মীরার কাছে ছুটি লইয়া নিজের ঘরে আসিয়া আমার একটা মজার কথা মনে পড়িল—আমি মীরার কাছে ছুটি চাহিতে গিয়াছিলাম কেন? মীরা ছুটি দেওয়ার কে? মীরার মা অবশ্য এসব কথার মধ্যে বিশেষ থাকেন না, কিন্তু মিস্টার রায় তো রহিয়াছেন এখন এখানে। না, আমার নিজেরই দোষ, আমি নিজেই মীরাকে মাথায় তুলিয়াছি। ও হুকুম দিবে তবে আমি যাইব! চমৎকার অবস্থা দাঁড় করাইয়াছি তো!

তরু আসিয়া উপস্থিত হইল। লক্ষ্মী-পাঠশালার শাড়ি ছাড়িয়া লরেটোর জন্য তৈয়ার হইয়াছে—খাটো ইজের, ধ্বধবে সাদা ফ্রক, বাঁ ঘাড়ের কাছে একটা আসমানি রঙের সিল্কের ফুল; এতক্ষণ ঘাড়ের উপর অর্ধ-চক্রাকারে বেড়া-বেণী ছিল, খুলিয়া দিয়াছে, এখন পিঠের দুই প্রান্তে দুইটি স্বরচিত বেণী দুলিতেছে; প্রান্তভাগে চওড়া রাঙা-ফিতার তৈয়ারি ফুল। পায়ে মোজা আর স্ন্যাপ দেওয়া জুতো।

গতিটাও বদলাইয়া গেছে। জুতা ঘষিতে ঘষিতে কতকটা লাফাইতে লাফাইতে আসিয়া বলিল, “দিদি দিলে ছুটি মাস্টারমশাই, কিন্তু আমার পদ্য না লিখে দিলে বলব বন্ধ ক’রে দিতে।”

টাটকা এই চিন্তাই করিতেছিলাম বলিয়া কথাটা অত্যন্ত তিক্ত লাগিল। “তোমার দিদি কি আমার…?” বলিয়া থামিয়া গেলাম। বলিতে যাইতেছিলাম, “তোমার দিদি কি আমার দণ্ড-মুণ্ডের মালিক নাকি যে তিনি ছুটি দিলে তবে আমি যাব?”

ঠিক সময়েই হুঁশ হইল যে, ছেলেমানুষের কাছে মনের ভাব ব্যক্ত করা বড় বেমানান হইবে। হাসিয়া কথাটাকে হাল্কা করিয়া দিয়া বলিলাম, “তোমার দিদি কি তোমার মাস্টারমশায়ের মাস্টারমশাই নাকি যে ছুটি দেবেন আমায়?”

তরু প্রথমটা একটু অপ্রতিভ হইয়া পড়িয়াছিল, আমার মুখের পরিবর্তিত ভাবে আবার আশ্বস্ত হইয়া বলিল, “বাঃ, তবে যে দিদি বললেন–তরু, তোমার মাস্টার-মশাই ছুটি নিয়ে গেছেন, কিন্তু পদ্যটা না লেখা পর্যন্ত ছেড় না যেন?”

আমার মুখটা আবার বোধ হয় একটু গম্ভীর হইয়া গিয়া থাকিবে, আবার সামলাইয়া লইয়া বলিলাম, “আসল জায়গায় ছুটি নেওয়া তো বাকিই আছে, তোমার বাবাকে, তোমার মাকে বলতে হবে না।”

তরু যেন একটু ফাঁপরে পড়িয়াছে, একটা বেণী সামনে ঘুরাইয়া আনিয়া তার ফুলটা লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছিল, সাহস দেওয়ার ভঙ্গিতে আমায় বলিল, “সে আর আপনাকে ভয় করতে হবে না মাস্টারমশাই, দিদি যা বলবেন তা বাবাও কাটবেন না, মা তো নয়ই। দিদির কাছে যখন ছুটি পেয়েছেন, তখন আর আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না।”

আমার কথার ও রকম উল্টা পরিণতি দেখিয়া সত্যই অত্যন্ত হাসি পাইল। হাজার চেষ্টা করিয়াও মীরাকে তাহার কর্ত্রীত্বের আসন থেকে নামাইতে পারিতেছি না, যেন বনেদী হইয়া গিয়াছে। আমি চক্ষু দুইটা বড় করিয়া বলিলাম, “ও বাব্বা! তোমার দিদি এত বড় মহাপুরুষ;—জানতাম না তো আমি। তা বেশ, চল তোমার মার কাছে, বরং বলা যাবে’খন—হাইকোর্টের ছাড়পত্র পেয়েছি, তুমি বরং বেশ সাক্ষীও দিতে পারবে, চল।”

