১৫

সানু সঙ্গে ছিল বলিয়া আসিয়াই নিজে হইতে কথাটা বলিয়া দিলাম, তাহা না হইলে সানু বলিতই; মাঝে পড়িয়া আমি চোর হইয়া যাইতাম। অনিল অম্বুরী দু-জনেই ছিল।

অম্বুরী গ্রামের সুবাদ ধরিয়া একটা ঠাট্টা করিতে ছাড়িল না। মর্মার্থটা এই যে, টানের প্রকারভেদ আছে—গঙ্গার টান—পুণ্যের টানই যে সব সময় শক্তিশালী হইবে এমন কিছুই কথা নাই। তাহার পর বলিল, “না, সত্যিই ভাল হয়েছে ঠাকুরপো, দু-দিন এল অথচ তোমার সঙ্গে দেখা হ’ল না। তুমিও তো চলে যাচ্ছ, ও-ও থাকে না এখানে।…মেয়েটা বড্ড ভাল ঠাকুরপো।”

আবার একটা ঠাট্টা করিল; কি কাজে ধরে যাইতেছিল, ঘুরিয়া বলিল, “আর হ’লও ভাল জায়গাটিতে দেখা? বড়পুকুর তো শুনেছি ছেলেবেলায় তোমাদের কালিন্দী ছিল—তোমার আর ঐ সাধুপুরুষটির।” বলিয়া অনিলের দিকে একটু সহাস্য চটুল দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া চলিয়া গেল।

সন্ধ্যার সময় কথাটা সবিস্তারে অনিলকে বলিলাম। ‘আমি বলিলাম’ বলার চেয়ে অনিল বাহির করিয়া লইল বলাই ঠিক। তবু, অনিল কৌতূহলী না হইলেও তাহাকে বলিব ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলাম, কেন-না-গোপন করিব না—যতই সকালের কথাই ভাবি, সৌদামিনী একটা সমস্যার আকারে আমার সামনে ফুটিয়া ওঠে।

স্কুলের মাঠের শেষে, মজানদীর ধারে আমরা দুইজনে বসিয়া। সন্ধ্যা হইয়া গেল। সন্ধ্যার পূর্ব হইতেই হাওয়াটা থামিয়া গিয়া একটা গুমট পড়িয়াছে। আমাদের মধ্যে সৌদামিনীর কথা কি হয় শুনিবার জন্য সমস্ত জায়গাটা যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করিয়া প্রতীক্ষা করিতেছে।

গল্প যখন শেষ হইল অনিল বলিল, “ভেবেছিলাম তোকে আরও দুটো দিন আগে পাঠিয়ে দিতে পারলেই ভাল হ’ত।”

একটু হাসিয়া বলিলাম, “হঠাৎ?”

অনিল বলি, “নিতান্ত হঠাৎ নয়। মীরা আসবার পর থেকেই কথাটা ভাবছি আমি—মীরার দিক থেকেও, সদুর দিক থেকেও, আর তোর দিক থেকেও। একটা কথা তোকে জিগ্যেস করি—নিশ্চয় নুকুবিনি—তোর কি মনে হয় না যে সদুর দুর্দিনের ঘুর্ণি অনিবার্যভাবে এগিয়ে আসছে, খুব সাবধানে না থাকলে, অর্থাৎ খুব দূরে আর নির্লিপ্ত না থাকলে তুইও তার ঘুরপাকের মধ্যে পড়ে যাবি?—যেতেই হবে পড়ে, তুই যা-ই বলিস্ না কেন। তুই দূর ভবিষ্যতের কথা ছাড়; ‘ডি. গুপ্ত সেবনের পূর্বে ও পরে’-র মত তোর মনের ফটো নেওয়া যদি সম্ভব হ’ত—‘বড়পুকুরে নাওয়ার পূর্বে এবং পরে’–তাহ’লে ফটো দুটো যে সহজেই চেনা যেত আমার এমন মনে হয় না।”

এত গাম্ভীর্যের মধ্যেও হাসি পাইল, বলিলাম, “এত আজগুবী তুলনাও তোর মেলে অনিল!”

অনিল হাসিল না, বলিল, “তুলনা আমার তোদের মত সাহিত্য-সাজানো না হোক, নিখুঁত হয়। অবশ্য এক্ষেত্রে ক্রমটা উল্টে যাবে—ডি. গুপ্ত খাওয়ার আগে কল্প, পরে পালোয়ান, বড়পুকুরে নাওয়ার আগে পালোয়ান, পরে রুগ্ণ। কথাটা অস্বীকার কর্ একবার!”

