ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগ

আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হই, তখন ইতিহাস। বিভাগের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক আবদুল হালিম। হালিম সাহেব লোদি সম্রাটদের ওপর অভিসন্দর্ভ লিখে ডক্টরেট অর্জন করেন। ওস্তাদি গানে তাঁর অনুরাগ ছিল এবং তিনি বিভিন্ন আসরে গান গাইতেন। প্রথম বর্ষে তিনি আমাদের ভারতের মুসলমান শাসন সম্বন্ধে কোর্সটি পড়ান। তিনি প্রথম ক্লাসে পাঠ্যপুস্তকের একটি তালিকা দেন। এই তালিকা কোনো কাগজ ছাড়াই স্মৃতির ওপর নির্ভর করে দেন। হালিম সাহেব আরবি, ফারসি শব্দের উচ্চারণ সম্পর্কে খুবই সতর্ক ছিলেন। এসব উচ্চারণ সঠিকভাবে করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য অস্পষ্ট হয়ে পড়ত। তিনি যখন আমাদের কোর্সটি পড়ান, তখন শরিফ কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে বার্ষিক পরীক্ষা হতো। এই পরীক্ষার কিছুদিন পরেই ড. আবদুল হালিম পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তবে তিনি আমাদের পরীক্ষার খাতার মূল্যায়ন সমাপ্ত করেছিলেন।

প্রথম বর্ষে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস আমাদের পড়ান অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (১৯১৫-১৯৭১)। ঢাকার পগোজ স্কুল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৩২ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় চতুর্দশ স্থান অধিকার করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষা দেন এবং এই পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ১৯৩৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিভাগে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। এমএ পাস করার পরই তিনি ইতিহাস বিভাগে মৌর্য শাসনপদ্ধতি সম্পর্কে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজে ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী প্রভাষকের পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬০-এর দশকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন।

১৯৬১ সালে তিনি আমাদের প্রাচীন ভারতের ইতিহাস কোর্স পড়ান। এর আগে এই কোর্সটি পড়াতেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আহমদ হাসান দানি। কিন্তু দানি সাহেব ১৯৬১ সালে পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাই সন্তোষ বাবু আমাদের কোর্সটি পড়ান। তিনি খুবই ভালো পড়াতেন। বক্তৃতা দেওয়ার কৌশল তাঁর ভালোভাবে জানা ছিল। কিন্তু শুধু বক্তৃতার কৌশলের জন্যই নয়, তাঁর বক্তৃতা ছিল অত্যন্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ। শিলালিপি, মুদ্রা এবং অন্যান্য মৌলিক ইতিহাসের ভিত্তিতে ইতিহাস কীভাবে রচিত হয়, সে বিষয়টি তিনি ছাত্রদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করতেন। সম্রাট অশোকের ইতিহাস পড়াতে গিয়ে তিনি ক্লাসে অশোকের শিলালিপি থেকে উদ্ধৃতি দিতেন। এই শিলালিপিগুলোর ইংরেজি অনুবাদ করতেন এবং এই ইংরেজি অনুবাদের ভিত্তিতে কী কী ব্যাখ্যা উপস্থাপন করানো সম্ভব, তা-ও তুলে ধরতেন। সমুদ্র গুপ্তের রাজ্যের বিস্তৃতি বোঝানোর জন্য তিনি এলাহাবাদ স্তম্ভের শিলালিপি পাঠ করতেন। তাঁর ইংরেজি অনুবাদ করতেন। এরপর বিভিন্ন স্থান সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যে ধরনের বিতর্ক ছিল, সেগুলোও ছাত্রদের কাছে তুলে ধরতেন। এভাবে প্রতিটি বিষয় তিনি খুবই যত্ন করে আমাদের পড়াতেন।