তরু হাসিতে হাসিতে মায়ের কাছে আমার আগমন বার্তা জানাইতে লঘুগতিতে আগাইয়া গেল।

অপর্ণা দেবীর ঘরের সামনে আসিয়া দেখি তিনি ঘরের বাহিরে দাঁড়াইয়া আছেন। উপস্থিত হইতেই ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “তুমিও অগ্রদূত পাঠিয়ে দেখা করতে আসবে শৈলেন? চল, ভেতরে চল।”

নিজে প্রবেশ করিয়া পর্দাটা বাঁ-হাতে তুলিয়া বলিলেন, “এস।”

আমিও পর্দাটা ধরিয়া লজ্জিতভাবে প্রবেশ করিলাম। এই ছোটখাট সৌজন্যে এত অপ্রস্তুত করিয়া দেন উনি। প্রবেশের সময় পর্দা তুলিয়া ধরিবেন, আহারের সময় জলের গেলাসটা বোধ হয় সামান্য একটু দূরে পড়িয়াছে, উঠিয়া আগাইয়া দিয়া আসিবেন, মোটর থেকে যদি আগে নামে, দোরটা টানিয়া ধরিয়া প্রতীক্ষাও করিয়াছেন। অনেকবার বলিয়াছি, কিন্তু ব্যতিক্রম হইবার যো নাই! বলেন, “এগুলো ভদ্রতা বা কার্টসি নয় শৈলেন, এগুলো ছোটখাট সেবা, শিভ্যাল্‌রির নাম নিয়ে আমরা আজকাল তোমাদের কাছ থেকে এগুলো আদায় করছি, কিন্তু আসলে এগুলো আমাদের কাছ থেকে তোমাদের প্রাপ্য।”

আপত্তিস্বরূপ কিছু বলিবার পূর্বে উত্তর পাইয়াছি, “না হ’লে মা বোনের জাত বলে আমাদের গুমোর বাড়াও কেন? আমরা যদি পাই এতে তৃপ্তি …”

হাসিয়া বলিয়াছি, “আমাদের লজ্জা দিয়ে তৃপ্তি পাবেন?”

জবাব পাইয়াছি, “আমরা তৃপ্তি পেলে লজ্জাটা না হয় সয়ে নিলে একটু।”

আর ওঁকে কিছু বলি না।

আমি প্রবেশ করিলে পর্দাটা ছাড়িয়া দিয়া চেয়ার দেখাইয়া বলিলেন, “তুমি বস এইটাতে।”

নিজে টেবিলের সামনে একটা হেলান-চেয়ারে বসিলেন।

প্রসঙ্গের জের ধরিয়া হাসিয়া বলিলাম, “মায়ের কাছে যে নোটিস দিয়ে আসতে হয় না আপনার বুড়ো ছেলে এ-কথাটা জানে, এই সায়েবী কায়দার জন্যে একজন লরেটোর ছাত্রী দায়ী”—বলিয়া সহাতদৃষ্টিতে তরুর দিকে চাহিলাম।

তরু অপর্ণা দেবীর গায়ে হেলান দিয়া দাঁড়াইয়াছিল। অপর্ণা দেবী যে আগ্রহ সহকারে দুই পা বাহিরে গিয়া আমায় লইয়া আসিয়াছেন এটা বোধ হয় ওর খুব মনে ধরিয়াছিল, ওর মাস্টারমশাইয়ের বেশ খাতির হয় এটা ও মনেপ্রাণে চায়। বলিল, “বা রে! আগে থাকতে না বললে মা উঠে এগিয়ে যেতে পারতেন?”

আমি বলিলাম, “তাই তো, বসে বসে কি মা হওয়া চলে? দেখুন তো!”

