8

অপর্ণা দেবী কি করিয়া প্রসঙ্গটা আবার তুলিবেন যেন ঠাহর করিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। তরু চলিয়া গেলে একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, “বলছিলাম তোমার বেড়াতে যাওয়ার মতলবটা যেন হঠাৎ হ’ল। কোন আত্মীয়-স্বজন কাছে-পিঠে আছেন নাকি?”

বলিলাম, “আত্মীয় নয় শ্রীরামপুরের কাছে আমার এক বন্ধু থাকে, একবার তার ওখান থেকে একটু ঘুরে আসব, অনেক ক’রে লিখেছে। কাছে, অথচ প্রায় পাঁচমাস যাইনি। ওদিকে পরীক্ষার জন্যে তোয়ের হ’তে নিঃশ্বাস ফেলবার যো ছিল না, তার পরেই আপনাদের এখানে এসেছি, বুঝেসুঝে নিতে এই তিনটে মাস কেটে গেল।”

অপর্ণা দেবী সুযোগটা হাতছাড়া হইতে দিলেন না, কথায় বাধা দিয়া বলিলেন, “তা কেন বুঝছ?”

বলিলাম, “ভাগই। তরুর মত তীক্ষ্ণবুদ্ধি ছাত্রী পাওয়া তো…”

“সে না হয় হ’ল, আর তীক্ষ্ণবুদ্ধি হ’য়েই বা কি করবে?–দোটানায় ফেলে ওকে কোথায় যে দাঁড় করাবে এরা, আন্দাজ করতেই পারছি না…আমি পড়াশোনা নিয়ে বোঝাবুঝির কথা বলছিলাম না; তুমি এই বাড়িতে রয়েছও তো? সেই দিক দিয়ে কেমন বুঝছ?”

বলিলাম, “সেদিক দিয়ে আমার তো আপনারা রাজার হালে রেখেছেন।”

অপর্ণা দেবী এই দ্বিতীয় সুযোগে সোজাসুজি আসল কথাটায় আসিয়া পড়িলেন, বলিলেন, “বেশ, মেনে নেওয়া গেল রাজার হালেই রয়েছ তুমি; কিন্তু যাকে রাজার হালে রাখা যায় তার মান-অভিমান সম্বন্ধেও সেই রকম সতর্ক হ’য়ে থাকতে হয়।… কাল এতে একটু ত্রুটি হয়েছে শৈলেন, আমার মনে হচ্ছে তোমার এই হঠাৎ বেড়িয়ে আসার সঙ্গে তার একটু সম্বন্ধ আছে।”

কথাটা এত আচম্বিতে আনিয়া ফেলিয়াছেন যে, আমি কি যে জবাব দিব বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিলাম না। অপর্ণা দেবীই বলিলেন “আমি তোমায় যতটা জেনেছি তাতে অবিশ্বাসের কারণ নেই—তুমি যখন ছুটি নিচ্ছ তখন নিশ্চয় ছুটিই নিচ্ছ; কিন্তু বলতে বাধা নেই, আমার একবার যেন একটু মনে হয়েছিল তুমি একটা অশোভন গোলমাল না করে ছুটির নাম নিয়ে আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছ।”

আমি আবার মুখ তুলিয়া হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিলাম, “এমন কি মহামা কাণ্ড হয়েছে যে…?”

অপর্ণা দেবী সারারণত খুবই সংযত প্রকৃতির স্ত্রীলোক, কিন্তু স্পষ্ট বুঝা গেল ভিতরে বেশ একটু অধৈর্য হইয়া উঠিয়াছেন, বলিলেন, “শৈলেন, আমি সব কথা শুনেছি। কাল সন্ধ্যেয় তরুর খোঁজ নিতে গিয়ে টের পেলাম তুমি তরুকে বেড়াতে নিয়ে গেছ। সেই থেকেই আমার মনে অশান্তি লেগে ছিল—বাড়িতে একটা পার্টি, আর তুমি তাকে নিয়ে বেড়াতে চলে যাবে এমন বেখাপ্পা কাজ তুমি কখনই করতে পার না; মীরাকে জানি, কিছু একটা ঘটেছে নিশ্চয়, যাতে তোমার মারাত্মক রকম কর্তব্যপরায়ণ হ’য়ে উঠতে হয়েছে। পার্টি ভেঙে গেলে টের পেলাম। টের পাবার ইতিহাসটাও বড় চমৎকার। তোমাদের সঙ্গে পার্টিতে যারা সব ছিল তাদেরই মধ্যে একজন এসে বড় গলা ক’রে ব্যাপারটা আদ্যোপান্ত আমার কাছে বর্ণনা করলে, যেন মীরা একটা মন্ত বড় বাহাদুরি করেছে। —আমি আর তার নাম করলাম না, কিন্তু তুমি তাকে চিনেছ নিশ্চয়।… কি করব এদের সঙ্গেই তো মীরাকে মেলামেশা করতে হবে?”