প্রথম বর্ষের পরীক্ষার পর আমাদের নম্বর জানানো হলো। আমি প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে পাই ৭৭ নম্বর এবং মধ্যযুগের ভারতীয় ইতিহাসে পাই ৭৮ নম্বর। কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে এক নম্বর কম পাওয়া সত্ত্বেও আমার উত্তরের সর্বোচ্চ প্রশংসা পাই সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যের কাছ থেকে। তিনি আমাকে ডেকে পাঠান এবং বলেন যে তোমাকে আমি সঠিক নম্বর দিইনি। তুমি মুসলমানের ছেলে, সংস্কৃত জানো না কিন্তু তুমি কষ্ট করে অশোকের মূল শিলালিপিগুলো এবং সমুদ্র গুপ্তের শিলালিপি মূল ভাষায় মুখস্থ করেছ। সঠিকভাবে পরীক্ষার খাতায় উদ্ধৃত করেছ। তার সঙ্গে এপিগ্রাফিকা ইন্ডিকাতে এদের যে অনুবাদ করা হয়েছে, তা উদ্ধৃত করেছ এবং এদের ব্যাখ্যা সম্পর্কে তর্কবিতর্ক নিয়ে আলোচনা করে তোমার সিদ্ধান্তে পৌঁছেছ। তুমি যেভাবে উত্তর দিয়েছ, তার চেয়ে ভালো উত্তর ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিতেরাও দিতে পারবেন না। অথচ তুমি মাত্র প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমি তোমাকে এই পত্রে ১০০-তে ১০০ নম্বর দিতে চেয়েছিলাম। পরে আমার খেয়াল হলো ১০০-তে ১০০ নম্বর দিলে তোমার ক্ষতি হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সব পরীক্ষার খাতা দুজন পরীক্ষক পরীক্ষা করেন। একজন অভ্যন্তরীণ পরীক্ষক, আরেকজন বহিরাগত পরীক্ষক। এই দুজনের দেওয়া নম্বরের মধ্যে ১০ নম্বরের বেশি তফাত না হলে এই দুই নম্বরের গড় নম্বর হবে চূড়ান্ত ফল। যদি ১০-এর বেশি তফাত হয়, তাহলে খাতা তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে পাঠাতে হবে। তৃতীয় পরীক্ষক যে নম্বর দেবেন, সেটাই হবে চূড়ান্ত নম্বর।

তিনি বলেন, আমরা পাকিস্তানে এখন বিএ, এমএ পরীক্ষার খাতা পাকিস্তানি শিক্ষকদের দিয়েই মূল্যায়ন করাই। দুর্ভাগ্যবশত এখন পাকিস্তানে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের যেসব শিক্ষক রয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই বিএ এবং এমএ-তে প্রথম শ্রেণির নম্বর পাননি। তারা তোমার খাতার মূল্য মোটেও উপলব্ধি করতে পারবেন না এবং কম নম্বর দেবেন। এই খাতার বহিরাগত পরীক্ষক যদি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নির্বাচিত হতো, তাহলে আমি তোমাকে ১০০-তে ১০০ নম্বর দিতাম। কিন্তু যেহেতু পাকিস্তানি শিক্ষকেরা এই মূল্যায়ন করবেন, সেহেতু আমি তোমার নম্বর কমিয়ে দিয়েছি, যাতে তুমি অন্তত সন্তোষজনক নম্বর পাও।

দ্বিতীয় বর্ষে আমাদের ইউরোপে মধ্যযুগের ইতিহাস এবং ভারতে ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে পড়ানো হয়। ইউরোপের মধ্যযুগের ইতিহাস আমাদের পড়ান অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ। অধ্যাপক আহমদ ছিলেন সুপুরুষ এবং সুবক্তা। যদিও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণি পাননি, তবু ইউরোপের ইতিহাসে তার গভীর আগ্রহ ছিল। মধ্যযুগের ইউরোপের ইতিহাস সম্পর্কে যেসব নতুন বই প্রকাশিত হতো, অধ্যাপক আহমদ সেগুলো বিলাত থেকে সংগ্রহ করতেন। তিনি ভালো ছাত্রদের সেসব বই পড়তে উৎসাহিত করতেন। তিনি ছিলেন সলিমুল্লাহ হলের আমাদের সহকারী হাউস টিউটর। এখনো মনে আছে, অনেক সময় তিনি নিজে আমার কক্ষে এসে নতুন বই পড়তে দিয়ে যেতেন। অধ্যাপক আহমদ আমাদের কোর্সটি পড়ান কিন্তু শরিফ কমিশনের প্রতিবেদন বাতিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সব পরীক্ষা তিন বছরের সম্মান কোর্স সমাপ্ত হওয়ার পর একসঙ্গে নেওয়া শুরু হয়। এর ফলে তিনি আমাদের খাতা দেখার সুযোগ পাননি। আমাদের খাতা দেখেছিলেন অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য।

ভারতের ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে আমাদের প্রথমে পড়ান আবদুল মমিন চৌধুরী। তারপর ড. আবুল খায়ের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পিএইচডি করে দেশে আসার পর তিনি আমাদের এ কোর্স পড়াতে শুরু করেন। কয়েক মাস পর মোহর আলি পিএইচডি করে দেশে আসেন। তিনি এই কোর্সের শেষ ভাগ আমাদের পড়ান।