দু-জনেই হাসিয়া উঠিতে তরু লজ্জিতভাবে মায়ের বুকে মাথা গুঁজিয়া বলিল—“যান্।”

ঘরের মধ্যে আর একটা মানুষ ছিল, সেই ভুটানী। পার্টির দিন সে খানিকক্ষণ গাড়ি-বারান্দায় আসিয়া তামাশা দেখিতেছিল; সেই দিনই লক্ষ্য করিয়াছিলাম তাহার চেহারা আর পোশাক—বিশেষ, পোশাকে পরিবর্তন হইয়াছে। ঘরের একটা কোণের দিকে একটা আরাম-চেয়ারে হেলান দিয়া বসিয়াছিল। হাতে একটা স্ফটিকের মালা, সামনে একটা নীচু টেবিলে পিতলের বেশ একটি মাঝারি সাইজের বুদ্ধমূর্তি। বৃদ্ধা বোধ হয় তন্দ্রাচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছিল, আমাদের হাসির শব্দে নড়িয়া চড়িয়া উঠিতে যাইতেছিল, অপর্ণা দেবী তাড়াতাড়ি গিয়া তাহার বুকে হাত দিয়া বুকের কাছে ঝুঁকিয়া বলিলেন, “বৈঠো ক্যা হায়, বুড়্‌হী মাই?”

বুড়ী বিহ্বলভাবে তাহার ছানিপড়া চক্ষু তুলিয়া অপর্ণা দেবীর মুখের দিকে একটু চাহিয়া রহিল। কি যেন একটা গোলমাল হইয়া গেছে। তাহার পর মাথাটা ডাইনে বাঁয়ে নাড়িয়া কপালের উপরে গোটাকতক টোকা মারিয়া অস্পষ্ট স্বরে বলিল, “না…বেটা, বেটা…”

অপর্ণা দেবী তাহার কপালে বাঁ-হাতটা বুলাইয়া বলিলেন, “বেটা আয়েগা। বুদ্যু বুদ্যু বোলো।”

ভুটানী স্ফটিকের মালাযুদ্ধ হাতটা ধীরে ধীরে আগাইয়া বুদ্ধমূর্তি স্পর্শ করিয়া আবার হাতটা কোলের মধ্যে ঠানিয়া লইয়া মালা জপিতে লাগিল। একটু পরে ধীরে ধীরে দুইটি ধারায় অশ্রু গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। কাঁপা ঠোঁটে খুব অস্পষ্টভাবে কি গোটা কতক দ্রুত উচ্চারণ করিয়া যেন আবেগটা আবার সামলাইয়া লইল।

অপর্ণা দেবী আসিয়া আবার উপবেশন করিলে প্রশ্ন করিলাম, “কেমন আছে আজকাল?”

বলিলেন, “ঠিক বোঝা যাচ্ছেন না। ঐ বুদ্ধমূর্তিটা আনিয়ে দিয়েছি, চেষ্টা করছি মনটা ধর্মের দিকে আকর্ষণ করবার! কতটা কি হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছি না, তবে এইটে লক্ষ্য করেছি, বাইরে বাইরে ততটা উতলা ভাব নেই, চুপ করে জপ নিয়েই থাকে যেন। তবে তন্দ্রাচ্ছন্ন হ’লে পরে কখন কখন ঐ রকম ক’রে ওঠে, বিশেষ ক’রে কারুর পায়ের শব্দে বা অন্য রকম ভাবে যদি টের পায় কেউ ভেতরে এসেছে। এদিক দিয়ে ওর অনুভূতিটা আশ্চর্য রকম তীক্ষ্ণ, প্রায় অসম্ভব রকম। সেটাকে ওর সিকস্থ্ সেন্স বা তৃতীয় নয়ন বলা চলে। এই এত মোটা কার্পেট দিয়েছি ঘরে তো? ও ঠিক টের পাবে কেউ এলে। জেগে থাকলে হঠাৎ একটু সতর্ক হ’য়ে ওঠে, তখনি বুঝতে পেরে আবার কতকটা নিরাশ হ’য়ে মালা জপতে সুরু ক’রে দেয়। কিন্তু যদি তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে তাহ’লেই গোলমাল ঐ যে কপালে হাত দিয়ে ‘বেটা-বেটা’ করলে, এর মানে স্বপ্ন দেখছিল ব্যাটা এসেছে। ঠিক স্বপ্ন বলা যায় না; বাস্তবের দিকের ঐ পায়ের শব্দটুকু নিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন মগজের মধ্যে একটা ধারণা গড়ে ওঠে। বড্ড ব্যাকুল হ’য়ে ওঠে, স্বপ্নের মধ্যে একটা ছবি ফুটে ওঠে কিনা…।”

প্রশ্নটা করিলাম, “মনটা ক্রমে ক্রমে পুরোপুরি ধর্মের দিকে এসে পড়েছে বলে আশা করেন কি?”