বলিলাম, “বাড়াবাড়ি হ’য়ে যাচ্ছে শুধু, অর্থাৎ ও-রকম অবস্থায় ছোটবেলার নিত্য-সঙ্গিনী কেউ পড়লে সহানুভূতি না হ’য়েই পারে না। তুই সহানুভূতি জিনিসটাকে অতিরিক্ত গাঢ় রঙে রাঙিয়ে একেবারে অন্য জিনিস ক’রে তুলতে চাইছিস্।”

অনিল বলিল, “আর একটা উপমা না দিয়ে পারলাম না। চোর যখন সিঁদকাঠি নিয়ে যথাপদ্ধতি গৃহস্থের ঘরে ঢোকে তখন ততটা সাংঘাতিক হয় না, যতটা হয় সে যদি অতিথি-অভ্যাগতের বেশে এসে খোঁটা গেড়ে বসে। তুই যদি ভালবাসা বলে চিনতে পারতিস জিনিসটাকে তাহ’লে মীরার দিক দিয়ে বিপদটা কম ছিল, কিন্তু যে ভালবাসাকে ছেলেবেলার সদুর জন্যে সহানুভূতি বলে ভুল করছিস, এইটেই হচ্ছে মারাত্মক। মনে রাখতে হবে আমি সমস্ত কথাই মীরার মুখ চেয়ে বলছি। মীরার কথা বাদ দিলে আমার মত যে কি এ-সম্পর্কে তোকে আগেই বলেছি, তুই চটেও গিয়েছিলি। এখন আবার তোকে উল্টো বলব শৈল, তুই সৌদামিনীর কথা আর একেবারেই ভাবিস্‌নি, ভাবলে মীরার উপর ঘোর অন্যায় হবে। সৌদামিনীর সম্বন্ধে উদাসীন থাকা তোর পক্ষে অপরাধ নয় একটা, কিন্তু কাল যা দেখলাম তাতে মীরার সম্বন্ধে আর অন্য রকম ব্যবহার শুধু অপরাধ নয়, পাপ তোর পক্ষে। মীরা তোকে ভালবাসে শৈল, আর এই ভালবাসার জন্যে সে অনেক কিছু ত্যাগ করতে বসেছে।”

অনিল চুপ করিল এবং ইহার পর অনেকক্ষণ ধরিয়া কেহ আর কোন কথাই বলিলাম না। অনেকক্ষণ। চারিদিক আরও নিস্তব্ধ হইয়া আসিয়াছে, শুধু মজা-নদীর গহ্বর থেকে একটা পোকার একঘেয়ে সংগীত উঠিয়া শব্দের একটা পাতলা কুহেলী বিস্তার করিতেছে।

অনিল হঠাৎ “শৈল!’, বলিয়া এমন উত্তেজিতভাবে আমার হাতটা চাপিয়া ধরিল যে আমি চমকিত হইয়া উঠিলাম। অনিল কখনও উত্তেজিত হয় না; এ এক অভিনব ব্যাপার। বলিল, “শৈল, সব ভুল বলেছি, তাই চুপ ক’রে তলিয়ে দেখবার চেষ্টা করছিলাম। সদুকে বাঁচাতে হবে। আমার উপায় নেই; মাঝখানে অম্বুরী, সানু, খুকী। তুই জানিস্ আমি আমাদের ছেলেবেলার নিত্য সহচরীকে ভুলিনি, তবে আমি ছেলেবেলাতেই বাঁধা পড়ে গিয়ে নিতান্ত নিরুপায়। আমি যা পারলাম না তোকে তাই করতে হবে শৈল; সদুকে ভাগবতের গ্রাস থেকে বাঁচাতেই হবে। ঐটিই তোর জীবনের সব চেয়ে বড় কর্তব্য—এর সামনে মীরার ভালবাসা একটা সৌখীন বিলাস মাত্র। কে বলতে পারে মীরা তোকে সত্যিই ভালবাসে? আর যদি বাসেই তো অঙ্কুরে রয়েছে সে-ভালবাসা এখনও। তোর নিজের মনের অবস্থা তুই নিজেই জানিস্। যদি খুব এগিয়ে গিয়ে থাকিস্ তো কিছু বলতে পারিনে। তা যদি না হয় তো একটা কথা তোকে ভেবে দেখতে হবে—সত্যিই কি মীরা তার ঐ হেরিডিটির গুমর—ঐ বেয়াড়া রকম আভিজাত্যের গর্ব ঠেলে তোকে গ্রহণ করতে পারবে? কাল যে ছুটে এসেছিল এটা খুব বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে এই ভাবটা কি স্থায়ী হতে পারবে ওর জীবনে? যদি কোন সময় অনন্ত ভাবটা মাথা চাড়া দিকে ওঠে তো তোর জীবনটা কি বিষময় হয়ে উঠবে না? সামাজিক স্তরে তোদের দু-জনের প্রভেদটা অত্যন্ত বেশি। ভালবাসা এ প্রভেদ মেটাতে পারে; কিন্তু সে অসাধারণ ভালবাসা! তোদের মধ্যে ঠিক এই জিনিসটা ডেভেলাপ্‌ড হয়েছে বলে অনুভব করিস, শৈল?”

