সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড

ছাত্ররাজনীতি ছাড়াও আমাদের কেউ কেউ সমাজসেবামূলক কাজে জড়িত ছিল। কোনো ছাত্রের ওপর অবিচার হলে আমরা তাঁর পক্ষে দেনদরবার করতাম। তখন আমাদের দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। একজনের নাম মোস্তাফিজুর রহমান, আরেকজনের নাম জিয়াউল আনসার। এঁরা দুজনই অসুস্থতার জন্য আইএ পরীক্ষায় প্রথমবার হাজির হতে পারেননি। দ্বিতীয়বার তারা ভালো ফল করে আইএ পাস করেন। কিন্তু তখন সরকারের নিয়ম ছিল দ্বিতীয়বারে যারা পাস করবে, তাদের কোনো বৃত্তি দেওয়া হবে না। ডিপিআই অফিসে সিলেটের চৌধুরী সাহেব নামে এক ব্যক্তি বৃত্তি বরাদ্দ করতেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি দাবি করেন যে প্রথম বছরের বৃত্তির ৫০ শতাংশ তাকে দেওয়া হলে তিনি তাঁদের বৃত্তি বরাদ্দ করবেন। এই চুক্তি অনুসারে তাদের বৃত্তি দেওয়া হয়। যেদিন তারা বৃত্তির টাকা তুলতে রেজিস্ট্রারের অফিসে যান, সেদিন চৌধুরী সাহেব ছাত্রদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মোস্তাফিজ টাকা নিয়ে বেরোতে গেলে চৌধুরী সাহেব এসে বলেন, ‘আমার স্ত্রীর ডেলিভারি কেস, আমাকে অবিলম্বে টাকা দেন। আপনার স্ত্রীর ডেলিভারি কেস, আমি টাকা দেব কেন’ বলে মোস্তাফিজ হইচই শুরু করলেন। চৌধুরী সাহেব অবস্থা বেগতিক দেখে কেটে পড়লেন। এরপরে তিনি মোস্তাফিজকে টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। আমরা তখন সিদ্ধান্ত নিলাম ব্যাপারটা ডিপিআইয়ের নজরে আনা উচিত। ডিপিআই তখন ছিলেন শামসুল হক সাহেব। তিনি পরবর্তীকালে পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর অফিসে আমরা আট-দশজনের একটি ছাত্র প্রতিনিধিদল যাই। সেখানে গিয়ে মোস্তাফিজ জিজ্ঞাসা করেন, ‘স্যার, হোয়াট ইজ দ্য কনসেপ্ট অব ফিফটি পার্সেন্ট ইন ইয়োর অফিস’? শামসুল হক সাহেব তো আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি আমাদের বললেন, ‘এ রকম কোনো ব্যবস্থা নেই। আমি খোঁজ নেব এবং কিছু পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করব। তোমরা এখন বাড়ি ফিরে যাও, গিয়ে পড়াশোনা করো। আমরা ফিরে এলাম কিন্তু চৌধুরী সাহেবের কিছু হয়নি। অবশ্য মোস্তাফিজকেও আর বিরক্ত করা হয়নি।

সমাজসেবার একটি উদ্যোগ আমরা গ্রহণ করেছিলাম ১৯৬২ সালে। তখন খুলনায় স্থানীয় বন্যা হয়। এই বন্যায় লোকজন না খেয়ে ছিল এবং অনেকে কলেরায় আক্রান্ত হয়। তাদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়নি। এই খবর ইত্তেফাঁক এবং পাকিস্তান অবজারভার-এ ব্যানার হেডলাইনে প্রকাশিত হয়েছিল। এ খবর পড়ে আমরা সবাই স্তম্ভিত হয়ে যাই। আমাদের বর্ষের ২০-২৫ জন ছাত্র হলের অডিটরিয়ামে বসে সিদ্ধান্ত নিই যে আমরা বন্যাদুর্গত অঞ্চলে একটি রিলিফ মিশন নিয়ে যাব। তখন প্রশ্ন উঠল এত অর্থ আমরা কোথায় পাব? সবাই একমত হলো যে হল ইউনিয়নে এ ধরনের কাজের জন্য ফান্ড রয়েছে। যদি আমরা হলের প্রভোস্টকে রাজি করাতে পারি, তাহলে এই ফান্ড থেকে অর্থ পাওয়া সম্ভব হবে। আমরা ওই দিনই বিকেলে প্রভোষ্টের সঙ্গে দেখা করি। প্রভোস্ট শুনে খুশি হন। বলেন, ছাত্রদের তো এসব ব্যাপারেই উদ্যোগী হওয়া উচিত, শুধু রাজনীতি করলে তো চলবে না। তারপর তিনি বললেন, ‘তোমরা কী করতে চাও? আমরা বললাম, আমরা ওখানে চিড়া, মুড়ি, গুড়, চাল, ডাল–এ ধরনের শুষ্ক খাবার নিয়ে যেতে চাই এবং এগুলো বিতরণ করতে চাই। সঙ্গে আমরা সুপেয় পানি নিয়ে যাব, যাতে আমাদের নিজেদের এবং বন্যার্তদের পানির অভাব না হয়।

