সিএসএস পরীক্ষার প্রস্তুতি

১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে আমাদের এমএ পরীক্ষা শেষ হয়। এমএ পরীক্ষার পর আমি বিশ্রামের জন্য নবীনগর যাই। তখন একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে। আমরা চার ভাই। আমার জন্ম ১৯৪৪ সালে। আমার ছোট ভাই জি এম জিয়াউদ্দিন খানের জন্ম ১৯৪৬ সালে। তার ছয় বছর পর আমাদের। তৃতীয় ভাই তসলিম উদ্দিন খানের জন্ম হয়। সবচেয়ে ছোট ভাই কবিরউদ্দিন। খানের জন্ম হয় ১৯৫৪ সালে। পরিবারের সবাইকে তসলিম খুবই ভালোবাসত। কিন্তু সে খুব দুষ্টু ছিল। একবার টিনের ঘরের চালে উঠে লাফালাফি করে মাটিতে পড়ে যায়। এতে মাথায় প্রচণ্ড চোট পায়। প্রথম দু তিন মাস কোনো খারাপ লক্ষণ দেখা যায়নি। তারপর তার খিচুনি ওঠা শুরু হয়। অনেক সময় খিচুনি সপ্তাহখানেক পর্যন্ত থাকত। স্থানীয় ডাক্তাররা প্রকট মৃগীরোগ বলে এ রোগকে চিহ্নিত করেন। সপ্তাহব্যাপী একটি বিরতিহীন খিচুনিতে পরিবারের সবাইকে কাঁদিয়ে সে মারা যায়।

জুন-জুলাই মাসে আমাদের ফলাফল প্রকাশিত হয়। আমি এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করে উত্তীর্ণ হই। ওই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে চারজন সহকারী অধ্যাপক নিয়োগ করা হয়। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাব। যখন পেলাম না, তখন ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদের সঙ্গে এই খবর মানসিকভাবে মড়ার উপরে খাড়ার ঘায়ের মতো আমার জন্য মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি না পাওয়ায় আমার অনেক অসুবিধা হয়। ভেবেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি হলে আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে একটি কক্ষ বরাদ্দ নিয়ে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করব। সেটা সম্ভব হলো না, আমাকে আমার চাচাতো ভাই আনোয়ার আলী খাঁনের ওপরই নির্ভরশীল থাকতে হলো। অবশ্য তার আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না। তখন আমি একজন চেইন স্মোকার ছিলাম। সিগারেটের জন্য এবং বিভিন্ন পাঠাগারে যাতায়াতের জন্য আমার অর্থের প্রয়োজন ছিল। ছাত্রজীবন শেষ হওয়ায় কোনো বৃত্তি পাচ্ছিলাম না। তাই টাকাপয়সার অভাব খুবই অনুভব করি। কয়েক মাস পরে এই অভাব আংশিকভাবে দূর হয়। পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগে ইতিহাসের একজন খণ্ডকালীন অধ্যাপকের জন্য কাগজে বিজ্ঞপ্তি বের হয়। আমি দরখাস্ত করি। প্রায় তিন সপ্তাহ পর আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরাসরি নিয়োগপত্র পাঠিয়ে দেয়। আমি স্থাপত্য বিভাগে দুই সেমিস্টার বিশ্বসভ্যতা সম্বন্ধে একটি কোর্স পড়াই। খণ্ডকালীন শিক্ষকের বেতন ছিল দেড় শ টাকা। এই দেড় শ টাকায় টেনেটুনে আমার ব্যক্তিগত খরচ মেটানো সম্ভব হয়েছিল। সভ্যতার ইতিহাস পড়াতে আমার ভালো লাগত। মনে হয় অধিকাংশ ছাত্রেরও আমার বক্তৃতা ভালো লাগত।

সিএসএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিই। এ ধরনের পরীক্ষার জন্য ছোট ছোট দলে আলাপ-আলোচনা করে প্রস্তুতি নিতে সুবিধা হয়। আমি তখন এলিফ্যান্ট রোডে থাকতাম। আমার বাসার উল্টো দিকে থাকতেন আবদুশ শাকুর। তিনি আমার এক বছর আগে এমএ পাস করেন এবং ঢাকা কলেজে তখন তিনি অধ্যাপনা করছিলেন। তার বড় ভাই হাই সাহেব ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। তাঁকে তখন ঢাকার বাইরে পদস্থ করা হয়। তিনি এলিফ্যান্ট রোডে তখন একটি বেশ বড় বাড়ি নির্মাণ করছিলেন। দোতলার কয়েকটি কক্ষে তাঁর স্ত্রী মেয়েদের নিয়ে থাকতেন। আবদুশ শাকুরকে একটি বড় রুম ছেড়ে দেওয়া হয়। এই কক্ষে আবদুশ শাকুর, আমি এবং জিয়াউল আনসার–এই তিনজন পরীক্ষাসংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। জিয়াউল আনসার তখন সমাজকল্যাণ কলেজের একজন গবেষক। তাঁর অফিসও এলিফ্যান্ট রোডের খুব কাছেই ছিল। সাধারণত আমরা বিকেল চারটার দিকে আলোচনা শুরু করতাম এবং এই আলোচনা রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত চলত। প্রচুর চা-বিস্কুট খাওয়া হতো। এর ব্যয় অবশ্য সম্পূর্ণ বহন করতেন আবদুশ শাকুর। এ ছাড়া আবদুশ শাকুরের সঙ্গে পড়াশোনা করার একটি সুবিধা ছিল যে তিনি ঢাকা কলেজ লাইব্রেরি থেকে প্রয়োজনীয় বইপত্র বাড়িতে নিয়ে আসতে পারতেন। সুতরাং বইপত্রের সমস্যারও অনেকটা সমাধান হয়।

