জুকি গভর্ণরের তাঁবুতে রাত কাটিয়েছে, নাজির গোপন হারেমেও এ সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল। ও এসেছে এই সেদিন, অথচ নাজি প্রথম দিন থেকেই অন্য সবার চাইতে ওকে বেশী ভালবাসে। এক মুহূর্তের জন্যও অন্য নর্তকীদের কক্ষে তাকে যেতে দেয়া হয়নি। জুকির জন্য ছিল আলাদা কক্ষ। নর্তকীরা প্রতিহিংসার আগুনে পুড়তে লাগল। সালাহুদ্দীন আইয়ূবীকে ফাঁসানোর জন্য জুকিকে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে ওরা তা জানত না। ওদের ধারণা, জুকি নাজিকে এককভাবে দখল করে নিয়েছে। নর্তকী দু’জনের প্রতিহিংসা চরমে পৌঁছলে ওরা জুকিকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
গভর্ণরের তাঁবুতে জুকির রাত কাটানোর সংবাদে ওরা আরও পাগল হয়ে উঠল। কিভাবে তাকে হত্যা করা যায় ভাবতে গিয়ে ওদের মাথায় দুটি চিন্তা আসে। এক, তাকে বিষ প্রয়োগ করা যায়। দুই, ভারাটে খুনী দিয়েও খুন করানো যায়। কিন্তু বাস্তবে দুটোর একটাও তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ জুকির খাওয়া দাওয়ার সবকিছু ছিল ওদের থেকে আলাদা, অন্যদিকে প্রহরী ছাড়া সে তার রুম থেকে বেরই হত না।
ওরা হারেমের এক চতুর বাঁদীকে হাত করল। জুকিকে শেষ করতে পারলে প্রচুর ধন সম্পদ দেয়ার লোভ দেখাল তাকে। চাকরাণীটা ছিল লোভী এবং জঘন্য প্রকৃতির। হেরেমের অসংখ্য অপকর্মের হোতা ছিল সে।
প্রস্তাব শুনে সে বলল, ‘মুনীবের কক্ষে গিয়ে ওকে বিষ খাওয়ানো সম্ভব নয়। সুযোগমত খঞ্জর ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে এ জন্য কিছু সময়ের প্রয়োজন।’
‘কতদিন সময় প্রয়োজন তোমার?’
‘জুকির তৎপরতার ওপর নজর রাখতে হবে। হয়ত শীঘ্রই সুযোগ এসে যাবে।’
‘কিন্তু তারাতারি যদি সুযোগ না আসে?’
‘তাহলে ঘাতক দলের সহযোগীতা নিতে হবে। তবে ওরা এজন্য অনেক টাকা দাবি করবে।’
‘যত টাকা লাগে দেব, তবু আমারা চাই কাজটা তুমি তাড়াতাড়ি শেষ কর।’ বলল নর্তকীরা।
ক্রোধে উন্মুক্ত প্রায় নাজি কামরায় পায়চারী করছিল। জুকি তাকে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করেছে। নাজির রাগ কমেনি।
‘আমাকে তার কাছে যেতে দিন।’ এ নিয়ে চতুর্থবারের মত বলল জুকি, ‘আমি তাকে সোজা পথে নিয়ে আসবো।’
‘কোন লাভ নেই।’ বেটা কমবখত হুকুম দিয়ে ফেলেছে, বাস্তাবয়নও শুরু হয়ে গেছে। আমার আর কিছুই রইল না। তোমার যাদু ওকে ধরেনি। আমার বিরুদ্ধে কারা ষড়যন্ত্র করছে জানি। ওরা আমার উন্নতি সইতে পারছে না। আমিই হতাম গভর্ণর। একজন সাধারণ সেনাপতি হয়েই সব শাসকদের শাসন করেছি আমি। আর এখন আমি একজন সামান্য কমাণ্ডারও নই।
নাজি প্রহরীকে ডেকে বলল, ‘জলদি এডরোসকে আসতে বল।’
এডরোস এলে দু’জনে নতুন নির্দেশ নামার ব্যাপারে আলাপ করল। এডরোসের কাছে এ খবর নতুন না হলেও সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে এ ব্যাপারে এডরোস কোন পরামর্শ দিতে পারল না।
নাজি বলল, ‘কি করব আমি ভেবে রেখেছি।’
‘কি ভেবেছেন?’
‘বিদ্রোহ করব।’
হতভম্বের মত তাকিয়ে রইল এডরোস।
‘কি ব্যাপার, হতবাক হয়ে গেছ মনে হচ্ছে? বল তো পঞ্চাশ হাজার সুদানী ফৌজ আমাদের পক্ষে থাকবে, না সালাহুদ্দীনের পক্ষে? আমি ওদের বিদ্রোহের জন্য উস্কানি দিয়ে বলব, মিসর তোমাদের কিন্তু তোমরা এখন হবে ওদের দাস-দাসী।’
দীর্ঘশ্বাস টেনে এডরোস বলল, ‘এ নিয়ে এখনও ভাবিনি। চোখের পলকেই তো বিদ্রোহ ঘটানো যায়। কিন্তু মিসরের নতুন ফৌজ আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত এবং যথেষ্ট শক্তিশালী। ইচ্ছে করলেই ওরা বিদ্রোহ দমন করতে পারবে। সরকারের সাথে সংঘর্ষে যাবার আগে সবদিক ভেবে দেখা উচিৎ।
‘ভাবাভাবির কাজ শেষ। আমি খৃষ্টান সম্রাটদেরকে সাহায্যের জন্য ডাকবো। দূত তৈরী কর, অনেক দূর যেতে হবে ওদের। এবার মন দিয়ে আমার পরিকল্পনার কথা শোন। জুকি তুমি নিজের ঘরে যাও।
জুকি ফিরে গেল নিজের কক্ষে। সারারাত দু’জন দরজা বন্ধ করে বিদ্রোহের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করল।
দুই ফৌজ একীভূত করার জন্য সালাহুদ্দীন সাতদিন সময় দিয়েছিলেন। কাগজপত্র তৈরী হতে লাগল। পূর্ণ সহযোগিতা করছিল নাজি। চারদিন পার হয়ে গেছে, এর মধ্যে গভর্ণরের সাথে আরও একবার দেখা করেছিল নাজি, কিন্তু কোন অনুযোগ করেনি। কাজের বিস্তারিত রিপোর্ট দিয়ে আইয়ূবীকে আশ্বস্ত করেছিল। গভর্ণরের সহকারীও তাকে আশাব্যঞ্জক সংবাদ দিচ্ছিল, কিন্তু আলী বিন সুফিয়ানের দেয়া তথ্য ছিল উদ্বেগজনক।
গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে বলা হল, ‘সুদানী সৈন্যদের মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করছে। গুজব ছড়ানো হচ্ছে মিসরের সেনাবাহীনীর সাথে একত্রিত করে সুদানী সৈন্যদেরকে তাদের দাস দাসীতে রূপান্তরিত করা হবে। যুদ্ধলব্ধ সম্পদে সুদানীদের কোন অংশ থাকবে না। বিশেষ করে কাউকে মদ পানের অনুমতি দেয়া হবে না।’
রিপোর্ট শুনে সালাহুদ্দীন আইয়ূবী বললেন, ‘অনেক দিনের বদ অভ্যাস, আমার এসন নীতি ওদের পছন্দ না হওয়ারই কথা। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, নতুন পরিবেশে এলে কিছুদিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ওই মেয়েটার সাথে আর দেখা হয়েছে আলী?’