প্রশ্নটা আমার করা উচিত হয় নাই। ঠিক এই রকমেরই একটা পরীক্ষা যে তাঁহার নিজের জীবনে চলিতেছে সেটা আমার টের পাওয়া উচিত ছিল। অপর্ণা দেবী জানালার বাহিরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া খানিকটা যেন আত্মস্থ হইয়া রহিলেন, পরে দৃষ্টি ঘুরাইয়া লইয়া বলিলেন, “কি বলছিলে? ও! ঠিক বলতে পারি না, তুমি সাইকলজির ছাত্র, জানই তো মনের গতি বড় অদ্ভুত—যাকে বলা যায় ইন্‌স্ক্রুটেব্‌ল। যখন ভাবা যাচ্ছে বর্হিমুখী হ’য়ে সে কোন একটা জিনিসকে আশ্রয় করেছে, আসলে তখন হয়তো নিজের চিন্তা নিয়ে নিজের অতলে ডুবে যাচ্ছে। ভুটানীর ব্যাপারে যদি তাই হয়তো বড় সাংঘাতিক, তাহ’লে ওর আর বেশি দিন নয়, ও ভেতরে ভেতরে ধ্বসে যাচ্ছে।”

চুপ করিয়া অপর্ণা দেবী চেয়ারটায় হেলিয়া পড়িলেন, যেন বড় বেশি ক্লান্ত এবং বিষণ্ণ হইয়া পড়িয়াছেন। শয়ান অবস্থাতেই ধীরে ধীরে, যেন আপন মনেই বলিলেন, “যাক্, বেঁচে থেকেই বা কি করবে?”

আমার সমস্ত মনটা অনুশোচনায খাক হইয়া গেল,–কি অন্যায়ই করিয়াছি অবুঝের মত প্রশ্ন করিয়া! খানিকক্ষণ নিজেকে বিশ্বাস করিয়া মুখ দিয়া কোন কথাই বাহির করিতে পারিলাম না। ঘরটা নিস্তব্ধ। ভুটানী এক-একবার মালা ঠিক করিয়া লইতে স্ফটিকে স্ফটিকে লাগিয়া এক-একটা কিট্‌ কিট্‌ করিয়া আওয়াজ হইতেছে। তরু ছেলেমানুষ হইলেও কথাটা যে কোথা থেকে কোথায় গিয়া দাঁড়াইয়াছে বুঝিয়াছে যেন। অপর্ণা দেবীর কথায় বলিতে গেলে তাঁহার এ দুর্বলতা সম্বন্ধে বাড়ির সবারই একটা তৃতীয় নয়ন আছে; কাহারও বয়স্থ ছেলে লইয়া কোন কথা উঠিলে অপর্ণা দেবীর সম্বন্ধে সবাই সশঙ্কিত হইয়া ওঠে।

অপর্ণা দেবীই আবার প্রথমে কথা কহিলেন, “মুশকিল হয়েছে ওর ছেলে এখানে নেই শৈলেন। আমি ওঁকে বলে পুলিস সাহেবের সাহায্য নিয়ে ঢের খোঁজ করেছি, যেখানে যেখানে ভুটিয়াদের আড্ডা, ওকে নিয়ে গেছি—ওর ছেলে কলকাতায় আসেনি। আর গরম পড়ে গেছে—নতুন ভুটিয়া আসছেও এ বছর। ওদিকে পুলিশ কমিশনারের আপিস থেকে ভুটান গভর্নমেণ্টকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল, টের পাওয়া গেছে এর ছেলে বাড়িতেও ফিরে যায়নি।… চারিদিকে চেষ্টা করেছি, কিন্তু…”

হঠাৎ একটু উত্তেজিত হইয়া পড়িয়া বলিলেন, “একটা মহাপাতকও করেছি ওর জন্যে শৈলেন, আর কি করব?”

ইচ্ছা ছিল না, তবুও ভাব পরিবর্তনে একটু শঙ্কিত হইয়া প্রশ্ন করিয়া ফেলিলাম, “কি?”

