১৯৬৫ সালে বুনিয়াদি গণতন্ত্রের ভিত্তিতে নির্বাচন

১৯৬৫ সালে বুনিয়াদি গণতন্ত্রের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় সম্মিলিত বিরোধী দল। বাইরে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য থাকলেও ভেতরে এরা সবাই নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চাইছিল। তাই প্রতিটি দলই তাদের পছন্দমতো প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার চেষ্টা করছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সলিমুল্লাহ হল, ইকবাল হল এবং পার্শ্ববর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীদের আবাসস্থল নিয়ে একটি নির্বাচনী এলাকা গঠন করা হয়। সলিমুল্লাহ হলে ছিল তখন ছাত্র ইউনিয়নের প্রাধান্য। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে সলিমুল্লাহ হলের নেতা আইয়ুব রেজা চৌধুরীকে এই আসনের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়। অন্যদিকে ইকবাল হলে ছিল তখন ছাত্রলীগের প্রাধান্য। ছাত্রলীগ এই আসনে একজন প্রার্থী মনোনয়ন দেয়। নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ তারিখ পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রলীগ একজন প্রার্থী সম্পর্কে একমত হতে পারেনি। সুতরাং দুজন প্রার্থীই থেকে যান। নির্বাচনের আগে বেশির ভাগ ছাত্রনেতা ঢাকা ছেড়ে পল্লি অঞ্চলে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে যান। ইকবাল হল ও সলিমুল্লাহ হলের ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা নির্বাচনী প্রচারে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে একমত হন যে এই আসনে ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী আইয়ুব রেজা চৌধুরীর প্রার্থিতা থাকবে। ছাত্রলীগ তাদের প্রার্থীর পক্ষে কোনো প্রচার করবে না এবং প্রার্থীর কোনো নির্বাচনী এজেন্টও ভোটকেন্দ্রে থাকবে না। এই আসনের ভোটকেন্দ্র ছিল ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের ভবন। সেখানে কয়েকটি কামরা খালি করে ভোটকেন্দ্র করা হয়। কোনো এক সরকারি ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজারকে এই কেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগ করা হয় এবং ঢাকা মিউনিসিপ্যালটির কিছু প্রাথমিক শিক্ষককে পোলিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমাদের তখন এমএ পরীক্ষা সামনে। তাই আমরা নির্বাচনী প্রচারণায় গ্রামে যেতে পারিনি। তাই আমাদের ঢাকা শহরে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন নেতা এসএম হলে এসে আমাকে বললেন যে আমাকে আইয়ুব রেজা চৌধুরীর নির্বাচনী এজেন্ট হতে হবে। আমি বললাম, আমি ভোটার নই। আমার বয়স একুশ বছর হয়নি। তিনি বললেন, নির্বাচনী এজেন্টের বয়স নিয়ে আইনে কোনো বিধান নেই। সুতরাং বাধ্য হয়ে আমি রাজি হলাম।

নির্বাচনের দিন আমার বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে আমি ভোটকেন্দ্রে গেলাম। ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সময় মনে হলো যে সলিমুল্লাহ হল ও ইকবাল হলের যেসব ছাত্র একুশ বছর বয়সের বেশি, তাদের সিংহভাগ গ্রামে নির্বাচনী প্রচারণা করতে চলে গিয়েছে। তাই আইয়ুব রেজা চৌধুরীকে পাস করানোর মতো যথেষ্ট ভোটার নেই। সৌভাগ্যবশত কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে আমাকে যখন পোলিং এজেন্টের সিদ্ধান্ত জানানো হয়, তখন কেন্দ্রের একটি ভোটার লিস্টও তারা আমাকে দেয়। ভোটার লিস্টটা আমার বন্ধুদের হাতে দিয়ে বললাম, এই লিস্টের ভিত্তিতে তোমরা একেকজন এসে দাবি করবে তুমিই এই ভোটার। যেহেতু বিরোধী দলের কোনো পোলিং এজেন্ট নেই, সুতরাং এ নিয়ে কোনো বিতর্ক হবে না। অনায়াসে শতকরা ১০০ ভাগ জাল ভোট দিয়ে আমরা আমাদের প্রার্থীকে জয়ী করতে পারব। আমার বন্ধুরা আমার বক্তব্যকে সমর্থন করলেন। তাঁরা হলে গিয়ে ভোটার নয়, এ রকম ছাত্রদের ভোটার পরিচয় দিয়ে ভোটকক্ষে হাজির করলেন। এঁরাই প্রকৃত ভোটার বলে আমি প্রত্যয়ন করলাম, প্রিসাইডিং অফিসারের কিছু করার ছিল না। তাঁদের ভোটের ভিত্তিতে শ খানেক ভোটে আইয়ুব রেজা চৌধুরী নির্বাচিত হন। তার বিরোধী পক্ষে ভোট ছিল শূন্য। জীবনে প্রথম আমি নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করলাম। তবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দেখলাম গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা সহজ নয়। যেখানে পোলিং এজেন্টের মাধ্যমে ভোটারদের পরিচয় চ্যালেঞ্জ করার কোনো ব্যবস্থা নেই, সেখানে শতভাগ জাল ভোট হওয়া সম্ভব। পরবর্তীকালে ১৯৭০ সালে যখন আমি আটটি নির্বাচনী এলাকার রিটার্নিং অফিসার ছিলাম, তখন এই অভিজ্ঞতাকে স্মরণ করে ভোটে যাতে জালিয়াতি না হয়, সে ব্যাপারে তৎপর ছিলাম।