যথাসময়ে লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। আমি এবং আবদুশ শাকুর উত্তীর্ণ হই, জিয়াউল আনসার পাস করতে পারেননি। এরপর ধানমন্ডিতে কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস অফিসে আমাদের ভাইভা হয়। ভাইভার (মৌখিক পরীক্ষা) আগে একদিন আমাদের মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়। তবে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় কোনো প্রভাব ভাইভার নম্বরের ওপরে পড়ত না। মনস্তাত্ত্বিক ভাইভা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে প্রার্থীর ব্যক্তিগত প্রবণতা সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন পাঠাতেন। বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন নাজির আহমদ। তিনি ১৯৩৮ সালের আইসিএস অফিসার ছিলেন। বোর্ডে অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক জনশিক্ষা বিভাগের পরিচালক ফজলুর রহমান ও ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের সদস্য এ এম সাদুল্লাহ। এ ছাড়া বিভাগীয় প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। আমাকে প্রায় ২০ মিনিট ভাইভা বোর্ডে রাখা হয়। আমাকে বেশির ভাগ প্রশ্ন করা হয় আর্ট সম্পর্কে। যেহেতু আমি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগের ছাত্রদের পড়াচ্ছি, সেহেতু ইসলাম ধর্মে চিত্রকলা জায়েজ কি না, সে সম্পর্কে আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন করা হয়েছিল। ভাইভায় আমি মোট ৩০০ নম্বরে ২০০ নম্বর পাই।

১৯৬৭ সালের জানুয়ারি মাসে ভাইভা পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপকের একটি পদ খালি হয়। তারা এ পদের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়। আমি দরখাস্ত করি। আমাকে ইন্টারভিউর জন্য ডাকা হয়। ইন্টারভিউ এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হয় যে তখন সিএসএস পরীক্ষার ফলাফল বের হওয়ার সময় হয়ে এসেছে। আমি শেষ পর্যন্ত ইন্টারভিউ দিতে যাইনি। সিএসএস পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে দেখা গেল আমি সারা পাকিস্তানে সিএসএস পরীক্ষায় ১৬তম স্থান। অধিকার করেছি। এর মধ্যে চারজন পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যাওয়ার ইচ্ছা। ব্যক্ত করেছে। সিএসপিতে আমার স্থান হয় ১২ নম্বরে। সে বছর সারা। পাকিস্তানে ২০ জন সিএসপি নিয়োগ করা হয়। সুতরাং কোনো কোটা ছাড়াই। আমি সিএসপিতে নির্বাচিত হই।

সিএসএস পরীক্ষার ফলাফল আগস্ট ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়। আমি লাহোর যাওয়ার আগে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য নবীনগরে যাই। ওই সময় আমার ছোট ভাই জিয়াউদ্দিন খান ন্যাশনাল অ্যান্ড গ্রিনলেজ ব্যাংকে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করছিল। সেও একই সময়ে শিক্ষানবিশের চূড়ান্ত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে ৯ মাসের জন্য লন্ডনে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হয়। সে-ও ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে। আমরা বাড়িতে বেশ হইচই করে দিন কাটাই। আমরা ঠিক করলাম যে দেশ ছাড়ার আগে রেখা আপা ও ফুফু ফুফাঁদের মধ্যে যারা জীবিত আছেন, তাঁদের সঙ্গে দেখা করে বিদায় নিয়ে আসব। প্রথমে আমরা নৌকা করে গেলাম বাইরা গ্রামে রেখা আপার বাড়িতে। সেখানে রাতে থেকে পরদিন আমরা সকালবেলা নৌকা করে গেলাম রতনপুর। সেখানে ছোট ফুফুর সঙ্গে দেখা হয়। তারপর নৌকায় করে আসলাম কালঘরায়। সেখানে মেজ ফুফুর সঙ্গে দেখা হলো। সবশেষে গেলাম শাহাবাজপুরে, সেখানে দেখা হলো ফুফার সঙ্গে। এরপর মেঘনা নদী দিয়ে সেদিনই প্রায় রাত ১০টার দিকে নবীনগর এসে পৌঁছাই। ফুফু-ফুফাঁদের সঙ্গে সেই আমাদের শেষ দেখা। নৌকায় করে এটাই ছিল আমাদের নবীনগরে খাল-বিল দিয়ে শেষ ভ্রমণ। এখন আর খালপথে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়; বেশির ভাগ খাল এখন ভরাট হয়ে গেছে।