১০
কয়টা দিন গুমট করিয়াছিল, পরের দিন সকাল থেকে মেঘ জমিতে জমিতে দুপুরের পর বৃষ্টি নামিল। এই জন্যও, তা-ভিন্ন মনেও দুইজনের মেঘ জমিয়া আছে, সে জন্যও, আর মোটেই বাহির হইলাম না। অম্বুরী বলিল, “হয়েছে ভাল, কাল যেমন আমায় ভাবিয়েছিল…”
বিকালে দুইখানা চিঠি পাইলাম; একটি বাড়ির চিঠি রিডাইরেক্ট করা, একটা তরুর। তরুর সেই প্রীতি-উপহার ছাপা হইয়াছে এক কপি পাঠাইয়া দিয়াছে। সত্যই খুব ভাল করিয়া ছাপাইয়াছে মীরা, এক্সমাস কি নিউ-ইয়ার কার্ডের মত চারখানি মোটা মোটা পাতার একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকার আকারে ছাপা। চওড়া সবুজ রেশমের ফিতা দিয়া বাঁধা। তরু লিখিয়াছে মীরা নাকি দুঃখ করিয়াছে পদ্যটি যেমন, তাহার যোগ্য ছাপানো হইল না। নিশীথবাবু আসিয়াছিলেন, মীরা নিজের হাতে একখানা দেয়। নিশীথবাবু বলিলেন, —ভয়ংকর চমৎকার হইয়াছে, তিনি কখনও এমন সুন্দর প্রীতি-উপহার পড়েন নাই। আমি চলিয়া আসিতে তরুর মন খারাপ হইয়া পড়িয়াছে। কাল রাত্রে খাবার সময় ওর বাবা, মা দুইজনেই নাম করিতেছিলেন। ওর বাবা বলিলেন, “তরুকে নিয়ে মাস্টারমশাই না হয় বিলেতে চলে যান না, ইচ্ছে থাকে নিজেও কিছু শিখে আসুন।” মা বলিলেন, “লক্ষ্মী-পাঠশালার শখ এর মধ্যেই মিটে গেল?” তাহার পর থেকেই ওর বাবা চুপ করিয়া গেলেন। যদি যাইতে চাই আমি বিলাত, একাই হোক, বা তরুকে লইয়া হোক—তাহা হইলে ওর দিদি চেষ্টা করিতে পারে। আজ আমার ঘরে বসিয়া এই কথা বলিল।
আর একটা কথা বলিল দিদি। বলিয়াছে, “তরু, তোমার মাস্টারমশাইকে সাবধান ক’রে দাও, তাঁর জন্যে মস্ত বড় একটা সারপ্রাইজ তোয়ের করেছি আমি, নোটিশ দিয়ে রাখলাম!”
তরুকে কিছু বলে নাই মীরা, আমি কিছু আন্দাজ করতে পারি কি?
চিঠিটা যখন পাইলাম তখন অম্বুরীও ছিল সেখানে বসিয়া, প্রশ্ন করিল, সারপ্রাই না কি লিখেছে, ওটার মানে কি ঠাকুরপো? সারপ্রাই তোয়ের করা কি?”
অনিল বলিল, “তার মানে হঠাৎ এমন একটা কিছু ক’রে বসবে যাতে শৈলেনের একেবারে তাক লেগে যাবে।”
“আর আমি ভাবলাম ঠাকুরপোর জন্য মস্ত একটা মালা তোয়ের করছে বুঝি। হাসি নয়, সত্যিই তাই ভেবেছিলাম—মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, আমরা কি ক’রে জানব বল? ভাবলাম ইংরিজীতে মালাকেই বুঝি সারপ্রাই বলে।”
অদ্ভূত আন্দাজে নিজেই একটু লজ্জিত হইয়া বলিল, “অবিশ্যি বলতে পার ঢাক পিটিয়ে সাবধান ক’রে আর কে মালা দেয়। তা জজ-ব্যারিস্টারের মেয়ে, ওদের পদ্ধতি কেমন কি ক’রে জানব বল?”
একটু থামিয়া বলিল, “বেশ, তা কি সারপ্রাই করবে বলই না—মালা না-ই হ’ল।”
বলিলাম, “সেটা তো তোমায়ই জিজ্ঞেস করব মনে করছিলাম; মেয়েছেলেদের সারপ্রাইজ্ করবার কি সব রীতি তা আমরা কি করে জানতে পারব?—বিশেষ ক’রে আমি বেচারা।”
অম্বুরী চক্ষু তুলিয়া চিন্তা করিতেছিল, অনিল বলিল, “হ্যাঁ, ভেবে আরও দু-একটা বল অম্বুরী, তোমার বা তোমাদের একটা সারপ্রাইজ করবার রহস্য তো জানাই গেল।”
অম্বুরী বিস্মিত ভাবে চাহিয়া প্রশ্ন করিল, “কি?”
“এই মালা তোয়ের করবার কথা। যদিও অভ্যেস হ’য়ে পড়ায় আমার কাছে ওতে কিছু সারপ্রাইজ নেই।”
অম্বুরী বলিল, “আমি তোমার জন্যে রোজ রোজ মালা তোয়ের করতে গেলাম! আমার খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই যেন।”
অনিল বলিল, “রোজ নয়; রোজ হ’লে তো আর সারপ্রাইজ হ’ল না। যেমন কোন রাত্তিরে যদি তেমন জ্যোৎস্না ফুটল, কিংবা ধর আজ রাত্তিরে—এই ঘন বর্ষা নেমেছে…”
অম্বুরী ধমক দিয়া বলিল, “আচ্ছা, তোমার লজ্জা বলে একটা বস্তু নেই? কি বেহায়াপনা হচ্ছে বল দিকিন ঠাকুরপোর সামনে?”
