১৪
ক্ষণমাত্র দ্বিধা, তাহার পর আমি আবার ফিরিয়া পা বাড়াইলাম। সৌদামিনী ডাকিল, “ও সানু, যাচ্ছ কেন? তোমরা নাইবে এস, আমি ও-ঘাট দিয়ে উঠে যাচ্ছি।”
আমি ওকে ও-ঘাটে যাইবার অবসর দিয়া পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম, একটু পরে চাহিয়া দেখি সৌদামিনী সেই ভাবেই চিবুক পর্যন্ত নিমজ্জিত করিয়া দাঁড়াইয়া আছে; ঊর্ধ্বাঙ্গের বস্ত্র ভাল করিয়া লইয়া সংবৃত করিয়া তাহার উপর গামছাটা ঘুরাইয়া দিয়াছে। নড়ন চড়নের কোন লক্ষণ নাই। আমি ফিরিয়া চাহিতে একটু হাসিয়া প্রশ্ন করিল, “শৈলদার হঠাৎ পুকুরে নাওয়ার সখ হ’ল যে?”
আমি হাসিয়া বলিলাম, “গঙ্গায় বড্ড কুমীর, তাই সানু আমায় এখানে নিয়ে এল। এখানে এসেও সানু তোমার ডুব-সাঁতার কাটতে দেখে কুমীর ভেবে পালাচ্ছিল।”
সদু বলিল, “যাক ওর ভুলটা ভেঙেছে।…আপনার ভুলটা যেন এখনও রয়েছে মনে হচ্ছে”—বলিয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।
হাসি থামাইয়া বলিল, “আপনি বসুন একটু ঘাটে এসে শৈলদা, কতক্ষণ জঙ্গলে দাঁড়িয়ে থাকবেন? —গো-সাপের আড্ডা। সাঁতার কেটে হাঁপ ধরেছে, একটু জিরিয়েই আমি ও-ঘাট দিয়ে উঠে যাব।”
চুপ করিয়া রহিলাম একটু দুজনে। সানু প্রশ্ন করিল, “টুমি এখন নাইবে না শৈল টাকা?”
বলিলাম, “না।”
“কেন?
কাজেই সৌদামিনীর সঙ্গে কথা কহিতে হইল, সানুর অসঙ্গত প্রশ্নের উত্তর এড়াইবার জন্য। বলিলাম, “তুমি রোজ এখানেই নাইতে আস নাকি সদু?”
সৌদামিনী উত্তর করিল; “হ্যাঁ, এখানে থাকলেই আসি।”
একটু চুপ করিয়া থাকিয়া আমার মুখের পানে চটুল হাস্যের সহিত চাহিয়া বলিল, “অভ্যেস ম’লেও যায় না কিনা; তুমিই বল না শৈলদা?”
আমি আর ওর মুখের পানে চাহিয়া থাকিতে পারিলাম না এবং যে-কারণে সানুকে এড়াইয়া সদুর সঙ্গে কথা আরম্ভ করিয়াছিলাম, সেই কারণেই সদুকে ছাড়িয়া আবার সানুর সঙ্গে আলাপ আরম্ভ করিয়া দিতে হইল। বলিলাম “না হয় নেয়ে নাও গে না সানু ততক্ষণ।”
“একলা?”
বলিলাম, “একলা কেন? তোমার মাসীমা তো রয়েছেন?”
অতটা পছন্দ হইল না কথাটা সানুর। আমার হাতটা জড়াইয়া ধরিয়া আব্দারের সুরে বলিল, “না, টুমিও টলো।”
ভীষণ বিব্রত হইয়া আমি সংক্ষেপে বলিলাম, “না!”
সানু মুখটা উঁচু করিয়া নাছোড়বান্দার মত বলিল, “কেন? টুমি মাসীমার ঠঙ্গে নাও না?”
আমার অবস্থা তখন—“বল্ মা তারা দাঁড়াই কোথা?” কোন রকমে বলিলাম “না”—এবং এর পরেও আবার “কেন?” বলিয়া যে প্রশ্ন হইবে তাহার ভয়ে কাঁটা হইয়া রহিলাম।
সদু কৌতুক দেখিতেছিল, হাসিয়া বলিল, “ওঁর কথা বিশ্বাস ক’রো না সানু; উনি ছেলেবেলায় তোমার মাসীমার সঙ্গে অনেক নেয়েছেন—এই পুকুরেই; না হয় তোমার বাবাকে জিগ্যেস ক’রো।”
সঙ্গে সঙ্গে কথাটা একটু ঘুরাইয়া লইয়া বলিল, “কিন্তু আজকাল আর সে বড়পুকুর নেই; আছে শৈলদা?”