‘না, দেখা করা সম্ভব হচ্ছে না। আমার পাঠানো লোকটাকে নাজি আটকে রেখেছে।’
দিন পেরিয়ে কালো নেকাব পরে প্রকৃতিতে নেমে এসেছে রাত। এডরোসের সাথে রুদ্ধদ্বার কক্ষে বসেছিল নাজি। জুকি তার নিজস্ব কামরায়। ঘোড়ার পায়ের শব্দ কানে এল ওর। পর্দা তুলে বাইরে তাকাল জুকি।
দু’জন ঘোড়সওয়ার। পোশাক আশাকে ব্যবসায়ী মনে হচ্ছে।
ঘোড়া থেকে নেমে নাজির কক্ষের দিকে হাঁটা দিল ওরা। ওদের চলাচল জুকির কাছে ব্যবসায়ীর মত মনে হল না। ততক্ষণে এডরোস বেরিয়ে এসেছে। থমকে দাঁড়াল আরোহী দু’জন। সামরিক কায়দায় স্যালুট করল। এডরোস ওদের পোশাক দেখে বলল, ‘প্রমাণ দাও।’
ওরা পোশাকের নীচে লুকানো অস্ত্র বের করল। ছোট তলোয়ার এবং খঞ্জর।
ওদের ভেতরে নিয়ে গেল এডরোস। প্রহরী দাঁড়িয়ে রইল একপাশে।
গভীর চিন্তায় ডুবে গেল জুকি। কক্ষ থেকে বেরিয়ে নাজির কক্ষের দিকে হাঁটা দিল ও। পথরোধ করে দাঁড়িয়ে প্রহরী। বলল, ‘কারও ভেতরে যাবার অনুমতি নেই।’
সে বুঝে নিল কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে। দু’তিন রাত আগের কথা মনে পড়ল তার। নাজি এডরোসকে বলেছিল, ‘আমি খৃষ্টান শাসকদেরকে সাহায্যের জন্য ডাকবো। তুমি দু’জন দূত তৈরী কর। ওদেরকে অনেক দূর যেতে হবে।’ এর পর জুকিকে বিদেয় করে বিদ্রোহের ব্যাপরের আলাপ করেছিল ওরা।
নিঃশব্দে নিজের কক্ষে ফিরে এল ও। নাজির খাস কামরার সাথে সংযুক্ত জুকির কক্ষের কপাট আঁটা। ও চুপিসারে দরজায় কান লাগিয়ে দাঁড়াল। ওপাশের কক্ষে অস্ফুট শব্দ। কিছুই বুঝা যাচ্ছিল না।
একটু পর ভেসে এল নাজির কণ্ঠ, ‘পরিষ্কার জনবসতি থেকে দূরে থাকবে। ধরা পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে এ চিঠি নষ্ট করে ফেলবে। পথে কেউ বাঁধা সৃষ্টি করলে হত্যা করবে নির্দয়ভাবে। চার দিনে সফর তিন দিনে অতিক্রম করতে হবে। মনে রেখো, তোমাদের রোখ থাকবে উত্তর পূর্বদিকে।’
নাজির কক্ষ থেকে সেই দুই ব্যক্তি বেরিয়ে এল। বেরিয়ে এল জুকিও। এদের বিদায় দিতে নাজি এবং এডরোস আগেই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল। লোক দু’টো ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল। জুকির দিকে চোখ পড়তেই নাজি বলল, ‘আমি বাইরে যাচ্ছি, তুমি গিয়ে বিশ্রাম করো। একা একা ভাল না লাগলে হারেমে ঘুরাফিরা করতে পার।’
‘ঠিক আছে।’ জুকি বলল।
ও এখানে আসার পর থেকে একবারের জন্যও বেরোতে পারেনি।
নাজি এবং এডরোস চলে যেতেই ও নিজের কক্ষে ফিরে গাউন পরল। কোমরে একটা খঞ্জর গুঁজে হাঁটা দিল হারেমের দিকে। হারেমের মেয়েরা অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকাতে লাগল। এখানে ওর এই প্রথম আসা। সবাই আন্তরিকতার সাথে স্বাগতঃ জানাল ওকে। সেই দুই নর্তকী অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে। কথা বলল হেসে হেসে।
একটু পর বেরিয়ে এল জুকি। হারেম আর নাজির বসত বাড়ির মাঝখানটা নির্জন এবং এবড়ো থেবড়ো। নাজির বাড়ীল দিকে না গিয়ে ও অন্যদিকে চলে গেল।
এদিকে ছিল একটা পায়ে চলার পথ। সে পথ ধরে হাঁটতে লাগল জুকি। ওর পনর বিশ কদম পেছনে এক ছায়ামূর্তি। ছায়ামূর্তি তার চেহারা আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢেকে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছিল তার পিছু পিছু।
কিন্তু সতর্ক জুকি টের পেয়ে গেল। সে তার চলার গতি বাড়িয়ে দিল, বেড়ে গেল ছায়ামূর্তির গতিও। সামনে ঘন ঝোঁপঝাড়। জুকি ঝোঁপের আড়ালে ঢুকে গেল, পেছনে ঢুকল ছায়ামূর্তি।
সেখান থেকে শ’তিনেক গজ দূরে সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর বাসগৃহ। আশপাশে সেনা অফিসারদের বাস ভবন।
জুকি ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আইয়ূবীর বাড়ীর দিকে হাঁটতে লাগল। বায়ে উদয় হল ছায়ামূর্তী। ঝকঝকে জোৎস্নায়ও তার মুখ দেখা যাচ্ছিল না। বিড়ালের মত নিঃশব্দে এগোচ্ছিল সে।
ছায়ামূর্তির হাত উপরে উঠল, বিদ্যুৎ গতিতে একটা খঞ্জর নেমে এল জুকির বাম কাঁধ এবং ঘাড়ের মধ্যখানে।
আঘাত খেয়ে জুকিও কোমর থেকে খঞ্জর বের করল। ছায়ামূর্তি আরেকটা আঘাত করল ওকে। পাশ কেটে নিজেকে বাঁচিয়ে ডান হাতের খঞ্জর ছায়ামূর্তির বুকে আমূল বসিয়ে দিল জুকি।
ভেসে এল এক মরণ চিৎকার। চিৎকারটা নারী কণ্ঠের। জুকি এবার আঘাত করল ছায়ামূর্তির পেটে। মাটিতে পড়ে গেল সে। আক্রমণকারীর দিকে না তাকিয়েই দৌড়াতে লাগল জুকি। রক্ত ঝরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে ও।
সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর বাড়ীর অর্ধেক পথ এখনও বাকী, মাথা ঘুরতে লাগল ওর। গতি শ্লথ হয়ে এল। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে শরীর। সে এখন টলছে, পা পড়ছে এলোমেলো। ভয় হল, সে আর সালাহুদ্দীনির বাড়ি পৌঁছতে পারবে না।