বুঝিলাম, নিশীথের কাজ; মীরার সব চেয়ে বড় আর সব চেয়ে অযোগ্য স্তাবক, ওদের মধ্যে আমার প্রবেশটা ওরই সব চেয়ে পীড়াদায়ক হইয়াছিল, আমার অপমানে তাই ও-ই হইয়াছিল সব চেয়ে পুলকিত; প্রথম সুযোগ পাইয়াই অপর্ণা দেবীকে সুসংবাদটা না জানাইয়া পারে নাই।… মূর্খ! এত দিন দেখিয়া শুনিয়াও অপর্ণা দেবীকে চেনে নাই।

আমি নীরবই রহিলাম।

অপর্ণা দেবী খানিকক্ষণ চুপ করিয়া কি ভাবিতে লাগিলেন, তাহার পর প্রশ্ন করিলেন, “তোমায় একদিন হেরিডিটি সম্বন্ধে কতকগুলো কথা বলেছিলাম, মনে আছে শৈলেন?”

কথাটা পূর্বে উল্লেখ করিতে ভুলিয়া গিয়াছি; —একদিন কথা প্রসঙ্গে অপর্ণা দেবী হেরিডিটি বা বংশানুক্রমিকতার কথা তুলিয়াছিলেন। এই রকম একটা অবান্তর বিষয় সম্বন্ধে ওঁর অধ্যয়ন ও জ্ঞানের গভীরতা দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছিলাম।

আমার জীবনের যা সবচেয়ে বড় সমস্যা হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহা কি ভুলিতে পারি? তবুও কথাটা হাল্কা করিয়া ফেলিবার জন্য হাসিয়া বলিলাম, “হ্যাঁ, বলেছিলেন বটে বংশের ধারাটা কখনও কখনও একটা বা দুটো ধাপ বাদ দিয়ে আবার চাগিয়ে ওঠে। আপনাদের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন—আপনাদের দেহে যে রাজবংশের রক্ত আছে, এটা আপনার মনে না থাকলেও মীরা দেবীর মধ্যে এ-ধারণাটা আবার ফুটে উঠেছে।”

অপর্ণা দেবী আরও বেশি বলিয়াছিলেন,—বলিয়াছিলেন, “আশ্চর্য এই যে, মীরার রক্তের মধ্যে সেই রাজবংশের ধারাটা আরও পাৎলা হ’য়ে আসা সত্ত্বেও ওরই মধ্যে মর্যাদাজ্ঞানটা—আভিজাত্যের গুমরটা আরও উৎকট হ’য়ে দেখা দিয়েছে।”

অবশ্য এ-কথাটা আর অপর্ণা দেবীকে আমি বলিলাম না এখন।

অপর্ণা দেবী একটু শঙ্কিত-ব্যথিত কণ্ঠে বলিলেন, “ঐ হয়েছে সর্বনাশের গোড়া, শৈলেন। যখন জানই সব, তখন বরাবরের জন্যে তোমায় একটা কথা বলে রাখি,—মীরা এ-বিষয়ে নিরুপায়। ও মেয়ে ভাল, কিন্তু প্রকৃতির বিরুদ্ধে কি ক’রে যাবে? ওর মধ্যে এই নতুন গণতন্ত্রের যুগ আর মৃতপ্রায় রাজতন্ত্রের যুগ পাশাপাশি কাজ করছে। ও তোমাদের চায়, তোমাদের মধ্যে যেখানে সৌন্দর্য, যেখানে মহত্ত্ব সেখানে ওর নজর গিয়ে পড়ে; কিন্তু ওর মায়ের বংশের কোন যুগের রাজা-মহারাজারা ওর মাথা দেন বিগড়ে মাঝে মাঝে। ও এইখানে একেবারে নির্দোষ। তাই বলছিলাম শৈলেন—মীরার ব্যবহারে যদি তুমি কখনও চলে যেতে বাধ্য হও তো নিশ্চয় যেও—হীনতা কেউ মাথা পেতে নেয় এটা আমি চাই না—কিন্তু ওকে ক্ষমা করো। হ’তে পারে রাজরক্তের খামখেয়ালীপনায় ও তোমার মনুষ্যত্বের কাছে কোন সময় বোধ হয় আরও বেশি অপরাধ করবে; আমাদের বাড়ির আতিথ্যধর্মে সেটা একটা মস্ত বড় অন্যায় হবে বলে আগে থাকতেই আমার মেয়ের হ’য়ে তোমায় এই অনুরোধ ক’রে রাখলাম।”