তৃতীয় বর্ষে আমাদের চারটি কোর্স পড়ানো হয় : (১) ফরাসি বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস, (২) ফরাসি বিপ্লব থেকে প্রথম মহাযুদ্ধ পর্যন্ত আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস, (৩) ১৭১৫ সাল থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ইতিহাস, (৪) আধুনিক যুগে ইংল্যান্ডের শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের ইতিহাস। প্রাক্-ফরাসি বিপ্লব আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস আমাদের পড়াতেন অধ্যাপক জহুরুল ইসলাম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিভাগে বিএ অনার্স এবং এমএ উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। প্রথমে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর তিনি সরকারি কলেজে যোগ দেন। তিনি ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন এবং যত দূর মনে পড়ে, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ডিরেক্টর অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। অবসর গ্রহণ করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ইউরোপের ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল প্রগাঢ়। তিনি যেকোনো সময় ক্লাসের বোর্ডে ইউরোপের দেশসমূহের মানচিত্র আঁকতে পারতেন এবং মানচিত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে যে সংঘাত চলছিল, তার ব্যাখ্যা করতেন। আমি ইতিহাস বিভাগে অনার্স পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পাই অধ্যাপক জহুরুল ইসলামের কোর্সে। এই কোর্সে আমি ৭৫ নম্বর পাই। ৬০ নম্বরকে প্রথম শ্রেণি ধরে আমাকে ৭৫ নম্বর দেওয়া হয়। আমি যে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে ৭৭ নম্বর পেয়েছিলাম, সেখানে প্রথম শ্রেণির নম্বর ছিল ৭০। যদি এই হিসাবে জহুরুল ইসলামের প্রদত্ত নম্বর হিসাব করা হয়, তাহলে তা দাঁড়াবে ৮৫ নম্বরে। সম্ভবত ইউরোপের ইতিহাসের অনেক খুঁটিনাটি বিষয়। সঠিকভাবে ধরতে পেরেছি বলেই আমাকে এত বেশি নম্বর দেওয়া হয়।

ফরাসি বিপ্লব-পরবর্তী ইউরোপের ইতিহাস পড়ান অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ। কিন্তু ক্লাস শেষ হওয়ার পরই তিনি বিলাত চলে যান। তাই খাতা দেখেছিলেন ড. আবুল খায়ের। এই পত্রে আমি ৬৮ নম্বর পাই। আধুনিক ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ইতিহাস পড়ান অধ্যাপক আবু সাঈদ। তিনি ছিলেন ঐতিহাসিক রামজেমুইর এবং গ্রিন ইত্যাদি হুইগ ঘরানার ঐতিহাসিকদের সমর্থক। এঁরা রাজনৈতিক ইতিহাসকে শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখেছেন। রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক মিথস্ক্রিয়া সম্বন্ধে এঁদের তত আগ্রহ ছিল না। বামপন্থী রাজনীতির সমর্থক হিসেবে আমি রাজনৈতিক বিশ্লেষণে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ব্যাখ্যার তাৎপর্যে বিশ্বাসী ছিলাম। এ সময়ে লুই নামিয়ের নামে একজন অধ্যাপক তৃতীয় জর্জের রাজত্বকাল সম্বন্ধে নতুন ধরনের ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। ব্রিটিশ কাউন্সিলে তখন এই নতুন ব্যাখ্যা সম্পর্কে অনেক বই পাওয়া যাচ্ছিল। এসব বইয়ের ভিত্তিতে আমি আমার নোট তৈরি করি। অধ্যাপক আবু সাঈদের কাছে এসব ব্যাখ্যার খুব তাৎপর্য ছিল না। কাজেই শেষ পর্যন্ত এই পত্রে আমি মাত্র ৫৫ নম্বর পাই। শুধু এই পত্র ছাড়া আর সব পত্রেই আমি প্রথম শ্রেণির চেয়ে অনেক বেশি নম্বর পাই। যদি এই পত্রে আমি শূন্যও পেতাম, তাহলেও আমি ইতিহাস বিভাগে সম্মান পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করতাম।