এবার ও চিৎকার করতে লাগল। ‘আলী, আলী, সালাহুদ্দীন।’
রক্তে ভিজে গেছে ওর পোশাক। পা টেনে টেনে এগিয়ে চলছে ও। অনেক কাছে চলে এলেও মনে হচ্ছে সালাহুদ্দীনের বাড়ী পর্যন্ত ও আসলেই পৌঁছতে পারবে না।
ও আলী এবং সালাহুদ্দীন আইয়ূবীকে ডেকেই যাচ্ছিল। ওর ডাকাডাকির শব্দ কানে যেতেই ছুটে এল এক পাহারাদার। টলতে টলতে জুকি তার গায়ের উপরই হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
পাহারাদারকে বলল, ‘আমাকে এক্ষুণি গভর্ণরের কাছে পৌঁছে দাও। জলদি। তাড়াতাড়ি কর।’
শোবার ঘরে বসে আলীর নিকট থেকে রিপোর্ট নিচ্ছিলেন সালাহুদ্দীন আইয়ূবী। পাশে দু’জন পদস্থ কর্মকর্তা। আলীর রিপোর্ট অনুযায়ী সুদানী বাহিনীতে বিদ্রোহের সম্ভাবনা রয়েছে। এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা চলছিল।
আতংকিত প্রহরী ভেতরে প্রবেশ করল। কক্ষের চোখগুলো এক সঙ্গে ঘুরে গেল তার দিকে। প্রহরী বলল, ‘পাহারাদার একজন আহত মেয়ে নিয়ে বাঁইরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা গভর্ণরের সাথে দেখা করতে চাইছে।’
তীরের মত কামরা থেকে বেরিয়ে গেল আলী। পেছনে সালাহুদ্দীন আইয়ূবী। জুকিকে ভেতরে নিয়ে আসা হল। একজনকে পাঠিয়ে দেয়া হল ডাক্তারের জন্য। আইয়ূবী নিজের পালঙ্কে শুইয়ে দিলেন ওকে। রক্তে ভিজে গেল বিছানার চাদর। ‘কাউকে ডাকতে হবে না।’ ক্ষীণ কণ্ঠে বলল জুকি, ‘আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি।’
‘জুকি, তোমাকে কে আহত করেছে?’ আলী প্রশ্ন করলেন।
‘আগে জরুরী কথা শুনুন। এখনি উত্তর-পূর্ব দিকে লোক পাঠিয়ে দিন। দেখতে পাবেন দু’জন অশ্বারোহী দ্রুত ছুটে যাচ্ছে। দু’জনের পরনেই বাদামী পোশাক। দেখতে ব্যবসায়ী মনে হবে। একজনের ঘোড়া ধুসর অন্যেরটা কালো। খৃষ্টান সম্রাট ফ্রাঙ্কের কাছে নাজির লেখা চিঠি আছে ওদের কাছে। নাজি সুদানী বাহিনী নিয়ে বিদ্রোহ করবে। আমি আর কিছুই জানি না। আপনাদের দেশ ভয়ঙ্কর সংকটের মুখে। অশ্বারোহী দু’জনকে পথেই ধরে ফেলতে হবে। ওরা সব কিছু জানে।’ বলতে বলতে থেমে গেল জুকি। জ্ঞান হারিয়েছে ও।
দু’জন ডাক্তার দ্রুত ঘরে ঢুকলেন। রক্তক্ষরণ বন্ধ করার চেষ্টা করতে লাগলেন ওরা। ওষুধ খাওয়ানোর কয়েক মিনিট পর জ্ঞান ফিরে এল ওর।
জ্ঞান ফিরতেই জুকি নাজির সথে এডরোসের কথাবার্তা থেকে শুরু করে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করল। এরপর বলল, ‘আততায়ীকে আমি চিনি না, আঘাত পেয়ে পাল্টা আঘাত করেছিলাম। তার চিৎকার শুনে মনে হয়েছে মহিলা। তবে এখন পর্যন্ত বেঁচে নেই হয়ত।’
সাথে সাথে আক্রমণ স্থলে লোক পাঠিয়ে দেওয়া হল। জুকির রক্তক্ষরণ বন্ধ হল না। ও সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর হাতে চুমো খেয়ে বলল, ‘আল্লাহ আপনাকে এবং আপনার দেশকে অবশ্যই নিরাপদে রাখবেন। আপনি পরাজিত হতে পারেন না। সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর ঈমান কত দৃঢ় আমার চে’ বেশী কেউ জানে না।’
এরপর আলী বিন সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তো দায়িত্ব পালনে অবহেলা করিনি। যে জিম্মা আমাকে দিয়েছিলেন আমি তা পূর্ণভাবে পালন করেছি।’
‘তুমি অনেক বেশী পালন করেছ জুকি।’ আলী বললেন, ‘নাজি এতটা বিপজ্জনক আমি কল্পনাও করিনি, যার জন্য তোমায় জীবন দিতে হল। আমি শুধু তথ্য সংগ্রহের জন্য তোমাকে ওখানে পাঠিয়েছিলাম।’
‘হায়! আমি যদি মুসলমান হতাম।’ বেদনা ঝরে পড়ল জুকির কণ্ঠ থেকে। সাথে সাথে বেরিয়ে এল অশ্রু বন্যা।
‘আমাকে যে বিনিময় দেয়ার কথা ছিল তা আমার অন্ধ পিতা আর চিররোগা মাকে পাঠিয়ে দেবেন। তাদের অপারগতাই বার বছর বয়সে আমাকে নর্তকী হতে বাধ্য করেছিল।’
বাক রুদ্ধ হয়ে এল জুকির। হঠাৎ মাথা একদিকে ঢলে পড়ল। অর্ধনিমলিত চোখ আর ঈষৎ ফাঁক করা ঠোঁট দেখে মনে হচ্ছিল ও মৃদু হাসছে। ডাক্তার ওর নাড়িতে হাত রাখলেন। করুণ চোখে চাইলেন সালাহুদ্দীনের দিকে।
‘ও যেই ধর্মেরই হোক, সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হবে ওকে।’ বললেন সালাহুদ্দীন। ‘ইচ্ছে করলে আমাদের ধোঁকাও দিতে পারত। কিন্তু তার পরিবর্তে ও ইসলামের জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছে।’
প্রহরী এসে বলল, ‘একজন মহিলার লাশ নিয়ে আসা হয়েছে।’ সবাই দেখলো মধ্যবয়সী এক অপরিচিতা মহিলা। আক্রান্ত স্থানে দু’টো খঞ্জর পাওয়া গেল। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, মহিলা ছিল নাজির হারেমের চাকরাণী, যার জন্য কেউ তাকে চিনতে পারেনি।’
অত্যন্ত গোপনে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জুকিকে সমাহিত করা হল। মাটি খুড়ে পুঁতে রাখা হল মহিলার লাশ।
রাতেই সালাহুদ্দীন আইয়ূবী পত্রবাহী অশ্বরোহীদের ধরে আনার জন্য আটজন দুঃসাহসী ঘোড়সওয়ার প্রেরণ করলেন। জুকির নির্দেশিত পথ ধরে ধাওয়া করে ছুটল ওরা। মরুভূমির ধুলো উড়িয়ে দ্রুত এগিয়ে চলল আলী বিন সুফিয়ানের নেতৃত্বে।