অত্যন্ত লজ্জিত এবং অস্বস্তি বোধ করিতেছিলাম। বলিলাম, “আপনি ব্যাপার”টাকে বড় বাড়িয়ে দেখে মিছিমিছি কষ্ট পাচ্ছেন; আসলে অতটা কিছু নয়। বোধ হয় একেবারেই কিছু নয়। হেরিডিটি নিয়ে মীরা দেবীর সম্বন্ধে আপনার একটা বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে বলেই আপনি অতটা ভেবে নিয়েছেন। নিশীথবাবুও বোধ হয় নিজের মনের রঙ ফলিয়েই কথাটা আপনাকে বলেছেন…।

অপর্ণা দেবী চক্ষু তুলিয়া চাহিতে হুঁশ হইল—নিশীথের নামটা হঠাৎ আমার মুখ দিয়া বাহির হইয়া গিয়াছে, অথচ তিনি ওটা প্রকাশ করিয়া বলেন নাই। কিন্তু অপর্ণা দেবী সে-বিষয়ে কিছু না বলিয়া, দৃঢ়তার সহিত বলিলেন, “আমার ধারণাটা ভুল নয় শৈলেন, নিজেরই মেয়ে তো, এতটা ভুল হবে না। ওর এই রাজরক্তের গুমর নিয়ে আমার মস্ত বড় একটা আশঙ্কাও রয়েছে, ভগবান না করুন, সেটা যদি কখনও ফলে ওর জীবনে…।”

একটু ভীতভাবে চাহিয়া প্রশ্ন করিলাম, “কি আশঙ্কা?”

অপর্ণা দেবী বলিলেন, “আশঙ্কা ঐ নিশীথকে নিয়ে, জান তো ও একজন খুব বড় জমিদারের ছেলে। নিজে যে ও একেবারেই অপদার্থ, যদি মীরা অসার বংশমর্যাদার মোহে এ-কথাটা কখনও ভুলে বসে?”

প্রকৃতিস্থ হইতে একটু বিলম্ব হইল।

সমস্ত ঘরটা নিস্তব্ধ। ভুটানী তান্দ্রালু হইয়া পড়িয়াছে, তাহার হাতের স্ফটিক মালাটা কোলে পড়িয়া গিয়া ‘ছলাৎ’ করিয়া একটা মৃদু শব্দ হইল।

অপর্ণা দেবী প্রশ্ন করিলেন, “কবে যাবে?”

উত্তর করিলাম, “কালই যাই তাহ’লে। ক’টা দিন কাটিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসি।”

অপর্ণা দেবী বলিলেন, “বেশ যাও, একটু জায়গা বদলান দরকার।”

সিঁড়ি দিয়া নামিতেছি, দেখি সরমা উঠিয়া আসিতেছে। আমি সিঁড়ির বাকে পাশ কাটাইয়া দাঁড়াইলাম। নমস্কার করিয়া প্রশ্ন করিলাম, “একটু অসময়ে যেন?”

ল্যাণ্ডিঙের দুইটা ধাপ নীচে দাঁড়াইয়া হাসিয়া উত্তর দিল, “মীরার ঝোঁক চাপলে তো সময়-অসময় বাছবার যো নেই। ফোন মারফত হুকুম হয়েছে—যেমন আছি চলে আসতে হবে, নৈলে আমার সঙ্গে চিরদিনের আড়ি।”

কিছু একটা বলার দরকার বলিয়াই বলিলাম, “একেবারে জার্মান কাইজারের আলটিমেটাম?”

“ঠিক তাই, কিন্তু কারণটা কি?”

“জানি না তো!”