ইংল্যান্ডের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস পড়ান অধ্যাপক ওয়াদুদুর রহমান। তিনি ছিলেন সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের ছোট ভাই। আমরা যখন ছাত্র, তখন তিনি ইতিহাস বিভাগের রিডার ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের (যা এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগ এবং যেখানে তখন আমতলা, মধুর ক্যানটিন ও কলাভবন অবস্থিত ছিল) গেটে কয়েকটি কামরায় তিনি থাকতেন। ওয়াদুদুর রহমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল বিচিত্র। তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় তৃতীয় শ্রেণিতে পাস করেন। এরপর আইএ পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে উচ্চস্থান অধিকার করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে তৃতীয় শ্রেণি পান। কিন্তু এমএ পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির সুবিধা ছিল সীমিত। তাই এমএ পাস করার পর তিনি পুলিশের দারোগা হিসেবে চাকরি শুরু করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু শিক্ষকেরা পাকিস্তান ছেড়ে চলে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য শিক্ষকের অভাব দেখা দেয়। এ সময় ওয়াদুদুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। এরপর তিনি সরকারি বৃত্তি নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে অনার্স কোর্সে ভর্তি হন। এই কোর্সে তিনি আবার তৃতীয় শ্রেণি পান। দেশে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের ইতিহাস সম্পর্কে বিভিন্ন কোর্স পড়াতে থাকেন। বেশির ভাগ ক্লাসেই তিনি কিছু পুরোনো নোট নিয়ে যেতেন। সম্ভবত এই পুরোনো নোটগুলো অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় তৈরি করেছিলেন তিনি। এই নোটগুলো দেখে তিনি ক্লাসে পড়াতেন। যাতে ছাত্রদের একঘেয়ে মনে না হয়, সে জন্য বিভিন্ন বক্তব্যের মাঝে ইউ সি (you see), হোয়াটস কলড (what’s called), সো ন্যাচারালি (so naturally) বিভিন্ন শব্দ গুঁজে দিতেন।

একদিন ওয়াদুদুর রহমানের ইংল্যান্ডের টিউডর রাজাদের রাজত্বকালের শাসনপদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা শুনছিলাম। তিনি নোট দেখে পড়াচ্ছিলেন, ‘Tudor monarchs were shy, you see they were shy, what’s called they were shy, so naturally they were shy.’ Dita 01917 8637 VCP Sport করলাম, ‘স্যার, একটি বংশের সব রাজা কীভাবে লাজুক হয়? আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি এড়িয়ে যান। তাঁর নোটের পাতা উল্টিয়ে তিনি পড়েন, ‘of trangressing the rights and liberties of their subjects.’ M169 তিনি টিউডর রাজারা লাজুক ছিলেন এ কথা বলতে চাননি। তিনি বলতে চেয়েছিলেন টিউডর রাজারা প্রজাদের অধিকার এবং স্বাধীনতায় হাত দিতেন না। কিন্তু নোট লেখার সময়ে shy শব্দটি এক পৃষ্ঠায় এবং of এবং তার পরবর্তী শব্দগুলো অন্য পৃষ্ঠায় থাকায় এই বিপত্তির সৃষ্টি হয়। ওয়াদুদুর রহমান খুবই স্নেহশীল ছিলেন। আমাকে খুবই পছন্দ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার পরও তার সঙ্গে আমার আন্তরিক যোগাযোগ ছিল। তার কোর্সে আমি ৬৮ শতাংশ নম্বর পাই।

প্রথম শ্রেণির নম্বর ৬০ ধরে আমি অনার্স পরীক্ষায় ৬৮.৬ শতাংশ নম্বর পাই। কাছাকাছি সময়ে ইতিহাসে কেউ এত নম্বর পায়নি। কেউ কেউ বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ নম্বর। সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই।

ইতিহাস বিভাগে এমএ শ্রেণিতে তিনটি গ্রুপ ছিল। প্রথম গ্রুপে ছিল প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস। দ্বিতীয় গ্রুপে ছিল মধ্যযুগের ভারতীয় ইতিহাস। তৃতীয় গ্রুপে ছিল সমসাময়িক ইতিহাস। আমরা যে বছর এমএ পাস করি, সে বছর আরেকটি নতুন গ্রুপ যোগ করা হয়। এ গ্রুপের নাম ছিল বাংলার। ইতিহাস। আমি সমসাময়িক ইতিহাসে এমএ ডিগ্রি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এই গ্রুপে চারটি বিষয়ে পড়ানো হতো : (১) প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত সমসাময়িক ইতিহাস, (২) মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক ও সমসাময়িক ইতিহাস, (৩) দূরপ্রাচ্যের আধুনিক ও সমসাময়িক ইতিহাস এবং (৪) আন্তর্জাতিক আইন।