জুকি ছিল মরোক্কোর এক নর্তকী। তার ধর্ম সম্পর্কে কেউ জানতে পারেনি। নাজি শত্রুর বিরুদ্ধে সুন্দরী যুবতী এবং হাসিস ব্যবহার করে একথা জানত আলী। তাই সে এক বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে মরক্কো থেকে জুকিকে আনিয়েছিল। এরপর নারী ব্যবসায়ী ছদ্মবেশে নিজেই ওকে নাজির কাছে বিক্রি করেছিল। মেয়েটার মধ্যে ছিল যাদুর চমক। নাজি ওকে সালাহুদ্দীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেল। নাজির গোপন বৈঠকে হাজির থাকত জুকি। সম্বর্ধনার রাতে ওকে আইয়ূবীর তাঁবুতে পাঠিয়ে নাজি ভীষণ খুশী হয়েছিল। এতদিনে পাথর গলানো যাবে, মেয়েটা তাকে মদ খাওয়াবে, এরপর তাকে নিজের ইচ্ছেমত গড়ে নিতে কতক্ষণ—এই ছিল নাজির ভাবনা। কিন্তু নাজি জানত না জুকি আইয়ূবীর চর। সে রাতে ও সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর তাঁবুতে তার ওপর অর্পিত কাজের রিপোর্ট দিয়েছিল। তাঁবু থেকে বেরিয়ে দেখা করেছিল আলীর সাথে। আলী ওকে পরবর্তী নির্দেশ দিয়েছিল। এরপর নাজির বাড়ী থেকে আর বের হওয়ার সুযোগ পায়নি ও। সুযোগ যখন পেল, ঘাতকের খঞ্জর কেড়ে নিল ওর প্রাণ।
জুকির মৃত্যুর পর প্রতিশ্রুত পারিশ্রমিক, নাজির কাছ থেকে নেয়া বিক্রয়লব্ধ অর্থ এবং আইয়ূবীর দেয়া উপহার সামগ্রী মরক্কোয় পাঠিয়ে দেওয়া হল বাপ-মার কাছে।
মৃত্যুর আতঙ্ক জড়ানো বিষন্ন রাতের আঁধার কেটে গেছে। গা জ্বলা তীব্রতা নিয়ে উঁকি দিয়েছে মরু সূর্য। আলী বিন সুফিয়ান তখন জনবসতি থেকে অনেক দূরে। সাথে আটজন সশস্ত্র অশ্বারোহী। যাচ্ছিল উত্তরপূর্ব দিকে। সম্রাট ফ্রাঙ্কোর রাজধানীর পথ আলীর চেনা। ক্লান্ত হলেও আরবী ঘোড়াগুলো এখনও সপ্রতিভ। দূরদিগন্তে দৃষ্টি ছুঁড়লেন আলী। খর্জ্জুরবীথির পাশ ঘেঁষে এগিয়ে যাচ্ছে দু’জন অশ্বারোহী।
পথ পরিবর্তন করে পাহাড়ের আড়াল নিয়ে এগুতে লাগলেন তিনি। আলী ছিলেন মরুভেদী। পথ হারানোর সম্ভাবনা ছিল না। সওয়ার দু’জন এখনও মাইল চারেক দূরে, গতি বাড়িয়ে দিলেন আলী।
অবসন্ন হয়ে পড়েছে ঘোড়া। খর্জুরবীথির কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে সওয়ার দু’জন আরও মাইল দুয়েক এগিয়ে গেছে। চলছে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। ওদের ঘোড়াও সম্ভবতঃ ক্লান্ত। ঘোড়া থেকে নেমে পাহাড়ের আড়ালে চলে গেল লোক দুটো। আলী আবার পথ পরিবর্তন করলেন। দু’দলের মধ্যে দূরত্ব কমে এল। এখন মাত্র কয়েকশ গজের ব্যবধান।
লোক দুটো অশ্বক্ষুরের শব্দে বেরিয়ে এর। আলীদের দেখে দ্রুত ঘোড়ায় চড়ে পালাতে লাগল ওরা। সামনে বালিয়াড়ি। ভয় পেয়ে ওরা একবার ডানে একবার বায়ে যাচ্ছিল। একজন তীরন্দাজ চলতি ঘোড়া থেকে তীর ছুঁড়ল। একজনের ঘোড়ার পায়ে বিঁধতেই লাফিয়ে উঠল ঘোড়াটা। টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ল আরোহী। আলী ওদের ঘিরে ফেললেন। দু’জনকেই বেঁধে ফেলা হল।
আলীর প্রশ্নের জবাবে ওরা নিজেদের ব্যবসায়ী পরিচয় দিল। তল্লাশীর পর পাওয়া গেল নাজির লেখা চিঠি। আলী খানিক বিশ্রাম করে বন্দীদের নিয়ে রাজধানীর পথ ধরলেন।
চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণছিলেন সালাহুদ্দীন আইয়ূবী। দিন শেষে রাত এল। গভীর হয়ে এল রাতও। অনেক রাতে বিছানায় পিঠ লাগালেন সালাহুদ্দীন। ভোর রাতে দরজায় মৃদু করাঘাতের শব্দে জেগে উঠলেন তিনি। তড়িঘড়ি দরজা খুলে দেখলেন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আলী। পেছনে আটজন সওয়ার এবং দু’জন বন্দী। সালাহুদ্দীন সকলকে ভেতরে ডেকে নিলেন। নাজির চিঠি এগিয়ে দিল আলী।
চিঠি খুললেন সালাহুদ্দীন। কয়েক লাইন পড়তেই ক্রোধে বিবর্ণ হয়ে গেল তার চেহারা। পলকে আনন্দ ঝলকে উঠল চোখে মুখে। নাজি তার দীর্ঘ চিঠিতে খ্রিষ্টান সম্রাট ফ্রাংককে আক্রমণের জন্য দিনক্ষণ ঠিক করে দিয়েছে। লিখেছে, রোম উপসাগর উপকূলে নৌবহর থেকে খৃষ্টান সৈন্যরা নেমেই মিসর আক্রমণ করবে। এদিকে বিদ্রোহ করবে পঞ্চাশ হাজার সুদানী ফৌজ। সালাহুদ্দীনের নতুন সৈন্যরা এক সঙ্গে দুই ফৌজ মোকাবিলা করতে পারবে না। এর বিনিময়ে নাজি সমগ্র মিসর অথবা মিসরের একাংশ ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব করেছে।
‘জেলে পাঠিয়ে দেয়া হল বন্দী দু’জনকে। নাজি এবং তার সঙ্গীদের নিজস্ব বাসগৃহে নজরবন্দী করা হল। নাজির হারেমের মেয়েদেরকে ছেড়ে দেয়া হল। বাজেয়াপ্ত করা হল নাজির ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এ সব কিছুই করা হল অত্যন্ত গোপনে ও সতর্কতার সাথে। নাজি লিখিত চিঠি দু’জন দূত মারফত শুধু আক্রমণের তারিখ পরিবর্তন করে ফ্রাঙ্কোর কাছে পাঠিয়ে দিলেন আইয়ূবী। দুই সেনাবাহিনীর একত্রীকরণ সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেয়া হল।