সরমা আমার পাশ দিয়া উঠিয়া গেল। সিঁড়ির মাথায় গিয়া আমার দিকে ফিরিয়া হাসিয়া বলিল, “অবশ্য জানবার কথাও নয় আপনার।—শুনেছি কাইজার নিজের নিকটতম পার্শ্বচরদেরও সব সময় নিজের গুপ্ত মন্ত্রণা জানাতেন না।”

ওদিক ঘুরিতেই নিশ্চয় মীরাকে দেখিতে পাইল। অগ্রসর হইতে হইতে বলিল, “তোমার এমন ‘ভয়ানক মন খারাপ’ কিসের জন্যে যে…”

যেন ওদিক থেকে বারণের ইঙ্গিত পাইয়া থামিয়া গেল।

রাত্রের আহারের সময় মিস্টার রায়কেও বলিলাম। একটু বেশি অন্যমনস্ক ছিলেন; বলিলেন, “যদি বেড়াতেই হয় শ্রীরামপুর না গিয়ে একবার পদ্মার ওদিকটা হ’য়ে এস বরং, চাঁদপুর, পার তো কুমিল্লা পর্যন্ত…ও রকম চমৎকার…”

আজ বিলাস-ঝি ডাইনিং-রুমে ছিল, এক-একদিন থাকে, পরিবেশনে সাহায্য করে। বলিল, “শুনছেন মাস্টারমশায়ের বন্ধু থাকেন শ্রীরামপুরে, উনি পদ্মার ধারে গিয়ে হাঁ ক’রে দাঁড়িয়ে থেকে কি করবেন? আপনার মাথা খারাপ হয়েছে রায়মশাই…কি রকম মক্কেলের পাল্লায় আজ পড়েছিলেন বলুন তো?”

মিস্টার রায় কাঁটা-চামচ প্লেটের উপর রাখিয়া দিয়া সিধা হইয়া বসিলেন, বলিলেন, “ভীষণ বিলাস, ভীষণ! আর বুড়ো বয়সে একলা এঁটে উঠতে পারি না। ভাবছি কাল তোমায় জুনিয়ার করে নিয়ে যাব—যেমন চমৎকার ওকালতিটা করলে মাস্টার-মশাইয়ের পক্ষে!…”

পরদিন সকালে সঙ্গে ল‍ইয়া যাইবার জন্য কয়েকখানা বই, কাপড়-চোপড় অনিলের ছেলেমেয়ের জন্য গোটাকতক খেলনা, আর কয়েকটা টুকিটাকি গুছাইয়া লইতেছি, তরু নামিয়া আসিল। খুব উল্লসিত। বলিল, “উঃ কী চমৎকার যে আপনার পদ্যটি হয়েছে মাস্টারমশাই!”

হাসিয়া বলিলাম, “সত্যি নাকি?”

তরু একটু ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল, “বিশ্বাস করছেন না, কিন্তু দিদি নিজে বলেছে!”

আমি চক্ষু কপালে তুলিয়া বলিলাম, “তবেই তো! আর, বিশ্বাস যে করতেই হবে এ হুকুমও হয়েছে নাকি তোমার দিদির?”

আমার কপট গাম্ভীর্য দেখিয়া তরু হাসিয়া ফেলিল, সেও কৌতুকের ভঙ্গিতে ঈষৎ হাসিয়া মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলিল, ‘হ্যাঁ, হয়েছে হুকুম। আরও একটা হুকুম হয়েছে।”

আমি আবার একচোট ভয় পাইয়া প্রশ্ন করিলাম, “আবার কি?”

তরুও ভয় পাইবার ভঙ্গিতে বলিল, “আপনার ঠিকানাটা দিয়ে যেতে হবে।”

“কেন?”

তরু হাসিতে হাসিতেই সামনে ঘাড়টা দুলাইয়া দুলাইয়া বলিল, “কেন আবার? আরও যদি কোন হুকুম করতে হয় দিদির, কি ক’রে করবেন? —বাঃ!”

তাহার পর আমার গা ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া আমার মুখের পানে চাহিয়া বলিল, “না মাস্টারমশাই, দিদি প্রীতি-উপহারটা খুব ভাল কাগজে ছাপাবেন, আপনাকেও একখানা পাঠাবেন, তাই ঠিকানাটা চেয়ে রাখতে বললেন।”

আমি ছুটিতে যাইব, মীরা বিশ্বাস করিতে পারিতেছে না আমায়, কোন একটা যোগসূত্র ধরিয়া থাকিতে চায়।

আপনি যাইবেন, তাই লইয়া একজন অহেতুকভাবে শঙ্কিত—কথাটা ভাবিতেও সুখ নয় কি?