“একদিন একটা ভুটিয়া ছেলেকে দেখেছিলে তো এখানে? না, সেদিন তুমি ছিলে না, আমি তোমার একবার খোঁজ নিয়েছিলাম—তুমি আগে যেখানে টুইশ্যন করতে তাঁদের মেয়ের না ছেলের বিয়েতে সমস্ত দিন সেখানে ছিলে।…সেই ছেলেটাকে বুড়ীর ছেলে বলে বুড়ীকে স্তোক দিয়ে রাখবার চেষ্টা করেছিলাম। বুড়ীর ছেলের নাম, ওদের গাঁয়ের নাম আরও মোটামুটি কিছু খবর যোগাড় ক’রে ছেলেটাকে তালিম দিয়ে দিলাম। ভাল দেখতে পায় না চোখে, সমস্ত দিন বুড়ীর ছেলে পেয়ে সে যে কী আহ্লাদ!—যদি দেখতে!…সন্ধ্যের সময় প্রবঞ্চনাটা ধরা পড়ল। পরে টের পেলাম ওর ছেলে সমস্ত দিন খেলা শিকার—এই সব নিয়ে হুড়োহুড়ি ক’রে বেড়ালেও সন্ধ্যে থেকে একেবারে মাকে ঘিরে থাকত। রাত্তিরে দু-একটা বুড়ীকে মরতে দেখে তার কেমন একটা আতঙ্ক দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, যে-কোন রাত্তিরেই ওর মা ওকে ছেড়ে চলে যেতে পারে। দামাল ছেলে ভয়ে যেন একেবারে অসহায় হ’য়ে থাকত। ছেলের এই শিশুভাবটা ছিল বুড়ীর সম্পত্তি—সব মায়েরই এইটে সবচেয়ে বড় সম্পত্তি, শৈলেন। ভুটিয়া ছেলেটার মধ্যে বুড়ী এইটে না পেয়ে খাঁটি-মেকির তফাতটা ধরে ফেললে। …শৈলেন, এসব পাড়ায় যে হিন্দুস্থানী গয়লারা গরু নিয়ে বাড়ি বাড়ি দুধ দিয়ে যায় দেখেছ?–বাছুর মরে গেলে তার চামড়ার মধ্যে খড় ভরে কাঁখে ক’রে নিয়ে নিয়ে বেড়ায়, মার সামনে সেই কুশ-বাছুর দাঁড় করিয়ে দুধ আদায় করে…”

হাতটা ধীরে ধীরে মুষ্টিবদ্ধ করিয়া মুখটা যেন অসহ্য যন্ত্রণায় কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, “ওঃ! কি অন্যায় করেছিলাম!—পারলাম কি ক’রে বল তো…মা হ’য়ে?”

কী মুশকিলে যে পড়িয়াছি! কি করিয়া বদলাই আলোচনা? বলিলাম, “আপনি মিথ্যে নিজেকে দোষী মনে করেছেন। ভূটানীর সঙ্গে ব্যবহারটা বাইরে দেখতে প্রবঞ্চনা হ’লেও সত্যিই কি প্রবঞ্চনা ছিল? ধরুন, এই তরুকে ছেলেবেলা থেকে কি বরাবরই সত্যি কথা বলে মানুষ ক’রে এসেছেন? সত্যি কথা ধরে বসে থাকলে কি হত মানুষ? আমার তো বিশ্বাস, মায়ের শুদ্ধ মনের জন্যে ভগবানের বিশেষ মার্জনার ব্যবস্থা আছে। শুধু মার্জনার কথা বললে মায়ের প্রবঞ্চনাকে খাটো করা হয়, বরং বলব সেই প্রবঞ্চনার জন্যে বিশেষ পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে।”

অপর্ণা দেবী শান্ত দৃষ্টিতে আমার মুখের পানে চাহিলেন, মুখে একটা প্রসন্ন হাসি ফুটিয়া উঠিল—ঠিক মায়ে যে প্রশ্রয়ের হাসিতে অবোধ শিশুর মুখে ভারিক্কে কথা শুনিয়া তাহার পানে চাহিয়া দেখে।…সত্যই তো, এই প্রতিভাময়ী নারীকে একটা তুলনা দিয়া ভুলাইতে গিয়াছিলাম! লজ্জায় আমার দৃষ্টি যেন আপনি নত হইয়া পড়িল।

যা হউক একটা ভাল হইল। অপর্ণা দেবী বুঝিয়াছেন আমিও ওঁর সঙ্গে অন্তরে অন্তরে বেদনাতুর হইয়া পড়িয়াছি! প্রসঙ্গটা বদলাইবার জন্য ভিতরে ভিতরে ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছি। বলিলেন, “কোন কাজ আছে শৈলেন তোমার? এই জন্যে জিজ্ঞাসা করছি যে, আমি একটু কুনো বলে তরু কখন কখন আমি ডাকছি বলে, মীরাকে, এমন কি ওঁকে পর্যন্ত ডেকে এনেছে। তোমাকেও তেমনই ক’রে ডেকে আনেনি তো?”