দূত ফিরে এল আট দিন পর। নাজিকে জবাব লিখেছেন ফ্রাঙ্ক। সালাহুদ্দীন যেন আক্রমণ প্রতিহত করতে না পরে এজন্য আক্রমণের দুদিন আগেই বিদ্রোহ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এ সংবাদ গোপন রাখার স্বার্থে সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর অনুমতি নিয়ে আলী দু’জন দূতকে সসম্মানে গৃহবন্দী করে রাখলেন।
রোম উপসাগরের পাড়ে নির্দিষ্ট স্থানের আশপাশে আইয়ূবী নিজের সৈন্যদের লুকিয়ে রাখলেন। আক্রমণের এখনও কয়েকদিন বাকী। পত্রের নির্দেশ মত খৃষ্টান হামলার পূর্বেই নির্দিষ্ট দিনে সুদানী ফৌজ বিদ্রোহ ঘোষণা করল। শক্তি প্রয়োগ না করে ডিপ্লোমেসী এবং সুন্দর ব্যবহার দিয়ে সালাহুদ্দীন এ বিদ্রোহ দমন করলেন। সেনাপতির অনুপস্থিতি ছিল ওদের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।
সুদানী ফৌজ বিদ্রোহ করার দু’দিন পর নির্দিষ্ট তারিখে দেখা গেল খৃষ্টানদের নৌবহর এগিয়ে আসছে। এর মধ্যে ফ্রান্স, গ্রীস, রোম এবং সিসিলির যুদ্ধ জাহাজ ছিল ১৫০টি। এসব জাহাজের মধ্যে ১২টি ছিল খুবই বিশাল। এসব জাহাজ মিসরে অবতরণকারী সৈন্য বহন করছিল।
খৃষ্টানদের এ বাহিনীতে কেবল কমাণ্ডারই ছিল এক লাখ। রসদ এবং অস্ত্র বোঝাই নৌকার সংখ্যা ছিল অগণিত। জাহাজগুলি এগিয়ে আসছিল দুই সারিতে। সালাহুদ্দীন আইয়ূবী নিজে মিসর বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে এগিয়ে গেলেন এর মোকাবেলা করতে।
জাহাজ উপকূলের কাছে আসার অপেক্ষায় রইলেন তিনি। সবচে বড় জাহাজটি কিনারে এল। হঠাৎ জাহাজ লক্ষ্য করে অগ্নি গোলা নিক্ষিপ্ত হতে লাগল। কামানের গোলায় আগুন ধরে গেল পালে। আড়াল থেকে বেরিয়ে এল মুসলমানদের যুদ্ধ জাহাজ। ওদের জাহাজগুলো ছিল কাঠের তৈরী। দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল সাগর বক্ষে। মনে হচ্ছিল আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে নিচ্ছিল সমগ্র রোম উপসাগর।
খৃষ্টান জাহাজগুলো পালাতে গিয়ে পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে আগুন আরও ছড়িয়ে পরল। সৈন্যদের অনেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাগরে। যারা সাঁতরে তীরে উঠার চেষ্টা করছিল আইয়ূবীর তীরন্দাজদের নিশানা হল ওরা।
ওদিকে নুরুদ্দীন জঙ্গী ফ্রান্স সম্রাটের রাজধানী আক্রমণ করলেন। মিসরের দিকে এগিয়ে আসা স্থলবাহিনী এ সংবাদ পেয়ে স্বদেশের দিকে ফিরে চাইল। কিন্তু সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর সাড়াশী আক্রমণের ফলে রোম উপসাগরে সলিল সমাধি হল ওদের। এ যুদ্ধে সম্মিলিত খৃষ্টান নৌশক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল। আগুনে পুড়ে এবং সাগরে ডুবে নিহত হল অসংখ্য নৌ সেনা।
কমাণ্ডার এসমার্ক আত্মসমর্পণ করে সন্ধির প্রস্তাব করল। প্রচুর অর্থের বিনিময়ে তাকে মুক্তি দেয়া হল। গ্রীস এবং সিসিলির কিছু যুদ্ধ জাহাজ বেঁচে গিয়েছিল। আইয়ূবী তাদের ফিরে যাবার অনুমতি দিলেন। কিন্তু হঠাৎ সাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে সব ক’টি জাহাজ নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেল। ১১৬৯ সনের ১৯শে ডিসেম্বর কর প্রদানের শর্তে খৃষ্টানরা সন্ধি চুক্তিতে স্বাক্ষর করল। বলতে গেলে এ বিজয়ের মূল কৃতিত্ব ছিল গোয়েন্দা সংস্থার।
এ ছিল দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী ক্রুসেডের প্রথম লড়াই। ইতিহাসের পাতায় খৃষ্টান ও মুসলমানদের মধ্যে সংঘটিত অসংখ্য লোমহর্ষক ক্রুসেডের যে কাহিনী ছড়িয়ে আছে তা আরও চমকপ্রদ, আরও ঘটনাবহুল।
ঐতিহাসিকরা বলেন, এতো কেবল মাত্র শুরু। সালাহুদ্দীন আইয়ূবী ক্রমেই প্রবেশ করলেন জীবনের বিপজ্জনক সব অধ্যায়ে। যে সব অধ্যায় অতিক্রম করে তিনি হয়েছিলেন গাজী সালাহুদ্দীন। তাঁর সে বিপদজনক জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, সংঘর্ষ এবং রহস্য ও রোমাঞ্চের ভয়াবহ সব জটিল ও কুটিল অধ্যায়।
খৃষ্টানদের সম্মিলিত নৌশক্তি বিধ্বস্ত হয়েছে সাতদিন আগে। উপকূল ছেড়ে জাননি সালাহুদ্দীন আইয়ূবী। এখনও সাগর বক্ষে ঢেউয়ের দোলায় দুলছিল দু’একটি পালছেড়া জাহাজ, মাল্লাহীন নৌকা। জ্বলন্ত জাহাজ থেকে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে বাঁচতে চেয়েছে অনেক সৈন্য। ঢেউয়ের তালে ভেসে বেড়ানো জাহাজ এবং নৌকা তল্লাশীর জন্য সালাহুদ্দীন আইয়ূবী লোক লাগিয়ে দিলেন। অক্ষত নৌকা এবং জাহাজ তীরে নিয়ে আসছিল ওরা। অকেজো জাহাজ থেকে মালপত্র বের করা হচ্ছিল। বেশীর ভাগই অস্ত্র এবং খাদ্য সামগ্রী।
