প্রথম পশ্চিম পাকিস্তান সফর

১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে যখন আমরা এমএ পড়ি, তখন পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ লাগে। তিন সপ্তাহের মধ্যে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। তবে এ যুদ্ধের ফলে একাডেমিক ক্যালেন্ডার ওলটপালট হয়ে যায়। সাধারণত ডিসেম্বরের আগে এমএ পরীক্ষা হতো। আমাদের ব্যাচে এ পরীক্ষা ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারির আগে কোনোমতেই নেওয়া সম্ভব ছিল না।

১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরের আগে আমি কখনো উড়োজাহাজে চড়িনি। পেট্রলের গন্ধে আমার বমি আসত। আমি পারতপক্ষে বাসে উঠতাম না। বিমানে কয়েক ঘণ্টা বসে থাকতে পারব কি না, সে সম্বন্ধেও সন্দেহ ছিল। বিশেষ করে বিমানযাত্রীদের প্রায়ই বিবমিষা হতো। আগস্ট ১৯৬৫-এর শেষ দিকে সলিমুল্লাহ হলের প্রভোস্ট মফিজউদ্দিন আহমদ আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি জানান, পাকিস্তানের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তান থেকে একটি ছাত্র ডেলিগেশন পশ্চিম পাকিস্তানের উপজাতি এলাকায় শিক্ষাসফরে পাঠানো হবে। এই সফরের উদ্দেশ্য হলো পশ্চিম পাকিস্তানের উপজাতি অঞ্চল এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তোলা। প্রভোস্ট বললেন, তোমাকে সলিমুল্লাহ হলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। দিন সাতেকের মধ্যে ডেলিগেশন পশ্চিম পাকিস্তানে যাবে, তুমি তৈরি হয়ে নাও।

৭ আগস্ট ১৯৬৫-এর কাছাকাছি সময়ে আমি ঢাকা বিমানবন্দর থেকে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের বিমানে করাচি রওনা হই। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের ফলে পাকিস্তানের কোনো বিমান ভারতের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে উড়তে পারত না। তাই আমাদের বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে পাঁচ ঘণ্টা উড়ে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে যেতে হবে। ঘণ্টাখানেক বিরতির পর আবার সাড়ে চার ঘণ্টা উড়ে করাচি বিমানবন্দরে যেতে হবে। সৌভাগ্যবশত বিমানে আমার কোনো শারীরিক অসুবিধা হয়নি। বরং বেশ আরামের সঙ্গেই করাচি পৌঁছাই।

আমাদের ডেলিগেশনে প্রায় ২০ জনের মতো সদস্য ছিল। ফজলুল হক হল থেকে পদার্থবিজ্ঞানের বিশিষ্ট ছাত্র সৈয়দ তারিক আলি ছিলেন (যিনি পরবর্তীকালে কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক ছিলেন); নটর ডেম কলেজ থেকে কাজী জাফর উল্যাহ (যিনি পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা হয়েছেন) ছিলেন; আর জগন্নাথ কলেজ থেকে ছিলেন আমিনুল হক বাদশা (যিনি পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর প্রেস সচিব হয়েছিলেন)।

করাচিতে যাওয়ার পর আমাদের জানানো হয়, আমাদের সরাসরি পেশোয়ার যেতে হবে। করাচি বিমানবন্দরে কয়েক ঘণ্টা বিরতির পর আমরা পেশোয়ারের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাই। ইসলামাবাদ বিমানবন্দর হয়ে আমরা পেশোয়ার বিমানবন্দরে পৌঁছাই। বিমানবন্দর থেকে আমাদের শাহি মেহমানখানা’ নামে একটি গেস্টহাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। শাহি মেহমানখানায় রাজকীয় বিলাসিতা দূরের কথা, অনেক প্রয়োজনীয় সুবিধাও ছিল না। গরমের মধ্যে এই মেহমানখানায় থাকতে খুবই অসুবিধা হয়েছে।