তরুকে বুকের কাছে চাপিয়া হাসিয়া আমার পানে চাহিয়া বলিলেন, “আমার মা কি না, তাই মিথ্যে কথা বলে আমার ভাল করবার চেষ্টা করে। ভয় নেই, এ মিথ্যে তোমার শিক্ষা নয়, তুমি আসবার আগে থেকেই ওর এ-বুদ্ধি হয়েছে।”

ঘরের গুমোটটা গিয়া একটা লঘু হাস্যের স্রোত বহিল। আমি বলিলাম, “ নয়ই তো আমার শিক্ষা, ওটা নিতান্ত মায়ের জাতের শিক্ষা, আমার কাছে কি ক’রে পাবে? —আপনি ভিন্ন আর কারুর কাছে পেতেই পারে না ও! মিথ্যের রাংকে সোনায় পরিণত করতে পারে যে পরশমণি, ভগবান মা ভিন্ন আর কারুর হাতে দেননি তো সেটা।”

অপর্ণা দেবী প্রশংসাটা তরুর ঘাড়ে তুলিয়া দিলেন। হাসিয়া বলিলেন, “তোমার-ছাত্রীও একদিন মা হবে, তাকে বড় করতে চাইছ, সুতরাং আর আপাতত প্রতিবাদ করলাম না। … কি দরকার তোমার শৈলেন?”

বলিলাম, “আমি ক’দিনের জন্যে ছুটি নিতে এসেছি।”

অপর্ণা দেবীর মুখের হাসিটা যেন নিভিয়া গেল। আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন, “হঠাৎ ছুটি নিচ্ছ যে, বাড়ি যাবে?”

বলিলাম, “না, বাড়ি যাওয়া এখন হ’য়ে উঠবে না, দিন পাঁচ-ছ’য়ের ছুটি নিয়ে একটু কাছাকাছি থেকে ঘুরে আসব।”

হাসিয়া বলিলাম, “জানেনই তো বাংলা আমার প্রবাসভূমি, সাত-সমুদ্র তের নদী পার হ’য়ে নিজের দেশে যেতে হ’লে অত অল্প ছুটিতে হবার নয়, তাতে গায়ের ব্যথাই মরবার সময় পাওয়া যায় না।”

অপর্ণা দেবী কিন্তু হাসিতে যোগ দিলেন না। যেন কি একটা বলিতে চান, বাধা রহিয়াছে। বাধা বোধ হয় তরু, তাই আমি বলিলাম, “তরু, তোমার বোধ হয় এবার লরেটোয় যাবার সময় হ’ল।”

ঘড়িটার পানে চাহিয়া বলিলাম, “হ্যাঁ, আর দেরী নেই বেশি; খাওয়া হয়েছে তোমার?”

এসব বাড়ির মেয়েরা এ ধরনের ইসারাগুলো বেশ টপ করিয়া বুঝিয়া লয়। শুধু বুঝিয়া লওয়া নয়, তরু খানিকটা মানাইয়া লইবারও চেষ্টা করিল। বলিল, “এখনও একটু দেরী আছে, তেমনি আবার বই-টই গুছিয়েও নিতে হবে তো?”

যাইতে যাইতে দুয়ারের নিকট হইতে ফিরিয়া বলিল, “আমার পদ্য শেষ না ক’রে গেলে কিন্তু চলবে না মাস্টারমশাই, তা বলে দিচ্ছি।”

আমি গম্ভীর হইয়া বলিলাম, “যাতে বিয়েই অচল হ’য়ে যাবে এমন ভুল আমি করতে পারি কখনও? তোমার গুরুমার সঙ্গে আমার কিসের শত্রুতা বল?”

অপর্ণা দেবী একটু হাসিয়া বলিলেন, “বিয়ের প্রীতি-উপহার বুঝি? বলছিল বটে ওর মেজ গুরুমার বিয়ে।”