প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে ১৯৬০ দশক পর্যন্ত সমসাময়িক ইতিহাস পড়াতেন অধ্যাপক আবু সাঈদ। অধ্যাপক আবু সাঈদের কাছে আমি ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ইতিহাস পড়েছি। কিন্তু তার পড়ানো আমার কাছে ভালো লাগেনি। তবে সমসাময়িক ইতিহাস তিনি অপেক্ষাকৃত ভালো পড়াতেন। বিশেষ করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের খুঁটিনাটি সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। তিনি নাটকীয়ভাবে এ ইতিহাস উপস্থাপন করতেন। আমি এমএ পরীক্ষায় তাঁর কাছে অপেক্ষাকৃত ভালো নম্বর পাই। হয়তো বহিরাগত পরীক্ষক হাবিবুর রহমান শেলি বেশি নম্বর দিয়ে থাকতে পারেন। এই কোর্সে আমি ৬১ নম্বর পেয়েছিলাম। মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক ও সমসাময়িক ইতিহাস এমএ ক্লাসে পড়াতেন মফিজুল্লাহ কবির। অধ্যাপক আবদুল হালিম অবসর গ্রহণ করলে মফিজুল্লাহ কবির বিভাগীয় প্রধান হন। এই সময় কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে পাকিস্তানের নতুন ইতিহাস রচনা করার কাজ শুরু হয়। এই কাজে মফিজুল্লাহ কবিরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে এক বছরের জন্য ইসলামাবাদ যেতে হয়।

অন্যদিকে এমএ ক্লাসে দূরপ্রাচ্যের আধুনিক ও সমসাময়িক ইতিহাস পড়াতেন অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য। কিন্তু ডক্টর আবুল খায়ের দাবি করেন, তিনি দূরপ্রাচ্যের ইতিহাসে বিশেষজ্ঞ। সুতরাং তিনি এ বিষয়টি পড়াবেন। মফিজুল্লাহ কবির এক বছর না থাকার কারণে সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য এবং আবুল খায়েরের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়। সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস পড়ানোর দায়িত্ব নেন এবং আবুল খায়ের দূরপ্রাচ্যের ইতিহাস। পড়ানোর দায়িত্ব পান। অধ্যাপক ভট্টাচার্য এর আগে কখনো মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস পড়াননি। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন তিনি এ দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস তিনি আগে পড়েননি, তাই এ কোর্সটি পড়িয়ে তিনি তাঁর জ্ঞানের অসম্পূর্ণতা হ্রাস করার সুযোগ পাবেন। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে আমি ৬৮ নম্বর পাই। অধ্যাপক ভট্টাচার্য আমাকে আরও অনেক বেশি নম্বর দিয়েছিলেন। কিন্তু বহিরাগত পরীক্ষক কম নম্বর দেওয়ায় এ নম্বর ৬৮-তে দাঁড়ায়। আমার মনে হয়েছিল যে এ পরীক্ষায় আমি ভালো করিনি। পরীক্ষায় চার ঘণ্টায় পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছিল। আমার প্রথম চারটি প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রায় ৩ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট সময় লাগে। পঞ্চম প্রশ্নের উত্তর লেখার জন্য আমি মাত্র ১৫ মিনিট সময় পাই। এই অল্প। সময়ে উত্তর দেওয়ার জন্য আমি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইরাকের উত্থান। সম্পর্কে একটি উদ্ধৃতির ব্যাখ্যা সম্পর্কে প্রশ্ন বেছে নিই। আমার ধারণা ছিল, এ প্রশ্নের উত্তরে আমি হয়তো কম নম্বর পাব। পরীক্ষা শেষে সন্তোষ বাবু বললেন, ওই প্রশ্নে তুমি আমার কাছে ৮০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছ। কারণ হলো উত্তর যদিও ছোট করে দিয়েছ কিন্তু সমস্ত পয়েন্ট তোমার উত্তরে না ছিল। কাজেই সেখানে বেশি নম্বর দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। আধুনিক ও সমসাময়িক দূরপ্রাচ্যের ইতিহাস পড়ান আবুল খায়ের। তিনি মোটামুটি পড়াতেন। এই বিষয়ের পরীক্ষায় আমি ৬৭ শতাংশ নম্বর পাই।

আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পড়ান অধ্যাপক মোহর আলি। মোহর আলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স এবং এমএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি না পাওয়ায় তিনি রাজশাহী ও চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে তিনি পিএইচডি করার জন্য লন্ডন যান। সেখানে তিনি উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতে খ্রিষ্ট ধর্মপ্রচারকদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে অভিসন্দর্ভ রচনা করেন। পিএইচডির পাশাপাশি তিনি ব্যারিস্টারি ডিগ্রি অর্জন করেন। সেই সূত্রেই তিনি আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে পড়াশোনা করেন। মোহর আলি ভালো পড়াতেন। ব্রায়ারলি নামে এক আইনজ্ঞের বই তিনি আমাদের পড়িয়েছেন। তার কোর্সে আমি ৬৮ শতাংশ নম্বর পাই।

এমএ পরীক্ষায়ও আমি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করি। সমসাময়িক ইতিহাসে আরও দুজন প্রথম শ্রেণি পান। প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন। প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী। আমি এবং আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দিই। ১৯৬৮ সালে মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। এ ছাড়া মধ্যযুগের ইতিহাসে একজন প্রথম শ্রেণি পান। বাংলার ইতিহাসে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন শরিফউদ্দিন আহমদ। আমি এমএ পাস করার আগে পাঁচ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে সমসাময়িক ইতিহাসে যিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হতেন, তাঁকে ইতিহাস বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে নিয়োগ করা হতো। এই পদে থেকে তিনি সিভিল সার্ভিসের জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিতেন এবং এঁরা সবাই সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে যোগ দেন।

আমি যে বছর এমএ পাস করি, সে বছর বিভাগে চারটি সহকারী অধ্যাপকের পদ শূন্য ছিল। তিনটি পদের জন্য তিনজন পিএইচডি প্রার্থী ছিলেন। চতুর্থ পদে অবশ্যই এমএ পাস কাউকে নিতে হবে। বিএ অনার্স এবং এমএতে খুব ভালো নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করায় আমি ধরে নিয়েছিলাম যে এই পদটি আমি পাবই। আমি এ সম্বন্ধে আর কোনো তদবির করিনি, নিশ্চিন্তে ঘরে বসেছিলাম। ইন্টারভিউ বোর্ডে হাজির হয়ে বুঝতে পারলাম যে এসব ব্যাপারে কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়। বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন ভাইস চ্যান্সেলর ওসমান গণি। তিনি ছিলেন কট্টর এনএসএফের সমর্থক। তিনি কোনোমতেই আমার মতো কট্টর পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থককে চাকরি দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। শুধু ছুতো খুঁজছিলেন। ছুতোটি দিলেন বিভাগীয় প্রধান মফিজুল্লাহ কবির। প্রথম প্রশ্নই আমাকে করা হলো

আমি সিএসএস পরীক্ষার ফর্ম দাখিল করেছি কি না। আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, ‘তোমার ইন্টারভিউ নিয়ে কোনো লাভ নেই। সিভিল সার্ভিসে যারা যোগ দিতে চায়, তাদের আমরা লেকচারার নিয়োগ করব না। এই একটি প্রশ্ন করেই আমার ভাইভা শেষ হয়ে গেল। আমি যাকে মনে করেছিলাম অত্যন্ত সহজ কাজ, আসলে সেটি হয়ে দাঁড়ায় অসম্ভব। মফিজউল্লাহ কবির দুর্বল চিত্তের লোক ছিলেন। যারা সিএসএস পরীক্ষা দেবে, তাদের বিভাগে চাকরি দেবেন না–এ ধরনের সিদ্ধান্ত তাঁর একার পক্ষে নেওয়া সম্ভব ছিল না। এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি আবদুল করিমের পরামর্শে। আবদুল করিম লন্ডন থেকে তাঁর দ্বিতীয় পিএইচডি করে ফিরে এসেছেন এবং ইতিহাস বিভাগে বাংলার ইতিহাস নামে একটি নতুন শাখা চালু করেছেন। এই শাখায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন আমার সহপাঠী শরিফুদ্দিন আহমদ। তিনি অনার্সে আমার চেয়ে প্রায় ৮০ নম্বর কম পান এবং এমএ পরীক্ষাতেও প্রায় ১৫ নম্বর কম পান। কিন্তু নম্বর এখানে বিচার্য বিষয় নয়। ড. করিম ভাবলেন, যদি তার ইচ্ছায় লেকচারার নিয়োগ হয়, তাহলে ইতিহাস বিভাগে তার প্রতিপত্তি হবে সবচেয়ে বেশি। অবশ্য এসব অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটি সমাধান ছিল। সমাধানটি আমাকে খেয়াল করিয়ে দেন। সলিমুল্লাহ হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক মফিজউদ্দিন আহমদ। তার কাছে সার্টিফিকেট আনতে গিয়েছিলাম। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বললেন যে শুনলাম তোমার চাকরি হয়নি। তারপর বললেন, ‘বাবা, চাকরি তো এত সোজা নয়, চাকরির দরখাস্ত করে তোমার আমার সঙ্গে দেখা করা উচিত ছিল। তাহলে সব ব্যবস্থা হয়ে যেত।’ ড. মফিজউদ্দিন তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ডাকসাইটে ছাত্রদের এনএসএফপন্থী শিক্ষকদের দলে ভর্তির চেষ্টা করছিলেন। পরে জানলাম আমার পূর্ববর্তী ব্যাচের অর্থনীতির পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নপন্থী একজন অধ্যাপককে বামপন্থী শিক্ষকদের নেতা ড. আবু মাহমুদের বিরুদ্ধে এনএসএফপন্থী শিক্ষকদের সঙ্গে একই বিবৃতিতে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করেছিলেন। ভাগ্যিস আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। তাহলে আদর্শবাদ একেবারেই বিসর্জন দিতে হতো।