ঢেউয়ের আঘাতে বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ছিল অর্ধদগ্ধ অথবা মাছে খাওয়া লাশ। জাহাজের ভাঙা কাঠ আঁকড়ে সাগরে ভাসছিল কিছু জীবন্ত মানুষ। ঢেউ ওদের তীরে ঠেলে দিচ্ছিল। সমগ্র বেলাভূমিতে পাহারা দিচ্ছিল মুসলিম ফৌজ। আহত খৃষ্টান সৈন্যদের কুড়িয়ে এনে চিকিৎসা করা হচ্ছিল তাদের। ঘোড়ায় চড়ে উপকূল ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন সুলতান আইয়ূবী।
ঘুরতে ঘুরতে ছাউনি থেকে দু’মাইল দূরে চলে এলেন তিনি। সামনে পার্বত্য এলাকা। পাহাড়ের একদিকে সাগর, অন্যদিকে খেজুর, নানা রকম গাছগাছালি এবং লতাগুল্ম ঘেরা প্রান্তর। সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর সাথে তিনজন সেনাপতি ও চারজন দেহরক্ষী।
ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন তিনি। ঘোড়ার বাগ রক্ষীদের হাতে দিয়ে হাঁটতে লাগলেন। সেনাপতি তিনজনও ঘোড়া থেকে নেমে তার সঙ্গ নিল। এদেরই একজন বন্ধু বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ। যুদ্ধের একিদন আগে মাত্র তিনি এখানে এসেছেন।
শীত মওশুমের শান্ত সাগর। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এলেন তিনি। রক্ষীদের দৃষ্টির আড়ালে। সামনে পেছনে ছোট ছোট টিলা আর বালিয়াড়ি। বাঁয়ে পাহাড়। ডানে বেলাভূমির দিগন্ত বিস্তৃত বালুকারাশি। চার পাঁচ হাত উঁচু এক বালিয়াড়িতে উঠে দাঁড়ালেন আইয়ূবী। দৃষ্টি ছুঁড়লেন রোম উপসাগরের নীল জলরাশিতে। মনে হল সাগরের সব নীল জমা হয়েছে তার চোখে। বিজয়ের আনন্দে চেহারা উদ্ভাসিত। নাক কুঞ্চিত করে বললেন, ‘ভীষণ দুর্গন্ধ।’
সৈকতে আছড়ে পড়ল সব ক’টি চোখ। আকাশে ওড়াওড়ি করছে কতগুলো শকুন। ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেল ওরা। সুলতান বললনে, ‘ওখানে মড়া আছে।’
ঢিবি থেকে নেমে চারজনই সেদিকে এগিয়ে গেলেন। পনের বিশগজ দূরে এক ঝাঁক শকুন লাশের মাংস খাচ্ছে। একটা শকুন এক মড়ার মাথার খুলি নিয়ে আকাশে উড়ল। কিন্তু পাঞ্চা থেকে ছুটে গেল মুণ্ডটা। পড়ল এসে সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর সামনে। তিনি মাথাটার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে রইলেন। মাথাটার খোলা চোখ আইয়ূবীর দিকে তাকিয়ে আছে যেন।
সালারদের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তিনি বললেন, ‘এ মাথাটা মুসলমানদের মাথা থেকে অনেক ভাল। এ মস্তিষ্কের জোরেই ওরা নারী আর মদে মাতাল করে দিচ্ছে সমগ্র মুসলিম খেলাফত।’
‘ওরা ইঁদুরের মত মুসলিম বিশ্বকে কুরে কুরে খাচ্ছে সুলতান।’ বললেন এক সেনাপতি।
আরেকজন বললেন, ‘আমাদের সম্রাটগণ ওদের নিয়মিত কর দিয়ে যাচ্ছে।’
শাদ্দাদ বললেন, ‘ফিলিস্তিন ওদের দখলে সুলতান। আমরা কি কোনদিন তা পুনরুদ্ধার করতে পারব না?’
‘আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়োনা শাদ্দাদ।’
‘আল্লাহর রহমত থেকে না হলেও আমরা আমাদের ভাইদের দিক থেকে নিরাশ হয়ে পড়েছি।’
‘তুমি ঠিকই বলেছ। বাইরের আক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। একবারও কি ভেবেছ, কি করে খৃষ্টানদের এতবড় নৌশক্তি আমরা নিঃশেষ করে দিলাম? খোলা ময়দানে নয়, শুধু কমাণ্ডো হামলার মাধ্যমে। ওদের ফৌজ সমগ্র মিসর ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু বন্ধুরা, ভেতরের আক্রমণ এত সহজে ঠেকানো সম্ভব হত না। ভাই আক্রমণ করলে ভাববে, সত্যিই কি ভাই আক্রমণ করেছে! যখন তার বিরুদ্ধে তরবারী তুলবে, দুশমন এ সুযোগ নেবে, নিঃশেষ করবে দু’জনকেই।’
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এগিয়ে চললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবী। কিছু দূর এগিয়ে কি দেখে থমকে দাঁড়ালেন। নুয়ে মাটি থেকে জিনিসটা তুলে দেখালেন সবাইকে।
একটা ক্রুশ, তাগায় বাঁধা।
ছড়িয়ে থাকা লাশগুলোর দিকে তাকালেন আবার। আগেই সেই খুলিটা নিয়ে ঝগড়া করছে তিনটে শকুন।
দ্রুত মাথাটার কাছে গেলেন তিনি। ক্রুশটা সেই মাথার ওপর রেখে ফিরে এলেন সঙ্গীদের কাছে। বললেন, ‘আমি এক বন্দী খৃষ্টান অফিসারের সাথে কথা বলেছি। ও বলেছে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হবার সময় সকলকেই ক্রুশের ওপর হাত রেখে শপথ করতে হয়। জীবন বাজি রেখে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শপথ নেয়ার পর সব সৈনিকের গলায় একটি করে ক্রুশ ঝুলিয়ে দেয়া হয়। জানি না কুড়িয়ে পাওয়া এ ক্রুশটি কার? ক্রুশের জন্যই এরা জীবন দিয়েছে। খুলিটার ওপর ক্রুশটা রাখলাম, একজন সৈনিকের শপথের অমর্যাদা যেন না হয়।’
‘সুলতান’, শাদ্দান বললেন, ‘জেরুজালেমে খৃষ্টানরা মুসলমানদের কি মর্যাদা দিচ্ছে আপনি জানেন? ওখান থেকে স্ত্রী পরিজন নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে মুসলমানরা। লুন্ঠিত হচ্ছে আমাদের মেয়েদের ইজ্জত। এখনও আমাদের বন্দীদের ওরা ছেড়ে দেয়নি। মুসলমানরা ওখানে পশুর মত জীবন যাপন করছে। আমরা কি এর প্রতিশোধ নেব না?’