যেন আরও একটু উত্তেজিত হইয়া বলিল, “ধরে নিলাম হয়েছে, তবু তোকে ঘুরতে হবে। জীবনে কত বড় বড় জিনিস ছাড়তে হয়, নিজের হাতে নিজের হৃৎপিণ্ড উপড়ে ফেলতে হয়, সে তো মানুষেই করে? তার জন্যেও তো মানুষে মানুষের দিকেই চেয়ে থাকে? …সদু বসেছে মরতে—মরলেও ছিল ভাল—মরার চেয়ে একটা ভীষণ অবস্থা ওর সামনে, এ সময় একটা হালকা ভাব নিয়ে চুলচেরা বিচার করতে বসা—আমার মাথায় ঠিক আসছে না ব্যাপারটা শৈল। Nero fiddied while Rome burnt,—এটা হচ্ছে যেন তার চেয়েও একটা উৎকট বিলাসিতা।”

একদমে কথাগুলা বলিয়া গিয়া অনিল একটু চুপ করিল। আমি অবশ্য কোন উত্তর দিলাম না; কেন না অনিল আমাকে কোন প্রশ্ন করে নাই, ওর উত্তেজিত কথাগুলা ছিল সেই ধরনের জিনিস যাহাকে ইংরাজীতে Thinking aloud অর্থাৎ শব্দিত চিত্তাবলী।

অনিল অন্ধকারে সম্মুখের পানে চাহিয়া একটু অন্যমনস্কভাবে বসিয়া রহিল। ক্রমে মুখের উত্তেজিত ভাবটা মিলাইয়া আসিল; ধীরে ধীরে শব্দিত চিন্তার ভঙ্গিতেই বলিল, “এদিকেও কি সহজ? আমি যেন বলে গেলাম গড়গড় ক’রে। …বিধবা-বিবাহ, তার মানে নিজের পরিবার, নিজের সমাজ থেকে চিরনির্বাসন। তাও আবার ইচ্ছে করলেই কি হবে?—ভাগবতের দুর্গ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসা সদুকে…”

সহসা উঠিয়া অনিস বলিল, “ওঠ্, যা হবার হবে, আর ভাবতে পারি না।”

পরদিন বিকালে সাঁতরা ছাড়িলাম। জেঠাইমা বলিলেন, “সুবিধে পেলেই আসবি শৈল, তুই এলে অনা বরং ভাল থাকে, না হলে কী যে আকাশ-পাতাল ভাবে সর্বদা? আর বিয়ে-থা কর একটা—যা বুঝি! কেমন যেন নেড়া নেড়া ঠেকে।”

বাইরের উঠানে চৌকাঠের কাছে দাঁড়াইয়া অম্বুরী একটু আর্দ্র কণ্ঠে বলিল, “এত কাছে আছ ঠাকুরপো ইচ্ছে করলেই টুপ ক’রে চলে আসতে পার কিন্তু এমনি ভুলেছ আমাদের যে মনে হয় যেন কত দূরেই যাচ্ছ, কত দিনের জন্যেই না বিদেয় দিতে হচ্ছে।”

সানুকে শিখাইয়া দিল, “বল শৈল কাকা নিশ্চয় আসবে শীগ্‌গির।”

সানু ঝাঁকড়া মাথাটি ঈষৎ হেলাইয়া বলিল, “শৈল টাকা নিশ্চয় ঠেলনা নিয়ে আসবে ঠীগ্‌গির।”

বলিলাম, “সেয়ানা ছেলে তোমার অম্বুরী।”

বিদায়ের বিষয় আকাশে হাসির একটু বিদ্যুৎস্ফুরণ হইল। গাড়ি ছাড়িবার পূর্বে অনিল বলিল, “একটা বোধ হয় দুর্ভাবনা নিয়ে যাচ্ছিস শৈল। কিন্তু উপায় কি? দেখলি তো ভেতরে ভেতরে ও কত ক্লান্ত, কত নির্ভর করে রয়েছে আমাদের ওপর?”