একজন বলে উঠল বন্যার্তদের আমরা টিএবিসি ইনজেকশন দেব। টিএবিসি মানে হলো (টি-টাইফয়েড, এ-এমিবিক, বি-বেসিলারি, সি-কলেরা) চারটি রোগের প্রতিষেধক ইনজেকশন। প্রভোস্ট বললেন, এটা করতে পারলে খুবই ভালো হয়। তবে টিএবিসি ইনজেকশনের জন্য তোমাদের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। আমি এখনই তোমাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি।’ বলে তিনি ফোনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিফ মেডিকেল অফিসার ড. মর্তুজার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তিনি বললেন, ‘আমার ছাত্রদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ বিষয়ে আপনি প্রশিক্ষণ দিন। ড. মর্তুজা রাজি হলেন এবং পরদিন বিকেল চারটায়। তিনি আমাদের তার অফিসে পাঠাতে বললেন। প্রভোস্ট বললেন, তোমরা ট্রেনিংটা নিয়ে নাও, আর এদিকে আমি টাকাপয়সার ব্যবস্থা করছি।’

পরদিন মহা-উৎসাহে আমরা ড. মর্তুজার অফিসে হাজির হই। গিয়ে দেখি তার রুমে হাতের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি করা অনেকগুলো চার্ট ঝোলানো। তিনি বললেন, ‘ইনজেকশন দিতে হলে হাত সম্পর্কে তোমাদের ধারণা থাকা দরকার। তারপর তিনি হাতের পেশি সম্পর্কে আমাদের বক্তৃতা দিলেন। হাতের নার্ভের ব্যবস্থা সম্পর্কে বক্তৃতা দিলেন, রগ সম্পর্কে বক্তৃতা দিলেন। তারপর তিনি ব্যাখ্যা করলেন যে ইনজেকশন দিলে পেশি, রগ এবং স্নায়ুর ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে। তিনি বললেন, বেশির ভাগ ইনজেকশনেরই খারাপ ফল হয় না, কিন্তু অনেক কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইনজেকশন রোগীর ক্ষতি করতে পারে। এমনও হতে পারে ভুল ইনজেকশনের জন্য হাত কেটে ফেলার প্রয়োজন পড়তে পারে। কোথাও কোথাও অনেক দিন ধরে হাতে ব্যথা থাকে, কোথাও কোথাও অমাবস্যা পূর্ণিমার সময় হাতে ব্যথা হয়। সঠিকভাবে ইনজেকশন না দিলে সেপটিক হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। ঘণ্টাখানেক বক্তৃতা দেওয়ার পর বললেন, আজকের বক্তৃতা ছিল তাত্ত্বিক, আগামীকাল প্রায়োগিক ক্লাস হবে। প্রায়োগিক ক্লাসে তোমরা আমার সামনে একজন আরেকজনের কাছ থেকে ইনজেকশন নেবে। ইনজেকশন নেওয়ার পর আমরা তোমাদের সাফল্যের সঙ্গে প্রশিক্ষণ সমাপ্তির প্রত্যয়ন দেব। তাঁর এ বক্তব্যের পর আমার তো আক্কেলগুড়ুম! পাশের বন্ধুবান্ধবের দিকে তাকালাম, এমন কাউকে দেখলাম না যার কাছে নিশ্চিন্তে আমার হাতে ইনজেকশন দেওয়ার জন্য হাত তুলে দিতে পারি। আমি তৎক্ষণাৎ মনে মনে ঠিক করলাম যে আমি পরের দিন যাব না। তবে যদি হলে থাকি বন্ধুবান্ধব বিরক্ত করবে। তাই আমি হলে ফিরে গিয়ে দু-একটা বই নিয়ে আমার চাচাতো ভাইয়ের বাসায় এলিফ্যান্ট রোডে চলে যাই। সেখানে গিয়ে আমি বলি আমার পেট খারাপ। আমি হলের খাবার না খেয়ে বাসায় রান্না করা খাবার খেতে এসেছি। ভাবি যত্ন করে শিং মাছ দিয়ে কাঁচকলার ঝোল রান্না করে আমাকে দেন। পরের দিন দুপুরবেলা আমি ঘোষণা করলাম যে আমার পেট ভালো হয়ে গেছে এবং সন্ধ্যার পর হলে গিয়ে হাজির হলাম। হলে গিয়ে দেখি বন্ধুবান্ধব আমাকে দেখে হাসছে। আমি তাদের হাসির তাৎপর্য বুঝতে পারিনি। রাতে তারা আমার কক্ষে এল। তারা বলল, তুই ভীরুর মতো কেন পালিয়েছিলি? গ্রামের চাষাভুষাদের ইনজেকশন দেওয়ার জন্য আমরা কি এত বড় ঝুঁকি নিতে পারি? আমরা হলেই ছিলাম এবং কেউ প্রায়োগিক পরীক্ষা দিতে যাইনি। আমাদের খুলনা যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। ঘটনাটি ছোট কিন্তু অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। এই ঘটনায় নৈতিকতার একটি সুন্দর সংজ্ঞা বেরিয়ে আসে। সে সংজ্ঞাটি হলো, যা তুমি নিজের ক্ষেত্রে করতে পারবে না, সেটা অন্যের ক্ষেত্রে করা সঠিক হবে না। প্রথম যখন এই সূত্রটি খুঁজে পাই, তখন মনে হয়েছিল যে এটি আমার নিজের আবিষ্কার। পরে ইতিহাস পড়তে গিয়ে জানি এই সূত্র খ্রিষ্টের জন্মের ৬০০ বছর আগে আবিষ্কার করেছিলেন পারস্যের পয়গম্বর জরথুস্ত্র। তিনি বলেছেন, ‘That nature alone is good which shall not do unto another whatever is not good unto its own self.’[১]

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. Will Durant, Out Oriental Heritage, 1935 : Simon and Schuster, New York P-369