে কানামাছি খেলছে। হারিয়ে যাচ্ছে, আবার দৌঁড়াচ্ছে। ক্রোধে ফুঁসতে লাগল কমাণ্ডার।

ঝোপঝাড় আর গাছের ফাঁকে ফাঁকে এভাবে লুকোচুরি খেলতে খেলতে মাইল দুয়েক দূরে চলে এসেছে ওরা। সামনে দেখা যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের তাঁবু।

মেয়েটা তাঁবুর কাছে পৌঁছে চিৎকার করে ডাকতে লাগল ওদের। আলো জ্বেলে তাঁবু থেকে বরিয়ে এল ব্যবসায়ীরা।

তরবারী হাতে কমাণ্ডারও পৌঁছে গেল ওখানে। ব্যবসায়ীদেরকে মুসলমান মনে হচ্ছে। মেয়েটা তাদের একজনের পা জড়িয়ে ধরে আছে। আতঙ্কে বিবর্ণ চেহারা, হাঁফাচ্ছে।

‘এ মেয়েটাকে আমার হাতে তুলে দাও।’ নির্দেশের ভঙ্গীতে বলল কমাণ্ডার।

‘ও একা নয়,’ বলল এক ব্যবসায়ী, ‘আমরা সাতজনকেই তোমাদের সুলতানের কাছে দিয়ে এসেছি, একেও নিয়ে যেতে পার।’

‘না।’ আরও জোরে লোকটার পা আঁকড়ে ধরল মুবি। বলল ‘আমি ওর সাথে যাব না। মুসলমানরা খ্রীষ্টানের চাইতেও জানোয়ার। ওদের সুলতান একটা ষাঁড়, একটা পশু। সে আমার হাড়গোড় পর্যন্ত ভেঙে দিয়েছে। আমি কোন রকমে পালিয়ে এসেছি।’

‘কোন সুলতান?’ কমাণ্ডারের হতবাক কণ্ঠ।

‘যাকে তোমরা সালাহুদ্দীন আইয়ূবী বল।’

‘মেয়েটা মিথ্যে বলছে। কে ও? তোমাদের সাথে এর সম্পর্ক কি?’

‘ভেতরে এস বন্ধু। বাইরে ঠাণ্ডা, তারাবারী খাপে ঢুকাও। কোন ভয় নেই, আমরা ব্যবসায়ী। মেয়েটা কি বলতে চায় শোনই না। আমরা তোমাদের সুলতানকে ভাল মানুষ ভেবেছিলাম। কিস্তু সুন্দরী যুবতীদের দেখে তিনিও ঈমান আমান খুইয়ে বসেছেন!’

‘অন্য ছ’টি মেয়ের কি অবস্থা করেছে কে জানে!’

‘অন্য সেনাপতি এবং কমাণ্ডাররা এদের শেষ করে দিয়েছে।’ মুবি বলল, ‘এদেরকে সন্ধ্যার সময় নিয়ে গেছে, দিয়ে গেছে খানিক আগে। এখন ওরা তাঁবুতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।’

কমাণ্ডার তরবারী কোষবদ্ধ করে তাঁবুতে প্রবেশ করল। কফি তৈরী করতে লাগল এক ব্যবসায়ী। কমাণ্ডারের অলক্ষ্যে কি যেন মেশাল তাতে। অন্য একজন জানতে চাইল তার পদমর্যাদা।

আলাপচারিতায় ব্যবসায়ীরা বুঝল লোকটা সেনাবাহিনীর উঁচু পর্যায়ের কেউ নয়, একজন সাধারণ গ্রুপ লিডার মাত্র। তবে লোকটা মেধাবী এবং সাহসী।

ওরা মেয়েদের ব্যাপারে সুলতানকে বলা গল্পটাই কমাণ্ডারকে পুনরায় শোনাল। জানাল এদের ব্যাপারে সুলতানের সিদ্ধান্ত। যোগ্য বর পেলে এরা মুসলামন হবে, দেশে ফিরবে না কখনও, তাও কমাণ্ডারকে বলা হল।

অন্য একজন বলল, ‘এ মেয়েটার সাথে তোমাদের প্রিয় সুলতান কি কাণ্ড ঘটিয়েছে তা তো ওর মুখেই শুনলে।’