পেশোয়ার থেকে আমাদের একদিন মানকি শরিফে নিয়ে যাওয়া হয়। মানকি শরিফ পেশোয়ার জেলার নওশেরা মহকুমায় অবস্থিত। মানকি শরিফের পীর সাহেব একজন মুসলিম লিগ নেতা ছিলেন এবং তার মৃত্যুর পর তার ছেলে পীর সাহেবের গদিতে বসেছেন। সেখানে আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয় এবং আমাদের প্রত্যেককে একটি করে মানকি শরিফের টুপি দেওয়া হয়। পরে এ টুপি আমি বহুদিন ব্যবহার করেছি। পেশোয়ার থেকে আমাদের আফগান সীমান্তে লান্ডিকোটাল শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের জানানো হয় যে লান্ডিকোটাল পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হলেও লান্ডিকোটাল অনিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে অবস্থিত। সেখানে প্রশাসনে উপজাতিদের নিজস্ব ভূমিকা ছিল।

পেশোয়ার থেকে আমাদের কোহাট নিয়ে যাওয়া হয়। কোহাটের বন্দুক তৈরির একটি কুটিরশিল্প ছিল। আমাদের বন্দুক তৈরির কারখানা দেখানো হয়। সেখানকার উপজাতিরা আমাদের জানায়, ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য যত বন্দুক দরকার, তত বন্দুক সরবরাহ করার জন্য তারা অবশ্যই চেষ্টা করবে।

পেশোয়ার থেকে চার দিনের সফরে আমাদের সোয়াত নিয়ে যাওয়া হয়। সোয়াত তখনো একটি দেশীয় রাজ্য। সোয়াতের ওয়ালি তখনো সোয়াতের প্রশাসনের প্রধান। তার বড় ছেলের সঙ্গে আইয়ুব খানের বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছিল। তাই ওয়ালি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী। সোয়াতে আমাদের মিনগোরা নামে একটি শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। এই শহর ছিল সোয়াতের রাজধানী সাইদু শরিফ থেকে তিন-চার মাইল দূরে। মিনগোরাতে আমাদের কারিগরি মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে রাখা হয়। কারিগরি মহাবিদ্যালয়ে তখন ছুটি ছিল। কাজেই পুরো ছাত্রাবাসে আমরাই ছিলাম একমাত্র বাসিন্দা। ছাত্রাবাসটির মান বেশ উন্নত ছিল। পরদিন আমাদের সাইদু শরিফে নিয়ে যাওয়া হয়। সোয়াতের ওয়ালির পরিবারের পক্ষ থেকে একজন আমাদের স্বাগত জানায়। সাইদু শরিফের বিভিন্ন জায়গা আমাদের ঘুরিয়ে দেখানো হয়। বিশেষ করে আমরা সোয়াত জাদুঘরটি ঘুরে দেখি, যেখানে বৌদ্ধ সংস্কৃতির অনেক নিদর্শন ছিল। পরের দিন আমাদের সোয়াতের উত্তাঞ্চলে কালাম নগরীতে নিয়ে যাওয়া হয়। কালাম নগরী সোয়াত নদীর তীরে অবস্থিত। তখন সেপ্টেম্বর মাস। ওই সময় উত্তর দিকে বরফ পড়ছিল এবং নদীর জলে বরফ ভেসে আসছিল। কালাম নগরী থেকে আমাদের মিনগোরাতে নিয়ে আসা হয়। এরপর আমরা পেশোয়ারে ফিরে আসি। পেশোয়ার থেকে বিমানে করে আমাদের সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় কোয়েটা শহরে।

কোয়েটা শহরে বোলান হোটেল নামে একটি নামী হোটেলে আমাদের রাখা হয়। আমাদের কোয়েটা শহরের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য স্থান দেখানো হয়। একদিন আমাদের কালাত বিভাগের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই বিদ্যালয়ের ছাত্ররা আমাদের বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান গেয়ে শোনায়। আমরাও পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার জন্য ডাক দিই। চার দিনের একটি সফরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় লোরেলাই জেলার শৈলনিবাস জিয়ারতে। জিয়ারতে বেলুচিস্তান প্রদেশের প্রধান (যিনি এজিজি–এজেন্ট টু গভর্নর জেনারেল নামে পরিচিত ছিলেন) তার জন্যও একটি নির্ধারিত বাসস্থান ছিল। পাহাড়ের চূড়ায় শহরটি অবস্থিত হওয়ায় অনেকে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য এই শহরে আসত। পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হন। করাচি শহরে বাতাসের মান ছিল অত্যন্ত নিচু। তাই তাঁকে জিয়ারতে নিয়ে আসা হয়। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে তিনি জিয়ারতে ছিলেন কিন্তু তার পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। ১০ সেপ্টেম্বর গুজব রটে যে তিনি মারা গেছেন। পাকিস্তান সরকারের তথ্য বিবরণী অনুসারে জিয়ারতে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলেও তিনি মারা যাননি। তিনি বিমানে করাচি শহরে অবতরণ করার পর মারা যান। জিয়ারতে যে বাড়িটিতে অসুস্থতার সময় জিন্নাহ ছিলেন, ওই বাড়িটিতে তিনি যেসব আসবাব ব্যবহার করেছিলেন, তা তখন। পর্যন্ত একই অবস্থায় রাখা হয়। আমরা বাড়িটি ভালো করে ঘুরে দেখি।

