১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন

পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পর ১৯৫৮ সারে ৩০ ডিসেম্বর আইয়ুব খান কেন্দ্রীয় শিক্ষাসচিব এস এম শরিফের নেতৃত্বে কমিশন অন ন্যাশনাল এডুকেশন নিয়োগ করেন। কমিটিতে সভাপতি বাদে আরও ১০ জন সদস্য ছিলেন। কমিশন ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট সরকারের কাছে তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। এই প্রতিবেদনে শিক্ষার মান উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়। তখন পাকিস্তানে দুই বছরের ব্যাচেলর পাস কোর্স চালু ছিল। যেসব ছাত্র অনার্স ক্লাসে ভর্তি হতে পারত না, তারা পাস কোর্সে পড়ত। এক বছরের কম সময়ে ডিগ্রি নিয়ে এরা অনেকেই চাকরিতে যোগ দিত। শরিফ কমিশন দুই বছরের ডিগ্রি কোর্সের বদলে তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স প্রবর্তনের সুপারিশ করে। এই সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে ডিগ্রি সম্পূর্ণ করার জন্য অতিরিক্ত এক বছরের খরচ বাড়ে। আগে ৩৩ শতাংশ নম্বর ছিল পাস নম্বর। শরিফ কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যেকোনো একটি বিষয়ে পাস করতে হলে ন্যূনতম ৪০ শতাংশ নম্বর পেতে হবে। স্নাতক পর্যায়ে পাঠ্যসূচিতেও পরিবর্তন আনা হয়। যারা কলা এবং বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র ছিলেন, তাঁদের জন্য বিজ্ঞানের ইতিহাস অবশ্যপাঠ্য করা হয়। এই বিষয় প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ছিল, ছাত্ররা যাতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণের বিবর্তন সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করেন। যারা বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন, তাঁদের জন্য সভ্যতার ইতিহাস বাধ্যতামূলক করা হয়। অতিরিক্ত বিষয় প্রবর্তনের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রের অসুবিধা হয়। এই নতুন বিষয়গুলো পড়ানোর জন্য যথেষ্ট শিক্ষক নিয়োগ করা সম্ভব হয়নি, তাই যেসব শিক্ষক এসব বিষয় পড়াতেন, তাদের যাতে অসুবিধা না হয়, সে জন্য নতুন বিষয়ের ক্লাস হতো সকাল আটটায়। আমার মতো অনেকে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, তারা সাড়ে ৯টার আগে ঘুম থেকেই উঠতেন না। কাজেই তাদের পক্ষে এই ক্লাসে উপস্থিত থাকা ছিল প্রায় অসম্ভব।

আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রায় তিন মাস ক্লাস হয়েছিল। এই তিন মাসে আমি তিনটি ক্লাসেও হাজির হতে পারিনি। আমি তাই শিক্ষা সংস্কারের গুরুতর বিরোধী হয়ে যাই এবং সলিমুল্লাহ হলে শিক্ষা সংস্কারকে বাতিল করার দাবি জানিয়ে অনেক বক্তৃতা দিই। আরেকটি সংস্কার করা হয়েছিল পরীক্ষাপদ্ধতিতে। শরিফ কমিশন প্রতিবেদনের আগে দুই বছর বা তিন বছর মেয়াদি কোর্সের কোর্স সমাপ্তির পর একবার পরীক্ষা হতো। শরিফ কমিশনের প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয় যে ছাত্রদের প্রতিবছর পরীক্ষা দিতে হবে। যখন ছাত্র আন্দোলন দানা বাঁধে, তখন পূর্ব পাকিস্তানে তৃতীয় বর্ষের ডিগ্রি ক্লাসের পরীক্ষার্থীরা ইতিমধ্যে প্রথম দুই বছরের পরীক্ষায় পাস করেছেন। এই পরীক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন হলে যারা পাস কোর্সে ডিগ্রি অর্জন করবেন, তাদের আর তৃতীয় বছরের পরীক্ষায় পাস করার প্রয়োজন হবে না। এঁরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্নাতক হয়ে যাবেন। যখন সত্যি সত্যি শিক্ষা কমিশনের সুপারিশসমূহ প্রত্যাহার করা হলো, তখন পূর্ব পাকিস্তানে অনেক ছাত্র তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা না দিয়ে তাঁদের স্নাতক ডিগ্রি পান। এঁদের ঠাট্টা করে আইয়ুব গ্র্যাজুয়েট’ বলা হতো।