অনিল হঠাৎ সচকিত হইয়া উঠিল, যেন একটা ভুল সামলাইয়া লইবার ভঙ্গিতে বলিল, “ও ঠিক, মনেই ছিল না…শৈলেন, ওটা আমাদের নিজেদের মধ্যেকার কথা…”
“আঃ কি জ্বালা গা!”—বলিয়া অম্বুরী তাড়াতাড়ি উঠিয়া পলাইল।
অনিল বলিল, “অম্বুরীর সামনে কথাটা তুললে ও বোধ হয় মাকে বলত, মা আবার এই নিয়ে ভ্যানর ভ্যানর লাগাত, তাই ওকে দিলাম উঠিয়ে। জিজ্ঞাসা করছিলাম, বিলেত যাওয়ার কথাটা সিরিয়াস ভাবছিল্ শৈল?”
আমি হাসিয়া বলিলাম, “কথাটা কি সিরিয়াসলি উঠেছে বলে তোর বিশ্বাস অনিল?”
অনিল একটু চিন্তা করিল, তাহার পর বলিল, “ধর, যদি ওঠে কখনও? যে ভাবেই উঠুক, উঠছে তো কথাটা? তোর নিজের কাছেও তো বারদুয়েক প্রশ্ন হয়েছে বললি। আমি যতটা বুঝেছি ব্যাপারটা তোদের দু-জনের সম্বন্ধে তরলতা কিংবা ঘনিষ্ঠতার ওপর নির্ভর করছে। আমার মনে হয় এখানে রায়-দম্পতি ওঁদের মেয়েকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন।”
আমি বলিলাম, “ঠিক এখানেই ওঁরা আমার স্বাধীনতা নষ্ট করেছেন। আমি যেতে পারি যদি তরুর গার্জেন হ’য়ে যেতে হয়, কিন্তু সেটা হবে না অনিল।”
অনিল প্রশ্ন করিল, “কেন?”
বলিলাম, “যতদূর বুঝতে পেরেছি, তরুর বিলিতী কেরিয়ার ঐ লরেটো পর্যন্ত। ওর মায়ের ওপর দ্বিতীয় আর একটা আঘাত দিতে মিস্টার রায় সাহস করবেন না। তাঁদের ছেলের আঘাতই তাঁর পক্ষে দিন দিন মর্মান্তিক হ’য়ে উঠেছে। ভুটানীর ব্যাপারটা যদি নিজের চক্ষে দেখিস তো স্পষ্টই বুঝতে পারবি, অপর্ণা দেবী ওর মধ্যে দিয়েও নিজের পুত্রশোকটা আর একবার ক’রে উপলব্ধি করছেন। শোককে এই রকম দু-ধারায় পান করলে আর কত দিন টিকবেন?”
অনিল একটু চিন্তিত ভাবে থাকিয়া বলিল, “হুঁ।…বেশ ধর্ তরু যেমন লিখেছে মীরা চেষ্টা ক’রে যদি তোকে একাই পাঠাতে পারে কোন ট্রেনিঙের জন্যে কিংবা ব্যারিস্টারির জন্যে?”
আমি অল্প একটু হাসির সঙ্গে বলিলাম, “সেই কথাই তো বলছিলাম। পৌঁছুতে পারব কি বিলেতে তা হ’লে?”
অনিল একটু বিমূঢ় ভাবে প্রশ্ন করিল, “তার মানে?”
বলিলাম, “তার মানে অতটা লজ্জার বোঝা ঘাড়ে ক’রে যাত্রা করলে জাহাজসুদ্ধ ডুবে মরব না কি?”
অনিল লজ্জিতভাবে হাসিয়া বলিল, “না না, আমি তা মীন্ করিনি।…আচ্ছা, আর একটা সম্ভাবনার কথা ধর্; মানে ধর্ রায় দম্পতিই যদি স্বতঃপ্রবৃত্ত হ’য়ে তোকে পাঠান?”
বলিলাম, “একই কথা হ’ল না কি? তার পেছনেও কি মীরা নীরব মিনতি নিয়ে রইল না?”
অনিল আবার একটু থামিল, তাহার পর বলিল, “কেন যৌতুক বলে কিছু দেবার অধিকার নেই বাপ-মায়ের?”
বলিলাম, “ঠিক এই কথাই তুই আর একবার জিগ্যেস করেছিলি অনিল, পরশুই। নিজের বুদ্ধিমত আমিও উত্তর দিয়েছি—অর্থাৎ এটা ঠিক যৌতুক হবে না, হবে আমার বর্তমান অবস্থাকে অপমান। গরীব বাপ-মায়ে জন্ম দিয়ে যে আমায় মীরার উপযোগী শিক্ষা দিতে পারলেন না—সেই ব্যাপারটা নিয়ে ব্যঙ্গ। আমার বাপ-মায়ের গরীবিয়ানা তাতে ক্ষুণ্ণ হবে।”
বাহিরে প্রবল ধারায় বর্ষাপাত চলিয়াছে। অনিল আবার খানিকক্ষণ মৌন রহিল, তাহার পর প্রশ্ন করিল, “বিলেত তা হ’লে হ’ল না?”
বলিলাম, “হবেই—যদি এই রকম পড়বার সুবিধেটা থেকে যায়। কোন না-কোন একটা স্কলারশিপ নিয়ে আমি যাবই বিলেত—বিলেতই হোক বা জার্মানীই হোক।”
অনিল খোলা দরজা দিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া থাকিয়া যেন অন্যমনস্কভাবে ধীরে ধীরে টানিয়া টানিয়া বলিল—“যদি—এই রকম—পড়ার সুবিধেটা থেকে যায়…যদি!…”