বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি

১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন প্রবর্তন করেন। সামরিক শাসনামলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। তবু সামরিক শাসনের আগে যে ছাত্রসংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছিল, তারা আড়ালে থেকে নিজেদের কার্যক্রম চালু রাখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন চারটি ছাত্রসংগঠন ছিল। একটি সংগঠন ছিল সামরিক শাসনের সমর্থক। প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন বা এনএসএফ। এই প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি ছিলেন ইব্রাহীম তাহা। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী এ টি এম মুস্তফার ছোট ভাই। এই সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এ আর ইউসুফ। পরে তিনি সংগঠনটির সভাপতি হন। ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য তিনি বিলাত চলে গেলে সংগঠনটির সভাপতি হন আবুল হাসনাত। তিনিও পরবর্তীকালে ব্যারিস্টারি ডিগ্রি অর্জনের জন্য বিলাত যান। এনএসএফের এই দুজন নেতাই এরশাদ সরকারের আমলে মন্ত্রী হয়েছিলেন। এনএসএফের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষের খুবই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এনএসএফ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে একদিকে অনেক ভালো ছাত্র, অন্যদিকে অনেক গুন্ডা প্রকৃতির ছাত্রকে একত্র করে। যদি ছাত্ররা সামরিক শাসন সমর্থন না করে, তাহলে পিটিয়ে তাদের সমর্থন আদায়ে বাধ্য করতে এরা দ্বিধাবোধ করত না।

আরেকটি ছাত্রসংগঠন পরোক্ষভাবে সরকারের সমর্থক ছিল। তবে প্রত্যক্ষভাবে তা তারা প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করত। এ সংগঠনটির নাম ছিল পাকিস্তান ছাত্র শক্তি। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন ফরমানউল্লাহ খান। তাঁর সহযোগী ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মিঞা মোহাম্মদ নুরুজ্জামান, ড. মিজানুর রহমান শেলী প্রমুখ। এঁদের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরোর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ঘনিষ্ঠ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হাসান জামান এবং সরকারের সঙ্গে এই সংগঠনটির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় হাসান জামান পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল।

তৃতীয় ছাত্রসংগঠনটির নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। আগে এটি মুসলিম ছাত্রলীগ নামে পরিচিত ছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগ যেভাবে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগে পরিণত হয়, তেমনি মুসলিম ছাত্রলীগ মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে ছাত্রলীগে পরিণত হয়। এই সংগঠনের নেতা ছিলেন রফিকুল্লাহ চৌধুরী, এ টি এম শামসুল হক, আবদুল আউয়াল, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও ওবায়দুর রহমান। পরবর্তীকালে শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল কুদুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী প্রমুখ নেতা হন। তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসারী ছিলেন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে এঁদের অবদান রয়েছে।

চতুর্থ ছাত্রসংগঠনটির নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। ১৯৫২-৫৪ সালে এই ছাত্রসংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন কাজী আনোয়ারুল আজীম ও সৈয়দ আবদুস সাত্তার। প্রথম আনুষ্ঠানিক সভাপতি ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান এবং সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইলিয়াস। এরপর সভাপতি ছিলেন আবদুল মতিন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম আরিফ টিপু। ১৯৫৬-৫৮ সালে সভাপতি কাজী আনোয়ারুল আজীম এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এস এ বারী এ টি। এরপর কাজী জাফর আহমদ, এ কে বদরুল হক, হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, সাইফউদ্দিন আহমদ মানিক, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, মোস্তফা জামাল হায়দার, মাহবুব উল্লাহ, নুরুল ইসলাম নাহিদ অনেকেই ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ ভেঙে যেভাবে ন্যাপ বা জাতীয় আওয়ামী পার্টি আত্মপ্রকাশ করে, তেমনি প্রগতিশীল ছাত্ররা ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রলীগে বিভক্ত হয়। ছাত্র ইউনিয়ন ছিল কমিউনিস্টদের ছাত্রসংগঠন। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের যোগসূত্র ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ। দিনাজপুরে তার বাড়ি এবং দীর্ঘদিন ধরে তিনি বামপন্থীদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশির ভাগ তুখোড় ছাত্ররা ছিল ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে ও বিভাগে ছাত্র ইউনিয়নের সংগঠন ছিল।

প্রথম দিকে ছাত্র ইউনিয়নে প্রকাশ্যে কোনো দলাদলি ছিল না। কিন্তু ১৯৬৫ সালের দিকে সোভিয়েত রাশিয়া ও চীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এর ফলে কমিউনিস্টরা মস্কোপন্থী ও চীনপন্থী–এই দুই দলে ভাগ হয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়াপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন নামে পরিচিত হয়। চীনপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন মেননপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন নামে পরিচিতি লাভ করে।

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সংযুক্ত হই। ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচনের ম্যানিফেস্টো লেখায় এবং নির্বাচনী প্রচারণার কাজে আমি চার বছর অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু আমি ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে প্রার্থী হতে রাজি হইনি। এই রাজি না হওয়ার কারণ ছিল দুটি–একটি হলো আমি ছিলাম নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পাস করে চাকরি না করলে আমার খাওয়াদাওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে বৃত্তি পেতাম, সেটা আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। এই বৃত্তি শেষ হওয়ার পর আমার বেঁচে থাকার জন্য চাকরির প্রয়োজন। কাজেই আমার পক্ষে পূর্ণকালীন পার্টির ক্যাডার হওয়া সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয়টি হলো অনেকে বামপন্থী দল থেকে মনোনয়ন গ্রহণ করে নির্বাচিত হয়। কিন্তু নির্বাচনের পর সরকারের পক্ষ থেকে তাদের ওপরে প্রচণ্ড চাপ আসে। তখন তারা দলের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। এটি ছিল অত্যন্ত লজ্জাজনক বিষয়। আমি তাই সরাসরি সার্বক্ষণিক ছাত্ররাজনীতিতে যোগ দিতে পারিনি।