যেন পরিত্রাণ পাইলাম। বলিলাম “সত্যিই নেই।”
“তার কিছুই নেই, মজে এসেছে, শ্যাওলা জন্মে গেছে, ঘাটে লোক ও থাকে না; কষ্ট হয় দেখলে!”
বলিলাম, “তবুও তো তুমি আসতে ছাড় না দেখছি।”
সদু জলের মধ্যে তাহার শুভ্র বাহু দুইটি ঘুরাইয়া আনিয়া যেন আলিঙ্গন করিয়া বলিল, “হ্যাঁ তবুও আমার বড়পুকুর বড্ড ভাল লাগে, চমৎকার লাগে। এখানে এসেই যেন মনে হয় শৈলদা যে আবার ছেলেমানুষ হ’য়ে গেছি, সেটা কি অল্প লাভ মনে কর?.. কি রকম জান শৈলদা?—বয়স হ’লে আবার প্রথম ভাগ কি দ্বিতীয় ভাগ পড়লে যেমন ছেলেমানুষ হ’য়ে গেছি বলে মনে হয় সেই রকম।”
আমি অতিমাত্র বিস্ময়ে সদুর মুখের পানে চাহিলাম, এতটা ভারসাম্য কি করিয়া আসে; ঠিক এই কথাই যে অনিল বলিল সেদিন!
সদু আমার বিস্মিত ভাব দেখিয়া বলিল, “তুমি বিশ্বাস করছ না শৈলদা? বড়পুকুরে এলে সতিই আমি অন্য মানুষ হ’য়ে যাই। মনেই থাকে না কোথাকার মানুষ কাদের বাড়ির বৌ। তুমি তো দেখেই ফেলেছ আমায়—সাঁতার কাটছিলাম!—বৌ মানুষ সাঁতার কাটে, এ আবার কে কোথায় শুনেছে বল? আবার যে-সে বৌ নয়, পঞ্চাশ বছরের বুডীর মত সর্বদা সভ্যভব্য ভারিক্কে হ’য়ে থাকা উচিৎ”—বলিয়া আবার খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।
আবার গম্ভীর হইয়া পড়িতে বলিল, “না সত্যিই বলছি শৈলদা, একবারে অন্য মানুষ হ’য়ে যাই, স্মৃতির পথ বেয়ে যে কোথায় যাই চলে! শুধু আমি কি একাই? তোমরা পর্যন্ত এসে জোট—তুমি, অনিলদা, বঙ্কু। পরশু এই রকম ঘাটে গা ডুবিয়ে বসে হঠাৎ নিজের মনেই হেসে উঠেছি, রতন বাগ্দীর ভাদ্দর-বৌ জল তুলতে আসছিল, দেখতে পাইনি। বলে, ‘ওকি সদু ঠাকুরঝি, পাগল হ’লে নাকি?’ আসল কথা, অনেক দিনের একটি কথা মনে পড়ে গেল, বুঝলে শৈলদা? —জামরুল খেতে সাধ হয়েছে তোমাদের সদীর। দুপুর বেলা, অনিলদা ঐ জামরুল গাছটায় উঠেছে, তুমি গুঁড়িটা জড়িয়ে ধরে উঠছ, আমি অনা বাগ্দীর দাওয়ায় বসে দেখছি, এমন সময় দিদিমা-বুড়ী একটা আমের শুকনো ডাল হাতে ক’রে—‘কোথায় গেল তারা—গেল কোথায়?’ —-করতে করতে হন্ হন্ ক’রে ঘাটের পানে এগিয়ে আসছে। সঙ্গে বঙ্কু। তাকে তোমরা কি জন্যে খেদিয়ে দিয়েছ বলে সে-ই গিয়ে ডেকে নিয়ে এসেছে বুড়িকে। যেমনি গলার আওয়াজ কানে যাওয়া অনিলদা তো সেই মগডাল থেকে কোঁচড়ে জামরুলসুদ্ধ পুকুরে ঝপাং ক’রে দে লাফ, আর তুমি…”
সদু আর হাসির তোড় রুখিতে পারিল না, মুখখানা দুই হাতে ঢাকিয়া দুলিয়া দুলিয়া জলে বেশ খানিকটা বীচিভঙ্গ করিয়া হাসিয়া উঠিল। হাসির ছোঁয়াচ আমাকেও স্পর্শ করিল; কিন্তু অত প্রাণ খুলিয়া হাসিবার শক্তি কি সবার হয়? সদু যখন হাসে তখন হাসেই শুধু—আমি যতটা না হাসিতেছি তাহার বেশি হাসি দেখিতেছি, তার চেয়ে বেশি ভাবনা লাগিয়া আছে, কেহ দেখিয়া না ফেলে। সানু আমার মুখের পানে তাহার অবুঝ মুখখানা তুলিয়া হাসিতে লাগিল। সদু হাসিতে হাসিতেই বলিল, “আর তুমি কি করেছ মনে আছে শৈলদা? নেমে পড়ে একেবারে চৌধুরীদের ঐ জলের নালাটার—ভেতরে—হামাগুড়ি দিয়ে—ওঃ!”