‘প্রতিশোধ নয় শাদ্দাদ, আমরা ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার করতে চাই। কিন্তু আমাদের শাসকরাই এ পথের বড় বাঁধা। ওরা ক্রুশ স্পর্শ করে মুসলিম বিশ্বকে নিঃশেষ করার শপথ নিয়েছে, আমিও আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে বুকে হাত দিয়ে শপথ করে বলছি, অবশ্যই ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার করব। কিন্তু বন্ধুরা, আমাদের ভবিষ্যত ইতিহাস আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে।’
এক সময় ওরা শাসক ছিল, আমরা ছিলাম যোদ্ধা। এখন মুসলমান শাসক হচ্ছে ওরা দখল করে নিচ্ছে যুদ্ধের ময়দান। আমার মনে হয় মুসলমানরা শাসক হলেও নেতৃত্ব থাকবে খ্রীষ্টানদের হাতে। শাসক হতে পেরেই ওরা সন্তুষ্ট থাকবে। আমি ফিলিস্তিন জয় করব কিন্তু ওরা তা রক্ষা করতে পারবে না। খৃষ্টানদের মস্তিষ্ক অত্যন্ত উর্বর। পঞ্চাশ হাজার সুদানী ফৌজ কারা লালন করছে? আমাদের খেলাফতের পোশাকে লুকিয়ে আছে নাজির মত কালকেউটে। এরা দেশের জন্য বিপজ্জনক। আমিই প্রথম গভর্ণর যে এ সত্যটা বুঝতে পেরেছি। নাজির চিঠি আমাদের হাতে না এলে এতক্ষণে আমাদের রক্ত মিশে যেত মরুর বালুকারাশির সাথে, নয়ত হতাম ওদের হাতে বন্দী।’
আইয়ূবী আবেগাপ্লুত কণ্ঠে কথা বলে যাচ্ছেন, আকস্মাৎ পেছন থেকে শনশন শব্দে ছুলে এল একটা তীর। সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর দু’পায়ের ফাঁকে বালিতে গেঁথে গেল তীরটা। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে পিছনে ফিরে পাহাড়ের দিকে তাকালেন সবাই। আরও তীর আসতে পারে ভেবে দৌড়ে এক পাহাড়ের আড়ালে দাঁড়ালেন।
শীস দিলেন শাদ্দাদ। নীচে থেকে ছুটে এল রক্ষীরা।
‘ঘোড়াগুলো এখানে রেখে তোমরা পাহাড়ের ওপাশে চলে যাও।’ রক্ষীদের বললেন সুলতান, ‘ওদিক থেকেই তীর এসেছে। কাউকে দেখলে গ্রেফতার করবে।’
যেদিক থেকে তীরটা ছুটে এসেছিল সাবধানে সেদিকে এগোতে শুরু করল রক্ষীরা। সেনাপতিরা দ্রুত পাহাড়ে উঠতে লাগলেন। ওদের নিষেধ উপেক্ষা করে তাদের সাথে এগিয়ে চললেন সালাহুদ্দীন আইয়ূবী নিজেও।
পাহাড়ে উঠে দাঁড়ালেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবী। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত পর্বতমালা। কোনটা উঁচু, কোনটা নীচু। সালারদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলেন চারদিক। জনমানুষের চিহ্নও নেই। রক্ষীরা ঘোড়া ছুটিয়ে বিভিন্ন পাহাড় খুঁজে দেখল। কেউ নেই। যেন হাওয়া থেকে ছুটে এসেছে তীরটা।
সালাহুদ্দীন আইয়ূবী ফিরে এলেন তীরের কাছে। হাত লাগতেই পড়ে গেল ওটা। তীরটা হাতে নিলেন সুলতান। বললেন, ‘অনেক দূর থেকে এসেছে, এ জন্য হালকা ভাবে বিঁধেছে। তবে তীরটা গুপ্তঘাতকদের নয়, খৃষ্টানদের।’
‘সুলতানের জীবন বিপন্ন।’ বললেন এক সেনাপতি।
হেসে উঠলেন সালাহুদ্দীন আইয়ূবী, ‘এবং সব সময় ঝুঁকিপূর্ণই থাকবে।’ বললেন তিনি। ‘খৃষ্টানদের যেসব নৌকা মাঝা মাল্লা ছাড়া ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে, আমি তা দেখতে বেরিয়েছি। কিন্তু বন্ধুরা ওদের সব তরীই মাল্লাহীন নয়। ওরা আবার আসবে, আসবে ঝড়ের গতিতে। আঘাত করতে মাটির নীচ থেকে, পিছন থেকে। যুদ্ধের স্বাভাবিক নিয়মে ওদের সাথে মোকাবিলা করা যাবে না। আমি যুদ্ধ পলিসিতে এক নতুন পদ্ধতি সংযোজন করব। এ পলিসি সম্পূর্ণ আনকোরা, নতুন। গেরিলা অপারেশনে আনব নতুন মাত্রা। কমাণ্ডো এবং গোয়েন্দাদেরই থাকবে এতে প্রধান ভূমিকা।
তীরটা হাতে নিয়েই ঘোড়ায় চাপলেন সালাহুদ্দীন আইয়ূবী। এগিয়ে গেলেন শিবিরের দিকে। ডানে, বাঁয়ে এবং পেছন থেকে সালাহুদ্দীন আইয়ূবীকে অনুসরণ করে এগিয়ে চললেন সেনাপতি তিনজন।
বলতে গেলে অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন সালাহুদ্দীন আইয়ূবী। কিন্তু তিনি ছিলেন এ ব্যাপারে নিরুদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠাহীন। যেন কিছুই হয়নি।
তাঁবুতে ফিরে সালারদে নিয়ে বসলেন। তাদের সামনে তুলে ধরলেন গেরিলা আক্রমণ এবং কমাণ্ডো হামলার বিভিন্ন দিক। বললেন, ‘আমি আলী বিন সুফিয়ানকে শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী গঠন করার নির্দেশ দিয়েছি। তোমরা সেনাবাহিনী থেকে স্বাস্থ্যবান এবং মেধাবী যুবকদের বাছাই কর। ওরা হবে দুরদর্শী, বুদ্ধিমান। ওদের থাকবে উটের মত দীর্ঘ সময় ক্ষুধাতৃষ্ণা সহ্য করার ক্ষমতা। গতি হবে চিতাবাঘের মত ক্ষিপ্র। ঈগলের মত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং খরগোশ ও হরিণের মত দ্রুতগামী হবে ওরা। এদের থাকবে সশস্ত্র শত্রুর সাথে খালি হাতে লড়াই করার ক্ষমতা, নেশা ও পরনারীর প্রতি আসক্ত হবার লোভ থেকে মুক্ত।