যদিও আমি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিনি, তবু মুসলিম হল ইউনিয়নের অনুরোধে আমি ১৯৬৩-৬৪ সালের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল বার্ষিকী সম্পাদনা করতে রাজি হই। তখন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সদস্যরা তাদের হলের বার্ষিকীতে লেখা দিতেন। ১৯৬৩-৬৪ সালের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল বার্ষিকীতে পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যাকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র কবি শামসুর রাহমান ‘পুরাণ’ শিরোনামে নামে একটি কবিতা দেন। তখনকার অনুপম কথাশিল্পী জহির রায়হান একটি গল্প দেন। হলের পাঁচজন প্রাক্তন ছাত্র তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছিলেন। এঁরা হলেন ড. কাজী দীন মোহাম্মদ, এ টি এম হাফিজুর রহমান, মিজানুর রহমান শেলী, শামসুল আলম চৌধুরী ও সৈয়দ আবদুস সামাদ। এঁদের প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতা বার্ষিকীতে ছাপা হয়। এ ছাড়া হলের তিনজন ছাত্র তিনটি গল্প প্রকাশ করেছিলেন। এরা পরে বিশিষ্ট সাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃত হন। এঁরা হলেন হুমায়ুন আজাদ, রশিদ আল ফারুকী এবং আবুল কাশেম ফজলুল হক। লেখা সংগ্রহ এবং ছাপানোর ব্যাপারে আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেন। হলের ছাত্র ফারুক আলমগীর।

কমিউনিস্ট পার্টি অবশ্য আমাকে তাদের দলে টানার জন্য অত্যন্ত উদগ্রীব ছিল। ১৯৬৩ সালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে তারা কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকটি সেল খোলে। একটি সেলের সদস্য ছিলাম তিনজন। আমি, শামসুজ্জোহা মানিক ও আফজালুর রহমান। শামসুজ্জোহা মানিক আমার এক বছরের কনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। তার পিতা পুলিশ বিভাগে কাজ করতেন, কিন্তু তার মা ছিলেন একজন প্রগতিশীল নারী কর্মী। তারই উৎসাহে শামসুজ্জোহা মানিক ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডে সম্পূর্ণরূপে জড়িয়ে পড়েন। আফজালুর রহমান একজন ভালো ছাত্র ছিলেন। পরে তিনি পাকিস্তান পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়ে সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এই তিনজনের তত্ত্বাবধান করতেন মোহাম্মদ ফরহাদ। মাসে একবার কি দুবার তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য নির্দেশ আসত। আমরা কখনো রেসকোর্সের ময়দানে, কখনো জগন্নাথ হলে, কখনো অন্য কোনো নিরাপদ স্থানে একত্রে বসে দেশের রাজনীতি সম্পর্কে মোহাম্মদ ফরহাদের আলোচনা শুনতাম। অবশ্য এই সেল বেশি দিন টেকেনি। চীনপন্থী ও মস্কোপন্থী–এই দুই ভাগে বামপন্থীরা বিভক্ত হয়ে যায়। আমাদের সেলের তিনজন সদস্যেরই সহানুভূতি ছিল চীনপন্থীদের দিকে। অন্যদিকে মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন মস্কোপন্থী। শামসুজ্জোহা মানিক প্রকাশ্যে চীনপন্থীদের পক্ষে কাজ করে যান। এর ফলে মোহাম্মদ ফরহাদের। সঙ্গে মানিকের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাই আমাদের সঙ্গেও ফরহাদের কোনো যোগাযোগ থাকে না।

পক্ষান্তরে চীনপন্থীদের পক্ষ থেকে নতুন সেল প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। যদিও আমি এবং আফজালুর রহমান রাজনীতিতে টিকে থাকিনি, তবু শামসুজ্জোহা মানিক বামপন্থী রাজনীতিতে থেকে যান। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তিনি দিনাজপুরে নকশালপন্থীদের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে কৃষক আন্দোলন সংগঠনের চেষ্টা করেন। তবে এই আন্দোলন খুব বেশি দূর এগোতে পারেনি। মানিক কয়েকবার জেল খাটেন। পরবর্তীকালে আমার মনে হয় বামপন্থী আন্দোলনের সাফল্য সম্পর্কে তাঁর মনে দ্বিধা দেখা দেয়। তিনি রাজনীতি ছেড়ে প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করেন। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম সভ্যতা সিন্ধু সভ্যতা সম্বন্ধে তিনি গবেষণা শুরু করেন। সিন্ধু সভ্যতার একটি বড় দুর্বলতা হলো এই যে এই সভ্যতার নিজস্ব কোনো লিপি ছিল না। কোথাও কোথাও লিপিসদৃশ লিখন দেখা গেলেও এগুলোর কোনো তাৎপর্য আছে কি না, তা জানা যায় না। তিনি তার ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে গাণিতিকভাবে সিন্ধু সভ্যতার লিপি পাঠের চেষ্টা করেন। তবে এ চেষ্টা এখনো সফল হয়নি। তিনি ছোট একটি প্রকাশনালয় স্থাপন করেন। এই প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশিত একটি বই মুসলমান ধর্মান্ধদের আক্রমণ করেছে–এই অজুহাতে বইমেলায় তার স্টলে আক্রমণ করা হয় এবং পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।