শিক্ষা সংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ ছিল না, সেটি গোটা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানেও এর বিরুদ্ধে আন্দোলন দেখা দেয়। শরিফ কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয় ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে করাচিতে গ্রেপ্তার করা হয়। এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে প্রধান দুটি ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে আন্দোলন শুরু করে। সোহরাওয়ার্দী এবং অন্যান্য রাজবন্দীর মুক্তির দাবির আন্দোলনের পাশাপাশি শিক্ষা সংস্কারবিরোধী আন্দোলনও আত্মপ্রকাশ করে। এই আন্দোলনগুলো একত্র হয়ে যায় এবং সরকারের জন্য একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

১৯৬২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী মঞ্জুর কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য কলা বিভাগের দোতলায় একটি কক্ষে আসেন। সৌভাগ্যক্রমে বক্তৃতা শুরু হওয়ার আগে ওই কক্ষে সামনের দিকে আমি একটি আসন পেয়ে যাই। মঞ্জুর কাদের বক্তৃতা দেওয়া শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে সভায় গন্ডগোল শুরু হয়ে যায়। তদানীন্তন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা জিয়াউদ্দিন মাহমুদ মঞ্জুর কাদেরকে প্রশ্ন করা শুরু করেন। তাঁর প্রশ্ন ছিল গণতন্ত্র নেই কেন? পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থনৈতিক বৈষম্য কেন? মঞ্জুর কাদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগেই ছাত্ররা তাকে ধাক্কা মারেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা তাকে ঘেরাও করে সভা থেকে বের করে নিয়ে যান। মঞ্জুর কাদেরকে যখন দোতলা থেকে একতলায় নামানো হয়, তখন আমরা অর্থাৎ ছাত্ররা তাঁর মাথায়, গায়ে এবং কাপড়ে থুতু ছিটাতে থাকি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে পতাকাবাহী মন্ত্রীর যে গাড়ি ছিল, তাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশের গাড়িতে করে মন্ত্রীকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপরই ছাত্র আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে।

শিক্ষা সংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সাফল্য অর্জিত হলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য আসেনি। এর একটি বড় কারণ ছিল এই যে সরকারবিরোধী ছাত্রগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক দলাদলি ছিল। অতি অল্প সময় এদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে। আইয়ুব খান এ সময়ে একজন অতিবশংবদ মুসলিম লীগ নেতা আবদুল মোনেম খানকে পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নর নিয়োগ করেন। মোনেম খান এনএসএফ-কে শক্তিশালী করেন এবং এনএসএফে গুন্ডা-পান্ডার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড. ওসমান গণিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য করে নিয়ে আসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকসহ সব পর্যায়ে তীব্র রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

১৯৬৫ সালে আইয়ুব খান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের উদ্যোগ নেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভগ্নি ফাতেমা জিন্নাহকে বিরোধীদলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেন। এ সময়ে নির্বাচন তথাকথিত বুনিয়াদি গণতন্ত্রের ভিত্তিতে পরিচালিত হতো। ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে এ দেশে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিরা সরাসরি নির্বাচিত হতেন। আইয়ুব খান শুধু ইউনিয়ন কাউন্সিলে প্রত্যক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা বহাল রাখেন কিন্তু ইউনিয়ন কাউন্সিলের উর্ধ্বে যত প্রতিষ্ঠান ছিল, যথা : থানা কাউন্সিল, জেলা কাউন্সিল, বিভাগীয় কাউন্সিল, প্রাদেশিক আইন পরিষদ, কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোটার করা হয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্যদের। তখন মার্কিন সরকার ফোর্ড ফাউন্ডেশনের কারিগরি সহায়তা নিয়ে পাকিস্তানের পল্লি অঞ্চলে কর্ম সৃষ্টির জন্য পল্লি পূর্ত কর্মসূচির প্রবর্তন করেন। এই কর্মসূচিতে ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যদের প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অথচ এদের নজরদারি ছিল অত্যন্ত দুর্বল। তার ফলে পল্লি পূর্ত কর্মসূচি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়। এ ধরনের ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যরা আইয়ুব খানের গোড়া সমর্থক হয়ে দাঁড়ায়। সম্মিলিত বিরোধী দলের দাবি ছিল তারা ক্ষমতায় এলে বুনিয়াদি গণতন্ত্র ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হবে। অথচ সংবিধান অনুসারে বুনিয়াদি গণতন্ত্রের মধ্য দিয়েই বিরোধী দলকে ক্ষমতায় আসতে হবে।