সদু আরও ডুকরাইয়া হাসিয়া উঠিল। হাসির চোটে মুখ সিঁদুরবর্ণ হইয়া উঠিয়াছে চক্ষু দিয়া জল গড়াইয়া পড়িতেছে, কোনমতেই যেন সামলাইতে পারিতেছে না নিজেকে। আমি বলিলাম, “থাম, এক্ষুণি। আজও আবার না রতন বাগ্দীর ভাদ্দর বৌ এসে পড়ে।”
সদু চেষ্টা করিয়া নিজেকে থামাইয়া লইল, মুখে এক আঁজলা জল ছড়াইয়া দিয়া হাসির জেরটাকে ঠেলিয়া রাখিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, “আসুক গে, বয়ে গেল।” আবার একটু খুক্ খুক্ করিয়া হাসিয়া উঠিল, তাহার পর নিজেকে সংযত করিয়া লইয়া বলিল, “শৈলদা, আমি দু দিন তোমাদের ওখানে গিয়েছিলাম, বৌ নিশ্চয় বলেছে, বলতে পারবে না যে, দু-দিনের জন্যে এলাম, সদী খোঁজও নিলে না একবার।”
বলিলাম, “কিন্তু সবুর ক’রে তো একটু বসতে পারনি।”
সৌদামিনীর হাসি আবার উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল, তাহার সঙ্গে ভয়ের ভান মিশাইয়া বলিল, “রক্ষে কর, তাহলে ছ-মাস বসে থাকতে হ’ত—কুম্ভকর্ণের ছ-মাস নিদ্ৰা, ছ-মাস জাগরণ।… আমার তো কোন কাজ ছিল না, মাত্র একবার দোষ খণ্ডন ক’রে আসা—কোন সময় বলতে না পার, সদী একবার খোঁজ নিতেও এল না।”
দুইবার কথাটা বলায় নিতান্ত লজ্জিত হইয়াই আমার একটা মিথ্যা বলিতে হইল, কেন না ওর যা অবস্থা তাহাতে আমারই আগে খোঁজ নেওয়া উচিত। বলিলাম, “আমিও তোমার ওখানে যাচ্ছিলাম সদু। আজ বিকেলে একবার যাব বোধ হয়।”
সদুর দীপ্ত মুখখানা যেন ফুৎকারে নিবিয়া গেল। বলিল, “আমার ওখানে কি করতে যাবে শৈলদা?—না, যেয়ো না।”
কলোচ্ছ্বসিত জায়গাতে খানিকক্ষণ একটা থমথমে নিস্তব্ধতা ছাইয়া রহিল। ইহার মধ্যে একবার চাহিয়া দেখিলাম, সদু গামছার একটা প্রাপ্ত কামড়াইয়া ধরিয়া আড়চোখ তুলিয়া আমার পানে চাহিয়া আছে। চোখাচোখির পর আমি দৃষ্টি ফিরাইয়া লইতে বলিল, “দেখছিলাম তুমি রাগ করলে কিনা শৈলদা।”
বলিলাম, “রাগ করার কি আছে এর মধ্যে?”