খৃষ্টানরা আমাদের মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে চায়। সুন্দরী মেয়েদের ব্যবহার করছে গোয়েন্দা কাজে। ওরা নিঃশেষ করে দিতে চাইছে আমাদের ঈমানী আবেগ। আমি দেখছি মুসলমানরা নারীদের ব্যাপারে অত্যন্ত দুর্বল। আমি গোয়েন্দাগিরি বা অন্য কোন কাজে কোন মেয়ে ব্যবহারের পক্ষপাতি নই। আমরা নারীর ইজ্জত আব্রুর রক্ষক। নারীর ইজ্জতকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা আমাদের কাজ নয়। আলী গোয়েন্দা কাজে কয়েকটি মেয়েকে ব্যবহার করছে। ওরা না মুসলিম না খৃষ্টান। কিন্তু কোন ধর্মাধর্ম নয়, আমি নারীকে নারী হিসেবেই সম্মান করি।’
তাঁবুতে ঢুকল রক্ষী দলের কমাণ্ডার। বলল, ‘রক্ষীরা কয়েকজন মেয়ে ও পুরুষকে ধরে এনেছে।’
বেরিয়ে এলেন সালাহুদ্দীন আইয়ূবী। তার পিছু নিলেন তিন সেনাপতি। বারজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। পাঁচজন পুরুষ, সাতজন মেয়ে। মালপত্র দেখে মনে হচ্ছে ব্যবসায়ী। মেয়েগুলো অপূর্ব সুন্দরী। রক্ষীরা বলল, ‘তীর নিক্ষেপকারীকে খুঁজতে গিয়ে এদের পাওয়া গেছে। তিনটি উটসহ একটি তাঁবুতে অপেক্ষা করছিল ওরা।’
‘এদের কি তল্লাশী নেয়া হয়েছে?’ এক সেনাপতি প্রশ্ন করলেন।
‘জ্বী, ওদের দেহ এবং মালপত্র তল্লাশী নেয়া হয়েছে। খঞ্জর ছাড়া কোন অস্ত্র পাওয়া যায়নি।’
‘আমরা মরক্কোর ব্যবসায়ী।’ ওদের একজন বলল, ‘যাব ইস্কান্দারিয়া পর্যন্ত। দু’দিন আগে আমরা যখন দশ ক্রোশ পেছনে তখন এ মেয়েগুলো আমাদের কাছে আসে। ভেজা কাপড়, বিধ্বস্ত চেহারা। বলল, বাড়ী সিসিলি। এদিকে আসার পথে এক খৃষ্টান কমাণ্ডোর ওদেরকে উপকুল থেকে ধরে নিয়ে আসে। ওরা আমাদের সাহায্য চাইল। অসহায় মেয়েগুলোর জন্য মায়া হল আমাদের। সেই থেকে ওরা আমাদের সঙ্গে।’
‘এদের সম্পর্কে আর কি জান তুমি?’
‘এরা বলেছে, এরা গরীব ঘরের সন্তান। জাহাজে এনে অফিসাররা এদের সতীত্ব নষ্ট করেছে। যুদ্ধের সময় গোলার আঘাতে হঠাৎ ওদের জাহাজে আগুন ধরে গেলে সবাই সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। সাঁতার জানে না বলে এদেরকে একটা ছোট্ট নৌকায় তুলে দিল সৈন্যরা। এরা নৌকা বাইতে জানে না। ঢেউয়ের ধাক্কায় একসময় নৌকা কিনার স্পর্শ করল। আমরা তখন উপকূল থেকে সামান্য দূরে বিশ্রাম করছিলাম। তখনই ওরা আমাদের কাছে আসে।’
‘তারপর?’
‘প্রথমে ভেবে পেলাম না কি করব, ওদের সাথে নেয়া ঠিক হবে কিনা। পরে অসহায় ভেবে আশ্রয় দিলাম, সাথে নিয়েই এগিয়ে চললাম। পেছনের তাঁবুতে আপনার লোকেরা আমাদের তল্লাশী নিতে লাগল। কারণ জিজ্ঞেস করায় বলল, মিসরের গভর্ণর সুলতান আইয়ূবীর নির্দেশ। আমরা অনুনয় বিনয় করে বললাম, আমাদেরকে সুলতানের কাছে পৌঁছে দাও।’
‘কেন তোমরা সুলতানের কাছে আসতে চাইলে?’
‘এ মেয়েগুলোকে আশ্রয় দেয়ার জন্য সুলতানকে অনুরোধ করব। আমরা ব্যবসায়ী, কোথা থেকে কোথায় যাই তার তো ঠিক নেই। এদের আমরা কতক্ষণ বয়ে বেড়াবো?’
মেয়েদেরকে জিজ্ঞেস করা হল। ওরা কথা বলল, সিসিলির ভাষায়, দু’তিনজন এক সঙ্গে। আতঙ্কিত চোখ।
সুলতান ব্যবসায়ীদের দিকে চাইলেন।
‘তোমরা কি এদের ভাষা বোঝ?’
একজন এগিয়ে এল। ‘জ্বী, কেবলমাত্র আমিই বুঝি। ওদের আশ্রয় দেয়ার জন্য মহানুভব সুলতানকে অনুরোধ করছে ওরা। ওরা বলছে, ব্যবসায়ীদের সাথে ওরা যাবে না। চারদিকে যুদ্ধ চলছে। ভয় আছে চোর ডাকাতের। ওরা আরও বলছে, খৃষ্টান সৈন্যদের ওরা ভীষণ ভয় পায়। অপহরণের সময় ওরা সবাই কুমারী ছিল। জাহাজে ওদের সতীত্ব হরণ করা হয়েছে।’
অন্য একটা মেয়ে কিছু বলল, দোভাষী বলল, ‘মেয়েটি বলছে, আমাদেরকে মুসলমানদের রাজার কাছে নিয়ে চল। হয়ত তিনি আমাদেরকে আশ্রয় দেবেন।’
অপর একটি মেয়ে কান্না ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘আমাদেরকে খৃষ্টান সৈন্যদের কাছে ফিরিয়ে দিও না। আমরা মুসলমান হয়ে যাব।’ বলল আরেক মেয়ে।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা মুসলমান হয়ে যাব। কোন মুসলমান দয়া করে আমাদের বিয়ে করলে আমরা আর দেশেও ফিরে যাব না, আমরা এখানেই থেকে যাব।’ বলল আরেক মেয়ে।
তার কথা শুনে চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে দু’তিনটি মেয়ে মুখ লুকানোর চেষ্টা করছিল, যেন ওরা লজ্জায় মরে যাচ্ছে।
সুলতান বললেন, ‘এদেরকে খৃষ্টান সৈন্যদের কাছে তুলে দেয়া হবে না। মুসলমান হওয়ার জন্যও ওদের বাধ্য করবে না কেউ। ওরা যদি আমাকে বিশ্বাস করে মুসলিম মেয়েদের মতই ওদের আশ্রয় দেব। জেরুজালেমের খৃষ্টান ফাদার বা পাদ্রীর কাছে পাঠিয়ে দেব রাজধানীতে গিয়ে। অথবা খৃষ্টানদের সাথে বন্দী বিনিময়ের সময় ওদেরকে স্বদেশ পাঠিয়ে দেয়া হবে। ওদের প্রয়োজন এবং মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রাখা হবে। কিন্তু কেউ বিয়ে করলে মুসলমান হবে এ প্রস্তাব গ্রহণ করা যাবে না। এমনকি কোন মুসলমানের সাথে ওরা মিশতেও পারবে না।’
ব্যবসায়ী সুলতানের কথা মেয়েদের বুঝিয়ে বলল। স্বস্থির ভাব ফুটে উঠল ওদের চেহারায়। সুলতানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ফিরে গেল ব্যবসায়ীরা।