ইতিহাস বিভাগে ভালো-মন্দ মিলিয়ে ১২ জন শিক্ষক ছিলেন। তখনকার দিনে ইতিহাস বিভাগে অনার্স কোর্সে ছাত্র ভর্তির আসন ছিল ৪০। বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি অর্জনের পর প্রতি ব্যাচে সাধারণত ৫ থেকে ১০ শতাংশ যে পেশায় যোগ দিত, সে পেশায় সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করত। অথচ ১৯৬১ সালে অনার্স কোর্সে ইতিহাস বিভাগে যারা ভর্তি হয়েছিল, তাদের ৪০ ভাগের বেশি নিজেদের পেশায় সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে। এই শ্রেণির পাঁচজন ছাত্র মন্ত্রী হয়েছিলেন। আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ছিলেন বিএনপির মহাসচিব এবং স্থানীয় সরকারমন্ত্রী। মোস্তফা জামাল হায়দার ছিলেন জাতীয় পার্টির যুগ্ম মহাসচিব এবং পূর্ত ও নগর উন্নয়নমন্ত্রী। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সদস্য এবং আইন ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা এবং রেলমন্ত্রী। মন্ত্রীর পদমর্যাদায় উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী ও আকবর আলি খান। সচিবের দায়িত্ব পালন করেন ছয়জন : আকবর আলি খান, আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, ইসমাইল হোসেন, আনিসুর রহমান (টাইগার), কামরুল হুদা ও হীরালাল বালা। অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদায় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য ছিল মোজাম্মেল হক। উপসচিব ছিলেন আবুল বাশার জোয়ারদার ও সৈয়দ আহমদ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল ছিলেন মেজর জেনারেল এ এম সিরাজ। পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন তিনজন : আকবর আলি খান, শরিফউদ্দিন আহমদ ও ফিরোজ মাহমুদ। কমপক্ষে দুজন ছিলেন ক্যাডেট কলেজ ও বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ। ব্যাংকার হিসেবে বিশেষ সাফল্য অর্জন। করেন দুজন। সুলেমান খান মজলিস, যিনি যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন এবং এ টি এম আফসার (সাবু) ছিলেন ন্যাশনাল ব্যাংকের ফার্স্ট এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট। ৮-১০ জন মহিলা ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁরা কেউই কোনো স্বাধীন পেশা বেছে নেননি। এঁরা এঁদের স্বামীর কর্মজীবনকে সমর্থন করেছেন। ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্রী ছিলেন মকসুদা বেগম। তাঁর স্বামী মঞ্জুরুল করিম জাঁদরেল স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন। রাশিদা খানম নানকুর স্বামী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার শাফায়েত জামিল। আমাদের সঙ্গে পাস কোর্সে এমএ পাস করেন বিএনপির বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী তানভীর আহমদ সিদ্দিকীর স্ত্রী খুরশীদ আজিম সিদ্দিকী।