সদু শরীরটা আরও একটু ডুবাইয়া লইয়া গোটা-দুই কুলকুচি করিয়া বলিল, ‘রাগ করবার নেই—এ কথ শুনব কেন? তুমি যাব বললে, অথচ আমি করলাম মানা! তবে কি জান? এই নিয়ে তোমাদের কেউ দুটো কথা বলে এটা আমার সহ্য হয় না। আমাকে বলে সে আমি গ্রাহ্য করি না—মোটে নয়। যাদের সঙ্গে চিরটাকাল কাটালাম দুঃখে-সুখে, আজ বয়সের ওপর আরও গোটাকতক বছর জুড়ে গেছে বলে তারা আর আমার কেউ হবে না, চিরকাল যেমন হেসে কথা কয়ে এসেছি সেই রকম হেসে কিংবা সোজা মুখ তুলে কথা কইলেই আমার জাত যাবে, এসব কথা আমি বিশ্বাস করি না শৈলদा। অবশ্য জাত যেত যদি তোমরাও বদলাতে, কিন্তু তা বদলাওনি, বদলাবেও না।”
আমি ফিরিয়া চাহিতে উদ্দেশ্যটা বুঝিয়া বলিল, “কি করে জানলাম?—আমার মন বলছে, দেখছিও। আসল কথা সব মানুষ বদলায় না; এই দেখ না, আমি বদলেছি? এমন অবস্থাতে পড়েও বদলাইনি। কি জানি আমার যেন মনে হয় আমি বরাবরই এই রকম থাকব যত যা-ই ঘটুক না কেন।”
আবার এক ঝলক হাসিয়া জলে একটু একটু আঙুল চালাইয়া বলিতে লাগিল, “আমি যখন বদলাইনি, তখন তোমরা কোন্ দুঃখে বদলাতে যাবে শৈলদা? যাক্ কি যে বলছিলাম—হ্যাঁ, আমায় কিছু বললে আমি গায়ে মাখি না, কিন্তু তোমাদের বললে আমার গায়ে লাগে। সেদিন আমরা আসবার পর অনিলদা দেখতে এসেছিল; চলে গেলে ভাগবত-কাকা আমায় শুনিয়ে শুনিয়ে বললে, ‘মার চেয়ে যার টান বড় তারে বলি ডাইন।’… কথাটা আমার যেন শক্তিশেলের মত বাজল শৈলদা। কিন্তু সে কি আমার জন্যেই! আমি তো সেই দিন দুপুরেই তোমাদের ওখানে গেলাম। পাছে ভাগবত-কাকা টের না পায় সেই জন্যে পকেট থেকে চাবির থোলোটা বের করে নিয়ে তাকে গিয়ে বললাম—‘এই তোমার চাবি নাও, কোথায় যে ফেল ভাগবত-কাকা!’ চাবি হাতে ক’রে বললে—‘কোথায় যেন বেরুচ্ছিস তুই এই দুপুর রোদ্দুরে?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, একবার অনিলদার ওখানে যাব।’ আমায় সচরাচর বেশি ঘাঁটাতে সাহস করে না, কিন্তু আস্পদ্দাটার মাথা ছাড়িয়ে যায় দেখে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলে, ‘অনিলদাদা! শুনলাম তোর আর এক দাদাও নাকি এসেছে?’ তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘তোকে ডেকে পাঠিয়েছে নাকি?’ এত বড় কথাটা বলতেও ওর মুখে একটু আটকাল না শৈলদা?”…বলিতে বলিতে সদুর গলাটা একটু গাঢ় হইয়া উঠিল। মুখটা ফিরাইয়া লইয়া নিজেকে সামলাইয়া লইল। তাহার পর বলিল, “আমিও কথা সইবার মেয়ে নই, বললাম, ‘ডাকেনি বলেই তো যাচ্ছি ভাগবত-কাকা, যে দরদ দেখিয়ে ডেকে নেয় না তার কাছে যেতেই তো ভরসা হয়।’ কথাটা গায়ে নিশ্চয় বিষ ছড়িয়ে দিয়ে থাকবে ওর; বললে, ‘আর একটা লোক যে ঘরে এখন-তখন হয়ে রয়েছে, তার সঙ্গে কোন সম্বন্ধ নেই;’…কথাটা এবার আমার গায়ে আগুন ছড়িয়ে দিলে যেন, বললাম, ‘সম্বন্ধ আমার চেয়ে’…”
সদু হঠাৎ নিজেকে সংবৃত করিয়া লইল, কথাটা ঐখানে শেষ করিয়া দিয়া সমস্ত ভঙ্গিটা বদলাইয়া দিয়া বলিল, “এই দেখ! শৈলদা ভাববেন সদু সেই থেকে নিজের কথাই পাঁচ কাহন করছে। সত্যি!… তোমার কথা বল এইবার—কত দিন যে তোমায় দেখিনি শৈলদা—উঃ, তারপর? —শুনলাম বিএ পাশ করেছ—একটা খাওয়া পাওনা আছে।…শৈলদা, খাওয়ানোর কথায়, আমার কি মনে হচ্ছে বলব? রাগ করবে না?”