কোয়েটায় আমরা যখন যাই, তখন সেখানে আমার খালাতো ভাই ব্রিগেডিয়ার কুদুস সেনা প্রকৌশল বিভাগে কাজ করছিলেন। আমি ভাবলাম এখানে যখন এসেছি, তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করে যাই। আমার বন্ধু সৈয়দ তারিক আলিকে নিয়ে আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাই। বাসায় গেলে দারোয়ান জানায় যে ব্রিগেডিয়ার কুদুস রাওয়ালপিন্ডি গেছেন এবং আরও সাত দিন সেখানে থাকবেন। আমি দারোয়ানকে বললাম ভাবিকে বলবেন ব্রিগেডিয়ার কুদুসের খসরু নামের একজন কাজিন এসেছিল–এ খবরটি যেন তাকে দেওয়া হয়। আমরা চলে আসছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে আমাদের ফিরে আসতে বলা হয়। দেখি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আমার ভাবি আইলিন (Eileen) কুদুস। তিনি একজন খাঁটি ব্রিটিশ নাগরিক। ব্রিগেডিয়ার কুদুস যখন প্রশিক্ষণের জন্য লন্ডন যান, তখন তাঁর প্রেমে পড়েন এবং তাঁর সঙ্গে বিয়ে করে পাকিস্তান চলে আসেন। তিনি আর লন্ডনে ফিরে যাননি। তিনি আমাকে ভাঙা বাংলায় জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোন খালার ছেলে। আমি বললাম নবীনগরের খালা। ব্রিগেডিয়ার কুদুস তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে নবীনগরে বেড়াতে গিয়েছিলেন ১৯৫৮ সালে একটি সরকারি স্টিমারে করে। আম্মা মেহমানদের জন্য অনেক খাবার রান্না করে আমাদের নিয়ে ওই স্টিমারে যান। আইলিনের সে স্মৃতি মনে পড়ে এবং তিনি বলেন, হ্যাঁ, তোমাকে দেখেছি। তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ। কাল সন্ধ্যায় তুমি এবং তোমার বন্ধু আমাদের সঙ্গে এসে ডিনার খাও।’ আমরা ডিনার খেতে গিয়েছিলাম। খুবই যত্ন করে আমাদের ডিনার খাইয়েছিলেন তিনি। এরপর বহুবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তিনি সব সময়ই ছিলেন অত্যন্ত স্নেহশীলা। ব্রিগেডিয়ার কুদুস মারা যাওয়ার পরও তিনি বিলাত ফিরে যাননি। অতি সম্প্রতি তাঁর বয়স ৯০ অতিক্রম করেছে। বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় তিনি এখন ভুগছেন। তিনি ছোট ছেলের সঙ্গে এখনো ঢাকাতেই আছেন।

কোয়েটা থেকে আমরা বিমানে করাচি আসি। সেখানে আমাদের একদিন। পর বিমানবন্দরে যেতে বলা হয়। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন আমার বন্ধু। ফজলুল হক এমএ পড়ছিল। আমি তাকে চিঠি লিখি যে আমি করাচি হয়ে। ঢাকা ফিরে যাব। সে আমাকে বিমানবন্দর থেকে তুলে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। আমাকে করাচি শহরে জিন্নাহর মাজার দেখায় এবং ক্লিফটন সমুদ্রসৈকতে নিয়ে যায়।

পরদিন বিমানে করে আমরা সবাই কলম্বো হয়ে ঢাকা ফিরে আসি। এই সফরে জাতীয় সংহতির কী লাভ হয়েছিল জানি না, তবে ব্যক্তিগতভাবে। আমার সঙ্গে সৈয়দ তারিক আলি, কাজী জাফর উল্যাহ ও আমিনুল হক বাদশার সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়।