শরৎ-আকাশের মত কথায় কথায় ভাবের পরিবর্তন, ভঙ্গির পরিবর্তন; আমি ওর মুখের পানে চাহিয়া বলিলাম “কি মনে হচ্ছে?”
“মনে হচ্ছে বলি, ‘শৈলদা পাশ করেছ জামরুল পেড়ে দাও খাই, পেকেছেও কিছু কিছু দেখ না।” বলিয়া আবার খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।
হাসিয়া উত্তর দিলাম, “শক্তই বা কি এমন? বঙ্কাও নেই, দিদিমাও নেই।”
“তবুও পারবে না তুমি, এতক্ষণে একবার সে-সব দিনের মত ‘সদী’ বলে ডাকতে পারলে না যখন…” বলিয়াই এক মুখ জল লইয়া মুখটা অপর দিকে ঘুরাইয়া ধীরে ধীরে কুলকুচি করিতে লাগিল। একটু পরে আবার মুখ ঘুরাইয়া বলিল, “আর শুনলাম বেশ ভাল একটা কাজও পেয়েছ পড়াবার। আরও একটা কথা শুনলাম শৈলদা…”
থামিল বলিয়া ওর মুখের পানে চাহিয়া দেখি কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার পানে চাহিয়া মৃদু মৃদু হাসিতেছে! বহু দিনের পরিচিত একটা চাহনি—ছেলেবেলার কত ইতিহাস যে মনে করাইয়া দেয়…!
সদু বলিল, “যদি নেমন্তন্ত্র না পাই শৈলদা তো…কি ক’রেই বা বলি?—রাজ-কন্যাকে পেয়ে ছোটবেলার কোন এক সদী-বাঁদীর কথা কি —”
আবার হঠাৎ থামিয়া গেল। প্রসঙ্গ, ভঙ্গি এবং উদ্দেশ্য—সবই বদলাইয়া দিয়া বলিল, “তাহলে তুমি এলে না নাইতে তোমার মাসীর কাছে সানু? বেশ, আড়ি তোমার সঙ্গে, আর কখনও জামরুল আর গোলাপ জাম নিয়ে যাব না।”
তাহার পর আমার পানে চাহিয়া বলিল, “এবার তুমি নাইবে এস শৈলদা, আবোল-তাবোল কি সব বললাম, কি মনে করবে জানি না। আসল কথা, তোমাদের দেখলে যেন মনে হয় শৈলদা…না বাপু, তুমি বরং একটু ওদিকে গিয়ে দাঁড়াও, আমি এখান দিয়ে উঠে যাই; ও আ-ঘাটা দিয়ে আর উঠতে পারি না! একে তো অনেকক্ষণ রয়েছি বলে এমনই গা-টা একটু কুট্ কুট্ করছে—কি যে হয়েছে অবস্থা বড়পুকুরের—আহা!”
বলিলাম, “হ্যাঁ, সেই কথা আমি ভাবি। তা তুমি তো স্বচ্ছন্দে গঙ্গায় গেলেই পার সদু। তোমরা তো চাও-ও, তোমাদের ওখানে গঙ্গা নেইও তো শুনেছি!”
সদু একরকম অদ্ভূত নিষ্প্রভ হাসির সহিত আমার পানে চাহিল। বলিল, “চাওয়া? …হাঁ, অন্তত উচিত তো চাওয়া… ঠাকুর-দেবতা! দেখ না ভাগবত-কাকা দু-বেলা ধর্না দেন, সন্ধে-আহ্নিকটি পর্যন্ত গঙ্গার তীরে হওয়া দরকার তাঁর।”
একটু নীরব থাকিয়া বলিল, “কিন্তু আমার কিসের জন্যে ঠাকুর-দেবতার খোশামোদ শৈলদা?”